#৫ম_তলার_মেয়েটা,৩২,৩৩
ফাহমিদা_লাইজু
#পর্ব_৩২
নাম্বার ব্লক করার সঙ্গে সঙ্গেই তাশফি বুঝতে পারলো কোন সমস্যা নিশ্চয়ই হয়েছে। তার আম্মু ফিরে আসার আগেই সব কিছুর উত্তর পেয়ে গেলো সে।আম্মু নিশ্চয়ই এমন কিছু বলেছে, নওমি আর সম্পর্ক রাখতে চাইছে না। নিজের আত্মসম্মান বোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে নওমির মতো মেয়ে সুখের সাগরে ভাসতে পারে না । ওহ্ আর ভাবতে পারছে না তাশফি।
নওমিকে কল করার আগে তাশফি তার আম্মুকে কল দিয়েছিল। তাবাসসুম কল রিসিভ করেননি। পরে স্বর্ণার সাথে কথা বলে জানতে পেরেছিল, ওরা নওমির বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। এর পরেই নওমির সাথে কথা বলার জন্য অস্থির লাগছিলো।বিয়ের ব্যপার নিয়ে আলোচনা করার জন্যই কল করেছিলো সে।সে ভেবেছিল সব কিছু ঠিক ঠাক মতোই এগিয়েছে।আব্বু মন থেকে রাজি না হলেও আম্মু নিশ্চয়ই খুশি মনেই গিয়েছে নওমির সাথে কথা বলতে। অনন্ত তাই মনে হয়েছিল যাওয়ার আগে।
এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই।স্বর্ণা সব কিছু বলবে তাকে।আম্মুর কারণে কিছু গন্ডগোল হলে,তাশফি কি করবে বুঝতে পারছে না।কি এক উভয় সংকটে পড়ে গেলো সে। আব্বু-আম্মুকে কষ্ট দিতে চায় না আবার নওমিকেও কিছুতেই হারাতে পারবে না সে। প্রথমে নওমিকে শুধু পছন্দ ছিল,পরে ভালোবাসা আর এখন নিজের অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে আছে নওমি।
তাশফিকে দেখেও আম্মু কথা না বলে ভেতরে চলে গেলেন। স্বর্ণাকে জিজ্ঞেস করলেও কোন কথা বলল না, শুধু চোখ দিয়ে ইশারা করলো পরে কথা বলবে।
হসপিটাল থেকে ইমারজেন্সি কল আসলে তাবাসসুম তাড়াতাড়ি চলে গেলেন।স্বর্ণার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো তাশফি।
—ভাইয়া তোকে আগেই বলেছিলাম পালিয়ে বিয়ে করে ফেল।তখন হয়তো নওমি রাজি হতো।এখন আর কোন ভাবেই ও রাজি হবে না।
—আমাকে খুলে বল,ওখানে কি হয়েছিল?
—খুলে বলার মতো কিছু নেই।আম্মু এমন ভাবে কথা বলেছে যে,নওমি মানা করে দিবে এটাই স্বাভাবিক।ওর মাথায় সামান্য পরিমাণ ঘিলু হলেও আছে। কোন খারাপ ল্যাংগুয়েজ ইউজ না করলেও বলার ধরণ খুব খারাপ ছিল।আম্মু ভেবেছিল, আম্মুর প্রস্তাব শুনে নওমি খুশিতে টগবগ করতে করতে রাজি হয়ে যাবে।
—নওমি আমার নাম্বার ব্লক করে দিয়েছে।
—সেটাই তো স্বাভাবিক।ও সরাসরি আম্মুর প্রস্তাব নাকোচ করে দিয়েছে।
তাশফি কিছুই বলতে পারছে না।কষ্ট যেন গলা চেপে ধরেছে।বুকটা এতটা ভার লাগছে যে মনে হচ্ছে একটা পাথর কেউ বুকে চাপিয়ে অথৈ পানিতে ডুবিয়ে দিচ্ছে তাকে। চোখের সামনে শুধুই অন্ধকার দেখছে সে।সব রাস্তাই যেন বন্ধ হয়ে গেছে।দম বন্ধ লাগছে তার।
দ্রুত পা ফেলে ছাদে চলে গেল তাশফি ।আজ আকাশে এত মেঘ জমেছে কেন?বাতাস কি বন্ধ হয়ে গেছে?প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস টুকু নিতে পারছে না সে।
নওমির কথা শুনেই পম্পি বুঝতে পারলো কিছু একটা হয়েছে। পম্পিকে কল করে যখন আসতে বলল,পম্পির মনে হলো যেন নওমির প্রাণ নেই দেহে ও কথা বলছে যন্ত্রের মতো। সঙ্গে সঙ্গেই রওনা হয়ে গেল সে। মেয়েটার জীবনে কি আর শান্তি পাবে না?নওমিকে সে আত্মার খুব কাছের ভাবতে শুরু করেছে অনেক আগে থেকেই।তাই ওর কষ্ট পাওয়া মানে নিজের কষ্ট পাওয়া। এতো ভালো একটা মেয়ের কপালে কেন শুধু দুঃখই থাকবে?
পম্পিকে দেখে নওমি কাঁদলো না একটুও।কেমন যেন ফ্যাকাশে লাগছিলো ওকে, মনে হচ্ছিল শরীরের সমস্ত রক্ত কোন ড্রাকুলা চুষে নিয়েছে। পম্পির চোখের দিকে না তাকিয়ে খুব সহজেই বলে গেলো সব কিছু।সব শুনে পম্পি একেবারে রেগে আগুন। কিভাবে তাশফির আম্মু এভাবে কথা বলতে পারল সে ভেবে পেল না। এমনিতে দেখা হলে সব সময় কত সুন্দর করে আদর করে কথা বলেন। ওই রূপের সাথে এইরূপ কিছুতেই মেলাতে পারছে না। সে বলল এই ব্যাপারে অবশ্যই তাশফিকে জানানো উচিত। নওমি যুক্তি দিয়ে বোঝালো, তার জন্য কেন আরেক জন পরিবার ছাড়া হবে? তার নিজের ভাগ্যের সাথে কিছুতেই তাশফিকে জড়াতে চায় না।পম্পি প্রশ্ন করলো,
—এইসব করলেই কি তাশফিকে ভুলে থাকতে পারবি? নিজের জীবন কাটিয়ে দিতে পারবি ভালোবাসাহীন ভাবে?
—জানিনা, কিছুই জানিনা। এখন একটা মাত্রই চিন্তা অপমানিত হয়ে ওদের ফ্যামিলিতে কিছুতেই যেতে পারবো না। তাশফির সঙ্গে বিয়ে হলে ওরা সব সময় আমাকে করুনার চোখে দেখবে। মনে হবে যেন আমি একটা ঘৃণ্য বস্তু সবাই আমার থেকে গা বাঁচিয়ে চলতে চাইবে। সেই সব অপমান কোনোভাবেই সহ্য করতে পারবো না। তাই আন্টির প্রস্তাব কোনভাবে আমার পক্ষে মানা সম্ভব না।
—সবকিছুই ঠিক আছে বুঝলাম। কিন্তু তাশফি তোকে ভালবাসে। ওর নিজের মুখ থেকে শোনা উচিত সবকিছু। আন্টির মুখের কথার সাথে তার কথার মিল নাও থাকতে পারে। সিনেমা-নাটকে দেখিসনা কিভাবে মা-বাবারা ভিলেন হয়ে আসে সম্পর্কের মাঝখানে। যে কোনো উপায়ে সম্পর্ক ভেঙে দিতে চায়। সেরকম কিছুও হতে পারে।
আমি কি স্বর্ণাকে একটা কল করব?
—না। স্বর্ণাকে দেখেই বুঝেছি ও আন্টির কথা হজম করছে খুব কষ্ট করে। ও এই সবের মধ্যে হয়তো নেই। মায়ের মতামতের সমর্থন করতে পারছে না আবার সরাসরি বিরোধিতাও করতে পারছে না। ওকে দেখে খুব কষ্ট লাগছিল আমার।
—তাহলে বুঝতে পারছিস ব্যাপারটা? তাশফি আর স্বর্ণা চাইছে তোদের সম্পর্কটা সুন্দরভাবে সমাধান হোক। আর আঙ্কেল আন্টি চাইছেন সম্পর্কটা ভেঙে যাক। এইজন্যই তাশফির সাথে তোর কথা বলা দরকার।
—তাশফির সাথে কথা বললে কি হবে? সে হয়তো তার বাবা-মার অমতে আমাকে বিয়ে করবে, আমার জন্য তাদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে সেটা আমি কিছুতেই হতে দিতে পারিনা।
—তোর সাথে বিয়েতে তারা মত না দিলেও কি বাবা মায়ের সাথে ছেলের সম্পর্ক আগের মত থাকবে ভেবেছিস?
—সেটা তাদের ব্যাপার তখন আমি আর মাঝখানে থাকবো না। এসব কথা বাদ দে, আমার একটা অনেক বড় উপকার করে দিতে হবে তোকে। বলতে পারিস আমাকে সাহায্য করতে হবে।
এই বলে নওমি হাত চেপে ধরলো পম্পির।
—এইসব কি করছিস নওমি। এভাবে কেন বলছিস?
—তুই আমাকে কোথাও লুকিয়ে ফেল।কেউ যেন আমাকে খুঁজে না পায়।
—এটার মানে কি? কাউকে লুকিয়ে ফেলা যায় নাকি?
—তাহলে এক কাজ কর,তোর আব্বুর কত জানাশোনা,উনাকে বলে দূরে কোথাও একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দে আমাকে।
—তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? কেন পালিয়ে যেতে চাইছিস?
—তাশফি এসে সামনে দাঁড়ালে আমি নিজেকে শক্ত রাখতে পারবো না।ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ওকে ফিরিয়ে দেয়ার সাধ্য আমার নেই।
ওকে বড্ড ভালোবাসি রে।
পম্পি তাকিয়ে রইল নওমির দিকে ওর হাত দুটো তার হাতের মুঠোয়।এই এক অভিজ্ঞতা পম্পির জীবনে কখনো হলো না।কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারলো না সে।তার জন্যেও তো কেউ এমন অস্থির হয়নি।তাকে সবাই টমবয় বলে এই জন্য ছেলেরা কাছেও আসেনি আর সেও এক অদৃশ্য দেয়াল তুলে রেখেছিলো নিজের মনে,সেই দেয়ার ভেদ করে প্রেম ভালোবাসা প্রবেশ করতে পারেনি।এখন নওমিকে দেখে তার এক অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো। কিছুক্ষণের জন্য মনে হলো তার জীবনেও এমন ভালোবাসা আসুক। ভালোবাসার উষ্ণতা, অভিমান,বিরহ যন্ত্রনা সব কিছু বুঝতে চায় সে।এটা এক মধুর যন্ত্রনা।নিজের অজান্তেই লাজুক এক চিলতে হাসি বেরিয়ে গেলো ঠোঁটের ফাঁক গলে।
—কি রে পম্পি হাসছিস কেন?
—তুই পালিয়ে গেলে তাশফি পাগল হয়ে পাবনা চলে যাবে।কিংবা সুইসাইড করবে।
—কি বলছিস এইসব অলক্ষুণে কথা।ওর কোন ক্ষতি হোক কখনো চাই না।
নওমির চোখ বড় বড় হয় গেলো।
—দুষ্টুমিও বুঝিস না?আসল কথা হলো তুই যেই প্রান্তেই থাকিস তাশফি তোকে খুঁজে বের করে ফেলবে।
—তাহলে আমাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দে। আমি আস্তে আস্তে পরে তোর টাকা শোধ করে দেবো।
—দেশের বাইরে কি বললেই চলে যাওয়া যায় নাকি? সেইসবের ব্যবস্থা করতে সময় লাগে।
—তাহলে আমি কি করবো বলে দে।
—তাশফি কি বলে আগে শোন।ও যদি তোকে সত্যিই ভালোবাসে তাহলে তাকে ফিরিয়ে দিস না।
যা পেয়েছিস তা হেলায় নষ্ট করিস না।
সেদিন রজনীকে ,সিরাতের সাথে কথা বলতে দেখে পম্পির বাবার মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল।
শুধু মাত্র পম্পির দিকে তাকিয়ে সেখানে কিছু বলেননি।ওরা বাসায় আসার পর ও স্বাভাবিক ছিলেন কিন্তু রাত নিস্তব্ধ হওয়ার সাথে সাথে তাঁর মধ্যে হিংস্রতা জেগে উঠেছিল।তখন রজনী কে একা পেয়ে মুখে কিছু না বললেও নিজের পুরুষত্ত্ব ভালোভাবেই দেখিয়েছিলেন। যদিও তার বয়স হয়েছে, হাঁপিয়ে ওঠেন।একদিনের ধকল সইতে হয় কয়েকদিন। রজনী এই পর্যন্তই পম্পির বাবাকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। যতটা না তার বয়সে কারণে তার চাইতে বেশি তার পশুসুলভ ব্যবহারের কারণে। প্রভু-ভৃত্যের মতোই তাদের সম্পর্ক। পম্পির বাবাই নিজেকে প্রভু মনে করাতে থাকেন প্রতিটা আচরণে।জোর করে রজনীর শরীরটাকে ভোগ করার আইনত ও সামাজিক ভাবে স্বীকৃত হলেও , রজনীর শরীর,মন ঘিনঘিনিয়ে ওঠে, তার শরীরের কাছাকাছি এলেই ।বাকি রাতটুকু রজনী বারান্দায় বসেই কাটিয়েছিল। তার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা পানিও পড়েনি।এত দিনে হয়তো চোখের পানি শেষ হয়ে গেছে।
HSC পড়ার সময় সিরাত ক্লাসমেট ছিল রজনীর।
রজনী বুঝতে পারতো সিরাত তাকে পছন্দ করে কিন্তু বলতে পারছে না।সব কিছু বুঝেও না বুঝার ভান করতো সে। খুব যে এক সাথে চলাফেরা হতো,তাও না। ক্লাসের ভেতর, কোচিং এর সময় কিংবা যাওয়া-আসার পথে দেখা অতটুকুই।
রজনীর মনে কখনো সিরাতের জন্য ভালোবাসার উদয় হয়নি।এর পরে কলেজ পাশ করে জগন্নাথে ভর্তি হলো সে।সিরাতের আর কোন খবর কানে আসেনি বা জানার ইচ্ছেও হয়নি।
আর তখন তার জীবনে ভালোবাসা এলো,যাকে ছাড়া বেঁচে থাকার কথাও চিন্তা করতে পারতো না রজনী ,সেই তাকে ধোঁকা দিলো।সেই প্রতারক ফিরে এসে আবার রজনীকে স্বপ্ন দেখাতে চাইছে।এই সব আর মনে করতে চায় না রজনী।
নতুন করে আর কাউকে নিয়ে ভাবতে চায় না সে। সেটা সিরাতই হোক কিংবা সেই প্রতারকই হোক। কাউকে ভালোবাসার মতো কিংবা ঘৃণা করার মতো মন কোনটাই নেই তার। দুঃখগুলো এখন তাকে খুব বেশি গ্রাস করে না। সবাই দেখছে সে ভালো আছে এটাই ভালো।
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু
#৫ম_তলার_মেয়েটা
#পর্ব_৩৩
নওমির সামনে তাশফি দাঁড়িয়ে আছে একদৃষ্টিতে নওমির চোখের দিকে তাকিয়ে। সেই দৃষ্টি সহ্য করা নওমির পক্ষে কোন ভাবেই সম্ভব না।সে নিচের দিকে চোখ নামিয়ে নিল। তার রাগ, অভিমান সব কিছু গলে গলে যাচ্ছে।তার মন চাইছে তাশফিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতে,
‘কোন দিন আমাকে ছেড়ে যেও না।’
কিন্তু কোন কথা গলা দিয়ে বের হলো না নওমির। তাশফির দিকে তাকাতেও সাহস হলো না।
তাশফি বলল-
—আমাকে বল নওমি,তুমি কি আমাকে ভালোবাস না?যদি তুমি মানাও কর আমি বিশ্বাস করবো না। কারণ এই কথা বিশ্বাসযোগ্য না। আমি তোমার চোখে ভালোবাসা দেখেছি আমার জন্য। কিছু কথা মুখে না বললেও বোঝা যায়।
তাশফি কথা বলছে রেগে রেগে।
নওমির ভয় করতে লাগলো,এর আগে সে তাশফিকে এত রেগে যেতে দেখেনি।
—আমি আগেও বলেছি এখনো বলছি তোমার জন্ম নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই।তাহলে তুমি কেন এত ভাবছ? আমার আম্মু আব্বু তোমাকে না মেনে নিলে, নেই।তাদের বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছি।এখন আমার ধৈর্যের সীমা ভেঙে গেছে।এখন চল আমরা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করবো।
—কিছুতেই না।আমি চোরের মতো বিয়ে করবো না।
—বুঝতে পারছ না,বিয়ে হয়ে গেলে আর কেউ কিছু বলতে পারবে না।
—আমি কারো কিছু বলাতে ভয় পাইনা, আমার কিছুই যায় আসে না।তুমি চলে যাও।আমাকে নিয়ে শুধু সমস্যা বাড়বেই,ঝামেলা বাড়বেই।
তাশফি, নওমির দু’টো হাত নিজের হাতের মুঠোয় ভরে নিজের বুকের বাম পাশে চেপে ধরলো,
—এই হৃদয়ের প্রতিটা স্পন্দন তোমার নামে হচ্ছে। তুমি আমাকে এলোমেলো করে দিয়েছ।তোমাকে পাওয়ার যে এতটা আকুলতা আমার মধ্যে সেটা তুমি কেন বুঝতে পারছ না?
পৃথিবী চলুক না তার নিজের মতো করে, কি আসে যায় তাতে, শুধু তুমি থাকো আমার হৃদয়ও গভীরে।
আমরা দুজন কোন কিছুকে তোয়াক্কা না করে শুধু ভালোবেসে যাবো আজীবন। বল তুমি শুধু আমার।
নওমির শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে।সে এর আগে কখনো তাশফির এতটা কাছাকাছি হয়নি। সে চোখ বন্ধ করে ফেলল।আর এই মুহূর্তে তার মায়ের কথা মনে হলো। সে মনে মনে বলল,’মা তোমাকে আমি ক্ষমা করে দিলাম।’
নওমি হাত ছাড়িয়ে দুই কদম পেছনে গিয়ে অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে রইলো।তাশফি যা বলেছে তার মনেও সেই একই অনুভূতি । পার্থক্য শুধু একটাই তাশফি বলতে পারছে আর সে বলতে পারছে না।
আবার ঘুরে তাশফির একটা হাত চেপে ধরলো নওমি কিছুই বলল না, তার চোখ গড়িয়ে শুধু পানি পড়লো।তাশফি যা বোঝার বুঝতে পারলো, তার উত্তর তার সামনে পরিষ্কার।সে তার ঠোঁট দুটো নওমির ঠোঁটে ছুঁইয়ে ,আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না।
এক অপার্থিব আনন্দ অনুভূত হতে লাগলো তাশফির। চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে জানিয়ে দিতে ইচ্ছে করলো নওমির কথা।এই হৃদয়হীন শহরটা কিছুক্ষণ আগে তাকে দেখে যে করুণার হাসি হাসছিলো এখন তাকে জানাতে ইচ্ছে করছে ,এই হৃদয়হীন শহর তোমার মতো সবাই হৃদয়হীন নয়,নওমি তার হৃদয় দিয়েই আমাকে ভালোবাসে।’
স্বর্ণা ওর আম্মুকে বলল-
—ভাইয়া তোমাদের অমতে কিছুই করতে চায়নি। তোমরাই তাকে বাধ্য করেছ।
তাবাসসুম একটা কথাও বললেন না।এই এক অদৃশ্য বা দৃশ্য দ্বন্দ্ব চলে মা আর ছেলের মধ্যে। তাবাসসুম ভাবতেন তিনি আর দশটা মায়ের মতো হবেন না । কিন্তু তার ভেতরেও কাজ করছে বিয়ের পর ছেলে দূরে চলে যাবে। আর নওমিকে কোন ভাবেই মন থেকে মানতে পারছেন না। স্বর্ণার আব্বু এসে টেবিলে বসার পর স্বর্ণা চুপ হয়ে গেল।
এর আগে সপ্তাহে দুই দিন যে তারা একসঙ্গে ডিনার করতো তখন কখনো কারো অনুপস্থিতি ছিল না।এই প্রথম তাশফিকে ছাড়া তারা ডিনার করতে বসেছে। সিরাজুল ইসলাম দেখলেন তাশফির চেয়ারটা খালি। হঠাৎ তাঁর বুকটা ও যেন খালি খালি লাগছে। ছেলে তাঁর উপর অভিমান করে আছে।এখনো সে বাসার বাইরে।তিনটা মানুষ খাবার সামনে নিয়ে বসে আছে কারো খাওয়ার কথা মনে আসছে না। কয়েকদিন থেকেই সিরাজুল খেয়াল করছেন ছেলে মুখে কিছু না বললেন আচরণে অনেক কিছু প্রকাশ পাচ্ছে তার। বুঝতে পারলেন ছেলের পক্ষে নওমিকে ভোলা সম্ভব না।ওদের বিচ্ছিন্ন করে জীবন এলোমেলো করে দেয়ার চাইতে এক সাথে হয়ে নিজেরাই উপলব্ধি করুক ভুল কিংবা সঠিক সিদ্ধান্ত হয়েছে।অনেক ভেবেচিন্তে সিরাজুল আর তাবাসসুম দম্পতি ঠিক করেছেন ছেলের ইচ্ছাতেই সব হোক।এত বছর কোন ব্যপারে দুজনের এতটা সময় এতবার আলোচনা হয়নি। এখন সন্তানের বিয়ের জন্য দুজন যেন নিজেদের মনের জানালা মেলে ধরলেন।
স্বর্ণা বলল-
—আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।রুমে যাচ্ছি।
—বসো। তোমার ভাইকে বলো নওমির মামার কাছে আমরা প্রস্তাব নিয়ে যেতে চাই খুব তাড়াতাড়ি।
স্বর্ণা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল।
—কল করে এখনই বাসায় আসতে বল।আমরা খাবার টেবিলে ওর জন্য অপেক্ষা করছি এটা জানাও।
স্বর্ণা উঠে গেলো।একটু পর আবার এসে বসলো। —ভাইয়া বলল আধা ঘন্টা লাগতে পারে।
—আচ্ছা ঠিক আছে।আমরা অপেক্ষা করি তাহলে।স্বর্ণা তোমাকে একটা প্রশ্ন করি এবার, আশা করি সত্যিটাই বলবে।
—আমি কি কখনো তোমাদের কাছে মিথ্যে বলেছি?
—তোমার কি কোন পছন্দ আছে?
স্বর্ণা একেবারে যেন আকাশ থেকে পড়লো। তার আব্বুর মুখের এই কথা কখনোই মানানসই না। তাদের সম্পর্ক এতটা ফ্রেন্ডলি না যে এই ধরনের প্রশ্ন করবে আব্বু। কিভাবে উত্তরটা দিবে বুঝতে পারলো না সে।
তাবাসসুম স্বামীর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। হঠাৎ করে নিজের মেয়েকে এমন প্রশ্ন করবেন তিনিও বুঝতে পারেননি। অনেক ফ্যামিলিতে বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানদের খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকে যেটা তাদের সন্তানদের সাথে তাদের নেই। কেন নেই এটা চিন্তা করতে লাগলেন-এটা কি শুধুই তাদের ব্যস্ততার কারণেই নাকি সেই পুরনো যুগের ধ্যান ধারণা থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারেননি? যতই উচ্চশিক্ষিত বা আধুনিক হোন না কেন কিছু না কিছু বাঁধা তাদের মধ্যে রয়েই গেছে। যেটার জন্য বাবা-মা আর সন্তানদের মধ্যে একটা অদৃশ্য দূরত্ব সব সময় থাকে।
—চুপ করে আছো কেন? বলতে কোন সমস্যা আছে? আমি চাই এখন থেকে আমরা পরিবারের সবাই খোলামেলা আলোচনা করব। একটু দেরীতে হলেও এই ব্যাপারটা আমাদের মধ্যে শুরু হলো।
—না আব্বু। সেরকম কেউ নেই।
—তুমি সিউর তো?
—হু
—তাহলে শোন তোমার আপত্তি না থাকে আমার পছন্দের একটা ছেলে আছে তার সঙ্গেই তোমার বিয়ের আলোচনা করতে চাই। এর আগে তোমরা দুজন দুজনকে দেখো ভালোভাবে বোঝো। তোমার পছন্দ না হলে কথা আর সামনে যাবে না।
স্বর্ণা এই কথা শুনে ঠাস করে মাটিতে পরে গেল যেন।ভাইয়ার সমস্যা এখনো সলভ হলো না আর এখনই তার বিয়ে নিয়ে আলোচনা!
সিরাজুল, তাবাসসুমের সাথে এই নিয়ে আলোচনা করেননি তাই তাবাসসুম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। সিরাজুল চোখের ইশারায় বোঝালেন এই বিষয়ে পরে তাঁর সাথে আলোচনা করবেন।
সিরাজুল ভাবছেন তাশফির মতো যেন স্বর্ণা ভুল না করে তাই আগেই ওর বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলবেন।মেয়ের জন্য ডাক্তার ছেলেই পছন্দ করেছেন।তাশফির বেলায় যতোই মতামত দিয়ে দেন তার পর ও তো ছোট হলেও একটা দীর্ঘশ্বাস থেকেই যায়।যাই হোক ওরা যেন সুখী হয় এইটা এখন বড় চাওয়া।
বাবা-মা ভাবছেন সন্তানের ভালোর জন্য তারা সব কিছু করছেন।তাদের পছন্দ বা সিদ্ধান্ত ভুল এটা মনে করেই বাবা-মায়েরা অনেক কিছুতে অমত পোষণ করেন।নিজেদের পছন্দই সঠিক হবে সন্তানরা সুখী হবে এটাই তাঁরা ভেবে বসে থাকেন।
সন্তানরা নিজেদের পছন্দে বিয়ে করে অসুখী হলে তখন তাঁরা বলেন ,নিজের পছন্দ দেখেই এমন হয়েছে আর যদি তাঁদের পছন্দে বিয়ে করে অসুখী হয় তখন বলেন, সবই কপালের দোষ। কিন্তু তারা কি জানেন কোনটাতে ভালো আর কোনটাতে খারাপ হবে?যদি আগে থেকেই মানুষ সব কিছু বুঝতে পারতো তাহলে তো এই পৃথিবীর কারো কোন ভুল হতো না। পৃথিবী হয়ে উঠতো সুখী ও সুন্দর।
পম্পির বাবা অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগলো রজনীকে।আজ রজনী ভয়ে কুঁকড়ে থাকলো না , কাজের লোকেরা শুনতে পাবে কিংবা পম্পি শুনতে পাবে,সেইসব ভয় বা লজ্জার ঊর্ধ্বে এখন সে। সামনে এসে চিৎকার করে বললো সে-
—আপনার নোংরা গালিগালাজ এই মুহূর্তে থামান না হলে আমি ছাদ থেকে এখনই ঝাঁপ দিবো। একজন তো ধুঁকে ধুঁকে মরছে আর আমি সুইসাইড করবো। আপনার কি ধারনা আমার যাবার জায়গা নেই তাই এতদিন আমি এখানে পড়ে আছি এত অপমান আর অপদস্থ হয়ে? আমার যদি ইচ্ছে হতো অনেক আগেই আমি এখান থেকে চলে যেতে পারতাম, আপনি আমাকে কোন ভাবে আটকাতে পারতেন না। কিন্তু আমার মনে সেরকম কোনো চিন্তা কখনো আসেনি। আর লুকিয়ে লুকিয়ে কারো সাথে সম্পর্ক ? ছিঃ সেসব স্বপ্নেও ভাবি না আমি।বিশ্বাস ঘাতকতা আমি কখনোই করব না, যাওয়ার ইচ্ছে হলে আপনার চোখের সামনে দিয়েই যাবো। আপনি একজন অসুস্থ মানুষ। আপনার ধারণা নারী-পুরুষের সম্পর্ক মানেই শুধুমাত্র একটা সম্পর্ক,সেটা হলো শারীরিক। আপনার এই ধারণা নিয়েই আপনি বসে থাকেন। যে যেরকম তার মনে সে রকম ধারণা জন্ম নেয় অন্যের সম্পর্কে। অনেক ভয় করেছি, কথা বললে সমস্যা বাড়বে এই জন্য চুপ থেকেছি। কিন্তু আমার এই চুপ থাকা কে আপনি আমার দুর্বলতা ভেবে বসে আছেন।
কথা বলতে বলতে রজনী রাগে কাঁপতে লাগলো। পম্পির বাবা রজনীর এই রুপ দেখে ভয় পেয়ে গেল। তার কল্পনাতেও ছিল না রজনী এমন ভাবে প্রতিবাদ করতে জানে। ব্যাপারটা বুঝতে তার অনেকটা সময় লাগল।
মাঝরাতে চিৎকার শুনে পম্পি বুঝতে পারলো তাঁর বাবার রুম থেকে আসছে। সে উঠে আস্তে আস্তে তাদের রুমের সামনে গেল। এভাবে চলতে পারে না। চোখের সামনে এভাবে একটা মেয়ের নির্যাতন সহ্য করা যায় না। আজ তার বাবার সামনে দাঁড়াতেই হবে। দরজার কাছে যেতেই রজনীর গলা শুনতে পেলো।সে অবাক হয়ে গেলো, রজনী প্রতিবাদ করতে শিখে গেছে।সে নিজেই তার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটাই তো হওয়া উচিত, কে কাকে কতদিন রক্ষা করতে পারে? নিজেকে নিজেই রক্ষা করতে হয়।
পম্পি আবার রুমে এসে পড়ায় মন দিতে চেষ্টা করলো।
স্বর্ণার মেসেজ ভেসে উঠলো মোবাইল স্ক্রিনে।
‘জেগে আছিস?’
‘হু
‘আম্মু আব্বু চাইছেন খুব ধুমধাম করে ভাইয়ার সাথে নওমির বিয়ে দিতে। কিন্তু এখন নওমি রাজি হচ্ছে না।’
‘সেটাই তো স্বাভাবিক’
‘এসব না বলে চল আমরা নওমিকে ভালো করে বুঝাই।তুই কি ভেবেছিস এসব করে নওমি ভালো থাকবে, ভাইয়া ভালো থাকবে?’
‘না ভালো থাকবে না, দুজনের জীবনটাই এলোমেলো হয়ে যাবে।কিন্তু নওমির মনে যে অভিমান জমা হয়েছে সেটা গলতে দে আগে।’
‘কিন্তু তোর কি হয়েছে,গলা এমন শোনাচ্ছে কেন?’
‘কিছু হয়নি।’
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু