প্রমত্ত_হৃদয়❤️,১৫

0
1164

#প্রমত্ত_হৃদয়❤️,১৫
#লেখনীতে:সারা মেহেক

রিডিং রুমে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। পরিবেশ থমথমে হয়ে আছে। আফসার সাহেব বসে আছেন কাঠের অলংকৃত পুরোনো ধাঁচের সেই চেয়ারটিতে। কনুইতে ভর দিয়ে থুতনি ঠেকিয়ে সালমা বেগমের দিকে চেয়ে আছেন তিনি। দৃষ্টি কঠিন ও দৃঢ়। সালমা বেগম জবাবের আশায় পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,
” কি হলো? জবাব দিন।”

আফসার সাহেব প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়লেন। অতঃপর বললেন,
” তুমি আদিলের ব্যাপারে যা বলছো তা আমার জানা নেই। ”

সালমা বেগম আশ্চর্যান্বিত হলেন। কণ্ঠে আকাশসম বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন,
” জানা নেই মানে! আপনি আদিলের সাথে পুতুলের বিয়ে দিবেন। কিন্তু আদিলের সম্পর্কে কিছু না জেনেই বিয়ে দিবেন!”

সালমা বেগমের উচ্চ এবং তীক্ষ্ণ কণ্ঠ আফসার সাহেবের কানে এসে বাড়ি খেলো। তিনি যথেষ্ট বিরক্তি প্রকাশ করে শান্ত কণ্ঠে বললেন,
” আস্তে কথা বলো। তোমার কণ্ঠে এতো জোরে কথা শুনতে ভালো লাগে না। সবসময় ধীরে কথা বলবে। প্যানিক হয়ে উঠো কেনো?”

সালমা বেগম শান্ত হলেন না। বরং আফসার সাহেবের এহেন গা ছাড়া ভাব ও শান্ত প্রকৃতির রূপ দেখে তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে পড়লেন। মেয়ের বিপদাপন্ন ভবিষ্যতে আঁচ করতে পেরে স্বামীর অবাধ্য হয়ে উঠলেন তিনি। ক্রোধিত স্বরে উচ্চ স্বরে বললেন,
” প্যানিক হওয়ার মতোই পরিস্থিতি এটা। আপনি মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছেন, ভালো কথা। কিন্তু তাই বলে কি আপনি একবারও আদিলের সম্পর্কে খোঁজখবর নিবেন না? যাই হোক, আমি আদিলের সম্পর্কে যা জানার জেনে গিয়েছি। এখন এ বিয়ে আমি হতে দিবো না। ”

সালমা বেগমের উচ্চ স্বরের কথায় আফসার সাহেব ভীষণ ক্রোধিত হয়ে উঠলেন। এতোক্ষণ যাবত যে শান্ত মনমানসিকতা নিয়ে তিনি বসে ছিলেন তা আর ধরে রাখতে পারলেন না৷ প্রচণ্ড ক্রোধে কপালের রগ দৃষ্টিগোচর হলো। দৃষ্টি অসম্ভব কঠোর হয়ে এলো। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে সালমা বেগমের সম্মুখ পানে দাঁড়ালেন।দাঁতে দাঁত চেপে রাগত স্বরে বললেন,
” বা’জে বকো না। কি ভেবে বিয়ে ভাঙার কথা বললে তুমি? তোমার এ কথার কোনো সত্যতা আছে? আদিল যে সত্যিই বিবাহিত তার গ্যারান্টি কি? হতেও তো পারে মেয়েটা ওর গার্লফ্রেন্ড। তবে তুমি যাই বলো না কেনো, এ বিয়ে ভাঙা সম্ভব না।”

আফসার সাহেবের নিকট হতে আদিলের এহেন পক্ষপাতিত্বমূলক কথা শুনে সালমা বেগম যেনো আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি এই ভেবে অবাক হলেন, আদিলের সম্পর্কে সত্য জানার পরও তার স্বামী কি করে আদিলের পক্ষ নেয়৷ যেখানে তার মেয়ের পক্ষ নিয়ে তৎক্ষণাৎ বিয়ে ভেঙে দেওয়ার কথা ছিলো! আজ যেনো নতুন করে স্বামীর লুক্কায়িত এক রূপের সাথে পরিচিত হলেন সালমা বেগম৷ তিনি আফসার সাহেবের কথায় পিছপা হলেন না। বরং দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে বললেন,
” বেশ। আমিও দেখে নিবো আপনি আমার পুতুলের বিয়ে কিভাবে ঐ ছেলের সাথে দেন। যে ছেলে বিয়ের আগেই এমন ধোঁকাবাজি করেছে, আমাদের কাছ থেকে নিজের সম্পর্কের কথা লুকিয়েছে সে আর যাই হোক, ভালো মানুষ না। এমন মেয়ের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে কিছুতেই দিবো না। আবার আমার মেয়েও তো আদিলকে পছন্দ……”
রাগীবের সম্পর্কে কথা বলতে প্রস্তুতি নিতে নিতে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটিয়ে ফেললেন আফসার সাহেব। প্রচণ্ড ক্রোধে নিজেকে সামলাতে না পেরে অকস্মাৎ সালমা বেগমের গলা টিপে ধরলেন। স্বামীর এহেন কার্যে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়লেন সালমা বেগম৷ নিমিষের জন্য হতভম্ব দৃষ্টিতে আফসার সাহেবের পানে চেয়ে থাকতে থাকতেই তিনি গলায় প্রচণ্ড চাপ অনুভব করলেন। শ্বাসনালী বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে এলো। নিঃশ্বাস নিতে হাঁসফাঁস করতে লাগলেন তিনি। গলা হতে আফসার সাহেবের হাত সরিয়ে দিতে তীব্র প্রচেষ্টা চালালেন তিনি। কিন্তু আফসার সাহেবের ক্রোধের সামনে তিনি যেনো ক্ষুদ্র কোনো বস্তুতে পরিণত হলেন। আফসার সাহেব সালমা বেগমের গলা চাপ দিয়ে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে ক্রোধিত কণ্ঠে বললেন,
” আমার কাজের পথে কাঁটা হয়ে আসবে কেউ, এটা আমার সহ্য হয় না। আদিলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে হবে মানে হবেই। এট এনি কস্ট। খবরদার আমাকে বাঁধা দিতে আসবে না৷ তোমাকে যতটুকু করতে বলা হয়েছে ততটুকুই করবে৷ বাড়াবাড়ি কিছু করলেই ভয়ঙ্কর একটা পরিণাম ভোগ করবে তুমি।”

এই বলে আফসার সাহেব সালমা বেগমকে ছেড়ে দিলেন। সালমা বেগম দু হাত গলায় রেখে টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে গেলেন৷ এতোক্ষণ শ্বাসনালী অবরুদ্ধ হয়ে থাকার পর মুক্তি পেয়ে এ মুহূর্তে বড় বড় প্রশ্বাস নিলেন তিনি৷ সাথে সাথে বেশ কয়েকবার কাশিও দিলেন। আজ বহু বছর পর স্বামীর সেই লুক্কায়িত রূপের সম্মুখীন হলেন সালমা বেগম। হতভম্ব সালমা বেগম কিছু বলতে যাবেন, কিন্তু এর পূর্বেই দরজায় টোকা পড়ার শব্দে তিনি থমকে গেলেন। আফসার সাহেব হলেন সতর্ক। দরজার ওপাশে সাবিহা দাঁড়িয়ে আছে। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ডেকে চলছে বাবা মা’কে। তার কণ্ঠস্বর শুনে আফসার সাহেব আরো সতর্ক হলেন। ইশারায় সালমা বেগমকে বললেন এ ব্যাপারে নীরব থাকতে। অসহায় সালমা বেগম ঠিক তাই করতে রাজিও হলেন।

আফসার সাহেব গিয়ে দরজা খুলতেই হুড়হুড় করে রুমে প্রবেশ করলো সাবিহা ও সাবিত। দুজনের মুখশ্রীতে উদ্বিগ্নতার ছাপ। তারা আফসার সাহেবের রুমের খোলা জানালা দিয়ে ব্যাক ইয়ার্ডে চিৎকার চেঁচামেচি করতে শুনেছে। কিন্তু এ চিৎকার চেঁচামেচির বিষয়বস্তু স্পষ্টরূপে তাদের কান অব্দি পৌঁছায়নি। এ কারনেই এক ছুটে উপরে চলে এসেছে তারা। রুমে পৌঁছানো মাত্রই সাবিহা জিজ্ঞেস করলো,
” আব্বু? তোমরা ঝগড়া করছিলে কেনো?”

আফসার সাহেব আড় চোখে সোফায় বসে থাকা সালমা বেগমের দিকে চেয়ে বললেন,
” ঝগড়া না। যাস্ট একটু কথা কাটাকাটি হয়েছিলো। তাই না সালমা?”

সালমা বেগম ঠোঁট চেপে আগত কান্না আটকিয়ে রেখে মাথা ঝাঁকালেন। অর্থাৎ আফসার সাহেব সত্য বলছেন। আফসার সাহেব সাবিহাকে বললেন,
” তোরা একটু বাইরে যা তো। তোদের আম্মুর সাথে কিছু কথা আছে। ”

সাবিত আফসার সাহেবের কথার পিঠে কথা বলতে উদ্যত হলো। কিন্তু আফসার সাহেব তৎক্ষনাৎ বললেন,
” নো মোর ওয়ার্ডস সাবিত। যেতে বলেছি মানে যাবি। ”

বাবার আদেশ মান্য করে বাধ্য ছেলেমেয়ের ন্যায় রুম হতে বেরিয়ে এলো সাবিহা ও সাবিত। সাবিত বেরিয়েই নিজের রুমে চলে গেলো। কিন্তু সাবিহা সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। তার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খেলো নিজের বাবা মায়ের পরিস্থিতিসমূহ। সাথে এসে জড়ো হলো বেশ ক’খানা প্রশ্ন। যার উত্তর তার জানা নেই এবং সে চাইলেও হয়তো সেসবের উত্তর বের করতে পারবে না।

.

সালমা বেগম ও সাবিহার মাঝে বিরাজ করছে বিরাট ভীতিকর এক অনুভূতি। এ ধরণের মহা বিপজ্জনক এবং দুঃসাহসিক কাজ তারা আগে করেননি। বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে তারা। সেটাও আবার সকলের অগোচরে! আর কারণও বা কি! বিয়ে! বিয়ের জন্য তারা সকলের দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে এসেছে! এ যেনো এক অবিশ্বাস্যকর, শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনা৷ এ ঘটনার সূত্রপাত ঘটে গতকাল রাতে। গতকাল রাতে খাবার খেয়ে যখন সকলে ঘুমিয়ে পড়ে তখন সালমা বেগম সাবিহা ডেকে নিয়ে গেস্ট হাউজে রাগীবের কাছে যায়। তখন আদিল সম্পর্কে সবটা খুলে বলেন দুজনকে। তবে আফসার সাহেব সম্পর্কিত ঘটনাটি বাদে। তখনই সালমা বেগম সাবিহাকে অনেকটা ইশারার মাধ্যমেই রাগীবের মনের কথা জানিয়ে দেয় এবং রাগীবের কাছে সাবিহার বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে। রাগীব প্রথম পর্যায়ে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হওয়ার ভান করলেও পরে ঠিকই রাজি হয়ে যায়। কিন্তু সাবিহা মায়ের কথার বিস্মিত ভাবটা তখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। পরবর্তীতে সালমা বেগম ও রাগীব কিছু কথা বুঝিয়ে বললে সে বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। কারণ এ ছাড়া তার কাছে আর উপায় ছিলো না।
দুজনে বিয়েতে রাজি হতেই সালমা বেগম পালিয়ে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়ে বসেন। এটি তিনি রাগীবের নিকট আসার পূর্বেই ভেবে রেখেছিলো। কারণ এটি ব্যতিত আফসার সাহেবের ঘৃণ্য কবল থেকে মেয়েকে বাঁচানোর আর কোনো পথ খুঁজে পাননি তিনি৷
এদিকে সালমা বেগমের এহেন প্রস্তাবে ভীষণ অবাক হয়েছিলো সাবিহা ও রাগীব। রাগীব কখন ভেবে উঠতে পারেনি যে সালমা বেগম হেন দুঃসাহসিক একটি কাজের প্রস্তাব দিয়ে বসবে।
পরিবেশ পরিস্থিতি প্রতিকূলে থাকায় শাশুড়ীর প্রস্তাবে রাজিও হয়ে যায় রাগীব। ব্যস তখন থেকে কাজী সাহেবের ঘরে আসা অব্দি সবকিছুই নিজ পরিকল্পনায় সম্পন্ন করেছে রাগীব। মাঝে মাঝে লোকদেখানোর খাতিরে সালমা বেগমের নিকট হতে কিছু সাহায্যও নিয়েছে সে। যেনো সালমা বেগম তাকে সন্দেহ না করে বসে।

সালমা বেগম, সাবিহা ও রাগীব এ মুহূর্তে ভেনিসের মূল শহর হতে কিছুটা দূরে অবস্থিত একটি মুসলিম ঘরে অবস্থান করছে। আজ আদিল ও সাবিহার বিয়ে হওয়ার কথা। কিন্তু ভাগ্যের পরিক্রমায় আজ সাবিহা রাগীবের হবু স্ত্রী হতে চলেছে। আদিল ও সাবিহার বিয়ের সম্পূর্ণ কাজ আদিলের বাসায় অনুষ্ঠিত হবে। ফলে রাগীব, সাবিহা ও সালমা বেগমের বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়া বেশ সহজতর ছিলো। আফসার সাহেব, সাবিত ও সামাদ আগেই বেরিয়ে যায়। পথিমধ্যে সামাদ ড্রাইভারকে ফোন করে বলে সাবিহা বিয়ের জন্য তৈরী হয়ে নিলেই সালমা বেগম, সাবিহা ও রাগীবকে নিয়ে আদিলের বাড়িতে চলে আসতে। সেই সুযোগে ড্রাইভারের চোখে ধুলো মিশিয়ে তিনজনে রাগীবের ঠিক করা একটি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। আধ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে তারা এসে পৌঁছায় কাজী সাহেবের বাড়িতে।

কাজী সাহেব বেশ ধীরস্থিরতার সহিত বিয়ের রেজিষ্ট্রি খাতা নিয়ে চেয়ারে বসেন। তার এ ধীর স্থির গতির কাজ দেখে রাগীব মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হয়। কিন্তু সালমা বেগম ও সাবিহা দুঃশ্চিতায় অস্থিরতার সহিত বসে থাকে। কাজী সাহেবের হেন ধীর গতি দেখে সালমা বেগম আর না পেরে অস্থির ও আতঙ্কিত হয়ে বলে উঠলেন,
” তাড়াতাড়ি বিয়ের কাজ সেড়ে ফেলুন কাজি সাহেব। দেরি করবেন না।”
সালমা বেগমের আতঙ্কিত কণ্ঠে শুনে কিঞ্চিত বিস্মিত হলেন কাজী সাহেব। সালমা বেগমের কথার মর্মোদ্ধার করতে পারলেন না তিনি৷ ফলস্বরূপ রাগীবের দিকে চাইলেন তিনি। ইতালিয় ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন,
” এই আধ বয়সী মহিলাটা এভাবে কি বলতে চাইছে?”

হুটোপুটিপূর্ণ পরিবেশে কাজী সাহেবের এমন শান্ত রূপ দেখে রাগীব ভীষণ বিরক্ত হলো। এতো খুঁজে খুঁজে এই ভেনিস শহরে একটা কাজী পেয়েছে সে। কিন্তু কাজী সাহেবের এহেন আচরণে মনে হচ্ছে, নিতান্তই বোকাসোকা গোছের সে৷ রাগীব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো। অতঃপর কাজী সাহেবকে সালমা বেগমের কথাগুলো অনুবাদ করে শুনালো। তা শুনে কাজী সাহেব মৃদু হেসে ইতালিয় ভাষায় বললেন,
” অবশ্যই অবশ্যই৷ ছেলে মেয়েকে বসতে বলুন৷ ”

সালমা বেগম সাবিহাকে চেয়ারে বসালেন। তার দেখাদেখি রাগীবও বসে পড়লো। পরিস্থিতির শিকার সাবিহা সিক্ত চাহনিতে একবার কাজী সাহেবের দিকে তাকালো। অতঃপর এক পলক রাগীবের দিকে তাকিয়ে নিরংশু গলায় তার মাকে জিজ্ঞেস করলো,
” আম্মু? আব্বুকে ছাড়া এ বিয়ে কি করে সম্ভব? ”

সালমা বেগম উৎকণ্ঠিত গলায় মেয়েকে বুঝানোর চেষ্টা বললেন,
” এ পরিস্থিতিতে তোর বাবাকে কিভাবে আশা করতে পারিস পুতুল? তাড়াতাড়ি কবুল বলে বিয়েটা সেড়ে ফেল।”
এই বলে সালমা বেগম রাগীবের দিকে আকুতিপূর্ণ চাহনিতে চেয়ে বললেন,
” কাজী সাহেবকে দ্রুত কাজ করতে বলো বাবা। আমার খুব ভয় হচ্ছে।”

সালমা বেগমের কথার প্রত্যুত্তর স্বরূপ রাগীব আস্থাসম্পন্ন নজরে চাইলো৷ বললো,
” আপনি চিন্তা করবেন না আন্টি। সব ভালো হবে।”

রাগীবের কথায় খানিক আশ্রয়স্থল খুঁজে পেলেও স্বামীর কথা চিন্তা করে ভয়ে সংকুচিত হয়ে এলেন সালমা বেগম। তিনি জানেন না, ভবিষ্যতে কি হবে। তবে তিনি এটা জানেন যে, এ বিয়ে তার ভাগ্যে অশুভ কিছু বয়ে আনবে। যার ভাগিদারী হয়তো সাবিহাও হবে। এমনকি রাগীবও বাদ যাবে না। প্রচণ্ড মনে মনে দোয়া কালাম পড়তে লাগলেন সালমা বেগম। এদিকে কাজী সাহেব বিয়ের কার্যক্রম শুরু করলেন।

.

প্রচণ্ড ক্রোধে বড় বড় পা ফেলে রুমে পায়চারি করছেন আফসার সাহেব। সাবিহাকে বিয়ের আসরে না দেখে তার মস্তিষ্কের রক্ত গরম হয়ে উঠেছিলো। বিয়ের আসরে আদিলের বাবার কাছে ভীষণ অপমানিতও হয়েছিলেন তিনি। সাবিহা ও আদিলের বিয়ের মূল উদ্দেশ্য ছিলো বিজনেস ইনভেস্টমেন্ট। আফসার সাহেবের ব্যবসা মাঝ নদীতে ডুবন্ত নৌকার ন্যায় ডুবন্ত পর্যায়ে ছিলো। তখনই দূতের ন্যায় আদিলের বাবা প্রস্তাব দিয়ে বসে, সাবিহা ও আদিলের বিয়ে হলে তিনি আফসার সাহেবের ব্যবসায় বড় মাপের ইনভেস্টমেন্ট করবেন। ব্যবসা বাঁচানোর লোভে আফসার সাহেব চিন্তাভাবনা ছাড়া রাজিও হয়ে যান। কিন্তু আজ সাবিহা ও আদিলের বিয়ের কার্য সম্পন্ন না হওয়ায় আদিলের বাবা ইনভেস্টমেন্ট করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বসে। তীব্র অপমানে অপমানিত হয়ে আফসার সাহেবেও দ্বিতীয় কিছু বলে উঠতে পারেননি৷ এ মুহূর্তে তিনি চওড়া মেজাজ নিয়ে নিশ্চুপভাবে পায়চারি করছেন। তার এ পরিস্থিতি দেখে নির্বাক সামাদ এ পর্যায়ে বলে উঠলো,
” খালু? নিজেকে…..”

সামাদের কথা সম্পূর্ণ শেষ হতে না দিয়েই আফসার সাহেব এক প্রকার হুঙ্কার ছেড়ে বললেন,
” সামাদ, যেভাবে পারিস ঐ তিনটাকে খুঁজে আন। আমার চোখের সামনে ওদের দেখতে চাই। আমার সব প্ল্যানিং ভেস্তে দিয়ে কোথায় গেলো ওরা!”

আফসার সাহেবের এহেন কথা শুনে সামাদ ভীত হলো। সে এগিয়ে আফসার সাহেবকে শান্ত করাতে বললো,
” খালু, শান্ত হোন। এতো হাইপার মেজাজ নিয়ে কোনো কাজ করতে যাবেন না। ”

আফসার সাহেব পুনরায় সিংহের ন্যায় হুঙ্কার ছাড়লেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
” ওদের পক্ষ নিতে আসবি না সামাদ। না হলে তোকেও ওদের সাথে মে’রে ফেলবো। ”

সামাদ প্রচণ্ড আশ্চর্যান্বিত হলো। কণ্ঠে আকাশসম বিস্ময় প্রকাশ করে বললো,
” এসব কি বলছেন খালু! ”

” ঠিক বলছি। সবার আগে ঐ রাগীবকে খু’ন করবো। শা’লা আমার বাড়িতে থেকে আমার মেয়েকে নিয়েই পালিয়ে গেলো!”

” প্লিজ শান্ত হোন খালু। রাগের মাথায় উল্টাপাল্টা কিছু করে বসবেন না। ওরা আসুক। সব শুনুন। তারপর সিদ্ধান্ত নিন।”
আফসার সাহেব কিছু বললেন না। উপরন্তু রাগে ফুঁসতে লাগলেন।

পনেরো মিনিটের মাথায় বাড়িতে প্রবেশ করলো সালমা বেগম, সাবিহ ও রাগীব। সাবিহার পরনে শুভ্র রঙের একটি গাউন। ও রাগীবের পরনে সাদা শার্ট, কালো কোট ও প্যান্ট। এখানে বিয়েতে প্রত্যেকে এই পোশাকে সজ্জিত হয়ে বলেই রাগীব-সাবিহা নবদম্পতিও এ পোশাকে সজ্জিত হয়েছে।

আফসার সাহেব ও সামাদ রিডিং রুমে বসে আছে। সালমা বেগম তা আঁচ করত পেরে তুমুল সাহস সঞ্চয় করে রাগীব ও সাবিহাকে নিয়ে রিডিং রুমে উপস্থিত হলেন। রুমে কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে সামাদ ও আফসার সাহেব একত্রে পিঠ ঘুরিয়ে তাকালেন। রাগীব ও সাবিহাকে বিয়ের পোশাকে হাতে হাত রাখতে দেখে দুজনে ভীষণ বিস্মিত হলো। তবে আফসার সাহেব বিস্মিত কম ক্রোধিত হলেন বেশি। রাগীব ও সাবিহার একে অপরের হাতে হাত রাখা দেখে আফসার সাহেবের মূল ঘটনা বোধগম্য হতে বিলম্ব হলো না। তিনি রক্তপূর্ণ চোখে রাগীব ও সাবিহার দিকে কিয়ৎক্ষণ চেয়ে রইলেন। তন্মধ্যে সালমা বেগম শুকনো একটা ঢোক গিলে অন্তঃস্থলে সাহস সঞ্চারিত করে এক নিঃশ্বাসে বললেন,
” রাগীব ও সাবিহার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ”
এই বলে তিনি সজোরে চোখের কপাট রুদ্ধ করে নিলেন। এ মুহূর্তে আর আফসার সাহেবের সম্মুখীন হওয়ার সাহস তার মাঝে নেই। এদিকে বাবার এ নির্বাক ক্রোধিত রূপ দেখে সাবিহা ভয়ে অসার হয়ে এলো। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। কিন্তু রাগীব, সে একেবারে নির্ভীক মনোভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাঝে ভয়ের লেশমাত্র উপস্থিত নেই। ভয়ংকর এ পরিস্থিতিতেও সে ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেনো সে সকল প্রকার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। অপেক্ষা শুধু তার প্রিয় শ্বশুড় আব্বার।

আফসার সাহেব নির্বাক রইলেন। কিন্তু তার চোখে ক্রোধের অনল যেনো দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগলো। তার এ শান্তশিষ্ট রূপ দেখে সামাদ কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেলো। কারণ আফসার সাহেবের এ রূপ মানে সে জানে, এটি ঝড় আসার পূর্ব মুহূর্তের সংকেত। ফলে আফসার সাহেবের আগাম কিছু কার্যের কথা চিন্তা করে সামাদ মনে মনে প্রতিরক্ষার অঙ্ক কষতে লাগলো। তার এ কার্যের মাঝেই অকস্মাৎ আফসার সাহেব টেবিলের উপরে রাখা পি’স্ত’ল নিয়ে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেলেন রাগীবের দিকে এবং সহসা রাগীবের কপালের দিকে পি’স্ত’ল ঠেকিয়ে ধরলেন। মুহূর্তে ট্রিগারে আঙুল রেখে রাগীবের কপালের সাথে দৃঢ়ভাবে পি’স্ত’ল ঠেকালেন তিনি। ক্রোধের অনলে চিবিয়ে চিবিয়ে রাগীবের উদ্দেশ্যে বললেন,
” আজ আমার হাতেই তোকে ম’র’তে হবে রা’স’কে’ল। এই পি’স্ত’লের সবকটা গু’লি তোর মাথায় ভরে তবেই দম নিবো আমি। ”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here