প্রমত্ত_হৃদয়❤️,১৭

0
907

#প্রমত্ত_হৃদয়❤️,১৭
#লেখনীতে:সারা মেহেক

আফসার সাহেব পার্সেলটি নিয়ে রিডিং রুমের অভ্যন্তরে অবস্থিত ছোট রুমটিতে প্রবেশ করলেন। রুমটিতে প্রবেশাধিকার শুধু তারই আছে৷ তবে কাল বিশেষে সামাদও সেই রুমে প্রবেশ করে। তবে সালমা বেগম, সাবিহা ও সাবিতের ক্ষেত্রে রয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। অবশ্য তারা কেউ কোনোদিন আফসার সাহেবের গোপনীয়তায় ব্যাঘাত ঘটায়নি।

আফসার সাহেব রুমে এসে দরজা আটকিয়ে দিলেন। তার মুখশ্রী যেনো প্রায় রক্তশূণ্য হয়ে গিয়েছে। ফ্যাকাসে উদ্বিগ্ন চেহারায় ধরপাকড় হওয়ার ভয় স্পষ্ট। আফসার সাহেব পার্সেলটা টেবিলে ছুঁড়ে দিয়ে মুখ চেপে পাশের নরম সোফায় ধপ করে বসে পড়লেন। মস্তিষ্ক তীব্র উৎকণ্ঠায় ঝিম ঝিম করতে লাগলো। গলা ও ঠোঁট শুকিয়ে এলো। তিনি ছোট গোল টেবিল হতে পানির গ্লাস নিয়ে ঢক ঢক করে পানি পান করলেন। ভেজা জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলেন তিনি৷ অতঃপর দীর্ঘক্ষণ পার্সেলের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন তিনি। উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে স্বগোতক্তি করে বললেন,
” এ পার্সেল পাঠালো কে? যে-ই পাঠিয়েছে সে নিশ্চয়ই আমার ব্যাপারে জানে। কিন্তু সে মানুষটা কে?”

আফসার সাহেব ভাবনার কেতাবে ডুব দিলেন। কিন্তু হাতড়ে হাতড়েও পার্সেল পাঠানো অজ্ঞাত ব্যক্তিটি সম্পর্কে ধারণা করতে পারলেন না তিনি। এরই মাঝে তার ফোন বাজখাঁই সুরে বেজে উঠলো। অকস্মাৎ ফোনের শব্দে হতচকিত আফসার সাহেব দ্রুত কল উঠালেন। ফোনের ওপাশ থেকে তার এসিস্ট্যান্ট জরুরি মিটিং এর কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন তাকে। আফসার সাহেব কোনোপ্রকার জবাব না দিয়ে কল কেটে উঠে দাঁড়ালেন। ফোনটি পকেটে ঢুকিয়ে এগিয়ে গেলেন পার্সেলটির দিকে। পার্সেলটি নিয়ে টেবিলের ড্রয়ারে রেখে রুম হতে চলে গেলেন তিনি। মনে মনে ভাবলেন, অফিস হতে ফিরে পার্সেলটির একটা ব্যবস্থা করা যাবে।

.

সকালের নাস্তার টেবিল রমরমা। বিভিন্ন পদের খাবার দিয়ে ডাইনিং টেবিল ভরপুর। অসংখ্য খাবার দেখে রাগীবের চক্ষুচড়াক গাছ। সে বৃহদাকার বিস্মিত নেত্রজুগল দ্বারা বিভিন্ন পদের খাবারের দিকে অপলক চেয়ে রইলো। তার এ বিস্ময়ের মাত্রা উপলব্ধি করতে পেরে সালমা বেগম ক্ষীণ শব্দে হেসে উঠে বললেন,
” এতো অবাক হওয়ার কি আছে রাগীব?”

রাগীবের বিস্ময় তখনও কাটেনি। সে বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
” এতো খাবার কেনো আন্টি? কে খাবে এসব?”

” কেনো, তুমি।”

রাগীব আরেক দফা বিস্মিত হলো। বললো,
” অসম্ভব আন্টি। এতো খাবার খেলে আমি বেলুনের মতো উড়ে যাবো। এতো খাবার রান্না করেছেন কেনো?”

” কেনো আবার। তুমি এখন আমাদের জামাই। সে হিসেবে তো খাবার দাবার রান্না করতেই হয় তাই না। এটা হলো সকালের জামাই ভোজ। দুপুর আর রাতেরটা আছে। ”

” আন্টি, আপনি তো আমাকে খাইয়েই মে’রে ফেলবেন দেখি। আমি এতো পেটুক না। একটু কম করে রান্না করবেন প্লিজ। আর আজকে আমার ও সাবিহার জন্য লাঞ্চ আর ডিনারের ব্যবস্থা করার দরকার নেই। আমরা বাইরে খাওয়াদাওয়া করবো।”

সালমা বেগম মৃদু হেসে বললেন,
” আচ্ছা। ঠিক আছে। ”

” সাবিহা, সাবিত কোথায়?”

” আসছে ওরা। তুমি খাওয়া শুরু করো। ”

” ওরা আসুক তারপর খাওয়াদাওয়ার শুরু করবো। আপনিও বসুন আন্টি। ”

সালমা বেগম চেয়ার টেনে বসে পড়লেন। দু মিনিটের মাঝে সাবিহা ও সাবিত ডাইনিং এ চলে এলো। তাদের প্রতিক্রিয়াও ঠিক রাগীবের মতো হলো। এ নিয়ে কিছুক্ষণ হাসাহাসি শেষে নাস্তা খাওয়া শুরু করলো।

.

” মন থেকে ডেটে যেতে চাইছো তো?”
টারটেল নেক সোয়েটারের উপর কালো ব্লেজার পরতে পরতে সাবিহাকে জিজ্ঞেস করলো রাগীব। সাবিহা তখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে অবিন্যস্ত চুলের গোছাকে রাবার ব্যান্ড দিয়ে বিন্যস্ত করতে ব্যস্ত। আয়নার মাধ্যমে রাগীবের পানে চাইলো সে। অপলক চাহনিতে রাগীবের দিকে চেয়ে রইলো। তার এ দেখার তৃষ্ণা যেনো মিটলো না। ভাবতেও অবাক লাগে, আয়নায় ভেসে উঠা প্রতিবিম্বের মানুষটি আজ তার! অথচ গতকাল সকাল অব্দিও সবকিছু অনিশ্চিত ছিলো। প্রথম ভালোবাসাকে দীর্ঘস্থায়ী ও শেষ ভালোবাসা হিসেবে পাওয়ার সৌভাগ্যটা তার হবে কি না সেটাও জানা ছিলো না সাবিহার। তবে ভাগ্যের পরিক্রমায় রাগীব আজ থেকে বৈধভাবে তার।

সাবিহার নিশ্চুপতা উপলব্ধি করে রাগীব পুনরায় একই প্রশ্ন করলো। ঘোর কাটলো সাবিহার। ক্ষীণ লাজুক প্রচ্ছন্ন হাসি দিয়ে বিনা দ্বিধায় সে বললো,
” অবশ্যই। ডাউট আছে?”

রাগীব স্মিত হাসলো। ব্লেজারের স্লিভ ঠিক করতে করতে বললো,
” ছিলো। কিন্তু তোমার কনফিডেন্টলি এন্সার দেওয়া দেখে সে ডাউট ক্লিয়ার হয়ে গিয়েছে। ”

সাবিহা প্রত্যুত্তরে মুচকি হাসলো। অতঃপর চেয়ারের উপর থেকে উঠে ঘিয়ে রঙয়ের লং জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে রাগীবের সামনে এসে দাঁড়ালো। বললো,
” রেডি? ”

” হুম।”

” তাহলে যাওয়া যাক?”

” অবশ্যই। ”
এই বলে রাগীব সাবিহার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিলো। হিম শীতল পরিবেশেও এক উষ্ণ ছোঁয়া অনুভব করলো সাবিহা। তার সর্বাঙ্গ অল্প বিস্তর কেঁপে উঠলো। প্রথমবারের মতো রাগীবের স্পর্শে তার অন্তঃস্থলে তীব্র সুখানুভব হলো। ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো প্রশান্তির হাসি। রাগীব আড়চোখে তাকালো সাবিহার পানে। তার স্নিগ্ধময়ীর স্নিগ্ধ আবেশী হাসিতে বিগলিত হলো রাগীব। তার হাতের মুঠো দৃঢ় হলো। সাবিহা তা উপলব্ধি করতে পেরে ঠোঁট চেপে হেসে বললো,
” কি হলো? যাবেন না?”

রাগীবের আশাভঙ্গ হলো। সে আশা করেছিলো, সাবিহা হয়তো ভীষণ লজ্জায় নুয়ে পড়বে। তার গোলগাল গাল দুটো ঈষৎ রক্তিমাভাব ধারণ করবে। কিন্তু তার ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে সাবিহা ঠিক উল্টো কাজটা করলো। বিয়ের পর রোমান্টিক ডেটে যাওয়ার প্রস্তাবে তৎক্ষণাতই রাজি হলো সে। ছোটবেলা হতে বিদেশি সংস্কৃতিতে গড়ে উঠা সাবিহার মননে সকল বিষয়ে লজ্জা ভাবটা তুলনামূলক কম। বাঙালি মেয়েরা যেখানে বিয়ের পর স্বামীর সাথে লাজুক কণ্ঠ ব্যতিত কথাই বলতে পারে না সেখানে সাবিহা ব্যতিক্রম। সে এসব লাজুক মুহূর্তে সময় না দিয়ে রাগীবকে পুরোপুরি জেনে নিতে সময় দিতে চাইছে। রাগীবকে গভীরভাবে ভালোবাসতে চাইছে। যে ভালোবাসায় থাকবে না কোনো খাঁদ।

.

ঈষৎ নীলাভ সবুজ টলমল পানির উপর দিয়ে ধীর গতিতে বয়ে চলছে তাদের গন্ডোলাটি। মাঝারি আকারের গন্ডোলাটি বেশ কারুকার্যপূর্ণ। সম্মুখ প্রান্তে রয়েছে সোনালী রঙের ঘোড়ার একটি মূর্তি। গন্ডোলার দুপাশে লাল ও সাদা রঙের গোলাপ দিয়ে সাজসজ্জায় পরিপূর্ণ। বসার জন্য রয়েছে দুটো চেয়ার। গন্ডোলাটি মূলত দম্পতিদের জন্য। ফলে রাগীব ও সাবিহা বেশ আরাম আয়েশের সহিত বসতে পেরেছে। দু পাশে বিভিন্ন উচ্চতার দালানের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা সরু খালের টলমলকৃত পানির উপর দিয়ে বয়ে চলছে গন্ডোলাটি। তাদের গন্ডোলার আশেপাশে চলাচল করছে আরো গন্ডোলা। কিছুদূর পর পর গন্ডোলাটি ছোট আকৃতির কিছু ব্রিজ অতিক্রম করে চলছে। ব্রিজের এপাশের রাস্তা ও ওপাশের রাস্তার দূরত্ব নিতান্তই কম। দু পাশের রাস্তায় খালের ধার ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ছোটখাটো কিছু স্থায়ী ও অস্থায়ী রেস্তোরাঁ। কিছু কিছু কপোত-কপোতীরা সেখানে বসে গল্প করছে এবং কফি খাচ্ছে। তো কিছু কপোত-কপোতী লোকলজ্জার পরোয়া না করে খানিক অন্তরঙ্গ মুহূর্ত উপভোগ করছে।
রাগীব ও সাবিহা একে অপরের হাত ধরে চলমান পরিবেশটি দারুণ উপভোগ করছে। আধ ঘন্টার দীর্ঘ রোমান্টিক গন্ডোলা রাইড শেষে তারা হেঁটে হেঁটে সরু গলি পেরিয়ে একটি রেস্তোরাঁয় এসে বসলো। লাঞ্চের জন্য ওর্ডার করলো ‘pasta al tonno’ ও ‘red shrimp’।

লাঞ্চ শেষে ভেনিসের সরু গলি ধরে হাঁটলো তারা। শেষ বিকেলে একটি জুয়েলারি দোকানে ঢুকে সাবিহার জন্য সুক্ষ্ম কারুকার্যে খচিত হার্ট শেইপের একটি লকেট কিনে দিলো রাগীব। অনুরাগের সহিত সাবিহার গলায় পরিয়ে দিলো সেটি। অতঃপর তার স্নিগ্ধময়ীর ললাটে এঁকে দিলো ভালোবাসায় মোড়ানো আলতো একটি চুম্বন। রাগীবের নিভৃত ছোঁয়ায় আবেগী হয়ে উঠলো সাবিহা। তার আঁখিজোড়া ঈষৎ সিক্ত হয়ে এলো। সে মৃদু হাসি দিয়ে নিচু কণ্ঠে বললো,
” থ্যাংক সো মাচ রাগীব। ”
রাগীব প্রত্যুত্তর করলো না। ঠোঁটের কোনে বিস্তৃত হাসি ঝুলিয়ে সাবিহাকে নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে পড়লো।

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। রাত পেরিয়ে মধ্য রাত ছুঁইছুঁই। রাগীব ও সাবিহা এখনও বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়নি। দুজনের কারোরই মন চাইছে না এ দারুণ উপভোগ্য সময়গুলো ফেলে চার দেয়ালের মাঝে বন্দি হতে। তারা চাইছে আজ রাতটা এ শহরের মাঝে বিচরণ কাটিয়ে দিতে। হিনহিনে শীতল হাওয়ার মাঝে বসে জ্যোৎস্না বিলাস করতে। একে অপরের হাতে হাত রেখে নিশ্চুপ সময়গুলো উপভোগ করতে।

রাতের খাবার খেয়ে রেস্তোরাঁয় সময় কাটিয়ে সরু গলিগুলো দিয়ে হাঁটছে তারা। প্রায় জনমানবশূন্য গলি ও রাস্তাগুলো গভীর নীরবতায় ছেয়ে আছে। এ নীরবতার সাক্ষী হয়ে পথ পারি দিচ্ছে নতুন ভালোবাসায় মোড়ানো এক দম্পতি।
রাগীব ও সাবিহা বিনাবাক্য হেঁটে চলছে। কিছুদূর যেতেই রাগীবের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিলো, তাদের ব্যতিতও এ রাস্তায় এক লোক হাঁটছে। হাঁটছে বললে ভুল হবে। লোকটি তাদের পিছু নিয়েছে। রাগীব নিজের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের শক্তিকে ভুল প্রমাণিত করতে পর পর দুটো গলি অতিক্রম করলো। তাদের পিছু পিছু লোকটিও দুটো গলি অতিক্রম করলো। নাহ, রাগীবের এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো না। সত্যিই লোকটি তাদের পিছু নিয়েছে। রাগীব সতর্ক হলো। সাবিহার হাতখানা শক্ত করে ধরলো। অকস্মাৎ হাতের বাঁধন দৃঢ় হওয়ায় কিঞ্চিৎ অবাক হলো সে। এ নিয়ে রাগীবকে প্রশ্ন করতে সে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশ ফিরে রাগীবের দিকে চাইলো। কিন্তু রাগীব তাদের পিছু নেওয়া ব্যক্তিটিকে দেখতে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে চাইলো। অমনিই লোকটি অকস্মাৎ রাগীবের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here