৫ম_তলার_মেয়েটা,পর্ব-০৫,০৬

0
909

#৫ম_তলার_মেয়েটা,পর্ব-০৫,০৬
ফাহমিদা_লাইজু
#পর্ব_৫

বাড়িওয়ালার বোন জামাই , নওমির পথ রোধ করে দাঁড়ালো।
রাস্তার পাশে লাইটপোস্টে লাইট নেই তাই এই জায়গাটা কিছুটা অন্ধকার। খুব বেশি রাত হয়নি,বলা যায় সন্ধ্যা কিছুক্ষণ আগে বিদায় নিয়েছে।নওমি দোকানে যাচ্ছে পাউরুটি আনার জন্য।সকালে পাউরুটি আর কলা খেয়েই বেশিরভাগ সময় বাসা থেকে বের হয় সে।
হঠাৎ একটা লোককে এভাবে সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে খুব ভয় পেলো নওমি।ভাবলো ছিনতাইকারী।
যখন, সেই একই রকমভাবে বিশ্রি হাসি হেসে প্রায় ফিস ফিস করে লোকটা নওমিকে বলল-
—দরজা খোল না কেন?বার বার নক করি,বুঝতে
পার না কিছু?
এটা ছিনতাইকারী না বুঝতে পেরে যতটা না স্বস্তি এলো তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি ভয় তাকে ঘিরে ধরলো লোকটাকে চিনতে পারার পর।গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো নওমির।কারণ এই লোক ছিনতাইকারীর থেকেও ভয়ঙ্কর।

ভয় এবং আতঙ্কে নওমি কোন কথাই বলতে পারছিলো না।
—কি ব্যপার নওমি কোন কথা বলছো না যে।সব রকম সুবিধা পাবে,আমি যেভাবে বলি সেইভাবে চললে।
নিজেকে কিছুটা সামলে নওমি বলল-
—আপনি আমাকে যেমন মেয়ে ভাবছেন আমি তেমন মেয়ে না।
কথা বলতে গিয়ে নওমির গলা কাঁপছে।
—আরে রাখ তো তোমার, যেমন আর তেমন।ঐ সব বুলি প্রথমে সবাই বলে ,এর পরে টাকার গন্ধ পেলে তখন খোলস থেকে বেরিয়ে আসল রুপে আসে। টাকা-পয়সা নিয়ে কোন ঝামেলা হবে না।
—আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।যা মুখে আসছে বলে যাচ্ছেন!
—এখনো তো কিছুই করিনি,কথা না শুনলে এই বাসা থেকে খুব তাড়াতাড়ি তাড়ানোর ব্যবস্থা করবো,আর এমন অবস্থা করবো এই মুখ আর সমাজে দেখাতে পারবে না।
সত্যি বলছি তোমাকে প্রথম দেখেই আমার মনে ঝড় উঠে গেছে।তোমাকে রানী করে রাখবো।

নওমির কান দিয়ে যেন কথা ঢুকছিল না, তার মনে হচ্ছিল গরম কোন পদার্থ তার কান দিয়ে ঢুকছে। বাসার দিকে দৌড় দিল নওমি।উদভ্রান্তের মত সিঁড়ি দিয়ে উঠলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে কিছুতেই দরজার চাবি লকের ভেতরে লাগাতে পারছে না।ওর কাছে মনে হচ্ছে হিংস্র হায়েনা তাকে তাড়া করেছে,ধরতে পারলেই কামড় বসিয়ে দিবে।
অনেকক্ষণ চেষ্টার পর লক খুলতে পারলো। দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেছে। আবার উঠে দরজা টেনে দেখলো ঠিক মত দরজা লেগেছে কিনা। বিছানায় শুয়ে নওমি কাঁপতে লাগলো।

এভাবে কতক্ষণ সময় কেটে গেলো নওমি ধারণা করতে পারলো না।মোবাইলে রিং হতেই বিছানা থেকে ছো মেরে মোবাইলটা হাতে নিল,মনে হচ্ছে কেউ যেন মোবাইলটা ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। মোবাইল স্ক্রিনে মামা দেখে তার আত্মায় যেন পানি এলো।
—মামা ..বলেই নওমি হু হু করে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলো।
হোসেন একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলেন।কি হয়েছে আদরের ভাগ্নীর ,এই দুঃচিন্তায় তাঁর আত্মা বের হয়ে যেতে চাইলো।
বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন-
—মা, আমার কি হইছে বল আমারে। আমি কি এখনই রওনা দিব,বল আমারে,চইলা আসবো? মারে বল আমারে কি হইছে?
নওমির ভেতরে ঝড় কিছুটা কমে আসলে,প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সব কিছু বলল রশিদের সম্পর্কে।
হোসেন রাগে ফেটে পড়লেন রশিদের উপর, পারলে এখনই গলা চেপে ধরেন ।
—তুই আমারে আগেই বলস নাই কেন? কত বড় সাহস ..। গালিগালাজ শুরু করলেন রশিদকে।
নওমি মা আমার, তুই কোন চিন্তা করিস না। আমি সব ব্যবস্থা করতেছি।
—মামা আমার আর পড়তে হবে না।আমি চলে আসি ময়মনসিংহ।মামা তোমার কাছে খুব আসতে ইচ্ছে করছে।আমার খুব একা লাগছে , অসম্ভব ভয় লাগছে।ছোট বেলার মত তুমি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিও।মামা অনেক রাত আমি ঘুমাতে পারি না।
—এমন করিস না মা,একটু শান্ত হইয়া আমার কথা শোন।সব ঠিক করমু আমি।ঐ রশিদ এই বাড়ির আশপাশে আর আসতে পারবো না।তুই একদম চিন্তা করিস না।তোরে অনেক শক্ত হওন লাগবো।মনে রাখিস, সবাই শক্তের ভক্ত নরমের যম।এমন করলে কেমনে চলবে।দুনিয়া খুব কঠিন জায়গা।তোরে শক্ত হইয়া চলতে হইবো।
ভাত খাইছস?
—না
—এখনি খাওয়া শেষ কইরা ঘুম দে।আমার কথা শোন,না শুনলে আমি কইলাম খুব কষ্ট পাবো।
—ঠিক আছে মামা।
—এইবার রাখি তাইলে মা।কাইল সকালে আবার ফোন দিবোনে।
—আচ্ছা।

হোসেন ওখানে বসে কি করবেন নওমি ভেবে পেলো না।তবে কিছুটা আস্বস্ত হলেও পুরোপুরি ভারমুক্ত হতে পারলো না সে।

রোকেয়া, নাঈমকে বললেন-
—সিমির বাবা বড় ভাইয়ার কোম্পানিতে চাকরি করে এই কথা জান?
নাঈম ল্যাপটপ থেকে মুখ না উঠিয়েই উত্তর দিলেন-
—না তো।
রোকেয়া রাগ হয়ে বললেন-
—আমি না বলেছি আমার সাথে কথা বলার সময় অন্যদিকে মনোযোগ দিবে না।
—আমি তো কথা বলছি না,কথা তো বলছো তুমি।
—সব সময় সব কিছু নিয়ে ফাজলামো করবে না তো।কথা শুনলে রাগে গা জ্বলে যায়।
—আচ্ছা ঠিক আছে।এই যে ল্যাবটপ রেখে দিলাম। তোমার ডাগর কালো চোখের দিকে তাকালাম। এবার বল রুক্কু।
—আগে তোমার ঢং করা বন্ধ কর।
এই বলে রোকেয়া উঠে চলে যেতে চাইলে নাঈম রোকেয়ার হাত ধরে ফেললেন।
—আচ্ছা এইবার বল,আমি সিরিয়াস।
রোকেয়া নাঈমের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন।

—তোমার হাসি দেখে আমার হৃদয় জুড়ায় রুক্কু।
—তোমার চেহারার ভাব দেখে হাসি পেলো।যা কর না!
আচ্ছা শোন আত্নীয় স্বজন কেউ জানে না পরশের বিয়ের কথা।জানতে পারলে কেউ কথা শোনাতে ছাড়বে না। একটা রিসেপশন প্রোগ্রাম করলে কেমন হয়?
—সিমির বাবা তো মনে হয় মানবে না।
—এই জন্যই বলছি ভাইয়ার কথা,যদি জানতে পারে কোম্পানির চেয়ারম্যান এর ভাগ্নের সাথে তার মেয়ের বিয়ে হয়েছে, তখন নিশ্চয়ই তাদের আপত্তি থাকবে না।
—আমি চাচ্ছি না।কোন পরিচয় ব্যবহার করে এই সম্পর্ক নরমাল করতে। ছেলে এবং আমার পরিচয় জেনেই যেন ওরা সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
—তোমার পরিচয় জানলেও কি আপত্তি কযতে পারবে? সমস্যা হলো পরশ এখনো পড়াশোনা করছে।সময় হলে সেও ভালো কিছু করবে।
—আরো কিছু দিন যাক।দেখা যাক কি হয়।পরে প্রোগ্রাম করা যাবে।
—কেউ বাসায় এসে সিমিকে দেখলে কি বলবো?
—যেটা সত্যি সেটাই বলবে। আমাদের তো কিছু করার নেই। সন্তান যদি মা-বাবাকে কথা শোনানোর ব্যবস্থা করে,শুনতেই হবে।এই দায়ভার আমাদেরই নিতে হবে।
রোকেয়ার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। তিনি আর কথা বাড়ালেন না।বুঝতে পারলেন উপরে উপরে যতোই দেখাক না কেন নাঈমের মনেও কষ্ট জমে আছে।

রোকেয়ার সাথে সিমির ভালো ব্যবহার করাটা দুলি কিছুতেই মানতে পারছে না। সেই দিন সাথে নিয়ে গিয়ে খাট কিনে দিল!আল্লাদ দেখলে রাগ উঠে যায়।সে এবার ক্লাস নাইনে উঠেছে।তাদের সব জিনিসে সিমির ভাগ বসানোটা মানতে পারলেও তার মায়ের আদরে ভাগ বসানো,কোন ভাবেই মেনে নিবে না দুলি।সে ভাবে তার আপুটাও কেমন। সারাক্ষণ আছে পড়া নিয়ে। সিমির কথা কিছু বললে বলে,’ও তাই,তাতে কি হয়েছে?’ এই সব কথাবার্তা।ভাইটাও একেবারে বেহায়া হয়ে গেছে।বৌকে নিয়ে বাইরে যায়, আর এসে রেডি করা খাবার খায়।কত আরাম।এই সব দেখে রুমিকে বলল-
—আপু তুমি বিয়ে করে ফেল?
—কেন?আমি বিয়ে করবো কেন?
—তাহলে ভাইয়ার মতো তুমিও আনন্দে দিন কাটাবে তোমার স্বামীকে নিয়ে।
—এই সব আনন্দের দরকার নেই।আমি জবে ঢুকে পরে বিয়ে করবো।বাবাকে তো বলেছি এই কথা।বাবাও বলেছেন আমার ইচ্ছে মতোই হবে।
এই যে ওরা বাবার টাকায় চলছে এটা খারাপ দেখায় না?
—আমিও তো তাই বলি আপু।
—হয়েছে বড়দের ব্যপারে তোর কথা বলতে হবে না।
—তাহলে স্বীকার করছ আমি এখনো ছোট আছি।সেই দিন আমাকে যে বললে,’এখন বড় হয়েছিস ঠিক করে ঘুমানোর অভ্যাস কর, আমার গায়ের উপর পা উঠিয়ে দিলে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।’
—সেই কথা তখনের জন্য ঠিক ছিল।আর এখন যা বললাম, সেটাও ঠিক।তুই এত বড় হয়ে যাসনি যে বড়দের ব্যপারে নাক গলাবি।
—তোমাদের কথাই বুঝতে পারি না।এই বল বড় হয়ে গেছি আবার এই বল ছোট আছি।

এমন সময় সিমি ঢুকলো-
—আপু কি করছো তোমরা?
দুলি মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেলো।
সিমি বসতে বসতে বলল-
—তুমি এত পড়াশোনা কর কিভাবে বল তো? আমি কিছুক্ষণ পড়ার পরেই হাঁপিয়ে যাই।
—এই জন্যই কি বিয়ে করে ফেলেছ?
সিমির মুখটা হঠাৎ কালো হয়ে গেলো।কোন কথা না বলে বেরিয়ে গেলো।
নিজের রুমে যেতেই পরশের চোখে পড়লো সিমির মুখ ভার।
—কি ব্যপার ,কি হয়েছে?
—তোমার বোনদের সাথে গল্প করতে গেলাম।দুলি আমাকে দেখেই ভেংচি কেটে চলে গেল।আর রুমি বলল,’আমি বিয়ে করেছি কেন?’

—তুমি রুমি আপুকে নাম ধরে বলছ কেন?আর কখনো বলবে না।
—আমার সাথে কি করলো সেটা না দেখে,নাম ধরে বললাম কেন তাই নিয়ে পরেছ?
—রুমি আপু এমনিতেই কথা কম বলে। তোমাকে শুধু শুধু কেন এই কথা বলতে যাবে? তুমি কি বলেছিলে?
—আমি বললাম,তুমি এত পড়াশোনা কর কিভাবে?আমি তো একটু পড়লেই হাঁপিয়ে যাই।এই কথা শুনেই বলল,এই জন্যই কি বিয়ে করে ফেলেছ?’
—তাহলে এই কথার খারাপ কি দেখলে?আপু জিজ্ঞেস করতে পারে না, তোমার পড়তে ভালো লাগে না বলেই কি বিয়ে করেছ।
— বোনেরা যা বলবে সেটাই ঠিক, আমার সম্মানের কথা ভাববে না?
—আমাদের বাসায় তোমার সম্মান কেউ নষ্ট করবে না,এই সব বন্ধ না করলে তোমার নিজের সম্মান নিজেই জন্যই নষ্ট হবে। সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলার চেষ্টা কর।না হলে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে তোমার সাথে সাথে আমার ও।সবাই আমাকে দুরে সরিয়ে দিবে।এটা আমি সহ্য করতে পারবো না।একটু বোঝার চেষ্টা কর ।
—দুলি আমার সাথে কেমন ব্যবহার করে জান?
—ও তো ছোট মানুষ।
—ঝিমি এমন করলে বাবা মেরে তক্তা বানিয়ে দিতো।
—তুমিও কি মার খেতে নাকি?
সিমি কোন কথা বলল না।
—আচ্ছা ঠিক আছে আমি দুলির কথা মাকে বলবো,মা যেন বুঝিয়ে বলে।

সিমির ভালোই অভিজ্ঞতা আছে মার খাওয়ার ব্যপারে। তার বাবার রাগ উঠলে এমন মারতো যে শরীর অবশ হয়ে যেতো।সেই কথা আর মনে করতে চায় না সিমি।

ঘুম ভাঙ্গতেই গত রাতের সব ঘটনা মনে পড়লো নওমির। তার চোখে শুকিয়ে আছে গত রাতের চোখের পানি। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছিল মনে করতে পারছে না।রাতে খাওয়া হয়নি,পেট সেটাই জানান দিচ্ছে কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করছে না কিছুতেই।রাতে মশারীও টানানো হয়নি।মশারা ইচ্ছে মত কামড়েছে, শরীরে অনেকগুলো মশার কামড়ের দাগ,এখন এইগুলো খুব চুলকাচ্ছে।
আজ আর ভার্সিটিতে যাবেনা।একদম ইচ্ছে করছে না বাইরে বের হতে।সব কিছু বন্ধ রাখলেও,পেটের ভেতরে খাবার দেয়ার কাজ তো আর বন্ধ রাখা যাবে না।

চলবে…

#ফাহমিদা_লাইজু

#৫ম_তলার_মেয়েটা

#পর্ব_৬

খবরটা শুনে সুমি দুটো করে সিঁড়ি টপকে হাঁপাতে হাঁপাতে পারুদের বাসায় উপস্থিত হলো। তার ইচ্ছে করছিলো এক লাফে উঠে যেতে।

পারু রান্না ঘরে ছিলেন। তার শরীর কিছুদিন থেকে খুব খারাপ যাচ্ছে।সুমি রান্না ঘরে এসে উপস্থিত।সুমিকে দেখেই পারুর মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল।সেটা বুঝতে না দিয়ে লিভিং রুমে বসতে বললেন।

গলার স্বর নামিয়ে সুমি বলল-
—আন্টি খবরটা শুনে বিশ্বাসই হয়নি। আমাদের সিমি এমন একটা কাজ করতে পারে?তাই তো দৌড়ে এলাম আপনার সাথে কথা বলতে। মানুষের খেয়ে দেয়ে কাজ নেই,তিলকে তাল বানায়।সিমি হয়তো কোথাও বেড়াতে গেছে, আর সবাই বলে বেড়াচ্ছে এক ছেলের সাথে নাকি ভেগে গেছে সুমি।

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে সুমি তাকিয়ে রইল পারুর দিকে,পারু কি বলে শোনার জন্য।মনে মনে বলতে লাগল, এমনিতে তো মানুষের হাঁড়ির খবর নিয়ে ব্যস্ত থাকে আন্টি,আজ দেখি নিজের হাঁড়ির খবর নিজেই কিভাবে বলে।

পারুর ভেতরটা দুমড়ে যাচ্ছিলো।কি বলবেন ভাবতে লাগলেন।এত অপমানের মধ্যে ফেলে গেল মেয়েটা! ঘরের লোকের কাছ থেকে উঠতে বসতে কথা শুনতে হয়।এখন বিল্ডিংয়েও ছড়িয়ে গেল।এখন কত জনের থেকে কত অপমান সহ্য করতে হবে মুখ বুজে!

আহত হরিণের মত পারু বললেন-
আমরাও ভালো করে জানি না কোথায় গেছে,কার সাথে গেছে?
—বিয়ে করে ফেলেছে শুনলাম।
—শুধু এত টুকুই জানি।ফোনে ওর বাবাকে বলেছে।
—হায় হায় কি আফসোসের কথা।ভদ্র ফ্যামেলির মেয়ে এমন করে?কি আর করবেন আন্টি,সবই কপালের দোষ!

পারু মর্জিনাকে চুলার তরকারিটা দেখার জন্য বললেন।কথা অন্যদিকে ঘোরাতে চাইলেন কিন্তু সুমির মনযোগ একচুলও সরলো না।
—আন্টি কয়েকদিন থেকে হাঁটতে ও যাচ্ছেন না।
—শরীরটা ভালো না।
—এমন তো হওয়ার কথাই আন্টি।মা হয়ে এ সব কি সহ্য করা যায়?তবে কি আন্টি ছোটবেলা থেকেই এ সব শিক্ষা দিতে হয় সন্তানদের।ভালো সংস্কার পেলে এই সব করে না।

এই কথা শুনে পারু ভাবতে লাগলেন তাহলে কি সুমি বোঝাতে চাইছে উনি সন্তানদের শিক্ষা দিতে পারেননি,ভালো সংস্কার দিতে পারেননি।সবসময় সিমির বাবা যা বলে সেটাই কি সত্যি?তিনি একজন ব্যর্থ মা?

—সুমি তোমার ও তো মেয়ে আছে।এখন থেকেই সাবধান হয়ে যাও।ওকে কিন্তু ভালো সংস্কার দিও।বলা তো যায় না কার কপালে কি আছে!

পারু কথা বলছিলেন খুব শান্ত ভাবে কিন্তু কথাগুলোর সাথে পারুর দুঃখ ঝরে ঝরে পড়ছিলো। সুমির মনে হলো এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি। আর বসতে পারলো না সে।

কিছু মানুষের কাজই হলো কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়া।এত দিন এই কাজটা করে গিয়েছেন পারু। আজ বুঝতে পারছেন অপ্রিয় কথা শুনতে কেমন লাগে।কোন মানুষকে লজ্জায় পড়তে হবে জেনেও ঠিক সেই বিষয়ে কথা শোনানো , শরীরে কাঁটা ফোটানোর মত । এই মুহূর্তে পারুর ঠিক এমন অনুভূতি হচ্ছে। তাঁর মাথাটা কেমন করতে লাগলো। তাড়াতাড়ি বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন।কারো দূর্বল জায়গায় আঘাত এত জঘন্য কাজ এটার মাসুল তো কিছু পেতেই হবে।

সিমির সাথে দুলির ঝগড়া লেগে গেলো। দুজনের মনে দুইজনের প্রতি আগে থেকেই অনেক রাগ জমে ছিল।যখন দুলি দেখলো তার রাখা আইসক্রিম ফ্রিজে নেই তখন সবাইকে জিজ্ঞেস করা শুরু করলো তার আইসক্রিম কে খেয়েছে? সিমি কে জিজ্ঞেস না করলেও সে বলল,সে খেয়েছে।
এই নিয়ে দুলি রাগারাগি শুরু করলো।কেন তার আইসক্রিমে হাত দিল সিমি ? সাথে সাথে সিমিও কথা বলতে লাগলো উচ্চ স্বরে।ব্যপারটা এক সময় অনেক ঘোলা হয়ে গেলো।

সিমি পরশকে হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে গেল। সরাসরি পরশকে বলল, আলাদা বাসা নেয়ার কথা।পরশের পক্ষে কোন ভাবেই এটা সম্ভব না জেনেও যখন সিমি বার বার এই কথা বলতে লাগলো ,তখন পরশ বলল-
—আমার পক্ষে এই মুহূর্তে এটা সম্ভব না এটা তুমি ভালো করেই জান।
—তাহলে বিয়ে করলে কেন?
—আমি অনেক বুঝিয়ে ছিলাম তোমাকে পড়াশোনা শেষ হয়নি এখন কিছুতেই বিয়ে করা ঠিক হবে না,তুমি কোনভাবেই মানলে না।এখন আমাকে দোষ দিচ্ছ?
—তোমার বাবার কাছ থেকে খরচ নিবে।
পরশ কিছুক্ষণ সিমির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল-
—আমার অবাক লাগছে এই কথা তুমি বল কি করে? তাঁরা নিজেরা আমাদের বিয়ে দিয়ে এনেছেন,যে আমাদের আলাদা বাসা ভাড়া করে সম্পূর্ণ খরচ বহন করবেন? তাদের খুব ঠেকা পরে গেছে না? এমনিতেই এখন তোমার সব খরচ তো বাবাই দিচ্ছেন।
—আমি কিছুই শুনতে চাই না। আমি আলাদা সংসার চাই আমার, তোমার তাই করতে হবে।
—তোমার যে মাথায় সমস্যা আছে আগে বুঝতে পারিনি।এখন দেখছি তোমার ট্রিটমেন্ট দরকার।
—কি আমি পাগল?

রোকেয়া একটা কাজে বাইরে গিয়েছিলেন। তিনি থাকলে হয়তো এই ঝগড়াই হতো না।সব কিছু শুনে রোকেয়া দুলিকে খুব বকাবকি করলেন।
—তুমি জীবনে আইসক্রিম খাও নি?একটা আইসক্রিম নিয়ে ঝগড়া করতে হয়?
—আমি স্কুল থেকে আসার সময় নিয়ে এসেছিলাম।একটু গলে গিয়েছিল তাই ভেবেছি ফ্রিজে রেখে দিয়ে,একটু পরে খাবো।সে যদি বলতো, তার খুব ইচ্ছে করছিলো তাই খেয়ে ফেলেছে তাহলে রাগ করতাম না।সে বলল,’আইসক্রিমে কি নাম লিখা আছে,খেয়েছি তো কি হয়েছে?’ এই কথা শুনে আমার রাগ উঠে গেলো।
—তবুও তোমার এমন করা ঠিক হয় নি।সিমিকে সরি বলবে।
দুলি চুপ করে আছে দেখে রোকেয়া বললেন-
—সরি বললে কেউ ছোট হয়ে যায় না,বরং তার মহৎ হৃদয়ের পরিচয় মিলে।

রুমির দিকে তাকিয়ে রোকেয়া বললেন-
—তুমি কিছু বললে না দুলিকে?
—আমি দুলিকেই বকা দিচ্ছিলাম।সিমির কথা বলার ধরণ দেখে আমি রুমে চলে গেছি। আমি থাকলে আমারো রাগ উঠে যেতো, কিছু না কিছু বলে ফেলতাম সিমিকে।

এমন সময় চিৎকার শুনে পরশের রুমে গিয়ে দেখেন সিমি পাগলের মতো আচরণ করছে।মুখে যা আসছে তাই বলছে।
রোকেয়া কঠিন গলায় ধমক দিয়ে বললেন-
—একদম চুপ কর,এটা ভদ্রলোকের বাড়ি।
সিমি রোকেয়ার দিকে তাকিয়ে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল।
সবার কাছে সিমিকে অপ্রকৃতিস্থ লাগছে।
রোকেয়া বললেন-
—রাতে এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। তোমার বাবার সাথে খুব তাড়াতাড়ি যোগাযোগ করতে হবে।
—কেন বাবার সাথে যোগাযোগ করতে হবে ? সে কি বিয়ে করেছে?
—একদম বেয়াদবি করবে না সিমি।
—তাহলে কি করবেন?মারবেন?মারবেন আমাকে?মারেন।

রোকেয়া আর দাঁড়ালেন না।নাঈমের কথা শুনে ভেবেছিলেন , তাদের সম্পর্কটা শুধু বৌ-শাশুড়ীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বন্ধুত্বের দিকে গড়াবেন কিন্তু সেটা হয়তো সম্ভব হবে না। পরশের জন্য কষ্টেবুক ফেটে যেতে লাগল।কেন ছেলেটা এমন করলো,ওর কপালে এমন একটা মেয়ে জুটলো!

রাতে সবাইকে নিয়ে লিভিং রুমে বসলেন নাঈম।
প্রথমে সিমিকে কথা বলতে বললেন।
—আমি এখানে থাকতে চাই না।
—তোমার বাবার বাড়ি যেতে চাও?
—না। আমার আলাদা সংসার চাই।
—খরচ কে দিবে?
—আপনি দিবেন?
—যদি না দেই?
—আমি যে কোন কিছু করে ফেলবো,পরে আপনারা ফেঁসে যাবেন।

সিমির কথা শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল।নাঈম আর রোকেয়া একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে কিছুই বলতে পারলেন না।

পরশ একেবারে গর্জে উঠলো।এই সব কি বল তুমি?বাবার সাথে বেয়াদবি কর?

নাঈম চুপ করতে বললেন পরশকে।

নাঈম বলতে শুরু করলেন-
—আজ সিমি যা বলল,সেটা সবাই শুনেছ। আমরা ওর সাথে কোন খারাপ আচরণ করিনি কিন্তু সে তার ইচ্ছাকে প্রতিষ্ঠিত করতে যে কোন কিছু করে আমাদের ফাঁদে ফেলতে পারে,এটাও সবাই শুনলে।
তোমাকে আলাদা বাসায় রেখে সমস্ত খরচ আমি চালাতে পারবো না।বিয়ের পর স্বামীকে কিংবা স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে খরচ বহন করতে হয়। তোমাদের তো আর আমরা বিয়ে দেইনি।তুমি কেন ক্লাসমেট বেকার ছেলেকে বিয়ে করেছ? সেটার দায়ভার কি আমরা নিব?

—পরশকে আপনারা জন্ম দিয়েছেন তো , আপনাদেরই দায়ভার।
—যদি খরচ না দেই তবে কি করবে?
—সবার নামে পুলিশের কাছে অভিযোগ করবো, আপনারা আমাকে যৌতুকের জন্য অত্যাচার করেন।আর জানেন তো নারী নির্যাতনের আইন কত মারাত্মক।

এ সব শুনে রোকেয়ার শরীর কেমন করতে লাগলো,মনে হচ্ছে মাথা ঘুরিয়ে পরে যাবেন। নাঈমের হাত চেপে ধরলেন।নাঈম তাড়াতাড়ি রোকেয়া কে ধরে বেডরুমে নিয়ে শুইয়ে দিলেন। সবাই রোকেয়া কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও দুলি বসেই রইল।সে সিমির খুব কাছেই বসে আছে।সিমির মধ্যে ও কোন ভাবান্তর হলো না।
দুলি বলল-
—তোমার তো খুব বুদ্ধি। কিভাবে শিখলে এ সব বুদ্ধি?
—তোমাকে এই সব বলার কোন প্রয়োজন নাই। তবে এতই যখন জানার ইচ্ছা তাহলে বলি-আমার এক কাজিনের বিয়ের পর থেকেই শ্বশুরবাড়ির সবাই মিলে অত্যাচার শুরু করলো।উঠতে বসতে খোঁটা, স্বামীর মাইর।সে চলে গেল বাবার বাড়ি, কেইস ফাইল হলো এখন গোষ্ঠী সহ কারাগারে।

—আমরা তো তোমার সাথে তেমন কিছু করিনি বরং মা-বাবা আমাদের মতোই তোমাকে আদর করে তাহলে এই সব করবে কেন?
—একা থাকলে স্বাধীন ভাবে থাকা যাবে। তোমাদের সাথেও ঝগড়া হবে না।
—এটাকে ঝগড়া বল?বোনেরা বোনেরাও তো ঝামেলা হয় এই জন্য আলাদা বাসায় চলে যেতে হবে?
—সেটা তুমি বুঝবে না।
একটা বাঁকা হাসি হেসে সিমি রুমে চলে গেলো।

এর পর দুলি একটা তৃপ্তির হাসি দিয়ে সেও উঠে দাঁড়ালো,মনে মনে বলল-‘এত সহজ না আমাদেরকে বিপদে ফেলা।’

এই কয় দিন নওমির ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কেটেছে।দিন রাতের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না।যখন ক্ষুধা লাগছে উঠে কিছু খেয়ে আবার বিছানায়। মামার কল ছাড়া আর কারো কল রিসিভ করেনি।স্বর্ণা অনেকবার কল দিয়েছে।এখন আবার রিং হচ্ছে।
রিসিভ করতেই স্বর্ণা চেঁচিয়ে উঠলো-
—কিরে ফোন ধরিস না কেন?কত বার কল করলাম।
—ইচ্ছে করেনি।
—কি? আমার সাথে তোর কথা বলতে ইচ্ছে করে না?
—এই সব তুচ্ছ কারণে রাগ করিস না তো। এমনিতেই অনেক ঝামেলায় আছি।

এবার নরম হয়ে জিজ্ঞেস করলো স্বর্ণা-
—কি হয়েছে বলতো?
—পরে বলছি,তুই আগে বল এত জরুরি কেন?বার বার কল দিচ্ছিস?
—তুই যে বলেছিলি কোন মেয়ে তোর সাথে শেয়ারে থাকতে চাইলে তোকে যেন জানাই।
এবার শোয়া থেকে উঠে বসলো নওমি-
—পেয়েছিস?
—ঐ যে পম্পি আছে না?ও থাকতে চাইছে।
—পম্পি?কেন ওরা তো চারজন এক বাসায় থাকতো।এখন কি হলো?
—কি নাকি ঝামেলা হয়েছে।

কিছুদিন আগে হলেও কিছুতেই পম্পির সাথে রুম শেয়ার করতো না নওমি কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ও থাকলে খুব ভালো হবে।একটু উত্তেজিত হয়ে নওমি বলল-
—পম্পি কবে আসতে চায়?যত তারাতাড়ি সম্ভব নিয়ে আয়।
—কি হয়েছে বল তো?পম্পির কথা শুনে তুই খুব খুশি হয়েছিস মনে হয়?

এর পর সব কিছু খুলে বলল স্বর্ণাকে।নওমি এখন বাসা থেকে বের হতেই ভয় পাচ্ছে।
সব কিছু শুনে স্বর্ণা খুব আশ্চর্য হয়ে গেল।অনেক সান্তনা দিল নওমিকে,সাহস জোগালো আর বলল-
—পম্পির সাথে যোগাযোগ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিয়ে আসছি।

চলবে…

#ফাহমিদা_লাইজু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here