উল্টো চালে উল্টো পথে,শেষ পর্ব

0
1078

উল্টো চালে উল্টো পথে,শেষ পর্ব
#সানজিনা_সায়েদ_খান

“উল্টো চালে”
সোহেলী ফিরে দেখলো, ও নেই, মেয়েরা বা মেয়েদের বাবা কেউই এখনও ভাতে হাত দেয় নি। মেয়ে দু’টো দুই মাথা এক করে কি কি সব গুজ গুজ ফুস ফুস করছে। আর মেয়েদের বাবা মুখ গোমড়া করে থম ধরে বসে আছে। বুঝলো সোহেলী, দুপুরের খাবার এতো দেরী হওয়াই এর কারণ। সাথে আরও হতে পারে, সেলিনার কাছে সোহেলীর এগিয়ে যাওয়া, এতোটা সময় ওর সেবাযত্ন করে আসা! ছুটির দিনে দুপুরের খাবার বলে কথা! এগুলো কোনটাই এর থেকে বেশি জরুরী হতে পারে না! বুঝলো সোহেলী, আজ আবারও ঝড় সামলাতে হবে ওকে! ক্লান্ত লাগলো ওর। রাগও লাগলো মেয়েদের উপর। ওর দেরী হচ্ছে দেখে বাপকে নিয়ে খেয়ে নিতে তো পারতো! খাবারগুলো গরমও করেনি এতোটা সময়ে! সব ওর জন্য বসে আছে।
এখন আর রাগ দেখিয়ে আরও সময় নষ্ট করলো না সোহেলী। ভেতরে গিয়ে কাপড়টা পাল্টে হাতমুখ ধুয়ে এসে দ্রুত মাইক্রোওয়েভে দিতে শুরু করলো একের পর এক বাটি। রাশেদের মুখের দিকে তাকাচ্ছে না। জানে, এই নীরবতা ভাঙবে ওকে ভাঙার মধ্য দিয়ে। মনে মনে শুধু আল্লাহকে ডাকছে, অন্তত মেয়েদের সামনে যেন উল্টোপাল্টা কিছু না বলে রাশেদ। যদিও ওর এই চাওয়া না চাওয়াতে কিছুই আসে যায় না। যখন মুখ খোলার ঠিকই খুলবে রাশেদ।
রাশেদ আর সোহেলীর প্রেমের বিয়ে। বুয়েটে পড়ার সময় রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে এসে সোহেলীকে দেখে পাগল হয়ে রাশেদ বহু কষ্টে, বহু মানুষজনকে ধরে, বহু দেনদরবার করে সোহেলীকে মানিয়েছিলো ওর সাথে সম্পর্কে। যদিও প্রেম করার সুযোগ খুব বেশিদিন সেভাবে হয়নি। সোহেলী তখন সবে ভর্তি হয়েছে নৃবিজ্ঞান বিভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সোহেলীর চাইতে প্রায় ৫ বছরের বড় হওয়াতে সোহেলীর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রায় শুরুতেই রাশেদ পড়ার পাঠ চুকিয়ে চাকরিতে ঢুকে যায়। তাই সম্পর্কে বেশ ক’বছর থাকলেও, ঠিক প্রেম করা বলতে যা বোঝায় সেটা হয়ে ওঠেনি ওদের। মাসে এক-দু’বার রেস্টুরেন্টে দেখা করা, ফোনে ফোনে কিছু কথাবার্তা, ব্যস। তাও তখন মোবাইলের যুগ না, হলের ফোনেই কখনও কখনও ফোন দিতো রাশেদ। পরবর্তীতে ওদের পরিবারেও আর বিশেষ সমস্যা হয় নি সম্পর্কটা মানিয়ে নিতে। বর্তমানে দু’জনেই চাকরিজীবী। রাশেদ একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে আছে। সোহেলী আছে একটা এনজিও তে। দু’জনেই যথেষ্ট উঁচু পদেই আছে যার যার কর্মক্ষেত্রে।
দ্রুত হাতে খাবার গুছিয়ে মেয়েদের ডাক দিলো সোহেলী। যে যার নির্ধারিত চেয়ারে গিয়ে বসার পর রাশেদের প্লেটে ভাত তুলে দিলো। মেয়েরা যে যার মতো নিয়ে নেবে, কিন্তু রাশেদকে বেড়ে দিতে হবে ওর। বেগুন ভর্তা আর ডাঁটা-চিংড়ির চচ্চড়িটা দেয়ার পর রাশেদ হাত তুলে ইশারায় বোঝালো আর কিছু এখন না দিতে। স্বস্তি পাচ্ছে না সোহেলী। দুরুদুরু করছে বুকের ভেতর। কখন যে শুরু করে রাশেদ সেটা ভেবেই মুখের ভেতরটা বিস্বাদ লাগছে।
মেয়েরা যার যার প্লেটে ভাত তরকারি তুলে নেয়ার পর ও নিজের প্লেটে ভাত তুললো। আর তখুনি মুখ খুললো রাশেদ, “তারপর? এতো সেবাযত্ন করে আসলা… তো ওই ঘরে কেউ খেয়ে আসতে বললো না? এতোক্ষণ যখন থাকলাই, ওই বাসাতেই খেয়ে আসতা!” এই অযৌক্তিক কথার কিই বা উত্তর হতে পারে? সোহেলী বরাবরের মতো চুপ থাকলো তাই এবারও। এখন ও মুখ খুললেই রাশেদের মুখের কথা আরও খারাপ হবে। মুখ খুলতে গিয়ে মেয়েদের সামনে নিজের বেইজ্জতি আরও বাড়িয়ে নেয়ার কোনও মানে হয় না। নিঃশব্দে ভাত মাখতে লাগলো ও, যদিও খাওয়ার রুচি চলে গেছে।
কিন্তু রাশেদ ওকে রেহাই দিলো না। ভাতের প্লেট থেকে আঙুল তুলে তর্জনী উঁচু করে শাঁসালো, “এই শেষবারের মতো বলে দিচ্ছি… ওই সেলিনা না ফেলিনা… ওই নষ্ট টাইপের মেয়েমানুষটাকে যেন আর কোনদিন আমার ঘরে ঢুকতে না দেখি… অসভ্য মেয়েছেলে! সকলের সামনে নিজের স্বামীর নামে যা নয় তা বলে গেলো! তুমি আবার আগায় গেসো তারে ধরতে! পড়ে থাকতো মরে! তোমার একটা মান সম্মানের জ্ঞান নাই? এই ধরণের ক্যাচালের মধ্যে গেসো তুমি ঢুকতে? কোন হিসাবে গেলা তুমি? ওই পারভেজ একটা বেয়াদব! ওর বউটা আরও বড় অসভ্য! ওদের মধ্যে যেয়ে ঢুকতে হইসে তোমার!? এই সমস্ত নষ্টামির মধ্যে? আবার এতোক্ষণ মাথায় পানি ঢেলে সেবাও করে আসলা! তোমার আক্কেল কোনদিনও ছিলও না… হবেও না! কোথায় ইনভল্ভড হইতে হয়, আর কোথায় নাক গলাইতে যাইতে হয় না, এতোটুকু জ্ঞান তোমার নাই এই বয়সেও! আর কবে হবে? যত্তোসব!…” বিরক্তি আর ক্ষোভ নিয়ে ভাতের গ্রাস মুখে তোলে রাশেদ।
এসব সময়ে সোহেলী মাথা নিচু করেই থাকে। রাশেদের দিকে চোখ তুললে শুনতে হবে ওর চোখে চোখ রাখার সাহস কিভাবে হলো! আর মেয়েদের দিকে তাকালে ওর মনে হবে ওদের চোখে ভাসছে তাচ্ছিল্য আর করুণা। তাই মাথা নিচু করেই ভাত মেখে চললো ও। যন্ত্রের মতো গ্রাস মুখে দিচ্ছে, কিছুর স্বাদ পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ চারজনেই চুপচাপ খাওয়ার পর একবার আলগোছে মাথা তুলে দেখলো রাশেদের প্লেটে তরকারি নেই। দ্রুত রুই মাছের বাটি থেকে বড় পিসটা তুলে দিলো ওর পাতে। টম্যাটো আর ঝোল দেয়ার পর আবারও হাত তুলে থামতে বললো রাশেদ। ছুটির দিনে বাসায় ৫-৬ পদ রান্না হয় রাশেদের নির্দেশে। আজ তাই টেবিলে ছোট মাছ, বড় মাছ, গরুর মাংস সবই উপস্থিত।
সোহেলীর খাওয়ার অনীহা বরাবরের মতই আজও নজর এড়ায় নি রাশেদের। সেই এক বেগুন ভর্তা নিয়ে অনেকক্ষণ নাড়াচাড়া করছে ও। চাপা গলায় হুঙ্কার দিয়ে উঠলো রাশেদ, “তরকারি নিচ্ছো না কেন? অন্যের বাড়ির ঝামেলা মেটাতে গিয়ে কি খিদাও মিটায় আসছো নাকি? আমার টাকায় কেনা ভাত তরকারি নষ্ট করবা না বলে দিলাম! যাই হোক না কেন, খাওয়া নিয়ে কোনও নাটক আমি সহ্য করবো না!” ধমক খেয়ে সোহেলী দ্রুত হাতে ডাঁটা চচ্চড়ির জায়গায় আগেই রুই মাছ নিয়ে ফেললো। ঝোল পড়লো টেবিলে। হাত কাঁপছে ওর। মনে প্রাণে চাইছে রাশেদ এবার থামুক।
কিন্তু রাশেদ থামলো না, “আর আসছে ওই এক নারী নেত্রী! ওর বাপ নাকি পুরা বিল্ডিং কিনে নিতে পারে! কি পরিমাণ বেয়াদব একটা মেয়ে! এত্তোগুলো বয়স্ক মানুষ যেখানে উপস্থিত, এত্তোগুলো পুরুষ মানুষের সামনে আগায় আসছে গলা তুলে কথা বলতে! আবার নিজের স্বামীর মুখের উপর হাত তুলে থামায় দেয়! আজকালকার মেয়েগুলার কোনও ভদ্রতা-সভ্যতার বালাই নাই… আদব লেহাজ নাই… বাপ-মা খালি বড় করে লেখাপড়া শিখায়েই বিয়ে দিয়ে দেয়! স্বামী-শ্বশুরের সামনে কিভাবে কথা বলতে হয় সেই শিক্ষা আর দেয় না! অসভ্য তৈরি হচ্ছে একেকটা!… মিতালী! আমি যেন আর কোনদিন না শুনি যে তুমি বা তোমার বোন ওই বাসায় গেসো বা ওই মেয়ের সাথে মেলামেশা করসো! ওই রকম বেয়াদব আর অতো বড়লোকির ফুটানি যার, তার সাথে মিশে তোমাদের মাথাও নষ্ট হবে… স্বাধীনতা বুঝছেন উনারা… আজকালকার দিনের মেয়েরা… কেন? তোমার মা কে দেখো! তোমাদের মা কে আমি কি স্বাধীনতা কম দেই? আমার সাথে বিয়ে হওয়ার পরে কি সে মাস্টার্স শেষ করে নাই? চাকরি করতেসে না? এ্যালাউ করি নাই আমি? তার কোনও ইচ্ছা আমি অপূর্ণ রাখসি? কোনদিন দেখসো তোমাদের মা রে ওইরকমভাবে গলা তুলে অভদ্রের মতো কথা বলতে? … খবরদার আর ওই তিথির সাথে কোনরকম যোগাযোগ তোমরা রাখবা না…”
সোহেলীর গলার কাছে সমস্ত খাবার, কান্না আর একটা প্রচন্ড চিৎকার যেন দলা পাকিয়ে আছে। ও না পারছে গিলতে, না পারছে উগড়ে ফেলতে। যখন ওর মনে হচ্ছিলো যে আর পারবে না, এখুনি দমটা বন্ধ হয়ে যাবে ওর, ঠিক তখুনি মিতালী কথা বলে উঠলো। যে কথাটা বললো, তাতে এক মুহূর্তের জন্য সোহেলী সম্পূর্ণ বিস্মৃত হলো ওর নিজের দমবন্ধ করা এই অবস্থাটা সম্পর্কে। অবাক চোখে মাথা তুলে তাকালো মিতালীর দিকে। মেয়েটার নজর ভাতের প্লেটের দিকে। আয়েশ করে ভাত মাখছে রুই মাছের তরকারির ঝোল দিয়ে। ওর ভাব দেখে মনে হচ্ছে, এতোক্ষণের এই যে শ্বাসরুদ্ধকর একটা অবস্থা খাবারের টেবিলে, ওর বাবার এই যে এতো আস্ফালণ, এই সমস্ত কিছুর উর্ধ্বে ও! মুখটা হাসিমাখা। সম্পূর্ণ শান্ত। একদম নিশ্চিন্ত! মিতালী বললো, “আব্বু, পিয়ালীর কথা বলতে পারবো না, কিন্তু আমি ঠিক করেছি বিয়ে করে ফেলবো। আমার তো আঠারো হয়ে যাবে এই আগস্টেই! আমাকে বিয়ে দিয়ে দাও তুমি… বুঝছো?”
মিতালী আর পিয়ালী। দু’বোনের বয়সের পার্থক্য বেশি নয়। দু’জনের বন্ডিংটাও দেখার মতো। অথচ, দু’জনের স্বভাবে আকাশ পাতাল পার্থক্য। সোহেলীর অবশ্য মনে হয় মাঝে মাঝে যে ওদের প্রতি রাশেদের ভিন্ন ধরণের আচরণটাও এর জন্য দায়ী। মিতালী উচ্ছ্বল, চারদিক তোলপাড় করে চলতে ভালবাসে, সর্বক্ষণ কলকল করছে, নিজের মনের কথা মুখের উপর বলতে পেছায় না, সেই সাথে বাপের আহ্লাদী বলতে যা বোঝায়, সে হলো তাই। মায়ের প্রতি উদাসীন না তাই বলে, বরং মায়ের ব্যাপারে যথেষ্ট প্রোটেক্টিভ, বড় হওয়ার সাথে সাথে মা’কে আগলে রাখার প্রবণতাটা বেড়েছে খুব ওর। পিয়ালী সম্পূর্ণ এর উল্টো। অসম্ভব চাপা, ধীর-স্থির, গম্ভীর প্রকৃতির, মুখ দিয়ে একটা কথা বের করতে হাজার বার ভাবে, অন্যদিকে বাপের সাথে ঘনিষ্ঠ তো নয়ই, এমনকি মায়ের সাথেও যে খুব খোলামেলা, তাও না। ওর একমাত্র কথা বলার জায়াগা, সব শেয়ার করার মানুষ সম্ভবত মিতালী। তবে মায়ের বিষয়ে সেও পজেসিভ, অধিকারবোধটা প্রবল।
রাশেদের মিতালীর প্রতি প্রশ্রয়টা প্রচ্ছন্ন নয়, রীতিমতো প্রত্যক্ষ। ওর শখ ছিলো ছেলের। প্রথমবার ঘরে মিতালী এলে অবশ্য তাকে ও সাদরেই গ্রহণ করেছিলো। মেয়ের সাথে নাকি বাপের নৈকট্য বেশি হয়। সেই কথাকে সত্য প্রমাণ করে বাপের একেবারে কোলঘেঁষা মেয়ে হয়েছে মিতালী। মিতালীর সখ-আহ্লাদ কোনকিছুই অপূর্ণ রাখে না রাশেদ। মিতালীও জানে ওর প্রতি বাবার এই দুর্বলতার কথা, এবং সেটার সদ্ব্যবহার করতে বিন্দুমাত্র পিছপা হয় না। অন্যদিকে, দ্বিতীয়বারও যখন মেয়ে হলো, তখন সেই মেয়ে, পিয়ালীকে আর রাশেদ অতটা আদরে গ্রহণ করতে পারলো না, যতটা করেছিলো মিতালীকে। হ্যাঁ, মেয়ের প্রয়োজন, সখ ইত্যাদির খেয়াল রাশেদ রাখে ঠিকই, কিন্তু ছোট্টবেলা থেকেই পিয়ালীর সাথে একটা অলিখিত দূরত্ব তৈরি হয়েছে রাশেদের। এবং সেই দূরত্ব মেটানোর কোনও আগ্রহও রাশেদের মধ্যে দেখা যায় নি কোনদিন। মিতালী-পিয়ালীর প্রতি রাশেদের আচরণে বৈষম্যটা চোখে পড়ে বরাবরই। পিয়ালীও তেমনই। ছোটবেলা থেকেই কি বুঝেছে তা ওই জানে, কিন্তু ওর সখ, আবদার এমনিতেই কম, স্রেফ প্রয়োজনের কথাটুকুই মুখ ফুটে বলে, তাও মায়ের কাছে। বাপের ধারে কাছে সে কমই ঘেঁষে।
তবে ওরা দু’বোনই পড়ালেখায় ভালো, এই একটা ব্যাপারে ওদের নিয়ে মাথাপাগল করতে হয়নি সোহেলীর। বাবা-মা দু’জনেই কর্মজীবী হলে যা হয়, বাচ্চাদের বেড়ে ওঠা ঠিক মতো হচ্ছে কিনা সে নিয়ে মাথার উপর একটা আলাদা চাপ কাজ করে। কিন্তু মিতালী-পিয়ালীকে নিয়ে এই দিকটাতে খুব শান্তি পেয়েছে সোহেলী। মেয়েরা যদি ঠিকঠাক রেজাল্ট না করতো, বা ভদ্র-সভ্য আচার-আচরণে কোনও ঘাটতি থাকতো ওদের, সে অপরাধ নিঃসন্দেহে এসে সোহেলীর ঘাড়েই বর্তাতো। সেকথা চিন্তা করলেও সোহেলী মনে মনে ওর মেয়েদের প্রতি কৃতজ্ঞ হয়। দু’টো বাচ্চাই ওর অনেক অল্প বয়স থেকেই অনেক বুঝদারের মতো আচরণ করে ওকে কি পরিমাণ আরাম দিয়েছে, সেটা ও বলে কুলাতে পারবে না। মিতালী বড় হওয়াতে, পিয়ালীকেও অনেক সময় সামলে নিয়েছে ওই, সেটাও খেয়াল করে সোহেলী। ও ভাবে, রাশেদের ওর প্রতি এই আচরণগুলোই কি এর কারণ? ওর মেয়েরা পারতপক্ষে এমন কিছু না করার চেষ্টা করে যাতে ওদের বাবা, মাকে কিছু বলতে পারে।
আজকে খাবারের টেবিলে তাই মিতালীর বলা এমন একটা কথা নাকের উপর একটা আস্ত গ্রেনেড ফাটার মতো করেই ফাটলো সোহেলী আর রাশেদের সামনে। দুই মেয়ের এখনও পড়ালেখা শেষ হওয়ার অনেক দেরী। বিয়ের কথা ভাবার প্রশ্নই ওঠে না এখন! রাশেদও যেমনই হোক, মেয়েদের অন্তত অনার্স শেষ হওয়ার আগে, স্বাবলম্বী করার আগে বিয়ের কথা ভাববে না, সেটা জানে সোহেলী। তাহলে মিতালীর এরকম একটা কথা বলার কারণটা কি? সোহেলী হতভম্ব হয়ে ভেবে চলেছে, এমনিতেই রাশেদ কি আজকে কম অপমান করছিলো, যে এখন এই কথা বলে আরও উস্কে দিতে হবে?
ভাত খেতে খেতে হাত থেমে গেছে রাশেদেরও। ভ্রূ কুঁচকে মিতালীর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে মেয়েটা মজা করছে কিনা। মুখে হাসি থাকলেও মিতালীকে দেখে মনে হলো না যে মজা করার ইচ্ছে আছে ওর। প্লেট থেকে চোখ সরায় নি এখনও। বলে চললো, “আব্বু, এতো অবাক হচ্ছো কেন? বিয়ে তো আমাকে দিতেই হবে, তাই না? আর এখন বিয়ে দিলেও আমাকে যা যা করতে হবে, কয়েক বছর পরে দিলেও তো তাই করতে হবে! তাইলে দেরী করে কি করবা বলো?” ভাতের গ্রাস মুখে তোলে মিতালী।
গম্ভীর হয়ে আছে রাশেদ। সোহেলীর মনে হলো যে কোনও মুহূর্তে ফেটে পড়বে রাগে, যদিও বাসায় একমাত্র মিতালীর ওপরই এই রাগে ফেটে পড়ার ঘটনাটা ঘটায় না রাশেদ। বহু কষ্টে মেজাজ ধরে রেখে গুরুগম্ভীর গলায় রাশেদ বললো, “ফাজলামি হচ্ছে? এই সমস্ত বাপের সাথে ফাজলামি করার মতো বিষয়? এগুলো শিখছো আজকাল?”
৬ জনের ডাইনিং টেবিলের এক মাথায় বসে রাশেদ, তার হাতের ডান দিকে বসে সোহেলী, আর বাঁয়ে মিতালী, সোহেলীর মুখোমুখি চেয়ারে। মিতালীর বাঁ দিকে বসে পিয়ালী। সোহেলী খেয়াল করলো মিতালীর এই অসম্ভব কথাতেও পিয়ালী চোখ তুলে তাকায় নি। এক মনে খেয়ে যাচ্ছে। ওকে একটুও অবাক মনে হলো না।
মিতালী এবার রাশেদের দিকে চোখ তুলে তাকালো খাওয়া বন্ধ করে, “ঊফফ… আব্বু! রেগে যাচ্ছো কেন? আমার কথাটা তো শোনো পুরোটা! … শোনো… মেয়েদের আসল ক্রেডিট তো হলো সংসার করতে পারা, তাই না? ঘরের কাজ জানা, রান্না পারফেক্টলি জানা, স্বামীর মন মতো কাজ করতে পারা, রাইট? এইগুলা করার পর চাকরিবাকরি কিছু করলে করা যাইতে পারে… সেটা এক্সট্রা… দাঁড়াও আব্বু! আমার কথা শেষ করতে দাও না! প্লিজ!… আমি এইচএসসি পাশ হইলেও আমারে স্বামীর হুকুম তামিল করতে হবে, পিএইচডি পাশ হইলেও আমারে স্বামীর হুকুম তামিল করতে হবে… নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য সেই জীবনে নেহায়েতই কম… এখন তুমি আমাকে পাশের বাসার ওই সেলিনার উদাহরণ দিবা তো? যে লেখাপড়া করে নাই বলে আজকে ওর কি অবস্থা! যাওয়ার কোনও জায়গা নাই… স্বামী ছাড়া গতি নাই… লাত্থি গুতা খেয়ে হলেও শ্বশুরবাড়ির লোকের পা ধরে বসে থাকতে হয়… ইত্যাদি ইত্যাদি… আমি কিন্তু বলতিসি না যে আমি পড়ালেখা ছেড়ে দিবো… বিয়ের পরে যদি হাজবেন্ড বা হাজবেন্ডের ফ্যামিলি ‘এ্যালাউ’ করে…” সোহেলী দেখলো, ‘এ্যালাউ’ শব্দটা মিতালী দুই হাতের তর্জনী আর মধ্যমা জড়ো করে এক করে, বাঁকিয়ে কোটেশন মার্ক তৈরি করে তারপর বললো।
মিতালী বলে যেতে লাগলো, “যদি হাজবেন্ড আর হাজবেন্ডের ফ্যামিলি ‘এ্যালাউ করে’, যেমন তুমি আম্মুকে ‘এ্যালাউ করসিলা’, বা স্বাধীনতা দিসলা মাস্টার্স করার জন্য, তাহলে আমি বিয়ের পরেও পড়ালেখা কন্টিনিউ করতে পারি! যদিও আমি তার কোনও প্রয়োজন দেখি না… কারণ আমার পড়াই বলো আর পড়ালেখা শেষ করার পর চাকরিই বলো, সবই ডিপেন্ড করবে আমাকে ‘এ্যালাউ করা’ হচ্ছে কিনা তার উপরে…আমার নিজের ইচ্ছের উপরে না… সেটার উপর ঘরে আমার স্ট্যাটাসও কিছু বাড়বে কমবে না… আর সত্যি বলতে কি, আজকের পরে আসলে আমার পড়ালেখা করার বা বড় চাকরি-বাকরি করার ইচ্ছাটাই চলে গেসে… কারণটা বলতিসি… আম্মুকে দেখো! সে পড়ালেখাও করসে… নিজের পায়েও দাঁড়াইসে… তোমার চাইতে বেশি ইনকামও করে… তাইতে তার লাভটা কি হইসে? সেই তো তোমার কথাতেই তারে উঠতে হয় বসতে হয়, তাই না? ইন ফ্যাক্ট তুমি না চাইলে সে তার চাকরিটাও করতে পারতো না! তুমি হুকুম করবা, আর আম্মু কাঁপতে কাঁপতে এসে তোমার হুকুম পালন করবে… ছোট থেকে তো এইটাই দেখে আসতিসি আমরা দুই বোন, তাই না? আম্মুর অফিসে আম্মু বস হইলে কি হবে? আম্মুর বস তো তুমি, রাইট?… নো ম্যাটার হোয়াট… যত শিক্ষিত হোক, যত বড় পোস্টেই থাকুক… দিনের শেষে ওই… ঘরে আসলে তুমি সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন। বেঁচে থাকাটাই তো রীতিমতো অনুমতির উপর ডিপেন্ড করে! সেখানে নিজের জীবনের কন্ট্রোল নিয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচা!… ঘরে ওই সমস্ত বসগিরি দেখাইতে আসলে এক থাপ্পড়ে বসগিরি ছুটে যাবে…”
সোহেলীর সম্পূর্ণ শরীর জমে গেছে হিম হয়ে। মেয়ে আজকে যা বলছে, ও বিশ্বাস করতে পারছে না। ও তো কখনও মেয়েদের কাছে ওদের বাবাকে নিয়ে কোনও অভিযোগ তোলেনি! সত্য বলতে একমাত্র নিজের মা ছাড়া ও কারও কাছেই কখনও অভিযোগ করে নি রাশেদকে নিয়ে। সেই মাও তো ওকে সেই অর্থে সাপোর্ট করেন নি। মা-মেয়ে একই সাথে চোখের পানি ফেলেছেন, কিন্তু ঘাড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে মা বুঝিয়েছেন সেই ওকেই, দু-দু’টো মেয়ে আছে ওর, সমাজ কি বলবে এধরণের দাম্পত্য কলহের কথা যদি বাইরে আসে, মেয়েদের বাবার সম্মানও তো নষ্ট হবে, তার উপর ওর তো পছন্দের বিয়ে, অন্যদিকে ও পরিবারের বড় মেয়ে, সুতরাং ওর যদি এখন এধরণের কোনও দুর্ঘটনা ঘটে সেটার জের টানতে হবে ওর ছোট ভাই-বোনদের, তাদের সবারই এখন বিয়ে-শাদী হয়ে গেছে, শ্বশুরবাড়ির লোকজন আছে, ইত্যাদি হাজারটা বাস্তবতার বয়ান। তাই যতটা সম্ভব সামলে চলেছে রাশেদের উগ্র মেজাজ, আর ওর প্রতি অপমানজনক আচরণগুলোকে ঢেকে রাখতে চেয়েছে মেয়ে দু’টোর সামনে। সব সময় পারে নি সেকথা জানে সোহেলী। রাশেদ যেহেতু কখনও এই আচরণগুলো রেখে ঢেকে করার চেষ্টা করে নি, সুতরাং ওর একজনের প্রচেষ্টায় নিত্যদিনের দুর্ব্যবহার কি আর ঢাকা যায়? সত্যিই তো মেয়েরা এই দেখেই বড় হয়েছে! রাশেদ একটা হুঙ্কার দেবে আর সোহেলী পড়িমড়ি ছুটে এসে নিজের ভুল শোধরানোর চেষ্টা করবে, রাশেদের রাগ ঠান্ডা করার চেষ্টা করবে।
সোহেলীর চিন্তার স্রোতকে থামিয়ে দিয়ে কথা বলে উঠলো পিয়ালী। এমনিতে ও খুবই অল্প খায়, এবং সকলের আগে ওর খাওয়া শেষও হয়ে যায়। আজকে ওর খেতে এতো সময় লাগছে কেন, সোহেলীর প্রায় অবশ মস্তিষ্কে সেই চিন্তাটাও একবার ঘুরে গেলো। পিয়ালী বললো, “বাজে কথা বাদ দিয়ে ঠিক মতো খা আপ্পি… আম্মু পড়ালেখা করেছে বলে তাঁর অন্তত সমাজে একটা সম্মানের জায়গা আছে, সেটা তো তুই অস্বীকার করতে পারবি না, তাই না?”
দৃশ্যত মুখ বাঁকালো মিতালী, “ওইখানেই তো আরও বড় সমস্যা রে পিউ!… সমাজে সম্মান আছে বলে কি মানুষের ঘরের অসম্মানটা অসম্মান না? অপমান কি বাসার নিচের সব্জিওয়ালা আর নিউ মার্কেটের কাপড়ের দোকানদার করলে বেশি লাগে, আর অফিসে কলিগ বা বসদের কেউ করলে কম লাগে? আর বাইরে মাথা উঁচু করে আমি চলি, ঘরে ঘাড় নিচু করে… এটা তো র‍্যাদার আরও বড় প্রিটেনশন! আর ঘরের কেউ… কাছের কেউ যখন অপমান করে, তখন সেটা শুধুমাত্র অপমান থাকে না… সেটা একধরণের বিট্রেয়ালও…”
এই পর্যন্ত বলে একটু থামলো মিতালী। তারপর কি মনে করে ফিক করে একটু হাসলো, হেসে বললো, “মাইর তুই এমনিতেও খাবি… ওমনিতেও খাবি… হাতে না মারলেও মুখে খাবি… ওই সেলিনা আন্টির মতো হইলে কিন্তু সুবিধা আছে, সেটা বুঝিস? মাইরটা খাইলে স্রেফ শরীরে লাগবে… তোর ওই সম্মানে লাগবে না… “।
পিয়ালীর কণ্ঠ শুনে রোবটের মতো ওর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সোহেলী। পিয়ালী বলছে, “বলছে তোকে… সম্মানের সেন্স সবার থাকে… কম বেশি হইতে পারে… কিন্তু থাকে সবারই… তুই কিন্তু রেসিস্ট আচরণ করতিসিস! কারও পড়ালেখা কম হইলে তার মানসম্মানের জ্ঞান কম হয়, কে বলছে তোরে? তুই কি বলতে চাস, সেলিনা আন্টি যে এরকম রোজ রোজ মার খায়, এতে ওর সম্মানে একটুও লাগে না? হইতে পারে যে মারের ঠ্যালায় শরীরের যন্ত্রণাতে সম্মানের দিকে বিশেষ নজর দেয়ার অবস্থা থাকে না ওর… কিন্তু তাই বলে হাউজওয়াইফদের কি মান-সম্মান থাকে না নাকি? কি বলিস এগুলা?“
পিয়ালীর কথার মাঝ পথে থামিয়ে দিলো মিতালী, “লাগে না… আমি বলতিসি ওর সম্মানে লাগে না… সেটার সাথে ওর হাউজওয়াইফ হওয়ার কোনও সম্পর্ক নাই পিউ! পড়ালেখারও কোনও সম্পর্ক নাই… সম্মানের সেন্স থাকলে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ওয়ার্কিং উওম্যান অর হাউজওয়াইফ, যে কারোরই থাকে, কথা সত্য… না থাকলে থাকেই না… ওর লাগে না তার প্রথম কারণ, ওর বা ওর মতো অধিকাংশ মেয়েদের, শিক্ষিত বা অশিক্ষিত নির্বিশেষে… অধিকাংশ মেয়েদের ধ্যানধারণাতে এটা অলরেডি এ্যাক্সেপ্টেড যে স্বামী মাত্রই তার স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার অধিকার আছে… স্বামী মাত্রই স্ত্রীকে শাসন করতে পারে… আর দুই নাম্বার হইলো, ওকে তো বাইরে এক রকম ঘরে এক রকম দুইভাবে ম্যানেজ করে চলতে হচ্ছে না! আম্মুর মত বাইরে ফিটফাট ভিতরে সদরঘাট হইলে ভেতরে ভেতরে স্বামীর হাতে এ্যাবিউজড হয়ে বাইরে গিয়ে ভাব ধরতে হয় সঅব ঠিক আছে… আর সকলের মতো তার স্বামীও তারে সম্মান করে… বিষয়টা তো এরকম না যে ও মার খায় সেটা খালি ওই জানে, আর কেউ জানে না! আমরা সবাই জানি! ওর তো রাখঢাকের বিষয় নাই… বাইরে বিশাল সম্মানিত একটা ফেস ধরে রেখে ঘরে এসে বেল্টের বাড়ি খায়, তা তো না! যাই ঘটে… পুরাই খুল্লামখুল্লা ওর জন্য… সবাই জানে… আলগা লজ্জাশরমের বালাই নাই…“।
পিয়ালী বললো, “হ্যাঁ… ওই জন্যই আজকে পারভেজ আঙ্কেলের উপর ওই ভাবে চড়াও হইতে পারসে সেলিনা আন্টি… সেটাও বল! কি যে সব বলিস না তুই আপ্পি!”
মিতালী হি হি করে হেসে বললো, “অবশ্যই! ওর নিজের সম্মানের অতো জ্ঞানও নাই… সমাজের সকলের সামনে অতো হিসাব করে চলার দায়ও নাই… দে মাইর! হি হি হি… আমি এই জন্যই আরও বলতিসি আব্বুকে যে আমার বিয়ে দিয়ে দাও… বেশি শিক্ষিত হইলে সম্মানের জ্ঞান টনটনা হবে… তখন আর মাইর খেয়ে মরে গেলেও কিছু বলতে পারবো না… লুকাইতে লুকাইতে জীবন যাবে… বলতে গেলেই মনে হবে হায় রে! এই বুঝি আমার সম্মান চলে গেলো… সবাই সব কিছু জেনে গেলো… এখন যতোটুকু জ্ঞান আছে তাই নিয়েই আমি টেনশনে পড়ে গেসি! যাই বলিস না কেন পিউ! আজকের পর থেকে কিন্তু সেলিনা আন্টি আমার আইডল হয়ে গেসে… বিয়ে করবো, জামাইয়ের মাইরও খাবো… দেন কোণঠাসা হয়ে গেলে জামাইরে ধরে কয়টা লাগায় দিবো! … হিহিহি… “
সোহেলী দেখলো পিয়ালীর ঠোঁটের কোণে হাসি। কিন্তু হাসিটাকে বাড়তে দিচ্ছে না ও। বললো, “তোর মাথা পুরাই গেসে আপ্পি… দুনিয়ার সব হাজবেন্ড কি খারাপ হয় নাকি?”
মুখ ভেংচালো মিতালী, “জানি জানি… সব হাজবেন্ড খারাপ হয় না আবার? থাকে না কতোগুলা ওই শাফিন ভাইয়ার মতো ভেড়ুয়া? বউ হাত তুলে থামায় দিবে আর সে ওমনি ফুস করে চুপ মেরে যাবে? শুনলি না আব্বু কি বললো? আমি ওরকম পুরুষ মানুষ বিয়েই করবো না! আমার হাজবেন্ডের পৌরুষ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে? তওবা তওবা… আব্বু আমাকে দেখে শুনে ঠিকমতোই বিয়ে দিবে… আর আমার জামাই আমি ভুলেও কখনও গলা তুললেই আমারে এক চড়ে আমার জায়গা বুঝায় দেবে… দেখিস তুই! সেই রকম না হইলে আবার পুরুষ কিসের?!… তুই বরং নিজের জন্য ওরকম একটা ভেড়ুয়া ভালোমানুষ খুঁজে দ্যাখ পাস কিনা…“।
গলায় বিরক্তি টেনে পিয়ালী বললো, “তুই নিজে বিয়ে করবি কর না! আমাকে টানতিসিস কেন? আমি বিয়েই করবো না… বিয়ের সাধ আমার মিটে গেসে… থ্যাংক ইউ… আর তুই বিয়ে করবি ভালো কথা… তার সাথে পড়াশোনা মিলাচ্ছিস কেন? আজকাল তো লোকে বিয়ে করতে গেলেও শিক্ষিত মেয়ে খোঁজে… তোর মতো ইন্টার পাশ মেয়ে কে বিয়ে করবে? করলেও বলবে যে তুমি বাকি পড়ালেখাটা শেষ করো… তখন?”
জবাব দিতে এক সেকেন্ডও সময় নিলো না মিতালী, “যদ্দিন বিয়ে না হচ্ছে আমি পড়ালেখা ঠিকই করবো, মানলাম… কিন্তু বিয়ের পরে পড়বো জামাইয়ের ইচ্ছায়… নাইলে পড়বোই না… শেষ বয়সে গিয়ে জামাই ঠুসা মারবে, যে তোমারে তো পড়াইসি আমিই! পড়তে দিসি… পড়ার সুযোগ করে দিসি… নো ওয়ে! এমনেও উঠতে বসতে কথা শুনতেই হবে জামাইবাড়িতে… আরও তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়ার প্রশ্নই আসে না… কষ্ট করে পড়বো আমি… পরীক্ষা দেবো আমি… ভালো রেজাল্ট করবো আমি… আর দিনের শেষে গিয়ে বলবে যে আমার জন্যই তো তোমার পড়াটা হইলো! আমি ‘এ্যালাউ’ করসিলাম বলেই তো! আমি কতো মহান!… মাফ চাই!… “
পিয়ালী এবার হাসতে হাসতে বোনের দিকে চেয়ে বললো, “এ্যাই আপ্পি! তুই তো বিয়ে হওয়ার আগেই তোর কাল্পনিক জামাইরে শত্রু বানায় ফেললি! সে মহান হইতে পারে না? মহান হইলে তারে মহান বলা যাবে না নাকি?”
“শোন পিউ!… স্বামীরে মহান বলা না বলায় কিসসু আসে যায় না… বিয়ে হওয়ার সাথে সাথে স্বামী মাত্রই মহান, এটা তোর মেনে নিতে হবে… বাইরের দুনিয়ায় সে যাই হোক… দুনিয়ার মানুষেরে সে জ্বী হুজুর জ্বী হুজুর করুক… চোর বাটপার অভদ্র বদমাশ যাই হোক… স্ত্রীর কাছে স্বামী মানেই সম্মানের পাত্র… তারে মাথায় করে রাখতে হবে…”
“আপ্পি! তুই কিন্তু এবার তোর যুক্তিতেই আটকা পড়লি… একটু আগেই বললি সেলিনা আন্টির অতো শিক্ষাদীক্ষা নাই মানসম্মানের জ্ঞান নাই বলেই পারভেজ আঙ্কেলের সাথে আন্টি এরকম করতে পারলো আজকে… আবার এখন বলতিসিস স্বামী মানেই সম্মানের পাত্র… কন্ট্রাডিকশন হয়ে গেলো না?”
“হিহিহি… মোটেই না… সেলিনা আন্টি যেটা করসে, সেটা করে বসছে তার অবচেতন থেকে… মানে… ছ্যাঁচা খাইতে খাইতে আর পারে নাই উলটা দিয়ে বসছে…কিন্তু তাইতে তার সারাজীবনের ধ্যানধারণা পাল্টায় যায় নাই! … তোর বিশ্বাস না হয় তুই এখুনি গিয়ে তারে জিজ্ঞেস কর! তার স্বামী মরসে শুনলে সে খুশি হবে কিনা! তোর গলায় পাড়া দিবে সে! ক্যান তুই শুনিস নাই… আমাদের বাসায় যতবার আসছে প্রতিবারই তো বলে, হাজার হইলেও উনি তো আমার স্বামী!… হিহিহি… আর সে যেইটা করসে সেটা কি কেউ এ্যাপ্রেশিয়েট করতেসে নাকি? মাইর খাইতে খাইতে মরে যাইতো! মাইনষে আহা উহু করলেও খুশি হইতো… কি ভালো বউ! স্বামীর মাইর খেয়ে মরে গেলো তবু টু শব্দটা করে নাই! নির্ঘাৎ বেহেশতে যাবে!… আর আজকের পরে সেলিনা আন্টিরে কেউ দেখতে পারবে? স্বামীর গায়ে হাত তুলছে! সোজা কথা? ডাইরেক্ট জাহান্নাম… আব্বুর কথা শুনিস নাই? আমাদের বাসায় ঢুকা নিষেধ ওইরকম মেয়েমানুষের!… তবে তুই যত যাই বলিস… আমি উনার মতোই হইতে চাই… আম্মুর মতো না… যে সবরকম সুযোগসুবিধা যোগ্যতা ইত্যাদি থাকা স্বত্তেও ঘরের মধ্যে বসে বসে স্বামীর অপমান হজম করবো… আবার বাইরে যাতে কেউ সেটা টের না পায় রাতদিন সেইটা এনশিওর করার চেষ্টা করবো, কোনও প্রতিবাদ করবো না যাতে কেউ কিছু টের না পায়… মুখে পাউডার আর মেকাপ ঘষে বাইরে যাবো যাতে কেউ চড়ের দাগ দেখতে না পায়… এর চাইতে সেলিনা আন্টি অনেক সিম্পল, সেটা তো স্বীকার করবি? দিনরাত এক করে স্বামীর সেবাও করবো, মাইরও খাবো… আবার চিল্লাবোও… যখন যেটা দরকার… বিন্দাস!“
ঘরের ভেতর বাতাসটা যেন থম ধরে আছে। ঘূর্ণিঝড়ের আগে যেমন নিম্নচাপের একটা প্রচন্ড দম আটকানো উত্তাপ ছড়ায় প্রকৃতি, তেমনই চাপ ধরে একটা ভ্যাপসা গরম নিয়ে স্থির হয়ে আছে আছে এই খাবারের ঘরে ৪ জন মানুষের চারপাশটা। সোহেলীর খাওয়া থেমে গেছে অনেক আগেই! একবার মিতালী, একবার পিয়ালীর দিকে চোখ ঘুরছে ওর। স্তব্ধ হয়ে ওদের দু’জনের কথোপকথন শুনছে ও। পিয়ালী এতো কথা বলছে কেন আজকে? ও তো কোনদিন এতো কথা একসাথে বলে না! আর মিতালী! এতো কিছু বুঝতে শিখলো কবে এই মেয়েটা?! ওর কি এতোকিছু বোঝার বয়স হয়েছে? ওরা কি এতো বড় হয়ে গেছে যে মায়ের মনের ভেতর খুব সন্তর্পনে লুকানো না বলা কথাগুলো সব শুনতে পায় ওরা? সবে তো কলেজের গণ্ডী পার হচ্ছে দুই বোন! কই, অতো বড় তো না? সোহেলীর নিজের মা কোনদিন সমাজ আর অনুশাসনের বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস পান নি, যে কারণে সোহেলীরও সেই বুকের পাটা গড়ে ওঠে নি সমাজের এবং নিয়মের ত্রুটিগুলো চোখে পড়লেও তার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে। ওর মেয়েরা কোথায় পেলো এতো সাহস? পিয়ালী-মিতালীর আপাত-ব্যাঙ্গাত্মক কথার আড়ালে যে বিদ্রোহের সুর, সোহেলীর কানে তা বেজেছে পরিষ্কার।
রাশেদের অন্যায় আর বছরের পর বছর সোহেলীর সেই অন্যায়ের প্রতিরোধ না করে এক প্রকার তাকে পোষণ করে আসা, সচেতন সরব মনের আড়াল দিয়ে একবার ভেসে গেলো সোহেলীর এই কথাটা, যে সুখী পরিবারের মুখচ্ছবি ধরে রেখে ভেতরের এই অসামঞ্জস্যতা কি তাহলে ওর মেয়েদের বয়সের তুলনায় পরিণত করে তোলার কারণ?
চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পাচ্ছে সোহেলী, পাথর হয়ে বসে রাশেদ। হাত এখনও ভাতের প্লেটে, চোখও সেটাতেই আটকে আছে। মিতালী কথা শুরু করার পরে এক লোকমা ভাত মুখে তুলতে পারে নি আর। সোহেলী নড়তে পারছে না, বুঝতে পারছে ওর মতো একই কারণে না হলেও, রাশেদের একই অবস্থা।
পিয়ালী এবার একটু গম্ভীর হয়ে গেলো, “তো তুই কি বলতে চাচ্ছিস? স্বামীকে সম্মানই করা উচিৎ না? আর সেলিনা আন্টি আজকে যেইটা করসে সেটা ঠিক? মানুষের সামনে হাজবেন্ড-ওয়াইফ মারামারি করাটা খুব ভালো কাজ?”
“মোটেই ভালো কাজ না! স্বামীকে অবশ্যই সম্মান করা উচিৎ… বাট!… তারে সেই সম্মানের যোগ্য হইতে তো হবে, তাই না?! সম্মান পাওয়াটা কারও অধিকার না পিউ… সম্মানটা অর্জন করতে জানতে হয়… এই পারভেজ আঙ্কেল টাইপের হাজবেন্ড হইলে সম্মান আসবে? … দ্যাখ পিউ… আমাদের এসব কথায় কিছু যায় আসে না… কারণ হাজবেন্ডের প্রতি আমার আচরণ কেমন হবে, সেটা ঠিক করে দেয় সমাজ আর আমাদের শিক্ষা… সেখানে আমি তাকে অন্তর থেকে ভালবাসলাম কিনা, সম্মান করলাম কিনা… ম্যাটার করে না… মনে মনে যদি আমি তারে কুৎসিত দুইটা গালিও দেই… ঘৃণাও করি… সামনে সামনে আমি তারে আপনি-হুজুর করবো… কারণ সেটা না করার সাহস আমার নাই… না করলেই আমারে লোকে গালি দিবে… যেমন দিচ্ছে সেলিনা আন্টিরে… বা তিথি আপুরে… আর হাজবেন্ড ব্যক্তিটা… যেহেতু সে অলরেডি এই ফ্যাসিলিটিটা পায়… একটা সম্মানজনক পজিশনের… সুতরাং তার মাথাতেও থাকে না যে সম্মান জিনিসটা আরোপ করে দেয়ার বিষয় না… ওটা অর্জন করতে হয়… সামনে সামনে হুজুর-হুজুর টাইপ বিহেভিওর পেয়ে সে আনন্দের সাথে জীবন পার করে ফেলে… তার মাথায় আর এটা আসে না যে সম্মান পাইতে হইলে সম্মান দিতেও জানতে হয়… আরেকটু সিমপ্লি বলি… ধর আব্বুর অফিসের আব্বুর উপরে যে বস… কি জানি নাম আঙ্কেলের? রহমান আঙ্কেল… উনার কথাই ধর… আব্বু বাসায় এসে কি বলে? যে উনি এতো উপরে উঠসে স্রেফ তেলবাজির জোরে আর ঘুষ দিয়ে টিয়ে… রেজাল্ট ভালো না, আব্বুর ধারে কাছেও না… একটা অফিস রান করার যোগ্যতা তার নাই… কিন্তু বসে আছে আব্বুর চাইতে উঁচু পজিশনে… উনার দুলাভাই না কে জানি আছে উপরে, তার জোরে, রাইট? তাইলে তুই বল… আব্বু যে এতো ব্রিলিয়ান্ট… আব্বুর উপরে একজন অযোগ্য ব্যক্তি বসে আছে… আব্বু কি তারে মন থেকে সম্মান করে? করে না তো, তাই না? কিন্তু সামনে সামনে তো ঠিকই তারে স্যার ডাকতে হয়, তাই না? এবার বুঝছিস? সম্মান করার মতো মানুষ হইলে তারে সম্মান করবো না কেন? আমাকে কি মেন্টালি চ্যালেঞ্জড মনে হয় নাকি তোর?”
রাশেদ ঘুরে তাকালো সোহেলীর দিকে। দুই চোখের দৃষ্টি ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। দাঁতে দাঁত চেপে সে সোহেলীকে প্রশ্ন করলো, “এইসব শিখাচ্ছো মেয়েদের? এই সমস্ত বস্তাপঁচা আইডিয়া দিয়ে মাথা ভরতেসো ওদের? আমার পিছনে পিছনে এইগুলা শিখাও ওদের তুমি?! আমার বিরুদ্ধে উস্কাও?” শেষের বাক্যটা বলার সময় ওর আওয়াজটা কর্কষ হুঙ্কারে পরিণত হলো। জীবনে যতোবার এই গলার আওয়াজটা শুনেছে সোহেলী রাশেদের, ততোবার ওর পুরো শরীরে কাঁপুনি উঠে গেছে আতঙ্কে। আজকে এই প্রথমবারের মতো এই হুঙ্কারের সামনে ও নিজেকে আবিষ্কার করলো সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন ভাবে। ওর ভয় হচ্ছে না আজ। কান্নাও পাচ্ছে না। ওর নিজের মনের ভেতরেও এই বিষয়টা ভেসে গেলো একবার, ও কিছুই অনুভব করছে না!
রাশেদের দিকে চেয়েছিলো ও, যন্ত্রের মতো ওর ঘাড় ঘুরে গেলো মিতালীর দিকে, মেয়ের গলার বিস্মিত প্রশ্ন শুনে, “আব্বু! তুমি আম্মুকে কি বলতেসো এইগুলা? তোমার সিরিয়াসলি মনে হয় এগুলা কিছু আম্মু শিখাইসে আমাদের? আম্মুর অতো সাহস আছে? না আমরা দুই বোন আম্মুরে গোণায় ধরি? আম্মু খালি কয়টা টাকাই ইনকাম করে এই বাসায়, আর হ্যাঁ… রান্নাটা করে… ঘরের কাজকাম করে… এর বেশি তো কিছু না! এই বাসা তোমার! এই খাবার তোমার! বাসার বা আমাদের ব্যাপারে সমস্ত ডিসিশন তো তুমিই নাও! আমরা যা কিছু শিখসি, তোমাকে দেখেই শিখসি, আব্বু!”
বাবার চোখে চোখ রেখে সাবলীল ভঙ্গীতে কথাগুলো বলে গেলো মিতালী। সোহেলী লক্ষ্য করলো পিয়ালীও সরাসরি চেয়ে আছে রাশেদের চোখের দিকে। দুই মেয়ের দিকে তাকিয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে রাশেদ। আচমকা উঠে দাঁড়াতে চেয়ারটা পেছনে উলটে পড়তে গিয়েও পড়লো না। রাশেদ দ্বিতীয় হুঙ্কার ছাড়লো, “তো কি আমি শিখাইসি তোমাদের এগুলো? এত্তো বেয়াদব হইসো তোমরা? কোত্থেকে শিখে আসছো এইসব? ওই তিথির কাছ থেকে?”
রাশেদ যতো জোরে কথাগুলো বলছে, সোহেলীর মনে হলো বাইরের করিডোরের ওই প্রান্তে তিথিদের বাসার ভেতর থেকেই ওরা শুনতে পাবে ওর কথা। মিতালী কিন্তু সম্পূর্ণ শান্ত। শান্তস্বরেই বললো, “শান্ত হও আব্বু! কেন উত্তেজিত হচ্ছো? তুমিই না সবসময় আম্মুকে বলো? আম্মুর কোনও কিছু ভুল হলেই… কিছু জিনিস হাজার বলেও শেখানো যায় না মানুষকে… কিছু কিছু নিজে থেকে শিখে নিতে হয়, মানুষ নিজেই শিখে নেয় আশপাশ দেখে… তো আমি তো তোমার মেয়ে, তাই না আব্বু? আমি তোমাকে আর আম্মুকে দেখেই শিখে নিসি যে মেয়েদের কেমন হতে হয়… আর পুরুষদেরই বা কেমন হওয়া উচিৎ! তিথি আপুর থেকে শিখার অনেক কিছু আছে, সেটা সত্য… কিন্তু তিথি আপুর থেকে কিছু শিখার মতো সাহস আমার বা পিউয়ের নাই… তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো… যাদের সামনে আম্মুর মতো একটা ক্যারেক্টার থাকে যে অপমানকেই নিজের ম্যারিড লাইফের অলঙ্কার মনে করে, যাদের সামনে তোমার মতো একজন গার্ডিয়ান থাকে যে সমাজের সামনে সম্মান রক্ষা করা বলতে বোঝে সমাজের প্রতি দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়াকে… তারা তিথি আপুর মতো সত্য কথা শিরদাঁড়া সোজা করে সবার সামনে বলার মতো সাহস রাখে না…”
রাশেদের রাগ আর বিস্ময় আজকে সীমা ছাড়িয়ে গেছে। উঠে দাঁড়িয়ে কাঁপছে রীতিমতো রাগে। কথা বেরোচ্ছে না মুখ দিয়ে। কোনরকমে বললো, “আর একটা কথা বললে জন্মের শিক্ষা দিয়ে দেবো মিতালী! মনে করো না আহ্লাদ পেয়ে পেয়ে বড় হয়েছো বলে তোমার সবরকম বেয়াদবি, আস্পর্ধা আমি মেনে নেবো! এক চড়ে গাল ফাটিয়ে দেবো বলে রাখলাম…”
ঠিক সেই সময় মিতালী বাঁ হাতের কনুইটা টেবিলের উপর রেখে হাতের তালুর উপর রাখলো নিজের বাঁ চিবুকটা। মিষ্টি হেসে বললো, “ইস আব্বু!… ইউ লুক সো হ্যান্ডসাম ইউ নো? রাগলে তোমাকে কত্ত হ্যান্ডসাম লাগে তুমি জানো? তুমি আমাকে ঠিক তোমার মতো একটা ছেলে খুঁজে দিবা বিয়ে করার জন্য, কেমন? একদম তোমার মতো… ওকে? ঠিক এই রকম করে রাগ করবে! তাকেও এই রকম হ্যান্ডসাম লাগবে!”
ব্যঙ্গটা সহস্র তীরের তীক্ষ্ম ফলার মতো বিঁধলো রাশেদের গায়ে। চিৎকার করে কিছু একটা বলতে গিয়ে থমকে গেলো। ধপ করে চেয়ারে আবার বসে পড়লো রাশেদ। কানে বাজছে বহু বছর আগে শোনা একটা কথা, সোহেলীর বলা কথা, তখনও সোহেলী ওর সাথে ঝগড়া করতো, যুক্তির বিপরীতে যুক্তি দিয়ে তর্ক করতো, আজকের মতোও এমন চুপ, এমন নিস্তব্ধ হয়ে যায় নি তখনও। সেই বিয়ের প্রথম দিকে, মিতালী-পিয়ালীর জন্মেরও বহু আগে, কোনও একবার ঝগড়ার পরে সোহেলী ক্ষুব্ধভাবে বলেছিলো, “রাশেদ, রাগলে তোমাকে খুব কুৎসিত লাগে!”
হঠাৎই রাশেদের মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাসে দেখালো। ধীরে ধীরে কাঁধ ঝুলে পড়লো ওর। মাথাটা নেমে গেলো। যে পৌরুষ নিয়ে প্রতিমুহূর্তের অহঙ্কার ওর, আজ তাকেই ভীষন ভারী মনে হচ্ছে। ওর শরীরটা কাঁপতে দেখছে সোহেলী, সেটা কি ওর চোখের কোলে টলমল করা পানির ভেতর দিয়ে ওকে দেখার জন্যই কিনা সোহেলী বুঝলো না। রাশেদের গলা ভেঙে গেলো পরের প্রশ্নটা করতে, “সারাটা জীবন আমি তোমাদের প্রয়োজন, স্বপ্ন, সখ-আহ্লাদ পূরণ করার জন্য নিজেকে বিলায় দিলাম কি আজকে এই ঘৃণা পাওয়ার জন্য? এতো ঘৃণা? এতো অসম্মান?”
দীর্ঘ একটা বিরতি নিলো মিতালী কিছু বলার আগে। তারপর ধীর কণ্ঠে বললো, “আব্বু, পৃথিবীর মধ্যে সব থেকে বেশি ভালবাসি আমি তোমাকে… আম্মুর চাইতেও বেশি… সব্বাই জানে আমি আমার বাবার মেয়ে… তোমাকে ঘৃণা করার প্রশ্নই ওঠে না! দূরের কল্পনাতেও সেকথা আমি কোনদিন ভাবিনি… মানুষ হিসেবে তুমি সৎ, ভদ্র, সচ্চরিত্র, সজ্জন… মানুষ হিসেবে তোমাকে অসম্মান করার মতো দুঃসাহসও আমার নেই… যদি সেরকমটা তোমার মনে হয়ে থাকে, আমি সত্যি দুঃখিত… তবে এটা সত্য… তোমার প্রতি আমার যত ভালবাসা, যত সম্মান… সবটুকুই একান্তই আমার বাবা হিসেবে… আমার মায়ের স্বামী হিসেবে না…“।
হঠাৎ করেই যেন হেরে গেলো রাশেদ, আর কিছু বলার মতো কথা খুঁজে পেলো না। স্তম্ভিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো মেয়ের মুখের দিকে। সোহেলী গাল বেয়ে যখন গরম পানি গড়ালো, তখন ওর খেয়াল হলো ও কাঁদছে। কেন কাঁদছে তা জানে না, খুব কষ্টে নাকি খুব আনন্দে নাকি ভীষণ অনুতাপে ও বুঝে উঠতে পারছে না। শুধু এটুকু বুঝতে পারছে যে অনুভূতিটাই ওকে কাঁদাক না কেন, অনুভূতিটার তীব্রতা খুব বেশি।
ঝাপসা চোখে ও মিতালীকে দেখলো। মেয়েটার মুখে তখনও হাসি, চোখ বাবার দিকে, কিন্তু হাসিটা ওর চোখ ছুঁচ্ছে না। পিয়ালীকে দেখলো। পিয়ালী বরাবরের মতোই গম্ভীর, চোখ মায়ের দিকে। সেই চোখে প্রচন্ড শাসন।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here