#তুমি_তাই,২০,২১
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২০
যাত্রীদের প্লেনে উঠার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। রেজোয়ান বারবার জাহিদের নাম্বারে ট্রাই করছে। নাম্বার আনরিচেবল। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। এইসময়ে জাহিদের ফোন কিছুতেই বন্ধ থাকার কথা নয়। রেজোয়ানের চিন্তায় হচ্ছে। নিশ্চয়ই কোন ঝামেলায় আটকে গেছে জাহিদ। আরো কয়েকবার ট্রাই করলো। এবার রিং হলো কিন্তু কেউ রিসিভ করলো না।
মাথা থেকে দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে আস্তে আস্তে প্লেনে উঠার প্রস্তুতি নিলো সে। মিনিট খানেক বাদে জাহিদ নিজেই কল ব্যাক করলো। রেজোয়ান ফোন রিসিভ করে সর্বপ্রথম তাঁর অবস্থানের কথা জানতে চাইলো,’হ্যাঁ জাহিদ। কোথায় তুমি? তোমার ফোন বন্ধ কেন? আধঘণ্টার মাঝে প্লেইন টেইক অফ করবে।’
-‘একটা খারাপ খবর আছে স্যার।’ ওপাশ থেকে জাহিদের উদ্বিগ্ন ককন্ঠস্বর শোনা গেলো। রেজোয়ান এমনিতেই টেনশনে ছিলো। তারওপর খারাপ খবরের কথা শুনে ধৈর্য রাখতে পারলো না। কিঞ্চিৎ গলা চড়িয়ে বললো,’কি?’
-‘নিলি ম্যাম অ্যাক্সিডেন্ট করে হস্পিটালাইজ। সারভাইব করার চান্স খুবই কম। অ্যাক্সিডেন্টের খবর শুনে মি.রেজা পালিয়েছে। স্থানীয়রা একটা সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেছে উনাকে। কিন্তু এখানে আইসিইউ, বেড, কেবিন কিছুই খালি নেই। তাই বাধ্য হয়ে বারান্দায় রাখা হয়েছে। ডাক্তাররা বলছে এক্ষুনি যদি আই সি ইউর ব্যবস্থা না করা হয় তবে খুব তাড়াতাড়ি কোন অঘটন ঘটে যাবে।
রেজোয়ানের হাতে ফাইল পত্র,কাগজ যা কিছু ছিলো সব মাটিতে পড়ে গেলো। শূন্য, ভোঁতা দৃষ্টিতে শায়লা মুরসালীনের মুখের দিকে চেয়ে রইলো সে। ক্রমশ দৃষ্টি ঝাপ্সা হয়ে আসছে তাঁর। মস্তিষ্ক ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। শায়লা মুরসালীন ছেলের অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেলেন। রক্তশূন্য ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে রেজোয়ানকে।চাদর দিয়ে তাঁর মুখমন্ডলের ঘাম মুছে দিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,’কি হয়েছে বাবা? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’
-‘মা জাহিদ কি বলছে এসব?’ বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো রেজোয়ান। শায়লা মুরসালীন এবার আরো বেশি ঘাবড়ে গেলেন। আতংকিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,’কি বলছে?’
-‘নিলি অ্যাক্সিডেন্ট করে হস্পিটালে ভর্তি মা। বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। আমি এখন কি করবো মা!’
রেজোয়ানের পাগলের মত অস্থির আচরণ করছে। কান্নার বেগ ক্রমশ বাড়ছে তাঁর। আশেপাশে সবাই হাঁ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। শায়লা মুরসালীন রেজোয়ানের হাত থেকে ফোন নিয়ে নিজে জাহিদের সঙ্গে কথা বললেন,’কন্ডিশন কেমন জাহিদ? বাঁচবে?’
-‘ভালো না ম্যাম। যে কোন সময় অঘটন ঘটে যেতে পারে। জরুরি ভিত্তিতে আই সি ইউতে শিফট করা প্রয়োজন।’
-‘ব্যবস্থা করো। আমরা আসছি।’
ফোন রেখে ছেলের হাত ধরে উঠে দাঁড়ালেন শায়লা মুরসালীন। ধমক দিয়ে বললেন,’কান্নাকাটি পরে হবে। আগে হস্পিটালে চল।’
রেজোয়ান কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না। যার জন্য সে এতগুলো দিন অসহ্য বেদনায় দিন কাটিয়েছে, এত আত্মত্যাগ করেছে, দেশ ছেড়ে পর্যন্ত পালিয়ে যাচ্ছে সে আজ দুনিয়া ছেড়ে পালানোর পায়তারা করছে। নিজেকে কি করে স্থির রাখবে রেজোয়ান। শায়লা মুরসালীন একপ্রকার টেনে ছেলেকে বের করে নিয়ে গেলেন।
★
নিলির কন্ডিশন খুব একটা ভালো নয়। ব্রেনে মারাত্মক আঘাত লেগেছে। মেজর অপারেশন করানো লাগবে। বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। পরিস্থিতি আউট অফ কন্ট্রোল দেখে রেজা সটকে পড়েছে। এতদিন রেজোয়ানকে শায়েস্তা করার জন্য নিলিকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলো সে। নিজামউদ্দিন সাহেবের চিকিৎসার সব দায়ভারও নেবে বলেছিলো। কিন্তু এখন যখন সেটা হচ্ছে না তখন আর নিলিকে দিয়ে তাঁর কোন কাজ নেই। উপরন্তু রেজোয়ানও সব ছেড়েছুড়ে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। অতএব এই উটকো ঝামেলার মরা বাঁচাতে তাঁর কিছু আসে যায় না।
রেজোয়ান রিসেপশনে টাকা জমা দিয়ে আই সি ইউর বাইরে বসে আছে। আজই অপারেশন করা হবে নিলির। যাবতীয় ফর্মালিটিজ সব জাহিদ পালন করছে।
শায়লা মুরসালীন এই প্রথম স্নেহের দৃষ্টিতে ছেলের মুখের দিকে চাইলেন। দুহাতে মুখ চেপে ধরে নিঃশব্দে কাঁদছে তাঁর আদরের ছেলেটা। চোখের পানি হাতের গাল ভিজে যাচ্ছে।
রিসেপশনের কাজ শেষ করে ফিরে এলো জাহিদ। রেজোয়ানকে উদ্দেশ্য করে নরম গলায় বললো,’আপনি টেনশন করবেন না স্যার। উনার কিচ্ছু হবে না।’
বাচ্চা শিশুর মত ফুঁপিয়ে উঠলো রেজোয়ান। চোখের সামনে নিলির এমন করুণ অবস্থা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না সে। তাঁর আসার আগে হস্পিটালের বারান্দায় পড়ে ছিলো নিলি। জাহিদ ছাড়া সঙ্গে কেউ ছিলো না। একটা লোক ছিলো না আফসোস করার মতন। রেজোয়ানের পূর্বের সব অভিমান ভুলিয়ে দিলো নিলির অসহায় অচেতন মুখ। বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইলো হৃদপিন্ডটা। শত চেষ্টা করেও নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না সে। ছুটে গিয়ে নিলিকে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে চাইছে,’অভিমান আমার করার কথা ছিলো হৃদয়হীনা নিষ্ঠুর, তোমার নয়। তুমি কেন আমাকে বারবার কষ্ট দিচ্ছো? কেন তুমি আমার ভালোবাসা বুঝতে পারো না।’
শায়লা মুরসালীন ছেলের মাথায় হাত রাখলেন। আঁচল দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিলেন। অশ্রুসজল, করুণ মুখে মায়ের দিকে চাইলো রেজোয়ান। ঠোঁট কাঁপছে তাঁর। চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে। বাচ্চা ছেলেটির মতন তাঁর মাথা বুকে টেনে নিলেন শায়লা মুরসালীন। মাথা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,’পুরুষ মানুষ এত ভেঙ্গে পড়লে চলে না। পুরুষ মানুষকে শক্ত হাতে সকল পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়।আল্লাহ ভরসা। ধৈর্য রাখ।
রেজোয়ান ফের কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। মায়ের হাত দুটো চেপে ধরে বললো,’ওকে তুমি বদদোয়া দিও না মা। ও বেঁচে থাকলেই আমি খুশি। ওর কাছে যাবো না। কথা দিচ্ছি তোমাকে।’
শায়লা মুরসালীন ছেলের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তেমন কোন কঠোর মনোভাব দেখালেন না। রেজোয়ান মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। এইমুহূর্তে মা হিসেবে উনার ছেলের পাশে থাকা দরকার। ছেলেকে আশ্বস্ত করে বললেন,’এসব কথা এখন থাক। আমি চাই সে বাঁচুক। অন্যের সন্তানের মৃত্য কামনা করা কোন মায়ের পক্ষেই সম্ভব নয়।
★
নয়ঘন্টা যাবত অস্ত্রপাচার শেষে ওটি থেকে বের করা হলো নিলিকে। মাথা, হাতে, পায়ে গলায় ব্যান্ডেজ। অচেতন অবস্থায় আই সি ইউর বেডে পড়ে আছে তাঁর নিথর দেহ। রেজোয়ান গ্লাসের ফাঁক দিয়ে চাইলো। চোখের পানি আজকে বাধ মানছে তাঁর। সারাজীবন এই মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছে। সবাই তাঁকে ঠকিয়েছে। কখনো রেজোয়ানকে বাঁচাতে গিয়ে ঠকেছে কখনো বা নিজেকে সুখি করতে গিয়ে। কিন্তু ঠকেছে। সুখের দেখা একমুহূর্তের জন্যেও পায় নি। হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছলো রেজোয়ান। শায়লা মুরসালীনকে উদ্দেশ্য করে বললো,’তুমি মামার বাসায় চলে যাও মা। গিয়ে রেস্ট নাও। আমি হস্পিটালে থাকি।’
-‘কিন্তু ওর জ্ঞান তো এখনো ফেরেনি। তাছাড়া ওর বাবাকেও খবর দেওয়া হয় নি।’
-‘উনি আজ বারোদিন যাবত হস্পিটালে ভর্তি। হুঁশ নেই। ডাক্তাররা অক্সিজেন দিয়ে রেখেছে।’
-‘বলিস কি?’
-‘হ্যাঁ। জাহিদ নিলির বাসায় গেছিলো খবর জানাতে। সেখানে ওর প্রতিবেশিরা বললো নিলির বাবা আজকে বারোদিন যাবত অচেতন।’
শায়লা মুরসালীন কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। নারীহৃদয় স্বভাবতই কোমল। তাঁর ওপর নিলির এমন দুর্দশার কথা শুনে বিগলিত হয়ে গেলেন। আফসোসের সুরে বললেন,’লোকটা নিজেও শান্তিতে রইলো না মেয়েটাকেও শান্তিতে থাকতে দিলো না।’
রেজোয়ান জবাব দিলো না। নিলির এমন পরিস্থিতির জন্য সে ঠিক কাকে দোষ দিবে বুঝতে পারছে না। সে নিজেও তো দোষী। চাকরীতে জয়েন করার পর থেকে কম অত্যাচার তো করে নি নিলির ওপর। বাধ্য হয়ে মেয়েটা চাকরী ছেড়ে দিয়েছে। এতকিছুর পর রেজোয়ান নিলিকে কি করে একতরফা দোষ দেয়?
#তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২১
বারো ঘন্টা বাদে নিলির জ্ঞান ফিরেছে। ডাক্তাররা টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স অবজারভেশনে রাখছেন। এখন যদিও শংকামুক্ত সে। তবে ডাক্তার জানিয়েছেন এতবড় একটা অপারেশন এর পর এক্সট্রা সিকিউরিটির জন্যে হলেও আরো কিছু হস্পিটালে থাকতে হবে নিলিকে।
জ্ঞান ফেরার পর জাহিদই প্রথম দেখা করতে গেলো নিলির সঙ্গে। রেজোয়ানের কেবিনের বাইরে বারান্দায় বসে ছিলো। জাহিদ দেখা করে এলে উদ্বিগ্ন মুখে নিলির অবস্থার কথা জানতে চাইলো সে। জাহিদ বিস্তারিত সব খুলে বললো। সব শুনে রেজোয়ান স্বস্তি পেলো।
তাঁকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জাহিদ কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন করলো,’আপনি দেখা করবেন না স্যার?’
-‘না।’
রেজোয়ানের এমন উত্তর জাহিদকে অবাক করেছে। অপারেশনের পর থেকে নিলির জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত রেজোয়ান ঠায় বসে ছিলো হস্পিটালের বারান্দায়। একমুহূর্তের জন্যেও এদিক ওদিক হয় নি। এখন বলছে দেখা করবে না? এ কেমন অভিমান? মনে মনে দুঃখবোধ করলো জাহিদ। কিন্তু এই দুঃখবোধটা ঠিক কার জন্য সে নিজেও বুঝতে পারছে না। নিলির জন্য নাকি রেজয়ানের জন্য?
রেজোয়ান উঠে দাঁড়ালো। হস্পিটাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় জাহিদকে উদ্দেশ্য করে বললো,’টাকা পয়সা যা লাগে খরচ করবে। কিন্তু ট্রিটমেন্ট এর যেন কোন ঘাটতি না হয়।’
রেজয়ান বেরিয়ে গেছে। জাহিদ হতাশভাবে মাথা দোলালো। মনে হচ্ছে ছ্যাঁকাটা নিলি নয় সে নিজেই খেয়েছে। এই অদ্ভুত ভালবাসার কোন কূলকিনারা সে খুঁজে বের করতে পারছে না।
★
শায়লা মুরসালীনের হাতে প্লেনের টিকেট। এইমাত্র রেজোয়ান এসে দিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় বলে শায়লা মুরসালীনকে উদ্দেশ্য করে বলেছে,’আজকের সন্ধ্যা ছটায় আমাদের ফ্লাইট মা। তুমি রেডি থেকো। আমার একটা কাজ আছে। সেটা সেরে আসি।’
শায়লা মুরসালীন অবাক হলেন। এত ঘটনা হয়ে যাওয়ার পর রেজোয়ান নিজে থেকে দেশ ছাড়তে রাজি হবে এটা তিনি ভাবতে পারেন নি। ভেবেছিলেন এবার রেজোয়ানকে নিলির কাছ থেকে সরানো অসম্ভব। মনে মনে সেটা নিয়ে দুঃখবোধও করছিলেন। কিন্তু রেজোয়ান তাঁর ধারণা কে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে নিজে গিয়ে টিকেট কেটে এনেছে। আসল ঘটনা কি সেটা জানার জন্য জাহিদের কাছে ফোন করলেন। জাহিদ জানালো সে বলতে পারবে না। রেজোয়ান হস্পিটালেও নিলির সঙ্গে দেখা করে নি। সব শুনে শায়লা মুরসালীন চিন্তায় পড়ে গেলেন! রেজোয়ানের হঠাৎ হলো টা কি! সে কি সত্যিই কানাডা যাবে নাকি প্ল্যান করে শায়লা মুরসালীনকে পাঠিয়ে দিতে চাইছে?
★
দুদিন পরের ঘটনা,
নিলি এখন সম্পূর্ণ সচেতন। কথাবার্তা বলতে পারে। জাহিদ সর্বক্ষণ ওর আশেপাশেই আছে। জ্ঞান ফিরতেই নিলি তাঁকে দেখে মলিন হাসলো। ক্ষীণস্বরে বললো,’এবারেও মরলাম না জাহিদ ভাই।’
-‘কেমন লাগছে এখন? মাথায় পেইন আছে?’
-‘না।’ দুদিকে মাথা নাড়ালো নিলি।
জাহিদ ব্যাগ থেকে একটা হলুদ ফাইল বের করে নিলি দিকে এগিয়ে দিলো। নিলি ভ্রু কুঁচকালো। ইশারায় জিজ্ঞেস করলো,’ কি এটা?’
-‘খুলে দেখুন।’
খুললো নিলি। ভেতরে ফ্ল্যাটের কাগজপত্র! রেজোয়ানের নামে কেনা ফ্ল্যাটটা নিলির নামে ট্রান্সফার করে দিয়ে গেছে সে!
নিলি অবাক হলো। হতবিহ্বল চেহারা নিয়ে জাহিদের দিকে চেয়ে রইলো। জাহিদ মুচকি হেসে বললো,’স্যার একেবারে পাকাপোক্তভাবে দলিল করে দিয়ে গেছে ম্যাম। কারো বাবার ক্ষমতা নেই এখানে হাত লাগায়।’
নিলি বিমূঢ়, অশ্রুসজল চোখে ফাইলটার দিকে নিনির্মেষ চেয়ে রইলো। অসহনীয় যন্ত্রনায় শরীর বিবশ হয়ে আসছে তাঁর। নিদারুণ মর্মপীড়ায় বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে আসছে। জ্ঞান ফেরার পর থেকে একবারও রেজোয়ানের দেখা পায় নি সে। জাহিদের কাছে শুনেছে রেজোয়ানই অপারেশনের সব ব্যবস্থা করেছে। এখন আবার এই ফ্ল্যাটের কাগজপত্র।
নিলি কিছুতেই নিজের মনকে শান্ত রাখতে পারছে না। বারবার মনে হচ্ছে রেজোয়ানের সঙ্গে অন্তত একবারটার দেখা করতে পারলে অনুতাপের বোঝাটা কিছুটা হলেও হালকা হতো। রুগ্ন গলায় বললো,’আপনার স্যার হস্পিটালে আসেন না জাহিদ ভাই?’
-‘অপারেশনের দিন ছিলো।’
-‘এরপর আর আসেন নি?’
-‘স্যার এখানে নেই ম্যাম। মঙ্গলবার সন্ধার ফ্লাইটে ঢাকা ছেড়েছেন। যাওয়ার সময় আমাকে বলে গিয়েছেন আপনার খেয়াল রাখতে। বলেছেন আপনি যদি মি.রেজার নামে কোন ধরনের মামলা করতে চান তাহলে আমি যেন আপনাকে সাহায্য করি। টাকা পয়সার ঝামেলা স্যার সামলে নেবে।’
নিলির মস্তিষ্ক এবার ফাঁকা হয়ে গেলো। জাহিদের কথাগুলোর ঠিক কি রিয়েকশন দেবে বুঝে উঠতে পারলো না। শূন্য দৃষ্টিতে জাহিদের মুখের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষন। চোখের পানি গলগল বেরিয়ে পড়লো। এত কষ্ট, এত গ্লানি নিয়ে সে কেন বেঁচে আছে? রোজ এত মানুষ মরে, সে কেন মরে না! কেন নিলি যেই ডাল আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায় সেই ডালই ভেঙ্গে পড়ে?
এত লজ্জা নিয়ে বেঁচে থাকার চাইতে তো মরে যাওয়াই ভালো! যাকে সে নিজের ভালোবাসার মানুষের চাইতে বেশি বিশ্বাস করেছে, বন্ধুর মর্যাদা দিয়েছে, সে-ই তাঁকে অসহায় অবস্থায় ফেলে চোরের মত পালিয়ে গেলো! নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে নিলির। অসম্ভব ঘৃণা হচ্ছে। তাঁর ঠাঁই কোথাও নেই। চোখের পানি মুছে নিজেকে স্থির করে নিলো। তারপর ম্লান হেসে বললো,’আপনার স্যার আমার জন্য যা করেছেন তার জন্য আমি সারাজীবন তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো জাহিদ ভাই। উনাকে বলবেন নিলি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। আর আমি মি.রেজার নামে কোন মামলা করবো না। যদি সম্ভব হয় আপনি একবার আমাকে বাবার কাছে নিয়ে চলুন।’
জাহিদ মনে মনে বিরক্ত হলো। এই সুযোগ ছিলো রেজাকে আচ্ছামত শায়েস্তা করার। নিলি মামলা করতে রাজি হলে রেজোয়ান কিছুতেই ওকে ছাড়তো না। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতারণার মামলায় চৌদ্দশিকের ঘানি টানাতো। কিন্তু এতকিছুর পরেও রেজার প্রতি নিলির শীতল মনোভাব জাহিদকে বিরক্ত করলো। নিলিকে অপেক্ষা করতে সে বেরিয়ে গেলো রিলিজের কাগজপত্র জোগাড় করতে।
★
এদিকে গতকালই তিন্নিকে দেখে এসেছেন ফুয়াদের বাবা মা। মেয়ে উনাদের পছন্দ হয়েছে। এবার ফুয়াদের মতামতটা জানা প্রয়োজন। ছেলেকে নিজের ঘরে ডাকলেন ফুয়াদের বাবা আহমেদ শফিক। ফুয়াদ নিজের ঘরে বসে অফিসের ফাইল রেডি করছিলো। বাবার ডাক শুনে হাতের কাজ রেখে বেরিয়ে গেলো।
-‘বাবা ডেকেছো?’
-‘হ্যাঁ। বসো। তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।’
ফুয়াদ খাটের ওপর বাবার মুখোমুখি বসলো। মনে মনে ধারণা করে নিলো বিয়ের ব্যাপারেই কোন কথা বলতে ডেকেছেন আহমেদ শফিক। তার ধারণা একেবারে নির্ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আহমেদ শফিক গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,’গতকাল তোমার ফুফুর বাসায় তাঁর পছন্দের পাত্রীকে দেখে এসেছি আমি এবং তোমার মা। এই বিষয়ে তুমি কিছু জানো?’
-‘হ্যাঁ মা বলেছে।’
-‘যাইহোক, মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে। দেখতে শুনতে মাশাআল্লাহ। কিন্তু বিয়েটা তোমার। তাই তোমার মতামত জানা সবচাইতে বেশি প্রয়োজন। তোমার যদি কোন আপত্তি থাকে বলতে পারো।’
ফুয়াদ চুপ করে রইলো। কি বলবে বুঝতে পারছে না। আহমেদ শফিক ছেলেকে চুপ থাকতে দেখে আশ্বস্ত করে বললেন,’তুমি নির্দ্বিধায় নিজের মতামত জানাতে পারো। কোন সমস্যা নেই। আমি আর তোমার মা তোমার মতামতের বাইরে কিছু করবো না। তুমি হয়ত ভাবছো তুমি অমত করলে তোমার ফুপু মনে কষ্ট পাবে কিংবা বাবার সঙ্গে ফুপুর সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে। তেমন কিছুই না। তোমার ফুপু বুঝবেন। প্রয়োজনে আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলবো। কিন্তু তুমি মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ো না।
ফুয়াদ ভেবেচিন্তে কোন কুল কিনারা পেলো না। তিন্নির ব্যাপারে সে ভালো খারাপ কোন সিদ্ধান্তই নিতে পারছে না। শায়লা মুরসালীন জানপ্রাণ দিয়ে বলছে তিন্নি ভালো। বাবার মায়েরও পছন্দ হয়েছে। কিন্তু রাস্তায় সেদিন তিন্নির যে আচরণ করেছে তাতে কোন দিক দিয়েই তাঁকে শান্তশিষ্ট লক্ষ্মী মেয়ে মনে হচ্ছে না ফুয়াদের। আবার সামান্য একটা কারণ নিয়ে বিয়েটা ভেঙ্গে দিতেও মন টানছে না। উপায়ন্তর না পেয়ে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিলো সে। নিজেকে স্থির করে নিয়ে বললো,’তোমাদের পছন্দ হলেই হবে। আমার আপত্তি নেই।’
শফিক সাহেব খুশি হলেন। বললেন,’তবে আমি আত্মীস্বজনদের সবাইকে জানাই? বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করতে হবে তো।’
ফুয়াদ ঘাড় কাত করে সায় জানালো। এত ভেবে লাভ নেই। সৃষ্টিকর্তা ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন তাই হবে। হতে পারে সত্যিই তিন্নির সম্পর্কে তাঁর ধারণা ভুল। তাঁরা দুজনে সত্যিই একে ওপরের জন্য উপযুক্ত।
★
বিয়ের সব প্রস্তুতির মাঝে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে এংগেইজম্যান্ট এর দিনই তিন্নির সঙ্গে ফুয়াদের বিয়েটা হয়ে গেলো। কথা ছিলো আগে এংগেইজম্যান্ট হবে তারপর আত্মীয়স্বজনরা সবাই এলে বড় করে বিয়ে অনুষ্ঠান করা হবে।
কিন্তু গণ্ডগোল পাকালেন তিন্নির নানুভাই মোঃ আতাহার আলী। এংগেইজম্যান্ট দিন বৃদ্ধ বেঁকে বসলেন। তাঁর এক কথা এংগেইজম্যান্ট যদি হয় তাহলে বিয়েও হতে হবে। নইলে দুটোর একটাও হবে না।
তিনি আগেকার দিনের মানুষ। শুধুমাত্র এংগেইজম্যান্ট এর ওপর ভিত্তি করে ছেলেপক্ষকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। তাই নিজের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করালেন, এংগেইজম্যান্ট এর পর আল্লাহ না করুক কোন কারণে যদি ছেলেপক্ষের সাথে মেয়ের পরিবারের কোন ঝামেলা হয় তখন মেয়ের কি হবে? তখন যদি ছেলেপক্ষ কোন একটা বাহানা বানিয়ে বিয়েটা ভেঙ্গে দেয়? কে নেবে তার দায়ভার? ক্ষতিটা তো মেয়েরই হবে। সবাই তো বলবে মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে গেছে। কেউ তখন আর বুঝবে না এটা সামান্য একটা এংগেইজম্যান্ট।
ফুয়াদের সঙ্গে আসা আত্মীয়রা জোর দিয়ে বললেন এসব কিচ্ছু হবে না। আহমেদ শফিকের কথা দাম আছে। তিনি এক কথার মানুষ। দুনিয়া উল্টে গেলেও তাঁর কথার নড়চড় হয় না।
কিন্তু আতাহার আলীকে কিছুতেই মানানো গেলো না। তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অটল। এদিকে মুরুব্বী মানুষ। লজ্জায় তার মুখের ওপর কথাও বলতে পারছেন না মেয়ে আর মেয়ের জামাই। লেগে গেলো দুপক্ষের মাঝে বাকবিতণ্ডা। মেয়েপক্ষ বলছে এংগেইজম্যান্ট হলে বিয়ে এখনই হবে। আতাহার আলী একদম ঠিক বলছেন। এদিকে বরপক্ষ বলছে আত্মীয়স্বজন ছাড়া এভাবে বিয়ে হয় না। এটাকে লোকে চোরাই বিয়ে বলে।
পরিস্থিতি হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যেত যদি না শেষমুহুর্তে ফুয়াদের বাবা আহমেদ শফিক মুখ খুলতেন। তিনি মজলিসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন বিয়ে আজই হবে। কিন্তু বউ এখন তুলে নেওয়া হবে না। বউ তোলা হবে অনুষ্ঠান পর। তার একমাত্র ছেলের বউ। তিনি সাজিয়ে গুজিয়ে বউ ঘরে তুলতে চান।’
এরপর আর কেউ অমত করলো না। কাজি ডেকে সাদামাটা ভাবেই বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলো। ফুয়াদ এবং তিন্নি দুজনের কেউই এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। তারওপর দুপক্ষের ঝামেলার কারণে আলাদাভাবে কথা বলারও সুযোগ পায় নি। সবমিলিয়ে এক হ-য-ব-র-ল অবস্থা। শেষে
যাওয়ার সময় ফুয়াদের এক খালাতো বোন বুদ্ধি করে তিন্নির নাম্বার যোগাড় করে নিলো ফুয়াদকে দেওয়ার জন্য। তিন্নির কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,’চিন্তা করো না ভাবি। আজ রাতেই বরের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেবো।’