#তুমি_তাই,১১,১২
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১১
চোখের বাঁধন খুলে দিতেই ঘোলাটে দৃষ্টিতে আশেপাশে চারদিকটা চাইলো রেজা। মাথাটা এখনো ঘুরছে তাঁর। ঘাড়ের কাছে রগ চিনচিন করছে। প্রফেশনাল কিডন্যাপার দিয়ে কিডন্যাপ করানো হয়েছে তাঁকে। রেজোয়ানই করিয়েছে। কিডন্যাপার গাড়িতে তোলার আগে চেতনানাশক স্প্রে করে তাই এতটা সময় ধরে হুঁশ ছিলো না রেজার।
হুঁশ ফিরতেই খেয়াল করলো সামান্য একটা সুতার বস্ত্রও নেই তাঁর গায়ে। সম্পূর্ণ নিরাবরণ সে। সামনের ক্যামেরায় তার অনাবৃত দেহের ভিডিও করছে জাহিদ।
ইশারায় তাঁর মুখের বাঁধনও খুলে দিতে বললো রেজোয়ান। মুখের বাধন খুলে দিতেই সক্রোধে চিৎকার করে উঠলো রেজা। বিশ্রি ভাষায় গালাগাল শুরু করে দিলো জাহিদকে।
তার অবস্থা দেখে রেজোয়ান মৃদু হাসলো। অত্যাধিক ভয়ংকর হাসি। বলা বাহুল্য, এই হাসি যে কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিতে পারে। পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো রেজার।যথাসম্ভব শান্ত থাকার চেষ্টা করলো।
-‘আমাকে কিডন্যাপ করার মানে কি?’
-‘আপনি আমাকে বাধ্য করেছেন। এই ছাড়া আমার হাতে আর কোন উপায় ছিলো না।
ভেবে দেখলাম, আপনাকে একশো কোটি টাকা দেওয়ার চাইতে দুইএককোটি টাকা খরচ করে কিডন্যাপ করাটাই বেশি লাভজনক। তাছাড়া আমার মত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর জন্য একশোকোটি টাকা অ্যাফোর্ড করাটাও অসম্ভব ব্যাপার।’
একেই বলে যেমন কুকুর তেমন মুগুর। হতবম্ভ হয়ে গেলো রেজা। তাঁর হাত থেকে বাঁচার জন্য রেজোয়ান এমন একটা বুদ্ধি বের করবে একথা সে স্বপ্নেও ভাবে নি। তাঁর ধারণা ছিলো রেজোয়ান হয়ত টাকার অংকটা কমানোর জন্য ট্রাই করবে কিন্তু একেবারেই যে দিতে চাইবে না এটা সে ভাবতে পারে নি।
সাধারণত এইসব ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষই চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলে। অত্যাধিক ভয়ে বুদ্ধিভ্রষ্ট হয় অনেকের। কিন্তু রেজোয়ানের ব্যাপারটাকে অন্যরকম ভাবে সামলেছে। খুব স্মুথলি খেলাটা খেলেছে সে।
হতাশায়, ক্রোধে রেজার চোখ দিয়ে আগুন ঝরলো। দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,’কাজটা আপনি একটা ভালো করেন নি মি.মুরসালীন। এর পরিণাম খুব খারাপ হবে, আমাকে এভাবে কিডন্যাপ করে মস্ত বড় ভুল করেছে আপনি। এর ফল আপনাকে ভোগ করতে হবে।’ ইত্যাদি নানারকম হাবিজাবি কথাবার্তা।
রেজোয়ান সেগুলো পাত্তাও দিলো না। তাঁর সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চেয়েছিলো রেজা। এত সহজে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া যায় না। ক্রুর হেসে বললো,’ভিডিও আমার হাতে মি.রেজা আর হুমকি দিচ্ছেন আপনি? ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে না? ইজন্ট ইট উইয়ার্ড?’
-‘এর জন্য আপনাকে পস্তাতে হবে।’
-‘আই ডোন্ট থিংক সো। কারণ আমি চাইলে এইমুহূর্তে আপনার এই অশ্লীল ভিডিও ভাইরাল করে দিতে পারি। এর আর সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না আপনি।’
হুমকি শুনে ভড়কে গেলো রেজা। ভয়ে মুখ শুকিয়ে এলো। সত্যি যদি এই ভিডিও ভাইরাল হয় তবে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে তাঁকে। নরম অনুতপ্ত হয়ে এলো গলার স্বর। রেজোয়ানকে চটিয়ে লাভ হবে না বুঝে গেলো। কাঁদোকাঁদো কন্ঠে অনুনয় করে বললো,’ভুল হয়ে গেছে মি.মুরসালীন। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি সব ছবি ডিলিট করে দেবো। কিন্তু আপনি প্লিজ এই ভিডিও ডিলিট করুন। আমি বলছি আর জীবনেও এমন ভুল হবে না।’
ইশারায় জাহিদকে ভিডিও বন্ধ করতে বললো রেজোয়ান। গলার স্বরে খানিকটা দৃঢ়তা এনে বললো,’ভিডিও এখন ডিলিট হবে না। আগে ছবি ডিলিট হবে তাঁরপর ভিডিও।’
রেজার ভয় কমলো না। তাঁর বুঝতে বাকি নেই এই ভিডিও এত সহজে ডিলিট করবে না রেজোয়ান। এই ভিডিওটাকে কাজে লাগিয়ে যখন খুশি তাঁকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারবে সে। তাই যথাসম্ভব নরম হয়ে কথা বলার চেষ্টা করলো। অত্যাধিক করুণ গলায় বললো,’আমি আপনার কাছে হাতজোড় করছি, ভিডিওটা আমাকে দিয়ে দিন প্লিজ! এটা ভাইরাল হলে আমার মানইজ্জত আর কিছু থাকবে না। দেশ ছেড়ে পালাতে হবে আমাকে। আই স’য়্যার অন মাই মম, আমি ছবি ডিলিট করে দেবো। প্লিজ ক্যামেরাটা আমাকে দিয়ে দিন।’
‘সয়্যার অন মাই মম?’
রেজোয়ান উচ্চশব্দে হাসলো। যে মানুষ শুধুমাত্র টাকার লোভে নির্দ্বিধায় কারো চরিত্রে কালিমা লাগানোর কথা ভাবতে পারে তাঁকে আর যাই হোক বিশ্বাস করা যায় না। তা সে যতই মায়ের দিব্যি দিক না কেন।
রেজা যদি ভেবে থাকে তাঁর এইসব ইমোশনাল কথা শুনে রেজোয়ান তাঁকে ক্যামেরা দিয়ে দেবে তাহলে সে ভুল ভেবেছে। এতটা বোকা রেজোয়ান নয়।
স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলো যতদিন পর্যন্ত না সে পুরোপুরি নিশ্চিত হচ্ছে,রেজা সব ছবি ডিলিট করেছে ততদিন পর্যন্ত এই ভিডিওটাই তাঁর কাছে থাকবে। এটাই তাঁর প্রধান অস্ত্র। রেজার মতন মানুষের শিক্ষা দিতে হলে তাঁদের ভাষাতেই দিতে হবে।
★
রেজার বাসা থেকে কিছুটা দূরে গাড়ি পার্ক করে ওকে নামিতে দিলো রেজোয়ান। যাওয়ার সময় মুচকি হেসে কাঁধে হাত রেখে বললো,’আশা করছি এই ব্যাপারে আর কখনো কথা বলার প্রয়োজন হবে না আমাদের। ছবিগুলো আপনি ডিলিট করে দেবেন। অবশ্যই ছবিগুলো ডিলিট না হলে আমার তেমন কোন ক্ষতি নেই ভিডিওটাও ডিলিট না হলে কি হবে বুঝতে পারছেন? সেগুলো কোথায় কোথায় যাবে এটা নিশ্চয়ই আপনাকে আর বলে দিতে হবে না?
কথা শেষ করে রেজার জবাবের অপেক্ষা না করেই গাড়িতে উঠে গেলো রেজোয়ান। তাঁর কন্ঠে বোধহয় খানিকটা হুমকি ছিলো। ভয় পেলো রেজা। ঘনঘন ঢোক গিললো। রেজোয়ানকে ফাঁসাতে গিয় ভয়ংকর ভাবে ফেসে গেছে সে নিজে। এখন আর কিছুই করার নেই। রেজোয়ান যা বলে তাই শুনতে হবে।
★
কিন্তু পরেরদিন সকালে অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা ঘটে গেলো। রেজোয়ানের অফিসে নিলি এলো দেখা করতে। প্রথমে তাঁকে দেখে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলো না রেজোয়ান। ফরমাল গেটাপে একেবারে অন্যরকম লাগছে নিলিকে। বেশকিছুক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সে। কিন্তু নিলির মেজাজ তিরিক্ষি। তিক্ত কন্ঠে টেবিলে চাপড় মেরে বললো,’মি.রেজোয়ান?কোন সাহসে আপনি মি.রেজাকে কিডন্যাপ করেছেন?’
তাঁর এমন প্রশ্নে অবাক হলো রেজোয়ান। হাঁ করে চেয়ে রইলো নিলির মুখের দিকে। সে ভাবতেই পারে নি রেজার কিডন্যাপের ব্যাপারটা নিলি অব্দি পৌঁছাবে। এবং সেই কৈফিয়ত চাইতে তাঁর অফিসে আসবে নিলি। বিস্ময়ভাব কাটিয়ে শান্ত গলায় বললো,’সেটা জেনে তোমার লাভ?’
-‘উনি আমার বস। আপনি উনাকে এভাবে কিডন্যাপ করতে পারেন না।’
-‘একশোবার পারি। আমার সম্মানে কেউ আঘাত করলে আমি তাঁকে যা খুশি তাই করতে পারি। ওর ভাগ্য ভালো যে ওকে জানে মারি নি।’
-‘এত ঔদ্ধত্য কিসের আপনার হ্যাঁ? নিজেকে কি মনে করেন আপনি? মানুষকে কি মানুষ মনে হয় না?’
-‘মানুষকে মানুষই মনে হয় কিন্তু জানোয়ার কে নয়। ও একটা জানোয়ার। তুমি জানো সে কি করেছে?’
-‘কিচ্ছু জানার দরকার নেই আমার। আমি ভালো করেই জানি আপনি কেন উনাকে কিডন্যাপ করেছেন।’
-‘কেন?’
-‘উনি যেন আমাকে চাকরী ছাড়তে বাধ্য করে তাই।’
এতক্ষণ যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রেখে কথা বলার চেষ্টা করছিলো রেজোয়ান। কিন্তু আর পারলো না। নিলিকে রেজার পক্ষ নিয়ে কথা বলতে দেখে মেজাজ চটে গেলো। তাঁর ওপর রেজার অফিসে চাকরী নিয়েছে শুনে মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেলো। দাঁতেদাঁত চেপে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,’তো?’
-‘তো মানে?’
-‘তো মানে আমি তাঁকে বলেছি তোমাকে চাকরী থেকে ফায়ার করে দিতে। এখন বলো কি সমস্যা! কি করবে তুমি? পুলিশে দেবে আমাকে? জেলে ঢোকাবে! ঢোকাও। দেখি তোমার কত ক্ষমতা।’
অত্যাধিক রাগে বাক্যশূন্য হয়ে গেলো নিলি। হতাশভাবে দুদিকে মাথা দোলালো। স্মিত হেসে বললো,’তোমাকে জেলে ঢোকানোর ক্ষমতা হয়তো আমার নেই রেজোয়ান কিন্তু মনে রেখো কর্মফল বলে একটা কথা আছে। এটা কাউকে ছাড় দেয় না।’
-‘যেমনটা তোমাকে দেয় নি? তাইতো?’, রেজোয়ানের চোখেমুখে তিরস্কার।
-‘আমি কোন অন্যায় করি নি। যা হয়েছে সেটা আমার ভাগ্য ছিলো। এর জন্য আমি কাউকে দায়ী করি না। কিন্তু তুমি যা করছো তাতে করে নিজের ধ্বংস ডেকে আনছো। এতটা ঔদ্ধত্য কিন্তু ভালো নয়। কাউকে বিনা অপরাধে কষ্ট দেওয়া খুবই খারাপ জিনিস। রেজা সাহেব অত্যন্ত ভালো মানুষ। আমার জন্য তুমি উনাকেও কষ্ট দিচ্ছো।’
-‘ভালো মন্দের জ্ঞান অন্তত তোমার কাছ থেকের শেখার কোন আগ্রহ আমার নেই। যার নিজের চরিত্রের ঠিক নেই সে এসেছে অন্যকে জ্ঞান দিতে।’
নিলি ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে পলকহীনভাবে চেয়ে রইলো রেজোয়ানের দিকে। এই মানুষটা একদিন নিজের চাইতেও বেশি ভালোবেসেছিলো তাঁকে। অথচ আজ তার ছিটেফোঁটা পর্যন্ত নেই। চোখজোড়া আর্দ্র হয়ে উঠলো তাঁর। উঠে দাঁড়ালো সে।
-‘রেজা নিশ্চয়ই পার নাইট আমার চাইতে বেশি অফার করেছে? সেইজন্যই তাঁর জন্য এত দরদ?’
থমকে গেলো নিলি। আচমকা রেজোয়ানের বিষাক্ত বাক্যবাণে জর্জরিত হয়ে গেলো সমস্ত শরীর। মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো। দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে রেজোয়ানের কলার চেপে ধরলো সে। কান্নাভেজা গলায় আর্তনাদ করে বললো,’কেন তুমি আমাকে এত কষ্ট দিচ্ছো রেজোয়ান? কেন তুমি বিশ্বাস করতে পারছো না আমি তোমাকে ধোঁকা দেই নি? দেই নি আমি তোমাকে ধোঁকা।’
বলতে বলতেই রেজোয়ানের বুকে এলোপাথাড়ি কিলঘুষি বসালো সে। রেজোয়ান মূর্তির মতন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তাঁর দৃষ্টি ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে আসছে। অসহায়ভাবে তাঁর বুকে লুটিয়ে পড়লো নিলি। বিরতিহীন ক্রন্দনে রেজোয়ানের বুক ভিজিয়ে দিলো সে।
রেজোয়ান ঢোক গিললো। তাঁর ভেতরটা মোমের মত গলতে শুরু করেছে। এতদিনের জমাটবাঁধা সব অনুভূতিগুলো আবার নতুন করে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিতে মন চাইছে ক্রন্দনরত প্রেয়সীকে। কিন্তু তাঁর আত্মসম্মানবোধ, অন্তঃকরণের তীব্র আর্তনাদ, পারিবারিক অসম্মানের কুৎসিত স্মৃতি তাঁকে সেটা করতে দিলো না। নিজেকে দ্রুত সামলে নিলো।
একটা সময় এই মেয়েটাকে ভালোবাসার অপরাধে পুরো মহল্লা ভর্তি লোকজনের সামনে তাঁকে জুতোপেটা করেছিলো তাঁর বাবা। তাঁর অর্থনৈতিক অবস্থা, পারিবারিক স্ট্যাটাস নিয়েও কুৎসিত রকমের গালাগাল করেছিলো। অথচ সেদিন একফোঁটাও প্রতিবাদ করে নি নিলি। ঘরের দরজা বন্ধ করে চুপটি করে লুকিয়ে ছিলো। সত্যিটা অস্বীকার করে সর্বসম্মুখে জোর গলায় বলেছিলো রেজোয়ানের সঙ্গে তাঁর কোন সম্পর্ক নেই। রেজোয়ানকে ভালোবাসে না সে। সেদিনের সেই অপমান, সেই লাঞ্ছনা আজও ভুলতে পারে নি রেজোয়ান।অসহায়ের মত নিজামউদ্দিন সাহেবের পায়ে ধরে কেঁদেছিলো। কিন্তু তাঁর দয়া হয় নি।
পুরোনো স্মৃতি মনে পড়তেই চোখ ছলছল করে উঠলো রেজোয়ানের। চাপা কষ্ট বুকের ভেতরটা গুমোট হয়ে এলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ক্লান্ত গলায় বললো,’আজ থেকে তুমি মুক্ত নিলি। তোমাকে আমি আর বিরক্ত করবো না।’
রেজোয়ানের গলা জড়িয়ে ধরে তখনো কাঁদছিলো নিলি। অবাক দৃষ্টিতে মাথা তুলে চাইলো। তাঁর হাত ছাড়িয়ে নিলো রেজোয়ান। খানিকটা দূরে সরে গিয়ে বললো,’তোমার জীবনে রেজোয়ানের নামের কেউ ছিলো সেটা ভুলে যাও। আজ থেকে আমরা একে অপরের জন্য সম্পূর্ণ অপরিচিত।’
সম্বিত ফিরে পেলো নিলি। রেজোয়ানের কাছে ভালোবাসা ভিক্ষে চাইতে সে আসে নি। এসেছিলো সব যন্ত্রনা থেকে মুক্তি চাইতে। মুক্তি তাঁর ঠিকই মিলেছে কিন্তু যন্ত্রণার অবসান ঘটে নি। বরং বেড়েছে। ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণা আরো একবার, আরো একবার তাঁর সমস্ত হৃদয়টাকে ভেঙেচুরে তছনছ করে দিলো।
চোখ মুছে মলিন হাসলো। ঠোঁট কামড়ে কান্না চাপার চেষ্টা করে বললো,’থ্যাংকস। আশাকরি তুমি তোমার কথা রাখবে। আমার প্রতি কোন রাগ রাখবে না। সে যাইহোক, পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমাকে।’
#তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১২
গাড়িতে একসঙ্গে বসে আছে রেজোয়ান এবং তিন্নি। মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে রেজোয়ান। বেরোনোর সময় শায়লা মুরসালীন বারবার করে বলে দিয়েছেন তিন্নিকে যেন সঙ্গে করে নিয়ে যায়। তিন্নির পরীক্ষা শেষ। কয়েকদিন উনার কাছে থাকবে।
রেজোয়ান আড়চোখে তিন্নির দিকে চাইলো। কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে। খুব একটা তাকাচ্ছে না সামনের দিকে। ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিলো রেজোয়ান।
বাসার কাছাকাছি চলে এসেছে প্রায়। তিন্নি হঠাৎ কান থেকে হেডফোন খুলে বললো,’আপনি কি আমাকে দিয়ে আবার চলে আসবেন?’
-‘সেরকমই তো ইচ্ছে। কিন্তু মা ছাড়বে কিনা সেটাই আসল কথা।’
-‘ও আচ্ছা।’
-‘কেন? তোর কিছু লাগবে?’
-‘হ্যাঁ। আমি আসার সময় আমার ওষুধের বক্সটা ফেলে এসেছি।’
-‘কিসের ওষুধ?’
-‘মাথাব্যথার!’
-‘সেটা তো যেকোন দোকান থেকে কিনে নেওয়া যাবে। নাম মনে আছে ওষুধের?’
-‘আছে।’
-‘তাহলে সমস্যা নেই। আমি বেরোনোর সময় মনে করিয়ে দিলেই চলবে।’
‘আচ্ছা’ বলে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো তিন্নি। অন্যদিনের তুলনায় আজকে একটু চুপচাপ লাগছে ওকে। রেজোয়ান সেটা লক্ষ্য করে বললো,’কি রে। কি হয়েছে তোর? মন খারাপ নাকি?’
-‘অল্প,অল্প।’
রেজোয়ান হেসে ফেললো। ইশারায় জিজ্ঞেস করলো,’কেন?’
-‘আব্বা বলেছে রেজাল্ট ভালো না হলে আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে।’
-‘ভালোই তো? এই জন্য মন খারাপ?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘কেন তুই না বিয়ে করতে চেয়েছিলি?’
-‘হ্যাঁ। চেয়েছিলাম। কিন্তু সমস্যা তো আপনার জন্যই হচ্ছে। আপনি আমাকে বলেছিলেন শিক্ষিত মেয়ে ছাড়া বিয়ে করবেন না।’
রেজোয়ান চুপ করে গেলো। এই মেয়েটাকে এত করে বোঝানোর পরেও সে বারবার একই কাজ করছে। ইচ্ছে করে আগুনে ঝাপ দিতে চাইছে।
বাস্তবিক, তিন্নিকে বড্ড ভালোবাসে রেজোয়ান। কিন্তু তিন্নি যেমন করে চায় তেমন করে নয়। তেমন করে সে কেবল একজনকেই ভালোবেসেছে।
-‘কি হলো? আপনি কথা বলছে না কেন?’
-‘তোর সঙ্গে কথা বলা যায়? বলিস তো সব আবোলতাবোল কথাবার্তা। কতদিন নিষেধ করেছি আমার সামনে এই ধরনের কথাবার্তা বলবি না তবুও কেন বলিস?’
-‘ভালো লাগে। আপনাকে রাগাতে আমার ভালো লাগে।’
-‘তুই আমাকে রাগানোর জন্য ইচ্ছে করে এসব বলিস?’
-‘হ্যাঁ। কিন্তু সত্যি বলি।’
রেজোয়ান দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তিন্নি কেন এত অবুঝ? কেন বুঝতে চাইছে না সে যা চাইছে তা অসম্ভব।
মাঝেমাঝে তিন্নির জন্য ভীষণ ভয় হয় রেজোয়ানের। ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণা এই বাচ্চা মেয়েটা সহ্য করতে পারবে তো?
এই যন্ত্রণা বড়ই ভয়ানক! সারাজীবন বুকে পাথর চাপা দিয়ে বয়ে বেড়াতে হয়। সে ভেবেছিলো তিন্নি বড় হলে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তাঁর ধারণা ভুল। দিনদিন মেয়েটার পাগলামি বাড়ছে।
★
মায়ের সঙ্গে কথা কাটাকাটি চলছে রেজোয়ানের। কোন এক গোপন মারফতে নিলির ফিরে আসার খবরটা শায়লা মুরসালীন এর কানে গেছে। সেই নিয়েই রেজোয়ানের ওপর খেপেছেন তিনি। রেজোয়ানকে এবার বিয়ে জন্যে চাপাচাপি করছেন। হুমকিও দিয়েছেন রেজোয়ান যদি বিয়ে করতে রাজি না হয় তবে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন তিনি।
রেজোয়ানের মুখ থমথমে। মায়ের কথাটা সে মানতে রাজি নয়। আবার শক্ত ভাবে প্রতিবাদও করতে পারছে না। পাছে তিনি দুঃখ পান।
-‘আমার কথার কোন মূল্য নেই তোর কাছে। এইজন্য তোকে আমি কষ্ট করে মানুষ করেছি? বয়স হয়ে গেলে আসলে মাবাবার কোন দাম থাকে না!’ কেঁদে ফেললেন শায়লা মুরসালীন। রেজোয়ানের তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। হাত ধরতে গেলেই উনি ঝাড়া মেরে সরিয়ে দিয়ে বললো,’খরবদার রেজোয়ান আমি বারবার করে বলে রাখছি তুই ঐ মেয়েটার সঙ্গে কোনরকম সম্পর্ক রাখবি না। তাহলে কিন্তু মহা ঝামেলা হবে তোর সঙ্গে আমার। আমি যদি শুনেছি তুই ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিস তাহলে কিন্তু আমি বাড়ি ছেড়ে
তোর ছোটবোন কে নিয়ে নিরুদ্দেশ হবো।’
-‘মা প্লিজ।’
-‘মা প্লিজ বলে কোন লাভ হবে না। আমি জাহিদকেও বলে দিয়েছি ঐ মেয়েকে যেন আমার ছেলের আশেপাশেও না দেখা যায়। নির্লজ্জ, বেহায়া মেয়ে কোথাকার। নিজের সব ধ্বংস করে এখন আমার ছেলের পেছনে পড়েছে।’
-‘তুমি ভুল করছো মা। ও নিজে থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার কোন চেষ্টা করে নি। চাকরীর ইন্টার্ভিউ দিতে এসেছিলো কেবল।’
-‘তুই একদম আমার সামনে ঐ মেয়ের হয়ে সাফাই গাইবি না। কেন দিয়েছিস অফিসে চাকরী? এতকিছুর পরেও তোর শিক্ষা হয় নি? লজ্জাবোধ নেই তোর?’
-‘আমার রাগ, জেদ এসবের জন্য বিনাদোষে ওকে জেলে যেতে হয়েছিলো মা।’
-‘বেশ হয়েছে। বের করলো কে? তুই?’
রেজোয়ান জবাব দিলো না। শায়লা মুরসালীনের সঙ্গে এখন স্বাভাবিক কোন কথাবার্তাই বলা যাবে না। রাগে অন্ধ হয়ে আছেন তিনি। একটা সময় রেজোয়ানও ছিলো। কিন্তু এখন সে জানে তাঁকে বাঁচানোর জন্যই বাধ্য হয়ে মুবিনকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলো নিলি। রাগের মাথায় প্রথমে বুঝতে না পারলেও এখন ঠিকই বুঝতে পারছে। সত্যিই তো? মুবিনের বাবার ক্ষমতার সঙ্গে কি পেরে উঠতো রেজোয়ান? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো।
-‘মা প্লিজ একটু শান্ত হও। তোমার প্রেসার হাই হয়ে যাবে।’
-‘যাক। যার ছেলের কাছে মায়ের কথার কোন মূল্য নেই তাঁর আর বেঁচে থেকে কি লাভ! আমার তো মরে যাওয়াই ভালো।’
রেজোয়ান ব্যস্ত হয়ে চেয়ার ছেড়ে মায়ের বিছানার পাশে এসে বসলো। তাঁর হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,’এভাবে বলো না মা। তুমি তো জানো আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি? আমার কাছে তোমার চাইতে বেশি মূল্যবান আর কেউ নয়। কিন্তু আমার কথাটা শোনো প্লিজ। নিলি আমাকে বাঁচানোর জন্যই মুবিনকে বিয়ে করেছিলো। ওর বাবা আর ভাই বাধ্য করেছিলো ওকে।’
-‘আবার? আবার তুই ঐ মেয়ের হয়ে আমার সামনে
কথা বলছিস? যা সর আমার সামনে থেকে!’
-‘আচ্ছা যাচ্ছি। কিন্তু তুমি শুধু আমাকে একটা কথা বলো। এত সবকিছুর মাঝে ওর দোষটা কোথায়? স্বামীর বাড়িতেও অত্যাচার সহ্য করতে হলো, আমিও ভুল বুঝলাম, অসুস্থ বাবা সংসারের বোঝাও কাধে নিলো। একটা মেয়ে কেন বিনাদোষে এত শাস্তি পাবে মা? তাঁর তো এত কষ্ট পাওয়ার কথা ছিলো না?’
-‘সেসব আমার জানার দরকার নেই। খুব বেশি হলে তাঁকে আমি টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করবো। কিন্তু ঐ মেয়ের সঙ্গে তুই কোন সম্পর্ক রাখতে পারবি না ব্যস।’
-‘কেন সবাই ওকেই ছোট করে মা?’, রেজোয়ান যেন নিজেকে নিজেই প্রশ্নটা করলো।
চোখ বড়বড় করে ছেলের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন শায়লা মুরসালীন। ডুঁকরে উঠে বললেন,’ঐ মেয়ে তোর মাথা খেয়ে নিয়েছে। তুই এখন আর মায়ের দুঃখ বুঝতে চাইছিস না।’
-‘ও আমাকে কিচ্ছু বলে নি।’
-‘আলবাত বলেছে। নইলে এতদিন বাদে তোর মুখ দিয়ে এসব বেরোবে কেন? তুই তিন্নির কথাটা একবার ভাববি না? ঐ মেয়েটা কি দোষ করেছে?’
তিন্নির কথা উঠতেই রেজোয়ানের মনটা নরম হয়ে গেলো। কোথাও না কোথাও তো তিন্নিও জড়িয়ে আছে তাঁর সিদ্ধান্তের সঙ্গে। তাই মনে মনে চিন্তিত বোধ করলো। তিন্নি কি আদৌ সহ্য করতে পারবে? পারবে না। ভীষণ ইমোশনাল আর একরোখা মেয়ে। যদি উল্টোপাল্টা কিছু করে বসে?
তিন্নির প্রতি রেজোয়ানের একটা সফট কর্নার আছে সেটা শায়লা মুরসালীন আগে থেকেই জানেন। সেই সুযোগটাই কাজে লাগালেন তিনি। নরম, মোলায়েম কন্ঠে বললেন,’মেয়েটা তোকে ভালোবাসে রেজোয়ান। তুই ওকে কষ্ট দিস না। ওকে নিয়ে নতুন করে শুরু কর। দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।’
জবাব না দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো রেজোয়ান। উভয়সংকটে পড়েছে সে। এর থেকে মুক্তির উপায় কি তাও বুঝতে পারছে না।