৫ম_তলার_মেয়েটা,৪০,৪১

0
788

#৫ম_তলার_মেয়েটা,৪০,৪১
ফাহমিদা_লাইজু
#পর্ব_৪০

রজনীর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে।চোখের পানি ফেলার মতো কি হয়েছে সে নিজেই বুঝতে পারছে না।চোখের পানি, এই এক বেয়াড়া জিনিস
বাঁধা মানতে চায় না,কারনেও পড়ে কারনেও পড়ে।মুখে হাত চেপে আওয়াজ বন্ধ করতে পারলেও শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে।

শুকনো, রুক্ষ ,খসখসে একটা হাত রজনীর মাথায় ,গালে বুলিয়ে দিতে লাগলো। এই রুক্ষ হাতেই ভালোবাসার মোলায়েম পরশ,মনকে মুহূর্তেই শীতল করে দেয়। আরো কাছে সরে এলেন নানি, রজনীর একেবারে গা ঘেঁষে,এত কাছে যে রজনীর বুকের ভেতরে যে হাতুড়ি পেটা হচ্ছে সেটাও শুনতে পাচ্ছেন।নানি, রজনীকে কাঁদতে মানা করলেন না,একটা কথাও বললেন না, শুধু গভীর মমতায় হাত বুলাতে লাগলেন।

নানি আর রজনী নিচে বিছানা করে শুয়েছে। পম্পি চৌকির উপরে। পম্পিও নিচে ঘুমাতে চেয়েছিল রজনীর সাথে,নানিকে চৌকিতে শোয়ার জন্য বলেছিল। তার নিজের কাছে খারাপ লাগছিলো বয়ষ্ক মানুষটা নিচে শোবেন। কিন্তু নানি রাজি হননি। তিনি বললেন-
—মেমানরে কেমনে মাডিত থাকবার দেই। এইডা অইতেই পারে না।

পম্পির প্রথমে খুব অদ্ভুত লাগছিলো। কোন দিন এমন বাড়ি এমন বিছানায় ঘুমায়নি সে।রাত বাড়তে থাকলে বিভিন্ন রকম প্রকৃতির শব্দ কানে আসতে লাগলো। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল প্রথমে। একসময় ক্লান্ত শরীরের কাছে সবকিছু হার মানলো। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল পম্পি।

অন্য ঘরটাতে থাকতে দেয়া হয়েছে পম্পির বাবাকে। কিছুতেই ঘুম আসছে না।তার উপর একটু পর পর প্রাকৃতিক কর্ম সারতে বাইরে বের হতে হচ্ছে।ঘর থেকে একটু দূরে টয়লেট নামক যে জায়গাটা আছে সেখানে গেলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।হ্যারিকেন নিয়ে একটা খুঁটিতে ঝুলিয়ে রাখতে হয়। বহুমূত্র রোগ হয়ে গেল কিনা চিন্তা করতে লাগলেন। ঢাকায় গিয়েই আবার সবকিছু টেস্ট করতে হবে। শিয়াল ডাকছে, কুকুর ডাকছে, জোনাক পোকার ঝিঁ ঝিঁ , বিভিন্ন পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দে চোখের পাতা এক করা যাচ্ছে না। একটা খসখস শব্দ হতে লাগলো, মনে হচ্ছে কেউ ভোঁতা দা দিয়ে কিছু ঘষে ঘষে কাটছে। পম্পির বাবার ভয় করতে লাগলো, এমন জায়গায় ঘরে ঢুকে কেউ জবাই করে ফেললেও টের পাবেনা কেউ। সাহায্য করার জন্য আসতে আসতেই সব কিছু শেষ। ইনফর্মাল আর ড্রাইভার গাড়িতেই ঘুমাবে। যেকোনো একজনকে এখানে রাখলে ভালো হতো।
অদ্ভুত সব চিন্তা-ভাবনা। কে, কেনই বা তাকে খুন করতে যাবে? মৃত্যুর এত ভয়! পম্পির বাবা নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দিলেন। মৃত্যুকে ভয় পেয়ে কেউতো আর তাকে ঠেকাতে পারবে না, যখন আসবে তাকে আলিঙ্গন করতেই হবে। রজনীর মনোভাব তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি বার বার মনে করেন কোন খারাপ চিন্তা মনে ঠাঁই দেবেন না, রজনীকে আর দুঃখ দেবেন না কিন্তু কিভাবে যেন তার অবচেতন মনে এসব ঘটে যায়!
আফসোস সারাজীবন কি নিজের মনের সাথে নিজের আফসোস করে চলে যাবে। এই আফসোসটা যদি কাউকে দেখাতে পারতেন তবুও ভালো ছিল কিন্তু এসব কিছুই তিনি অন্য কাউকে বোঝতে দিতে চান না। তিনি মনে করেন তার ভুল হয়েছে এই কথা কেউ বুঝতে পারলে তার আর দাম থাকবে না, তিনি ছোট হয়ে যাবেন।

আফসোস, যদি পম্পির বাবা বুঝতে পারতেন নিজের দোষ বা ভুল স্বীকার করলে কেউ ছোট হয়ে যায় না বরং অন্যের চোখে সে আরো বড় অবস্থানে চলে যায়।

আর এক জনের চোখেও ঘুম আসছিল না। সেটা হল জমিরের বউ খুশির চোখে। সে বারবার ভাবছিল পম্পির কথা, রজনীর কথা। পম্পি তাকে দেখেই মুখটা কেমন গোমরা করে ফেলেছিল। কেন তাকে দেখে মুখ গোমরা হয়েছিল সে কি দেখতে এতটাই খারাপ? এখনো মন খারাপ লাগছে এটা ভেবে। রজনীর বয়স কত কম, তার বিয়ে হয়েছে একটা বুড়া লোকের সাথে, ওই লোকের কত বড় একটা মেয়ে আছে! এমন একটা লোকের সাথে কেন বিয়ে হল রজনীর। শিক্ষিত, সুন্দর,ভালো ঘরের মেয়ের এমন বয়ষ্ক লোকের সাথে বিয়ে হয়?মনে হয় টাকা দেখেই হয়েছে। কিশোরী বৌয়ের এর চাইতে বোঝার ক্ষমতাই ছিল না।পাশে শুয়ে থাকা জামিলের তাকে পেঁচিয়ে থাকা হাতটা আস্তে আস্তে আলগা করে সরিয়ে দিলো।মাঝে মাঝে দম বন্ধ লাগে এই সব কিছু ।তার জীবন নিয়ে সে সুখি,জমির খুব ভালো, তার খুব যত্ন নেয়। শাশুড়ি আদর শাসন দুইই করে। কোনভাবেই বলা যায় না সে তার জীবন নিয়ে অসুখি কিন্তু তবুও মাঝে মাঝে দূর কোন অজানায় হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।কেন এমন হয় নিজেও জানে না।
রজনীকে দেখে প্রথমদিন সে ভেবেছে ,বিয়ে হয়নি।পরে জানার পর অবাক হয়েছে,স্বামীকে ছাড়া একা কিভাবে বেড়াতে চলে এলো।শহরের লোক যা ইচ্ছা তাই করতে পারে!

মানুষের নিজের অবস্থান থেকে চিন্তা ভাবনা কতটা আলাদা!!অন্যের অবস্থা আরেকজন চিন্তা করলে সেটা বিপরীত মুখী ও হয়ে যেতে পারে। কিছু মন্তব্য করলে বা মনে মনে চিন্তা করলে তাই
নিজের হিসাবেই যুক্তি দাঁড়ায়,সেটা ঠিক হোক বা বেঠিক।

খুশি যখন থেকে বুঝতে শিখেছে, পরিবারের লোকদের দেখেছে কবে বিয়ে দিবে সেই চিন্তায় অস্থির। শুধু খুশির না,গ্রামের বেশির ভাগ মানুষের এই একই চিন্তা মেয়েদের নিয়ে। সরকার পড়ার এত সুযোগ-সুবিধা করেও বাল্য বিয়ে ঠেকানো যাচ্ছে না। মেয়েরা একটু বড় হলেই শুরু হয় বখাটেদের উৎপাত।হাইস্কুলে যেতে হলে অন্য গ্রামে যেতে হয়। তাই বেশির ভাগ মেয়েদের পড়া প্রাইমারি স্কুলেই ইতি ঘটে।তাদের ঘরের কাজ শেখানো হয় নিপুণ ভাবে।ছোট বেলা থেকেই মেয়েদের একমাত্র স্বপ্ন বিয়ে আর সংসারের কাজ মাথার ভেতরে এমন ভাবে সেট করে দেয়া হয় যে এর থেকে কখনো আর তারা বের হতে পারে না।যাদের বাবাদের অবস্থান সমাজে একটু উপরে তাঁরা চান মেয়েদের এগিয়ে নিতে আর একটু।তবে তাতেও অনেক বাঁধা বিপত্তি চলে আসে।

গ্রামের অনেকেই রজনীর স্বামীর বয়স নিয়ে আলোচনা করেছে।তারাই আলোচনা করেছে আবার তারাই পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি দিয়েছে।

সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর পম্পির বাবা সব সময় মসলা চা আর মুড়ি খান।ঘরে মুড়ি ছিলো না,জমিরদের পাশের বাড়িতে মুড়ি ভাঁজে সেখান থেকেই মুড়ি আনা হয়েছে।মসলা চা আর মুড়ি নিয়ে হাজির হলো রজনী। পম্পির বাবা অনেক আগেই উঠেছেন।
মুড়িতে হাত দিয়েই বুঝতে পারলেন কিছুক্ষণ আগে ভাজা মুড়ি,এখনো অনেটা গরম আছে। তাঁর চোখে খুশি ঝিলিক দিলো।ছোটরা পছন্দের একটা জিনিস পাওয়ার পর যেমন খুশি হয়ে যায় তেমনিভাবে বলে উঠলেন-
—গরম গরম মুড়ি ভাজা। উফ ছোট বেলার কথা মনে করিয়ে দিল। আমার নানার বাড়িতে আমরা গেলেই মুড়ি ভাজা হতো।
চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন-
—দারুন চা,বাসায় যেমন খাই তার থেকে কিছুটা আলাদা।
—পুদিনা পাতাও দিয়েছি।
—তাই নাকি,এখন থেকে সব সময় এভাবেই চা দিও আমাকে।

রজনী একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো।উনি সব কিছু এত সহজ ভাবেন!এত কিছু হওয়ার পর ও ভাবেন কিছুই হয়নি,কেউ কিছু মনে রাখেনি।
—রাতে ঘুম কেমন হলো আপনার?
—ঘুম খুব একটা হয়নি।
—এমন পরিবেশে কখনো থাকেননি তো তাই এমন হয়েছে।একবার ভেবে দেখেন জীবন যাপন একটু অন্য রকম হলেই আপনার জন্য কত সমস্যা। সব পরিবেশে আপনি চাইলেও অভ্যস্ত হতে পারবেন না।
শুধু এটাই না জীবনে অনেক কিছুই আপনি চাইলেও করতে পারবেন না।
—যেমন
—যেমন আমাকে অকারণে কষ্ট দেয়া,সন্দেহ করা,খারাপ আচরণ ইত্যাদি ইত্যাদি।

পম্পির বাবা চোখ কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর বিরুদ্ধে এত এত অভিযোগ রজনী হেসে হেসে বলছে।
—তোমার বিরুদ্ধে সব অভিযোগই কি শুধু শুধু?
—সেটা তো আপনি নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছেন। এখানে আমার সারা জীবন কাটিয়ে দিলেও আমার আফসোস থাকবে না। কারণ আমার কিছু পাওয়ার কিংবা হারানোর নেই।
—এত দিন আমার সাথে থেকেও আমার প্রতি তোমার একটুও ভালোবাসা জন্মায়নি।
—না,সোজা কথায় আপনার প্রতি আমার কোন ফিলিংস নেই।কারণ আপনার মন বলে কিছু নেই।
আপনি সব জোর খাটিয়ে আদায় করতে চান, অন্য কেউ সেটা পছন্দ করুক বা না করুক।
যে কোন কিছু আপনি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে নেন।
জিতে গেলেন তো সব হয়ে গেল।

এই সময় নানি, নাত জামাই বলতে বলতে ঘরে ঢুকলেন-
—কি গো জামাই ঘুম অইলো?
—জ্বী হয়েছে।
—আমরা গরীব মানুষ, কিছু মনে করুইন না যে।
—না না মনে করার কি আছে?
—এই রজনী জামাই নাস্তা করবো কুন সোময়।
—নয়টার সময় খাবেন।তুমি এত অস্থির হইয়ো না তো নানি।

পম্পির বাবা বাইরে বের হলেন।

জমিরের বৌ খুশি রান্না করছে,বেগুন আর ছোট আলু দিয়ে ভুনা খিচুড়ি আর হাঁসের মাংস। কয়েকজন হাত লাগাচ্ছে,তাই অল্প সময়েই কাজ হয়ে যাচ্ছে।কেউ কোন আশা করে সাহায্য করছে না,এমনটাই হয়ে থাকে সব সময়।কারো বাড়িতে মেহমান এলে সাহায্য করার জন্য আশপাশের সবাই চলে আসে। গল্প করতে করতে কাজ করে যায় আনন্দের সাথে।নানি ওদেরকে খেয়ে যেতে বললেন,যদি সবার পেট ভরে খাবার না হয় তাহলে অল্প করেই হাতে হাতে খেয়ে নিবে।

পম্পি ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করতেই ভুলে গেছে।যেখানে ঢাকায় থাকলে এক মুহুর্ত মোবাইল ছাড়া চলে না আর এখানে মোবাইলের কথা বেমালুম ভুলে গেছে।মোবাইলের রিং নিজের অস্তিত্বকে মনে করিয়ে দিয়ে তার ঘুম ভাঙল।

নওমি কল করেছে-
—কি রে কোথায় আবার ডুব দিয়েছিস?
—আমরা এসেছি রজনী খালামনির নানির বাড়ি।
—তাশফির মামার জন্য আমাদের বিয়েটা আটকে ছিলো। এখন উনার আসা কনফার্ম হয়েছে, সামনের মাসের পনের তারিখ আসবে।তাই ঠিক হয়েছে বিশ তারিখ বিয়ের ডেট ফেলবে।
—ভালোই তো।
—সমস্যা হলো গতকাল সেমিস্টার ফাইলালের ডেট দিয়েছে।
এটা শুনে পম্পি লাফিয়ে উঠলো। গতকাল সে এখানে আসায় ভার্সিটিতে যেতে পারেনি।
—কি?কবে? পরীক্ষা পেছানোর কথা ছিলো যে?
—বাইশ তারিখ। আমার অবস্থাটা বোঝ এবার।
— বিয়ে বিশ তারিখ হলে, বাইশ তারিখ থেকে পরীক্ষা সমস্যা কি?
—আরে, বৌভাত হবে না?
—তাহলে বিয়েটা আগে বা পরে ফেলতে বল।
—গতকাল শোনার পর তাশফিকে জানিয়েছি। বাসায় আলোচনা করবে। ভাগ্যিস আগেই কার্ড ছাপাতে দেয়নি।
পম্পি পরে কথা বলবো।এখনি বের হচ্ছি।তোর সাথে কথা বলতে বলতে ক্লাসের কথা ভুলেই গিয়েছি।এই কথাগুলো তোকে বলতে পারছিলাম না দেখে আমার পেট গুড়গুড় করছিলো। রাখিরে আমার জান্টু দোস্ত।
—আচ্ছা ভালো থাকিস দোস্ত।

মেম্বার বাড়ি থেকে লোক এলো খবর দিতে, দুপুরের খাবারের আয়োজন চলছে মেম্বার বাড়িতে। মেহমানরা যেন সময় মতো পৌঁছে যান।
পম্পির বাবা ভালোমতোই আঁটকে গেলেন।

চলবে…

#ফাহমিদা_লাইজু

#৫ম_তলার_মেয়েটা

#পর্ব_৪১

মেম্বার বাড়িতে গরু জবাই দেয়া হয়েছে।গ্রামের সব লোকের এই বাড়িতে দাওয়াত।আসলে মেম্বারের একটা অজুহাতের দরকার ছিল তার বাড়িতে গ্রামের সবাইকে একত্রিত করার, কিছু দিন পরেই তো নির্বাচন!

পম্পির বাবা আজকেই চলে যেতে চেয়েছিলেন। এখন আবার এই ঝামেলা! তিনি এটাকে একটা ঝামেলাই মনে করছেন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে শুধু মাত্র রজনীকে নিতে এসেছেন।এটা কেমন কথা ইচ্ছার বিরুদ্ধে এভাবে দাওয়াত খাওয়া!মনে মনে ভাবছেন লোকটা অসম্ভব ধূর্ত, কথার প্যাঁচে ফেলে কাজ আদায় করে নিতে পারে। খুব বিরক্ত হয়ে বসে আছেন পম্পির বাবা, কে কি বলছে খুব একটা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন না তিনি। তাঁর দৃষ্টি এটা সেটা দেখছে।
দূরে মোবাইল টাওয়ারটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি আবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন আশপাশে তেমন কোন গাছ নেই, কিছু মরা নারিকেল গাছ দাঁড়িয়ে আছে শুধু। গাছগুলো কিভাবে মরে গেলো খুব জানতে ইচ্ছে করছে। তিনি মেম্বারকে জিজ্ঞেস করলেন এই কথা।
এত প্রসঙ্গ থাকতে এই প্রশ্ন শুনে মেম্বার একটু অবাক হয়েই উত্তর দিলো,এই মোবাইল টাওয়ার বসানোর পর থেকেই গাছ মরা শুরু হয়েছে। আশপাশের সব নারিকেল গাছ মরে শেষ।কেন এমন হচ্ছে কে জানে।
পম্পির বাবা চিন্তা করলেন,এই টাওয়ারের কারণে এখানে হয়তো বজ্রপাত বেশি হয় আর এই কারণেই গাছের এই অবস্থা।তবে এই কথাগুলো বলতে ইচ্ছে করলো না।

অনেক বড় উঠান। এখানেও শ্রেণী বৈষম্য। গরীব লোকদের নিচে বসিয়ে খাওয়ানো হচ্ছে। পম্পির বাবা আর গ্রামের অভিজাতদের জন্য টেবিল-চেয়ারের ব্যবস্থা। চেয়ারম্যান গ্রামে থাকলে তাঁকেও আসতে বলতেন কিন্তু তিনি বিশেষ কাজে গ্রামের বাইরে আছেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর ছেলে উপস্থিত হয়েছে।

খাবার পরিবেশন করা হলো।
অনেক আয়োজন করা হয়েছে।তবে সবার জন্য এত কিছু করা হয়নি। বিশেষ মেহমানদের জন্য বিশেষ আয়োজন করা হয়েছে।
এত কিছুর মধ্যেও খাবার খেতে পারেননি পম্পির বাবা ভালো করে, তরকারিতে প্রচুর ঝাল।কোন মতে খাওয়া শেষ করলেন।
মেম্বারকে ঢাকায় নিজের বাসায় দাওয়াত দিয়ে বিদায় নিলেন পম্পির বাবা।

রজনীকে তাড়াতাড়ি করতে বললেন, রাস্তা খুব খারাপ, দেরি করে রওনা হলে রাত হয়ে যাবে।
এই কথা শুনে খুব স্পস্ট ভাবে রজনী বলল-
—আমি এখন কোথাও যাচ্ছি না।
—মানে কি? তুমি এখানেই থাকতে চাও?
—যত দিন ভালো লাগে এখানেই থাকবো।
—এই অজপাড়া গাঁয়ে থেকে পঁচে মরতে চাও?
—আপনার ওখানে কি আমি বেঁচে ছিলাম? এখানে তবু প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি।

—তাহলে তুমি ডিভোর্স চাও?এটা সরাসরি বললেই পার।
— এত দিন সব কিছু আপনার ইচ্ছা মতো করেছেন,আমি কি চাই না চাই আমাকে কখনো জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করেননি এখন তাহলে কেন আমি ডিভোর্স চাই কিনা জানতে চাচ্ছেন? আমার জীবনে পুরুষের প্রয়োজন কিংবা ভালোবাসা সবকিছু ফুরিয়ে গেছে। বাকি জীবনটা আমি একা স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকতে চাই। এখন আপনার ইচ্ছা ডিভোর্স দিবেন কি দিবেন না।

পম্পির বাবা একেবারে থ হয়ে গেলেন।তাহলে কেন এত জামাই আদর,কেন এত কিছু?

—এই কথা আগে বললে এখানে থাকে সময় নষ্ট করার প্রয়োজন ছিল না।
—আসলেই তো,সময় নষ্ট!!এত দূর থেকে আসছেন,একটু আদর যত্ন করতে হবে না?একটু না হয় গ্রামের জীবনের অভিজ্ঞতা হলো ।দেখে গেলেন আমার কাছে আপনার বিত্ত বৈভবের কোন মূল্য নেই। আমার কাছে আমার আত্মসম্মানবোধটাই আসল।

পম্পির বাবা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন,এ যেন এক অচেনা রজনী কে দেখছেন।আসলেই কি তিনি এতটাই খারাপ যে,কেউ তাঁর সঙ্গে থাকতে চায় না?

—ঠিক আছে।আমি তোমার ফেরার অপেক্ষায় থাকবো।
—অপেক্ষায় না থেকে আপনার জীবন নতুন ভাবে সাজাতে পারেন।
—আমি অপেক্ষা করবো, দরকার হলে সারাজীবন অপেক্ষা করবো তোমার জন্য।
—সেটা আপনার ইচ্ছা।

পম্পি, রজনীকে টেনে আড়ালে নিয়ে গেলো।
—তুমি তাহলে যাচ্ছ না?
—না যাচ্ছি না।
—এখানেই থাকবে?
—কয়েক জায়গায় চাকরির জন্য আবেদন করেছি।দেখি কি হয়।জীবন তো একটাই ,প্রতি মূহুর্তে গোমরে মরার চাইতে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে,খুশি মনে, নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে জীবনটা পার করা ভালো না?
তাঁর জন্য জীবন দিয়ে দিলেও এই আত্মত্যাগ বুঝতে পারবে না,মনে করবে এটাই তাঁর প্রাপ্য ছিল।এমন মানুষের সাথে থাকা যায় না।

—আমি তোমার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করি। আমার বাবার মতো লোকের জন্য জীবন নষ্ট করার মানেই হয় না। কিন্তু তোমাকে খুব মিস করবো খালামনি- এই বলে পম্পি জড়িয়ে ধরলো রজনীকে। রজনীর চোখ ছলছলিয়ে উঠলো।

বাড়িটা ফাঁকা হয়ে গেলে নানি ঘরে ঢুকে দেখলেন রজনী বসে আছে। তিনি গিয়ে পাশে বসলেন।
—নানি তুমি কি এখন বলবা আমি না গিয়ে ঠিক করি নাই?এত ভালো মানুষরে ফিরিয়ে দেয়া ঠিক হয় নাই?
—না , এইডা কমু না।সবার জীবন পিরথক (পৃথক)।কেউর কাছে যেইডা ভালা আরেক জনের কাছে ভালা নাও অইবার পারে। তুই যেইডা ভালা বুজস হেইডা ভালাই অইবো।

—আমার আপন ভাইয়েরও আমার জীবন নষ্টের পেছনে হাত আছে।টাকার পাগল সে।আর এই সুযোগটাই নিছিলো পম্পির বাবা।
আসলে কি নানি নিজের আপনজন যখন স্বার্থপর হয়ে উঠে তখন একটা মেয়ের জন্য সব নিরাপত্তা বাঁধ একে একে খুলে যায়।বেড়াহীন বাগান, যেমন ভাবে বিভিন্ন পশুরা নষ্ট করতে চায় ঠিক সেই রকম পরিস্থিতি অতিক্রম করতে হয় একটা মেয়েকে। কেউ পশুদের আক্রমণে শেষ হয়ে যায়,কেউ বা আমার মতো আধামরা হয়ে বেঁচে থাকে।
আমার জীবনটা কেন এমন হলো নানি?

নানি চুপ করে থাকেন।এই প্রশ্নের উত্তর তো তাঁর জানা নেই।

পম্পি কোন কথাই বলছে না। পম্পির বাবা ঠিকই লক্ষ্য করছেন,পম্পি অন্য দিকে তাকিয়ে মাঝে চোখ মুছছে। তাঁর মনে হতো পম্পি খুব স্ট্রং মনের, এখন রজনীর জন্য চোখের পানি ফেলতে। তাঁর মনে হলো তিনি কি করবেন? চেয়েছিলেন তো রজনী কে সাথে নিয়েই ফিরতে।

—তোমার মন খারাপ লাগছে বুঝতে পারছি কিন্তু কি করবো বলো, রজনী কিছুতেই আসবে না বলল।তবে চিন্তা করো না এই রকম পরিবেশে এত কষ্ট করে কয়দিনই বা থাকতে পারবে? কয়েকদিন পরেই সুরসুর করে চলে আসবে।

—তোমার ধারণা ভুল। তুমি খালামনিকে চিনতেই পারনি।কষ্টের কথা বলছ না,এই কষ্ট তোমার সঙ্গে থাকার কষ্টের চাইতে অনেক গুণ কম।
—বাস্তবতা অনেক কঠিন।
—আশ্চর্য বিষয়!এখনো নিজের যুক্তি নিয়েই পরে আছ? তোমার কারণেই কত জন, অকারণে কষ্ট পাচ্ছে সেই সব তো তোমার চোখেই পরে না?

পম্পির বাবা শুধু তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে, কিছু বললেন না।

—আসলে কি জান, কিছু লোকের কোন দিন পরিবর্তন হয় না,হতে পারে না, হওয়ার চেষ্টাও থাকে না। তাঁদের জন্য তাঁদের আশপাশের মানুষেরা প্রতিনিয়ত কষ্ট পায় তাতেও তাদের কিছু যায় আসে না।এই সব লোক একদিন একদম একা হয়ে যাবে,যে দিকে তাকাবে শুধু দেখবে কেউ নেই, আশপাশে কেউ নেই।

একটু থেমে পম্পি আবার বলল-
—আমি আগামীকালই বাসা থেকে চলে যাবো।

পম্পির বাবা বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিন্তু কোন কিছুই তিনি দেখছেন না। তাঁর চোখে কিছুই ধরা পড়ছে না,সব কিছু যেন শুধু ছুটে চলেছে। তাঁর নিজের মেয়ে এভাবে কথা বলছে?সবার জন্য এত এত টাকা খরচ করেন এই তার প্রতিদান?
কে তাঁকে বোঝাবে,কার বোঝানোর সাধ্য আছে, তাঁর আচরণ,মন মানসিকতার জন্যই তার জীবন ভীষণ ভারি হয়ে উঠছে।

পম্পিকে এত সকালে দরজায় দেখে নওমি অবাক।ওর সাথে ছোট বড় কয়েকটা ব্যাগ।হাতে তার ফাইটার ফিসের জারটা ধরা।এটা দেখেই নওমি বুঝতে পারলো কোন সমস্যা হয়েছে,পম্পি বাসা থেকে চলে এসেছে।এই ফাইটার ফিসটা পম্পির খুব প্রিয়।
নওমি জিজ্ঞেস করলো-
—তুই ভার্সিটিতে যাবি না?
—না,আজ যাবো না, খুব টায়ার্ড লাগছে।
—আচ্ছা ঠিক আছে।আমি প্রায় রেডি হয়ে গেছি।যাওয়ার সময় দোতলায় নাস্তা খেয়ে যাবো।
তুই এখন আমার সাথে গিয়ে খাবি নাকি তোর নাস্তা উপরে পাঠিয়ে দিতে বলবো?
—এখন নাস্তা খাবো না।ঘুমাবো। গতকাল বাসায় ফিরে একটুও ঘুমাইনি।
—আচ্ছা তাহলে তুই ঘুম থেকে উঠলে দোতলায় চলে যাস।
—আচ্ছা ঠিক আছে।

নওমিকে যদিও বলল ঘুমাবে কিন্তু পম্পির ঘুম আসছিলো না।সে এই পাশ ঐ পাশ করতে লাগলো।এমন সময় পম্পির ভাই কল করলো। ভাইয়ের কল পেয়ে অসম্ভব ভালো লাগছিলো পম্পির।ভাই এত দূরে ইংল্যান্ড বসে কিভাবে বুঝে ফেলল পম্পির মন খারাপ!!
কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই,সব কিছু বলল পম্পি।
এর আগেও অনেক বার পম্পির ভাই পম্পিকে তার কাছে চলে যাওয়ার জন্য বলেছে ।সব সময় পম্পি মানা করেছে।আজ তার মন খুব বিক্ষিপ্ত। তাই বলল-
—ভাইয়া তুমি ব্যবস্থা কর আমি তোমার কাছে চলে আসতে চাই।
এটা শুনে ভাই খুবই খুশি হলো।

(আগামী পর্বে গল্পটা শেষ হয়ে যাবে)

#ফাহমিদা_লাইজু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here