শুষ্ক_পাতার_ভাজে?১৩.

0
1882

শুষ্ক_পাতার_ভাজে?১৩.
#লাবিবা_তানহা_লিজা?

আজকাল তৃষার মাঝে তেমন প্রান নেই । চুপ চাপ থাকে । একা একা কাদে তা কেউ না বুঝলে তৃনা আর পারুল ঠিক ই বুঝে । পারুল সব টা শুনে মেয়েকে সাহস দেয় । এরকম থাকেই তাই বলে এতো বড় ঘর ছাড়ার কোন প্রশ্ন ই উঠে না । বাচ্চার জন্য বাচ্চার ইয়াং দাদা দাদী আছে । এতোকাল উনারাই বড় করেছে বাকিটা উনারাই দেখে নিবেন । তবুও তৃষার মনে দ্বিধা থেকে যায় । যতই হোক সে তো ফুলকন্যা । তৃনা নিজের ঘরে এসে দেখে তৃষা বসে আছে । দরজা ভেজিয়ে দিয়ে এসে তৃষার সামনে বসে । মুখ ভার করে দাত দিয়ে আঙ্গুল কামড়াচ্ছে । চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে । তৃষার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠিতে নিয়ে বলে , “কি হয়েছে আমার বোন টার ?”
তৃষা ফুপিয়ে উঠে তৃনাকে জড়িয়ে ধরে কাদতে থাকে । তৃনা তৃষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে ” আজ বাদে কাল বিয়ে অথচ আমার বোনটা কাদছে । এটা কোন কথা ? দেখি দেখি মুখটা । ওমা কেদে কেটে ফুলিয়ে ফেলেছে চাদ মুখ খানা।এটা কিন্তু একদম ই ঠিক নয় । ”
” আপু এতো কষ্ট কেনো হচ্ছে আমার ?”
” কি হয়েছে বল আমাকে ?”
” আপু আমার খুব কষ্ট হচ্ছে । আমি কি করবো আপু ? আমি সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগছি ।রায়ান ডিভোর্সি ওর একটা মেয়ে আছে । আমি এতো বোঝা মাথায় নিতে পারছি না । আমার ফিউচারে কি হবে?”
” তুমার মন কি চায় ?”
” আমি জানি না কিচ্ছু জানি না।আম্মু বলে আমি আমার অধিকার থেকে না পিছিয়ে আসি । আচ্ছা আপু তুমি কিভাবে সহ্য করো এই ভালোবাসা নামের কষ্ট টা ?”
” বুঝবিনা । ”
” আমি বুঝি আপু । তুমি মুখে না বললেও আমি সবটা জানি । ”
” ভালোবাসা কখনো কষ্ট না তৃষা । ভালোবাসা হচ্ছে এক বিন্দু সুখ । যার জল কখনো শুকায় না বরং আস্তে আস্তে বর্ধিত হতে থাকে । ভালোবাসার মানুষটার একটু ছোয়া সারাজীবন ছোয়ার সমান । ভালোবাসার মানুষটার বুকে একবার মাথা রাখলে সারাজীবন তার বুকে মাথা রাখার সুখটা পাওয়া যায় । ভালোবাসার মানুষটার সৌন্দর্য একবার বাজেয়াপ্ত করলে সকল সৌন্দর্যকে হার মানায় । ভালোবাসার মানুষটার পাশে একবার থাকলে মনে হয় সারাজীবন তার পাশেই আছি । আর কিচ্ছু লাগে না । কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন অঘাত ভালোবাসা আর খাদহীন অনুভব । আমি সব পেয়েছি । আমার কোন কষ্ট নেই ।
তৃষা খেয়াল করে তৃনা হাসছে অথচ তার চোখে জল টলমল করছে । তৃনাকে জড়িয়ে ধরে তৃষা । তৃনাও তৃষাকে জড়িয়ে ধরে । তৃষা বলে, ” আমি তোমার মতো হয়তো কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারবোনা।
তবে দুলাভাইয়া কিন্তু খুব লাকিরে আপু । দোয়া রেখো আমি যেনো রায়ানকে নিয়ে সুখী হই । তার অতীত যেনো কখনো আমাদের মাঝে না আসে । ”
তৃনার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে । তৃষাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মনে মনে বলে ” আসবেনারে বোন । পাসপোর্ট হাতে পেয়ে গেছি । চলে যাবো তদের থেকে বহু দূরে । যেখানে তোর হাজবেন্ড আর আমার মাঝে অনেক ফারাক থাকবে । তোরাও সুখি হবি আর তোদের সুখে আমিও সুখী হবো । কখনোই আসবোনা রায়ান আপনার সামনে । কখনোই না । ”

কেনাকাটা সবার বিয়ের জন্য হলেও তৃনার কেনাকাটা বিদেশ যাত্রার জন্য । একা এসেছে আজ । নিজের জন্য কিছু ভালো বোরখা নিয়েছে । শো রুম থেকে বের হতেই দেখে রোহানা আর রোহান চিল্লাচিল্লি করছে আর বলছে আমার নাতনী টাকে নিয়ে গেলো ধরো ওকে ধরো । নাতনী মানে রুমু । তৃনাও দৌড় দেয় বাইরের দিকে । ঢাকা শহরের লোকজন একটু পিছু নিয়েই থেমে যায় । কিন্তু তৃনা পিছু ছাড়ে না । গাড়িটির পিছু পিছু সি এন জি দিয়ে ফলো করে । ইতিমধ্যে লোকাল থানায় রুমুকে কিডনাপ করার খবর দিয়ে দেয় রোহান । একটা পুরোনো বিল্ডিং এর কন্সট্রাকশনের কাজ চলছে । সেখানে গিয়ে গাড়িটি থামে । রুমুকে অচেতন অবস্থায় কোলে নিয়ে ভিতরে একটা মেয়ে চলে যায় । মেয়েটাকে পেছন থেকে দেখে খটকা লাগে তৃনার । পরক্ষনে ড্রেস থেকে চিনতে পারে । এই হলুদ টপ আর স্কার্ট টা দুই মাস আগে তৃনাই তৃষাকে কিনে দিয়েছিলো । তৃনা ভাড়া মিটিয়ে তৃষা যেদিকে গিয়েছে সেইদিকে যায় । এদিক সেদিক দেখে কিন্তু কোথাও পায় না । পুরো জায়গাটা তন্ন তন্ন করে খুজে কিন্তু কোথাও পায় না । সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে ছাদে যায় । ছাদথেকে এদিক ওদিক দেখতে থাকে । পাশের ছোট বিল্ডিংটার পেছন থেকে কান্নার আওয়াজ আসে আর একটা কালো ড্রেস পড়া মেয়েকেও হাফটা দেখা যায় । তৃনা ঝড় বেগে নিচে নেমে এসে ওদিকটা যায় । যা দেখে শুনে তা শুনে তৃনার চোখ ছানাবড়া । তৃষা আর লিনা দাড়িয়ে কথা বলছে আর রুমু লিনার কোল থেকে নামার জন্য চেষ্টা করছে । তৃনা জোরে তৃষাকে ডাক দেয় । তৃষা তৃনার দিক ফিরেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায় । তৃনাকে বলে –আপু তুমি এখানে কেনো ?
সজোরে থাপ্পর পড়ে তৃষার গালে । তৃষা গালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে থাকে । রুমু তৃনাকে চিনতে পেরে কান্না বন্ধ করে তৃনার কোলে এসে পড়ে । তৃনা রুমুকে কোলে নিয়ে তৃষাকে বলে ,” তুই এতো নিচে নেমে গেছিস আজ না দেখলে বিশ্বাস ই করতে পারতাম না আমি । ”
লিনা বলে, এই যে মিস কিসের নিচে নেমে গেছে ? কতটুকু জানেন আপনি ? রুমুর মম আমি । জানেন একটা মায়ের মেয়ের জন্য কতটুকু হৃদয় পুড়ে ? তৃষা আমার মেয়েকে আমার কাছে দিতে এসেছে । ওকে তো নিয়ে আপনার গর্ব করা উচিত । ”
রুমু আরো জোরে তৃনার গলা জড়িয়ে ধরে । তৃষা দাড়িয়ে দাড়িয়ে কাদছে । তৃনা বলে ,” এতোই যখন হ্যদয় পুড়ে তো ছেড়ে গিয়েছিলেন কেনো দুধের শিশুটাকে ছেড়ে ? একটা মা কখনো এমন করতে পারে না । মায়ের অধিকার নিয়ে ঐ ফেমেলির সামনে দাড়াতে পারতেন তা না করে কিডনাপ করিয়ে নিলেন আমার অবুঝ বোনটাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ? আর তুই ভালোই কিডনাপ করতে পারিস । এখানে আছিস কেনো ? ডাকাত দলে নাম লেখা ভালো ডাকাতি করতে পারবি । তারপর ধরা পড়লে ভাইয়া তো আছেই । ভাইয়া না থাকলে আমি আছি । ”
লিনা বলে, ” হেই বেশি কথা বলো তুমি । দাও আমার মেয়েকে আমার কাছে দাও । ”
“না তুমি ওর মম না ও তোমার মেয়ে । রুমু কে পাবে না তুমি চুন্নি কথাকার । লোভী মহিলা তোমার মতো মহিলা কখনোই মা হতে পারে না । আর কখনো রুমুর ধারে কাছে যেনো না দেখি তোমাকে । ”
চারিদিকে পুলিশ ঘেরাও করে । তৃনা রুমুকে নিয়ে চলে আসে । পিছু পিছু তৃষাও আসে । লিনাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয় ।

রায়ানের ফোনে একটা ভয়েজ রেকর্ড আসে হুয়াটসএপ এ আননোন নাম্বার থেকে । অন করতেই রুমুর গলা শুনতে পায় । রুমু বলছে
” পাপা তুমি পচা । আমাকে আমাল মাম্মাল কাছে যেতে দাও না । তুমি একটুও লাভ কলো না আমাকে । আদল কলো না । শুধু দাদু মনি আল দাদু ভাই ই আমাকে আদল কলে । আমাল মাম্মাও আমাকে আদল কলে । আমি আল থাকবোনা তুমাল সাথে । আমি চলে যাবো মাম্মাল কাছে । মাম্মা আমাকে নিতে আসছে । আমি চলে যাচ্ছি মাম্মাল কাছে । তুমি আল এসোনা আমাল কাছে । পচা পাপা তুমি ভালো থেকো । বাই বাই । টা টা । ”
রায়ানের মাথায় বাজ পড়ে যায় । ফোন দেয় সেই নাম্বারে কিন্তু পায় না । বাসায় ফোন করে পায় না । দারোয়ানকে ফোন করতেই দারোয়ান জানায় সবাই মিলে মলে গিয়েছে । বাসায় আসতেই দেখে রোহান রেহানা ড্রয়িংরুমে বসে কাদছে । রায়ানকে দেখে রেহানার কান্না বেড়ে যায় । রায়ানকে ধরেই কাদতে থাকে । রায়ান বলে , ” মম রুমু কোথায় ? রুমুকে এনে দাও আমার কাছে । ওর পাপাও আমি মাম্মাও আমি ।ওর কোন মমের প্রয়োজন নেই । আমার কলিজাটাকে আমার কাছে এনে দাও । ”
রোহান বলে , ” আমরা কেনাকাটা করছিলাম দাদুভাই হেটে হেটে বেরাচ্ছিলো আমাদের সাথেই । হটাৎ চিৎকার করতেই তাকিয়ে দেখি একজন দাদুভাইকে নিয়ে চলে যাচ্ছে দৌড়ে । আমার চোখের সামনে দিয়ে আমার দাদুভাইকে নিয়ে চলে গেলো । আমি আটকাতে পারলাম না । ”
রায়ানের ফোন আসতেই দেখে মাসুদ ফোন করেছে । ধরতেই বলে ” দোস্ত রুমুকে পেয়েছি । আসছি আমরা চিন্তা করিস না । ”
রোহানাকে সরিয়ে দিয়ে রুমে চলে আসে রায়ান । বুকের সাথে বালিশ চেপে চোখ বন্ধ করে থাকে । বার বার কেনো তার মেয়েটার সাথে এমন হয় ? ঐ টুকুন মেয়েটা তার আর কত সহ্য করবে ? চোখ থেকে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। ঘন্টা খানিক বাদে রুমুকে নিয়ে আসা হয় । তৃনার কোলে রুমুকে দেখে রোহানা রোহান দৌড়ে আসে । তৃনাকে দেখে বলে ” মাগো তুমি বার বার আমার নাতিটাকে বাচিয়ে দিচ্ছো । আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।পেছনে তৃষাকে দেখে অবাক হয় । তৃষা কাচুমাচু করতে থাকে । ড্রেস দেখে চিনে ফেলবে বলে তৃনার বোরখা পড়ে নেয় গাড়িতেই।রোহান বলে , ” তৃষা মা ?”
মাসুদ বলে ,” ভাবিরা দুই বোন হয়। ”
” ওওও তাই নাকি ?
তৃনা নির্লিপ্তে বলে ” রুমুর পাপা কোথায় ? ”
” উপরে রুমে আছে মা । ঐ মা কে স্যারের রুমে নিয়ে যা।”
কাজের লোকের সাথে রায়ানের রুমের সামনে চলে আসে । দরজায় নক করা শুনে দরজা খুলে রায়ান । তৃনার কোলে রুমুকে দেখে বড় শ্বাস ফেলে । তৃনার দিকে চোখ পড়ে । নিকাবে শুধু ছল ছল করা চোখ দুটোয় ভেসে আছে । চোখদুটো চেনা চেনা লাগে রায়ানের কাছে । তৃনা ভিতরে ঢুকে রুমে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় । ঘুমন্ত রুমুকে রায়ান কোলে তুলে নিয়ে তৃনার দিকে তাকিয়ে বলে ” ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবোনা আপনাকে । বসুন প্লিজ । কেমন আছেন ?”
তৃনা রায়ানের দিকে তাকায় । খাটে বসে বলে, ” আলহামদুলিল্লাহ । একটা কথা বলবো আপনাকে যদি অনুমতি দেন । ”
রায়ান তৃনার সামনে বসে বলে ,” বলুন”
” অনুরোধ বলতে পারেন । ”
” সিউর বলুন । ”
তৃনা রায়ানের চোখে চোখ রেখে বলে,” একটু ভালোবাসবেন রুমুকে ?
মুহূর্তেই রায়ানের বুক কেপে উঠে । এ কোন চাহনি ? এ কোন আকুলতা ভরা ভালোবাসার আবেদন ? মন ঢেকে উঠে তৃনলতা…।
তৃনা উত্তরের অপেক্ষা না করে বলে
” আসি। “আসসালামু আলাইকুম । ”
উঠে যেতে নিলে রায়ান বলে , ” নাম কি আপনার ?”
” আমি তৃষার বড় বোন । তৃষা বাইরে দাড়িয়ে আছিস কেনো ? ভেতরে আয় । উনার সাথে কথা বল । ”
দরজার পাশে তৃষা দাড়িয়ে ছিলো । তৃষা ভেতরে আসতেই তৃনা বেরিয়ে যায় । তৃষা রায়ানের সামনে গিয়ে দাড়ায় । রায়ান তৃষাকে এক হাত ধরে কাছে নিয়ে বলে ” থ্যাংক ইউ তৃষা । আমার মেয়ে টাকে বাচানোর জন্য । এখন তো ও শুদু আমার নয় ..আমার আর তোমার মেয়ে । ”
তৃষার নিজের উপর নিজের ঘৃনা হচ্ছে এবার । এতোটা খারাপ কাজ কিভাবে করলো ও । ওর ই বা দোষ কি ! লিনা এসে এমন ভাবে কান্নাকাটি করেছিলো যে রুমুর জন্য ও মরেই যাবে । মায়ের আর্তনাদ শুনে রুমুকে মায়ের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলো । সে তো আর জানতো না লিনা কতটা স্বার্থপর মহিলা । আর সে নিজেও রুমুকে একটা ভেজাল ভাবে । পরের মেয়েকে নিজের মেয়ে ভাবতে পারবেনা সে কখোনোই । নিজেকে সামলে বলে
” আমি না আপু বাচিয়েছে রুমুকে । ”
” এই তোমার বোন ? তোমার বোনকে তো আগে কখনো দেখিনি । তোমাদের বাসায় গিয়েও দেখলাম না । শ্বশুর বাড়িতে ছিলো বুঝি ? ”
” আপু বিয়ে করে নি । ”
” কেনো ? আমি কি ফাস্ট হয়ে যাচ্ছি ?”
” আপু কোনদিন বিয়ে করবে না । আপু একজনকে ভালোবাসতো । কিন্তু আপুকে ঐ লোক ভালোবাসতো না । লোকটা বিয়ে করে ফেলে । আপু আর কাউকে মেনে নিতে পারেনি । ”
” স্ট্রেঞ্জ । তবে এটাও ঠিক । যাকে একবার মন থৈকে ভালোবাসা যায় তাকে কখনো ভুলা যায় না । তবুও জীবন জীবনের গতিতে চলতে দেওয়া উচিত । থেমে গেলে সব শেষ । ”
” কেউ পারে কেউ পারে না । ”

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here