৫ম_তলার_মেয়েটা,৩৪,৩৫

0
561

#৫ম_তলার_মেয়েটা,৩৪,৩৫
ফাহমিদা_লাইজু
#পর্ব_৩৪

তাশফি যখন নওমিকে জিজ্ঞেস করলো ‘কি রং এর শাড়ি তোমার পছন্দ’ নওমি কোন উত্তর দিলো না।বিয়ের কথা বলতে থাকলে নওমি একেবারে লজ্জায় লাল হয়ে যায়। ভাগ্যিস তাশফি সামনে নেই, সামনে থাকলে দেখতে পেত নওমির গাল দুটো টমেটোর মত লাল হয়ে গেছে এখন। বিয়ের শাড়ি বলে কথা!
তাশফি বলল-
—কই বললে না তো কি রং এর শাড়ি তোমার পছন্দ?
—তোমার কি রং পছন্দ?
—কি আশ্চর্য! শাড়ি কি আমি পড়বো নাকি? তুমি পড়বে তাই তোমার পছন্দটাই আসল।
—কিন্তু আমার কাছে মনে হয় আমাকে যারা দেখবে তাদের পছন্দটাও তো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমি তো আর আমাকে দেখবো না।
—তুমি তো দেখি উল্টো কথা বলছো। সব মেয়ে চায় নিজের পছন্দের পোশাক কিনতে ।
—আমি চাই বিয়ের শাড়ি তুমি পছন্দ কর।
তাশফি এই কথা শুনে হাসলো।
—তাহলে আমার পোশাকটা তুমি পছন্দ করবে।
—না,সবাই একসাথে শপিং করার সময়, সবার সামনে আমি নির্লজ্জের মত কিছু বলতে পারব না।
—এটা কেমন কথা?তোমাকে আমি দেখবো, আমাকে কি তুমি দেখবে না?

এই সব আলোচনাতেই এখন বেশির ভাগ সময় নওমি আর তাশফির কেটে যায়।তারা এখন হাওয়ায় ভাসছে।তাদের চোখে শুধুই রঙিন স্বপ্নের আনাগোনা।

আজ দাদু খবর পাঠালেন দোতলায় যেতে।

দাদু বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুষ্টুমি করতে লাগলেন নওমির সাথে।আসল কথা হলো নওমিকে তিনি গয়না কিনে দিতে চান তাঁর নিজের টাকায়।আর নওমিকে সাথে নিয়ে গিয়ে নওমির পছন্দই কিনতে চান গহনা। নাওনি তার স্বভাব মতোই বললো তার কিছুই লাগবেনা। বেশি বেশি করে শুধু যেন তার জন্য দোয়া করেন।দাদু বললেন, এইটাই তাঁর দোয়া,নওমি মানা করলে তিনি কষ্ট পাবেন। ঠিক হলো বিকেলে বের হবে দাদুর সাথে।

দাদুর সাথে কথা বলতে বলতে তোফাজ্জল হোসেন বাসায় চলে এলেন।দাদু তাকে ডেকে নওমির কাছে বসালেন। তিনি নামাজ পড়তে উঠে গেলেন।
তোফাজ্জলকে দেখলে ইচ্ছে করে বাবা ডাকতে, তাঁকে জড়িয়ে ধরতে। ইচ্ছে করে ছোট বাচ্চাকে যেভাবে বাবারা আদর করে সে রকম আদর পেতে। কিন্তু সেই সব ইচ্ছা তার ভেতরেই গুমরে মরে।
তোফাজ্জল,নওমির সাথে কথা বলতে গেলে যেন কথা খুঁজে পান না।দুই একটা কথার পরে তাই বসেই রইলেন চুপ করে।
কিন্তু কথা না বললেও ভাবনারা তো বিচরণ করতেই থাকে।

নওমির মা নিরা একটা সাধারণ গ্রাম্য মেয়ে হয়েও কিভাবে তার মনে বসে গিয়েছিলো ভাবলে অবাক লাগে।এর আসল কারণ ছিল নিরার সারল্য আর নিঃস্বার্থ মনোভাব।তিনি ভেবেছিলেন সেই রাতের ঘটনায় নিরা ভেবেছে তার সাথে তোফাজ্জল অন্যায় করেছেন এই জন্যই ও চলে গেছে।এই জন্য তাঁর মনে একটা গ্লানি বয়ে বেরিয়েছেন সব সময়। কিন্তু ভুল ভেঙ্গে ছিল নওমির খবর জানার পরে। নিরা কে ভুলতে তাঁর অনেক সময় লেগেছিল,আসলে ভুলতে কি পেরেছিলেন?
মাঝে মাঝে মনে হতো হাজেরার সাথে তিনি অন্যায় করেছেন। কিন্তু নিয়তির কাছে সবাই বড় অসহায়।

তোফাজ্জল ভাবতে লাগলেন –
‘হাজেরা কি আমাকে ক্ষমা করবে?ও কিছুতেই আসবে না।ওর সামনে দাঁড়াবো কোন মুখে?তবে আমাকে তো যেতেই হবে ওর কাছে। ক্ষমা চাইতে হবে।অনেক দিনের অভ্যাসও হয়তো এক সময় ভালোবাসায় রুপ নেয়।

তোফাজ্জল তাকিয়ে রইলেন নওমির দিকে।নওমি তার নিজের মেয়ে,ভাবলে অবাক লাগে।এটাও এক আশ্চর্য বিষয় ও হয়েছে তাঁর নিজের দাদির মতো। তোফাজ্জলের দাদির চেহারা তাঁর সম্পূর্ণ মনে নেই, শুধু একটা আবছা স্মৃতি আছে।
তাঁর মা জালেরা বেগম বলেন এই কথা। তাঁর ভাই,বোন কারো সন্তান দাদির মতো হলো না,বেছে বেছে নওমিই বা কেন এমন হবে? সৃষ্টির রহস্য বোঝা ভার!

তবে নওমি তাঁকে কখনো বাবা বলে সম্বোধন করে না। মেয়েটার এত আত্মসম্মানবোধ তিনি খুব অবাক হয়েছিলেন এই বিষয়টাতেও। জালেরা বেগম বলেছেন ঠিক এমন স্বভাবেরই ছিলেন তোফাজ্জলের দাদি।
নওমি বাবা বলে না এই ব্যপারটা তোফাজ্জলকে কষ্ট দেয় না,এটা তিনি আশাও করেন না। শুধু মনে একটু খচখচ করে।

জালেরা বেগম ঢুকতে ঢুকতে বলতে লাগলেন-
—বাপ-মেয়ের কি কথা শেষ হইছে?কথা শেষ হইলে টেবিলে আস,খাইতে খাইতে কথা কই।
নওমির একটুও খেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু এখন খেতে মানা করা তার পক্ষে সম্ভব না।দাদু এত আদর মাখা কন্ঠে বলেন যে কোন ভাবেই এই ভালোবাসা অগ্রাহ্য করা সম্ভব না। নওমি যে ভালোবাসার বড় কাঙাল। বাবা,দাদু সবার ভালোবাসা সে পেতে চায়।

জালেরা বেগম তীক্ষ্ণ চোখে দেখলেন কাজের লোক কাছে আছে কিনা। তাদের আগেই বলা হয়েছে, কান পেতে কথা শুনতে যেন আশপাশে না থাকে কেউ।ওদের মাধ্যমেই এখান থেকে ওখানে কথা উড়াউড়ি করে।
জালেরা বেগম নওমির বিয়ের প্রসঙ্গ তুললেন আবার। যদি সম্ভব হয় গয়না কেনার সময় তাশফি যেন থাকে।
নওমি বলল,তাশফিকে সে বলে দেখবে।

নওমির মামার বাড়িতে গিয়েছিল তাশফির বাবা-মা। মোটামুটি একটা তারিখ ঠিক ঠাক হয়েছে। নওমির মামা তাশফির বাবাকে বলেছিলেন তোফাজ্জল একটু কথা বলতে চায়। কিন্তু তাশফির বাবা এখনো দেখা করার তারিখ বা সময় জানাননি।এতে অবশ্য নওমি মনে মনে একটু রাগ হয়েছে,কেন তোফাজ্জল নিজেই কথা বলতে চাইলেন তাশফির বাবার সাথে,কি দরকার ছিল?

সময়ের সাথে সাথে দুঃখ কষ্ট গুলো হালকা হয়ে যায়,এক সময় আর অতটা ভারী মনে হয় না কষ্টগুলোকে। মানুষ কখনো ইচ্ছে করে কখনো বা অজান্তেই ভুলে যায় কষ্ট আর তখন হাতড়ে হাতড়ে সুখের স্মৃতিগুলো মনে করে সুখানুভূতি অনুভব করে, পুলকিত হয় ,সেগুলোর কাছে ফিরে ফিরে যেতে চায়।
হাজেরার মনে সেই গভীর দুঃখ অনেকটা কমে গেছে।এখন দুঃখটা অভিমানে রুপ নিয়েছে। ছেলেরা বলেছিলো তাদের কাছে চলে যেতে, কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত যেতে পারেননি।মন সায় দেয়নি। তোফাজ্জল একবারই ফোন দিয়েছিলেন।তখন রাগের স্ফুলিঙ্গ উড়ছিল হাজেরার মনে, কি থেকে কি বলেছেন? ওই সময়ের জন্য সেই সব হয়তো ঠিকই ছিল কিন্তু এখন তার মনে হয় একবার তো আসতে পারতো কথা বলতে পারতো? তার এত বড় একটা অপারেশন হয়েছে মানুষ তো দেখতেও আসে।হাজেরা জানতেন না যে, তোফাজ্জল হসপিটালে গিয়েছিলেন তাকে দেখতে, হাজেরার ভাই হাফিজ দেখা করতে দেয়নি।হাফিজ এখনও হাজেরাকে প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার জন্য। এতে অবশ্য তার একটা স্বার্থও আছে। দেশের বাইরে স্যাটেল হলে হাজেরা হয়তো বাবার সম্পত্তি আর চাইবে না। হাফিজ নিজেও প্রচুর সম্পত্তির মালিক তারপরও তার আরো চাই আর চাই। হাজেরা এতদিন ভাইয়ের বাসায় থেকে বুঝতে পারছেন মোটামুটি সবকিছুই। এখানে তিনি খুবই একা। সবাই যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তাঁকে সবাই এই পরিবারের মেহমান হিসেবে ভাবছে। নিজের নামে এত টাকা পয়সা থাকলেও এখানে তার কোন দাম নেই। একটা নিঃসঙ্গতা ঘিরে আছে সব সময় তাঁকে। কোন কিছুতে যেন মন বসেনা। এতদিন পরে হিসেব-নিকেশ করতে বসেছেন নিজের জীবনের। তোফাজ্জল কেন অন্য নারীতে আসক্ত হলো এটা কি তার দোষ? সন্তান জন্মের পর সংসার সন্তান নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন আলাদা করে স্বামীকে কখনো বুঝতেই চাননি। প্রথম থেকে কোন ব্যাপারেই তাদের মতের মিল ছিল না। কোন কিছু পছন্দ না হলে কিংবা তার মন মতো না হলে তোফাজ্জলের উপরে খুবই রাগারাগি করতেন। একটা সময় সবকিছুর ভার তার ওপর দিয়ে তোফাজ্জল যেন পালিয়ে বাঁচলেন সংসারের দায় থেকে। প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া তাদের মধ্যে কথা হতো না। তবে যত যাই কিছু হোক দিন শেষে সমাজ-সংসারের কাছে তারাই তো তাদের সন্তানের বাবা-মা। ভালোবাসা কাকে বলে তিনি কখনো বোঝেননি । বাবা মা বিয়ে দিয়েছে সংসার করতে হয় তাই করেছেন আলাদা করে কোন কিছু ভাবার অবকাশই ছিল না কিংবা জানতেনই না। এই অবস্থার জন্য হাজেরা কাউকে দোষ দিচ্ছেন না সবকিছুই নিয়তি বলে মেনে নিয়েছেন।

হঠাৎ নিজের রুমে তোফাজ্জলকে ঢুকতে দেখে হাজেরা অবাক হয়ে গেলেন। ড্রইংরুমে না বসে সরাসরি তাঁর রুমে চলে এসেছেন এতে অবাক হওয়ারই কথা।এত বছরের মধ্যে কখনো এমন হয়নি । কেউ তাকে কেন জানালো না?

তোফাজ্জল যেন হাজেরার মনের কথা বুঝে ফেললেন-
—আসলে আমি মানা করেছি তোমাকে খবর দিতে। এখানে বস। আমি তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই।
—আমার সঙ্গে আবার কি কথা?

হাজেরার অভিমান যেন উপচে পড়ছিল। কিছুতেই তিনি ধরা দেবেন না। আগে মন থেকে তোফাজ্জলকে ক্ষমা চাইতে হবে, সব কিছুর জন্য।

—আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। তোমাকে ছাড়া তোমার বাসা শূন্য পড়ে আছে। আম্মাও চলে যেতে চাইছেন গ্রামের বাড়িতে। বাড়িতে ঢুকলে মনে হয় প্রাণহীন একটা বাড়ি।
—আমাকে কি দরকার ওই বাড়িতে? ওইটা তোমার বাড়ি। আমি তোমার কে?

আচমকাই তোফাজ্জল, গভীর মমতায় হাজেরার হাত ধরে আরো কাছে নিয়ে এলেন।
—তুমি আমার স্ত্রী, আমার সন্তানদের মা।
—সন্তানদের মা!নওমিও তো তোমার সন্তান।ওকে নিয়েই থাক।
—নওমি আমার সন্তান এই কথা তো আমি অস্বীকার করছি না।সব কিছু জানার পরই তোমাকে জানানোর দরকার ছিল।আমি তোমার কাছে লুকিয়েছি, আমাকে ক্ষমা কর হাজেরা।
আমি মন থেকে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।
—আমার হাত ছাড়।আমাকে তো তুমি ভালোবাসা না,তাহলে কেন আমাকে নিতে আসলে?
—তুমিও কি আমাকে ভালবেসেছ?
—সংসারের দরকার সংসার করেছি,আলাদা করে তোমাকে ভালোবাসা দরকার কিংবা বলা দরকার সেই সব তো বুঝিনি।তুমিও তো কখনো কিছু বলনি।
—কিছু বললেই তুমি রাগ হয়ে যেতে।আমাকে কখনো বুঝার চেষ্টাই করনি।আমাকে আলাদা সময় দেয়া দরকার। দুজনের একান্ত কিছু সময় কাটানো দরকার সেই সব বুঝনি কখনো। সন্তানদের দেখাশোনা করবে ঠিক আছে আমিও তো কিছুটা হলেও দেখাশোনা করেছি। কিন্তু জীবনের যৌবনকালকে হেলায় নষ্ট করে দিলে সেই সময় কি আর ফিরে আসে। স্বামী-স্ত্রী যদি দুজন দুজনকে একান্তভাবে কাছে না পায় আস্তে আস্তে দূরত্ব তৈরি হয়।আমি শুধু শারীরিক সম্পর্কের কথাই বলছি না। সারাদিন শেষে বাসায় ফিরে চাইতাম,সব কিছু তোমাকে বলতে।তুমি কাজের কথা বলে চলে যেতে।হয়তো কখনো বিকেলে একসাথে বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে গল্প করা, একটু ঘুরতে যাওয়া,একটু ছাদে হাঁটা , কোন কিছুর জন্যই তোমার সময় হয়নি।
এতদিন পর আর এই সব নিয়ে কথা বাড়াতে চাই না।
আমাকে ক্ষমা কর,চল তোমার বাড়িতে।আমরা আবার নতুন করে শুরু করবো আমাদের অধ্যায়।

চলবে…

#ফাহমিদা_লাইজু

#৫ম_তলার_মেয়েটা

#পর্ব_৩৫

রজনীর পা থমকে গেল।পম্পির বাবার সাথে সিরাতকে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে রজনীর জ্ঞান হারিয়ে ফেলার উপক্রম হলো।এ যেন কোন ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন। স্বপ্ন আর বাস্তবতার পার্থক্য বুঝে ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় লাগলো। কিন্তু তার হাত-পা কেমন অবশ অবশ লাগছে।তাকে দেখেই পম্পির বাবা বললেন-
—এসো এসো তোমার ফ্রেন্ড এসেছে। এখানে এসে বসো।

রজনী রান্না করছিলো। একটু আগে সাহায্যকারী মেয়েটা এসে বলেছিলো,’স্যার আপনারে ডাকতেছে ড্রয়িং রুমে।’
বেশ কিছুদিন থেকে রজনী ঠিকমতো কথা বলে না পম্পির বাবার সাথে তিনিও খুব একটা ঘাটান না।

রজনী কিছুই বুঝতে পারছে না।এখানে তো সিরাতের কোন ভাবেই আসার কথা না।আর পম্পির বাবা এত বিনয়ের সাথে কথা বলছে কারণ কি? নিশ্চয়ই তার মনে কোন দুরভিসন্ধি আছে।
সিরাত , রজনীর দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলো ও তাকে এখানে আসতে বলেনি। বরং সিরাতকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে রজনী।তাহলে কি রজনীর স্বামী মিথ্যা বলে এখানে এনেছে তাকে?
কিন্তু কেন?

রজনী বসলো।
রজনীকে, পম্পির বাবা বললেন-
—তোমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য উনাকে খবর দিয়ে এনেছি, তোমার আর কোন বন্ধুকে তো আমি চিনি না।আজ তোমার বার্থডে আমরা একসঙ্গে সেলিব্রেট করবো।

আজ রজনীর বার্থডে এই কথা জেনে সে নিজেই অবাক!!সে মনে করার চেষ্টা করলো আজ কত তারিখ। ইদানিং বার,তারিখ, সময়ের খেয়াল থাকে না।আসলে এই সব খেয়াল রাখার তেমন প্রয়োজন ও পরে না।তার জন্মদিন?
কোন দিন এই দিনটা উদযাপন করা হয়নি তার জীবনে।আর আজ এই সব করে পম্পির বাবা কি প্রমাণ করতে চাইছে ? তিনি রজনীকে খুব ভালোবাসেন? ভালোবাসা কখনো প্রমাণ করতে হয়?

সিরাতের খুব অস্বস্তি লাগছে।ফোন করে এই বাসার ঠিকানা দিয়ে তাকে যখন বলা হলো রজনী আসতে বলেছে, সে বোকার মতো চলে এসেছে। একবারও ভাবেনি রজনী কেন তাকে আসতে বলবে হঠাৎ, তাও আবার বাসায়? নিজের উপরেই নিজের এখন খুব রাগ হচ্ছে আস্ত হাঁদারাম একটা সে। রজনী কখনো তাকে বলেনি ভালোবাসে,তার আচরণেও কখনো প্রকাশ পায়নি।সে নিজেও তো কখনো রজনী কে প্রপোজ করেনি,তাহলে আজ রজনী আসতে বলেছে এই কথা শুনে, সাত পাঁচ না ভেবে কিভাবে সে চলে এলো?তবে এটা তো সত্যি সে রজনীকে ভালোবাসে সেই কলেজ লাইফ থেকেই।কখনো মুখ ফুটে বলা হয়নি।সে বুঝতে পারছে রজনী এখানে ভালো নেই। রজনী যদি এখনো সব ছেড়ে তাকে আপন করে নেয় তাহলে তাকে নিয়ে সুন্দর একটা সংসার সাজাবে। কিন্তু আজ মনে হয় সে রজনীর স্বামীর ফাঁদে পড়েছে।

এতক্ষণে রজনী নিজেকে সামলে নিয়েছে। ভেতরের সুপ্ত আগুনটা জ্বলে উঠেছে।আজ একটা সিদ্ধান্তে আসতেই হবে তাকে।

পম্পির বাবার দিকে তাকিয়ে রজনী বলল, ‘আপনার সাথে একটা জরুরী কথা আছে একটু ভেতরে চলেন।’
পম্পির বাবা তাকিয়ে রজনীকে বোঝার চেষ্টা করলেন। রজনীর চোখ মুখ শক্ত দেখে কোন প্রতিউত্তর না করে উঠে গেলেন।

রজনী,সিরাতকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি একটু বসো আমরা আসছি।চা,কফি কিছু খাবে?’

সিরাত কোনমতে দুই দিকে মাথা নাড়ালো শুধু।

রুমে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল রজনী। তার চোখ থেকে যেন আগুন বের হচ্ছিল।
—আপনি কি চাইছেন আমাকে সরাসরি বলুন। এত নাটক আর তামাশার কি দরকার?
—আমি শুধু চাইছি তুমি সুখী হও। তোমার প্রেমিক কে বিয়ে করে সুখী হও। আমি তোমাকে মুক্ত করে দেবো।
—কি আমার প্রেমিক? সিরাত আমার প্রেমিক?

রাজনী হাসতে লাগল। যেন সে জীবনে এমন হাসির কথা আর শুনেনি।

আপনি যে সিনেমা আর সিরিয়াল দেখেন আমারতো জানা ছিল না। তা না হলে এমন বুদ্ধি আপনার মাথায় কোত্থেকে এলো? অবশ্য আপনার মাথায় স্বাভাবিক বুদ্ধি তো আর নেই। নিজেকে অতি চালাক ভাবা মানুষগুলোই হয় সবচেয়ে বোকা।সিরাত আমার প্রেমিক না, কোনদিন ছিলোও না।

আমি আপনাকে কেন এই সব বলছি? আমি কিছু বললে আপনি তো আর বিশ্বাস করবেন না, তাহলে বলে শুধু শুধু লাভ কি? আপনি যে আপনার কল্পনার রাজ্যে বিরাজ করেন সেটাই আপনার কাছে সত্য। মানুষের কথা আপনার কাছে বিশ্বাসযোগ্য না।আপনি আমার সাথে ভালো ব্যবহার টুকু যদি শুধু করতেন,দেখতেন আমি আপনাকে কোথায় বসিয়ে রাখতাম।
থাক এইসব কথা। এবার বলুন আপনার প্ল্যান কি? সিরাতকে কেন এনেছেন?
—বললামই তো।
—আচ্ছা ঠিক আছে। তবে আমাকে ফিরিয়ে দিতে হবে, আমার জীবনের সেই সময়গুলো যা আপনার জন্য আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। সেই প্রতিটা মুহূর্ত যখন আমি নিজেকে মুক্ত পাখির মতো ভাবতাম। যেই জীবনে আমার অপমান, অপদস্থ দুঃখ-কষ্ট আর আতঙ্ক ছিল না।
আমার সেই জীবন আমি ফেরত চাই।

এই বলতে বলতে রজনী কান্নায় ভেঙে পড়ল।
পম্পির বাবা কখনো রজনীকে কাঁদতে দেখেননি। এই মেয়েকে কাঁদলেও এমন অদ্ভুত সুন্দর দেখা যায় সেটা তো জানা ছিল না!একটা মানুষ কাঁদছে আর তিনি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছেন,কি অদ্ভুত ব্যপার। তাঁর হাঁটুর বয়সী এই মেয়েটাকে প্রথমদিন দেখেই এত ভালো লেগেছিলো যে তিনি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন।প্রথম যৌবনে প্রেমে পড়ার মতো অনুভূতি হয়েছিল। রজনীকে পেতে, পারিপার্শ্বিক অবস্থা এমনতাবে তৈরি করেছিলেন, যেন রজনীর আর কোন উপায় না থাকে তাঁকে বিয়ে করা ছাড়া। তিনি সফল হয়েছেন কিন্তু কখনো রজনীর মনের ধারে কাছেও পৌঁছাতে পারেননি। বিছানায় সে পড়ে থাকে মরা গাছের মতো। তাঁর নিজের বয়সের কথা ভুলে গিয়ে কিভাবে উম্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি?
সব সময় ভয়ে থাকেন এই বুঝি রজনী তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এই ভয় থেকেই খারাপ ব্যবহার করে বসেন।এই জন্য পরে অনুতাপ হয় কিন্তু নিজের অহমের কাছে নতি স্বীকার করেন না।পম্পির মাকেও অনেক কষ্ট দিয়েছেন,এখন মনে হলে খুব খারাপ লাগে।সে মরে যাওয়ার পর ভেবেছিলেন আর বিয়ে করবেন না কিন্তু রজনী কে দেখার পর সেই সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেননি।এই জন্য ছেলে মেয়েরাও দূরে সরে গেলো।

আজ সিরাতকে ডেকে আনাটা ভূল হয়ে গেল। তিনি ভেবেছিলেন শুধু এতটুকু বোঝার চেষ্টা করবেন দুজনের সম্পর্কটা কতটা গভীর। রজনী চাইলে তাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবেন। রজনী সুখী হোক।

কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি রজনীর মতিগতি বুঝতে পারছেন না।

তিনি মাথা নিচু করে বসে রইলেন।

পম্পি বাইরে থেকে এসে সিরাতকে সোফায় বসা দেখে অবাক হলো। সে বসে টুকটাক কথা বলতে লাগলো। বুঝতে পারল রজনী কোন কঠিন সমস্যায় পড়েছে। তার খুব চিন্তা হতে লাগলো। প্রথমে সে ভেবেছিল সিরাত নিজে থেকেই এসেছে,যেটার ফলস্বরূপ রজনীর জন্য কঠিন শাস্তি বরাদ্দ ছিল কিন্তু যখন জানল তার বাবা রজনীর কথা বলে সিরাতকে ডেকে এনেছে তখন আরো বেশি চিন্তা হতে লাগলো। তার বাবার সঠিক মনোভাবটা বুঝতে পারল না তবে নিশ্চয়ই কোন প্ল্যান আছে।

একবার ভাবলো দাঁড়াবে নাকি আব্বুর সামনে? তখনই দেখলো ছোট একটা লাগেজ নিয়ে রজনী আসছে। পেছনে তার বাবা নেই।

পম্পি আর সিরাত দুজনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।রজনী ,পম্পির গালে হাত বুলিয়ে দিলো, কিছুই বলতে পারলো না,তার গলায় কান্না দলা পেকে আছে।
রজনী বেরিয়ে গেলো দরজা দিয়ে। হতভম্ব সিরাত কি করবে বুঝতে না পেরে সেও বের হলো।

পম্পি একদম গাছের মতো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। মুখে যতোই বলুক রজনীকে চলে যেতে সুন্দর জীবন গড়তে কিন্তু এখন খুব কষ্ট হচ্ছে তার জন্য।মনে হচ্ছে বুকটা একেবারে খালি হয়ে গেছে।আম্মুর মৃত্যুর পর কি এক কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে।সেই সব সামলে উঠেছিলো ।প্রথমে রজনী কে সহ্য করতে না পারলেও আস্তে আস্তে রজনী হয়ে উঠেছিল তার হৃদয়ের একজন কাজের মানুষ।এই সম্পর্কের কোন সুনির্দিষ্ট নাম নেই,পায়ে পায়ে এক সাথে পথ চলা।যে সম্পর্কে মায়া, ভালোবাসা, শাসন, বন্ধুত্ব সবই ছিল।এখন তার মনে হচ্ছে সে যেন একেবারে শূন্য হয়ে গেছে।

স্বর্ণা কল দিয়ে বলল ওদের সাথে তাশফি আর নওমির বিয়ের শপিং এ যেতে। সঙ্গে যেন রজনীকেও নিয়ে যায়। উত্তরে পম্পি শুধু হু বলেছে।
এই দুই দিন কিভাবে কেটেছে পম্পির, তা সে নিজেই জানে না। রজনী চলে যাওয়ার পর থেকেই ঘরবন্দি।তার খাবার ঘরেই দিয়ে যেতে বলেছে।
পম্পি ভাবলো রজনীকে কল করা উচিত।সে এই বাসায় না থাকুক ,তার সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক তো রাখাই যাবে। নিজেকে নিয়েই বোঝালো, এতটা কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই সে তো বেঁচে আছে।সেও তো চাইতো রজনী ভালো থাকুক।

রজনীর নাম্বারে কল করে দেখলো নাম্বার বন্ধ। ফেসবুক ডিএক্টিভেট করা।ব্যপারটা ঘোলাটে লাগছে।সব কিছু বন্ধ করে দিতে হবে কেন?নাকি সিরাত বলেছে?তার খুব অস্থির লাগছে।আরো আগেই রজনীর খবর নেয়া দরকার ছিলো।হয়তো সব বন্ধ করে আছে তার আব্বুর ভয়েই।

নওমির গাল দুটো লাল হয়ে আছে।তাশফির আম্মু,স্বর্ণা, পম্পি ,তাশফি আর পম্পি এসেছে। কিন্তু প্রথম থেকেই নওমি স্বাভাবিক হতে পারছে না। তাবাসসুমের নিজের বিয়ের শাড়ি ও মিরপুরের বেনারসী পল্লীর এই শোরুম থেকেই কেনা হয়েছিল।অনেক আগের নামকরা দোকান এটি। গুণগতমান,ব্যবহার সব কিছু দিয়ে গৌরবের সাথেই টিকে আছে এখনো। পছন্দ হয়ে গেলে তো কথাই নেই, পছন্দ না হলে নিজেদের পছন্দ মতো অর্ডার করা যাবে।নওমির এই সবে খুব একটা মন ছিল না,ওরাই পছন্দ করুক।সে আছে একটা ভালোলাগা ঘোরের মধ্যে। তাবাসসুম নওমিকে কাছে এনে বসিয়ে দেখাতে লাগলেন। নওমি তাকালো তাশফির দিকে এক পলক। তাবাসসুমের সেটা নজর এড়ালো না। বুঝতে পারলেন নওমি কি চাইছে।এবার তিনি ছেলেকেই বললেন পছন্দ করতে।তাশফির ইচ্ছে এই পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর শাড়িটা বিয়ের দিন নওমি পড়ুক। দোকানের সব তো দেখা হলোই।নেট ঘেঁটে তাদের সব কালেকশনও দেখা হলো। অবশেষে যেটা পছন্দ হলো সেটা তাদের কাছে এই মুহূর্তে নেই। কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।যাক শেষ পর্যন্ত পছন্দ তো হলো বিয়ের শাড়ি!!
স্বর্ণা বলল-
—যাক বাঁচা গেল,শেষ পর্যন্ত পছন্দ হলো।আমি অবাক হচ্ছি ভাইয়ার ধৈর্য্য দেখে।বাব্বা জীবনে কোন দিন শুনিনি ছেলেদের এতটা খুঁতখুঁত করতে শপিং এর সময়।আমিই অধৈর্য্য হয়ে গেছি।
আম্মু, আমি আর পম্পি একটু সামনে থেকে হেঁটে আসি,তোমরা বাকিগুলো দেখতে থাক।
—তোমার আবার কি কাজ?
—একটু দম নিয়ে আসি। পম্পি চল।

রাস্তায় বের হতেই সিরাতকে হেঁটে যেতে দেখলো পম্পি।বুঝে উঠার আগেই অনেকটা এগিয়ে গেল সিরাতে। পম্পি গলা ছেড়ে ডাকলো তাকে।শুনতে পায়নি মনে করে নিজেই এগিয়ে গেলো দ্রুত।
হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল-
—রজনী খালামনি কেমন আছে?
সিরাত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
পম্পি আবার একই প্রশ্ন করলো-
এবার সিরাত বলল-
—রজনী কেমন আছে, আমি কি করে জানবো?

চলবে…

#ফাহমিদা_লাইজু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here