৫ম_তলার_মেয়েটা,২৮,২৯

0
602

#৫ম_তলার_মেয়েটা,২৮,২৯
ফাহমিদা_লাইজু
#পর্ব_২৮

অনেকটা সময় নিয়ে শেষ পর্যন্ত তাশফি বলতে পারল,সে নওমিকে বিয়ে করতে চায়।
তাশফির কথা শুনে
সিরাজুল ইসলাম বললেন-
—এত তাড়াহুড়া করার কি আছে?সময় নাও। চিন্তা কর।আমি তোমাকে মানা করছি না।এখন আবেগে ভাসছ কিন্তু বাস্তবতা বড় নির্মম।
—আমি অনেক চিন্তা ভাবনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।নওমির সমস্যা আমার কাছে কোন সমস্যাই না।
—এই সমাজ নিয়েই আমাদের চলতে হয়। বিয়ের পর বৌকে কারো সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে যখন তার পরিচয় জানতে চাইবে সে তখন কি উত্তর দিবে?আর তখন তোমার ও সেটা ভালো লাগবে না।এক সময় এই সব ফেইস করতে করতে তোমার মধ্যে এক ধরনের বিতৃষ্ণা চলে আসবে নওমির প্রতি।
—এই সমাজ আমি মানি না।এই সমাজ আমার জন্য কি করে?
—তবুও সমাজের বাইরে আমরা বাস করতে পারি না।এই সমাজ নিয়েই আমাদের থাকতে হয়।
—তুমি তাহলে আমাকে মানা করছ নওমিকে বিয়ে করতে?
—না মানা করছি না। শুধু চিন্তা করতে বলছি।
—এইটাকে মানা করাই বলে আব্বু।
—তুমি যা ইচ্ছে করতে পার।
—তোমাদের অমতে আমি কিছুই করবো না এটা খুব ভালো করেই জান।সব সময় তুমি তোমার ইচ্ছা আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছ। আমি ডাক্তার হয়নি এজন্য তোমার খুব আফসোস। খুব চেয়েছিলে কিন্তু চান্স হয়নি। নাম্বার তো কম পেলাম যে, প্রাইভেট মেডিকেলেও ভর্তি হওয়া যাবে না। আমি সব সময় মনেপ্রাণে চাইতাম যেন চান্স না হয়। ডাক্তারিতে চান্স না পাওয়াতে তুমি আমার সাথে কতদিন ভাল করে কথাই বলোনি। মনে আছে? তোমাদের দুজন সমাজে প্রতিষ্ঠিত একজন হার্ট স্পেশালিস্ট আরেকজন গাইনোকোলজিস্ট। এত প্রতিষ্ঠিত যে সারাদিনে দুজনের দেখাই হয় না। সমাজের মানুষ খুব সম্মান করে এটাই বড় কথা, নিজেরা কেমন আছো সেটা দেখার কোন বিষয় না। আমরা কিভাবে বড় হয়েছি তুমি কখনো কাছ থেকে দেখেছো? আম্মু কাজের লোকের সহায়তায় ঘর, বাহির করতে করতে আমাদের বড় করেছে। আমি তোমাদের মত লাইফ লিড করতে চাইনা। তাই আমি সমাজের ও তোয়াক্কা করি না। যেই সমাজ মানুষের ইচ্ছে – অনিচ্ছা কে মূল্য দেয় না সেই সমাজের আমিও কোন মূল্য দেই না।
—তোমার একার ইচ্ছা-অনিচ্ছা কিংবা মূল্য দেয়া না দেয়াতে সমাজের কিছুই যায় আসে না।
—যেমনভাবে সমাজের কিছু যায় আসে না তেমনি ভাবে আমরা থাকলাম কিংবা মরে গেলাম এটাতেও সমাজের কিছু যায় আসে না। তোমার আসে কিনা জানিনা।

পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে দেখে তাশফির আম্মু তাবাসসুম এতক্ষণ চুপ থাকলেও এখন ওদের কথার মাঝখানে ঢুকলেন-
—তোমরা দুজনেই থামো। আমি বুঝতে পারছি না এই বিষয়টা নিয়ে এত উচ্চবাচ্য করার কি হলো? বসে ঠান্ডা মাথায় আলোচনা করা যাবে পরে। এখন চলো খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে খেয়ে নেই সবাই।
সিরাজুল ইসলাম বললেন-
—আমার ক্ষুধা নেই আমি এখন খাবো না।
—এটা কেমন কথা ক্ষুধা নেই?আমরা সপ্তাহে মাত্র দুইটা দিন সবাই একসাথে ডিনার করতে পারি। আস তো।
তাশফি কখনো এতটা রেগে যায়নি , তার পরেও কিভাবে যেন রাগ হজম করে ফেলল। এই ছেলের এই এক অসাধারণ গুন। সে কখনো এতটা সাহস নিয়ে আব্বুর সাথে কথা বলেনি।আজ একটু বেশিই হয়ে গেল।নওমিকে হারানোর ভয় থেকেই এমনটা হয়েছে।এটা তো কোন ভাবেই সম্ভব নয় আব্বু যা বলছে তা মেনে নেয়া।যে কোনো ভাবেই হোক তাঁকে রাজি করাতে হবে।

তাশফি বলল-
—আব্বু প্লিজ রাগ করো না।খেতে চল।সবাই একসাথে বসে খাবো‌ এই সময়টার অপেক্ষায় থাকি সবসময়।এটা আমাদের জন্য অনেক সুন্দর একটা মুহূর্ত।এই সুন্দর মুহূর্তটাকে নষ্ট করে দিও না প্লিজ।

সিরাজুল ছেলের দিকে তাকালেন।ছেলে উত্তপ্ত কণ্ঠে এতক্ষণ যা বলল,সেটা অপ্রিয় হলেও ঠিক। তিনি কখনো পর্যাপ্ত সময় পরিবারকে দিতে পারেননি। রোগীর হার্টের সব খবরাখবর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বুঝতে পারলেও পরিবারেরটা বুঝেননি। তাদের ইচ্ছা, অনিচ্ছাকে বুঝতে চেষ্টা করেননি। সব কিছু মানতে পারলেও এটা মন থেকে কিছুতেই মানতে পারছেন না, একটা অবৈধ সন্তানকে তাঁর ছেলে বিয়ে করবে।এতটা উদার মনের কখনো তিনি হতে পারবেন বলে মনে হয় না। এতদিন মেয়ের বান্ধবী হিসেবে এবং পরে ছেলের পছন্দ হিসেবে নওমিকে খুব পছন্দ করলেও একটা সত্য মুহূর্তেই সব কিছু বদলে দিল।
তবে যাই হোক ছেলের কথা অনুযায়ী এই সময়টাকে নষ্ট করার মানে হয় না। তিনি ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসলেন।
স্বর্ণা এতক্ষণ কোন কথা বলেনি।ওদের কথা শুনে একটু ভয়ও পেয়েছিলো।এমন তো কখনো দেখেনি।
অন্য সময়ের মতো কেউ কথা বলছে না আজ। সবাই একই বিষয় নিয়ে চিন্তা করলেও কেউ আর মুখে প্রকাশ করছে না।

তাবাসসুম কখনোই সিরাজুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেননি।আসলে অভিযোগ করার মত সময় তার ছিল না। নিজেকে এত ব্যস্ততার মধ্যে ডুবে থাকতে হয়েছে যে, এসব চিন্তা করার মতো সুযোগ ছিল না। এখনো নেই। সিরাজের মতো সন্তান দের উপরে কখনো জোর খাটাতে চাননি তিনি। ওদের যেটা ভালো লাগে, ওদের ভালোলাগাকে পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দিয়েই ওদের বড় করে তুলেছেন।এই জন্য অবশ্য মাঝে মাঝে তাঁকে কথা শুনতে হয়েছে সিরাজুলের কাছে কিন্তু সে সব কিছুই দীর্ঘ স্থায়ী হতো না। কারণ তাবাসসুমের সেই সবে কান দিয়ে ঝগড়া করার মতো সময় ছিল না। তিনি স্বামীর কাছ থেকে খুব বেশি আশা করেননি তাই তার দুঃখটা কম। পারিবারিকভাবে বিয়ে হওয়ার পরে এই দম্পতি পরিবার, সমাজ সবার চোখেই আদর্শ সুখী দম্পতি। হয়তোবা তাঁদের নিজেদের কাছেও।

তোফাজ্জল এখান থেকে সেখানে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন কিন্তু কোথাও শান্তি খুঁজে পাচ্ছেন না। স্টুডেন্ট লাইফে এইসব জায়গাগুলোতে এসে কি আনন্দ করেছেন বন্ধুদের সাথে। খাগড়াছড়ি, সিলেট, বান্দরবান, কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন ঘুরে বেরানোটা জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিল। পড়াশোনা শেষ করে, হয়ে গেলেন টাকা কামানোর মেশিন। টাকা কামানো একটা নেশার পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। এখন জীবনের অনেকটা সময় চলে গেছে সেই তারুণ্যদীপ্ত মন আর নেই। তার উপর মনে শান্তি না থাকলে দুনিয়ার কোন কিছুই ভালো লাগেনা।সব কিছু ছেড়ে আসলেও কি সব কিছু তাকে ছেড়েছে?হাজেরার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন তোফাজ্জল। এটা শুধু মুখের কথা ছিলো না আসলেই তিনি মন থেকে ক্ষমা চেয়েছেন। তাঁর সন্তানের মা’কে আসলেই দুঃখ দিতে চাননি। অনেকবার বলার পরেও হাজেরা তাঁকে বিশ্বাস করেননি। আসলে বিশ্বাস হলো কাঁচের মতো একবার ভেঙে গেলে আর জোড়া লাগে না, কোন না কোনভাবে জোড়া লাগালেও দাগ থেকেই যায়। হাজেরাকেও দোষ দেন না তিনি।সংসারের এত বছর পার হওয়ার পর কেউ যদি জানতে পারেন
তার স্বামীর অন্য কারো সাথে সম্পর্কের ফলে, সন্তানও আছে তাহলে তাকে কোন ভাবেই বিশ্বাস করা সম্ভব হয় না। নওমির মা যদি প্রথমেই তাঁকে জানাতো সন্তান হওয়ার কথা তাহলে পরিস্থিতি এতটা ঘোলাটে হয়তো হতো না।এটা অস্বীকার করার উপায় নেই নওমির মা নিরা সেদিন ঐ ভাবে না বলে চলে না গেলে আজ নিরাই হয়তো তার জীবনে থাকতো।এটা কিভাবে অস্বীকার করেন তিনি নিরাকে ভালোবাসেননি? ভালোবেসেছেন তবে সেটার প্রকাশ ও হয়নি , পরিণতি ও পায়নি।
তখন হয়তো হাজেরা কে সব কিছু জানানো হতো। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে যেতো। তবে জীবনে আর কখনো হাজেরার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি তিনি।
নিরা চলে যাবার পর তার মনে হয়েছে সব কিছু ঘটেছে খুব ভুল সময়ে,ভুলভাবে।হাজেরা, সন্তান সবার প্রতি সঠিক ভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। জীবনে কখনো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন স্বপ্নেও ভাবেন নি। নওমি তাঁর সন্তান,নওমিকে তিনি ভালোবাসেন।কোন প্রতিজ্ঞা করে হাজেরার সাথে থাকতে পারবেন না তিনি। হাজেরা প্রতিজ্ঞা করতে বলেছিল নওমিকে এই বাড়ী থেকে তাড়িয়ে দিতে,কখনো ওর সাথে সম্পর্ক না রাখতে।
তোফাজ্জল বুঝিয়ে বলেছেন অনেক, মেয়েটার দোষ কি,একটা অসহায় মেয়ে।ওর পাশে এখন তোফাজ্জল না থাকলে মেয়েটার ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে যাবে।নওমিকে বুকে টেনে নিতে বলছেন না।যে ভাবে চলছে সেভাবেই চলবে সব কিছু। নওমি তো কোন সমস্যা করছে না।এই সব কিছু বুঝিয়েও কিছু হলো না। হাজেরার শর্ত মেনে না নিলে সে আসবে না। হাজেরার ভাই হাফিজ এককাঠি উপরে। তার বুদ্ধিতেই হাজেরা এই সব করছে। হাফিজ সরাসরিই বলল,নওমিকে সে দেখে নিবে। তোফাজ্জল বলেছিলেন, ‘নওমির কি দোষ?দোষ আমি করেছি শাস্তি আমাকে দাও। যদি নওমির কোন ক্ষতি তুমি কর তোমাকে কিছুতেই ছেড়ে দেব না।’

এভাবে আর কতদিন লুকিয়ে থাকবেন? একসময় না একসময় যেতেই হবে গন্তব্যে। বেশ অনেকদিন হয়ে গেল। সবকিছুর থেকে পালাতে পারলেও নিজের থেকে নিজে পালাতে পারলেন কই?

তাশফির সাথে কথা বললেও, আগের মত কথা আর এগোতে চায় না নওমির। বেশিরভাগ সময় সে শুধু শোনে,তাশফি আগামী দিনের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা বলে। শুনতে খুব ভাল লাগে। তবে উত্তরে কিছুই বলতে ইচ্ছে করেনা। ওর কাছে মনে হয় তাশফি তার জীবনে একটা সুখস্বপ্ন। যেকোনো সময় এই সুখস্বপ্নের ইতি ঘটবে।ওর মধ্যে একটা নীরবতা চলে এসেছে। কারো সাথেই আর প্রাণ খুলে কথা বলতে পারেনা। ভবিষ্যতের স্বপ্ন গুলো কেমন করে যেন ঘুমিয়ে গেছে ওগুলো আর উঠে আসে না মনে। এখন শুধু জীবনটা হয়েছে এমন, সূর্য উদিত হয় আবার অস্ত যায় যেমন- বেঁচে থাকা লাগে তাই বেঁচে থাকা,এমন।

সবাই সব সময় নওমির খোঁজ খবর রাখছে, প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশিই রাখছে। এই ব্যাপারটা তার কাছে মোটেও ভাল লাগেনা। তার মনে হয় তাকে নিশ্চয়ই সবার থেকে আলাদা ভাবছে দেখেই তার প্রতি সবার এত করুণা। এটাকে সে করুণাই ভাবছে। শুধু পারু এই ঘটনা জানেন না, তিনি যা করছেন মন থেকেই করছেন। এমনও হতে পারে সবকিছু জানলে হয়তো নওমির ছায়াও দেখতে চাইবেন না। কি অদ্ভুত জীবন তার!

ভার্সিটি থেকে এসে অলস ভাবে শুয়ে রইলো নওমি, বাইরের কাপড় ও ছাড়লো না। দরজায় নক হলে , খুলে দেখে পারু দাঁড়িয়ে। খুব তাড়াহুড়ায় আছেন বোঝা যাচ্ছে।
তিনি বললেন-
—আমি হসপিটালে যাচ্ছি।সিমির নাকি পেইন ওঠেছে,ওকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছে। তোমার আংকেল ও অফিস থেকে চলে যাবে।
পারুদের দরজায় ঝিমি দাঁড়িয়ে আছে, ওকে উদ্দেশ্য করে পারু বললেন-
—তুই আর মর্জিনা নওমির বাসায় চলে আসিস। আর নওমিকে বললেন-
— তোমার সমস্যা না থাকলে তুমি চলে যেও আমাদের বাসায়। তোমাদের যেভাবে সুবিধা সেভাবেই তোমরা আজ থাকো।আমাদের কতক্ষণ লাগে ঠিক তো নেই। তাহলে আসি, দোয়া করো মা।
—আন্টি আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমরা এদিকটা ম্যানেজ করে নেব।

পারু সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতেই ঝিমি বলল-
—আপু চলে আস,আমরা আজ অনেক মজা করবো।

চলবে…

#ফাহমিদা_লাইজু

#৫ম_তলার_মেয়েটা

#পর্ব_২৯

সিমির ফুটফুটে একটা মেয়ে হলো।সমস্ত প্রাণীর বাচ্চাই ফুটফুটে, তুলতুলে আর নিষ্পাপ হয়ে পৃথিবীতে তাদের আগমন ঘটায়।
পরিবারের সবার অপেক্ষার সেই দিন আজ,যেই অপেক্ষার অবসান হয়ে, আনন্দে সবার মন ভেসে যাচ্ছে।
সিমি গতকাল থেকেই অপরিসীম কষ্ট সহ্য করে আজ নিজের অংশকে পৃথিবীর আলো দেখালো। ব্যথায় যখন তার মুখ কুঁচকে উঠছিল ঠোঁট গুলো কালো হয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছিল সেই অবস্থা পারু সহ্য করতে পারছিলেন না। একসময় নিজে এমন কষ্ট সহ্য করে মেয়েকে জন্ম দিলেও, আজ সেই মেয়ের কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারছেন না। কয়েকবার বলেছিলেন,
—নরমাল ডেলিভারির দরকার নেই সিজার করে ফেলুন।
ডাক্তার এই কথা শুনে হেসে বলছিলেন-
—সব কিছু ঠিক আছে।কেন শুধু শুধু অপারেশনের ঝামেলায় যাবেন?সেখানে কি কষ্ট নেই? মেয়ের চাইতে আপনিই বেশি অস্থির হয়ে গেছেন! তাই আপনাকেই বলছি ধৈর্য ধরুন মা।

সিমি নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছিলো তার নিজের এতটা ধৈর্য শক্তি দেখে।
একটা সন্তান নিজের মধ্যে আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠে, তার বৃদ্ধি তার অনুভূতিকে জানান দিয়ে। কত পছন্দের ত্যাগ করতে হয়, নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়। এতটা কষ্ট সহ্য করে তাকে পৃথিবীতে আসার পথ তৈরি করে দিতে হয়।সেই কাঙ্ক্ষিত সন্তানের মুখটা দেখেই সমস্ত কষ্ট ভুলে যায় একজন মা।
সিমির বেলাতেও তাই হলো, দুনিয়ার সবচাইতে অমূল্য সম্পদের মুখটা দেখে কষ্টের চিহ্ন রেখে যাওয়া কালো ঠোঁট গুলোতে জীবনের সবচেয়ে মিষ্টি হাসিটা ফুটে উঠলো। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানির রেখায় আবার পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই পরম নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করলো। আবার আবছা আবছা দেখলো মা আর শাশুড়িকে , সমস্ত রাজ্যের ঘুম যেন চোখের পাতায় ভর করেছে,কিছুতেই আর চোখ মেলতে পারলো না, গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো সে।

যখন সিমির ঘুম ভাঙল,সে নিজেকে কেবিনে আবিষ্কার করলো।কখন কিভাবে এখানে তাকে আনা হয়েছে মনে করতে পারলো না। কিন্তু সবাইকে দেখতে পারছে সে,সবার হাসিমুখ দেখে ভালো লাগছে।সিমির দিকে চোখ পড়তেই পারু বলে উঠলেন-
—এই যে সিমি উঠেছে।
তিনি মেয়ের কপালে চুমু দিলেন।মমতায় হাত বুলাতে লাগলেন।যেন মেয়ের কষ্টটাকে লাঘব করতে চাইছেন।
পরশ কাছে এসে হাতটা ধরে বলল-
—এখন কেমন লাগছে?
—ভালো।
—আমাদের মেয়ে,দেখ।
পরশের মা রোকেয়া কাছে এনে দেখালেন – নরম তুলতুলে শরীর, গোলাপী ঠোঁট,চোখ পিটপিট করা এক সদ্যজাত শিশুকে।

রোকেয়া পরশকে বললেন-
—বাবা,কোলে নাও নিজের সন্তানকে।

পরশ মেয়েকে কোলে নিল ভয়ে ভয়ে হঠাৎ যদি পড়ে যায় হাত ফসকে। ওর অবস্থা দেখে সবাই হেসে উঠল। পরশ এক অপার্থীব অনুভূতি অনুভব করলো। এই অনুভূতি প্রকাশ করার মতো না কাউকে বলে বোঝানোর মত না শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করার মত। তার চোখ ভিজে ভিজে উঠছে।এই অবস্থাটা নাঈম বুঝতে পেরে ছেলের কাঁধে হাত রেখে হালকা চাপ দিলেন,যেন বোঝাতে চাইলেন ‘প্রথম সন্তান হওয়ার অনুভূতি এমনই হয়।’

যদিও খুব একটা প্রয়োজন নেই তারপরেও আজকের দিন টা হসপিটালে থেকে গেলে ভালো হয়, তাই সিদ্ধান্ত হলো আজ থেকে আগামী কাল বাসায় চলে যাবে।

প্রথম বারের মতো দাদা দাদু,নানা-নানু হওয়ার অনুভূতি ও অন্য রকম।তাঁরা নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করতে লাগলেন।

সিমির বাচ্চা হওয়ার খবর পেয়ে ঝিমি দেখার জন্য একেবারে অস্থির হয়ে উঠলো।
নওমিকে সাথে নিয়ে ঝিমি হসপিটালে উপস্থিত হয়ে গেল। এত লোক হয়ে গেছে যে কেবিনে আর জায়গা হচ্ছে না। পারু বললেন, সবাইকে বাসায় চলে যেতে। সবাইকে ফ্রেস হয়ে , খেয়েদেয়ে, রেস্ট নিয়ে পরে আবার আসতে বললেন।
গতকাল থেকে সবার অনেক ধকল গেছে।

নওমি এত ছোট বাচ্চা কখনো কোলে নেয়নি। ঝিমি কোলে নিল বাবুকে। কিছুক্ষণ রেখে , নওমির কোলে বাবুকে দিলো।
ছোট্ট একটা পুতুল যেন।কি আদর যে লাগছে!

নওমির মনে হতে লাগল,তাকে কোলে নিয়ে মায়ের কেমন অনুভূতি হয়েছিল?সে কি আসলেই খুশি হওয়ার মত , মায়ের মনে সুখানুভূতি সৃষ্টি করার মত বাচ্চা ছিল সে?
এই বাচ্চার জন্ম হয়েছে সবাই কত খুশি। বাবা মা পরিবারের সবার আদর ভালোবাসা পেয়ে ও বড় হয়ে উঠবে। সবার ভাগ্য তো আর এমন হয়না। মনে মনে বলল,দোয়া করি ,’ পৃথিবীর কোন দুঃখ যেন তোমাকে স্পর্শ না করে।’

হঠাৎ নওমির অদ্ভুত অনুভূতি হল। একটা বাচ্চার জন্মের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ জার্নিতে বাচ্চাটার তো কোন দোষ থাকে না। সে তো জানেই না কিছু, একটা নিষ্পাপ পবিত্র আত্মা। তাহলে তার নিজের জন্ম নিয়ে নিজেকে এতটা দোষী ভাবার কি হলো? তার তো কোন দোষ নেই। যারা তাকে পৃথিবীতে আনার জন্য দায়ী, সেই দায়ভার তাদেরকেই বহন করতে হবে। একজন তো পৃথিবী থেকে চলে গিয়ে সে দায় ভারমুক্ত হয়ে গেছেন। কিন্তু আরেকজন তো আছেন তাকে সবকিছু সুদে-আসলে চুকাতে হবে। সে বাঁচবে, সমাজে মাথা উঁচু করেই বাঁচবে।

পারু বললেন-
—এবার আমার কোলে দাও।
এই সিমি বাবুকে খাওয়াতে হবে আবার।এই বলে নওমির কোল থেকে নিয়ে সিমির কোলে দিলেন বাবুকে।
নওমির কাছে মনে হলো , পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম দৃশ্য হচ্ছে মা তার সন্তানকে ব্রেস্ট ফিডিং করাচ্ছে। নওমি যেন চোখ ফেরাতে পারছে না।মনে মনে বলল, মাশাআল্লাহ।

সিমি তার মাকে বলল-
—বাবু মনে হয় খুব বেশি দুধ পাচ্ছে না। ওকে কি ফিটার দেওয়া শুরু করবো, মা?
—একদম না। প্রথম দুই-তিনদিন একটু কমই আসে দুধ। এরপর ঠিকমতোই পাবে। সবকিছুতেই তোমরা এতো অস্থির হয়ে যাও! ধৈর্য ধরতে হয়।

ঝিমি বলল-
—আপু তুই ব্যথা পাচ্ছিস না?
ঝিমির কথায় সবাই হেসে উঠল।
—আমি হাসার মতো কি বললাম?
নওমি বলল-
—হাসার মতো কিছুই বলিস নি। প্রশ্ন তো করতেই পারিস। কিন্তু তুই এমন ভাবে বলেছিস, তোর কথা বলার ধরন দেখেই আমরা সবাই হেসেছি।
পারু বললেন-
—এখন আমাদের সামনে বলেছিস ঠিক আছে। সবার সামনে এমন বোকামির প্রশ্ন করবি না কখনো।
—আচ্ছা ঠিক আছে। আমি চুপ করে বসলাম আর একটা কথা বলবো না ।
—কিছুই বলা যায় না তাকে। যেটা ভুল হয়েছে সেটা শুধরে দিব না? কিছু বললেই রাগ করে ফেলতে হয়?
সিমি বলল-
—এখন কিন্তু তুই খালামণি হয়ে গেছিস। এমন করলে চলবে না। তাহলে বাবু বলবে, খালামনি খুব বোকা।
এবার ঝিমির মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

নওমি বলল-
—সিমি আপু বাবুর নাম ঠিক করেছ?
—ও পেটে থাকতেই আমরা সবাই মিলে লটারি করে ওর নাম ঠিক করে রেখেছি।
—লটারি করে মানে?
—পরিবারের সব সদস্যরা দুইটা করে নাম কাগজে লিখে জমা দিয়েছে। একটা ছেলের নাম আর একটা মেয়ের নাম। এরপর সব কাগজ একসঙ্গে করে লটারি করেছি। লটারিতে উঠেছে ওর দাদার লিখা কাগজটা।সেখানে মেয়ের নাম লিখা ছিল ‘আয়েশা সুবহা।’ এই নামই রাখবো’ এই নামেই আকিকা হবে।
—খুব সুন্দর নাম-আয়েশা সুবহা।আর আপনাদের লটারি করে নাম রাখার পদ্ধতি টা খুব সুন্দর।
—এতে করে কেউ মনে দুঃখ পাবে না। সবাই মনে মনে নাম ঠিক করেছিল। সব নাম তো রাখা সম্ভব না।তাই এই পদ্ধতি।
পারু বললেন-
—আমি লিখে দিয়েছিলাম,সিমরান।যাই হোক আমার লিখাটা উঠলো না।
অবশ্য তাতে কি ?এই নামটাও খুব সুন্দর।

নওমি হসপিটাল থেকে বের হয়ে চিন্তা করলো পম্পিদের বাসায় যাবে।ঝিমি হসপিটালে থেকে গেল। আজ ভার্সিটি বন্ধ।
রিকশা দিয়ে পম্পিদের ওখানে যেতে অনেক দেরি হবে তবুও রিকশা নিল নওমি। অনেকদিন থেকে চারপাশে ভালো করে তাকিয়েও দেখে না সে। আজ দেখতে দেখতে যাবে। অনেক কিছু কেমন যেন নতুন নতুন লাগছে।

পম্পি,নওমিকে দেখে একেবারে অবাক। কিন্তু পম্পিকে দেখে মনে হল সে বাইরে যাচ্ছে।
—কি রে বাইরে যাচ্ছিস?তাহলে আমি বরং চলে যাই।
রজনী এসে বলল-
—আমরা দুজন যাচ্ছিলাম ,এখন তুমি মিলে তিনজন হলো।
—কোথায় যাবেন?
—আমার এক ফ্রেন্ডের আর্ট এক্সিবিশন হচ্ছে। আমরা এইচ. এস. সি পর্যন্ত একসঙ্গে পড়াশোনা করেছিলাম।সেখানেই যাচ্ছি। তোমার ভালো লাগবে।
—আমি বড় বড় শিল্পীদের আর্টের কিছুই বুঝিনা।

হেসে হেসে রজনী বলল-
—আমার ওই ফ্রেন্ড এর এটা প্রথম এক্সিবিশন। এত বড় হয়নি এখনও, কিছুটা হয়তো বুঝতে পারবে। খুব বেশি নাম ডাক হয়ে গেলে তখন আর অত অনুরোধ করে বলতো না যেতে। আরেকটা কারণ অবশ্য আছে। জানে যে, আমার স্বামীর অনেক টাকা। ইচ্ছে হলে একটা ছবি আমি কিনে ফেলতে পারি অনায়াসেই।
এবার হা হা করে হাসতে লাগলো রজনী। তার এই হাসির মধ্যেও যে গভীর দুঃখ লুকিয়ে আছে সেটা বুঝতে পম্পি বা নওমির কারো অসুবিধা হলো না।

—তবে নওমি তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে তুমি এক বিজয়ী সৈনিক।
পরাজিত মানুষকে সবাই আরো পায়ের নিচে ফেলে চটকাতে চায়। সব সময় এমনটাই থেকো।

নওমি একটু হাসলো।
—কিন্তু রজনী মণি আমার যে খুব ক্ষুধা লেগেছে।
নওমি মাঝে মাঝে রজনীকে আদর করে এই নামেই সম্বোধন করে। এমনিতে খালামণি বলে।
—ওরে আমার বাচ্চাটারে কতদিন পর তোর মুখে এই ডাক শুনলাম। আগে বলবে না।
পম্পি কৃত্তিম রাগ দেখিয়ে বলল-
—আহারে তোমাদের ঢং দেখে আর বাঁচি না। আমরা বাইরেই খাবো। এখন খেয়ে ক্ষুধা নষ্ট করিস না নওমি।
—অল্প কিছু খেয়ে নিক। অতিরিক্ত ক্ষুধা লেগে গেলে, তখন যত ভাল খাবারই দাও না কেন ভালো লাগবে না ক্ষুধা নষ্ট হয়ে যাবে।
—হালকা কিছু দাও।

তিনজন কথা বলতে বলতে, হাসতে হাসতে খুশি মনে সামনে এগিয়ে চলল।

চলবে…

#ফাহমিদা_লাইজু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here