প্রমত্ত_হৃদয়❤️,১৬

0
1192

#প্রমত্ত_হৃদয়❤️,১৬
#লেখনীতে:সারা মেহেক

আফসার সাহেবের হাতে পি’স্ত’ল দেখে ভীষণ ঘাবড়ে গেলো সাবিহা। তার চাহনিতে স্পষ্ট ভীতির ছাপ। সে আফসার সাহেবের পানে চেয়ে ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠে বললো,
” এটা কি করছো আব্বু! মাথা ঠাণ্ডা করো।”

আফসার সাহেব পূর্বের ন্যায় সাবিহার উদ্দেশ্য বললো,
” তুই একটা কথাও বলবি না পুতুল। তোর সাহস কি করে হয় আমার পারমিশন ছাড়া এতো বড় কাজ করার! এতো সাহস কোথা থেকে আসে তোর?”

সাবিহা নির্বাক। আফসার সাহেবের এ ভয়ংকর রূপের সম্মুখীন সে পূর্বে কখনো হয়নি। এতোটা হিংস্রতাপূর্ণ রূপ দেখে সে যারপরনাই ভীত। বাবার এ কর্মকাণ্ডে সে এতোটাই হতবাক হয়ে আছে যে রাগীবকে রক্ষার্থে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না সে। এদিকে সালমা বেগম চোখ মেলেই এহেন দৃশ্যের সম্মুখীন হয়ে ক্ষণিকের জন্য অসার হয়ে রইলেন। অতঃপর খানিক বাদে নিজের মাঝে সাহস সঞ্চারিত করে আফসার সাহেবকে প্রতিহত করে এগিয়ে গেলেন। ততক্ষণে সামাদও এগিয়ে এসেছে। আফসার সাহেবের এ ধরণের হিংস্র রূপের সাথে যেহেতু সে পূর্ব পরিচিত সেহেতু সে সহজেই আফসার সাহেবের সম্মুখীন হওয়ার সাহস রাখে। সে সূত্র ধরেই সে এগিয়ে এসে আফসার সাহেবের ডান হাত ধরে বাম দিকে সরিয়ে বললো,
” অবুঝের মতো কাজ করতে যাবেন না খালু। ”

আফসার সাহেব সামাদের নিষেধাজ্ঞা মানলেন না। বরং পুনরায় রাগীবকে গা’ন পয়েন্টে রাখলেন। এদিকে সাবিহা ও সালমা বেগম এহেন পরিস্থিতিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। আফসার সাহেবকে ঠিক কি বলে থামানো সম্ভব সে প্রক্রিয়া তাদের মস্তিষ্কে কাজ করলো না।
আফসার সাহেব রাগীবকে গা’ন পয়েন্টে রেখে বললেন,
” তোকে আমি ভালো ভেবেছিলাম রাগীব। কিন্তু তুই আমাকে এতো বড় একটা সারপ্রাইজ দিয়ে বসবি তা কল্পনাও করিনি। ”

রাগীব প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না। নিরস চাহনিতে চেয়ে রইলো আফসার সাহেবের নেত্র বরাবর। তার এ নির্ভীক রূপ দেখে আফসার সাহেব কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
” কি? ভয় করছে না তোর? তুই জানিস এ পি’স্ত’লের পাওয়ার কত?”

রাগীব এবারও জবাবে কিছু বললো না। আফসার সাহেব দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। অদ্ভুত! রাগীব এমন সংকটময় পরিস্থিতিতেও কিভাবে শান্ত ও নিরাতঙ্ক আছে, তা ভেবে কূল পাচ্ছেন না আফসার সাহেব। এই ভাবনার তোড়ে তিনি অন্যমনস্ক হয়ে এলেন। ফলস্বরূপ তার হাতের বাঁধন কিঞ্চিৎ শিথিল হয়ে এলো। এরই সুযোগে সামাদ আফসার সাহেবের হাত হতে চট করে পি’স্ত’ল নিয়ে নিলো। তৎক্ষনাৎ আফসার সাহেব সচকিত দৃষ্টিতে সামাদের দিকে চাইলেন। তিনি কিছু বলতে যাবেন কিন্তু এর পূর্বেই সালমা বেগম বললেন,
” আপনি শান্ত হোন দয়া করে। নিজ হাতে নিজের জামাইকে মারবেন না কি? মেয়ের কথা তো একবার চিন্তা করুন।”

সামাদ, সালমা বেগমের সাথে সম্মতি জানালো। বললো,
” হ্যাঁ খালু। খালা ঠিক বলেছে। আপনি ঠাণ্ডা হোন, যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। এখন চাইলেও কিছু করা সম্ভব না। রাগীবকে অপছন্দ করে থাকলেও সাবিহার জন্য এখন ওকে মেনে নিতে হবে। ”

আফসার সাহেব কিছু বললেন না। ক্রোধিত চাহনিতে সামাদের দিকে একবার চাইলেন। অতঃপর চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে রাগীবের দিকে চেয়ে শীতল কণ্ঠে হুমকি স্বরূপ বললেন,
” কাজটা ভালো করোনি তুমি। এর জন্য তোমাকে খুব পস্তাতে হবে রাগীব।”

এই বলে তিনি বড় বড় পা ফেলে রিডিং রুমের অভ্যন্তরে অবস্থিত ছোট আরেকটি রুমে চলে গেলেন। তিনি চলে যেতেই সালমা বেগম ও সাবিহা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। রাগীব স্থির দেহভঙ্গি হতে কিছুটা নড়েচড়ে পিছিয়ে এলো। প্রলম্বিত একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে চিন্তিত হওয়ার ভণিতা করে বললো,
” আমার মনে হয় না আংকেল রাজি হবে। ”

সালমা বেগম চিন্তিত তবে আশ্বস্তমূলক কণ্ঠে বললেন,
” হবে হবে। কতদিন আর এভাবে থাকবে। একসময় না একসময় ঠিকই রাজি হবে। তবে আমাদেরকে চেষ্টা চালাতে হবে। শুধু বসে থাকলে হবে না। পুতুলের বাবা পুতুলকে খুব ভালোবাসে। এখন রাগ হলেও পরে ঠিকই পুতুলের কথা চিন্তা করে রাজি হয়ে যাবে। ”

প্রত্যুত্তরে রাগীব স্মিতহাস্যে বললো,
” আই হোপ তাই যেনো হয়৷ ”

এদিকে সামাদ আফসার সাহেবের যাওয়ার পর থেকেই একাধারে রাগীবকে পর্যবেক্ষণ করছিলো। রাগীব যে এতো বড় একটা কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলবে তা সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি৷ সে সন্দিহান চাহনিতে রাগীবের দিকে কিয়ৎক্ষণ চেয়ে রইলো। অতঃপর হাতের পি’স্ত’লটা কোমড়ের পিছনে গুঁজে রাগীবকে জিজ্ঞেস করলো,
” তাহলে এসব তোমার প্ল্যান ছিলো?”

রাগীব অবুঝ হওয়ার ভান করে জিজ্ঞেস করলো,
” কোন সব?”

” এই তো বিয়ের। মানে সাবিহাকে পালিয়ে নিয়ে বিয়ে করার?”
এই বলে সে কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত নেত্রজুগল দ্বারা রাগীবের দিকে চেয়ে রইলো। রাগীব তার প্রশ্নের জবাবে কিছু বলতে যাবে কিন্তু এর পূর্বেই সাবিহা চট করে বলে উঠলো,
” রাগীবের না। প্ল্যানটা আম্মুর ছিলো সামাদ ভাই।”

সাবিহার এহেন কথা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না সামাদ। হেন আশ্চর্যান্বিত খবর শুনে সে যেনো আকাশ হতে পড়লো। সে কিছুতেই নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারলো না এটা তার খালার পরিকল্পনা ছিলো। তার বিস্ময়াভিভূত ভাবটি বেশ কিছুক্ষণ তার মুখশ্রীতে স্পষ্টরূপে দর্শন হলো। এদিকে সামাদের হেন প্রতিক্রিয়া দেখে রাগীব লুকিয়ে লুকিয়ে হাসলো। কিন্তু সালমা বেগম ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলেন৷ ফলস্বরূপ তিনি নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিয়ৎক্ষণ বাদে সামাদ কণ্ঠে আকাশসম বিস্ময়তা প্রকাশ করে বললো,
” এসব আপনার প্ল্যানিং ছিলো খালা!”

সালমা বেগম সংকুচিত হলেন। অত্যন্ত নিম্ন কণ্ঠে বললো,
” হ্যাঁ।”

সামাদের চক্ষুজোড়া যেনো বিস্ময়ে চক্ষুকোটর যাওয়ার উপক্রম হলো। সে সালমা বেগমের এ রূপ সম্পর্কে অনবহিত ছিলো। সে চরম বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
” সিরিয়াসলি খালা! এসব আপনার প্ল্যানিং ছিলো! আই কান্ট বিলিভ ইট। আপনি খালুর বিপক্ষে গিয়ে কি করে পারলেন এটা করতে?”

সালমা বেগম এবার মাথা তুলে চাইলেন। খানিক সিক্ত কণ্ঠে বললেন,
” মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই এটা করার সাহস পেয়েছি। আদিলের সম্পর্কে সবটা জানার পরও তো আমি ওর বিয়ে পুতুলের সাথে দিতে পারি না তাই না?”
সালমা বেগমের শেষোক্ত কথাটি শুনে ভ্রুজুগল কুঞ্চিত করলো সামাদ। সন্দিহান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” কি জেনেছেন আদিলের সম্পর্কে? ”

” সে কথা পরে বলবো তোকে। তুই আপাতত তোর খালুকে রাজি করানোর চিন্তা কর। ”

” হ্যাঁ। কিছুক্ষণ যাক। খালু কিছুটা শান্ত হোক। তারপর এ নিয়ে কথা বলবো।”
এই বল সে সাবিহার দিকে স্নেহাসিক্ত চাহনিতে চাইলো। সাবিহার মাথায় হাত রেখে স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করলো,
” তুই রাগীবকে পছন্দ করিস সাবিহা?”

সাবিহা মৃদু গতিতে মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো। সামাদ পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
” বিয়েতে খুশি তো?”

” হ্যাঁ সামাদ ভাই। কিন্তু আব্বু….”

” খালুর কথা চিন্তা করিস না। খালুকে সামলানোর ও রাজি করানোর দায়িত্ব আমার। আমি সবকিছু করতে রাজি আছি। শুধু তুই খুশি থাকলেই হবে। ”

সাবিহা প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না। মৃদু হাসলো। সামাদ সাবিহাকে পেরিয়ে এগিয়ে রাগীবের সম্মুখে দাঁড়ালো। কিয়ৎক্ষণ রাগীবের দিকে চেয়ে থেকে আচমকা হেসে বললো,
” আমি ভাবতেও পারিনি শেষমেশ তুমি আমার বোনজামাই হবে৷ সাবিহা যে তোমাকে পছন্দ করে, এটা আগে জানলে আমি নিশ্চিত এ বিয়ে আটকানোর চেষ্টা করতাম। ”

রাগীবও সামাদের তালে হেসে বললো,
” আংকেলের যে চেহারা আজ দেখলাম, মনে হয় না তোমার কথায় রাজি হতো। অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতো হয়তো।”

” তা তো হতোই। তবে সাবিহা তো খুশি হতো। বাই দা ওয়ে, তুমি সাবিহাকে পছন্দ করো তো?”

” পছন্দ না করলে এতো রিস্ক নিয়ে বিয়েটা করতাম না। ”

” ব্যস। তাহলে আর চিন্তা কিসের। এবার রুমে গিয়ে রেস্ট নাও। আপাতত সাবিহার রুমে যাও৷ পরে সুযোগ সুবিধামতো গেস্ট হাউজ থেকে সব ট্রান্সফার করে সাবিহার রুমে চলে এসো। ”

” আপাতত সাবিহার রুমে উঠছি। তবে খুব শীঘ্রই আমাদের জন্য আলাদা বাসা ভাড়া নিবো। কজ ঘর জামাই হিসেবে থাকার প্ল্যান মোটেও করিনি আমি। ”
এই বলে রাগীব হেসে উঠলো। তার সাথে হেসে উঠলো সামাদও। অতঃপর সালমা বেগম সাবিহা ও রাগীবকে নিয়ে সাবিহার রুমে পৌঁছে দিয়ে আসলো।

সারাদিনের দৌড়াদৌড়ির ধকল সামলে উঠতে না পেরে সাবিহা প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো। ফলস্বরূপ রুমে ঢুকে পোশাক বদলিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ে। রাগীবও পোশাক বদল করে শুয়ে পড়ে। তবে তার চোখে ঘুম আসে না। সে পরিকল্পনা করতে থাকে তার পরবর্তী পদক্ষেপের ব্যাপারে।

.

অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছেন আফসার সাহেব। তন্মধ্যে একটি অচেনা নাম্বার থেকে কল এসে তাকে বলা হয়, তার জন্য জরুরি পার্সেল এসেছে। আফসার সাহেব অফিসের জরুরি পার্সেল ভেবে নিশ্চিন্তে পার্সেল নিতে নিচে চলে আসে। দরজা খুলে ডেলিভারি ম্যানকে দেখে তার কাছ থেকে পার্সেল নিজ হাতে নেন তিনি। পার্সেলটি কে পাঠিয়েছে তা জানতে তিনি পুরো পার্সেল এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখেন। কিন্তু চূড়ান্তভাবে তিনি প্রেরকের নাম ঠিকানা কিছুই খুঁজে পান না। এ সম্পর্কে ডেলিভারি ম্যানকে জিজ্ঞেস করলে ডেলিভারি ম্যান জবাব দিতে ব্যর্থ হয়। এতে আফসার সাহেবের মনে সন্দেহের দানা বাঁধতে শুরু করে।
ডেলিভারি ম্যান চলে যেতেই তিনি অতি আগ্রহী হয়ে দরজায় দাঁড়িয়েই পার্সেলের মোড়ক খুলে ফেলেন। মোড়ক খু্লতেই তিনি দেখেন কাগজের একটি বাক্স। এর ভেতরে কি আছে তা জানতে তিনি দ্রুতই কাগজের বাক্সের উপরাংশ এক প্রকার ছিঁড়েই ফেলেন। অতঃপর কাগজের বাক্সটি পুরোপুরি উন্মুক্ত করে তিনি আগ্রহী হয়ে ভেতরে চাইলেন। পার্সেলে আসা জিনিসটি দেখে বুঝে উঠতে তিনি কয়েক সেকেন্ড সময় নিলেন। অতঃপর পার্সেলের ভেতরে তিনি যা দেখলেন তার সম্মুখীন হওয়ার জন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। পার্সেলটি দেখে তার চেহারা পাংশুটে বর্ণ ধারণ করলো। তার গলা শুকিয়ে যেতে লাগলো। অকস্মাৎ এমন কিছু দেখতে পাবেন তা জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। ভয়ে অসার হয়ে আসা পা দুটো নিয়ে পার্সেলসহ কোনোমতে ভেতরে ঢুকলেন আফসার সাহেব।

এদিকে আফসার সাহেবের প্রতিটি পদক্ষেপ গেস্ট হাউজ থেকে পর্যবেক্ষণ করছিলো রাগীব। প্যান্টের দু পকেটে হাত রেখে আয়েসী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার ঠোঁটের কোনে প্রহেলিকার ন্যায় হাসি। চাহনিতে তৃপ্তির ছাপ। আফসার সাহেবের হেন পরিস্থিতি লক্ষ্য করে সে উদ্বেগহীনতার সহিত অভিলাষের সুরে বললো,
” লেটস বিগেইন দ্য গেইম ম্যান।”
এই বলে সে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here