#তবু_কেন_এত_অনুভব_সিজন_২?,৮ম_পর্ব
#written_by_Liza
” মর-নদশা বিয়ে খেতে চলে আসছে,জীবনে যেনো খায় নি। আমাকে টর্নেডো বলা? আগে বিয়েটা ভাঙ্গুক এরপর জন্মের খাওয়া ঘুছিয়ে দেবো আমি বলে দিলাম”
হুজুর আজীম শেখ’কে বলে “বর কই?”
মাফলার পরা লোকটি দ্রুত পায়ে বেরিয়ে পরলো বরকে খোঁজার জন্য,ইনান পিছু পিছু যেতে লাগলো। আশেপাশে উঁকি দিয়ে দেখছে বরকে পাওয়া যায় কি-না।
কোথাও কোনো সাড়া শব্দ নেই,ইনান পা টিপে টিপে লোকটিকে অনুসরণ করছে। কিছুদুর যেতেই দেখা গেলো গাছের ঢালে একটা লোক ঝুলে আছে, মুখে কাপড় বাঁধানো। গাছের নিচে রাফি বসে পাহারা দিচ্ছে।
মাফলার পরা লোকটি দৌড়ে এসে রাফির গালে চড় বসিয়ে দিলো আর অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগলো। কারণ গাছের ঢালে বরকে পিটিয়ে কে যেনো বেধে রেখেছে। মাফলার পরা লোকটি বুঝতে পেরেছে কোনো বড় রহস্য আছে এখানে। রাফির কলার ধরে কোমড় থেকে চাকু(ছুরি) বের করে বলতে লাগলো “জামাই আটকাইয়া রাইখা পার পাইয়া যাবি ভাবছিলি নি? দেখ এহন তোর কী অয়”
যেই না ছুরি রাফির গলায় বসাতে যাবে অমনি ইনান বাশ দিয়ে লোকটির মাথায় বারি দেয়৷ লোকটি মাথা ধরে মাটিতে লুটিয়ে পরে। গ্রামের সবাই বিয়ে বাড়িতে তাই রাস্তাঘাট অনেকটা ফাঁকা। কেউ কিছু দেখে নি।
রাফি ইনানকে দেখে স্বস্তির হাসি হেসে দেয়। ইনান বলে রাফিকে “আমি আছি কিছু হবে না তোমার”
রাফি মুচকি হেসে ইনানকে বলে “কিছু হওয়ার চান্স নেই ইনান ভাই,পুলিশ আসতেছে ঐ যে দেখেন”
ইনান পুলিশকে দেখে রাফির সাথে হাই-ফাইভ করে। এদিকে মাফলার পরা লোকটি পালাতে গেলেই ইনান লোকটির কলার ধরে পুলিশের পায়ের দিকে ছুড়ে ফেলে দেয়।
লোকটি পুলিশের পা ধরে বলে “আমারে মাইরালাইবো এরা,বাঁচান আমারে দারোগা সাব”
পুলিশ লোকটিকে তুলে দাড় করিয়ে বলে “নিশ্চয়,তার আগে আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে”
পুলিশ লোকটিকে গ্রেফতার করে,এদিকে গাছের সাথে বেঁধে রাখা পাচারকারী বর সেজে আসা লোকটিকে গ্রেফতার করে। তাদের দুজন আসামীকে নিয়ে বিয়ে বাড়িতে যেতে লাগলো পুলিশ। পেছনে ইনান আর রাফি হাসাহাসি করে হেটে যাচ্ছে বিয়ের ভেতর।
বিয়ে বাড়িতে পুলিশের আগমনে সবাই আৎকে উঠে, এদিকে হুজুর অপেক্ষা করতে করতে রেগেমেগে বের হয়ে যায় ঘর থেকে।আজীম শেখ অসহায়ের মত মেয়ের বিয়ে ভাঙ্গন দেখছে চুপচাপ। হুজুর, পুলিশ আসতে দেখে দৌড়ে পালিয়ে যেতে চাইলেই পুলিশের খটকা লাগাতে পুলিশ এর স্টাফ যেতে দেয় না হুজুরকে।
হুজুর ভয়ে আকুতি মিনতি করে বলে “আমি কিতা করছি? আমারে ছাইড়া দেন”
গ্রামে পুলিশ দেখে পুরো গ্রামবাসী ছি ছি করছে,সবাই বিয়েটাকে অশুভ বলতে লাগলো।দোয়ার মা মুখে কাঁপড় গুজে কাঁদছে মেয়ের বিয়ে ভাঙ্গন দেখে।
ইনান ঘর থেকে দোয়াকে হাত ধরে টেনে বের করে উঠোনে নিয়ে আসে, ইনানকে উপকারের জন্য দোয়া সকলের সামনে ধন্যবাদ দেয়। ইনানের সাথে রাফিকে দেখে দোয়া বলে উঠে “সকাল থেকে কই ছিলি? তোকে পাইনি কত খুঁজেছি”
রাফি মুচকি হেসে কোনো কথা বললো না। ইনান দোয়াকে বলছে “আমি কিছুই করিনি দোয়া ম্যাম,যা সাহায্য করেছে রাফিই করেছে। আমি তো কিছুই জানতাম না এসব”
দোয়া থ বনে গেলো,দোয়া সকলের মাঝখানে বলে উঠলো “তাহলে এর পেছনে কে আছে? কে বরকে গায়েব করেছিলো? ইনান ভাইয়া আপনি ছিলেন না তাহলে?”
তানাফ দুরে এক পাশে দাঁড়িয়ে ফোন টিপছে আর চুইংগাম চিবোচ্ছে। রাফি আঙ্গুল তাক করে দেখিয়ে দেয় তানাফের দিকে। দোয়া রাফির ইশারা দেখে হতবাক।
ইনান বিশ্বাস করতে পারছে না তানাফের এই অদ্ভুত কাজগুলো। ইনান মনে মনে শুকরিয়া আদায় করে বলে “ভালো হয়েছে আসামী শাস্তি পাবে এবার”
রাফি এবার সকলের সামনে বলতে লাগলো সব,
ফ্ল্যাশব্যাক-
দোয়ার বিয়ের খাওয়াদাওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে,এদিকে ইনান তৈরি হয়ে কেউকে কিছু না জানিয়ে চলে যায়৷ রাফি নদীর ঘাটে বসে চোখের পানি ফেলছে বান্ধবীর এত বড় সর্বনাশ হতে যাচ্ছে,তার কিছু করার মতো জো নেই।।
হঠাৎ রাফির কাঁধে কারো স্পর্শ,
রাফি ভয়ে আৎকে উঠে, রাফি মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দেখে ডক্টর তানাফ আজমী তার পাশে। তানাফ রাফিকে বলছে “কেঁদে কখনো কিছুর সুরাহা করা যায় না। পরিস্থিতি হলো গেইমের মতো। হুটহাট পাশা উল্টে যাবে ধরতেও পারবা না। চোখ মুছে চলো আমার সাথে”
রাফি তানাফের কথায় চুপচাপ বাধ্য ছেলের মতো চোখ মুছে দাঁড়িয়ে পরে, তানাফ রাফিকে বলতে থাকে “যা করতে হবে কেউ না জানে ওভাবেই করতে হবে,ইনান যেনো কিছু না জানে।”
কেন তানাফ ভাই? ইনান ভাই জানলে কী হবে? (রাফি)
ইনানকে বলে দিলে ইনান নিজের উপর ভরসা করা ছেড়ে দিবে,পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারবেনা। ইনানের বিয়েতে থাকা জরুরি৷ কারণ ঐ লোকগুলো ইনানকে টার্গেট করেছে। ইনান যদি আমাদের সাথে থাকে তাহলে তারা ইনানকে না দেখে টের পেয়ে যাবে,ইনান যে কিছু একটা গড়বড় করবে সেটা।তাই ইনান কিছু না জানুক আমি চাই। ইনান সেখানে থাকুক আফসোস করুক। এতে পাজি লোকগুলো ভরসা পাবে যে তারা সাক্সেস। বুঝলা এবার? (তানাফ)
রাফি এক গাল হেসে বলে, বাহ ভাই কী বুদ্ধি,তানাফ রাফির কাঁধে হাত রেখে বলে “ডক্টরদের মাথায় কী চলে সেসব তোমরা বুঝবা না। ডক্টররা ঠান্ডা মাথায় খেলোয়াড়, নাহলে বলো তো,তাড়াহুড়ো করে কারো অপারেশন করা যায়? রিস্ক আছে না? তাই ঠান্ডা মাথায় ডক্টররা অস্ত্রো—পচার করে। যাতে রোগী ভালো থাকে।”
রাফি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে “হুম ঠিক ভাই”
তানাফ রাফির কাছ থেকে সব ইনফরমেশন কালেক্ট করে পুলিশদের ইনফর্ম করে, এরপর বিয়ে বাড়িতে রুমালে স্প্রে করে সোজা চলে যায় তানাফ। মায়াকে দিয়ে দোয়ার বরকে সেই রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে দেয়। মায়ার আদর যত্নকে শালীকার আদর যত্ন ভেবে সাতপাঁচ না ভেবে মুখ মুছে নেয় দোয়ার বর।
মিনিট খানেকের মধ্যে সেন্স হারায় বর,ঠিক তখন’ই ইভা মায়া বাড়িতে ঢুকে সবাইকে চেচিয়ে বলে “বর এসেছে বর এসেছে। সবাই বাড়িতে আগেভাগে ঢুকে পরে দোয়ার বিয়ে দেখার জন্য। এদিকে জায়গা ফাঁকা হতেই বরকে রাফি ও তানাফ তুলে নিয়ে যায়।
বর থেকে সকল টাকা ও কাগজপত্র নিয়ে গাছের সাথে বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় মুখে কাপড় বেঁধে। যাতে সেন্স ফিরলে বর আওয়াজ করতে না পারে।
রাফিকে গাছের নিচে পাহারা দিতে বলা হয়।
ঠিক সেই সময় তানাফ বিয়ে বাড়িতে এন্ট্রি নেয়।
বর্তমান-
দোয়া ধপ করে মাটিতে বসে পরে সবটা শুনে,দোয়ার মা উঠোনের মাঝখানে এসে বিলাপ ধরে কাঁদে আর বলে ” আমার মাইয়া কী সর্বনাশ হইলো গো”
ঠিক তখনি রাফি আবারো বলে “সর্বনাশ তো তহন অয়তো চাচি,যহন ঐ ব্যাডা বিয়া কইরা বেঁইছা লাইতো তহন।”
পুলিশ লোকগুলোর জবানবন্দি নেয় সকলের সামনে,মাফলার পরা লোকটি ভয়ে বলতে শুরু করে সব “আমার দোষ নাই দারোগা সাব,আমারে নাদিম কইছে ইডা করবার লাগি। কইছে দোয়ারে বেঁইচ্ছা টাহা লইয়া তারে জেল থেইক্কা ছুটাইতাম। নাদিম কইছে আজীম ভাইরে শিক্ষা দিতো”
লোকটির কথা শুনে আজীম শেখ কাঁদছে,দোয়া তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে ভয়ে কেঁদে দেয়।
পুলিশ লোকগুলোকে নিয়ে চলে যায়। ইনান তানাফকে জড়িয়ে ধরে বলে “স্যার ভাবতে পারি নি আপনি এতটা উপকার করবেন। আমি অনেক খুশি আজকে। সার্থক জীবন আমার আপনার এসিস্ট্যান্ট হতে পেরে।”
তানাফ ইনানের কান মলে দিয়ে বলে “তুমি আমার এসিস্ট্যান্ট নও ছোট ভাই হও।”
তানাফ রাফি ও ইনানকে জড়িয়ে ধরে। পুরো গ্রামবাসী খুশি।
আজীম শেখ কী বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে তানাফের কাছে ভাবতে পারছে না। তানাফ আজীম শেখ’কে বলে “আমি আপনার জন্য বাকি দশ মেয়ের মতো আপনাদের দোয়াকে বাঁচিয়েছি। মানুষ হিসেবে এটা আমার কর্তব্য।”
এদিকে দোয়া লজ্জায় নিশ্চুপ,গ্রামের মুরুব্বিরা বলছে “মাইয়ার বিয়া ভাঙ্গন ভালা না,অমঙ্গল”
তানাফ মাঝখানে বলে উঠে “আপনারা এখনো পুরোনো জমানায় থেকে গেলেন,বিয়ে ভাঙ্গন উচিৎ না বলতে পারেন এদিকে মেয়েটার বিয়ে হয়ে মা–রা যেতো সেটা ভাবতে পারেন না?”
কেউ আর তানাফের কথায় কথা বাড়ায়নি চলে যায় যে যার মতো। আজীম শেখ তানাফের হাত ধরে কান্না করছে আর বলছে “বাবারে আমি হয়তো বাঁচবো না।আমার মেয়েটারে তুমি একটু ঠাই দেও। তোমার কাছে দিয়ে আমি নিশ্চিন্তে ম-রতে চাই”
তানাফ বিপাকে পরে গেলো,তানাফ মনে মনে বলছে “উপকার করতে গিয়ে দেখি আমার গলায় টর্নেডো ঝুলছে। আমি কী করে রিজেক্ট করবো বুঝতেছি না। এদিকে অনু জানতে পারলে সব শেষ আমাদের”
তানাফের হাত ধরে কাঁদছে আজীম শেখ,তানাফ কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না গলায় দলা পাকিয়ে যাচ্ছে কথাগুলো। আজীম শেখ এর কান্না যেনো তার সবকিছু উলোটপালোট করে দিচ্ছে। তানাফ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে হাটু গেড়ে বসে পরে, চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে “ঠিকাছে, আপনার কথা রাখলাম”
ধুমধাম করে দোয়া ও তানাফের বিয়ে হয়। ইনান খুব খুশি। রাফি, ইনান,মায়া, ইভা বেজায় খুশি।
রাতে সবাই শহরে রওনা দিবে, দোয়ার সবকিছু গোজগাজ করছে তার পরিবার।
দোয়া বাবার আকুতি মিনতি দেখে বিয়ে করেছে,দোয়ার সাহসে কুলোয় নি তার বাবাকে আঘাত করতে। চুপচাপ বিয়ে করে বাবার ঘাড় থেকে তার বোঝা নামিয়ে নিলো।
দোয়া তার বাবার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আর মনে মনে বলছে “আজ আমার বোঝা নিতে না পেরে আব্বা তুমি আরেকজনের কাছে হাতে পায়ে ধরলা। ঠিকাছে আব্বা তুমি ভালা থাইকো,আমি তোমাগো বাড়ির বোঝা হমুনা। খুব ভালা থাইকো।আমি আসমুনা আর”
যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে দোয়াকে বিদায় দেয়া হচ্ছে,ইভা মায়া খেলার সাথীকে বিদায় দিতে গিয়ে বার-বার দোয়াকে আঁকড়ে ধরছে,কাঁদছে।
ইনান মায়াকে বলে “কান্না করো না,আবার দেখা হবে তোমাদের দোয়া ম্যামের সাথে। নিজেদের খেয়াল রেখো। আর রাতে বাহিরে বের হয়ো না। এই নাও আমার নাম্বার, কথা হবে, দরকার হলে ফোন দিও।গ্রামে সবার আপডেট দিও”
মায়া নাম্বারের কাগজটি ওড়নায় পেঁচিয়ে গিট্টু দেয়। তানাফ আড়চোখে ইনানের কান্ড দেখছে। ইনানকে ইশারা দিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলেই ইনান ক্যাবলার মতো হাসি দিয়ে সরে যায়।
এদিকে রাফি ইভা একপাশে দাঁড়িয়ে আছে হাত ধরে,তানাফ রাফির দিকে তাকিয়ে রাফির কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে “ওরে ভেতরে ভেতরে এত কিছু? যাক ভালো লাগছে দু’জনকে। শুভ কামনা”
রাফি লজ্জায় ইভার হাত ছেড়ে দিয়ে আলাদা হয়ে দাঁড়ায় আর বলে “আমার বান্ধবীরে একটু দেখিয়েন।ওঁকে কষ্ট দিয়েন না,ও সরল তাই কিছু সিরিয়াস নেয় না। আপনার হাতে তুলে দিলো আপনি ওঁকে আগলে রাখিয়েন”
তানাফ রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে “হয়েছে মুরুব্বি, তোমরাও ভালো থেকো। জলদি বিয়ের দাওয়াত দিও।গ্রামে আবারো আসবো স্পেশালি তোমার আর ইভার বিয়েতে। চলি”
গ্রামের সবাইকে বিদায় দিয়ে সবাই স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হলো
চলবে….
[গ্রামীন জীবন শেষ হতে চললো বোধহয়]