নুজাইরাহ,সূচনা_পর্ব

0
1813

#নুজাইরাহ,সূচনা_পর্ব
#written_by_Liza

আড়াই বছরের মেয়েকে কোলে করে শশুড় বাড়িতে উঠলো নাফিজ আলম, রান্নাঘর থেকে শাশুড়ী কোমড়ে শাড়ির কুঁচি বেঁধে বেরিয়ে আসে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে তার বড় মেয়ের জামাই নাফিজ আলম ফুলের পাঁপড়ির মতো একটা বাচ্ছাকে কোলে নিয়ে দাড়িয়ে আছে।

নাফিজ আলমের শাশুড়ী ভ্রু কুঁচকে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে, বোঝাই যাচ্ছে বেশ বিরক্ত মেয়েটার উপর। নাফিজ আলম মৃদু হেসে শাশুড়ীকে সালাম দেয়। নাফিজ আলমের শাশুড়ী দিলজাহান বেগম নাক সিটকে রান্না ঘরে চলে যায়, সালামের জবাবটাও দেয় না।

নাফিজ আলম পা টিপে টিপে তার বউয়ের পাশে বসলো। নাফিজের বিয়ে হয়েছে বেশি দেরী হচ্ছে না। নাফিজের কোলে বাচ্ছাটিকে দেখে ইশারায় জিজ্ঞেস করে “বাচ্ছাটি কে?”

আড়াই বছরের বাচ্ছাটি ড্যাব ড্যাব করে নাফিজের দিকে তাকিয়ে গালদুটো ধরে আছে। চোখমুখে বেশ ভয় মেয়েটির। নাফিজের বউ হালকা হেসে বাচ্ছাটিকে কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর বলে “আচ্ছা ওর নাম কি?,কে হয় তোমার? আগে তো কখনো দেখিনি”

নাফিজ আলম ইতস্তত হয়ে কয়েক ঢক গিলে কথাটা অস্ফুট স্বরে বলে “ওর নাম নুজাইরাহ,ও আমার বড় ভাইয়ের মেয়ে”

নুজাইরাহ নাম শুনে খানিকটা ভড়কে যান নাফিজ আলমের সদ্য বিবাহিত স্ত্রী মেহেরীমা। মনে মনে ভাবছে মেহেরীমা “নাফিজের তো বড় ভাইয়ের ছেলে আছে জানতাম। মেয়ে আছে বলে তো জানতাম না। নাফিজের ভাইয়ের নামটা হ দিয়ে শুরু। হামিদ। তাহলে নুজাইরাহ কেন দিয়েছে নাম? ব্যপারটা কেমন যেনো।”

“কি ভাবছো তুমি? ওকে কিছু খেতে দাও” নাফিজের ডাকে মেহেরীমার ভাবনার ঘোর ভাঙ্গে, মেহেরীমা হকচকিয়ে বলে ওঠে “কিছু না। নামটা বেশ সুন্দর ওটাই ভাবছিলাম। ঠিকাছে বসো আমি খাবার আনছি”

নাফিজকে বসিয়ে মেহেরীমা রান্নাঘরে চলে গেলো,রান্নাঘর থেকে আওয়াজ ভেসে আসছে
“পারবো না রোজ রোজ বসিয়ে খাওয়াতে, বিয়ে হয়েছে তোর। তোকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে না কেনো এখনো তোর শশুড়বাড়িতে, কি সমস্যা? মেয়েটা কে? বের হয়ে যেতে বল”

নাফিজ আলম সবটা শুনে মলিন মুখে বাচ্ছাটার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করছে। নুজাইরাহ নাফিজের দিকে তাকিয়ে বলে “পাপা কতায় এতেতি”
নাফিজ আলম কোনো কথার উওর না দিয়ে নুজাইরাহকে বুকে জড়িয়ে নেয়, চোখের কোণা বেয়ে পানি শ্রোত যেনো অঝর ধারায় বেয়েই চলেছে। কোনোমতে চোখের পানি আটকে মৃদু হেসে বলে নুজাইরাহকে কানে কানে ফিসফিসিয়ে “এটা তোমার নানুর বাড়ি”

নুজাইরাহ মুখে হাত দিয়ে বলে “তত্তি?”

নাফিজ আলম নুজাইরাহ’র কথাশুনে হেসে দেয়। মেহেরীমা হাতে খাবার নিয়ে এসে নাফিজকে বলে “কি কথা হচ্ছে হুম আমাকে ফেলে? কি প্লান চলছে?”

নুজাইরাহ রীতিমতো ভয়ে আবারো চুপসে যায়, নাফিজ আলম হেসে বলে “কিছু না দুষ্টুমি করছিলো একটু”

মেহেরীমা নুজাইরাহকে কোলে বসিয়ে খাবার তুলে দেয় মুখে, নুজাইরাহ মুখ ফিরিয়ে নাফিজের দিকে তাকিয়ে আছে। নাফিজ আলম বলে ওঠে “নুজাইরাহ খেয়ে নাও”

নুজাইরাহ ড্যাব ড্যাব করে মুখ উঁচু করে তাকিয়ে আছে মেহেরীমার দিকে,মেহেরীমা খাবার তুলে দিয়ে বলে “খেয়ে নাও মা”
অস্ফুট স্বরে নুজাইরাহ বলে উঠে “পাপ্পার আতে কাবো”

নুজাইরাহ’র মুখে পাপা ডাক শুনতে দু হাত আলগা হয়ে যায় মেহেরীমার। বুক মুচড়ে ওঠে। মেহেরীমা মূহুর্তে যেনো জমে শক্ত হয়ে আছে, মেহেরীমা মনে মনে ভাবছে “তার মানে নাফিজের আগের কোনো অতীত আছে? এই মেয়েটা কি নাফিজের’ই সন্তান?”

নাফিজ তড়িঘড়ি করে বলে উঠে মেহেরীমাকে
“কি হলো তোমার? আমার ভাইয়ের মেয়ে আমাকে পাপা ডাকতে পারে না নাকি? এটা নিয়ে এত সিরিয়াস হচ্ছো কেন তুমি?”

নাফিজের এমন কথায় মেহেরীমা চুপ করে আছে আর ভাবছে “হতেও পারে ভাইয়ের মেয়ে। আমি তো এখনো ঐ বাড়িতে যায় নি। আজ বিয়ে হয়েছে ন’মাস,তাই সবাইকে চিনি না। নাফিজ আমাকে মিথ্যা বলছে না হয়তো। শুধু শুধুই বেশি ভাবছি আমি”

নাফিজ আবারো বলে উঠে “কি হলো কোথায় হারিয়ে গেছো তুমি?”

মেহেরীমা হকচকিয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলে “কিছু না। তোমার হাতে খাবে বলছে খাইয়ে দাও”
খাবারটুকু এগিয়ে দিয়ে মেহেরীমা নাফিজকে বলে “কবে নিয়ে যাবা আমায় বাড়িতে? এভাবে আর কতদিন এখানে ফেলে রাখবা আমায় বলোতো। এটা কি ঠিক? আশেপাশে মহল্লার মানুষ কানাঘুঁষা করেই চলেছে। মায়ের কানে তো সব আসে। মা এসব শুনে আমাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছে। আমার বাবার অবস্তা তো জানোই। ক্যান্সার হয়েছে। সে যদি আমার সুখটুকু দেখে যেতে না পারে। তাহলে আমি মেয়ে হিসেবে কি দিলাম বাবাকে?”

নাফিজ আলম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেহেরীমার হাত ধরে বলে “খুব শীঘ্রই নিয়ে যাবো তোমায়। একটু ধৈর্য ধরো মেহু”

মেহেরীমা নাফিজের কথায় আশা নিয়ে চুপ করে আছে। নাফিজ নুজাইরাহকে খাইয়ে দিয়ে খেলতে বলে বাহিরে, নুজাইরাহ নাফিজের চোখ ফাকি দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো।

রান্নাঘরে বসে বটি দিয়ে আলু কাটছে দিলজাহান বেগম,নুজাইরাহকে দেখে রাগে বিষ্ফোরিত হয়ে তাকিয়ে আছে, আর বলছে বিড়বিড় করে “এই মেয়েটাই আমার মেয়ের সংসার ভাঙ্গার কারণ আমি বুঝতে পারছি ঢের”

নুজাইরাহ গিয়ে নাফিজের শশুড়ের পাশে বসলো। নাফিজের শশুড় শুয়ে আছে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে, নুজাইরাহ ছোট্ট ছোট্ট হাতে নাফিজের শশুড় রফিক সাহেবের কপালে হাত রাখে,রফিক সাহেব চোখ খুলে দিয়ে নুজাইরাহ’র দিকে তাকায়।।

নুজাইরাহ বাকা হাসি দিয়ে রফিক সাহেবকে বলে “দাদু তোমার অতুক?আমি বালো করে দেই। ফু”

নুজাইরাহ’র বাচ্ছামো দেখে রফিক সাহেব উঠে বসে, অমনি দিলজাহান বেগম দৌড়ে এসে বলে
“এই ছ্যামরি যাহ, আমার জামাইটাকে ঘুমাইতে দিলি না। এই বলে ঠাস করে বাচ্ছা নুজাইরাহ’র গালে চড় লাগিয়ে দেয় দিলজাহান বেগম”

রফিক সাহেব হুংকার দিয়ে দিলজাহান কে বের করে দেয় তার রুম থেকে, ছোট্ট নুজাইরাহ কান্না চেপে ভয়ে রফিক সাহেবের বুকে ঢুকে পড়ে। রফিক সাহেব নুজাইরাহকে কান্না থামিয়ে ভুলিয়েবালিয়ে তার সাথে খেলা কর‍তে শুরু করে।
রফিক সাহেবের যেনো একটা খেলার সাথি মিলে গিয়েছে।

নাফিজ বাহিরে তন্নতন্ন করে শশুড়ের রুমের দিকে পা বাড়ালো। নাফিজ ভেতরে গিয়ে দেখে, নুজাইরাহ রফিক সাহেবের লম্বা দাড়ি নিয়ে খেলছে। নাফিজ সাহেব এ দৃশ্য থেকে কিছুটা স্বস্তি পেলো। নাফিজ সাহেব আতংকে ছিলো নুজাইরাহ মুখ ফসকে কেউকে কিছু না বলে দেয়।

রাত আটটার দিকে নুজাইরাহকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বাসার উদ্দেশ্যে, নুজাইরাহ মুখ ফিরিয়ে খেলা করছিলো গাড়িতে,হঠাৎ খেয়াল করে দেখে নাফিজ, নুজাইরাহ’র গালের একপাশে গলার উপরিভাগে লালচে হয়ে আছে। নাফিজের বুক মুচড়ে উঠে। নাফিজ কাঁপা কাঁপা হাতে নুজাইরাহ’র গালে হাত ছোঁয়াতে গেলেই নুজাইরাহ ব্যথায়, সেই লালচে জায়গায় হাত দিয়ে মালিশ করতে থাকে আর বলে “পাপা পাপা দানো? ঐ দাদুটা না আমাকে এম্নে অক্কু দিছে।আমি তুব ব্যথা পাইতি”

নাফিজ আলম নুজাইরাহকে বুকে জড়িয়ে কেঁদে দেয়, নুজাইরাহ কিছু বুঝতে না পেরে নাফিজের দিকে তাকিয়ে আছে। নাফিজ আলম বাসায় এসে তার মাকে বলে “নুজাইরাহ’র যেহেতু মা নেয় আমি ওর জন্য আবার বিয়ে করবো।”

নুজাইরাহ’র দাদি নুজাইরাহকে কোলে নিয়ে বলে “আমার নাতিনডার কফালে দুখ আনিস না ফুত। আমার নাতিনডারে মারবো”

মায়ের কথায় খানিকটা ভড়কে গেলেও নাফিজ আলম কিছু বলে না। নাফিজ আলম ভালো করেই জানে মেহেরীমা অমন মেয়ে নয়।

নাফিজের মা নুজাইরাহকে কোলে নিয়ে অন্যরুমে চলে যায়। নাফিজ আলম চুপচাপ সোফায় ভাবছে “কি করেছে নুজাইরাহ,এভাবে কি করে আঘাত করতে পারলো বাচ্ছা মেয়েটাকে। কিভাবে মেহেরীমাকে ঘরে বউ করে আনবে তা ছক কষতে লাগলো নাফিজ আলম”

নুজাইরাহ নাফিজের আঙ্গুল ধরে বলে “পাপা পাপা ওতা কি আমাল আম্মু?”

নাফিজ আলম নুজাইরাহ’র মুখ চেঁপে ধরে ইশারায় মাথা নাড়িয়ে এসব কথা বলতে নিষেধ করে, নাফিজের মা আড় পেতে সবটা শুনে ফেলে

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here