নুজাইরাহ,৪র্থ_পর্ব

0
1073

#নুজাইরাহ,৪র্থ_পর্ব
#written_by_Liza

পরবর্তীতে এমন কিছুর হদীস পেলে ভুলে যাবো তুমিও আমার মা ছিলে”

এই বলে মেহেরীমা নুজাইরাহকে নিয়ে বাপের বাড়ি থেকে চলে আসে।

নুজাইরাহ কে নাফিজ আলম দু চোখে সহ্য করতে পারছে না, যেনো চোখের বালি। নুজাইরাহ, নাফিজ আলম বাসায় আসলে নাফিজ আলমের সামনে যায় না। নাফিজ আলম জুরাইনাহ কে নিয়ে ব্যস্ত থাকে প্রায়। বাহির থেকে আসার সময় সবসময় জুরাইনাহ’র জন্য চকলেটের বক্স হাতে করে নিয়ে আসে। দিন দিন যেনো নাফিজ আলমের পরিবর্তন ঘটছে।

পরিবর্তনগুলো নাফিজের মায়ের চোখে পড়ে, নাফিজের মা ভালো করেই জানে এগুলা দিলজাহান বেগমের কাজ। উনি ছেলেকে বশ করে এমন অবস্তা করেছে। নাফিজ আলমের মা নুজাইরাহকে মন খারাপ করতে নিষেধ করতে,নামাজ পড়তে বলে।
নুজাইরাহ ছিলো বুদ্ধিমতি,পড়াশোনায় এগিয়ে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কায়েম করতো।

দিলজাহান বেগম চাইতো জুরাইনাহ সবদিকে গুনবতী হোক। দিলজাহান বেগম আস্তে আস্তে জুরাইনাহ’র মনে নুজাইরাহ’র জন্য হিংসা ঢোকাতে শুরু করে।
শুরু হয় নুজাইরাহ’র জীবনে ঝড়।এতদিন পরিবারের ভালোবাসা পেলেও শেষ টুকু ভাগ্যে আর জোটে নি।

জুরাইনাহ হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছে,নুজাইরাহ এস এস সি দিবে।একসাথে আসাযাওয়া ছিলো দুই বোনের, জুরাইনাহ আইস্ক্রিম, চকলেটের লোভে নুজাইরাহ’র পেছনে লাগতে শুরু করে।

বিকেলে স্কুল ছুটি হয়েছে,নুজাইরাহ কোচিং করে বাড়ি ফিরছে, সাথে জুরাইনাহ আছে। রাস্তায় নেতার নাতি ‘ইহাম’ দাড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে। ইহাম নুজাইরাহকে দেখতে পেয়ে সামনে এগিয়ে আসে আর বলে “আংকেল কি আর কিছু বলেছে তোমায় সেদিনের পর?”

নুজাইরাহ বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে না সম্মতি দিয়ে পাশ কেটে বাড়ি চলে আসে। জুরাইনাহ সবটা দেখে মাথা নাড়িয়ে মনে মনে বলছে “আজ বাড়ি যা।মা-বাবাকে আমি সবটা বলছি দাড়া”।

নুজাইরাহ বাড়ি এসে গোসল করতে চলে যায়,সারাদিনের ক্লান্তি শরীরটা গোসল নিয়ে নামাজ পড়ার জন্য তৈরি হচ্ছে৷ এদিকে জুরাইনাহ রুমে গিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে আর জোরে জোরে বলছে ” দেখেছো আব্বু কি হয়েছে?”

নাফিজ আলম ও মেহেরীম চা খাচ্ছে বসে। নাফিজের মা তজবীহ হাতে নিয়ে তজবীহ পড়ছে। রুমের ভেতর থেকে নাফিজের মেঝো বোন দৌড়ে এসে বলে
“কিতা অইছে? চিল্লাইতেছোস কেরে? (কি হয়েছে?চেচাচ্ছিস কেন?)”

জানো ফুফু কি হয়েছে? তোমাদের আদরের নুরা ঐ ছেলের সাথে আজকেও কথা বলেছে। দু’জনেই সে কি আড্ডা হাসাহাসি। আমাকে দেখেও কথা থামছে না দু’জনের (জুরাইনাহ)

জুরাইনাহ’র কথা শুনে হাত থেকে চাপের কাপ ঠাস করে পড়ে যায় নিচে মেহেরীমার। মেহেরীমা রাগী চোখে জুরাইনাহকে বলে “বড় বোনের নামে মিথ্যা বলা তুই শিখলি কোথা থেকে? নিশ্চয় সে তোকে কিছু খাওয়ার সময় ভাগ দেয় নি”

আম্মু তুমি সবসময় ঐ মেয়ের জন্য টানো,তোমার নিজের মেয়ের কথা কি তোমার বিশ্বাস হয় না? (জুরাইনাহ)

অমনি মাঝখানে ফোড়ন কেটে নাফিজের মেঝো বোন বলে
“আমি ইতা আগেই বুঝছি।মা ছাড়া মাইয়া আর কত ভালা হইবো।কেউরে কইতে লজ্জা করে এই মাইয়া আমার ভাইয়ের মাইয়া।বান্ধা গুরু ছাড়া পাইলে যা অয়।সক্কাল কিছু কর নাফিজ, নাইলে এই মাইয়া তোরে বেইচ্চা খাইবো।(আমি তো আগেই বুঝেছি।মা ছাড়া মেয়ে আর কত ভালো হবে। পরিচয় দিতে লজ্জা হয় আমার ভাইয়ের মেয়ে বলতে। বাধা গরু ছাড়া পেলে এমনি হয়। অল্পতে লাগাম দে নাফিজ।নইলে এই মেয়ে তোকে বেচাকেনায় লাগিয়ে দেবে)”

নাফিজ আলম রাগে থরথর করে কাঁপছে নুজাইরাহ’র উপর। নুজাইরাহ গোসল সেরে নামাজে দাড়িয়েছে। জুরাইনাহ মিথ্যা কথাগুলো বলে কাপড় পাল্টাতে চলে গেলো। মেহেরীমা মেঝো ননাসকে বলে উঠে “মাফ করবেন আপা,লজ্জা তো আমারো লাগে আপনাকে আপা বলতে, যে কি না নিজের ভাইয়ের মেয়েকে দুচোখে দেখে”

মেহেরীমার কথায় গর্জে উঠে নাফিজের মেঝো বোন আর বলে,
“হুনছোত নি নাফিজ? তোর বউয়ের কথা? হেতি আমারে তোর সামনে অপমান করতাছে আর তুই খাড়াইয়া খাড়াইয়া হুনতাছোস? কবে থেইকা বউয়ের দাস হইলি তুই? (শুনতেছিস নাফিজ? তোর বউয়ের কথা? সে আমাকে তোর সামনে অপমান করতেছে আর তুই দাড়িয়ে দাড়িয়ে শুনতেছিস? কবে থেকে বউয়ের চাকর হলি?)”

নাফিজ আলম আর দেরী করলো না,সজোরে এক চড় মারলো মেহেরীমাকে। মেহেরীমা মুখ থোবড়ে বিছানায় পড়ে, নাফিজের উপর গর্জে উঠে, নাফিজের মা “কি করতাছোস তুই? ফুড়িডারে এইভাবে মারলি ক্যান? (কি করতেছিস তুই? মেয়েটাকে এভাবে মারলি কেন?)”

নাফিজ আলম বেরিয়ে গেলো, মেঝো বোন গাল টিপে হেসে রুমে এসে বড় ভাইকে ফোন দেয় আর বলে

“কাম হইতাছে, আইজ নাফিজ ঐ বেডিরে মারছে। তুমি বড় আফার কিতা করলা কও ছাইন। আফা থাকলে জায়গা জমি কিচ্ছুই পাইতাম না। ছাটাই করা লাগবো। আফা খালি নাফিজরেই সবতা দিবো।দরদ বেশি (কাজ হয়েছে,আজ নাফিজ ঐ মহিলাকে মেরেছে। তুমি বড় আপুর কি করলে বলো তো। আপু থাকলে জায়গা জমি কিছুই পাবো না। বিদায় করা লাগবে দুনিয়া থেকে।আপু শুধু নাফিজকেই সব দিবে। দরদ বেশি)”

“এত চিল্লাইস না, সব কাম হইতাছে আস্তে আস্তে, বড় আফারে মেয়াদি বান মারছি। হার্টো অসুক এর ভিত্রে বান, মইরা যাইবো কদিন বাদেই। তুই এত মাতিস না বেক্কল (এত চিৎকার করিস না,সব কাজ হচ্ছে আস্তে আস্তে,বড় আপুরে মেয়াদ উত্তীর্ণ জাদু করেছি। হার্টে অসুখ এর ভেতর মেয়াদ শেষ হলে কদিন বাদে মরে যাবে। এত কথা বলিস না বেয়াক্কেল)” বড় ভাই বলে উঠে প্রতুত্তরে।

মেঝো বোন জায়গার লোভে স্বস্তির শ্বাস নেয়।
রাত হয়ে এসেছে মেহেরীমা শুয়ে আছে না খেয়ে। নুজাইরাহ গিয়ে খাবার নিয়ে মেহেরীমার পাশে বসে আর মেহেরীমাকে বলে “আম্মু খেয়ে নাও। কেন আমার হয়ে বলতে গেলে,আজ বাবা এভাবে মারলো তোমায়”

মেহেরীমা নুজাইরাহকে কিছু না বলে ইশারায় খাইয়ে দিতে বলে। নুজাইরাহ মেহেরীমাকে খাইয়ে দেয়। মেহেরীমার চোখ বেয়ে ঝড়ছে অঝোরে পানি। মেহেরীমা নুজাইরাহকে খাইয়ে দিয়ে মা মেয়ে অন্যরুমে ঘুমাতে চলে যায়।

এভাবে দিন কাটছে,মেহেরীমা ও নুজাইরাহ কারো চোখে পরতে পারছেনা। বাড়ছে নির্যাতন।মেহেরীমা নিজের বাপের বাড়ি গিয়ে যে শ্বাস নিবে তার কোনো জো নেয়। কারণ মেহেরীমার মা ও তাদের দলে। ভালো বলতে শাশুড়ী ও বড় ননাস। আর কেউ তাদের দুচোখে দেখতে পারে না।

এস এস সি পরীক্ষা শেষ হয় নুজাইরাহ’র। দিলজাহান বেগম নাফিজকে ফোন করে বলে নুজাইরাহকে কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে পাটাতে। নাফিজ আলম দিল জাহানের কথায় উঠবস করে। রাতে নাফিজ আলম বাহির থেকে এসে মেহেরীমাকে বলে “কাল কাপড়চোপড় বেধে নুজাইরাহকে দিয়ে আসবে মায়ের কাছে। পরীক্ষা শেষ যখন মাকে টুকটাক হাত বাড়িয়ে কাজটাজ করে দিবে নুজাইরাহ। বয়স হয়েছে মায়ের,এমনিতেও ঘরে বসে প্রেম পিরিতি ভালোই শিখেছে তোমার প্রশ্রয়ে, এবার একটু কাজ করুক”

নাফিজের এমন কথায় মেহেরীমা হতভম্ব হয়ে আছে,কি বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা। মেহেরীমা কেউকে কিছু না বলে কাপড় গোছাতে শুরু করে। নুজাইরাহ জিজ্ঞেস করলে, মেহেরীমা বলে উঠে
“আমরা মা মেয়ে বেড়াতে যাবো। এই চারদেয়ালে দম বন্ধ হয়ে আসছে,এভাবে থাকলে মরে যেতে হবে আমাদের”

নুজাইরাহ মায়ের কথামতো কাপড় গুছিয়ে নেয়, একমাত্র শেষ সম্বল আশা ভরসা মা ও দাদী। এরা ছাড়া নুজাইরাহকে কেউ বুঝে না। বাবা তো কবেই বদলে গিয়েছে,আগের মতো নুজাইরাহকে দেখতে পারে না। না খেয়ে পড়ে থাকলে খোজ অব্দী নেয় না।

সকাল বেলা নুজাইরাহ ও মেহেরীমা রওনা দেয় বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে। মেহেরীমাকে নুজাইরাহ’র সাথে দেখে দিলজাহান বেগম খানিকটা ভড়কে যায়, তোতলাতে তোতলাতে বলে “তুই?”

বারেহ! বাপের বাড়ি আসবো এত কৈফিয়ত দেবো কেন (মেহেরীমা)
মেহেরীমা নুজাইরাহ’র হাত ধরে ভেতরে ঢুকে দিলজাহানকে পাশ কেটে। দিলজাহান বেগম কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপসে যায়। দিল জাহানের সকল চিন্তাভাবনায় যেনো এক ঘটি জল ঢেলে দিয়েছে তার মেয়ে মেহেরীমা।

বিকেলে দিলজাহানের ঘরে বুড়ো এক লোক আসে পান চিবোতে চিবোতে খাটের উপর পা তুলে বসে। নুজাইরাহ চা বানিয়ে মেহেরীমার হাতে দেয়, মেহেরীমা চা খাচ্ছে। বুড়ো লোক দিলজাহান কে ইশারা করে বলে “কই নাতনি দেখি এদিকে আনো”

দিল জাহান বেগম নুজাইরাহকে ডেকে বলে “নুজাইরাহ এই ছ্যমরি এদিকে আয়”
নুজাইরাহ মেহেরীমার দিকে তাকিয়ে আছে। মেহেরীমা চোখ বন্ধ করে অভয় দেয় যাওয়ার জন্য। মেহেরীমা ভেবেছে এমনি ডাকছে নুজাইরাহকে তারা। তাই মেহেরীমা সম্মতি দেয়।

নুজাইরাহ সামনে গিয়ে দাড়ায় মাথায় তার উড়না, উড়নার কারণে মুখ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না মেহেরীমার। লোকটি জ্বীভে চুন লাগিয়ে বলে দিলজাহানকে “কি মেয়ে আনলা আমার জন্য,মুখটা ও দেখিনা। এখুনি বউ সেজে বসে আছে।”

দিলজাহান বেগম নুজাইরাহ মাথার উড়না টান দিতেই মেহেরীমা তার মায়ের হাত ধরে ফেলে,দিল জাহান বেগম মেহেরীমাকে বলে “ছাড়”

মেহেরীমা নুজাইরাহকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে আর বুড়ো আধবয়সী লোককে বলে “কেন এসেছেন? নুজাইরাহকে কি দরকার?”

পাত্রী দেখতে আসছি (বুড়ো)

কার জন্য? (মেহেরীমা রাগী স্বরে)

আমার জন্য।কিরে দিলু (দিলজাহান) তুই না কইলি তোর মেয়ে তোর কথা শুনে? এডা এত ত্যারা ক্যা (বুড়ো)

এক পা কবরে রেখে এসে কচি মেয়ে বিয়ে করতে আসছেন? তাইলে নিজের কোনো ভাতিজি বা বোনের মেয়েকে বিয়ে করুন। বেয়াদব (মেহেরীমা)

দিলু এডা কেমন কথা,আমি আমার বোন ঝী রে বিয়া করমু? আমার পেডের হমান মাইয়ারে?তুই ডাইকা আইনা আমারে অফমান করাইতেছোস।টাহা নেওয়ার আগে মনে আছিলো না তোর? (বুড়ো)

মেহেরীমার চোখ চড়কগাছ টাকার কথা শুনে,মেহেরীমা এবার বলে উঠে “ওহ তাই বলি এত দরদ কেন উতলে উঠেছে আমার মেয়ের জন্য,আমার মেয়েকে এনে টাকা দিয়ে বিক্রি করতে চেয়েছিলে এই বুড়ো লোকের কাছে? বাহ মা।ক’দিন বাদে মরেই যাবা এখনো এসব ছাড়ো নি।তোমার এই অবৈধ কাজের জন্য আমার মৃত বাবা কবরে আজাব সহ্য করছে দিনের পর দিন। আল্লাহর পথে আসো মা। এসব ছেড়ে দাও।ভাগ্যিস আমি আজ এসেছি। তা না হলে আমার মেয়েটাকে আমি হারাতাম”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here