#তুমি_তাই,২২,২৩
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২২
তিন্নির কাছে সেদিন রাতে কোন ফোন এলো না। এ নিয়ে অবশ্য তাঁর কোন মাথাব্যথাও ছিলো না। মেহমানরা চলে যাওয়ার পরপরই ফ্রেশ হয়ে ঘুমাতে চলে গিয়েছিলো সে। সকাল থেকে বিয়ের ঝামেলায় দুদন্ড নিরিবিলি বসার সুযোগও হয় নি। সারাক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচিতে কানের তালা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। তাই সুযোগ পেয়ে আর দেরী করে নি। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। তারপর একঘুমেই রাত পার।
পরেরদিন নিতান্ত কৌতূহল বশতই ফোনে কোন আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে কি মা চেক করলো। আসে নি দেখে আর বেশি মাথা ঘামালো না।
ফোন এলো দুদিন পরে। সন্ধ্যার সময়। তিন্নি তখন নিজের ঘরে বসে চুল আঁচড়াচ্ছিলো। এমন সময় ফুয়াদ ফোন করলো। কিন্তু সংকোচ আর অস্বস্তিতে ঠিকমত কথা বলতে পারে নি তিন্নি। সে নিজেও বুঝতে পারছিলো না কেন তাঁর এমন অস্বস্তি হচ্ছিলো? ফুয়াদ খুবই সাধারণ কথাবার্তা বলেছে। এতে লজ্জা পাওয়ার মত কিছুই নেই।
তাছাড়া, তিন্নি বিয়েটা করেছে কেবল করতে হবে বলে। এছাড়া আর অন্য কোন এক্সপেক্টেশন তাঁর নেই। ইমোশন তো বহুদূরের কথা। শেষমেশ ফুয়াদের কথার মাঝখানেই ফোন কেটে দিয়েছে সে। ফুয়াদ কল ব্যাক করলো কিন্তু রিসিভ করলো না।
দুদিন বাদে ফুয়াদ বাসায় এলো দেখা করার জন্য। দুপক্ষের আত্মীয়স্বজনরাও তাই চাইছিলো। বউ উঠিয়ে নেওয়া হয় নি তো কি হয়েছে? ফুয়াদ তো আসাযাওয়া করতে পারে। স্বামী স্ত্রীর মিল মহাব্বতেরও তো একটা ব্যাপার আছে! ফুয়াদের নিজেরও মনে হচ্ছিলো তিন্নির সঙ্গে দেখা করা প্রয়োজন। আর কিছু না হোক অন্তত কথাবার্তা সহজ করার জন্যে হলেও প্রয়োজন।
★
ঘুম ঘুম চোখে আড়মোড়া ভাঙলো তিন্নি। সামনের চেয়ারে বসা ফুয়াদকে দেখে চমকে গেলো। স্বপ্ন দেখছে ভেবে চোখ কচলালো।
ফুয়াদ সুতির কাজ করা একটা ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী পরে এসেছে। নতুন জামাই লাগছে তাঁকে। ফোনে নিউজফিড স্ক্রল করছিলো সে।
তিন্নিকে চমকাতে দেখে হালকা হাসলো। ফোন পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে বললো,’তুমি খুবই সুখি একজন মানুষ। কারণ তোমার ঘুম ভালো ঘুম হয়।’
তিন্নি সোজা হয়ে বসলো। তাঁর পরনে একটা বেগুনী সেলোয়ার কামিজ। নাকফুল, চুড়ি সব খুলে রেখে দিয়েছে। ফুয়াদকে দেখে সেগুলোর কথা মনে পড়লো। খাটের পাশেই ড্রেসিংটেবিল। টেবিলের ওপর চুড়ি রাখা আছে। চিকন দেখে দুগাছি চুড়ি পরে নিলো সে। এলোমেলো চুলগুলো হাত খোঁপা করে বললো,’কখন এসেছেন?’
-‘আধঘণ্টার মত হবে।’
-‘আপনি বসুন আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।’
-‘বসেই তো আছি। তোমার কাজিনরা জোর করে আমাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে।ঢুকে দেখি তুমি ঘুমাচ্ছো। কয়েকবার ডেকেছি, সাড়াশব্দ করছিলে না দেখে আর ডিস্টার্ব করি নি।’
-‘আমার ঘুম গাঢ়। ঘুমালে হুঁশ থাকে না।’
তিন্নি ফোন করে তাসলিমা বেগমকে ঘরের দরজা খুলে দিতে বললো। তার কাজিনগুলো ভয়ানক অসভ্য। ওদেরকে বললে খুলবে না। তাই বাধ্য হয়ে তাসলিমা বেগমকে ফোন করেছে। তাসলিমা বেগম এসে দরজা খুলে দিয়ে গেলেন।
তিন্নি ঘর ছেড়ে বেরোনোর সময় জিজ্ঞেস করলো ,’কি খাবেন? চা না কফি?’
যদিও এখানে আসার পর একবার নাশতা করেছে ফুয়াদ। কিন্তু এইমুহূর্তে এক মগ কফি ভীষণ প্রয়োজন। অনেকক্ষণ বসে থাকার ফলে শরীরে ঝিমুনি এসে গেছে। তিন্নির প্রশ্নের জবাবে হাসিমুখে বললো,’কফি।’
মিনিট পাঁচেক বাদে কফি নিয়ে পুনরায় ঘরে প্রবেশ করলো তিন্নি। কফির মগটা ফুয়াদের হাতে তুলে দিয়ে খাটের ওপর বসলো। ফুয়াদ কফিতে চুমুক দিয়ে বললো,’কফি ভালো হয়েছে।’
তিন্নি জবাব দিলো না। ফুয়াদ ঠিক কি উদ্দেশ্য এই বাসায় এসেছে সে জানে না। স্বামীর অধিকার প্রয়োগ করতে নাকি শুধু গল্পগুজব করতে? যাই হোক আপাতত দুটোর একটাতেও ইন্টারেস্ট নেই তিন্নির। কিছুদিন নিজেকে সময় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে।
-‘আসলে বিয়েটা এত হুট করে হয়ে গেছে যে আত্মীয়স্বজন কাউকেই ঠিকমতো জানানো হয় নি। তাই একটু ঝামেলা চলছে বাসায়। তোমাকেও ঠিকমত সময় দিতে পারছি না।’
-‘সমস্যা নেই। আপনি আগে বাসার সমস্যার সমাধান করুন।’
-‘বোঝার জন্য ধন্যবাদ।’
ফুয়াদ কফির মগ রেখে উঠে দাঁড়ালো। পকেট থেকে ফোন বের করে সময় দেখলো। রাত বেশি হলে বাসায় ফিরতে দেরী হয়ে যাবে। তাছাড়া ফেরার পথে একবন্ধুর সাথেও দেখা করার কথা আছে। তাসলিমা বেগমের সঙ্গে দেখা করেই বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
তিন্নি দূরত্ব বজায় রেখে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালো। ফুয়াদ ফোন পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে তিন্নির দিকে চাইলো। তাঁর দাঁড়ানোর ভঙ্গি যথেষ্ট আড়ষ্ট। ফুয়াদ সপ্রতিভ হাসলো। বললো,’তুমি কি আমাকে দেখে বিব্রত হয়েছো?’
তিন্নি চুপ করে রইলো। ফুয়াদ জবাব না পেয়ে নিজে থেকেই বললো,’হয়ে থাকলে আমি সরি। আমার আসলে ফোন করে আসা উচিৎ ছিলো। ট্রাস্ট মি, তোমাকে বিব্রত করার কোন ইন্টেনশন আমার নেই। আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি।’
তিন্নি এবারেও জবাব দিলো না। এইমানুষটার সঙ্গে সেদিন রাস্তায় ঝগড়া হয়েছে তাঁর। যদিও ঝগড়াটা একতরফাই ছিলো। ফুয়াদ দোষ স্বীকার করে চুপচাপ মিটমাট করার চেষ্টা করেছে কেবল, রাগ যা করার তিন্নিই করেছে। কিন্তু প্রথম পরিচয়ের পর থেকে এইপর্যন্ত এই লোকটাকে কোনভাবেই ভায়োলেন্ট মনে হয় নি তাঁর। তবুও কেন সে স্বাভাবিক হতে পারছে না? এই প্রশ্নের উত্তর তিন্নির নিজেরও জানা নেই। এই মানুষটার সঙ্গে সে আদৌ স্বাভাবিক হতে পারবে কি না তাও জানে না। প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে বললো,’বিব্রত না। আমি আসলে একটু অন্যমনস্ক। আপনি কি আজকে থাকবেন?’
হঠাৎ মুখ ফস্কে কথাটা বেরিয়ে যেতেই ভীষণ লজ্জায় পড়লো তিন্নি। মনের ভয় তাঁর মুখে প্রকাশ পেয়ে গেছে। ফুয়াদ কি বুঝেছে কে জানে। সে খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললো,’না। আজকে তোমার সঙ্গে পরিচিত হতে এসেছি। বিয়ের দিনও ঠিকমতো কথাই বলতে পারি নি।’
তিন্নি পূর্বোক্ত প্রশ্নটা ধামাচাপা দিতে বললো,’না আসলে মা আপনার জন্য রান্না করছেন তো তাই।’
ফুয়াদকে খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেলো। এখন সবে সাড়ে আটটা বাজে। ডিনার করতে গেলে অনেক দেরী হয়ে যাবে। এদিকে বন্ধুর সঙ্গেও দেখা করতে হবে। চিন্তিত মুখে বললো,’চলো তো মা কি করছে দেখি?’
গিয়ে দেখলো তাসলিমা বেগম সত্যিই চুলায় রান্না বসিয়ে দিয়েছেন। নতুন জামাই কিছুতেই না খাইয়ে ছাড়বেন না। ফুয়াদও জোর দিয়ে না করতে পারলো না। অভদ্রতা দেখায়। বাধ্য হয়ে থেকে গেলো। বন্ধুকে ফোন করে জানিয়ে দিলো আজকে দেখা করতে পারবে না।
এদিকে অনেকক্ষণ বাদে তিন্নির কাজিনরা সুযোগ পেয়ে দুজনকে জেরা শুরু করে দিলো। এতক্ষণ দরজা বন্ধ করে কি করেছে তাঁরা এই নিয়ে নানারকম লজ্জাজনক প্রশ্ন।
তিন্নি ইচ্ছে করেই চুপ করে রইলো। এই লোক কি বলে সেটা শুনতে চায় সে। ফুয়াদ মুচকি হেসে বললো,’তোমাদের আপুকে গান শুনাচ্ছিলাম।’
সবাই একসঙ্গে প্রশ্ন করলো কি গান। ফুয়াদ দুষ্টুমিষ্টি হাসলো। অনেকটা কবিতা আবৃতির সুরে গেয়ে উঠলো সে,
“একেলা পাইয়াছি হেথা,
পলাইয়া যাবে কোথা
চৌ-দিকে ঘিরিয়া রে রাখিছে
আমার শ্যালিকা গনে।
আজ পাশা খেলবো রে শ্যাম!”
তাঁর গান শুনে তিন্নি কাজিনরা সবাই হাসতে হাসতে একে অপরের গায়ে পড়লো। তিন্নিকে টিপ্পনী কেটে বললো,’তোমার বর কিন্তু ভীষণ দুষ্টু আপু!’
লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিলো তিন্নি। সে ভেবেছিলো ওদের সঙ্গে পেরে উঠবে না ফুয়াদ। লজ্জায় কাঁচুমাচু করবে। কিন্তু এখন তো দেখছে উল্টো, মজা নিচ্ছে এই লোক।
যতক্ষণ ছিলো ফুয়াদ সবার সঙ্গে দুষ্টুমি করেই কাটিয়েছে। তিন্নি কেবল চুপচাপ বসে ছিলো। এমন পরিস্থিতিতে বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার ছিলো না তাঁর। উঠে গেলে অভদ্রতা হতো। আবার কথা বলতেও সংকোচ লাগে। তাই চুপচাপ বসেই ছিলো। এরপর থেকে মোটামুটি ঐ বাসায় আসা যাওয়া হয় ফুয়াদের। তিন্নি যদিও পুরোপুরি ফ্রি হতে পারে নি তবে টুকটাক কথাবার্তা বলে এখন।
#তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২৩
ফুয়াদ অফিস থেকে এসেছে আধঘণ্টা হয়েছে। ফ্রেশ হয়ে বেডরুমে শুয়ে টিভি দেখছিলো। তিন্নি শ্বাশুড়ির সঙ্গে রাতের রান্নাবান্না সেরে ঘরে এলো।
তিন্নির ঘরকন্না দেখলে সত্যিই বোঝার উপায় নেই এই সংসারে তার অনাগ্রহ। শ্বাশুড়ির সঙ্গে রান্না করা, শ্বশুরের ওষুধপত্রের খেয়াল রাখা, সময়মত ফুয়াদের সব কিছু রেডি রাখা এসব দেখে যে কেউই ভাববে বাড়ির আদর্শ বউ সে। দুমাস হয়েছে কেবল এই সংসারে এসেছে। এর মাঝেই সবার মন জয় করে নিয়েছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভীষণ ক্লান্ত তিন্নি। দিনের পর দিন সবার সঙ্গে মিথ্যে ভালো থাকার অভিনয় করে যাচ্ছে সে।
ভেতরে ঢুকে এসে দেখলো টিভি খামোখা চলছে, দেখার কেউ নেই। ফুয়াদ ফোন নিয়েই ব্যস্ত। এলো চুলগুলো হাতখোপা করে নিতে নিতে বললো,’নিচে খেতে ডাকছে।’
ফুয়াদ ফোন থেকে চোখ তুললো। তিন্নিকে সামনে দাঁড়ানো দেখে ভ্রুজোড়া অটোমেটিক কুঁচকে গেলো তাঁর। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললো,’আজকে এত তাড়াতাড়ি?’
-‘কাল সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে হবে। মা খালাম্মার বাসায় যাবেন। তাই সবাইকে তাড়াতাড়ি খেতে ডাকছেন।’
ফোন পকেটে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ালো ফুয়াদ। স্মিত হেসে বললো,’ঠিক আছে চলো।’
-‘আমি খাবো না। আপনি যান।’
-‘কেন খাবে না কেন? শরীর খারাপ?’
-‘শরীর ঠিক আছে। খিদে নেই। আপনি যান।’
ফুয়াদ জোরাজুরি করলো না। চুপচাপ খেতে চলে গেলো। তিন্নি বাতি নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। আজকে মনটা বড্ড অস্থির হয়ে আছে। ছুটে পালিয়ে যেতে মন চাইছে এই দমবন্ধকর সংসার জীবন থেকে থেকে।
অন্ধকারে চোখ দিয়ে গলগল করে পানি পড়ছে তাঁর। এতগুলো দিন হয়ে গেছে অথচ ফুয়াদের সঙ্গে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছে না সে। বারবার মনে হচ্ছে জেনে বুঝে ইচ্ছাকৃত ভাবে ফুয়াদ ঠকাচ্ছে। মিথ্যে ভালো থাকার অভিনয় করছে। তিন্নি মাঝেমাঝে মনে হয় ফুয়াদ অনেককিছু বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে। ইচ্ছে করেই তিন্নি নিজের মত করে থাকতে দিচ্ছে সে।
এদিকে খেতে বসে আজকে আর ফুয়াদ ভাবছে কখন রুমে যাবে সে। এই প্রথম তিন্নিকে একা ফেলে খেতে চলে এসেছে ফুয়াদ। গত দুমাসে এমনটা কোনদিন হয় নি। তাই তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস আজকে তিন্নির কাছ থেকে একটা না একটা রিয়েকশন সে পাবেই পাবে। কারণ অতিরিক্ত কেয়ার পেলে মানুষ হঠাৎ করে সামান্যতম অবহেলাও সহ্য করতে পারে না। এছাড়া তিন্নিকে বিগত দুমাস যাবত পর্যবেক্ষণ করছে ফুয়াদ। তাঁর এই নিরামিষ প্রকৃতির পিচ্চি বউটির মনের মধ্যে কোন একটা গোপন রহস্য আছে। যেটা চাইলেও ফুয়াদকে বলতে পারছে না সে। কিন্তু ফুয়াদ থেমে থাকবার পাত্র নয়। অনেক হয়েছে পার্সোনাল স্পেস দেওয়া। এবার সময় এসেছে আস্তে আস্তে তিন্নির পেট থেকে সব কথা টেনে বের করার।
অস্থিরতা চেপে, ইচ্ছে করেই দেরীতে ঘরে গেলো সে। গিয়ে দেখলো ঘর অন্ধকার। পা টিপে টিপে ভেতর ঢুকে দেখলো। তিন্নি শুয়ে পড়েছে। কিন্তু ঘুমায় নি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোঁপাচ্ছে। অবাক হলো ফুয়াদ। এইটুকুতেই এত কান্না? মেয়ে মানুষের জাতটা এমন কেন? এত কান্না তাদের আসে কোথা থেকে?
কাছে গিয়ে গলা খাঁকারি দিলো ফুয়াদ। আস্তে করে তিন্নিকে ডাক দিলো,’ঘুমিয়ে পড়েছো?’
তিন্নি জবাব দিলো না। ফুয়াদ আবার ডাক দিলো,’ঘুমিয়ে পড়েছো?’
-‘না। আপনার কিছু লাগবে?’
ফুয়াদ ইতস্তত করে বললো,’না মানে। আসলে আমি সরি। তোমাকে রেখে খেতে যাওয়াটা আমার একদমই উচিৎ হয় নি। আমি কি ভাত নিয়ে আসবো?’
-‘না।’ সংক্ষিপ্ত জবাব তিন্নি।
-‘কেন? রাতে না খেয়ে থাকা ভালো না।’
-‘আমার খিদে নেই।’
ফুয়াদ সাবধানে বিছানায় বসলো। তিন্নি ঠিক রেগে আছে নাকি অভিমান করেছে বোঝা যাচ্ছে না। অন্ধকারে তাঁর চেহারাও দেখতে পারছে না।
তিন্নি পাশ ফিরে বললো,’আপনি শুয়ে পড়ছেন না কেন? কালকে সকালে তো অফিস আছে।’
-‘আছে। কিন্তু…!’
-‘কিন্তু কি?..’ ফের বালিশে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো তিন্নি।
ফুয়াদ বিপাকে পড়ে গেলো। উঠে গিয়ে লাইট অন করলো সে। লাইট অন করতেই দেখলো তিন্নি শুধু ফোঁপাচ্ছে না কাঁদতে কাঁদতে অলরেডি তাঁর চোখমুখ ফুলে গেছে।
সামান্য ভাত খাওয়া নিয়ে নিশ্চয়ই এত কান্না করার কথা নয়? ফুয়াদ চিন্তায় পড়ে গেলো। তিন্নির সামনে চেয়ার টেনে বসলো সে। আলতো করে কনুই চেপে ধরে বললো,’এই ওঠো। ওঠো। দেখি কি হয়েছে বলো আমাকে?’
তিন্নি তৎক্ষণাৎ চোখ মুছে নিয়ে বললো,’কিচ্ছু হয় নি। আপনি যান শুয়ে পড়ুন।’
ফুয়াদ তিন্নির হাত চেপে ধরলো। জোরপূর্বক তাঁকে শোয়া থেকে টেনে তুলে বললো,’না বলতে চাইলে আমি জোর করবো না। কিন্তু খাবে চলো। মা তোমার কথা বারবার জিজ্ঞেস করছেন। ডাকতেও চাইছিলেন আমিই বারণ করেছি। চলো খাবে চলো।’
তিন্নি দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠে বললো,’খাবো না আমি।’
-‘কেন খাবে না?
-‘আমি একজনকে ভালবাসতাম।’
ফুয়াদের হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে গেলো। তবে ছাড়লো না। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে তিন্নির দিকে চেয়ে রইলো। তারপর খুব স্বাভাবিক ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করলো,’বাসতাম মানে কি? এখন বাসো না?’
তিন্নি মুখে জবাব এলো না। এটা কি ধরণের প্রশ্ন করেছে ফুয়াদ? লোকটার কি মাথাটাথা গেছে? তাঁকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফুয়াদ ফের একই প্রশ্ন করলো।
অনেকক্ষণ বাদে ধীরে ধীরে মুখ খুললো তিন্নি। বললো,’আপনি নিশ্চয়ই আমাকে ভুল বুঝছেন। কিংবা আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছেন না! আমি সত্যি বলছি বিয়ের আগে আমি একজনকে ভালোবাসতাম।’
-‘এটা তো আমার প্রশ্নের উত্তর হলো না? তুমি আমাকে বলছো তুমি একজনকে ভালোবাসতে। এর মানে আমি কি ধরে নেবো? তুমি এখন তাঁকে ভালোবাসো না? এই তো?’
-‘সে আমাকে কোনদিন ভালোবাসে নি।’
-‘এটাও আমার প্রশ্নের উত্তর হলো না। যাইহোক, এখন কি সেই দুঃখে কাঁদছো? আমি গিয়ে তাঁকে রিকোয়েস্ট করবো?’, ফুয়াদ চেহারা এবং কণ্ঠস্বর দুটোই স্বাভাবিক।
-‘আপনি আমার কথা কেন বিশ্বাস করছেন না? আমি ভেতরে ভেতরে অনেক কষ্ট পাচ্ছি। আর পারছি না ভালো থাকার অভিনয় করতে।’
-‘তো আপনি আমাকে কি করতে বলছেন? আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো। আপনি যদি চান তবে, ঐ ছেলেকে গিয়ে রিকোয়েস্টও করবো। শুধু মুখ দিয়ে বলতে হবে আমাকে। না বললে আমি বুঝবো না।’
তিন্নি কি করবে বুঝতে পারছে না। সে যতটা দুশ্চিন্তা নিয়ে কথাটা বলেছিলো ফুয়াদের কাছ থেকে ততটা রিয়েকশন পাচ্ছে না। নিতান্তই রাগ লাগছে তাঁর। সবাই কেন তাঁকে এমন হালকা ভাবে নেয়? আগে রেজোয়ান নিতো, এখন ফুয়াদ। এরা ভাবে টা কি? তিন্নি বাচ্চা? কান্না থেমে গেলো তাঁর। হতাশা এসে ভর করলো চোখের পাতায়।
ফুয়াদ তাঁর মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো,’কি ব্যাপার? আপনি কথা বলছেন না কেন?’
-‘বলবো না আমি আপনার সঙ্গে কথা।’
-‘ও আচ্ছা। তা,আপনি কি খাবেন? নাকি আমি শুয়ে পড়বো?’, ফুয়াদ বিছানার ওপর পা তুলে বসলো।
-‘আপনি আমাকে আপনি করে বলছেন কেন?’,
ফুয়াদ তাঁর প্রশ্নের জবাব দিলো না। স্থিরভাবে তিন্নির মুখের দিকে চেয়ে অল্প হাসলো। তিন্নি অস্বস্তিতে জড়সড় হয়ে বললো,’তাঁর সঙ্গে কিন্তু আমার কোন প্রেমের সম্পর্ক ছিলো না।’
-‘তো?’
-‘না মানে ভালোবাসাটা একতরফা ছিলো।’
-‘আচ্ছা।’
ফুয়াদ শুয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিলো। তাঁর ঠান্ডা রিয়েকশন তিন্নির মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এতক্ষণ কি করছে সে নিজেও জানে না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে নিজ হাতে সংসারটা ভেঙ্গে দিতে চলেছে সে! নতুবা ফুয়াদ এমন শান্ত আচরণ করবে কেন? নিশ্চয়ই তিন্নিকে ত্যাগ করার পরিকল্পনা করছে সে! তাই যদি হয় তবে বাবা মাকে কি জবাব দেবে তিন্নি? অকস্মাৎ ভয়ে কেঁদে ফেললো। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেললো। ফুয়াদ বাধা দিলো না।
উঠে গিয়ে চুপচাপ বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো সে। কিছুক্ষণ বারান্দায় কাটিয়ে এসে তিন্নির পাশে বসলো। বললো,’তাঁকে যখন এতই ভালোবেসেছো তখন আমাকে বিয়ে করেছো কেন?’
-‘তাঁর প্রতি এখন আর আমার কোন ফিলিংস নেই।’
-‘তারমানে তুমি বলতে চাইছো এখনো আমার একটা সুযোগ আছে?’
তিন্নি অবাক হলো ফুয়াদের প্রশ্ন শুনে। সে মোটেও এমন কিছু বলতে চাই নি। সে শুধু সত্যিটা জানিয়ে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু পরিণতির কথা ভাবে নি। তাঁর রিয়েকশন দেখে ফুয়াদের হাসি পেয়ে গেলো। তিন্নির সম্পর্কে রেজোয়ানের কাছ থেকে অল্পবিস্তর জেনেছে সে। মেয়েটা ভীষণ ইমোশনাল! খামখেয়ালিও। আবেগ চেপে রাখতে পারে না। হাসি ঠেকিয়ে বললো,’কি তাইতো?’,
-‘আমার মনে হয়েছিলো সত্যিটা আপনার জানা দরকার। আপনাকে অন্ধকারে রেখে আমি ভালো থাকতে পারছিলাম না।’
তিন্নি মাথা নিচু করে হাতদুটো মুঠো করে ফেললো।
-‘এখন বয়স কত তোমার?’
-‘জানুয়ারিতে উনিশ হবে।’
-‘বাহ! তাহলে তো ভালোই ইঁচড়েপাকা তুমি। একেবারে আণ্ডাবাচ্চা থাকতেই প্রেম ভালোবাসা বুঝে গেছো। গুড। ভেরি গুড।’
তিন্নির এবার রাগ লাগছে। গম্ভীরমুখে প্রতিবাদ করে বললো,’প্রেম ভালোবাসার কোন বয়স হয় না। আমি তাঁকে সত্যিই খুব ভালোবাসতাম।
-‘আমার বয়স কত জানো? একত্রিশ বছর, চার মাস, দশ দিন। আমাকে এসব প্রেম ভালোবাসা বোঝাতে এসো না। যা বলছি মনযোগ দিয়ে শোনো, এখন থেকে লক্ষ্মী মেয়ের মত মন দিয়ে সংসার করবে। পুরোনো প্রেমিকের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো, ওসব বাচ্চাকালের প্রেম ভালোবাসা সকলেরই দুচারখানা থাকে। তাই বলে জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। পড়াশোনায় মনোযোগ দাও। আর বাকিটা আমার দায়িত্ব। আমি যতদিন বেঁচে আছি,ততদিন মনে মনেও আমার স্ত্রীকে দ্বিচারিণী হতে দেবো না। এত ভালোবাসবো যে, দিনরাত চব্বিশঘন্টা শুধু আমার নামই জপ করবে।’
কথা শেষ করে ফুয়াদ তিন্নিকে কোন প্রতিউত্তর করার সুযোগ দিলো না। জোরপূর্বক তাঁকে টেনে ভাত খাওয়াতে নিয়ে গেলো।