৫ম_তলার_মেয়েটা,২৬,২৭

0
598

#৫ম_তলার_মেয়েটা,২৬,২৭
ফাহমিদা_লাইজু
#পর্ব_২৬

দরজার বাইরে কারা অপেক্ষা করছে,বার বার দরজায় নক করছে নওমি তা স্পষ্ট বুঝতে পারছে। ওদের কথাবার্তা সব শুনতে পাচ্ছে ভেতর থেকে তবুও নওমি চুপ করে রইলো। দরজা খুলল না। নওমি কিছুতেই দরজা খুলতে চাচ্ছে না।
পম্পি প্রায় চিৎকার করে বলল-
—খুব ভালো করে জানি তুই ভেতরে আছিস নওমি।দারোয়ানের কাছ থেকে খবর নিয়েই এসেছি।আমাকে বাধ্য করিস না দরজায় লাথি মারতে। শব্দ শুনে বিল্ডিয়ের সবাই জড়ো হয়ে যাবে তখন।ভালোয় ভালোয় বলছি দরজা খোল।

পাশের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বের হলেন পারু।অবাক হয়ে বললেন,
—কি হয়েছে?
—কিছু না আন্টি।ভেতরে বসে থেকে নওমি দরজা খুলছে না।
—আমি তো গতকাল নক করেছিলাম।দরজা খুলেনি,ভেতরে কোন সাড়াশব্দ নেই দেখে ভাবলাম নওমি হয়তো বাসায় নেই।
—ও বাসাতেই আছে,আমি খবর নিয়েছি। দারোয়ান বলেছে নওমিকে বের হতে দেখেনি আজ।
—ও আল্লাহ কিছু হয়ে যায়নি তো?
—আমরাও খুব টেনশন করছি,স্বর্ণা বলল।

আর তখনই নওমি দরজা খুলল।নওমিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো পম্পি।স্বর্ণা পেছনে পেছনে ঢুকলো। পারু, নওমিকে দেখে বললেন-
—আরে! কি অবস্থা হয়েছে মেয়েটার, অসুস্থ মনে হচ্ছে।
কপালে হাত দিয়ে বললেন,
—আরে নওমির তো গায়ে জ্বর।আমাকে কেন জানাও নি মা।যেতে পারনি, একটা কল দিতে। নিশ্চয়ই রান্নাও করতে পারছ না,খেতে পারছ না।
পম্পিদের বললেন-
—তোমরা ওর খেয়াল রাখো।আমি একটু স্যুপ করে আনি। কিছু খাইয়ে ঔষধ খাওয়াতে হবে।
আমি এখনি আসছি।

পারু চলে যেতেই পম্পি হাত উপরে তুলে বলল-
—চড় দিয়ে মাথার ভুত ছাড়িয়ে দিবো।কি হয়েছে মোবাইল বন্ধ,ক্লাস বন্ধ,মরে যেতে চাস? অসুস্থ হয়েছিস এই কথাটা জানাবি না? আস্ত হারামি একটা।
স্বর্ণা বলল-
—পম্পি থাম তো। এমনিতেই ও অসুস্থ।নওমি তুই শুয়ে থাক।তোর মাথায় পানি দিয়ে দেই। থার্মোমিটার আছে? জ্বর মাপা দরকার।
নওমি কঠিন গলায় বলল-
—তোরা এখনই চলে যা। আমার সেবা যত্নের দরকার নেই।
—ফাজলামো করিস আমাদের সাথে?এই পম্পির সাথে ফাজলামি?পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে ফেলবো।

এইবার নওমি দুইপা ছড়িয়ে সেখানেই বসে পড়লো।বিরবির করে বলতে লাগল,
—সব কিছু জানতে পারলে তোরা আর আমার সাথে মিশবি না। আমি আমি আমি একটা..
নওমি কথা শেষ করলো না, কান্নায় ভেঙে পড়ল। স্বর্ণায় বসে পড়লো ওর পাশে।
—কি হয়েছে বল আমাদের।কি হয়েছে তোর?
পম্পি বসে একটানে বুকে জড়িয়ে নিলো নওমিকে আর বলতে লাগলো-
—কিচ্ছু হয়নি লক্ষী আমার ,শান্ত হো ,এমন করে না।
পম্পি,স্বর্ণা দুজনেই কাঁদতে লাগলো নওমির সঙ্গে।আসলে এমন হৃদয় ফাটানো কান্না দেখে পাথরের চোখ থেকেও পানি ঝরবে।আর নওমি তো ওদের প্রিয় বন্ধু।
এমন সময় পারু নক করলো।
ওদের এই অবস্থা দেখে ধমক দিলেন।নওমি না হয় অসুস্থ ,ওর সাথে তোমরাও কেঁদে কেটে অস্থির?
তিনজনে নওমিকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো।
পারু থার্মোমিটার,ঔষধ, খাবার নিয়ে এসেছেন। জ্বর মাপলেন। একশো দুই ডিগ্রী।সবার আগে স্যুপ খাইয়ে নাপা ট্যাবলেট খাওয়ালেন।খাওয়াতে খাওয়াতে বললেন-
—ইনস্ট্যান্ট খাবারগুলো তাড়াতাড়ির সময় খুব কাজে দেয়।

মাথায় পানি ঢেলে হাত,পা,মুখ মুছে দিলেন।
এবার ওদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
—তোমরা দুপুরে কিছু খেয়েছ?
স্বর্ণা বলল-
—খাওয়ার কথা ভুলে গেছি।
—আমিও তাই ভেবেছিলাম।ভাত বসিয়ে দিয়ে এসেছি এখনই হয়ে যাবে।হলেই আমি নিয়ে আসছি।আর শোন ওর সামনে এভাবে কান্নাকাটি করো না। অসুখ কি মানুষের হয়না? চিন্তা করো না সুস্থ হয়ে যাবে।

নওমির মামা হোসেন যেতে চাননি। নাওমি বুঝিয়েছে সে স্বাভাবিক আছে, তাকে নিয়ে যেন কোনো দুশ্চিন্তা না করে। কিন্তু মামা যাওয়ার পরেই নওমি নিজের বাসাটার মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ করে ফেললো। দুইদিন কারো সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগ নেই। তাশফি প্রতিদিন কথা বলে। মোবাইলে না পেয়ে স্বর্ণাকে জিজ্ঞেস করলো নওমির কথা। স্বর্ণা কিছুই জানেনা, কেন নওমি ক্লাসে আসছেনা সেটাও জানেনা। এই কথা শুনে তাশফি স্বর্ণাকে বলে যে,এই তোদের বন্ধুত্ব? দুইদিন ‘মেয়েটার কোন খবর নেই আর তারা জানেই না কি হয়েছে।’
তাশফির কোন কিছুতেই শান্তি লাগছিলো না। নওমির বাসা সে চিনে না।এ ছাড়া ওর খোঁজ নেয়ার আর কোন উপায়ই নেই।
স্বর্ণা দুষ্টুমি করে বলেছিল,’যার বেশি দরকার সেই খোঁজ নিক।’
কিন্তু ভেতরে ভেতরে আসলেই চিন্তা লাগছিলো। সে পম্পিকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করলো। পম্পি বলল’ সরাসরি গিয়ে দেখি কি হয়েছে ওর।’

বাড়ী যাওয়ার পর থেকেই হোসেনের মনে হচ্ছে, নওমিকে একা ফেলে তার যাওয়া একদমই উচিত হয়নি। বাড়ী যাওয়ার পর থেকে নওমি কে কল করে আর পাননি। তোফাজ্জলের নাম্বারে কল করেও তাকে পাননি। দারোয়ানের নাম্বার ছিল তাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলে,সে বলে ,যে নওমি ভালোই আছে,আজকেও বাইরে থেকে ফিরতে দেখেছে নওমিকে। দারোয়ান কাকে না কাকে দেখে নওমি ভেবেছে কে জানে।
এটা শুনে হোসেন ভাবলেন, সবকিছু ঠিক আছে হয়তো নওমি হততো ক্লাস করছে । কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না দেখেই হয়তো মোবাইলটা বন্ধ করে রেখেছে।

হোসেনের মনে পড়লো নওমির বান্ধবী পম্পি আর স্বর্ণার নাম্বার আছে তার কাছে। স্বর্ণাকে কল করলে ধরলো না। এরপর কল দিলেন পম্পিকে।
পম্পি ,হোসেনকে নওমির অবস্থা সম্পর্কে সব কিছু বলল। হোসেন চিন্তায় পড়ে গেলেন। কেন তিনি নওমিকে সাথে করে নিয়ে গেলেন না আফসোস হতে লাগল। নওমি বাড়ি যেতে চায় না ওর মামির জন্য। সরাসরি কিছু না বললেও, কিভাবে নওমির মনের ভেতরে কষ্ট আরো বাড়িয়ে দেয়া যায় সেই কাজ গুলো সফলতার সাথে করতে পারে তার মামি।পুরো এক বছর থেকে নওমি বাড়ী যায় না।দুইটা ঈদ একা একা নিরানন্দ ভাবে কেটেছে। সেমাই বানিয়ে খেয়েছে। যাতে ঈদ মনে হয় অন্তত নিজের কাছে।কোন বান্ধবীদের বাসাতেও যায়নি। ওরা বারবার বললেও যায়নি। কারণ ওরা ওদের পরিবার নিয়ে আনন্দ করছে আর ওতো ওদের কেউ হয়না তাহলে কেন যাবে ওদের আনন্দের মধ্যে। দুইবারই স্বর্ণা বিকেলে এসে টিফিন ক্যারিয়ার ভরে খাবার দিয়ে গেছে। আর জোর করে ওকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছে।

ওদেরকে হোসেন অনুরোধ করলেন নওমির খেয়াল রাখার জন্য।এই অনুরোধের আসলে দরকার ছিল না।ওরা এমনিতেই নওমির দেখাশোনা করতো।

পারু ওদের জন্য খাবার নিয়ে এলেন।নওমির ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো।এখন অনেকটা ভালো লাগছে শরীর, কিন্তু মনের একই অবস্থা।পারু , নওমির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন-
—আমাকে এত পর কেন ভাবো? আমি তোমার মায়ের মত। আমিতো তোমাকে আমার মেয়ের মতই ভাবি। আমার দুইটা মেয়ে না,ঝিমি গেছে ওর খালার বাড়ীতে।ও থাকলে তোমার খবর আরো আগেই পেয়ে যেতাম। আমিও যে কেন ভালোভাবে খবর নিলাম না? এখন থেকে এমন ভুল আর হবে না। আর তুমি যতদিন পর্যন্ত সুস্থ না হবে , তোমার রান্না করতে হবে না। এখন আমি যাই একটু পরে আবার আসবো।

পারু চলে যেতেই স্বর্ণা বলল –
—ভাইয়া অনেকক্ষণ থেকে কল দিচ্ছে। মোবাইল কিভাবে যেন সাইলেন্ট হয়ে গেছে একদম টের পাইনি।নওমি তোর চিন্তায় আমার ভাইটা মরেই যাচ্ছে।এই পম্পি জানিস—নওমি আর ভাইয়ার সেটিং হয়ে গেছে।আমাদের কিছুই বলেনি।দেখলি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখাও করে।
—তাই নাকি?
—হু
তাশফি আবার কল করলে স্বর্ণা এবার রিসিভ করে নওমির অসুস্থতার খবর জানালো তাকে। নওমির সঙ্গে কথা বলতে চাইলে-সে তাশফির কথাটা রিপিট করলো-
‘নওমির সাথে কথা বলতে চাস ভাইয়া?’
নওমির দিকে তাকাতেই নওমি বলল-
—আমি এখন কারো সাথে কথা বলবো না।

এই কথা তাশফিকে বলার পর তাশফি ভাবলো নওমি হয়তো ওদের সামনে কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছে। তবে নওমির খবর জেনে তাশফির নিজেরই যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো,এখন খুব রিলাক্স ফিল হচ্ছে।

স্বর্ণা দুষ্টুমি করতে লাগল এই নিয়ে।
এবার নওমি রেগে গেলো-
—আমার কিছুই নেই তোর ভাইয়ার সাথে। তোদের সাথেও আমি কোন সম্পর্ক রাখবো না। আমি কারো সাথে সম্পর্ক রাখার যোগ্য না।
পম্পি আর স্বর্ণা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।ওরা দুজন দুই পাশে বসলো নওমির।
স্বর্ণা বলল-
—সত্যি করে বলতো তোর কি হয়েছে? নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। কিছু না হলে তুই আমাদের সঙ্গে এমন করতি না।
—আসলেই জানতে চাস আমার কি হয়েছে? ঠিক আছে জেনে নে, এরপর তো আর আমার সঙ্গে তোরা মিশতে চাইবি না। আমি একটা অবৈধ সন্তান। সমাজে আমার কোন স্বীকৃতি নেই। এই কথা জানার পর থেকে আমি নিতে পারছিনা। একদম সহ্য করতে পারছি না।আমার মাকে আমি মনেপ্রাণে ঘৃণা করি। আর এই যে বাড়িতে আছি আমি এ বাড়ির মালিক আমার জন্মদাতা। এই লোকই আমার সব খরচ দেয়। এতদিন মনে করতাম কত উদার মনের মহৎপ্রাণ মানুষ, আমার মত এতিমকে সাহায্য করছে!এই উদার মানুষটা কে জানতে পারলে তাঁকে সালাম করবো। আর দেখ, কেন সাহায্য করছে আমাকে? আসল কথা হলো নিজের পাপকে ঢাকতেই এমন করছে সে। এই লোকের টাকায় আমি আর কিছুই করবো না।আর বাঁচতে চাই না আমি।
বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল নওমি।

পম্পি আর স্বর্ণা একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলো। ওরা কখনো স্বপ্নেও এই কথা চিন্তা করে নি।

নওমি আবার বলল-
—তোর ভাইয়াকে গিয়ে এই খবরটা জানাস। তখন দেখবো এই ভালোবাসা কোথায় থাকে। আমার জন্ম পরিচয়টাই সবকিছুতে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। এ জীবন আমি আর রাখতে চাই না। ছি ছি আমি এই মুখ আর কিভাবে দেখাবো মানুষকে?

ওরা যে কি বলবে বুঝতে পারছে না।তবে পম্পিকে এমনটা না হলেও অনেকটা এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই যেতে হয়েছে যখন তার বাবা রজনীকে বিয়ে করে নিয়ে আসে।কিছুতেই সে এটা মানতে পারছিলো না। নিজের মায়ের জায়গাটায় অন্য কাউকে কিছুতেই দেখতে পারছিলো না।এই জন্য নিজের বাড়ী পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিলো।বাবার সাথে কথা বলা বন্ধ করেছিলো। কত রাত কেঁদে কেঁদে ভাসিয়েছে।তাই পম্পি জানে কষ্ট আসলে কাকে বলে।একেক মানুষের কষ্ট একেক কারণে হলেও, কষ্টের রং কিন্তু একই।

পম্পি বলল-
—তাহলে এখন তুই বাঁচতে চাস না?কিভাবে মরতে চাস মারার চিন্তা করছিস?

নওমি অবাক হয় তাকায়।স্বার্ণাও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে পম্পির দিকে।

চলবে…

#ফাহমিদা_লাইজু

#৫ম_তলার_মেয়েটা

#পর্ব_২৭

জালেরা বেগমের কানেও খবরটা পৌঁছে গেলো। তাঁর একার পক্ষে ৫ম তলায় উঠা কোনভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু এই খবর শুনে কোনভাবেই বসেও থাকতে পারলেন না ,উপরে উঠার ব্যবস্থা ঠিকই করলেন তিনি।
সাহায্যকারী মহিলা দুইজনের সহায়তায় অনেক কষ্টে উঠে এলেন ৫ম তলায়। এই জন্য তাঁকে, লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিতে নিতে থেমে থেমে চেয়ারে বসে বিশ্রাম নিতে হয়েছে কয়েকবার। দারোয়ান চেয়ার নিয়ে পেছনে পেছনে এসেছে।
অনেক পুরোনো বাড়ী তাই লিফট নেই।এই বাড়ী ছাড়াও তাঁদের অনেক সুন্দর আরো দুইটা আধুনিক বাড়ী আছে কিন্তু এই বাড়ীর সাথে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে হাজেরার।তাই কখনো এই বাড়ী ছেড়ে যাননি। কিন্তু এখন হাজেরা কিভাবে একেবারেই এই বাড়ী থেকে চলে গেলো? এত স্মৃতি, এত মমতা দিয়ে গড়া এই সংসার ছেড়ে চলে যেতে পারলেন!

পম্পি দরজা খুলে দেখলো তুষার কন্যার মতো একজন দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছেন। তফাৎ একটাই তিনি বয়ষ্ক বাঙালি তুষার কন্যা।সাথে তিন জন। হাঁপাতে হাঁপাতেই বললেন-
—এই মেয়ে দরজা থাইকা সর।
পম্পি সরে গেলো।আসলে জালেরা বেগমকে দেখে পম্পি এতটাই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল যে দরজা থেকে সরতে বা কিছু জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গিয়েছিলো।
তিনি ডাকতে ডাকতে ভেতরে ঢুকে গেলেন-
—নওমি কই?দাদু কই তুমি?
পম্পি বুঝতে পারলো উনিই রক্তের সম্পর্কে নওমির দাদু হয়, উনিই তোফাজ্জল হোসেনের মা।

জালেরা বেগমের সাথে আসা তিনজনকে বলে দিলেন,চলে যেতে। যাওয়ার সময় হলে তিনি ফোন দিবেন।তার সাথে একটা কাপড়ের পাশব্যাগ ঝোলানো , মোবাইল ব্যাগের চেয়ে একটু বড়।

নওমি একটু চোখ মেলে তাকালো।অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল দাদুর দিকে।সে বুঝতে পারছে না স্বপ্ন দেখছে নাকি সত্যি।আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল।এখন ঘুমিয়ে থাকলেই শুধু স্বপ্ন দেখে। তার মা’কেও, সে স্বপ্ন দেখলো তার মা নিরা এসেছে এই বাসাতেই এসেছে।নওমি তার মাকে দেখে খুব বিরক্ত হলো। কথা বলতে একটুও ইচ্ছে করছিল না। তার মা-ও একটাও কথা বলল না শুধু তার মায়ের চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছিল। একবার খুব ইচ্ছে করছিল মায়ের চোখটা মুছে দিতে। কিন্তু তবুও দিল না, অনেক রেগে বলল চলে যাও তুমি এখান থেকে আর কখনোই আসবেনা। এই কথা বলার একটু পর নওমির খুব খারাপ লাগছিল। মায়ের হাতটা ধরতে খুব ইচ্ছে করছিল, চোখ মেলে যখনই মায়ের হাতটা ধরতে গেল দেখল সত্যি সত্যি তার মা চলে গেছে। ওইভাবে বলা কিছুতেই ঠিক হয়নি তার মা আর কখনোই আসবেনা। অনেক কষ্ট পেয়েছে মনে হয়।
এখন মনে হচ্ছে দাদু এসেছে কিন্তু উনি তো সিঁড়ি ভাঙতে পারে না এই পাঁচ তলায় আসবেন কি করে? নাকি সে নিজেই চলে গিয়েছে দোতলায়?

জালেরা বেগম নওমির পাশে বসলেন।সেই সুন্দর গন্ধটা এসে নাকে লাগলো। এইবার নওমি দেখতে পাচ্ছে দাদুকে নিয়ে সে একটা সরিষা ক্ষেতের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সরিষা ক্ষেতে বাতাস বয়ে চলেছে সেখানে ঢেউয়ের মতো হচ্ছে।মৌমাছিরা উড়ে বেড়াচ্ছে। সরিষা ক্ষেতটা যেন হঠাৎ করে সূর্যমুখীর ক্ষেত হয়ে গেল। নওমি বলছে-
—দাদু আস্তে হাঁটেন, আমি আর পারছিনা।

স্বপ্নের ঘোরে বলা কথাগুলো দাদু আর পম্পি দুজনেই শুনতে পেলো।
—নওমি খুব কষ্ট হইতেছে?
কোন উত্তর পেলেন না।
পম্পি বলল-
—ও ঘুমের ঘোরে কথা বলছে।

—তুমি নওমির বান্ধবী?
—জ্বী।
—আরেকজন নাকি ছিল?
—স্বর্ণা ছিল।আমাদের আরেক বান্ধবী।ও বাসায় গেছে আজ আবার আসবে।
—হাসপাতালে নেয়া দরকার না নওমিরে?
—এখন খুব একটা জ্বর নেই।স্বর্ণার বাবা-মা ডাক্তার,উনাদের সাথে কথা হচ্ছে। অতিরিক্ত মানুষিক কষ্ট পেয়েছে তাই এমন হয়েছে।একদম ঘুমাচ্ছিলো না,কান্নাকাটি আর পাগলামি করছিলো তাই লো পাওয়ারের একটা ঘুমের ঔষধ দেয়া হয়েছে গতরাতে।

জালেরা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
—নাস্তা করছ?
—পাশের বাসার আন্টি একটু আগে নাস্তা দিয়ে গেছে।এখনো খাইনি।
—এখন আমাগো কি করা উচিৎ কওতো?

এমন সময় দরজায় নক হলো। পম্পি দরজা খুলে দেখলো,স্বর্ণার সঙ্গে তাশফিও দাঁড়িয়ে আছে।
পম্পি আস্তে করে বলল-
—নওমির দাদু বসে আছে নওমির পাশে।নওমি ঘুমাচ্ছে।
তাশফিকে পুরাই আউলাঝাউলা লাগছে পম্পির কাছে। সে যে পুরাই বিধ্বস্ত বোঝাই যাচ্ছে।

গত রাত থেকে একটুও শান্তি পাচ্ছে না তাশফি।বাবা-মা নওমির ব্যপারটা জানার পর কোন মন্তব্য করেনি। এতেই বোঝা যায় এই ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করার দরকার আছে তাদের। খুব সহজ হবে না ব্যাপারটা, সবকিছু খুব সহজে মেনে নিবে না। তাঁরা মানুষের কথার ভয় করবে, সমাজের ভয় করবে। কিন্তু তাশফির কাছে এটা কোন সমস্যাই না। কি হবে নওমির বৈধতা আর অবৈধতা দিয়ে?সে তো নওমিকে ভালোবেসেছে, ওর পরিচয়কে না।তাহলে পরিচয় কেন সম্পর্কের মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে? নওমিকে নিয়ে অনেক দূরে কোথাও চলে যাবে,যেখানে এই সব বিষয়ে বলার কেউ থাকবে না। সব কিছু সে ভেবে রেখেছে।এখন শুধু নওমি সুস্থ হলেই ওর সাথে কথা বলে সব কিছু ফাইনাল করতে হবে।

সামনের স্পেসটাতে শুধু একটা চেয়ার আর ডিভান।তাশফিকে এখানেই বসতে বলল পম্পি।

তাশফি একটু বসে আবার দাঁড়িয়ে গেলো।ঢুকে গেল বেড রুমে।দাদু তাশফিকে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে স্বর্ণা বলল,ও আমার ভাই।চার জনের মনের ভিতরেই বিভিন্ন কথা ঘুরপাক খাচ্ছে।

জালেরা বেগম খুব গভীরভাবে তাশফিকে পর্যবেক্ষণ করলেন। তাঁর তীক্ষ্ণ নজরে সব কিছু ধরা পড়লো।

জালেরা বেগম বললেন-
—এই যে ছেলে তুমি মনে হয় নওমিরে পছন্দ কর।

তাশফি মাথা নাড়িয়ে নিচু করে ফেলল।

জালেরা বেগমের এইটা প্রশ্ন ছিল না। উনি নিশ্চিত হয়েই এই কথা বলেছেন।তাশফির চোখ দেখেই বোঝা যায় ঐ চোখে এক সাগর ভালোবাসা উথালপাথাল করছে।তার অভিজ্ঞ চোখ ভুল হতে পারে না।
—কতটুক পছন্দ কর,এই সমাজ-সংসাররে কাঁচ কলা দেখাইতে পারবা?ওরে পাইতে হইলে একটা বিরাট যুদ্ধ তোমারে করতে হইবো , কাছের- দূরের আপন- পর সবার সাথে,পারবা?
—পারবো।
একটা কথাতে এত দৃঢ়তা ,জালেরা বেগম মনে মনে খুশি হলেন, যেন একটা আশার আলো দেখতে পেলেন।

তোফাজ্জলের স্ত্রী হাজেরা হাসপাতাল থেকে ওর ভাইয়ের বাসায় চলে গেছে। তোফাজ্জল কোথায় ডুব দিয়েছে কেউ জানে না। তিনি তো মা , তোফাজ্জলের চিন্তায় ঘুমের মধ্যেও দুঃস্বপ্ন দেখেন। সন্তান যাই কিছু করুক তার জন্য মায়ের মনের ভালোবাসা কমে যায় না কখনো।তিনি ভাবেন মানুষের একটা ভুলের জন্য কতগুলো জীবন এলোমেলো হয়ে যায়। যেই সময়ের ভুল, সেই সময় কিছু না হলেও, কিংবা সেই সময় সেটাকে ভুল মনে না হলেও, সেই ভুল জীবনে কখনো না কখনো এসে পাহাড়ের মত সামনে দাঁড়ায়। আর তখনই মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। এখন যেমন অবস্থা হয়েছে তোফাজ্জলের।

জালেরা বেগমের সাথে হাজেরার কথা হয়েছে।সে বলেছে,’আর সম্ভব না এই সংসারে আসা।কোন দিন যদি সব কিছু ভুলতে পারি তাহলেই আসব।’ হাজেরার জন্য কষ্ট হয় জালেরা বেগমের।তার কোন দোষ না থাকলেও সে কষ্ট পাচ্ছে।
যাই হোক এত কিছুর মধ্যে নওমির একটা কিনারা হলেই যেন শান্তি।

হঠাৎ নওমি উঠে বসলো।সবার দিকে তাকিয়ে বলল-
—আবার স্বপ্ন দেখছি,দাদু আসছে আবার তাশফি ও আসছে।
একটু হেসে আবার শুয়ে পড়তে চাইলে, দাদু বললেন-
—আসলেই আমরা আসছি, তুমি স্বপ্ন দেখতেছনা।

নওমি বলল-
—কেন আসছেন?সবাই চলে যান।

জালেরা বেগম নওমির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন-
—দাদু এমন করে না।দুনিয়াতে যেমন সমস্যা আছে তেমনি সমাধানও আছে। আমরা সবাই তোমারে ভালবাসি। আমরা সবাই চাই তুমি ভালো থাকো।
নওমি উঠে বাথরুমে চলে গেলো। অনেকক্ষণ সে বসেই রইল। ইচ্ছে করছে না কারো সামনে যেতে।
পম্পি দরজায় নক করতে লাগলো।শেষে নওমি বেরিয়ে এলো। পম্পি ওকে ধরে সামনের ডিভানে নিয়ে বসালো।সেখানে আগেই তাশফি বসে আছে। পম্পি চলে গেলো বেড রুমে।

তাশফি আরো কাছে এসে বসলো ,এত কাছে যে তাশফির নিঃশ্বাস নওমির গালে এসে পড়ছে।দুই হাত দিয়ে নওমির মুখটা তুলে বলল-
—তোমাকে ভালোবাসি, শুধু তোমাকেই। তোমার পরিচয় দিয়ে আমি কি করবো? পৃথিবীতে যত দিন আমার শ্বাস থাকবে ,প্রতিটা নিঃশ্বাসে তোমাকে চাই। তুমি যে কষ্ট পাচ্ছ সেই কষ্টের আঁচড় আমার বুকে এসে লাগছে।কারণ আমার মনটা যে তোমার কাছে।

নওমির হাত দুটো ধরে বলল-
—আমরা অনেক দূরে কোথাও চলে যাবো।তুমি যেখানে বলবে সেখানে।তুমি কোন দোষ না করেও কেন দোষী হবে?নিজেকে কেন এত কষ্ট দিচ্ছ?

নওমির চোখ থেকে পানি পড়ছে তাশফির হাতের উপর।তাশফি চোখের পানি মুছিয়ে দিতে দিতে বলল-
—তুমি এমন করলে আমি নিরুদ্দেশ হয়ে যাবো। আমাকে আর খুঁজে পাবে না।

এবার নওমি চোখ তুলে বলল-
—অনেক হারিয়েছি আর হারাতে চাই না।আমি চেষ্টা করবো আমার মনকে বোঝাতে।

তাশফি এক চিলতে হাসি দিয়ে নওমির গালে হাত রাখলো।এবার নওমি একটা স্পর্শ অনুভব করলো যেটাতে ভালোবাসা মিশানো আছে,আছে আস্থা আর বিশ্বাস। চোখ বুজে শুধু অনুভবে মিশে গেলো নওমি।একটা স্পর্শ কত কিছু বুঝিয়ে দিতে পারে।

চলবে…

#ফাহমিদা_লাইজু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here