৫ম_তলার_মেয়েটা,১৮,১৯

0
714

#৫ম_তলার_মেয়েটা,১৮,১৯
ফাহমিদা_লাইজু
#পর্ব_১৮

নওমিকে ডাইনিং টেবিলে দেখে তোফাজ্জল হোসেন চমকে গেলেন। ব্যপারটা এতটাই অপ্রত্যাশিত যে তোফাজ্জল দাঁড়িয়েই রইলেন যতক্ষণ না তাঁর মা তাঁকে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসতে তাড়া দিলেন।নওমি, তোফাজ্জলকে দেখে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।দাদু ওকে বসতে এবং খেতে শুরু করতে বললেন।

এত খাবারের আইটেম করা হয়েছে যে, নওমি বুঝতে পারছে না কোনটা দিয়ে শুরু করবে। মনে মনে তার কান্নাও পাচ্ছে। এতটা আদর করে খাওয়ায় শুধু রজনী। পম্পিদের বাসায় গেলে টেবিল ভর্তি করে খাবার দেয় রজনী। সব গুলো আইটেম থেকেই খেতে হয়। রজনী বসে থেকে খুব আদর করে খাওয়ায়।যেটা জীবনে কারো কাছ থেকে নওমি পায়নি। পম্পি তার বান্ধবী আর রজনী, পম্পির সৎ মা হলেও এখন তাদের বান্ধবী।সেই ব্যপারটা আলাদা।
কিন্তু আজ এখানে এমন অবস্থা দেখে তার কান্না পাচ্ছে। তাকে উদ্দেশ্য করেও কেউ এত আয়োজন করতে পারে এটা বিশ্বাস হচ্ছে না। খাওয়াটাই বড় কথা না, এখানে যে ভালবাসা মিশে আছে সেটারও গন্ধ পাচ্ছে নওমি।

তোফাজ্জল বাসায় কখন আসবেন তার ঠিক থাকে না।আজ তাঁর মা জালেরা বেগম কল করে,রাত নয়টার মধ্যে চলে আসতে বলেছিলেন তোফাজ্জলকে।

তোফাজ্জল হোসেন এসে বসলেন টেবিলে। তিনি হেসে জিজ্ঞেস করলেন-
—বাহ্ বিরাট আয়োজন! আজকে বিশেষ কিছু আম্মা?
—বিশেষ তো অবশ্যই। তোর ঘরেতো মাইয়া হইল না, দুই ছেলে তাও আবার বিদেশ পইড়া আছে। এখন এইখানে আমি এই নাতনিরে পাইছি। এই উপলক্ষেই এই সামান্য আয়োজন।

তোফাজ্জল হোসেন কিছু ভাবতে লাগলেন। তার মা আসলে কি করতে চাইছে সেটার ধারণাও করতে পারছেন না তিনি। অন্য কেউ হলে লোক লাগিয়ে যে কোনো খবর হোক বের করে ফেলতে পারতেন খুব অনায়াসে। কিন্তু তার মায়ের মনে কি চলছে সেটার ধারণাও এই পৃথিবীর কেউ করতে পারবে না। সবচেয়ে বড় কথা এত এত মানুষের চোখ দেখে মনের কথা বুঝতে পারলেও তার মায়ের মনের কথা কোনদিন বুঝতে পারেননি। গভীর চিন্তায় তার কপালে ভাঁজ পড়ে গেল।
তোফাজ্জল খাবার সামনে নিয়ে বসে আছেন দেখে মা তাড়া দিলেন খেতে। এটাও বললেন, খাবার সামনে নিয়ে বসে থাকতে হয় না।
তোফাজ্জল তার আম্মাকে কিভাবে বোঝাবে তার ভেতরে কি ঝড় বইছে।যদিও তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন নরমাল থাকতে।এখন তার কাছে ছোট্ট বেলার মত মনে হচ্ছে। ছোট্ট বেলায় কোন অন্যায় করে ফেললে,আম্মার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখার পর আম্মা জবাবদিহিতার জন্য যখন সামনে দাঁড় করিয়ে রাখতেন, ঠিক তেমন অনুভূতি হচ্ছে। আবার তার ছোট্ট হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। তখন আম্মা শাসনের পরে আবার বুকে জড়িয়ে বলতেন, দ্বিতীয়বার যেন এমন না হয়। এখন এই বয়সে কোন অন্যায় তো আর ক্ষমা করে দিতে পারবে না। আর বুকে জড়িয়ে বলতেও পারবেন না, এমনটা যেন না হয়।তিনি এখন যে পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছেন এটা কোন অন্যায় নয় বরং জীবনের অনেক বড় একটা ভুল।

এর মধ্যে দুইটা আইটেম জালেরা বেগম নিজে তৈরি করেছেন- একটা হলো পটলের দোড়মা আর একটা হলো ফলি মাছের কোপ্তা।
প্রতি সপ্তাহে মাছের আরত থেকে বিভিন্ন রকমের মাছ আসে এই বাড়িতে।এখন তোফাজ্জলের মা আছেন তাই তিনি যেই সব মাছ খেতে পছন্দ করেন সব আনিয়ে রাখেন।তিনি মাংস খেতে বেশি পছন্দ করেন না।
তোফাজ্জলের স্ত্রী হাজেরা বললেন-
—নওমি এই দোড়মা আর কোপ্তা অবশ্যই খাবে।আজ অনেক বছর পরে আম্মা আমার রান্না ঘরে ঢুকে এই দুই আইটেম রান্না করেছেন,শুধু তোমার জন্য।
এই কথা শুনে তোফাজ্জল খুশি হয়ে বলে উঠলেন-
—তাই নাকি !এই গুলোই আগে খাবো। আমার খুব পছন্দের।আগে আম্মা আমার জন্য প্রায়ই করতেন মাছের কোপ্তা।আম্মা মনে আছে আপনার?
—মনে আবার থাকবো না?খাওন নিয়া সবচাইতে বেশি জ্বালাইছস তুই। খাওয়া পছন্দ না হইলেই খাইবি না কইতি।তাই তোর পছন্দ মতো রানতে চেষ্টা করতাম।

তোফাজ্জল আবার ভাবনার রাজ্যে ডুব দিলেন। নওমির মা নিরার ও রান্নার হাত খুব ভালো ছিল।সব সময় আরো ভালো রান্না করতে চেষ্টা করতো। তোফাজ্জল যখন রান্নার প্রশংসা করতেন তখন নিরার চোখ জ্বলে জ্বল করে উঠতো খুশিতে।

জালেরা বেগম এখানে বসে আছেন ঠিকই কিন্তু তার মন চলে গিয়েছে সেই সময়ে, যখন তার শাশুড়ি এই সব রান্না তাঁকে ধরে ধরে শিখিয়েছিলেন।আর প্রত্যেকটা রান্না প্রথমবার করার পরে, খেয়ে বলতেন,’খুব সোয়াদ অইছে বৌ।’
আহ কিভাবে সময় চলে যায়!মনে হয় এই তো সেই দিনের কথা। তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথেই সব কিছুই শেষ,এই পৃথিবীর সব কিছুর সাথেই সম্পর্ক শেষ!আজ তিনি মরে গেলেও তাই হবে।আজ তিনি তাঁর শাশুড়িকে মনে করে কষ্ট পাচ্ছেন কিন্তু তাঁর ছেলের বৌয়েরা তাঁকে এভাবে মনেই করবে না হয়তো। বেঁচে থাকতেই দেখছেন বৌরা তাঁকে কতটা পছন্দ করে!এর জন্য কি তিনি দায়ী?সব সময় চেয়েছেন বৌরা সব কিছু ভালো করে করুক নিয়মমতো চলুক এই সব চাওয়া কি খুব অন্যায় ছিল?বিয়ের পরে বৌ নিয়ে সব ছেলেরা দূরে দূরে চলে গেল।এতে অবশ্য ছেলেদের দোষ নেই।যার যার কর্মস্থলে তো বৌকে নিয়ে থাকবেই।যখন ওরা বাড়ি যায় কিংবা তিনি ছেলেদের বাড়িতে আসেন তার মন টেকে না।দম বন্ধ লাগে , আশপাশের ওদেরকে দূরের মানুষ মনে হয়।

নওমির গলায় খাবার যেন আটকে যাচ্ছে। সবার সামনে খেতে তার খুব লজ্জাও লাগছে। সারাজীবন নিজেকে গুটিয়ে রাখতে রাখতে একটা জড়তা সব সময় কাজ করে। পম্পির সাথে মিশে তবুও অনেকটা সহজ হতে শিখেছে।তবে সেটাও নির্দিষ্ট একটা গন্ডির ভেতরে। বাড়িওয়ালা এবং তার পরিবার অবশ্যই এই গন্ডির বাইরে।

তোফাজ্জল আড়চোখে বার বার নওমিকে দেখছেন আর দীর্ঘশ্বাস গোপন করছেন।কি মায়াবী চেহারা হয়েছে মেয়েটার। কাছে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিবেন,কত গল্প করবেন সেই সবের কোন সুযোগ নেই।যেই মেয়েটার এই পৃথিবীতে আসার কথাই না সে দিব্যি বসে আছে তার সামনে। নওমির জন্মের খবর তিনি পেয়েছেন নওমির জন্মের উনিশ বছর পরে। তার পর থেকে মেয়েটা তার চোখের সামনেই আছে।কি দুর্ভাগা একটা মেয়ে। কিন্তু এখন তিনি আছেন। কিভাবে নওমির জীবন সুন্দর করা যায় সেটার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাবেন। বাকিটা ওপরওয়ালার ইচ্ছা। এর মাঝে তার মা জালেরা বেগম কোন ঝামেলা না বাজালেই হয়।তা না হলে সবকিছু ভন্ডুল হয়ে যাবে । তাহলে নওমির জীবনটা আরো দুর্বিষহ হয়ে যেতে পারে। তোফাজ্জল ঠিক করলেন আম্মার সাথে তিনি কথা বলবেন।

বাসায় এসে নওমি তার মামাকে কল দিলো।সব কিছু বলল, কিভাবে যত্ন করে ওকে খাইয়েছে, কিভাবে আদর করে কথা বলেন দাদু,সব কিছু বলল।মামা একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন আবার ভয়ও পেলেন, এটা কোন ঝড়ের পূর্বাভাস নয়তো?নওমিকে কিছুই বুঝতে দিলেন না।মুখে মুখে বললেন, খুব ভালো, খুব ভালো।’

এতদিন পর আজ হঠাৎ নওমির খুব আফসোস হতে লাগল তার নিজের একটা পরিবার নেই বলে। কেন সবার সব কিছু থাকতেও তার কিছুই নেই?তার মন ডুকরে উঠলো।এমন সময় মোবাইলে কল এলো। স্ক্রিনে তাশফির নাম ভেসে উঠলো।যেই পর্যন্ত রিসিভ না করবে কল করতেই থাকবে।তাই কল ধরবে না ধরবে না করেও শেষ পর্যন্ত ধরলো।
নওমির ভারি গলা শুনেই তাশফি অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
—কি হয়েছে?কি হয়েছে তোমার কাঁদছ কেন?
—এমনি।
—এমনি মানে কি?বল আমাকে?
—বাড়িওয়ালার বাসায় রাতের খাবারের দাওয়াত ছিল।ওখান থেকে আসার পর থেকে মনটা খারাপ লাগছে।
—কেন?
—সবার পরিবার আছে, আমার কেন একটা পরিবার নেই।এক মামা ছাড়া কারো আদর পাইনি।
—আমাদের পরিবার হবে।তুমি, আমি মিলে পরিবার হবে। আমার আব্বু-আম্মু তোমাকে খুব আদর করবে দেখো।
নওমি চুপ করে আছে দেখে -তাশফি বলল-
—কি হলো বল।
—কিছু না।
—আমি আম্মুর কাছে তোমার কথা বলেছি। তোমার ছবি দেখিয়েছি।আম্মু খুব পছন্দ করেছেন তোমাকে।
—আপনি কি বলে পরিচয় দিয়েছেন আমার?
—আমার পছন্দের মানুষ-এটাই বলেছি আম্মুকে।
তুমি কি ভেবেছ বলবো তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড?
—সেটাই ভেবেছিলাম।
—আমার কি মাথা খারাপ। তুমি এখনো বলইনি আমাকে পছন্দ কর কিনা,তাহলে কিভাবে বলি তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড?
এবার ও চুপ।এবার দুজনেই চুপ। কিছুক্ষণ পর তাশফি বলল-
—আমি কি তোমাকে ডিস্টার্ব করি? আমার সাথে কথা বলে বিরক্ত হও?
—না তো।
—তাহলে?
—তাহলে কি?
—আমাকে পছন্দ কর?
—আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।
—কথা এড়িয়ে যাচ্ছ কেন?
—যে মনের কথা বোঝে না তার সাথে কথা নেই।
বলেই নওমি কল কেটে দিলো।

কল কেটে গেলে ,তাশফি মোবাইলটা এক হাত দিয়ে বুকে চেপে বসে রইলো। তার মনে হচ্ছিল এই মোবাইলটাই নওমি।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছে নওমি, স্বর্ণা এখন আগের মতো মিশতে চায় না একটু এড়িয়ে চলছে চায়। এই কথাটা স্বর্ণাকে বলার পর ও বলল,’ নওমি তুই ইদানিং আমার কাছে অনেক কথা বলিস না।আর এখন তো তোর প্রাণের বন্ধু হয়েছে পম্পি।যেই পম্পিকে আগে তুই দেখতেই পারতি না।এখন আমার সাথে না মিশলেও হবে তোর।
নওমি একদম অবাক হয়ে গিয়েছিল।আসলেই কি স্বর্ণার কথা ঠিক?স্বর্ণার সঙ্গে প্রথম পরিচয় থাকলেও, ক্যাম্পাসে তার প্রথম ফ্রেন্ড হলেও একটা সূক্ষ্ম দূরত্ব ছিল সবসময়। যেটা পম্পির মাঝে নেই। পম্পি কিভাবে যেন মনের গভীরে ঢুকে যেতে পারে।আর এখন তো রজনী,যার কোন তুলনাই নেই,যে একাধারে মা ,বোন আর বান্ধবীর মতো।

নওমির মামা হোসেনের চোখে ঘুম আসছিল না। তাঁর খুব আদরের বোন ছিল নওমির মা নিরা। বোনটার জন্য কিছুই করতে পারেনি।করতে পারলে হয়তো এভাবে মরতে হতো না নিরাকে।সব কিছুর মূলে ছিল অভাব।নিরা ক্লাস নাইনে উঠতেই বাবা বিয়ে দিয়ে দিলেন।তখন হোসেন কলেজে পড়ে।তার বড় অন্য দুই বোনেরও বিয়ে হয়ে গিয়েছে।তিন মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে যৌতুকের টাকা যোগাড় করতে জমিজমা বিক্রি করতে হয় হোসেনের বাবাকে।নিরাকে টাকা পয়সা, জিনিস বরের চাহিদা অনুযায়ী সব কিছু দেয়া হয়েছিল। বিয়ের কিছুদিন পরেই নিরা বুঝতে পারে তার স্বামী একটা জুয়াখোর। একসময় সব কিছু এভাবেই শেষ হয়ে গেল।আরো যৌতুকের জন্য নিরাকে তার স্বামী বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিল। নিঃশ্ব বাপ কোত্থেকে দিবে?বিয়ের জন্য পড়াশোনা হলো না, কি করবে ভেবে পেলো না ।এত সব সমস্যায় নিরার বাবা হঠাৎ মরে গেলেন।বলা যায় মরে গিয়ে তিনি বেঁচে গেলেন।মা আগেই মারা গিয়েছিলেন।

সংসারে রইলো হোসেন আর নিরা দুই ভাই বোন।
এইচএসসি পাস করা হোসেন চাকরি খুঁজতে লাগলো।একসময় একটা খামারে কাজ জোগাড় হলো হোসেনের।এই বহুমুখী খামারে চাষ হয় মাছ, মুরগী আর গরু পালন করা হয়। অনেক বড় জায়গা জুড়ে এই খামার।আর এখানে মালিকের সময় কাটানোর জন্য খুব সুন্দর করে তৈরি করা হয়েছে খামার বাড়ি।মালিক মাঝে মাঝে আসেন সব কিছু তদারকি করতে।রান্নার জন্য একজন মহিলা আছেন।হঠাৎ সেই মহিলা অসুস্থ হয়ে পড়লে, হোসেনের উপর দায়িত্ব পড়লো রান্নার জন্য একজন মহিলা খুঁজে আনার।সেই মুহূর্তেই প্রয়োজন, কারণ মালিক উপস্থিত।
হোসেনের বাড়ি বেশ খানিকটা দূরে। আশপাশে খোঁজ করেও কাউকে জোগাড় করতে পারলো না হোসেন। হঠাৎই মনে পড়লো বোন নিরার কথা।

বাড়ি পৌঁছে দেখে নিরার স্বামী বেরিয়ে যাচ্ছে। দেখেই মাথায় রক্ত উঠে গেলো হোসেনের।নিরার স্বামী , হোসেনের গালিগালাজ কিছুই গায়ে মাখলো না দাঁত কেলিয়ে হেসে হেসে বেরিয়ে গেলো।
ঘরের ভেতরে নিরা বসে বসে কাঁদছে।হোসেন জানতে পারলো,নিরার স্বামী দুই দিন আগে এসেছে। তার আসল উদ্দেশ্য নিরা আগে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝলো।সে এসেছিলো নিরার গায়ের শেষ গয়না কানের রিং জোড়া খুলে নিতে।

চলবে…

#ফাহমিদা_লাইজু

#৫ম_তলার_মেয়েটা

#পর্ব_১৯

হোসেন বাড়ী নেই জেনেই নিরার স্বামী আসতে সাহস পেয়েছে। হোসেন বোনকে সান্ত্বনা দিলো। বোনকে বলল,সে যেই খামারে কাজ করে সেখানে নিয়ে যেতে এসেছে তাকে। সেখানে রান্নার কাজ করবে নিরা তাহলে ভাই-বোন এক জায়গাতেই থাকতে পারবে।একা একা এই বাড়ীতে নিরাকে থাকতে হবে না।এর মাঝেই অনেক শকুনের চোখ এই বাড়ীর উপর পড়েছে ,যারা নিরাকে খুবলে খেতে চায়।

এক অজানার পথে যাত্রা করলো নিরা।তবে তার ভাই সাথে আছে তাই বিন্দুমাত্র ভয় লাগছে না তার। খামারে ঢুকতেই মনটা ভালো হয়ে গেল নিরার।অনেক জাতের,অনেক রঙের গোলাপ ফুলের গাছ আর প্রতিটা গাছেই ফুল ফুটে আছে।
কি অপূর্ব লাগছে দেখতে,চোখ জুড়িয়ে যায়। জীবনে কোন দিন এত গোলাপ ফুলের গাছ সে দেখেনি।এই সুন্দর্য তার চোখ আটকে দিলো। হোসেন পেছনে তাকিয়ে দেখে নিরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুল দেখছে,সে কাছে এসে বলল,’এখন প্রত্যেক দিনই দেখতে পারবি, এইবার চল।’

এই খামারের মালিক তোফাজ্জল হোসেনের সামনে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল নিরা। হোসেন নিরার প্রশংসা করে যাচ্ছে,ওর রান্নার হাত কতটা ভালো খাওয়ার পরই বুঝতে পারবেন , আরো কত কি। তোফাজ্জল একবার মাথা তুলে বললেন,’ঠিক আছে কাজে লেগে যাও।’

রান্না আসলেই ভালো হয়েছে,এত এত টাকা ইনকাম করে লাভ কি যদি তৃপ্তি করে খেতেই না পারেন।হোসেনকে ডেকে বললেন,’তোমার বোনের চাকরি পাকা। ডাক তোমার বোনকে । খুব ভালো রান্না করে।নিরা দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল। ভেতরে ঢুকলো মাথা নিচু করে। তোফাজ্জল বললেন,’এখানে আমাকে প্রায়ই আসতেন হয়। আমি আবার রান্না ভালো না হলে খেতে পারি না।
ভালোই হলো তোমাকে নিয়ে এসেছে হোসেন,নাম কি তোমার?,’নিরা’।
‘শোন নিরা রান্নার আগে আমার কাছে জেনে নিবে কি রান্না করবে,ঠিক আছে?’
‘জী ঠিক আছে।’

খামারের কাজের জন্য অনেক কাজের লোক আছে,যাদেরকে স্থানিয় ভাষায় কামলা বলা হয়। এদের মধ্যে যাদের বাড়ী কাছে তারা বাড়ীতে গিয়েই খায় আর যারা এখানে থাকে তারা নিজেরাই রান্না করে খায়।ওদের থাকা খাওয়ার সব ব্যবস্থা উত্তর পাশে।আর তোফাজ্জল হোসেনের বাংলো দক্ষিণ পাশে।এখানেই রান্না ঘরে নিরার থাকার ব্যবস্থা।হোসেন থাকে রান্না ঘর লাগোয়া একটা চিলতে ঘরে।তার কাজ হলো তোফাজ্জল হোসেনের তদারকি করা , কাজের হিসাব রাখা এক কথায় সেক্রেটারি। তাই তার জায়গা কামলাদের চাইতে একটু উঁচুতে। এখানে ম্যানেজার ও আছে তবে সে রাতে থাকে না।তার বাড়ী কাছেই।

তোফাজ্জল যখন থাকেন তখন নিরার কাজ খুব বেশি থাকে।প্রতিবেলায় রান্না করতে হয়। ঘরদোর ঝকঝকে রাখা ইত্যাদি।তোফাজ্জল কি মোলায়েম করে কথা বলেন,নিরা এমনটা কখনো দেখেনি। সব পুরুষ প্রথমে তার শরীরের দিকেই নজর দেয় কিন্তু তোফাজ্জল খুব ভালো। কিছু ভুল হলে বুঝিয়ে বলেন।নিরার চোখে অমায়িক, ভদ্র একজন মানুষ।তবে মানুষটার একটা দোষ আছে,মাঝে মধ্যে মদ খায়। তখন মানুষটা বদলে যায়।এই ব্যপারে একদিন সাহস করে বলেছেও নিরা,’স্যার এই সব না খাইলে হয় না?’ তোফাজ্জল হেসে বলেছিলেন, ‘অভ্যাস হয়ে গেছে, বুঝলে অভ্যাস খুব খারাপ জিনিস।’ তোফাজ্জল এই কম বয়সী মেয়েটাকে পছন্দ করেন।অনেক ভালো মেয়ে। কপাল গুনে এখানে কাজ করতে এসেছে, ভালো ঘরে থাকলে রাজকন্যার মতো থাকতো। তোফাজ্জল চলে গেলে নিরার কেমন খালি খালি লাগে।মনে হয় কোন কাজই নেই। এখানে আসার পর নিরা আর হোসেনের আর কোন চিন্তা নেই।ভালো খাওয়া দাওয়ায় শরীর স্বাস্থ্যও ভালো হয়েছে।তবে কিছু কিছু রাত নির্ঘুম কাটে নিরার। তখন সে লম্বা মেঘের মতো কালো চুল মেলে বারান্দায় বসে আকাশ দেখে আর চুলে হাত বুলিয়ে উকুন আনে। দুঃখ বেশি ভর করলে চোখের পানি ফেলে। অন্ধকারে কেউ দেখলে নিশ্চিত ভুত ভেবে ভুল করবে।
এক রাতে এমনি করে চুল মেলে বসেছিল নিরা। তার চোখ বেয়ে পানি ঝড়ছিলো।আকাশটা ছিল গভীর রহস্যময়,মেঘ ছিল না, চাঁদ ও ছিল না আবার ঘুটঘুটে অন্ধকার ও ছিল না, খুব বেশি বাতাস ছিল না, খুব বেশি গরম বা ঠান্ডা ও ছিল না। তোফাজ্জল ওয়াক ওয়াক করে বমি করছিলেন । রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে সেই শব্দ এত দুরে বসেও নিরা শুনতে পেয়ে দৌড়ে গেল। দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল।হয়তো দরজা লাগাতে ভুলে গেছে। তারাতাড়ি তোফাজ্জলকে ধরলো নিরা।বমি শেষ হলে খাটে শুইয়ে ঘরের বমি পরিষ্কার করলো। এরপর তোফাজ্জল পানি খেতে চাইলে দিল। নিজেই বলতে লাগলেন ,’এত বেশি ড্রিংস করা ঠিক হয়নি,একটু লেবু পানি এনে দাও তো।’ নিরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লেবু পানি নিয়ে এলো।
তোফাজ্জল ঢক ঢক করে লেবু পানি শেষ করলো। এতক্ষণে এই দুই নরনারীর খেয়াল হলো এই নিশুতি রাতে এই ঘরে আর কেউ নেই , দুজন একেবারে কাছাকাছি। বয়ষ্ক মানুষ সব সময় বলেন,’আগুন আর ঘি পাশাপাশি রাখতে নেই।’ একটা হাত আলতো করে যখন নিরার কাঁধ স্পর্শ করলো নিরা কোন বাঁধা দিলো না। বাইরে তখন হঠাৎ ঝড় শুরু হয়ে গেল।এই ঝর যেন সব কিছু উপরে ফেলবে এমন ভয়ানক ঝড়।এর পর শুরু হলো বৃষ্টি। প্রকৃতির নিয়মে একটা অবৈধ সম্পর্ক ঘটে গেল।যে সম্পর্কের জন্য কেউ দায়ী ছিল না। না তোফাজ্জল হোসেন, না নিরা। চরম ভাবে দায়ী ছিল সেই মুহূর্তটা।

খুব সকালেই নিরা তার ভাই হোসেনকে ডেকে তুললো।ভাইকে বলল, বাড়ি দিয়ে আসতে তার পেটের খুব সমস্যা, শরীর খুব খারাপ লাগছে।
হোসেন তাদের স্যারকে জানাতে চাইলে,নিরা বলল,সে বলে এসেছে। হোসেন, নিরাকে বাড়ীতে নিয়ে গেল।নিরা একা থাকতে পারবে কিনা এই বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে লাগল।নিরা ভাইকে আশ্বস্ত করলো কোন সমস্যা হবে না একটু সুস্থ হলে সে আবার খামার বাড়ি চলে যাবে।

নিরা আর খামার বাড়ীতে যাবে না এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত ছিল তার নিজেকেই অপরাধী লাগছে গত কালকের ঘটনার জন্য। একটা চিরকুট রেখে এসেছে তোফাজ্জলের মাথার কাছে।তাতে লিখা আছে-
“আপনাকে কোন দোষ দিচ্ছি না।তবে আমি আর এখানে থাকতে পারবো না।ক্ষমা করবেন।”
নিরা

নিরা কেন এভাবে চলে এলো সেটা তার নিজের কাছে স্পষ্ট না।হয়তো অনুতাপ কিংবা পাপকে না বাড়ানোর দৃঢ় সংকল্প।এর পরের দিন সে গেলো তার শ্বশুর বাড়ি।তাকে দেখে তার শাশুড়ি ঝাঁজালো কন্ঠে তেড়ে আসলো। পোড়ামুখী অপয়া আরো অসংখ্য বিশেষণ যুক্ত করে নিরাকে সম্ভাষণ জানালো।জানতে পারলো তার স্বামী ঢাকায় চলে গেছে,কেউ তার ঠিকানা জানে না। শ্বশুরবাড়িতে এক গ্লাস পানিও খেতে পারলো না। এতটা পথ এই রোদের মাঝে হেঁটে এসে ক্লান্ত হয়ে গেছে সে। তবুও আবার হাঁটা শুরু করলো। মনে পরল রোজিনার কথা। সেখানে উপস্থিত হল নিরা। রোজিনার বাড়ি জুড়ে মহিলারা নকশি কাঁথা সেলাইয়ে ব্যস্ত। নিরাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো রোজিনা। কোন কিছু বলার আগে এক গ্লাস পানি খেতে চাইলো।
গ্লাসের পানি এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেলল নিরা।
—এই সময় কই থাইকা আসলি?
নিরা জানালো শ্বশুরবাড়ি থেকে। রোজিনা, নিরাদের গ্রামের ই মেয়ে।এক গ্রাম পড়ে এখানে বিয়ে হয়ে এসেছে রোজিনা। এখন এই সেলাইয়ের কাজ করিয়ে মোটামুটি ভালই ইনকাম হচ্ছে তার, স্বামীর উপর নির্ভর করতে হয় না। বরং দুজনের ইনকামে অনেক ভালো চলছে তারা। নীরা রোজিনা বু বলে ডাকে। তাকে একটা কাজ দিতে বলল নিরা। সমস্যা একটাই এতটা পথ প্রতিদিন হেঁটে এসে তাকে কাজ করতে হবে। তবুও নিরা বলল,সে এই সেলাই কাজ করবে।

তোফাজ্জল হোসেন আর আগের মতো খামার বাড়ীতে যান না,ভালো লাগে না কেমন একটা বিষন্নতা ভর করে। জরুরি কাজ থাকলে সকালে এসে বিকেলে চলে যান।আর কয়েক মাস থেকেই এই খামারের লস গুনছেন তাই সিদ্ধান্ত নিলেন খামারটা বিক্রি করে দেওয়ার।

হোসেন একটা মুদির দোকান দিল।এর সাথে সে প্রাইভেটে বি এ ভর্তি হয়ে রইল।এর মধ্যে একটা গোপন বিষয় ঘটেছিল। তোফাজ্জল একেবারে চলে যাওয়ার আগে হোসেনকে বেশকিছু টাকা দিয়ে যান। হোসেনের কাজে তোফাজ্জল খুব খুশি হয়েছেন আর হোসেন যেন বোনকে নিয়ে কিছু করে খেতে পারে এটাই বলেছিলেন।

এক সময় যখন আর নিরা কাপড়ের ডাবল ভাঁজ দিয়েও পেট লুকাতে পারছিলো না তখনই হোসেনের নজরে এলো।নিরাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো,’আমি যখন খামারে ছিলাম তখনও কি তোর জামাই এইখানে আসতো?’
‘আসতো।’
হোসেন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো।’হায় হায় করতে লাগলো।’আমারে আগে বলস নাই কেন?এখন তোর পেটের এই আপদ কেমনে মানুষ করবি?’ঐ শয়তান ও তো কই না কই পলাইছে?’
শেষ বার যখন নিরার স্বামী এখানে এসেছিল আশপাশের মানুষরাও দেখেছে। তাই নিরার গর্ভবতী হওয়া নিয়ে কেউ কোন প্রশ্ন তুলল না।
কিন্তু আসল ব্যপার জানে একমাত্র নিরা।ওর স্বামী এসেছিল ঠিকই , নিরার কাছে টাকা চাইতে এত দিন কাজ করে এসেছে বেতন কই? নিরা সাফ জানিয়ে দিয়েছিল ,টাকা ওর ভাইয়ের কাছে আর নিজের কাছে থাকলেও এক টাকাও দিতো না।এই নিয়ে ঝগড়া করে নিরার গায়ে হাত তোলে ওর স্বামী এবং রেগেমেগে চলে যায়।

ঠিক সময়েই একটা চাঁদের মতো ফুটফুটে একটা মেয়ের জন্ম দেয় নিরা। হোসেন ভাগ্নির নাম রাখে নওমি,নিরার সাথে মিলিয়ে।হোসেন যখন মিষ্টি নিয়ে নিরার শ্বশুর বাড়ি যায় সুসংবাদ জানাতে, তখন নিরার শাশুড়ি বলে দেয় আর কখনো যেন ওরা কেউ ওই বাড়িতে না আসে। যেখানে ছেলের সাথেই সম্পর্ক নেই সেখানে ছেলের বৌ আর তার মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখার কোনো মানেই হয় না।

হোসেনের দোকানটা আরো বড় হলো। হোসেন ভাবলো তার ভাগ্নি অনেক ভাল ভাগ্য করে এসেছে তাই তো নিজের ভাগ্যের এত উন্নতি হচ্ছে। ভাগ্নি নওমি হলো তার জান। হোসেনের জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতে লাগলো। হোসেনের এক কথা ভাগ্নিটা আরেকটু বড় হোক তারপর নিজের বিয়ের কথা ভাবা যাবে। এর মাঝে হোসেন নিরার বিয়ের কথাও চিন্তা করেছে কিন্তু নিরা এই প্রসঙ্গে কোন কথাই শুনতে চায় না।
যখন নওমির পাঁচ বছর তখন হোসেন বিয়ে করল আর তাদের ভাই বোনের সুখের সংসারে অশান্তি শুরু হলো।

মেয়ে শাপলার ডাকে যেন হোসেনের ঘোর কাটলো।-
—আব্বা এত রাইতে এইখানে বইসা কি কর, ঘুমাও না ক্যান?কিছু সমস্যা হইছে?
—আরে মা, না কোন সমস্যা হয় নাই। এমনেই ঘুম আসতেছিল না।
—তুই ঘুমাস নাই ক্যান শাপলা।
—আমি তো পানি খাইতে উঠছিলাম , দেখলাম দরজা খোলা।পরে দেখি তুমি এইখানে বইসা আছ।
—আচ্ছা চল ঘুমাই গিয়া।

সকালে বের হওয়ার আগে জালেরা বেগম, তোফাজ্জল হোসেনকে বললেন-
—তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।যদি পার রাইতে একটু তাড়াতাড়ি আইসো।
তোফাজ্জল বুঝতে পারছেন নওমির ব্যপারেই হয়তো কিছু বলবেন আম্মা।
—ঠিক আছে আম্মা তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করব।

তোফাজ্জল ভাবছেন মানুষের জীবনের একটা ভুল কখন যে সামনে এসে সবচেয়ে শক্ত প্রাচীরের মতো দাঁড়াবে তা কেউ জানে না। নওমির জন্ম না হলে তার হয়তো নিরার কথা মনেই থাকতো না।
যেদিন হোসেন তাঁর অফিসে এসে দেখা করলো,প্রথমে হোসেনকে চিনতেই পারেননি তোফাজ্জল।নিরার কথা তোলাতে সাধারণ ভাবেই জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন আছে নিরা?
‘নিরা তো মইরা গেছে।তবে আপনাদের মেয়ে নওমি ভালো আছে।’
এই কথা শুনে তোফাজ্জল বসা থেকে দাঁড়িয়ে পরেছিলেন।রাগে তাঁর গা কাঁপছিল।
তাঁর মনে হচ্ছিল হোসেনকে এখনই গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবেন।
কিন্তু হোসেনের আর একটা কথায় তোফাজ্জল দমে গেলেন।

চলবে…

#ফাহমিদা_লাইজু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here