৫ম_তলার_মেয়েটা,০৭,০৮

0
917

#৫ম_তলার_মেয়েটা,০৭,০৮
ফাহমিদা_লাইজু
#পর্ব_৭

দরজায় দুড়ুম দুড়ুম শব্দে নওমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো। সে ঘুমিয়ে ছিল। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো প্রায় একটা বাজে।একটু আগেই হয়তো যোহরের আযান হয়েছে।

আবার শব্দ হলো দরজায়। নওমি একেবারে শক্ত হয়ে গেল ভয়ে। দরজা পর্যন্ত যেতেও ভয় লাগছে। একটা মেয়ে বলছে-
—আপা আপনে কি ভিতরে আছেন?
এবার নওমির ভয় দুর হলো।সে দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
—কে?
—আমি পাশের বাসার মর্জিনা।একটু খুলেন।
দরজা খুলতেই মর্জিনা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল-

—আপা একটু আসেন আমাগো খালাম্মা কেমুন জানি করতাছে। চোখ উল্ডাইয়া দিসে।

নওমি সেই অবস্থাতেই ছুটে গেলো।
পারু সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন।নওমি বার বার ডাকলেও কোন সাড়া পেলো না।মনে হচ্ছে উনি তাকিয়ে থাকলেও কাউকে চিনতে পারছেন না।হাত পা ঠান্ডা ঠান্ডা আর অল্প অল্প কাঁপছে। নওমি, মর্জিনাকে বলল- হাতে পায়ে তেল মালিশ করতে।এই অবস্থা দেখে নওমির ভয় করতে লাগল।
নওমি পারুর চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিল তাতেও কোন লাভ হলো না।

মর্জিনাকে জিজ্ঞেস করল-
—-আন্টির বড় কোন রোগ আছে?
—ডাইবিটিস আছে।
—ডায়াবেটিস আছে।আন্টি খুব বেশি স্বাস্থ্যবান না হয়েও প্রতিদিন হাঁটতে যান।ডায়াবেটিস থাকার কারণেই উনি নিয়ম করে হাঁটেন তাহলে।

—এই রকম কি প্রায়ই হয়?
—যেই দিন সিমি আপা বিয়া কইরা ফেলল,সেই দিন অজ্ঞান হইয়া গেছিলো, মাথায় পানি দেওয়াতে ভালো হইয়া গেছিলো। কিন্তু এমন কোন দিন ও দেহি নাই।

উনার অন্য আর কোন রোগ আছে?
—আর কিছুর কথা তো শুনিনাই।

নওমি দৌড়ে আবার রুমে গিয়ে মোবাইলটা নিয়ে এসে স্বর্ণাকে ফোন দিল-
পারুর সমস্ত বিবরণ জানিয়ে বলল-
—আঙ্কেলকে জিজ্ঞেস করে বল,কি করবো?
—আব্বু বাসায় নেই হসপিটালে। আর এই জন্য আব্বুকে জিজ্ঞেস করতে হবে না। তুই দেখ বাসায় মধু আছে কিনা,একটু খাইয়ে দে।মধু না থাকলে চিনি খাওয়া।ঠিক হয়ে যাবে।
আমি একটু পর আবার কল দিচ্ছি তোকে।

মর্জিনাকে জিজ্ঞেস করতেই মধু এনে দিল।নওমি, পারুর মাথাটা উঠিয়ে বালিশে রেখে বাটিতে মধু ঢেলে দিতে বলল মর্জিনাকে।এর পর আঙ্গুলে নিয়ে নিয়ে পারুর মুখে দিতে লাগল।একটু একটু মুখের ভেতরে যেতে লাগলো মধু।বেশ কিছুক্ষণ এভাবে খাওয়ানোর পর পারু অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এলেন।পারু উঠে বসতে চাইলে,নওমি বলল-
—আন্টি প্লিজ উঠবেন না।আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকেন। এখন আপনার কিছু খাওয়া দরকার।
—মর্জিনা আন্টির জন্য খাবার আন।

নওমি আবার স্বর্ণাকে কল দিল-
—স্বর্ণা আন্টি এখন অনেকটা সুস্থ আছেন।
—উনার মনে হয় হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়েছিল। উনি হয়তো অনেক সময় ধরে না খেয়ে ছিলেন।ডাইবেটিক পেসেন্টরা দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যায় বা হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়। তখন মিষ্টি জাতীয় কোন খাবার খাওয়ালে ঠিক হয়ে যায়। আচ্ছা উনার ফ্যামেলির কাউকে জানিয়েছিস?
—না জানাইনি। আচ্ছা এখনি জানাচ্ছি।

আন্টি , আঙ্কেনকে একটা কল দেয়া দরকার। আপনার মোবাইল থেকে আমি একটা কল দেই আন্টি?
পারু মাথা নেড়ে সায় দিল।
—কি নামে সেভ করা আন্টি?
পারু দুর্বল কন্ঠে উত্তর দিলেন-
—সিমির বাবা।

নওমির দিকে পারু ভালোভাবে তাকাতে পারছেন না। অনুশোচনা নাকি লজ্জা ?হতে পারে দুটোই।

দরজা খোলাই ছিল,লাগানোর কথা কারো মাথাতেই আসেনি।তবে দরজা খোলা থাকলেও এই বাসায় কোন সমস্যা হওয়ার কথা না। দারোয়ান মফিজের চোখ ফাঁকি দিয়ে একটা মাছিও ঢুকতে পারে না।

কল দিতে দিতে শফিক চলে এলেন।

শফিক ,ঝিমিকে নিয়ে ভেতরে ঢুকেই জোরে বলে উঠলেন-
—দরজা খোলা কেন?
নওমি, পারুর বেড রুম থেকে বের হয়ে এলো সাথে মর্জিনাও।নওমি সালাম দিয়ে বাসায় চলে গেলো।
রুমে ঢুকে পারুকে উদ্দশ্য করে ধমকের স্বরে কথা শুরু করলেন শফিক-
—এই মেয়ে আমার বাসায় কেন? পোষাক-আশাকের কি অবস্থা!নওমি বাসায় লম্বা টিশার্ট,পালাজ্জো পড়া ছিল ।এখানে আসার সময় একটা উড়না গলার দুই পাশে ঝুলিয়ে চলে এসেছে।

বেশি কিছু বোঝে না যে মর্জিনা সেও চিন্তা করতে লাগল, ‘নওমি আপা কই খারাপ পোশাক পড়ছে? তার গায়ে তো ভালো পোশাকই ছিল তাইলে খালু এই সব কি বলে?’

পারু কথা বলছেন না দেখে মর্জিনার দিকে কটমট করে তাকালেন-
—খালাম্মা কেমুন জানি করতাছিলেন,চোখ উল্টাইয়া গেছিলো,আমারে চিনতে পারতাছিলো না,আমি খুব ভয় পাইছিলাম,এই জন্য নওমি আপারে ডাইকা আনছি।
—সে কি ডাক্তার,ওকে ডাকতে গেছিস?
—নওমি আপা আইসা হাতে-পায়ে তেল মালিশ করতে বলছে,মুখে পানির ঝাপটা দিসে,একটু একটু কইয়া মধু খাওয়াইছে এর পরে খালাম্মা ঠিক হইছে।

এই কথা শুনে এবার পারুকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেন-
—কি যে এক যন্ত্রনা,দুই দিন পর তার শুধু শরীর খারাপ। শরীরে রোগের কারখানা।বংশের থেকে নিয়ে এসেছে এক রোগ।বিয়ের পর থেকে এই সব দেখছি, আমাকে আর শান্তি দিলো না।

এর পর ভাত খেয়ে আবার অফিসে চলে গেলেন শফিক।ঝিমির স্কুল ছুটির পর ঝিমিকে বাসায় পোঁছে দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার অফিসে চলে যান। লাঞ্চ করার কথা বলেই অফিস থেকে বের হতে হয়।সিমি চলে যাওয়ার পর থেকেই এমন করছেন।অফিসের কাছাকাছি ঝিমির স্কুল হওয়াতেই এটা সম্ভব হচ্ছে।

পারু ভাবতে লাগলেন। শারীরিক দুর্বলতা ছাড়া তার তো কোন রোগই ছিল না ।এত বড় সংসার টেনে নিয়মমতো খাওয়া হতো না।এক বেলার খাবার অন্য বেলায় খেতেন।এই জন্য শরীর সব সময় দুর্বল লাগতো।
বিয়ের পর থেকে শ্বশুর বাড়ির জ্ঞাতি-গোষ্ঠী সবার জন্য গাধার খাটুনি খেটেছেন।এক সময় ননদ,দেবরা বিয়ে করে। তাদের আলাদা সংসার হয়। শ্বশুর অনেক আগেই মারা গিয়েছিলেন। শাশুড়ি কয়েকবছর আগে মারা গেছেন। শাশুড়ি মৃত্যুর আগে দুই বছর বিছানায় ছিলেন, সমস্ত কাজ পারুকেই করতে হয়েছে।নিজে যদি অসুস্থই থাকতেন তাহলে এত এত দায়িত্ব পালন করলেন কিভাবে?
ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে তিনমাস হলো। পারুর বাবার ডায়াবেটিস ছিল।এই খোঁটা মরার আগ পর্যন্ত শুনতে হবে।যাদের বংশে এই রোগ নেই তাদের কি কখনো এই রোগ হয় না?
এই স্বামী নামক লোকটার প্রতি তীব্র ঘৃণা পারুর মনে।দিন দিন যেন আরো বাড়ছে।এটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে তিনি জানেন না।

সকালে পারুর ছোট ননদ ফোন করেছিল। সিমির কথা জানতে পেরেছে।অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগল পারুকে।পারু কোন কথাই বলতে পারেনি।
এর পরে আর নাস্তাও করা হয়নি।আসলে খাবার গলা দিয়ে নামানোর মত অবস্থাতেই ছিলেন না।এই জন্যই শরীরটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

মর্জিনা পারুর জন্য খাবার নিয়ে এলো।পারু মুখে ভাত দিলেন কিন্তু খাবার যেন গলা দিয়ে নামতে চাচ্ছিলো না। নওমি মেয়েটা কত ভালো একটা মেয়ে।আর সে নিজে কিনা ওর নামে কত কিছু বলেছেন,এই বাসা থেকেও তাড়ানোর চিন্তা করেছিলেন।
ভাতের প্লেটে চোখ থেকে বড় বড় পানির ফোটা পড়তে লাগল তার।
ঝিমি মায়ের পাশেই বসে ছিল।ও বলল-
—মা তোমার বেশি খারাপ লাগছে?আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি।
ঝিমি হাত ধুয়ে এসে মায়ের মুখে খাবার তুলে দিতে লাগলো।কোন দিন কেউ তাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছিল কিনা পারু মনে করতে পারলেন না। তার চোখে পানি আর ঠোঁটে হাসি।পারুর মনে হচ্ছে তার মা তাকে যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছে।
—মা তুমি কেঁদো না তো।আমি এখন থেকে তোমার যত্ন নিবো,সব খেয়াল রাখবো।একটুও কেঁদো না মা।
একটু দুরে দাঁড়িয়ে মর্জিনা ও কাঁদছিল।সেটা দেখতে পেয়ে ঝিমি বলল-
—তুই আবার কাঁদিস কেন?অনেক বেলা হয়েছে ভাত খেতে যা।
—এমনেই কান্দি আপা।ভাত আপনের লগেই খামু।
এবার পারু বললেন-
—ঝিমি এবার তুই খেয়ে ঘুমাতে যা।এত সকালে উঠতে হয়। কয়েকদিন পরেই টেস্ট পরীক্ষা শুরু হবে। ভালো রেজাল্ট করতে হবে মা।
—আমাকে নিয়ে টেনশন করো না তো। টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট খুব বেশি ভালো না হলেও আমার এস এস সির রেজাল্ট ভালোই হবে।
এবার তুমি ঘুমাও।

ঝিমি খেতে বসে ভাবছে মাকে তো বলল রেজাল্ট ভালো হবে কিন্তু তার পড়ালেখার অবস্থা খুবই খারাপ। ইচ্ছে করে না পড়তে।এত দিন ইচ্ছে না করাটাকে প্রাধান্য দিয়েছে এবার এই ইচ্ছে না করাটাকে হারিয়ে দিতে হবে।জান প্রাণ দিয়ে পড়ায় বসতে হবে।

তোফাজ্জল হোসেনের সামনে অনেকক্ষণ ধরেই বসে আছে রসিদ।কিছুই বলছে না তোফাজ্জল, এক মনে একটা ফাইল দেখে যাচ্ছেন তাঁর সামনে যে রশিদ বসে আছে এটা যেন বেমালুম ভুলে গেছেন,এমনটাই ভাবছে রশিদ।
রশিদের এভাবে বসে থাকতে ভালো লাগছেনা। আবার কিছু বলতেও পারছেনা।

বেশ কিছুক্ষণ সময় পরে মুখ না তুলেই রশিদকে বললেন-
—সাভারে যে আমার একটা ফ্ল্যাট সেটা তো জান?
—জ্বী ভাইজান জানি।
—ওইখানে কিছু ঝামেলা হচ্ছে। আমাদের নিজেদের কেউ গিয়ে থাকলে খুব ভালো হয়।এই জন্য তুমি ফ্যামেলি নিয়ে ওখানে আগামী মাসে শিফট করবে।
—ভাইজান তাহলে কিভাবে চলবে।পুরান ঢাকার অফিসের কাজ কে দেখবে?
—তুমি সেই অফিসে কতক্ষণ থাক,কি কাজ কর সেই সব খবর আমি জানি না মনে কর? তোমাকে দিয়ে ওখানকার কোন কাজই হয় না। তুমি শুধু একবার গিয়ে হাজিরা দাও।আর গত মাসে তোমার বেতনের তিনগুণ বেশি টাকা তুমি ক্যাস ইনচার্জ থেকে নিয়েছ।
এখন আসল কথায় আসি।তোমরা ওখানে থাকবে।আর অন্য যা খরচ আমি শেফার কাছে পাঠিয়ে দিবো।
—তাহিয়া এখানকার স্কুলে পড়ে।এই সময় স্কুল বন্ধ করলে সমস্যা হবে।
—স্কুলের প্রিন্সিপালের সাথে কথা হয়েছে ,ওদের আরেকটা ব্রাঞ্চ আছে গাজীপুর । শেফার ব্যবহারের জন্য একটা গাড়ি দিবো,ড্রাইভার থাকবে।
—শেফা কি রাজি হবে যেতে?
—শেফার সঙ্গে কথা বলেই তো সব কিছু কনফার্ম করলাম।
—তাহলে সবকিছু ঠিক করে আমাকে জানাচ্ছেন?
—তোমার না জানলেও কোন সমস্যা ছিল না। এবার তুমি যেতে পার।
—কিন্তু ভাইজান..
—এই ব্যপারে আর কোন কথা বলতে চাই না।

রশিদ বেরিয়ে সরাসরি বাসায় গেলো।শেফাকে যেন একেবারে ছেঁচে ফেলতে ইচ্ছে করছে। ভাই-বোন মিলে কি শুরু করছে তার সাথে?
বাসায় ঢুকে সেই মেজাজের কিছুই দেখাতে পারলো না, রশিদের মা সোফায় পা তুলে বসে আছেন। হঠাৎ মায়ের আগমন রশিদের কাছে বোধগম্য হলো না।

চলবে…

#ফাহমিদা_লাইজু

#৫ম_তলার_মেয়েটা

#পর্ব_৮

বাসায় এমন একটা থমথমে পরিবেশ যেন পিন পতনের শব্দে কেঁপে উঠবে।তাই যখন ডোর বেল বেজে উঠলো , যেন পুরো বাসায় কম্পন অনুভূত হলো।

দুলি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে অবাক।দাদুবু বলে জড়িয়ে ধরলো তাদের দাদুকে। চিৎকার করে ডাকতে লাগল-
—মা মা দাদুবু এসেছে।
রোকেয়া দ্রুতপায়ে এসে পা ছুঁয়ে সালাম করলেন।
—আম্মা রাস্তায় কোন কষ্ট হয়নি তো?
—তোমাগো ঢাকায় যা জ্যাম , এইটাই তো অসহ্য।
এ ছাড়া আর কোন সমস্যা হয় নাই।আর সবাই কই?
—আম্মা ওরা সব বাইরে।আপনি ফ্রেশ হয়ে,খেয়ে বিশ্রাম করেন।
দুলি মুখ গোমড়া করে বলল-
—মা তোমরা জানতে দাদুবু আসবে?আমাকে এক বার ও জানাওনি।
—আরে দাদু রাগ করে না। হঠাৎ কইরাই আসতে হইলো।
এবার দাদু পেছনে তাকিয়ে বললেন-
—কিরে আকাশ ভিতরে আসস না ক্যান?

লম্বা ছিপছিপে আকাশ লাজুক মুখে ভেতরে ঢুকে সালাম দিলো।

—নাঈম বলল,সে নিজেই যাবে আমারে আনতে।বল তো নাঈমের এত কাজ ফেলাইয়া যাওনের কি দরকার?নাঈমরে বললাম গাড়ি তো পাঠাইবাই ড্রাইভার তো থাকবোই একলাই আসি।ও কিছুতেই রাজি হইলো না। তখন নাঈমরে বললাম তোর আসার দরকার নাই আমি আকাশরে নিয়া আসতাসি।

—আকাশরে তো তোমরা চিনই , বাবলুর ছেলে। খুব ভালো ছাত্র।ওর আবার কলেজ খোলা,কালকেই চইলা যাইবো।
—আম্মা কোন সমস্যা নেই।ওর কোন সমস্যা না থাকলে, ঢাকায় থেকে বেরিয়ে যাক কয়েকদিন। আকাশ চল ফ্রেশ হয়ে নাও।এই নিয়ে পরে কথা হবে।

হালকা গরম পানিতে লেবুর রস মিশিয়ে নিয়ে এলেন রোকেয়া।
—তুমি কক্খোনো ভুইলা যাও না, আমার কিসের পরে কি দরকার। দুপুরে খাওনের পরে আমি লেবু পানি খাই ,খাওয়া শেষ কইরা রুমে ঢুকতে টুকতেই মগ নিয়া হাজির। তোমার কাছে যে সেবা যত্ন পাই তুমিও তোমার ছেলের বৌয়ের কাছ থাইকা এমুন সেবা যত্ন পাইবা।

দুলি মুখ ভেংচি দিয়ে বলল-
—দাদুবু তোমার এই দোয়া কবুল হবে না।এক গ্লাস পানি ঢেলেও খায় না, তোমার নাতি বৌ সিমি। এখনই আলাদা বাসায় যেতে চায় আর সে করবে মায়ের সেবা।

রোকেয়া রাগি চোখে তাকালেন দুলির দিকে। বোঝাতে চাইলেন কেন এ সব কথা দাদুকে বলছে?

দুলির দাদু রোকেয়ার দিকে তাকালেন। তিনি তাকিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করলেন।আরো দুই ছেলে ঢাকায় থাকলেও তিনি ঢাকায় আসলে সবসময় এই বাসাতেই থাকেন। রোকেয়ার কাছে থাকলে তাঁর শান্তি লাগে আর কোথাও গেলে সেই শান্তি তিনি পান না।অন্য বৌয়েরা তার সেবা যত্ন করলেও তাঁর মনে হয় ওরা করে দায়িত্ব মনে করে, আর রোকেয়া করে আত্নার টানে।তাইতো তিনিও মেজ ছেলের বৌ রোকেয়ার জন্য আত্নার টান অনুভব করেন। তাঁর মায়ের মতো বৌটার কপালে কি ছেলের বৌয়ের আদর জুটবে না?এটা কেমন কথা?

—আম্মা আপনি একটু ঘুমান। সন্ধ্যার পরে যেতে হবে ডাক্তারের কাছে। আপনার ছেলে সিরিয়াল দিয়ে রেখেছে।

—তোমরা সবাই খামোখা অস্থির হইতাছ।নাঈমরে বললাম,বুকে একটু ব্যথা করছিলো,এখন ঠিক আছে। তবুও ছেলে শুনলো না,ঢাকায় আইনাই ছাড়লো।

—একবার চেকাপ করে নিলে সমস্যা কি আম্মা?

—শোন আল্লাহর রহমতে এই বয়সেও তোমাগোর চাইতে ভালো আছি।দেখবা কোন সমস্যাই নাই।

—এত দুরে একা একা থাকেন চিন্তা তো হওয়ারই কথা।এত বার বলার পরেও ঢাকায় এসে থাকবেন না। কয়েকদিন থেকেই অস্থির হয়ে যান। এইবার আর যেতে দিবো না।

—গ্রামের যে তাজা বাতাস তোমাগো ঢাকায় তা কই ?সব তো দূষিত।খাওন থাইকা ধইরা বাতাস সব কিছুই দূষিত। আমার দম আটকা আটকা লাগে ঢাকায়।
রোকেয়া একটু হাসলেন।দুলিকে বললেন-

—চল দাদুকে রেস্ট নিতে দাও।

—মা থাকি না দাদুবুর সঙ্গে।

—তুমি থাকলে বকবক করবে আম্মা একটুও ঘুমাতে পারবেন না।

—আমি একটুও কথা বলবো না।

এবার দাদু বললেন-

—থাকুক না টিয়া পাখিটা।ও কথা বললেও আমার ঘুম চইলা আসবো,এত সুন্দর টিয়া পাখির মতো কথা কয়!

—আম্মা সে এখন খুব দুষ্টু হয়েছে ,একদম কথা শুনতে চায় না।

পরশ আর সিমি এক সাথেই বাসায় এলো।দাদু এসেছে শুনে পরশ এক দৌড়ে দেখা করতে চলে গেল। রোকেয়া সিমিকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বললেন,দাদুর সামনে এমন কোন আচরণ যেন প্রকাশ না পায় যাতে উনি রেগে যান বা কষ্ট পান।

—আমি কিছু না বললেও দোষ হবে,বললেও হবে।

—সিমি আমাকে রাগিও না, তোমাকে সাবধান করে দিলাম।তুমি যখন মনে করছ দোষ হবেই তাহলে বরং কথাই বলো না।এবার চল আম্মার সাথে দেখা করবে আর উনার পা ছুঁয়ে সালাম করবে।

—এইটা ঠিক না,পা ছুঁয়ে সালাম করার কথা ইসলামে বলা নাই।

—ইসলামে যা যা বলা আছে তুমি সেগুলোর কয়টা মেনে চল?যে কোন একটার কথাই বল।বলতে পারবে?আমরা তো সবাই নামাজ পড়ি তুমি কয় ওয়াক্ত নামাজ পড় ?
আর পা ছুঁয়ে সালাম করলে সমস্যা কি?অনেক আগে থেকে যে রীতি চলে এসেছে, আর এতে করে যদি বয়ষ্ক একজন মানুষ মনে তৃপ্তি পান সেটা করা কি খুব বেশি অনুচিত হবে?

সিমির মুখ কালো হয়ে গেলো।সে আর কোন যুক্তি খুঁজে পেলো না।

সিমি দাদুকে সালাম করল।দাদু তাকে হাত ধরে পাশে বসালেন।
—দেখি দেখি নাতবৌরে দেখি, বলে সিমির থুতনিতে ধরলেন।বৌ তো দেখতে শুনতে ভালই।খালি হাতে তো বৌ দেখা যায় না,এই দুলি আমার হাত ব্যাগটা দে তো।
হাত ব্যাগ থেকে একজোড়া ঝুমকা বের করে সিমির হাতে দিয়ে বললেন-
একটু কানে পড়তো ঝুমকাটা ,কেমন মানায় দেখি।
হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলো সিমি।
দাদু আর রোকেয়া মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। দাদু হেসে বললেন-

—পছন্দ হয় নাই?

—হয়েছে।এটা কি স্বর্ণের?
এই বার সামনে একটা দাঁত পড়ে যাওয়া দাদু হো হো করে হেসে উঠলেন।

—তোমার কি ধারণা, সেইটা বল।
—আমার মাকে , আমার দাদু ঝুমকা দিয়েছিলেন স্বর্ণ বলে,পরে দেখা গেলো সেটা ইমিটিশনের।

—তোমার মায়ের সাথে যা হইছে সেইটা যে তোমার সাথেও হইবো সেইটা ভাবো কেমনে? তোমার দাদির সাথে পরশের দাদির তুলনা কর কেমনে?প্রত্যেকটা মানুষই তো আলাদা।
আচ্ছা ঠিক আছে আমি একটু ঘুমাই ,এই বার তুমি যাও।

পরশ খুব রাগ হলো সিমির ব্যবহারে।

—দাদুবু কখনো স্বর্ণ ছাড়া জিনিস দিবেন এটা ভাবলে কি করে?

—আমি এটা আগামীকাল দোকানে দেখিয়ে কনফার্ম হবো আসলেই স্বর্ণ কিনা।

—তুমি তো দেখি শুধু পাগল না অনেক লোভীও।
আমার মনে হয় তোমার সাথে আমাদের সাথে মিলবে না।সম্পর্ক তো শুধু দুইজন মানুষের মধ্যেই হয় না তাদের পরিবার পরিজন সবাইকে নিয়েই থাকতে হয়। আর এখনই এই অবস্থা তাহলে শুধু শুধু এই সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোন মানেই হয় না।

—এর মানে কি?তুমি ডিভোর্সের কথা বলছ?সেটা পারবে না। পাঁচ লাখ টাকা কাবিন হয়েছে।

—কাবিনের টাকা তোমাকে দিয়ে দিবো।

—তাহলেও ছাড়বো না,জেলের ভাত খাওয়াবো।

—সব কিছু এত সহজ ভাবো? আমার আত্মীয় স্বজন কে কোথায়,কি প্রফেসনে আছে জান? সমস্যা তোমার,আমাকে ফাঁসাতে সারাক্ষণ মনে মনে জপ করছ। আমার ফ্যমেলিকে ছোট করে। আর জেলের ভয় দেখাচ্ছ?এই সব করলে তোমার কি অবস্থা আমি করবো চিন্তা ও করতে পারবেনা।এত দিন আমার ভাল রুপ দেখেছ,এখন দেখবে আমার অন্য রুপ। কখনো চাইনি তোমার সাথে আমার এমন বিশ্রি সম্পর্ক তৈরি হোক আমার খারাপ রুপ তুমি দেখ কিন্তু তুমিই এই পরিস্থিতি তৈরি করলে।

এবার যেন একটু ভয় পেলো সিমি।সে চুপ করে রইলো।
মনে মনে ভাবতে লাগলো এদেরকে কিভাবে ঘায়েল করা যায়? নিজের জীবন কখনোই নিজের মায়ের মতো হতে দিবে না ।সেই জন্য যা কিছু করা দরকার সব কিছু করবে। ওদের ভালোমানুষী উপরে দেখানো, কিছু দিন গেলেই খারাপ ব্যবহার শুরু করবে।ওদেরকে একদম বিশ্বাস করে না সিমি।

টমবয় টাইপ মেয়ে পম্পিকে নিয়ে স্বর্ণা হাজির হলো নওমির বাসায়।ছোট,বড়,মাঝারি সব মিলিয়ে পম্পির ব্যাগ চোদ্দটা।একটা ছোট জারে একটা ফাইটার ফিস।এটা অবশ্য পম্পির হাতেই ধরা,অন্য কারো হাতে ফাইটার ফিসের জারটা দিতে পম্পি ভরসা পায় না। দারোয়ান মফিজ ও সাহায্য করলো এগুলো উঠাতে।পম্পি একশ টাকা দিল মফিজকে।মফিজ আশা করেছিল আরেকটু বেশি।
সে উল্টেপাল্টে নোটটা দেখতে লাগলো।
পম্পি বলল-
—কি মামা পোষায়নি? ঠিক আছে এর পরে পুষিয়ে দেব।
—আপনি কি ইখানে পারমেল(পারমানেন্ট) .
‌‌থাকপেন।
—মনে হচ্ছে থাকবো।
—সারকে(স্যার)কি কয়েচ্ছেন(বলেছেন)?
—সেটা আপনাকে ভাবতে হবে না মামা,আমি বলে নিব।ঠিক আছে?
—আইচ্ছা তাইলে পরে আমি আসি।
—আচ্ছা আসেন।

নওমি ভেবে পাচ্ছে না পম্পির এত জিনিস কোথায় রাখবে?
পম্পি বলল-
—কি রে তোর চোখ এত বড় বড় হয়ে গেল কেন?
আমি যেখানে যাই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাথে নিয়ে যেতে হয়।তা না হলে আমি এসে বলবো, আমাকে একটা প্লেট দে,মগ দে ,এটা দে,সেটা দে?
এখন বল কোন রুমে থাকবো,যেখানে বলবি সেখানেই থাকবো।আর শোন বার বার বলতে পারবি না গুছিয়ে রাখ গুছিয়ে রাখ।আমাকে যেখানে থাকতে দিবি নিজের মত বিন্দাস হয়ে থাকবো।অনেক ক্ষুধা লেগেছে এই যে বিরিয়ানি এনেছি তিন জনে খেয়ে নেই।পরে লম্বা একটা ঘুম দিবো। ঘুম থেকে উঠে গোছগাছ শুরু করবো। এখন খেতে খেতে বল তো তোর সমস্যাটা কি? সমস্যাটা নিশ্চয় অনেক বড়।না হলে তোর তো ক্লাস মিস্ দেয়ার কথা না।

প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছুই বলল ওদেরকে নওমি।
পম্পি হাসতে হাসতে বলল-
—এটা কোন সমস্যা? এখন তো আমি আছি।নক করলেই ব্যাটাকে ঢুকিয়ে এমন ধোলাই দিব যে, বাপের নাম ভুলে যাবে।

এবার স্বর্ণা বলল-
—আমি বলি কি তুই বিয়ে করে ফেল নওমি।
এবার পম্পি রেগে ভেঙ্গানোর মতো করে স্বর্ণাকে বলল-
— নওমি তুই বিয়ে করে ফেল।এই গাধা বিয়ে কি কোন সমস্যার সমাধান হলো?বিয়ে হলো জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা।

চলবে…

#ফাহমিদা_লাইজু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here