তোমার_ছায়া (পর্ব ২৩ এবং শেষ)

0
1416

#তোমার_ছায়া (পর্ব ২৩ এবং শেষ)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

আয়রিন আর ফারদিন দুজনে মিলে শাড়ি ও জামা দেখতে লাগলো। ফারদিন দেখে দেখে শাড়ি গুলো একটা একটা আয়রিনের গায়ে মেলে ধরে কিছুক্ষন তাকিয়ে দেখছে এগুলো কেমন মানায়। আয়রিন চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। আর মাঝে মাঝে আড় চোখে ফারদিনের দিকে চেয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
ফারহা হাটতে হাটতে একটা দোকানে ফারদিন ও আয়রিনকে এভাবে দেখে কিছুক্ষন চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো এক পাশে। এক পাশে দাড়িয়ে লুকিয়ে দুজনকে দেখছে সে। কতো হাসি খুশি তারা। দুজনকেই দেখে মনে হচ্ছে খুব গভির সম্পর্কে জড়িয়ে আছে তারাও।
কিছুক্ষনের মাঝে আবরার এসে পেছন থেকে কাধে হাত ছুইয়ে বললো,
– এখানে এভাবে দাড়িয়ে আছো কেন?
ফারহা একটু মুচকি হেসে বললো,
– ভালোবাসা দেখতেও ভালো লাগে।
ফারহার চোখের ইশারায় আবরারও ওদের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষন। এর পর ভ্রু-কুচকে ফারহার দিকে তাকালে ফারহা শান্ত ভাবে বললো,
– আপনাকে অনেক কিছু বলার আছে আমার।
আবরার ওভাবেই তাকিয়ে থাকা অবস্থায় বললো,
– কি?
– এখানে না। পরে আলাদা কোনো এক জায়গায় বলবো।
আবরার একটু হাসলো। তারপর মুকে হাসি ধরে রেখে বললো,
– মহা রাণী’র ইচ্ছাকেই মেনে নিলাম। এবার দাড়িয়ে না থেকে দয়া করে সামনে পা বাড়ান।
,
,
ফাইনালি অনেক কিছু সহ্য করে ভালোবাসা পূর্ণতা পেলো তাদের। সন্ধার পর থেকে গায়ে হলুদের কাজ শুরু হলো। সব শেষে রাতে গুমাতে গেলে আবরারের ফোন থেকে একটা টেক্সট আসে,
‘আমি তোমাদের ছাদে অপেক্ষা করছি তোমার জন্য।’
অবাক ভঙ্গিতে এক হাত গালে গালে চলে যায় তার। ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে মেসেজটা আবার ভালো করে পরে নিলো সে। ঘুমানোর আগে দুঃস্বপ্ন দেখছে না তো সে? না ঠিকই তো দেখছে। তার মানে আবরার সত্যি ছাদে আছে? যদি থাকেই তাহলে এতো রাতে কিভাবে ছাদে এলো? আর কেনোই বা এলো।
আর কিছু না ভেবে ছাদে চলে গেলো সে। দেখে ছাদের এক কোনে হেলায় দিয়ে দাড়িয়ে আছে আবরার। আর চাঁদের আলোয় মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
ফারহা তার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,
– কিভাবে এসেছেন এতো রাতে? আর কেনই বা এসেছেন?
আবরার একটু মুচকি হাসি দিয়ে বলে,
– তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিলো তাই।
– পাগল নাকি?
– বলতে পারো,,
– কালকে তো একেবারেই চলে যাবো। তখন কোলে নিয়ে বসে থাকবেন। একন যান।
– আজ কয়দিন হলো ওই বারি থেকে এসেছো? এই সময়টায় চোখে হারাচ্ছিলাম শুধু। মনে হচ্ছিলো আমার ছায়াটা আমাকে ছেরে দুড়ে চলে গেছে।
– হুম চলে এসেছিলো আমার কাছে। এই যে আমার সাথে মিশে আছে যে এইটা। হিহিহি,,,
– তাহলে রেখে দাও নিজের কাছে। যেন আমি পুরোটাই হয়ে থাকি #তোমার_ছায়া। তাহলে আর হারিয়ে যাওয়ার ভয় থাকবে না। সারাটা দিন তুমি যেখানে যাবে ছায়াটাও পাশে থাকবে তোমার।
আবরারের এমন পাগলামি কথা বার্তায় ফারহা হেসে দিয়ে বলে,
– এখন যান, এতো রাতে আপনাকে এখানে দেখলে সবাই হাসাহাসি করবে।
– আচ্ছা, বলো তো আমি তোমাকে কখনো জড়িয়ে ধরেছিলাম কি না?
ফারহা কিছুক্ষন ভেবে বলে,
– ওম,,, না কখনো ধরেন নি। তবে হাত ধরেছেন অনেক বার।
আবরার একটু হেসে বলে,
– জড়িয়েও ধরেছিলাম একবার। দেখো তো মনে করতে পারো কি না?
ফারহা কিছুক্ষন ভেবে বললো,
– মনে পরছে না।
– জঙ্গলে, ছিন’তাই কারিদের থেকে লুকাতে গিয়ে তখন।
ফারহা কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে হেসে দিয়ে বললো,
– হুম মনে পরছে। আর এতো ভঙিতা না করে সরাসরিই বলতে পারতেন, যে আপনি আমার জড়িয়ে ধরতে চাইছেন।
আবরার এবার ফাটা বাশের চিপায় পরার মতো অবস্থা হয়ে আর কিছু বলার মতো খুজে পাচ্ছিলো না। তাই হুট করে ফারহাকে টেনে নিজের সাথে জড়িয়ে চুপচাপ হয়ে রইলো।
,
,
বিয়ের বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। অনেক দিন পর আবার বাবার বাসায় আসে ফারহা। সেই সাথে মা কে ফারদিন আর আয়রিনের বিষয়টা জানালে, মা রেগে আগুন। বিসয় টা যেন তিনি কোনো ভাবেই মানতে পারছেনা। নিজের এক মাত্র ছেলেকে এমন মেয়ে বিয়ে করাবে, যার আগেও একটা বিয়ে হয়েছিলো?
রেগে বলে,
– তোদের দুই ভাই বোন কে ওই বাড়ি থেকে কি জাদু করেছে কে জানে? দুজনই ওদের দুই ভাই বোনকে নিয়ে পাগল হয়েছিস।
ফারহা মায়ের এক হাত ধরে বললো,
– ভাইয়াকে কখনো বিয়ের জন্য রাজি করাতে পেরেছো? পারোনি। আর ভাইয়া বলেই দিয়েছে আয়রিনকে বৌ করে না আনলে আর জীবনে বিয়েই করবে না। আর তোমরা কি চাও না, তোমাদের ছেলে সুখে থাকুক?
মা উঠে হাটতে হাটতে বলে,
– তোদের যা ইচ্ছা তাই কর তোরা।
ফারহা একটু হেসে রুমে চলে গেলো। পরে ফারদিন এসে চুপি চুপি জিজ্ঞেস করলে ফারহা বলে,
– একটু রাগ করেছে, তবে মনে হয় না অমত করবে।
,
,
– তুমি এতোটা দুশ্চরিত্রা, তা আগে জানলে কখনো আয়রিনের সাথে আমি এমনটা করতাম না।
কাচের গ্লাস ফ্লোরে ছুড়ে মা’রে মাহিন। আর পাশে চুপচাপ নিজের নিষ্পাপ বাচ্চাকে নিয়ে দাড়িয়ে আছে মাহি। আর অঝরে কাঁদছে।

মাহিনের রাগের কারণ টা হলো তার ছেলে। মাহি প্রেগনেট শুনে তাকে বিয়ে করে আয়রিনকে ডিবোর্স দিয়েছিলো সে। তবুও যেন একটু সন্দেহ মিশে ছিলো। আর বাচ্চা হওয়ার পর সেটাই ঠিক হলো।
বাচ্চার সাথে মাহিনের DNA টেস্ট কনো ভাবেই মেচ করছে না। যার অর্থ বাচ্চা টা মাহিনের না। অন্য কারো। যা মাহিনের বাচ্চা বলে মাহিনকে বিয়ে করেছিলো মাহি। মাহিনের বাবা মা তো সেদিনই তার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো, যে দিন মাহিকে বিয়ে করে এনে আয়রিনকে বের করে দিয়েছিলো মাহিন।
মাহিনের ভাবতেই আজ সব কিছু ভেঙে চুড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে যে, অন্য কারো বাচ্চা সে এখন নিজের সন্তান পরিচয় দিয়ে বড় করতে হবে।

আর খবর টা আয়রিনের কানে আসার পর ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠে তার। এতো দিনের জ্বলতে থাকা আগুন টা যেন একটু একটু করে নিভতে শুরু করলো। আসলে যে যেমন, তার জন্য মিলেও তেমন।
,
,
আবরার কলেজে যাওয়ার জন্য বের হলে দেখে সামনে একটা নীল রংয়ের চকচকে বাইক রাখা। আবরার কিছুক্ষন তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো। বাসায় তো তেমন কাউকেই দেখলো না।
পেছন থেকে ফারহা এসে একটা চাবি এগিয়ে দিয়ে বলে,
– অবাক হওয়ার কিছু নেই। এখন থেকে আর গাড়ির জন্য দাড়িয়ে থাকার প্রয়োজন নেই। নিজের বাইকেই যাবেন।
আবরার কিছুক্ষন চেয়ে থাকলে ফারহা আবার বলে,
– মায়ের কাছে শুনেছিলাম, গারি কেনার জন্য টাকা জমাচ্ছেন। যখন হবে তখন গাড়ি কিনবেন। এখন থেকে কিন্তু বাইকে করে আমাকেও কলেজে নিয়ে যেতে হবে।
,
,
আজ সারা দিন ক্লান্তিতে কেটেছে ফারহার। সন্ধার পর আবরার আসার পর তার জন্য ঠান্টা পানি আনতে গিয়ে মাথা ঘুরিয়ে পরে যায় সে।
আবরার দৌড়ে গিয়ে ফারহাকে কোলে তুলে খাটে শুইয়ে দেয়। আর মুখে পানি ছিটিয়ে নিলো।
আর দুই দিন পরই ফারদিন আর আয়রিনের বিয়ে। এর মাঝে ফারহার আবার কি হয়ে গেলো তা বুঝে উঠতে পারছে না সে।
আবরার একটা গাড়ি কল দিয়ে হসপিটালে নিয়ে যায় ফারহাকে। ওই দিনটা খুব টেনশনে কেটেছে তার।
হসপিটাল থেকে ফিরে আসার পর থেকেই আবরারকে খুব বিষণ্ন দেখালো। কাউকে এই ব্যাপারে কিচ্ছু বলেনি।

আজ শুক্রবার, ফারহা স্বাভাবিক ভাবে আবরারের কাছে গিয়ে বললো,
– হসপিটালে যাওয়ার পর কি হয়েছে তা কিন্তু এখনো বলেন নি।
আবরার শান্ত ভাবে বললো,
– কিছু হয় নি, এমনি তোমার শরির দুর্বল ছিলো তাই এমনটা হয়েছে।
ফারহা এবার সিরিয়াস লুক দিয়ে তার পাশে বসে বললো,
– দেখুন আমি আপনাকে দেখেই বুঝতে পারছি, কোনো কিছু লুকাচ্ছেন আমার কাছে।
– কি লুকাবো?
– বলুন না, কি হয়েছে? আমার বড় কোনো অসুখ ধরা পরেছে?
আবরার মুহুর্তেই ফারহার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে থামিয়ে দিলো তাকে। আর শান্ত ভাবে বললো,
– শুনবে কি হয়েছে?
– হুম, বলুন না। আমার খুব টেনশন লাগছে।
– বাড়িতে নতুন অতিথি আসছে।
ফারহা না বুঝে বললো,
– কে আসবে?
আবরার একটু হেসে বলে,
– হতে পারে কোনো রাজপুত্র, নয়তো রাজকন্যা।
ফারহা এবার কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে পাশ থেকে একটা বালিশ নিয়ে আবরারকে মা’রতে শুরু করলো। মা’রতে মা’রতে বললো,
– এমন একটা খুশির বিষয়ে আপনি এমন গম্ভির হয়ে ছিলেন? মন খারাপ হয়ে ছিলেন? আর জানেন আমি কতো টেনশনে ছিলাম? কেন করেছেন এমন, বলুন বলুন।
আবরার বালিশের বারি খেতে খেতে বলে,
– তোমাকে রাগাতে ভালো লাগে তাই। আর সত্যিই বাবা হওয়ার অনুভুতি আমাকে সব ভুলিয়ে দিয়েছিলো।
,
,
দুই বছর পর। ছেলে হয়েছিলো আবরারের। বসতে শিখেছে মাত্র। দাদির সাথে বসে ছিলো সে। আবরার আর ফারহা বের হবে ঈদের শপিং করতে। ঈদ ঘনিয়ে এসেছে। সন্ধার পর বের হলো দুজনই।

শপিং মলে কাঁন্নার শব্দ কানে আসতেই লোকজন জড়ো হয়ে যায় সেখানে। ফারহা পাগলের মতো আবরারের দিকে চেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো,
– আমার বাবু কোথায়? আমার ফাহাদ। মুহুর্তের মাঝে কোথায় চলে গেছে? কে নিয়ে গেছে তাকে? আমার বাবুকে এনে দিন।
বলেই আবার কাঁদতে থাকে ফারহা। পুরো শপিং মলে হই হুল্লার লেগে গেলো। পুরোটা খুজেও ছোট ফাহাদকে পাওয়া গেলো না। সি’সি’টিভি ফুটেজ দেখলে দেখে একটা লোক কোলে করে নিজের বাচ্চার মতো নিয়ে বের হয়ে গেছে। কিন্তু মুখটা কোনো ভাবেই দেখা গেলো না। সারা শরিরে শুধু চোখ দুটি দেখা যাচ্ছিলো। সেই রাতের মাঝেই যেন কোথায় হাড়িয়ে গেলো তাদের ছোট্ট ফাহাদ৷
,
,
বিশ বছর পর।
– তুমি আবার ভাইয়ার ছবি নিয়ে কাঁদছো মা?
ফারিহা পেছন থেকে গিয়ে কথাটা বলতেই চোখের পানি মুছে নিলো ফারহা। মেয়ের দিকে চেয়ে করুণ চোখে বলে উঠে,
– আমার ফাহাদ কবে ফিরবে রে মা? নাকি কখনো ফিরবে না?
ফারিহা মায়ের দিকে চেয়ে বলে,
– ভাইয়া ফিরে এলে তুমি তাকে চিনতে পারবে?
ফারহা চোখের পানি মুছে বললো,
– আমার ছেলেকে চিনতে আমার একটুও ভুল হবে না। ওর শরিরে এমন একটা চিহ্ন আছে যেটা দেখে আমি আরো বিশ বছর পর হলেও চিনতে পারবো।
ফারিহা আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো,
– কি সেটা?
ফারহা আবারও ছবির দিকে তাকিয়ে বলে,
– ওর পিঠে কোনাকোনি ভাবো বড় একটা কা’টা দাগ আছে। যেই কাটার জন্য আমার ছোট্ট ফাহাদ ১ মাস হসপিটালে ছিলো। অনেক কষ্টে ফিরে পেয়েছিলাম। এর পর আবার হারিয়ে ফেললাম।
ফারিহা মাকে সান্তনা দেওয়ার জন্য বললো,
– দেখবে আমি এক সময় ঠিকই ভাইয়াকে খুজে নিয়ে আসবো।

তবুও যেন মনটা বুজলো না ফারহার। রাতেও ছেলের ছবির দিকে চেয়ে কাঁদছিলো। কারণ আজ তার ছেলের জন্মদিন। এর মাঝে আবরার এসে ফারহাকে কাঁদতে দেখে, ফারহার মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে বলে,
– আবারও সেই পুরোনো স্মৃতি নিয়ে কাঁন্না করছো?
ফারহা আবরারের দিকে চেয়ে বলে,
– ছেলেটা তো আমারই। কেন ফিরে আসেনা এখনো? আমাকে আল্লাহ্ সব কিছু দিয়েও কেন আমার ছেলেটার থেকে দুরে রাখলো?
আবরার তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
– সৃষ্টি কর্তা যা করে প্রত্যেকটার পেছনেই উত্তম কোনো পরিকল্পনা থাকে। হয়তো আবার আমাদের বুকে আমাদের ছেলেকে ফিরিয়ে দিবে সে। আর না দিলেও এর পেছনে ভালো কিছুই থাকবে।
বলেই ফারহাকে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখলো সে। এই ২৩ বছরে যেন ভালোবাসা একটুও কমেনি।

এভাবেই বুকে জড়িয়ে কোনো এক জোৎস্নার আলোয় চাঁদকে শাক্ষি রেখে চিৎকার বলতে চায় সে,
~ তোমার জন্য আমি #তোমার_ছায়া হয়ে যাবো। এভাবেই পাশে রবো বাকি জীবন। কারণ কঠিন পরিস্থিতিতেও কখনো ছারা মানুষকে ছেরে যায় না। আমি সেই ভাবে #তোমার_ছায়া হয়েই তোমার পাশে থেকে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করলাম এই রাতকে শাক্ষি রেখে। কখনো হারিয়ে যাওয়ার ভয় থাকবে না।

কিন্তু আজও সেই কথাটা বলা হলো না। আমি যে #তোমার_ছায়া হয়ে থাকতে চাই।

~ সমাপ্ত,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here