৫ম_তলার_মেয়েটা,২৪,২৫

0
650

#৫ম_তলার_মেয়েটা,২৪,২৫
ফাহমিদা_লাইজু
#পর্ব_২৪

নওমির কাছে সবকিছুই স্বপ্ন মনে হচ্ছে।তাশফির সঙ্গে কাটানো সময়,তার কাছে মনে হচ্ছে স্বপ্ন। খুব সুন্দর সুখ স্বপ্ন।চিন্তা করতে করতে সে আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলো। দারোয়ান হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল-
— পেছন থেকে এতবার ধরে ডাকতেছি আপনি শুনেনই না।
নওমি কেমন হকচকিয়ে গেল।
—আমাকে ডাকছেন?
—হু আপনেরেই। অনেকবার ডাকছি।আপনের কোন সাড়া শব্দ নাই।উঠতেছেন তো উঠেছেন।
—একদম শুনতে পাইনি। কেন বলুন তো?
—দোতলায় একবার দেখা করে যেতে বলছে দাদু।
নওমির মনে পড়ল সে নিজেই দেখা করে যেতে চেয়েছিল কিন্তু একদম মনে নেই।মনের সমস্তটা জুরে এখন তাশফির আনাগোনা , অন্য দিকে খেয়ালই নেই।তার লজ্জা করতে লাগল।তার মনের সব চিন্তা , অন্য কেউ বুঝে ফেলছে তেমন মনে হচ্ছে। এই বুঝি ধরা পরে গেল। আশপাশের সবার কাছে ধরা পড়ে গেল ,সে তাশফিকে ভালোবাসে। অসম্ভব ভালোবাসে।

নওমি আবার নেমে দোতলায় গেলো।
দাদুকে অনেক কাহিল দেখাচ্ছে। নওমির কাছে প্রথম থেকে সব কিছু শুনতে চাইলেন হাজেরার কিভাবে কি হয়েছিল।নওমি সব কিছু বলল।
দাদু জানালেন ,খবর শুনেই তোফাজ্জল হাসপাতালে ছুটে গেছে।দাদু খুব অস্থির হয়ে পড়লেন। নওমি তাঁকে সান্তনা দিয়ে বলল,সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।জালেরা বেগম বললেন-
—তুমি কিছুক্ষণ থাক। আমার খুব একলা লাগতেছে।এই রকম কোন সময় হয় নাই। আজকে খুব অস্থির লাগতেছে। মনে হইতেছে ভয়ঙ্কর ঝড়ের পূর্বাভাস।
—এই সব কি বলেন দাদু?সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।
জালেরা বেগম কিছুক্ষণ নওমির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর চোখে অনেক কথা কিন্তু মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না।জালেরা বেগম ভাবছিলেন, এই মেয়েটার জীবনে এইবার ঝড় নেমে আসবে।কেউ কেউ কোন অন্যায় না করেও অন্যের পাপের শাস্তি ভোগ করে।আহা মেয়েটা যখন সব কিছু জানতে পারবে তখন কি করে সইবে?হাজেরা তার ভাইকে নিশ্চয় সব কিছু জানিয়েছে।আর হাফিজ জানা মানে সবার জন্য অনেক বড় অশান্তি। আক্রোশের বশে হাফিজ কি করে ফেলে ঠিক নেই। জালেরা বেগমকে চুপ করে থাকতে দেখে নওমি বলল-
—দাদু আপনার কি খারাপ লাগছে?
—না খারাপ লাগতেছে না।
—কিছু খেয়েছেন?
—হু
কাজের মহিলাকে ডেকে নওমি জিজ্ঞেস করল-
—খালা, দাদু কি ঠিক করে খাওয়া দাওয়া করেছে?
—একটু খাইছে সকালে। দুপুরের খাওন এখনো খায় নাই।
—খালা আপনি টেবিলে খাবার দিন।
—খাওন দেওয়াই আছে টেবিলে।
—দাদু এবার খেয়ে নিন।না হলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বেন।
বাধ্য মেয়ের মতো জালেরা বেগম উঠলেন। নওমি বসে রইলো, তাঁর খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত। জালেরা বেগমের একবার ও মনে হয়নি,নওমিকে খেতে বলেন।তিনি খুব বেশি খেতে পারলেন না। অল্প একটু খেয়ে উঠে গেলেন।

জালেরা বেগম , নওমির হাত ধরে বললেন-
—মানুষের জীবনে বিপদ আপদ আসবোই। মানুষ যা স্বপ্নেও চিন্তা করে না অনেক সময় তাই ঘটে জীবনে।তাই বইলা ভাইঙ্গা পড়তে হয় না।অনেক ধৈর্য্য আর সাহসের সাথে সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়।জীবনে অনেক বড় হও, তোমার স্বপ্ন সত্যি হোক এই দোয়া করি।
—দাদু হঠাৎ এই সব কথা আমাকে বলছেন যে?
—এই সব কথা শুধু তোমার জন্য না,সবার জন্যই। বয়স হইছে যে কোনো সময় মইরা যাইতে পারি আর বলার সুযোগ নাও পাইতে পারি তাই বললাম।
—কি যে বলেন না দাদু!আরো অনেক বছর বাঁচবেন আপনি।
—আমার কথাগুলি ভুইলো না।মনে রাইখো।
—আচ্ছা দাদু।

নওমি বিদায় নিয়ে বাসায় চলে এলো।

বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে স্বর্ণাকে কল দিলো-
—কি রে নওমি তোর এত ডাট বেড়েছে আমার কল পর্যন্ত ধরিস না।এখন কেন আবার কল করেছিস?
স্বর্ণা খুব রেগে আছে বোঝা গেল। পম্পির সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার পর থেকে স্বর্ণার মনে হিংসার সৃষ্টি হয়েছে। আগে নওমি শুধু তার সঙ্গেই মিশতো এখন স্বাভাবিকভাবেই স্বর্ণাকে কম সময় দিতে পারে। স্বর্ণার মধ্যে এমন একটা মনোভাব নওমি শুধু তার সঙ্গেই মিশবে। অন্য কারো সাথে মিশলে খুব একটা ঘনিষ্ঠ হবে না। এরকমটা প্রিয় বন্ধুকে হারিয়ে ফেলার ভয় থেকেই। প্রিয় বন্ধু আমাকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে আরেকজনকে কেন দিচ্ছে এতে করে দুঃখের সৃষ্টি হয় , হিংসার সৃষ্টি হয়। এই জিনিসটাই যখন অতিরিক্ত পর্যায়ে চলে যায় তখন হিংসার আগুনে জ্বলতে থাকে। আর তখনই সমস্যার সৃষ্টি হতে থাকে। স্বর্ণার এই ব্যাপারটাতে নওমি দুঃখ পাবে নাকি খুশি হবে বুঝতে পারছে না।
নিজেকে সামলে নওমি বলে গেলো সকাল থেকে হাজেরা কে নিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা।
সব শুনে স্বর্ণার গলার স্বর পাল্টে গেলো।সে বলল-
—আগে বলবি তো। আমি ভাবলাম এত ইম্পরট্যান্ট ক্লাস ফেলে নিশ্চয়ই পম্পির সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছিস।
—কেন? পম্পিও আজকে ক্লাসে আসেনি?
—তোর সাথে আর পম্পির যোগাযোগ হয়নি এই পর্যন্ত?
—না।
স্বর্ণা মনে হল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
নওমি আস্তে আস্তে বলল-
—তোর ভাইয়ার কথা কিছু বলবো।
—কি বলবি? আমার ভাইয়া অনেক খারাপ মানুষ,যাকে তুই একদম পছন্দ করিস না।ভাইয়ার কথা বললেই আমাকে বলিস,আর কথা বলবি না। আজ হঠাৎ ভাইয়ার কথা কি বলবি?
—তুই না অনেক বেশি কথা বলছিস।আমাকে বলতে দে কিছু।
—আচ্ছা ঠিক আছে বল।কি রে কিছু না বলে চুপ হয়ে আছিস কেন?
নওমি এক নিঃশ্বাসে বলল-
—আজ তোর ভাইয়ার সাথে দেখা হয়েছে।
—সত্যি? সত্যি বলছিস? কোথায়?
—এই বল আমাকে সব কিছু,এখন আবার চুপ করে আছিস কেন?ভাইয়া তোকে আই লাভ ইউ বলেছে?
—কি বলছিস এই সব?তাহলে কিছুই বলবো না।
—আচ্ছা ঠিক আছে? এবার বল। কোথায় দেখা হলো?
—কফি শপে।
—কবে?
—আজ ।
—ওরে আল্লাহ!তোদের প্রেম শুরু হয়ে গেছে আর আমি কিছুই জানি না।
—একদম বাজে কথা বলবি না।
—অফিস রেখে ভাইয়া কফি শপে তোর সাথে দেখা করতে গেছে কেন,এই সব বুঝি না ভাবছিস।
স্বর্ণার গলায় দুষ্টুমির সুর।
—যা ভাবছিস সেসব কিছুই না।

এবার স্বর্ণা একটু গাম্ভীর্য এনে বলল-
—নিজের ভাই বলে বলছিনা।ভাইয়া আসলেই খুব ভালো রে। তোকে আসলেই ভালোবাসে।ভাইয়াকে ফিরিয়ে দিস না তুই।
—আমার কোনো ফ্যামিলি নেই, তোদের এবং আমার মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ।এই জন্য ভয় হয়।
—তাহলে তোকে খুলেই বলি। ভাইয়া প্রথমে আম্মুর সাথে কথা বলেছে। আম্মু, আব্বুর সাথে কথা বলেছে। তোর সম্পর্কে তো আমরা সব কিছুই জানি। আমাদের কোন সমস্যা নেই।বুঝতে পারছিস তুই, তোকে আমার ভাবী বানাতে কোন সমস্যা নেই। সবচেয়ে বড় সমস্যা আর আসল সমস্যা হলি তুই। তুই আমার ভাইটাকে কষ্ট দিচ্ছিস।
—এখন রাখি রে। খুব ক্ষুধা লেগেছে,খাবো।
—কি? আমার ভাইয়া তোকে কিছু খাওয়ায় নাই।
—খাওয়াতে চেয়েছিল,আমি মানা করেছি।
—ও আচ্ছা।তোর তো আবার সব কিছুতেই সমস্যা।পেটে ক্ষুধা রেখে মুখে লজ্জা। আচ্ছা ঠিক আছে পরে কথা বলবো।এখন খেয়ে নে।
—আচ্ছা ঠিক আছে।

নওমির খুব ভালো লাগছে,জীবনে কোন দিন এত ভালো লাগেনি।মনে হচ্ছে সে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
আবার হাজেরার কথা মনে হওয়াতে দুশ্চিন্তা হতে লাগলো।

তোফাজ্জলকে দেখেই হাজেরার ভাই হাফিজ একেবারে ক্ষেপে গেলো।সে চেঁচামেচি করতে লাগলো।ওয়ার্ডবয় এসে স্ট্রিকলি মানা করলো হসপিটালে কোন চেঁচামেচি করতে। হাফিজ তবুও গজগজ করতে লাগল।

হাজেরার হার্টে দুইটা ব্লক ধরা পড়েছে। তাঁর দ্রুত অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। তোফাজ্জল আর হাফিজ দুজনেই চাইছিলা দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিন্তু সময় নেই। অপারেশনটা খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে।

রাতটা অনেক বেশি নিস্তব্ধ মনে হচ্ছে নওমির কাছে। তার খুব একা লাগছে। অজানা কারণে মনটা খুব বিষন্ন লাগছে।একটু আগেই তাশফির সঙ্গে কথা হয়েছে। মোবাইলে আবার টুং করে ম্যাসেজ আসার শব্দ হলো। মোবাইল হতে নিয়ে ওপেন করতেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না।
“তোমার মা আর অন্য একজনের অবৈধ সম্পর্কের ফসল তুমি।”
এই মেসেজ যে নাম্বার থেকে এসেছে নওমি সঙ্গে সঙ্গে কল করল। কিন্তু নাম্বার বন্ধ। নওমির মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছে। কেউ অবশ্যই তার সঙ্গে ফাজলামো করছে। কিন্তু এমন বিষয় নিয়ে কে ফাজলামি করতে পারে। এমন কেউ মেসেজ পাঠিয়েছে যে তাকে ভালো করে চেনে, তার নাম্বার জানে দেখেই পাঠাতে পেরেছে।
একটু পর মাথাটা কিছুটা শান্ত হলে ভাল করে খেয়াল করলো এখানে কারো নাম লেখা নেই তার মানে এটা কোন ভুয়া মেসেজে হতে পারে। অনেককে এই ধরনের মেসেজ পাঠিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়।
আর ঠিক তখনই আবার মেসেজ এলো-
“নওমি এই ব্যাপারে তোমার মামাকে জিজ্ঞেস করলে সবকিছু জানতে পারবে।”
এইবার নওমি একেবারে পাথর হয়ে গেলো। আগের মেসেজটা ভুয়া ছিল না তাহলে, জেনেশুনেই তাকে পাঠিয়েছে।নওমির হাত পা কাঁপতে লাগলো।
নওমি তার মামা হোসেনকে কল দিলো।এত রাতে নওমির কল দেখে হোসেন ভয় পেয়ে গেলো। নওমি খুব উত্তেজিতভাবে ম্যাসেজের কথা সবকিছু তার মামাকে বলল।
হোসেন বেশ কিছু সময় কোন কথাই বলতে পারলেন না। কি বলবেন, কি বলা যায় সেটাই বুঝতে পারছেন না।কোন মতে বললেন-
—আমি কালকে ভোরেই রওনা হইতেছি।আমি আইসা তোরে সব কিছু খুইলা বলবো।আর শোন মা, পৃথিবীতে অনেক কিছু ঘটে তার আপন নিয়মে যেখানে কারো কোন হাত থাকে না।তুই কোন চিন্তা করিস না। আমি আসতেছি।এই বলে লাইন কেটে দিলেন হোসেন।

মামার কথায় স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে সবকিছু। একটু আগেও তার মন নিজেকে বোঝাতে চাচ্ছিল মেসেজের সবকিছু, ভুয়া। কিন্তু মামা সবকিছু জানে। মুহূর্তেই তার মায়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আর মায়ের প্রতি তার ঘৃণায় গা ঘিন ঘিন করতে লাগলো। নিজের প্রতিই নিজের ঘৃণা হতে লাগলো। ছিঃ ।এখন সে বুঝতে পারছে হসপিটালে বাড়ীওয়ালির ভাই কেন তার সাথে ঐ ভাবে ধমকে কথা বলছিলো। তার মানে সেও সব কিছু জানে। আর হাজেরাও জানে।দাদু আসার পর থেকে তার সাথে ভালো ব্যবহার,ঐভাবে যত্ন করে খাওয়ানো।আর আজকের কথাগুলো-
সব কিছুর সাথে একটা যোগসুত্র আছে। আগামীকাল মামা আসতেই সবকিছুর খোলাসা হবে।
নওমি ভাবতে লাগলো তার জীবনে আর কত কষ্ট আসবে? যখনই তাশফিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করলো,ওকে চিন্তা করে সুখের সাগরে ভাসতে লাগলো তখনই জীবনের এই অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হলো। তার মত মেয়েকে কেউ কখনো মেনে নেবে? এটা হতেই পারে না। যার জন্ম কলঙ্কেের কালিতে ঢাকা সেখানে আলো পোঁছাবে কিভাবে?আজ নওমির চোখ থেকে কোন পানি পড়ছে না।সেখানে ঘৃণার আগুন জ্বলছে।

চলবে…

#ফাহমিদা_লাইজু

#৫ম_তলার_মেয়েটা

#পর্ব_২৫

নওমির মামা হোসেনের ঢাকায় পৌঁছাতে প্রায় দুপুর হয়ে গেলো। রাস্তায় বাসের চাকা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।সেটা ঠিক করতে সময় লেগেছে অনেকক্ষণ।এর মাঝে নওমিকে কয়েকবার কল করেও কথা বলতে পারেননি। নওমির মোবাইল বন্ধ।এর পরে গাজীপুর থেকে শুরু হলো আরেক ,যন্ত্রণা,যেমন রাস্তা খারাপ তেমনি জ্যাম। হালুয়াঘাট টু ঢাকা ‘রূপসী’ নামের বাসে উঠেছেন। হোসেনের খুব বেশি ঢাকায় আসা যাওয়া হয় না।যতবার এসেছেন ততবার রাস্তার এই বেহাল দশা। জীবনেও কি এই রাস্তা ঠিক হবে না?দুনিয়ার জ্যামের মধ্যে বসে থেকে থেকে কোমড় ধরে যায়।

নওমি সবসময় বলে,যখন সে বড় চাকরি করবে তখন ঢাকায় বড় বাসা নিয়ে তাঁদের সবাইকে ঢাকায় নিয়ে আসবে। হোসেন শুনে হাসেন কিছু বলেন না। হোসেনের মতে,ঢাকায় মানুষ থাকে কিভাবে?
কয়েকদিনেই তাঁর তো দম বন্ধ হয়ে যাবে।
হোসেনের মনটা সারা রাস্তাতায় নওমির চিন্তা করতে করতে ভারী হয়ে ছিল।

অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কানোর পরে যখন নওমি দরজা খুলল,নওমিকে দেখে তিনি চমকে উঠলেন।এই কি চেহারা হয়েছে মেয়ের!অন্য সময় হোসেনকে দেখেই জড়িয়ে ধরে নওমি কিন্তু আজ দরজা খুলে দিয়ে একবার শুধু হোসেনের দিকে তাকিয়ে অলস ভঙ্গিতে ভেতরে চলে গেল।
তিনি ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে রাস্তার কাহিনী বলতে লাগলেন।একা একাই কথা বলতে লাগলেন।ফ্রেশ হয়ে নওমির পাশে গিয়ে বসলেন। অন্য পাশে মুখ করে শুয়ে আছে সে। হোসেন বললেন-
—কিছু খাইতে দিবি না?যে ক্ষিদা লাগছে।তোর মামি তো উঠলোই না। বিস্কুট খাইয়া রওনা দিসি। তোর মামি তো কোন দিন আমার খেয়াল রাখলো না।আরে তোরে তো বলা হয় নাই ,কালা ছাগলটা চারটা বাচ্চা দিতে।কি ফুটফুইট্টা বাচ্চা।তোর ভাইবোনেরা তো সারাদিন ঐ বাচ্চা কোলে নিয়ে বইসা থাকে।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতেই হোসেন এইসব বলছেন কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না।নওমি কথা না বলে পাউরুটি আর কলা এনে সামনে দিলো হোসেনের। হোসেন বুঝতে পারলেন আঘাতটা একেবারে বুকের গভীরে লেগেছে।সেটাই তো স্বাভাবিক।নিরা যখন তাকে বলেছিল সেটা হজম করতে অনেক সময় লেগেছিল। হোসেন প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেননি।নিরার দিকে তাকালেই ঐ কথা মনে পরে যেতো।আর বেশি দিন নিরার চেহারা দেখতেও হয়নি নিঃশব্দেই মরে গেলো নিরা, তাঁর আদরের বোন।নওমির প্রতি এমন মনোভাব কখনো ভুলেও আসেনি হোসেনের।যে স্নেহ ভালোবাসা মায়া-মমতা দিয়ে নওমিকে বড় করে তুলেছেন, সেই সবের নিচে চাপা পরে গিয়েছে ওর জন্ম পরিচয়।
মেয়েটা মনে হয় খাওয়া দাওয়াও বন্ধ করে রেখেছে।
হোসেন, নওমির মাথায় হাত রেখে বললেন-
—মা আমার সাথে কথা বলবি না?
—আমার নিজের উপরেই ঘেন্না লাগছে।কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
—এই সব বলিছ না।
—তো কি বলবো? খুব খুশি হয়ে বলবো আমি একটা অবৈধ সন্তান। আমি একটা অবৈধ গভীর প্রণয়ের ফসল।
—এইটা একটা দুর্ঘটনা।
—তো আমি দুর্ঘটনায় জন্ম নেয়া একটা আস্ত দুর্ঘটনা।
নওমির বুকের আগুন চোখ দিয়ে যেন ছিটকে বের হচ্ছে।
—তুই একটু শান্ত হইয়া বস আমি সব কিছু তোরে খুইলা কইতেছি।
—তুমি প্রথম থেকেই সব কিছু জানতে?
—না।তোর মায়ের মৃত্যুর কিছুদিন আগে আমারে সব বলছে।নিরা হয়তো বুঝতে পারছিলো সে খুব তাড়াতাড়ি মইরা যাইবো।
এর পর হোসেন সব কিছু বললেন। শুধু নওমির জন্মদাতার নাম ছাড়া।নওমি ব্যঙ্গাত্মক ভাবে বলল-
—তুমি তোমার বোনের পক্ষ নিয়ে কথা বলছ?
—আমি কারো পক্ষ নিয়া কথা বলতেছি না।যা কিছু আমি নিরার কাছ থাইকা শুনছি তাই বললাম,একটু বেশিও না একটু কমও না।তুই আমারে বিশ্বাস করছ না?
হোসেনের শেষের কথাটায় খুব অভিমান মেশানো ছিল।
—লোকটার নাম তো বললে না?
হোসেন চুপ করে রইলেন।
—আমি নিশ্চয়ই তাকে চিনি? সেই লোক নয় তো যে এত দয়ালু আমার পড়াশোনার খরচ সে দিচ্ছে? আর এই ঘটনা হাজেরা আন্টির ভাই কিভাবে জানে?দাদুর কথাতেও বুঝেছি, হাজেরা আন্টি সে দিন যেভাবে কথা বলল,কেন?আমি সব কিছুর উত্তর জানতে চাই।সব কিছু বল মামা।

নওমির তপ্ত কণ্ঠে হোসেন ভেতর থেকে কেঁপে উঠলেন।
—তোফাজ্জল হোসেন তোর বাবা।
কথাটা শুনে নওমির মাথাটা ঘুরে গেল। এত কিছু ভাবলেও একবারের জন্যও মনে হয়নি তোফাজ্জল হোসেন তার বাবা হতে পারে।

এবারে সব কিছু যেন মিলে গেল।

—নওমি মা তোর কোন দোষ নাই। একটা মানব শিশুর জন্ম হওয়াতে তার নিজের কি দোষ থাকতে পারে?
—তুমি সেটা বললে কি হবে। এই সমাজ আমাকে একটা আলাদা নাম দেবে। আলাদা চোখে দেখবে। যারা জন্ম দিলো তাদের কিছুই হবে না এই কলঙ্ক আমাকেই বয়ে বেড়াতে হবে সারা জীবন। আমার নামের পাশে একটা বিশেষ শব্দ যোগ হয়ে যাবে। উহ্ মামা আর ভাবতে পারছি না।
আমি মনে হয় পাগল হয়ে যাব।
—মা আমার এমন করিস না। শান্ত হো।
নওমির হঠাৎ তাশফির কথা মনে হলো-
—তাশফিও আমাকে আর পছন্দ করবে না। ওর মা-বাবা আমাকে ঘৃণা করবে । পম্পি, স্বর্ণা ওরা কেউ আমার সঙ্গে মিশবে না কথা বলবেনা।
এই কথাগুলো বলতে বলতে এবার নওমি ডুকরে কেঁদে উঠল। বিছানায় আছড়ে পড়ল সে। হোসেন নওমির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন,তাঁর নিজের চোখেও পানি আছড়ে পড়তে লাগলো। অনেকটা সময় এভাবে কেটে গেলো।

নওমি এবার উঠে বলল-
—আমি দাদুর কাছে যাবো।তাকে কিছু জিজ্ঞেস করবো।
চোখে মুখে পানি দিয়ে নওমি বেরিয়ে গেলো।

জালেরা বেগম নওমি কে দেখেই বুঝতে পারলেন ঝড়ে বিধ্বস্ত একটা প্রাণ তাঁর সামনে বসে আছে।
—তুমি কি সব কিছু জানতে পারছ?
—জ্বী দাদু। সবাই সব কিছু জানতো শুধু আমি জানতাম না।
—কি ভাবে জানতে পারলা?
নওমি সব কিছু খুলে বলল। মোবাইলের মেসেজ থেকে শুরু করে আজকে ওর মামার মুখে শোনা সব ঘটনা। গাড়িতে হাজেরার বলা কথা হাজেরার ভাইয়ের ধমকি সব কিছু বলল, কোন কিছু বাদ দিলো না।
—আমি এইটাই ভয় পাইছিলাম। হাজেরার ভাই হাফিজ যখন জানতে পারছে এখন কোনো না কোনোভাবে তোমার ক্ষতি করতে চাইবো সে। খুব ভালো কইরা চিনি ওরে।ফোনে সেই তোমারে জানাইছে এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
—দাদু এখন আমি কি করব? সবাই আমাকে ঘৃণা করবে।
—তুমি কিছুই করবা না।যা করার এখন আমিই করমু।আর তোমারে কেন ঘৃণা করবো? অবশ্য মানুষের খাইয়া দাইয়া কাজ নাই হুদাই মাইনষের পিছনে লাইগা থাকে। ঐসবে কান দিবা না। আমিও প্রথমে অনেক কিছুই ভাবছিলাম। তোমারে প্রথম দিন সিঁড়িতে দেইখা আমি চমকাইয়া গেছিলাম। এরপর তোমার সাথে কথা বইলা দেখি যার সাথে তোমার এমন মিল শুধু চেহারাতেই না আচার-আচরণ কথাবার্তা সব কিছুতেই মিল।উনারে আমি গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতাম। এখনও করি। উনি তেমন মানুষই ছিলেন শ্রদ্ধা পাওনের মত।
—কে উনি?
—আমার শাশুড়ি। তোফাজ্জলের দাদু।
এই কথা শুনে নওমি খুব অবাক হয়ে গেলো। এমন হয় নাকি?
—কিন্তু আমাকে আপনাদের পরিবারের অন্য কেউ দেখে চিনতে পারেনি কেন?
—তোফাজ্জল আমার সবচাইতে বড় সন্তান।ও ছোট থাকতেই আমার শাশুড়ি মারা যান। উনার তো কোন ছবি নাই চিনবো কেমনে সবাই?উনি অসম্ভব সুন্দরী মহিলা ছিলেন।গায়ের রং অসম্ভব ফর্সা ছিলো, চুল ছিল লালচে, কোমরের নিচে। মেম সাহেবের মতো লাগতো দেখতে।
—আমি তো এমন না।
—উনি তো ঘর থাইকা বেশি বাইর হইতেন না তাই উনি বেশি ফর্সা ছিলেন আর তুমি তো চুল কাইটা রাখ।আর সব কিছুতে মিল আছে।
—উনি মারা গেলেন কিভাবে?
—সাপের কামড়ে।আগে তো আর ঘরের ভিতরে বাথরুম ছিলো না,আলাদা কইরা দুরে থাকতো বাথরুম।উনি ফজরের আগে বাথরুম করতে গেছিলেন। অন্ধকারে সাপ দেখেন নাই।সাপের উপরে পারা দিতেই কামড় দিলো।উঝা,কবিরাজ কেউ কিছু করতে পারলো না।উনার সাদা শরীর কেমুন জানি নীল নীল হইয়া গেছিলো।

নওমির মনে হচ্ছে সে যেন দেখতে পাচ্ছে ঐ ঘটনা।তার মনে হচ্ছে সেও সাপের বিষের যন্ত্রনায় ছটফট করছে ,বিষে নীল হয়ে গেছে মন।দাদুকে কিছু না বলে সে উঠে গেলো। বাসায় গেল। এর মধ্যে মামা বের হয়ে খাবার কিনে নিয়ে এসেছে। নওমিকে বসিয়ে তেহারি দিলেন প্লেটে।নিজেও নিলেন।নওমি শান্ত মেয়ের মতো খাওয়া শেষ করলো। এর পরে বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। খাওয়া পেটে পড়তেই ক্লান্ত শরীর বিছানায় পড়তেই ঘুমে তলিয়ে গেলো। পৃথিবীতে না খেয়ে তো আর বাঁচা যায় না। বাঁচলেও আর কয় দিন বাঁচা যায়?
নওমির ঘুম ভাঙ্গলো রাত একটার দিকে।এখন সে আগের মতো আর বিস্ফোরিত অবস্থায় নেই, আগ্নেয়গিরি যেন কিছুটা দমে এসেছে। সামনের স্পেসে এসে দেখে তার মামা ডিভানে ঘুমাচ্ছে। এর আগে মামাকে কখনো নিচে ঘুমাতে দেয়নি।জোর করে বেড রুমের খাটে ঘুমাতে বলেছে। সে নিজে ডিভানে ঘুমিয়েছে। তার মামারই বা দোষ কি? সে আর কি করবে?মামা লাইটটাও অফ করেনি। মামার হয়তো ঠাণ্ডা লাগছে, হাত পা গুটিয়ে শুয়ে আছে।নওমি ফ্যান কমিয়ে দিয়ে একটা কাঁথা মামার গায়ে সাবধানে জড়িয়ে দিল যেন মামার ঘুম না ভাঙ্গে।মামার দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো মামা তাকে বাবার আদর দিয়ে বড় করেছে।
বাবারা কেমন আদর করে নওমি জানে না তবে তার মনে হয় বাবার আদর যদি সে পেতোই, সেই কপাল যদি তার থাকতোই সেই আদরও মামার আদরের চেয়ে বেশি হতো না।মামা তার সব কিছু।
মামাকে আর কষ্ট দিবে না সে।

মামা এখানে বসে থাকলে বাড়িতে দোকান বন্ধ থাকবে আর দোকান বন্ধ থাকা মানে আয় বন্ধ। মামাকে কালকেই চলে যেতে বলবে নওমি।এর জন্য তাকে নর্মাল থাকতে হবে। ঠিক যেন মুখোশ পড়ার মতো। মুখোশের আড়ালে যেমন সত্যিকারের চেহারা দেখা যায় সেই রকম।

নিজের কষ্টের জন্য অন্যকে কেন কষ্ট দিবে?এই কষ্ট একান্ত তার নিজের। সারাজীবন তাকেই বয়ে বেড়াতে হবে। অবশ্য বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা যদি বেঁচে থাকে। মানুষের মনে যতটা কষ্ট লাগলে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা নষ্ট হয়ে যায়,এই সুন্দর পৃথিবীর সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে অজানার পথে পা বাড়ায় নওমির মনে ঠিক ততটাই কষ্ট লেগেছে।

চলবে…

#ফাহমিদা_লাইজু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here