শুষ্ক_পাতার_ভাজে?১৮.

0
2181

শুষ্ক_পাতার_ভাজে?১৮.
#লাবিবা_তানহা_লিজা?

সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে রায়ানের বুকে পায় তৃনা । রায়ানের দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপে চোখের জল ফেলে । ঘুমন্ত মুখটায় হাত দিতে গিয়ে হাত নামিয়ে নেয় । সরে যেতে নিলেই রায়ানের ঘুম ভেঙ্গে যায় । দুই হাতে তৃনাকে আটকে ধরে । কিন্তু তৃনা জোরে ধাক্কা দিয়ে উঠে যায় । বাথরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে গলা ছেড়ে কাদে । কান্নার আওয়াজটা রায়ানের কান অব্দিও চলে আসে । আজ সব চেয়ে বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে । রায়ানের চোখ বেয়েও জল গড়িয়ে পড়ে কোন ভাবেই আটকাতে পারছে না নিজেকে । ঘন্টা খানেক পর তৃনা বেড়িয়ে আসে । রায়ান আড় চোখে তৃনার দিকে তাকায় । নতুন বধু বিয়ের পরের দিন সদ্য গোছল করে নতুন শাড়িতে ভেজা চুলে বের হওয়া এমন রুপ দেখে নিমেষেই মুখে প্রশান্তির ছোয়া মেলে রায়ানের । তৃনা রায়ানের দিকে একবার তাকিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে রুম থেকে বেড়িয়ে যায় । ডাইনিং এ এসে রায়ান দেখে তৃনা সবার সামনে খাবার সার্ভ করছে । রায়ান বসতেই রায়ানের প্লেটে খাবার দিয়ে পাশে বসে পড়ে তৃনা । সবকিছু নরমাল বাট রায়ানের সাথেই কথা বলছে না । এমন ব্যবহার রায়ান মেনে নিতে পারছে না কিছুতেই । তৃনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে সবটা সুন্দর করে গুছিয়ে নিবে খেতে খেতে ভাবে । কিন্তু তৃনা কি তাকে ক্ষমা করবে ? তৃনার দিকে তাকিয়ে ভাবছে রায়ান । তৃনা আড় চোখে দেখছে আর অসস্তি ফিল করছে । আর যাই হোক কেউ এভাবে খেতে পারছে না । রুমু এসে বলে ” গুড মর্নিং মাম্মা পাপা”
রায়ান রুমুকে ধরে কোলে তুলে নিয়ে বলে,” গুড মর্নিং মাই প্রিন্সেস । ঘুম ভেঙেছে আমার প্রিন্সেসটার?”
” ইয়েস পাপা। মাম্মা ক্ষুদা লাগছে ।”
তৃনা মিস্টি হেসে রুমুর কপালে চুমু দিয়ে নুডুলসের বাটি থেকে চামচ দিয়ে নডুলস খাইয়ে দেয় । রুমু রায়ানের সাথে কথা বলতে বলতে খেতে থাকে ।রোহান রোহানা এই দৃশ্য দেখে মুচকি হেসে খাওয়া শেষে চলে যায় । রুমু খাওয়া শেষ করেই লাফাতে লাফাতে চলে যায় দাদুর কাছে । তৃনা বাটি গুছিয়ে উঠতে নিলেই রায়ান হাত টেনে ধরে ধপ করে চেয়ারেই বসিয়ে দেয় । তৃনা তাকাতেই বলে,
“তুমি তো কিছুই খেলে না। বস আমি খাইয়ে দিচ্ছি । ”
রায়ান পরটা ছিড়ে তৃনার মুখের সামনে ধরে । তৃনা পরটার দিক তাকিয়ে আছে চুপ চাপ।
” তৃনলতা…. হা করো আমার বউটা ।”
বুক কেপে উঠে তৃনার । অশ্রু সজল চোখে রায়ান দিকে তাকায় । রায়ান চোখ মুছে দেবার জন্য হাত বাড়াতেই তৃনা বলে, ” এভাবেই খাইয়েছেন লিনা মনা ছোয়াকে তাই না ?” থমকে যায় রায়ান । মাথাটা নিচু হয়ে যায়। তৃনা উঠে রুমে চলে আসে । রায়ান উঠে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় । ফিরে আসে রাত করে । সব কিছু এলোমেলো লাগে রায়ানের কাছে । রুমে ঢুকেই দেখে তৃনা বসে আছে খাটে হেলান দিয়ে একটা ম্যাগাজিন হাতে। সাথে রুমু খাটে শুয়ে ঘুমুচ্ছে । তৃনা রায়ানকে দেখে উঠে দাড়িয়ে বলে ” মম আপনাকে খাবার দিতে বলেছে আমায় । ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি খাবার দিচ্ছি ।” তৃনা পা বাড়াতে ডাকে রায়ান
” তৃনলতা…”
ফিরে তাকায় তৃনা । দু হাত ধরে খাটের সামনে এসে দাড় করিয়ে বলে ” বসো। ” তৃনা বসে । তৃনার সামনে হাটু ভাজ করে বসে তৃনার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নেয় । তৃনা খেয়াল করে রায়ানকে । অগোছালো লাগছে অনেকটা । নিজেই জিজ্ঞাসা করে
” কিছু বলবেন আমায় ?”
মাথা নাডায় রায়ান ।
” একটা সত্য কথা বলবে তৃনলতা ?”
” বলুন। ”
” তুমি কি চাও না আর আমার ভালোবাসা ?”
” আমি আর আগের মতো বোকা নই । ”
” কিন্তু আমি তো বোকা হয়ে গেছি । কাঙ্গাল হয়ে গেছি তোমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য । খুব বেশি ভালোবাসি তোমায় তৃনলতা । বিশ্বাস করো খুব ভালোবাসি । তুমার মায়ায় পড়ে গিয়েছি । ভালোবাসা না পাওয়ার বেদনা আমিও বুঝি তৃনলতা । আমার জীবন থেকে যেদিন হারিয়ে গিয়েছিলে সেদিন থেকে বুঝেছি তোমাকে কতটা ভালোবাসি আমি । আমি খুব খুজেছি তোমায় তৃনলতা । কোথাও পায় নি । জানতাম তোমাকে আর আমার জীবনে জড়াতে পারবোনা কারন লিনা ছিলো আমার জীবনে তবুও একবার সরি বলার জন্য খুজেছি তোমায় । তোমার বাসা পর্যন্ত খুজেছি আমি পাই নি তোমায় । আজ এতোবছর পর তোমাকে পেলাম । আল্লাহ নিজে আমাদের মিলিয়ে দিয়েছে এর জন্য তার দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া। আর কিচ্ছু চাই না আমার তুমি ছাড়া । খুব ভালোবাসি তোমায় তৃনলতা । খুব ভালোবাসি । একটু ভালোবাসবে আমায়? জাস্ট একটুখানি ভালোবাসলেই চলবে । ”
” আমি আপনাকে ভালোবাসি মি.রায়ান চৌধুরী । মিথ্যা বলবো না । খুব ভালোবাসি । এতোদিন যেভাবে ভালোবেসেছি সেভাবেই ভালোবেসে যাবো অনন্তকাল ধরে । ”
উঠে দাড়ায় তৃনা । অঝোরে পানি পড়ছে রায়ানের চোখ দিয়ে । রায়ানকে দেখে মুচকি হাসে তৃনা ।
” ভালো লাগলো আমার জন্য আপনার চোখে জল দেখে । নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে হচ্ছে । ”
” আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না তৃনলতা ? একটুও ভালোবাসা যায় না ?”
” ভালোবাসিতো । আপনাকে । আপনার হৃদয়টাকে ভালোবাসি । আমার ভালোবাসা একটু অন্যরকম । অন্যদের মতো ধন দৌলত আর সৌন্দর্যকে ভালোবাসতে পারি না আমি । ”
কেদে উঠে রায়ান । উঠে গিয়ে তৃনাকে জড়িয়ে ধরে রায়ান । তৃনাও মুচকি হেসে রায়ানকে জড়িয়ে ধরে কেদে উঠে । নিজেকে সামলে নিয়ে বলে ” আপনি ব্যর্থ। আপনি আপনার ভালোবাসার সঠিক মর্যাদা দিতে পারেন নি । কেউ যদি কাউকে ভালোবাসে তাহলে অন্য কারো প্রতি মুগ্ধ হয়ে রিলেশনশিপে জড়াতে পারে না । কেন করলেন বলুনতো এমন? ভালোই তো ছিলো সব । ”
” আমার ভুল হয়ে গেছে তৃনলতা । লিনা নামের মেয়েটা আমার সব কেড়ে নিয়েছে । তোমাকে আমার থেকে আলাদা করে দিয়েছে । আমি কখনো কাউকে ভালোবাসিনি শুধু তুমি ছাড়া তৃনলতা । আমিতো সব সম্পর্ক শেষ করে তোমার কাছে যেতে চেয়েছিলাম । কিন্তু পারিনি । বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছিলাম। শেষে ঐ সম্পর্ক ই মেনে নিয়ে ছিলাম কিন্তু আমি ঠকে গেছি তৃনলতা । আমি সব হাড়িয়েছি ।নতুন করে বাচতে চেয়েও পায়নি । একটু শান্তির জন্য ঘুরে বেড়িয়েছি কিন্তু কারো কাছে একটু শান্তি পাই নি একটু ভালোবাসা পায়নি । তোমাকে আমার হৃদয় থেকেও সরাতে পারিনি । শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম আমি । একের পর এক জি এফ পাল্টিয়েছি কিন্তু কেউ তোমার মতো ভালোবাসতে পারেনি । আমি নষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম তৃনলতা । কিন্তু যখন তৃষা আমার জীবনে আসে তখন থেকে অন্যদের থেকে আলাদা হতে থাকি আমি । তৃষার মাঝে আমি কেনো যেনো তোমাকে খুজে পেতাম । ভালো লাগতো আমার । তৃষার চালচলনে তোমার ছায়া পেতাম । সব কিছুতে আমি তোমাকেই খুজে পেতাম । তখন তো আর জানতামনা যে তৃষা তোমার ই বোন । আস্তে আস্তে বিয়ে পর্যন্ত ব্যপারটা এগিয়ে যায় । আমি মুখোমুখি হই তোমার । আজ তুমি আমার স্ত্রী । আমি তোমাকে নিয়ে নতুন জীবন গড়তে চাই তৃনলতা । আমি আমার সব টুকু ভালোবাসা উজাড় করে দিতে চাই তোমায় তৃনলতা । ”
” চাইলেই তো সব কিছু হয়না মি. রায়ান চৌধুরী । আমি চেয়েছিলাম । পায় নি তো । কিভাবে বিশ্বাস করি আপনাকে বলুনতো ? সেই জায়গাটুকু কি আপনি রেখেছেন ? আপনি কি জানেন লিনা আপু আপনাকে ছেড়ে গিয়ে উচিত কাজটা করেছে ! যে ছেলে একটার পর একটা মেয়ে ছাড়ে তাকে একটা মেয়ে ছেড়ে দিলে ক্ষতি কি?”
” আমি কিছু করিনি তখন তৃনলতা । ”
” মানলাম আপনি কিছু করেননি । তার পর তো আর বাকি রাখেন নি । কিসের ভালোবাসেন আপনি আমাকে ?আপনি আমাকে ভালোবাসতে পারেন নি । লিনা আপু চলে যাওয়ার পর খুজেছিলেন একটিবারের জন্য আমাকে? আমি কিন্তু ঠিক ই আপনার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম । তখন আপনি আপনার ছোট বাচ্চাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন । তারপর এই দুধের শিশুটাকেও এতিম করে চলে গেলেন নিজের দুনিয়ায় । আমাকে ভুলার নাম করে একটার পর একটা মেয়ের সাথে রিলেশনশিপে গিয়েছেন পেয়েছেন সাময়িক সুখ ছাড়া অন্যকিছু ? আপনি কি জানেন আমাকে ভালোবাসার নাম করে যতবার অন্য মেয়ের সাথে রিলেশনে গিয়েছেন ততোবার আমার ভালোবাসাকে অপমান করেছেন । একের পর এক মেয়ে নিজের লাইফে জড়িয়ে নিজে হাতে আমার ভালোবাসাকে মেরে ফেলেছেন আর নিজেকে বানিয়েছেন নষ্টা ছেলে । আপনি যতোই ভালোবাসেন না কেনো আপনার ভালোবাসা থেকে আমার ভালোবাসার গভীরতা শত গুনে বেশি । কই আমিতো এসব করিনি ? আপনার স্মৃতিকে জড়িয়ে সারাজীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আজ আপনাকে দেখলে আমার ঘৃনা হয় । আমি কিছুতেই পারছিনা আপনাকে মেনে নিয়ে আপনার সাথে সংসার চালিয়ে যেতে । আমার নিজের প্রতি ঘৃনা হয় এখন । ”
রায়ান তৃনার হাত মাথায় ঠেকিয়ে নিচে বসে বলে,
” এভাবে বলো না প্লিজ । আমি ভুল ছিলাম। প্লিজ তৃনলতা আমাকে ক্ষমা করো । আমি ক্ষমার অযোগ্য তবুও ক্ষমা চাইছি আমি । এতোটা শাস্তি দিও না সহ্য করতে পারবোনা আমি । ”
” শাস্তি! শাস্তি তো আপনি অবশ্যই পাবেন । আপনি শাস্তি না পেলে যে আমার পাপ হবে। আমি দেবো আপনাকে শাস্তি । শাস্তি যদি সহ্যই করার মতো হয় তাহলে মূল্য কি সেই শাস্তির ? ”
রায়ান কিছুক্ষন তৃনার দিকে তাকিয়ে থেকে শক্ত হয়ে বলে
” আমি মাথা পেতে নিবো তোমার দেওয়া সব শাস্তি।শুধু আমাকে তোমার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করো না । ”
মৃদু হাসে তৃনা ।

পরদিন ঘুম থেকে উঠে আর দেখা মিলে না তৃনার । রোহান রোহানা মুখ ঘোমড়া করে বসে আছে । রায়ান জিজ্ঞাসা করতেই বলে “ভেবেছিলাম তুই সবটা ঠিক করে নিতে পারবি । কিন্তু আফসোস তোর ভাগ্যটাই খারাপ। ”
” এসব কথা কেনো বলছো পাপা ? তৃনলতা কোথায় ?”
” চলে গেছে। আর আসবেনা তুমার মতো কুলাঙ্গারের সাথে সংসার করতে ।”
” পাপা এ হয়না ।”
” এটাই হয়েছে । আমার বাড়ির লক্ষী চলে গেছে এবার তুই ও বের হ আমার বাড়ি থেকে । এতো দিন অনেক সহ্য করেছি ।তোর সমস্ত বেয়াড়াপনা মেনে নিয়েছি আর নিবো না । আমাদের সব আশা শেষ করে দিয়েছিস তুই। আমি তোকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারিনি । ভুল আমিই করেছি । ওমন ফুলের মতো মেয়ের জীবনটা যে নষ্ট করেছি তোর দিক চেয়ে সেটাই বড় ভুল আমার । আমার দাদুমনির জন্য আমরা বেচে আছি । তোর কোন প্রয়োজন নেই না কোনদিন ছিলো আমাদের জীবনে। চলে যা তুই আমার সামনে থেকে । বের হ বলছি । ”
” পাপা তুমি এটা করতে পারো না । কিচ্ছু শেষ হয়নি । আমি আনছি তৃনলতাকে তুমি কিছুক্ষন সময় দাও ।”
” তৃনলতা আর কোন দিন আসবে না । ”
” এটা হয়না পাপা। তৃনলতা লাভ মি । ও আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না । আমি ওর অভিমান ভাঙ্গাবো। ”
” সে গুড়ে বালি‌ ।আর একটা কথা বলবিনা তুই । বের হ আমার চোখের সামনে এই বাড়ি থেকে । ”
” মম পাপা কি বলছে ? তুমি কিছু বলছো না কেনো ?”
” চলে যা ।”
” মম!”
রোহানা ধাক্কিয়ে দরজা দিয়ে বের করে দেয় রায়ানকে। দরজা বন্ধ করার সময় বলে ,”যদি আমার ঘরের লক্ষীকে নিয়ে ফিরতে পারিস তাহলে একসঙ্গে এই চৌকাঠে পা রাখবি নয়তো কোনদিন আসবিনা এখানে। ”
রায়ানের ফোনে টুং শব্দ হতেই ওপের করে দেখে তৃনার মেসেজ
” এটা আপনার শাস্তি । ছয়মাস পর ডিভোর্স লেটার পেয়ে যাবেন । ভালোবাসি আপনাকে। আগের মতোই ভালোবেসে যাবো । কখনো বঞ্চিত করবোনা । হারাম পথ ছেড়ে আল্লাহর পথে আসুন আখিরাত সুন্দর হোক আপনার দোয়া করি । আল্লাহ হাফেজ। ”

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here