#৫ম_তলার_মেয়েটা,১৪,১৫
ফাহমিদা_লাইজু
#পর্ব_১৪
সিমি তার পেটের উপর হাতটা রাখে।একটা প্রাণ তার নিজের মধ্যেই আছে চিন্তা করতেই কেমন অদ্ভুত লাগে।মনটা বিষণ্ন হয়ে যায়, তার কোন বান্ধবীর এখনো বাচ্চা হয়নি আর সে বাচ্চা নিয়ে ঘুরবে? কিন্তু আবার যখন ওর মনে হয় ,’আমার নিজের সন্তান,আমার অংশ।’ তখন সেই বিষণ্নতাকে ছাপিয়ে ভালোলাগার একটা অনুভুতি তাকে ঘিরে ধরে। কয়েকদিন আগেও অনেক রাগ লাগতো,শরীরটা যখন খারাপ লাগতো,বমি হতো সব কিছু ভেঙে চুরমার করে দিতে ইচ্ছে করতো। এখন এমনটা হয় না।বমি কমে গেছে, শরীরের অস্থিরতা ও অনেকটা কমেছে,তবে ঘুম কমে গেছে।
কিছুক্ষণ আগেই ভোরের আলো ফুটেছে।সিমির ঘুম ভেঙ্গে গেছে আরো আগে। পরশের দিকে তাকাতেই সিমির মনে হলো কি সুন্দর একটা মুখ।বিয়ের পর থেকে পরশের দিকে ভালো করে তাকানোই হয় না।পরশ হয়েছে ওর মায়ের মত দেখতে।সিমির মনে হয়,’আমার বাচ্চাটা কার মতো দেখতে হবে,ছেলে নাকি মেয়ে হবে?’
পরশের একেবারে কাছে গিয়ে ভালোবাসার গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলো পরশকে।পরশ ভয় পেয়ে জেগে উঠলো-
—তোমার খারাপ লাগছে?
—না,খারাপ লাগছে না।
—তাহলে কি হলো?
—কি আশ্চর্য আমি তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারি না?
পরশ হেসে বলল-
—সেটা তো পারই। কিন্তু তোমার এমন আচরণ দেখে আমি ভয় পেয়ে গেছি, কখনো তো এমন কর না।
সিমি তাকিয়ে রইলো পরশের দিকে।হাসলে পরশকে খুব সুন্দর লাগে।
—কি হলো রাগ করলে আমার কথায়?
—না রাগ করিনি।এবার কথা না বলে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধর তো একটু।
পরশ বুকের মাঝে জড়িয়ে নিল সিমিকে।
কয়েকদিন থেকেই সিমির আচরণে অনেক পরিবর্তন এসেছে।পরশের খুব ভালো লাগছে। নিজেকে খুব সুখি সুখি লাগছে।সিমির অনেক লম্বা চুল।এখন যত্ন নিতে পারে না।চুলে আঙুল চালাতে লাগলো পরশ।
—তোমার চুল আজকে শ্যাম্পু করিয়ে দিবো।মনে হয় ময়লা হয়েছে।
—গন্ধ লাগছে?তাহলে ছাড় দুরে গিয়ে শুই।
—আরে না।চুলটা চিটচিটে হয়ে গেছে।
—তুমি পারবে শ্যাম্পু করিয়ে দিতে?
—কেন পারবো না?
—হয়েছে আর কাজ দেখাতে হবে না।মা-ই আমাকে বিছানায় শুইয়ে শ্যাম্পু করিয়ে দেন।গোসল করার সময় এখানে বসে থাকেন, দরজা খোলা রাখতে বলেন।
—মা অনেক খেয়াল রাখছেন তোমার। তবুও তোমার যদি ইচ্ছে করে আমার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে কিছু দিন থাকতে,থাকতে পার।
—তোমার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে থাকতে হবে না। আমার শ্বশুর বাড়িতেই ভালো আছি আর আমার মা তো আসছেই এক দুই দিন পর পর।দুই মা মিলে আমার জীবন অস্থির করে ফেলল।
—তাঁরা তোমার এত খেয়াল রাখছেন দেখে খুব বিরক্ত হচ্ছো?
—মোটেও না। আমার খুব ভালো লাগে।মনে হয় আবার আমি ছোট হয়ে গেছি।আমাকে জোর করে,ধমক দিয়ে আদর করে খাওয়ায়।
—তাহলে বল তো,তুমি আলাদা বাসায় থাকতে চেয়েছিলে ,তখন এমন টেককেয়ার পেতে?
—আমি ঐ সব কথা একদম মনে করতে চাই না।
আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে কিছু খাবো।
—কি খাবে,এখানে ফ্রুটস, বিস্কিট আরো অনেক কিছু আছে কি খাবে?নাকি ফ্রোজেন ফুড কিছু খাবে,ভেজে দেই?
—এই সব কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না।আমাকে কাঁচা মরিচ আর পিঁয়াজ দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে দাও।
—কি!মুড়ি মাখানো খাবে? আচ্ছা দেখি মুড়ি আছে কিনা?
কিছুক্ষণ পর পরশ মুড়ি মাখিয়ে নিয়ে এলো।সিমি খেতে খেতে বলল-
—এই মুড়ি পৃথিবীর সবচেয়ে মজার মুড়ি মাখানো হয়েছে।এত মজার মুড়ি মাখানো কখনো খাইনি।
—সত্যি বলছ?
—ভালো না লাগলে খেতাম?তুমিও একটু খাও।
—না,তুমি খাও আমি তোমাকে দেখি।
কাঁচা মরিচের ঝালে হু হা করতে লাগল সিমি তবুও সে খুব তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। আর পরশ দেখছে ঝালে লাল আভা ছড়ানো সিমির মুখটা।
বাড়িওয়ালা তোফাজ্জল হোসেন অনেকক্ষণ থেকেই বসে আছেন তাঁর মা শুভ্রতায় জরানো জালেরা বেগমের সামনে।জালেরা বেগম পান বানাচ্ছেন। অনেক সময় নিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে পান বানাচ্ছেন তিনি।মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে এই কাজটা নিখুঁতভাবে না করলে এই পৃথিবীর অনেক অনিষ্ট হয়ে যাবে।জালেরা বেগমের এই স্বভাব, মানে নিজের সামনে কাউকে বসিয়ে রেখে নিজের কাজ করে যাওয়া ,কাউকে এভাবে ইগনোর করা, খুব ভালো ভাবে পেয়েছেন তোফাজ্জল।যখন নিজে এটা করেন তখন বুঝতে না পারলেও তার মা যখন তাকে বসিয়ে রেখে এমনটা করেন তখন কতটা অসহ্য লাগে বুঝতে পারেন।এটাও স্পস্ট বুঝতে পারছেন তার মা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলার জন্য তাকে বসিয়ে রেখেছেন। বিষয়টা অবশ্যই জালেরা বেগমের খুব অপছন্দের কোন বিষয় হবে। তোফাজ্জল ভাবছেন তার মা হয়তো তার স্ত্রী হাজেরার বিষয়ে কিছু বলবেন। ছেলের বৌয়ের দোষ সেটা সারা জীবনের সমস্যা। অনেকক্ষণ বসে থেকে তোফাজ্জল বললেন-
—আম্মা আমার তো দেরি হইয়া গেলো।
জালেরা বেগম চোখ তুলে তাকালেন।একটু মুচকি হেসে বললেন-
—মায়ের কাছে বসার ও সময় নাই তোমার?
তোফাজ্জল ভাবছেন বিষয়টা মনে হয় খুবই জটিল।কারণ আম্মা তাকে তুমি করে বলছেন।
—আচ্ছা ঠিক আছে আম্মা।আমি বসতেছি। আপনের কাজ শেষ হোক।
—আমার কোন কাজ নাই।পান বানানো কোন কাজ হইলো?
—রশিদের খবর কি কওতো।কেন তারে এই বাড়ি ছাড়া করলা?
—আপনেরে বলা যাবে না।সে জঘন্য একজন মানুষ। আমার বোন জামাই না হইলে কল্লাটা কাইটা রাখতাম।
—পাঁচ তলার মেয়েটার জন্য এত দরদ কেন তোমার?
হঠাৎ তোফাজ্জল যেন কারেন্টে শক খেলেন।এত কথা তার মা জানলো কি করে?
—আম্মা এইটা কেমন কথা বলেন? রশিদ যা করছে তাতে ওরে এমনি এমনি ছাইড়া দেয়া যায় না। শুধু মাত্র আমার বোন জামাই বলেই না রক্ষা পাইলো।ঐ মেয়ের মামা পুলিশে কমপ্লেইন করতে চাইছিলো। আমি বললাম আমার বাড়ির ভিতরের ব্যপার আমি সমাধা করতেছি, পুলিশের ঝামেলায় গেলে শুধু শুধু বদনাম হবে।
—তুমি উইঠা গিয়া দরজাটা লাগাইয়া আস।আর তোমার বৌ যে দরজার বাইরে দাঁড়াইয়া কথা শুনতেছে তারে বল আর যদি কখনো এমন করে আমি সোজা ওর গালে থাপ্পড় বসাইয়া দিমু।
তোফাজ্জল উঠে গিয়ে কাউকে পেলেন না তবে বুঝতে পারলেন এই মাত্র হাজেরা সরে গেলো। দরজা লাগিয়ে আবার এসে বসলেন তোফাজ্জল।
—এই বার বল ঐ মেয়েটার বাড়ি কই? এইখানে কার মাধ্যমে আইছে?
—বাড়ি ময়মনসিংহ।ওর মামা আমার পরিচিত। মেয়েটা এতিম।
এতিম কথাটা বলতে গিয়ে তোফাজ্জলের গলাটা কেঁপে উঠলো।তিনি জানেন তার মা জালেরা অসম্ভব বিদূষী একজন মহিলা। তিনি যেন সবসময় মনের ভেতরটা পড়ে ফেলতে পারেন। তোফাজ্জলের এই মুহূর্তে খুব ভয় হচ্ছে। এই রকম ভয় তিনি অনেক বছর আগে পেয়েছিলেন। তার যেন কেমন দিশেহারা লাগছে। তার মা কেন তাকে এত জেরা করছেন?
—ময়মনসিংহের কই যেন তোমার একটা খামার বাড়ি আছে?
—নাগলা।
—আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যাও তাইলে। তোমার না জরুরি কাজ আছে?তুমি এমুন ঘামতাছ কেন?
—আজ মনে হয় গরম খুব বেশি।
—এই রুমে তো এ সি ছাড়ি না। আমার সহ্য হয় না। হাজেরারে বল এক গ্লাস লেবুর শরবত কইরা দিতে।চিনি কম দিয়া।সেই শরবত খাইয়া বাইর হও।
—আচ্ছা ঠিক আছে আম্মা।
তোফাজ্জল যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। কিন্তু তিনি জানেন তার মায়ের মনে নিশ্চই কিছু চলছে।
একটা অজানা ভয় তোফাজ্জল হোসেনকে ঘিরে ধরলো।
হাজেরা মনে হয় এতক্ষণ একটুও বসে নি।কি কথা মা আর ছেলে মিলে এতক্ষণ হলো জানার জন্য অস্থির হয়ে আছেন। তোফাজ্জল বেরিয়ে আসতেই জিজ্ঞেস করলেন-
—আম্মা এতক্ষণ কি নিয়ে আলোচনা করলেন? আমার তো দোষের সীমা নাই।এক মিনিট বসতে পারি না, সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকি কি থেকে আবার কি মাইন্ড করে বসেন।
—তোমার ব্যপারে কিছু বলেননি।তবে তুমি যে লুকিয়ে কথা শুনছিলেন আর একবার এমন করলে আম্মা তোমার গালে কষিয়ে নাকি থাপ্পর দিবেন।
তোফাজ্জল আর দাঁড়ালেন না গট গট করে বেরিয়ে গেলেন। হাজেরা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন জায়গাতেই। তোফাজ্জল থাপ্পরের কথাটা এমনভাবে বললেন যেন হাজেরার গালে সত্যিই একটা থাপ্পর দিয়ে গেলেন।
ঝিমিকে পড়াতে গিয়ে নওমির পাগল হওয়ার অবস্থা। কয়েকদিন আছে পরীক্ষার আর এই মেয়ে তেমন কিছুই পড়েনি।নওমির কাছে এসেই পড়ে ঝিমি। দায়িত্ব নিয়েছে নওমি এখন মানাও করতে পারছে না।আর একটা সমস্যা হলো ঝিমি অনেক বেশি কথা বলে।ওর বয়সের সাথে কথার মিল নেই অনেক পাকা পাকা কথা বলে।এই যেমন পরশুদিন বলল,’আপু তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে?কেন নেই? আমাদের ক্লাসের অনেকের বয়ফ্রেন্ড আছে।ওরা কত জায়গায় ঘুরতে যায়।’
নওমি প্রথমে খুব হাসলো ওর কথা শুনে।এক সময় তো সে নিজেও এই বয়সটা পার হয় এসেছে। তার মনেও এমন অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খেতো।কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারতো না।আর বান্ধবীদের সাথে ও এত খোলামেলা ছিল না।সবার মাঝেই একটা লজ্জা কাজ করতো।আর এখন ঝিমি কি সহজভাবে এই সব প্রশ্ন করছে? নওমির হাসি বন্ধ হলে বলেছে,’পড়তে বসলে কথা বলবে না। পড়ার পর আমরা অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলবো। আমার কাছে যেই জন্য তোমার আসা সেটা যদি মনোযোগ দিয়ে না কর তাহলে লাভ কি এসে? শুধু শুধু আমার এবং তোমার দু’জনেরই সময় নষ্ট।পড়ায় মনোযোগ না দিলে তোমার মায়ের সাথে কথা বলবো।
‘ঠিক আছে মনোযোগ দিবো প্লিজ মাকে বলবে না। এমনিতেই বাবা মাকে কত কথা শোনায় আমার জন্য মাকে কথা শুনতে হোক সেটা একদম চাই না।’
আজ ঝিমি অনেকটা চুপচাপ।ঠিক করেই পড়া শেষ করলো।তবে একটু বেশিই বিষন্ন মনে হচ্ছে ঝিমিকে আজ।পড়া শেষ করে নওমি বলল-
—কফি খাবে?
—হু খাবো।
কফির মগ হাতে নিয়ে নওমি জিজ্ঞেস করলো-
—কিছু হয়েছে ঝিমি?এত মন খারাপ কেন?মন খারাপ থাকলে এত সুন্দর মুখটা কেমন প্যাঁচার মত দেখা যায়।
ঝিমি এতেও একটুও হাসলো না। হঠাৎ নওমিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু
#৫ম_তলার_মেয়েটা
#পর্ব_১৫
ঝিমি কাঁদতেই থাকলো।অনেকটা সময় নওমিকে জড়িয়ে ধরে থেকে কাঁদলো ঝিমি।নওমি ভাবলো কাঁদুক মেয়েটা, ওর মনে জমে থাকা কষ্টটাকে হালকা করুক।
অনেকটা সময় পরে কান্না থামলেও ঝিমির শরীরটা তখনও কেঁপে কেঁপে উঠছিলো।
—এবার বলো তো আমার ছোট্ট আপুটা এমন কি হয়েছে যে এভাবে কাঁদতে হবে?
—আমি আর স্কুলে যাবো না আপু।আজকেও যাইনি।
—আরে,কেন কি হয়েছে?
—আগে বল কাউকে কিছু বলবে না।
—ঠিক আছে বলবো না।
—আমাদের স্কুলে নতুন একজন টিচার এসেছে। ক্লাসে পড়া ধরার সময়,খাতা চেক করার সময় বিভিন্ন সময় মেয়েদের গায়ে হাত দেয়।আমি ভেবেছি আমার মনের ভুল এমন কিছু খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে এ সব করে না। কিন্তু গত পরশুদিন আমাকে বলল ছুটির পর তার কাছ থেকে c w খাতা নিয়ে আসতে।ক্লাসে জমা দেয়া খাতায় নাকি অনেক ভুল।আমাকে ভুল গুলো ধরিয়ে দিবে। আমি গেলাম।টিচার্স রুম খালি না হওয়া পর্যন্ত আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে নিজের কাজ করতে লাগলো।এর পরে কাছে আসতে আসতে একেবারে কাছে, আমার বুকের কাছে চলে এলো।উঃ আপু কি জঘন্য।আমি কোন মতে দৌড়ে চলে এলাম। আমার এখনো কেমন লাগছে,মনে হচ্ছে নিজেকে শেষ করে দেই।
—আরে আরে নিজেকে শেষ করে দিবে মানে কি?তুমি তো কোন অন্যায় করনি।যে অন্যায় করেছে তার শাস্তি হবে।এই ধরনের পশুর উপযুক্ত শাস্তি পেতেই হবে।
—তুমি কি বলে দিবে সবাইকে?আমাকে কিন্তু বলেছ কাউকে কিছু বলবে না।
—শোন না বললে ঐ শয়তানের শাস্তি হবে কি করে?এই ইতরের আরো কোন খারাপ রেকর্ড আছে।আর হয়তো প্রমাণ ও আছে। ভিকটিম সমাজের লজ্জায় কথা বলে না।এতে করে এরা ছাড় পেয়ে যায়। আবার অন্যায় করে ।কোন শাস্তি হয় না তাই বেপরোয়া হয়ে যায়।আজ যদি তুমি আওয়াজ তোল,ভেবে দেখ কত কত মেয়ে বেঁচে যাবে।
—কিভাবে ? কোন প্রমাণ তো নেই।
—টিচার্স রুমে নিশ্চই সি সি ক্যামেরা আছে।
—আছে, তবে নষ্ট।
—কারো না কারো নজরে নিশ্চিই পরেছে এই ঘটনা।
—সেটা জানি না।
—আচ্ছা দেখি আন্টির সাথে কথা বলি।
—মা কিছুতেই বিশ্বাস করবে না।
—করবে, নিজের মেয়েকে বিশ্বাস করবে না?
ঝিমি এই দুইদিন নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছে। বাথরুমে বসে বসে কেঁদেছে।কাকে বলা যায় ভেবেছে।মায়ের মোবাইল নিয়ে দুই বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলেছে, শুধু মুল ঘটনা ছাড়া।তবে ঘটনার আশপাশ দিয়ে গেছে।ওদের কাছেও ভালো লাগে না ঐ স্যারের আচরণ। ওদের মত হলো ,আমেনা ম্যাডামকে অন্তত পক্ষে জানানো দরকার।উনি অনেক ভালো।এই বিষয়গুলো সম্পর্কে ম্যাডাম খোলামেলা আলোচনা মেয়েদের সাথে করেন।উনি প্রধান শিক্ষকের কাছে কথাটা তুলতে পারবেন। ঝামেলা হলো মোবাইলে কথা বলার সময় তার মা আশপাশে ঘুর ঘুর করতে থাকে।কার সাথে কথা বলছে শোনার জন্য।এই জন্য পারু যখন গোসলে ঢুকলো তখন কল করেছে।
অনেক ভেবে ঝিমি আজ নওমিকে বলল।এখন অনেকটা হালকা লাগছে।
পম্পি,রজনীকে জিজ্ঞেস করল-
—কেমন লাগছে খালামনি?
—খুব ভালো লাগছে। অনেকদিন পর রিকশায় উঠলাম।
—আর মুভি কেমন লাগলো?
—এই যে তোমার সাথে মুভি দেখতে এলাম এটাই বড় কথা, আনন্দের কথা ।মুভি কেমন ছিল সেটা কোন বিষয় না। আজকের দিনটা আমার কাছে খুব স্পেশাল হয়ে থাকবে।
—তোমার কোন বোন নেই?একটা ভাই তো আছে এতটুকু জানি।
—আছে।বড় বোন।উনি সিলেট থাকেন।বাবা-মা মরে যাবার পর আমাদের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্নই হয়ে গেছে বলা যায়।আর ভাই,সে যে এত বড় স্বার্থপর হয়ে উঠবে কোনদিন চিন্তাও করিনি। আগে কত ভালোবাসতো আমাকে।এখন আমি হয়েছি তার এটিএম কার্ড। তোমার বাবার কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে।তবে আমি ভেবেছি যেই ভাই আমাকে ফোন করে একটা খবরও নেয় না , আমার জন্য সে আর কোন টাকা পাবে না। তোমার বাবাকে মানা করে দিবো,ভাইয়াকে যেন আর একটা টাকাও না দেয়।
—বাদ দাও তো দুঃখ দুঃখ কথা।দেখ কি সুন্দর আকাশ।সেল্ফি তুলি।
—আগে বান্ধবীদের নিয়ে এভাবে ঘুরে বেড়াতাম।
—তোমার কোন মনের মানুষ ছিল না।
এই কথায় রজনী চোখ নামিয়ে চুপ করে রইলো।
—বলতে না চাইলে সমস্যা নেই।এমনিই জিজ্ঞেস করলাম।
—শাহেদ ছিল। ভার্সিটি লাইফের প্রথম থেকেই দুজন দুজনকে ভালবাসতাম। এক সময় ওর বাবার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছিল। কিছুদিন আগে দেশে এসে আমার নাম্বার জোগাড় করে যোগাযোগ করেছিল।শাহেদ বলল সব কিছু ভুলে আবার আমরা যেন এক হই।
—তাহলে তো ভালোই।
—না ভালো না।একদম ভালো না। সবচেয়ে বড় কথা সে বিপদের দিনে আমাকে একা ফেলে চলে গেছে এই রকম হিপোক্রেটের সাথে কোন ভাবেই আর সম্পর্কে জড়াবো না।আর..
—আর কি?
—তোমার বাবার সাথে একটা সম্পর্ক হয়েছে সেটা যেভাবেই হোক।হয়েছে তো।আমি তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবো না।
—আব্বু তো এমনিতেও তোমাকে বিশ্বাস করে না। তোমার জীবনটা নরক বানিয়ে দিয়েছে। অত্যাচার করা যেমন অপরাধ অত্যাচার সহ্য করা আরো বড় অপরাধ।
—তোমার বাবার স্বভাবই এমন।এমনিতে তো আমার অনেক খেয়াল রাখে।কোন কিছুর অভাব রেখেছে আমার?আমি কার কাছে যাবো, কোথায় যাবো ,কোন আশায় যাবো?
—তোমাদের মতো মহিলাদের জন্য পুরুষরা এতটা সাহস পায় মেয়েদের উপর অত্যাচার করার। আমার মা মরে গিয়ে বেঁচে গেছে।ভাইয়া দেশের বাইরে গিয়ে বেঁচে গেছে।আমি কি করবো? এই সব আর সহ্য হয় না।
এমন সময় পম্পির মোবাইল বেজে উঠলো। রিসিভ করতেই নওমির উত্তেজিত কণ্ঠ।
কিছুটা শুনে পম্পি বলল-
—তোর বাসায় আসছি।
রিকশা ঘুরাতে বলে রজনিকে পম্পি বলল-
—নওমির সঙ্গে একটু কথা বলে যাই।
—অনেক দেরি হয়ে যাবে, তোমার বাবা এসে বাসায় না পেলে কি যে কান্ড করবে?
—ঠিক আছে আমি আব্বুকে কল করে বলে দিচ্ছি।
—হ্যালো আব্বু।আমি রজনি খালামনিকে নিয়ে আমার এক ফ্রেন্ডের বাসায় যাচ্ছি,কোন সমস্যা আছে?
—না না মামনি আমার, কোন সমস্যা নেই।গাড়ি ছেড়ে দিও না।ড্রাইভারকে অপেক্ষা করতে বলবে।
—আমরা তো গাড়ি নিয়ে যাইনি।
—কেন?এখনই ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে তোমরা যেখানে আছ যেতে বল।
—কেন আব্বু?লাগবে না গাড়ি।
—যা বলছি শোন। ওখানে যেতে বল আসার সময় গাড়িতে আসবে। আমার খুব টেনশন হবে।
—ঠিক আছে।
—লক্ষ্মী মা আমার।
পম্পির আব্বুর খুব ভালো লাগছে,আজ কতদিন পর মেয়েটা তার সাথে কথা বলল। রজনীকে বিয়ে করে নিয়ে আসার পর থেকে আর কথা বলেনি। সেদিন কিছুই বলেনি পম্পি,ওর চোখদুটো শুধু ছল ছল করছিলো।এর পরদিন ও বাসা ছেড়ে চলে যায়।ফোনে হোক তবুও তো কথা বলল।এটা হয়তো সম্ভব হয়েছে রজনীর জন্য। রজনীর মধ্যে কোন কিছু একটা আছে যা মানুষকে খুব টানে।তা না হলে তিনি নিজেই কেন এতটা আকর্ষীত হবেন? স্ত্রীর মৃত্যুর পর যেই মানুষ ভেবেছিলেন কোন দিন আর বিয়ে করবেন না সেই মানুষ রজনীকে দেখে একেবারে পাগল হয়ে গেলেন। তখন তাঁর শুধু মনে হতো যে কোন উপায়ে হোক রজনীকে চাই ই চাই।তাই তো এত কাঠখর পুড়িয়ে তার চাইতে এত বয়সের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও রজনীকে বিয়ে করে আনলেন। ছেলে সম্পর্ক ছিন্ন করলো।মেয়েটাও দুরে সরে গিয়েছিল।এখন সব কিছু ঠিক হবে মনে হচ্ছে।এত দিন তো পম্পি রজনীকে সহ্যই করতে পারতো না।পম্পি অসুস্থ হওয়ার পর রজনী যেভাবে সেবা করেছে এটাও একটা কারণ পম্পির রাগ গলানোর ।
মোবাইল রাখতেই রজনী বলল-
—কি বলল তোমার বাবা?
—ড্রাইভারকে কল দিয়ে গাড়ি আনিয়ে নিতে বলেছে।
এই মামা দাঁড়ান চলে এসেছি।
দরজা খুলে নওমি অবাক রজনীকে দেখে।জরিয়ে ধরলো রজনীকে।কি কথা বলার ছিল ভুলে গেলো। পম্পি বলল-
—এবার বল ঘটনা কি?
ঝিমির সব ঘটনা খুলে বলল ওদের।এটাও বলল,নওমি , ঝিমির মায়ের সাথে এটা আলোচনা করার পরে, উনি কিছুতেই ঐ টিচারের বিরুদ্ধে কমপ্লেইন করতে রাজি হলেন না।উল্টো ঝিমিকে বকাবকি করতে লাগলেন,কেন আমার কাছে ঝিমি বলল।উনি বললেন এই কয়দিন স্কুলে না গেলে কিছুই হবে না।
—এটা কোন সমাধান হলো, বল পম্পি?ঐ শয়তান আরেক জনকে স্বীকার বানাবে।
—এক দম ঠিক বলেছিস।এখনই চল পাশের বাসায় যাবো।উনাদের বুঝিয়ে বলতে হবে।
শফিক লিভিং রুমেই বসে ছিলেন।ওদের দেখে বুঝতে পারলেন না কেন এসেছে।পারু তাড়াতাড়ি এসে বললেন-
—ভেতরে আস। আমারা রুমে বসে কথা বলি।
পম্পি বলল-
—আপনার সঙ্গে তো নওমির কথা হয়েছেই।এখন আমারা আঙ্কেলের সাথে কথা বলতে চাই।
শফিক নড়েচড়ে বসলেন।
পারু তাড়াতাড়ি বলল-
—এই নওমির কাছে ঝিমিকে পড়তে দেওয়াই ভুল হয়েছে।
শফিক বললেন-
—তোমরা কি বলবে আমাকে কি হয়েছে?
—আঙ্কেল আপনার কোন মেয়ের সাথে কোন পুরুষ অসভ্যতা করলে আপনি সেটা হজম করে ফেলতে বলবেন?নাকি আপনার মেয়েকেই দোষারোপ করবেন?
ঝিমি আড়ালে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগলো।
—কি হয়েছে আমাকে খুলে বল।
পম্পি সব কিছু বলল।
শুনে শফিক রাগে কাঁপতে লাগলেন।পারু ভয় পেয়ে গেলেন।তিনি বললেন-
—এই জন্যই আমি তাকে জানাতে চাইনি।এখন দেখলে কেমন রেগে গেলো।এখন ঝিমিকে মেরেই ফেলবে।
শফিক রেগে বললেন-
—চুপ কর তুমি পারু। আমার মেয়ের সাথে অসভ্যতামী!ঐ জানোয়ারকে আমি শেষ করে ফেলবো।
—আঙ্কেল প্লিজ শান্ত হোন।সব কিছু করতে হবে খুব ঠান্ডা মাথায়।
—এমন একটা জানোয়ার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মতো একটা পবিত্র জায়গায় কিভাবে থাকে?এর শাস্তি তো পেতেই হবে।
—আঙ্কেল আমি আমার বাবাকে বলে সব কিছু ব্যবস্থা করবো। আগামীকাল আমরা সবাই যাবো ঝিমির স্কুলে।আর আরো এমন ভিকটিম পেয়ে যাবো স্কুলেই। শুধু ওদের একটু অভয় দিতে হবে।
ঝিমিদের আমেনা ম্যাডামের সাথেই প্রথমে কথা বলতে হবে।
রজনী এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি। এবার বলল-
—নিজের সন্তানের উপর কোন আচ আসলে বাবা মাকে হিংস্র নেকড়ের চেয়েও হিংস্র হয়ে সন্তানকে রক্ষা করা উচিত।এই সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে অসভ্য গুলো আর দ্বিতীয় বার এই অন্যায় করতে সাহস পাবে না।
দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি হওয়া উচিত এদের।
শফিক মুখ গম্ভীর করে বসে রইলেন।নওমি খুব ভয় পাচ্ছিলো শফিক সব শুনে পারুর মতোই রিয়েক্ট করবে।উনি যে এই অন্যায় মুখ বুঁজে সহ্য করবেন না এটা বোঝাই যায়নি।মনে মনে থ্যাংস জানালো শফিক আঙ্কেলকে, গভীর শ্রদ্ধা অনুভব করলো সে শফিকের প্রতি।
ওরা চলে যাওয়ার সময় শফিক বলল-
—নওমি মা আমার কাছে এসে একটু বস তো।
নওমি বসলো।
— আমাকে ক্ষমা করে দিও মা।
নওমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল শফিকের দিকে।
—রশিদ যে তোমার দরজায় নক করতো,আমি টের পেয়েও কিছু বলিনি।আমি দরজা খুলে বের হলেই ও আর এই সাহস পেতো না।তোমার প্রতি অন্যায় হতে দেখেও চুপ ছিলাম, তোমার পাশে দাঁড়াইনি।
এখন দেখ, প্রকৃতির কি বিচার আমার কর্ম আমার কাছেই ফেরত এলো।
—আঙ্কেল যা হবার হয়ে গেছে।ঝিমির ঘটনায় আপনি নিজেকে দায়ী ভাববেন না। এই সব নিপীড়নের কি যে যন্ত্রনা আমি টের পেয়েছি। সহ্য করা যায় না।নিজেকেই শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে।ঝিমি ছোট মানুষ, ওর এখন মানুষিক সাপোর্ট খুব দরকার।সবাইকে এখন ওর পাশে থাকতে হবে।
—তোমরা চিন্তা করো না।
শফিক ঝিমিকে ডাকলেন-
—আমার কাছে এসে বস মা।যা হয়েছে , তাতে তোমার কোন দোষ নেই।ঐ রাসকেলকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়েই ছাড়বো।তুমি একদম এই সব নিয়ে ভেবো না।মন দিয়ে শুধু পড়াশোনা কর।ঠিক আছে।
ঝিমি কেঁদে কেঁদে বাবার বুকে লুটিয়ে পড়ল ঝিমির এখন আর একটুও ভয় লাগছে না।ওর বাবা ওর পাশে আছে। তার বাবা এত ভালো, আগে কখনো বুঝতে পারেনি।মনে মনে বাবাকে বলল,’বাবা তোমাকে খুব ভালোবাসি।’
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু