কালো_আর্তনাদ?,পর্বঃ৩ (শেষ পর্ব)

0
1789

#কালো_আর্তনাদ?,পর্বঃ৩ (শেষ পর্ব)
#written_by_Liza

মনে হচ্ছে ভাই ভাবির ঝগড়া হয়েছে একটু আগে।ঝগড়ার কথা মাথায় আসতেই ভয়ে ঢোক গিলতে লাগলাম আর ভাবতে লাগলাম আমাকে নিয়ে নয়তো তাদের সংসারে অশান্তি!ভাবির দিকে তাকাতেই ভাবি চোখ সরিয়ে নিয়ে ভেতরের রুমে চলে গেলো।আমি অসহায় করূণ দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছি,ভাইয়া আমায় ভেতরে বসতে দিলো আর বললো তুই বস আমি আসছি।এই বলে ভাইয়া ভেতরের রুমে চলে গেলো একটু পর’ই কিসের যেনো আওয়াজ আসতে লাগলো ভেতর থেকে, আমি ভেতরের রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে আছি, তখন’ই কানে আওয়াজ আসতে লাগলো ভাবির কথাগুলো। কি দরকার ছিলো ঘাড়ের উপর এই অপয়া মেয়েকে এনে রাখার? কয়টা বিল্ডিং করেছো শুনি? ভালো করে এক্টা মাত্র ছেলের খরচ বহন করতে পারো না তার উপর এই অপয়া টাকে ঘরে ঢুকিয়েছো।কথা গুলো শুনে আমি আর নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না, মুখে কাপড় গুজে হু হু করে কাঁদতে লাগলাম,ওপাশ থেকে ভাইয়ের আওয়াজ আসছে, তুমি কি থামবে?আমার বোন তোমার কি ক্ষতি করেছে? ভাইয়ের মুখের উপর ভাবি জবাব দিয়ে বলে, হয় এই অপয়া থাকবে ঘরে, নয় আমি কাল সকালে ছেলে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাবো।
পাশে থাকা ভাইয়ের ছোট্ট ছেলে তাদের ঝগড়া দেখে ভয়ে আওয়াজ বন্ধ করে কাদো কাদো দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে,আমি কোলে নিয়ে কপালে চুমু খেলাম। ভাইয়ের ছেলে গুটি গুটি হাতের চোখের পানি গুলো ছোয়ার চেষ্টা করছিলো তার আগেই আমি মুছে নিয়ে স্বাভাবিকভাবে বসি। একটু পর ভাই রুম থেকে বের হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু কোনোরকমভাবে হেসে পাশে বসলো,মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আমায় জিজ্ঞেস করছিলো সিয়ামের কথা আর শশুড়বাড়ির কথা। কিছু বলার সাহস নেই ভাইয়াকে।কিছু বললে ভাইয়া আমায় যেতে দিবে না ওদিকে ভাবি চলে যাবে সংসার ছেড়ে। তাই কিছু বলিনি আর হাসিমুখে সবাই ভালো আছে বলে কথা এড়িয়ে গেলাম। রাত হলো খেতে বসেছি আমি ভাইয়া ভাবি। পাঙ্গাশ মাছের পাতলা ঝোল আর কুচি করে আলু কেটে ভাজি করেছে। খামারের মুরগি ডাকছে বোধহয় ডিম পারবে। খাবারের মেন্যু দেখে ভাইয়া বলে উটে একটা মুরগি কেটে রাধতে পারো নি আমার বোনের জন্য? ভাবি ভাইয়ার কথা শুনে কপাল কুচকে চামচ খাবারের প্লেটের উপর ছুড়ে দিয়ে বলতে থাকে,কারো বাপের চাকর নই আমি,আমার বাবার টাকার তৈরির খামারের মুরগি ওকে খাওয়াবো কেন? এই বলে রাগে গজগজ করে উটে চলে যায়। ভাতের লোকমা হাতে নিয়ে নড়াচড়া করছিলাম মাথা নিচু করে,চোখ বেয়ে পানি ঝড়ছে খাবারের উপর, বমির ভাব আসতে লাগলো মাছের গন্ধে, উটে গিয়ে বাহিরে বমি কর‍তে লাগলাম।ভাইয়া নুন দিয়ে পিট মাঝতে মাঝতে বলতে লাগলো, তুই ঠিক আছিস মিলি? আমি মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সুচক জবাব দেয়।এরপর ভাইয়া খেতে ডাকলে আর যায় না। বিছানা বিছিয়ে মাটিতে শুয়ে পরলাম। ভাইয়া আমার জন্য না খেয়ে বাহিরে রাগ করে সিগারেট খেতে চলে গেলো এই ঠান্ডায়।হাত গুজে মাটিতে শুয়ে আছি আর ভাবছি সিয়াম এখন কি করছে খেয়েছে কি না। ঠিক তখন ভাবির আওয়াজ কানে আসে পাশের রুম থেকে, এই ছ্যামড়া মাইর খাবি কইয়া দিলাম, ভাত না খাইলে এই গোশতোডি খা। শরীরটারে কি বানাইছোস খেয়াল আছে নি তোর? (দাঁতে কিড়মিড় করে)
বুঝতে পারছিলাম ভাইয়ের ছোট ছেলেকে খাইয়ে দিচ্ছে ভাবি মাংস দিয়ে। ভাবি ভাইয়াকে মিথ্যা বলেছিলো মাংস রাধে নি। ভাবির মাংস রান্না আগে থেকেই করা ছিলো আমি আছি বলেই খেতে দেয় নি ভাইয়াকে। সব বুঝতে পারছিলাম স্পষ্ট, কিন্তু কি করবো ভাগ্যের লিখন কে খন্ডাতে পারে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে টিন শেড এর উপর তাকিয়ে আছি, চোখ বেয়ে পড়ছে পানি।পানির বাধ মানছে না ঝড়ছে অঝোরে। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেলাম, ভোরের আজান দিচ্ছে উটে পুকুরপাড়ে গিয়ে অজু করে এসে নামাজ পড়ে নিলাম। বসে আছি উটোনে, প্রতিবেশ এগিয়ে এসে বলছে কবে এসেছিস অনেকদিন পর দেখলাম। পাড়ার চাচিমা আমায় তাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পিঠা খেতে দিলো,খেতে পারছিলাম না কিছুই শুধুই বমি পায়। চাচিমা এমন অবস্তা দেখে হেসে খাইয়ে দিতে লাগলো। চাচিমার সাথে কথা বলে বাড়িয়ে গিয়ে দেখি আমার ব্যাগ টা দরজার সামনে রেখেছে আর বলছে।এবার বিদায় হও, আমার স্বামীর অট্টালিকা নেই যে তোমায় বসিয়ে খাওয়াবো। ভাগ্যের দোষ মেনে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ভাইয়ের বাড়ি থেকে বিদাই নিলাম। স্টেশনে এসে বসে আছি ঠিক তখন-ই সিয়ামের ফোন। সিয়ামের ফোন পেয়ে খুশিতে আত্নহারা, আর ভাবছি এই বুঝি সিয়াম আমায় যেতে বলছে। ফোন ধরে হ্যালো বলতেই অপাশ থেকে সিয়াম বলে উটে, মিলি যেখানে গিয়েছিস যা, কিন্তু আর আমার দরজার চৌকাঠে পা রাখবিনা,তোর মতো অপয়া অলক্ষী যেনো আমার দরজায় পা না রাখে,এই বলে মুখের উপর ফোন কেটে দিলো।আমি চুপচাপ শুনছি আর চোখ মুচছি। আশেপাশে লোকজন আমায় দেখে আছে তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।।আমি কাঁদছি আর আল্লাহকে বলছি, কেন এত দুঃখ দিলে খোদা? জন্মে পর মাকে হারালাম, এখন স্বামী পরিবার হারাতে বসেছি কি ভুল ছিলো আমার,? সন্তান দিতে পারিনি এটা আমার ভুল? কেন এমন কঠিন শাস্তি দিলে আমায়,এই বলে অঝোরে কাঁদছি। স্টেশনে গাড়ি এসে দাড়ালো, আমি ট্রেন এ উটে পড়লাম। কোথায় যাচ্ছি তা আমার জানা নেই,মেয়েদের তো নিজস্ব বাসস্থান নেই,তারা আজীবন অন্যের ঘরে থেকে এসেছে অন্যের নামের উপর,জন্মের পর বাবার উপর, বিয়ের পর স্বামীর উপর, তাদের নামেই মেয়েদের পরিচয়।নয়তো সমাজে কোনো মুল্য নেই। কথাগুলো ভাবছি ট্রেনের জানালার দিকে তাকিয়ে আছি। চোখের পানি শুকিয়ে গেছে আর কাঁদতে পারছিলাম না।শরীরটা বেশ ভার ভার লাগছে কষ্ট হচ্ছে খুব।বারবার তেষ্টা পাচ্ছে। চোখ মুছে বাহিরে তাকিয়ে আছি তখনই সিয়ামের বড় বোন রিতুর ফোন। ফোন রিসিভ করে কানে দিতেই রিতু আপু বলে উটে। মিলি তুই কই? আমি কন্সিভ করেছি, তুই যেই ডক্টরের কাছে গিয়েছিলি তার নাম্বার টা দে তো,আমি বাড়ি আসছি শীগগির, তোকে নিয়ে ডক্টর”টার কাছে যাবো। আমি ফোন চ্যাক করে নাম্বার টা রিতু আপুকে দেয়,রিতু আপু কন্সিভ করেছে শুনে খুব খুশি লাগছে। স্টেশনে এসে ট্রেন থামে, আমি নেমে বেঞ্চিতে গিয়ে বসি। কোমড় আর পেটে খুব খারাপ লাগছে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে,রেল রাস্তার ওপাশে অসংখ্য দোকান। আস্তে আস্তে পেট ধরে এক হাতে ব্যাগ নিয়ে রেল রাস্তায় এক পা রাখলাম,শরীরটা বড্ড ক্লান্ত আর টানছেনা,কিন্তু আমার যে পার হতে হবে ওদিকটা এখন ট্রেন বন্ধ,তাই এই সুযোগে কষ্ট করে এগোতে লাগলাম,হঠাৎ করে চোখে কালো অন্ধকার নেমে আসে, আমি রেল লাইনে বসে পড়ি, ওদিকে ট্রেনের হুইসেল বাজছে, ঝাপসা চোখে ট্রেন কাছে আসতে দেখছি।।
দুই সেকেন্ডের মধ্যে মিলির শরীর খন্ড খন্ড হয়ে যায় ট্রেনের ইঞ্জিনে।
……………….
সিয়ামের বড় বোন ঘরে এসে মিলিকে খুজতে লাগলো। মিলি বাপের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে সিয়াম আর মিলির শাশুড়ী বলতে লাগলো। রিতু কথা না বাড়িয়ে সিয়ামকে নিয়ে মিলি দেওয়া নাম্বার সেই ডক্টরের কাছে যায়। ডক্টর তাদের চিনতে না পারাতে মিলির কথা বলে রিতু ডক্টর কে,ঠিক তখনই ডক্টর বলে উটে ওহ চিনতে পেরেছি, আপনাদের কারো পার্সোনাল ফোন নাম্বার আমার কাছে নেই তাই এক্টা কথা জানাতে পারিনি মিলি মেডামের ব্যাপারে। আপনাদের ঘরের টেলিফোনে ফোন দিয়েছিলাম কেউ ধরে নি,তাই আর বলা হয় নি। ওদিন মিলি ম্যাডামের কাছে ভুল রিপোর্ট গিয়েছিলো। উনি এসেছিলো টেস্ট করাতে, মিলি সাহার নেগেটিভ টেস্ট রিপোর্ট মিলি সাহেবের কাছে কো ইন্সিডেন্টলি চলে যায় মাফ করবেন। আর হে কংগ্রেস মিস্টার সিয়াম,আপনি বাবা হতে চলেছেন। ডক্টরের কথা শুনে কাপতে লাগলো সিয়াম,কাপতে কাপতে দাড়িয়ে গেলো।

ডক্টরের চেম্বারে বড় টিভির পর্দার হেডলাইনে লিখা আজকের খবরঃ
[সকালেই ট্রেনের ধাক্কায় মৃত্যু হয়েছে এক নারীর,আজ সকালে শান্তিপুরের রেললাইন রাস্তায় এই ঘটনাটি ঘটে, ডক্টরের মতে জানা গেলো যে মহিলাটি সন্তান সম্ভবা ছিলো]

সিয়াম আর রিতু টিভিতে অর্ধখন্ডিত মিলি বিভৎস ছবি দেখে চিৎকার করে উটে।

(অবহেলিত এক নারীর জীবন সমাধি ঘটে এই গল্পে)

সমাপ্ত?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here