উপন্যাসঃ মেঘফুল
পরিচ্ছেদঃ ১০,১১
লেখকঃ মিশু মনি
১০
পৃথিবীতে প্রেমে পড়ার মুহুর্তের চাইতে সুন্দর আর কিচ্ছু নেই! মৃদু আলোতেও সামারের লাজুক মুখটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো আরজুর সামনে। চাদরের উষ্ণতা অনুভব করে সামার চোখ নামিয়ে ফেলেছে। মুখে মিষ্টি হাসির প্রলেপন।
আরজু জানতে চাইল, ‘ ওদিকটায় গিয়ে বসবেন? নাকি বেশী বেশী কিছু চেয়ে ফেললাম?’
‘ চলুন। বেশী বেশী চাওয়ার অধিকারটুকু যার হাতে আছে, সে তো চাইতেই পারে।’
‘ অধিকার পেয়ে বসে আছি এটা তো আগে জানতামই না।’
‘ বোকাসোকা মানুষরা এসব জানবে কেমন করে?’
‘ আমি ফোকাসোকা! ভালোই বলেছেন। এই প্রথম কেউ আমাকে বলল আমি বোকাসোকা।’
সামার হেসে বলল, ‘ স্বাভাবিক নয় কী? সুন্দরী মেয়ে পাশে থাকলে যেকেউ বোকাসোকা হয়ে যায়।’
আরজুর হাসি পেলো। সামার ঠিকই বলেছে। সে অসম্ভব সুন্দরী। শুধু সুন্দরী বলেই নয়, সামার অন্যরকম একটা মেয়ে। সামারকে এক পলক দেখার জন্য আরজুর বুক আকুপাকু করে। ওর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়, যখন সামার বলে ‘আজকে ঘুমাবো, ফোন রাখছি।’
সামারের সঙ্গে পরিচয়ের দুই মাস হলো। একটা জন্মদিনের পার্টিতে পরিচয়। তারপর এক বন্ধুর মাধ্যমে ফেসবুক আইডি আদানপ্রদান। সেই থেকেই কত কথা দুজনাতে৷ গল্প, আড্ডা, মাঝেমাঝে রেস্টুরেটে বসে দুজনের প্রিয় খাবারগুলো ভাগাভাগি করে খাওয়া। সময়গুলো মধুর মতো কাটছে। আরজুর এখনই উচিৎ সামারকে ভালবাসার কথা জানিয়ে দেয়া।
সামার শুকনো পাথরের ওপর বসে পড়ল। আরজুও বসল ওর পাশে। মাথার ওপর কুয়াশা পড়ছে। পাহাড়ি এলাকায় এখনো যেন শীতকাল। নির্জনতা ক্ষণিকেই স্পষ্ট হয়ে উঠল।
সামার বলল, ‘চুপ করে থাকবেন? ফোনে তো কথার খই ফুটতে থাকে।’
আরজু লজ্জা পেলো। সামনা সামনি দেখা হলেও কত গল্প করেছে আগে। অথচ আজ সংকোচে মরে যাচ্ছে। প্রেমে পড়লে এমন হয় হয়তো! আরজু গলা খাকাড়ি দিলো।
সামার বলল, ‘গল্প শুনবেন? আমার বোনদেরকে নিয়ে?’
‘ হুম শুনবো।’
‘ আমার বড় আপুর নাম জাহ্নবী৷ আপু খুবই শান্ত প্রকৃতির। তারচেয়েও বড় কথা, আপু কখনো আমাদের দুই বোনের সাথে মেশে না। ওর একটা রুম আছে। রুমে বুকশেলফ ভর্তি বই আছে। সারাদিন সে বই পড়ে কিনা জানিনা, কিন্তু বেশিরভাগ সময় রুমেই থাকে। রুম আর রান্নাঘর। এছাড়া আপুকে কোথাও পাওয়া যায় না। একটা জায়গায় পাওয়া যায় অবশ্য, খাবার টেবিল।’
আরজু অবাক হয়ে বলল, ‘অদ্ভুত তো। আপনার বোন অথচ আপনার পুরোপুরি বিপরীত স্বভাবের।’
‘একদম। আর আমার ছোট বোনটা, ওর নাম ভায়োলেট। ও আবার ঠিক চুপচাপও না, আবার আমার মতো চঞ্চল প্রকৃতিরও নয়। ও সবার সঙ্গে মেশে। খুব চিন্তাশীল। যেকোনো কাজ অনেক চিন্তাভাবনা করে করবে। কিন্তু যেটাই করবে, সেটাই একদম সঠিক সিদ্ধান্ত হয়। আমি আবার সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা। বারবার ভুল করি।’
হেসে উঠল সামার। আরজু বলল, ‘বারবার ভুল করা মানুষ গুলো সাদামাটা হয়।’
‘ আমি সাদামাটা কিনা জানিনা। আমি একটু দিলখোলা। হা হা হা ‘
‘ তা বটে। এটা আমি জানি। যদিও সেই খোলা দিলে এখনও প্রবেশ করতে পারিনি।’
সামার লাজুক ভঙ্গীতে হাসল। এখানটায় খানিকটা অন্ধকার। ধীরেধীরে খড়ির আগুনও কমতে শুরু করেছে। যারা বাইরে ছিল তারাও ইতিমধ্যে চলে গেছে তাঁবুতে। আগুন বাড়ানোর জন্য কাঠ সংগ্রহ করার কেউ নেই। সামার সেদিকে তাকিয়ে রইল। আগুন নিভে গেলেই অন্ধকারে ডুবে যাবে তারা।
আরজু বলল, ‘ কী দেখছেন?’
‘ আগুন নিভে যাচ্ছে।’
‘ যাক।’
‘আগুন নিভে গেলে আলোও নিভে যাবে।’
‘ যাক।’
‘ অন্ধকারে আমার ভয় করে।
‘ আমি হাত ধরে থাকবো।’
সামার আরজুর দিকে তাকালো। আরজু মুচকি হাসছে। সামারের লাজুক চেহারা ক্রমশই ওর বুকের ধুকপুকুনি বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রসঙ্গ বদলাতে সামার বলল, ‘বলুন তো আমাদের তিন বোনের মধ্যে কে বেশী মেধাবী?’
‘ উমম, আপনি।’
‘ না। উত্তর ভুল। আমাদের তিনবোনের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ব্রিলিয়ান্ট আমার বড় আপু জাহ্নবী।’
অবাক হলো আরজু। জাহ্নবী সবার চেয়ে মেধাবী সেটা কল্পনাও করেনি সে। বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, ‘আপুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন না?’
‘ দেবো। এখান থেকে ফিরে আমাদের বাসায় আসুন একদিন।’
‘ বাসায় যাবো? সিরিয়াসলি?’
‘ হুম। আমার বাসার লোকজন খুবই আন্তরিক। আপনি গেলে ওরা যথেষ্ট খাতির করবে।’
‘ জামাই আদর?’
কথাটা বলেই হেসে উঠল আরজু। সামার নিজেও হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে অন্যদিকে মুখ ঘোরালো সামার।
কিছুক্ষণ পর সামার বলল, ‘আমি যাই, ঘুম পাচ্ছে।’
‘ ঘুম পেলে আটকিয়ে রাখার সাধ্য তো আমার নেই।’
‘ আপনার কোনো সাধ্যই নেই মিস্টার আরজু। আপনি একটা গ্রেট বোকাসোকা।’
সামার কথাটা বলেই উঠে দাঁড়াল। চলে যেতে উদ্যত হল সে। আরজু আচমকা ওর সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। সামার কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরজু ওকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলল। আরজুর থুতনির সঙ্গে কপালের ঘষা লেগে গেল সামারের। সামার নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারল না। আরজুর বুকে নিজেকে বন্দি করে সারাটা রাত কাটিয়ে দিতেও ওর দ্বিধা নেই। আরজুকে চায় সে, ভীষণভাবে চায়।
আরজু খানিকক্ষণ পর সামারকে ছেড়ে দিয়ে লজ্জিত ভঙ্গীতে মাথা চুলকালো। সামার স্তব্ধ হয়ে রইল। যেন স্পন্দন আটকে আছে ওর। থমকে গেছে সময়। পায়ের নিচে বুঝি শিকড় গজিয়ে ওকে নড়তে বাঁধা দিচ্ছে।
আরজু দুই পা পিছিয়ে গেল। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ছটফট করে উঠল আরজু। কাজটা ঠিক হয়নি, একদম না। সামার কী ভাবছে? কষ্ট পাচ্ছে না তো? ওকে এখনো প্রপোজ করাই হয়নি! ভাবলো আরজু।
সামারের দিকে তাকাতেই দেখল আবছা অন্ধকারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সামার। আরজু ‘সরি’ বলার জন্য এগিয়ে এলো ওর দিকে। কিন্তু কিছু বলার আগেই সামার অকস্মাৎ জড়িয়ে ধরলো ওকে। এবার আর দ্বিধা রইল না আরজুর। সামারকে শক্ত করে বুকে লেপ্টে জড়িয়ে ধরে রইল সে।
ঢাকা শহরে রাত নামে ভোর তিনটায়। রাত দুইটার সময়েও পাশের কোনো ফ্ল্যাট হতে মানুষের গলা ভেসে আসে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলে কেউ কেউ। আবার আলো জ্বলতে থাকে কারও ঘরে। রাত তিনটা পেরোলে ধীরেধীরে স্তব্ধ হতে শুরু করে সব বাসা। রাত নামতে থাকে শহরের মাঠে। সবাই একে একে ঘুমিয়ে পড়ে।
কিন্তু আজ রাত তিনটা বেজে গেলেও ভায়োলেট জেগে আছে। ওর ঘুম হচ্ছে না। এই বাড়ির তো বটেই, সবাই বলে ভায়োলেট নাকি এই শহরের সবচেয়ে সুখী মেয়ে। কারণ সে শুয়ে পড়লেই মিনিট দুয়েকের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। রাত দশটায় ঘুমিয়ে পরদিন সকাল সাতটা অব্দি ঘুমায় সে। কোনোরকম দুশ্চিন্তা ছাড়াই। অথচ আজ রাতে তার ঘুম হচ্ছে না। অস্থিরতা কাজ করছে। বারবার এপাশ এপাশ করছে ভায়োলেট।
টেবিলে আলো জ্বালিয়ে ভায়োলেট একটা খাতা টেনে নিয়ে বসল। খচখচ শব্দে লিখে ফেলল কিছু। চারদিকে ভীষণ নিস্তব্ধতা। শুধু খচখচ আওয়াজ হচ্ছে। ভায়োলেট পাতা ওল্টালো, আবারও লিখছে। একটা পাতা টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলার শব্দও হল।
জাহ্নবী আবছা ঘুমের ভেতর সবকিছু শুনতে পাচ্ছিল। চোখ মেলে টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখল ভায়োলেট টেবিলে ঝুঁকে বসে আছে। গভীর চিন্তায় মশগুল সে।
জাহ্নবীর মনে দুশ্চিন্তা দানা বাঁধল। বিছানা ছেড়ে উঠে ধীরপায়ে ভায়োলেটের কাছে এগিয়ে এসে জাহ্নবী বলল, ‘ কী হয়েছে ভায়োলেট?’
ভায়োলেট জাহ্নবীর দিকে তাকিয়ে একটা শুকনো হাসি দিয়ে বলল, ‘কই কিছু না তো। লিখছিলাম।’
‘ তুই কোনো সমস্যায় আছিস?’
‘ আরে আপু, কী যে বলো। আমি আবার কী সমস্যায় থাকবো?’
‘ সত্যি করে বল। আজকে দিনের বেলায়ও তোকে অনেক চিন্তাগ্রস্ত দেখেছি। তুই তো এমন থাকার মেয়ে না। কী হয়েছে তোর?’
ভায়োলেটকে জড়িয়ে ধরলো জাহ্নবী। ভায়োলেট বলল, ‘আপু, আমার কিচ্ছু হয়নি। আমি ওকে।’
‘ না আমার মনে হচ্ছে একটা গণ্ডগোল আছে। প্লিজ ভায়োলেট, প্লিজ?’
ভায়োলেট কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, ‘টেনশনের মতো কিছু নয়। আমি ঠিক আছি। আসলে আমি একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবছি। তোমাকে সময় হলে বলবো।’
‘ খারাপ কিছু?’
‘ না। খারাপ কিছু কখনোই না। অবশ্যই ভালো কিছু।’
‘ ভালো কিছু হলে তুই ঘুমাস নি কেন আজকে? এত রাতে জেগে জেগে টেনশন করছিস।’
ভায়োলেট আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘আপু। আমার স্বপ্ন আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না।’
‘ মানে! কিসের স্বপ্ন?’
‘ বুঝবে না তুমি। যদি কখনো তুমি কোনো স্বপ্ন দেখো, সেই স্বপ্ন প্রত্যেকটা মুহুর্ত তোমার শরীরে শিহরণ তুলবে। প্রত্যেকটা সেকেন্ড তোমার অস্থিরতা কাজ করবে। ঘুম আসবে না কিছুতেই। স্বপ্ন একটা মারাত্মক জিনিস আপু।’
জাহ্নবী বিছানার ওপর বসল। ওর চোখে ঘুম। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে উত্তর দিলো, ‘ কী জানি! আমি এতকিছু বুঝি না বাবা। তোর স্বপ্ন কীসের? আমাকে বলবি না?’
‘সময় হলে বলবো। জানো আপু, স্বপ্ন দেখতে শুরু করলে প্রতিটা দিন অর্থবহ মনে হয়। আরও মনে হয়, জীবনটা অনেক সুন্দর কিন্তু খুব ছোট্ট। স্বপ্ন পূরণের জন্য আমাদের হাতে অনেক কম সময় আছে।’ বলল ভায়োলেট।
জাহ্নবী হতাশ গলায় বলল, ‘আমিও এক সময় অনেক স্বপ্ন দেখতাম রে। আমি জানি এই ফিলিংস। আমি একসময় ভাবতাম, ডাক্তার হবো। যখন ক্লাস এইটে পড়তাম। ভাবতাম, ক্লাসের সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট আমি করবো। ওই গুলোই আমার কাছে স্বপ্ন ছিল। আমি ঘুমাতে পারতাম না। ভালো রেজাল্ট করলে জীবনটা অন্যরকম লাগতো। সবসময় ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছি ঠিকই, কিন্তু ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লাম অথচ জীবনে কিছুই করলাম না। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব অর্থহীন হয়ে গেছে।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জাহ্নবী। ভায়োলেট জাহ্নবীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ অর্থহীন হয়নি কিছুই। জীবনের এখনো শুরুই হয়নি। তুমি এখনও স্বপ্ন দেখতে পারো।’
জাহ্নবী খানিকটা হতাশ আর কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলল, ‘আমার বয়স শেষ। বুড়ি হয়ে গেছি। এখন আর কিসের স্বপ্ন।’
ভায়োলেট হেসে বলল, ‘ মিশু মনি নামে একজন লেখক কী বলেছেন জানো? তিনি বলেছেন, মানুষের জীবন শুরুই হয় একচল্লিশ বছর বয়সে। ধরো আমরা গড়ে সত্তর বছর বাঁচি। প্রথম অর্থাৎ এক থেকে বিশ বছর বয়স পর্যন্ত আমরা শুধু দুনিয়াটাকে দেখি। দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারিনা। বিশ বছরের পর আমরা জীবনকে উপলব্ধি করতে শিখি। তখন ভাবি আমার কিছু করা উচিৎ। আর চল্লিশ পঞ্চাশ বছর বয়স হয়ে গেলে আমাদের দেশের মানুষ ভাবে তার সব শেষ। বাচ্চাকাচ্চা, সংসার, দেনা পাওনা, ব্যাংকের কিস্তি, ছেলের স্কুল, জমিজমা, এসব করতে গিয়ে আমরা জীবনটাকে তিক্ত করে ফেলি। জীবনটাকে মনে হয় বিষাক্ত, অসুখী। অথচ বিষয়টা হওয়া উচিত এমন, বিশ/ বাইশ বছর বয়স পর্যন্ত আমরা দুনিয়াটাকে দেখবো আর শিখবো। বিশ থেকে চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত মানুষ শুধু পরিশ্রম করবে, লড়াই করবে, সাকসেস হবে আর লাইফটাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে দাঁড় করাবে যেন তার বাকি জীবনে আর খুব বেশী পরিশ্রম করতে না হয়। ততদিনে ছেলেমেয়েও মোটামুটি বড় হয়ে যাবে। একচল্লিশ বছরে পা দেয়ার পর থেকে বাকি যতদিন বেঁচে থাকবে, জীবনের প্রত্যেকটা দিনকে শুধু উপভোগ করবে। এখানে থাকবে না কোনো টেনশন, কোনো দেনা, কোনো বিরক্তি। শুধুই এনজয়। জীবনকে সেভাবেই তো গোছানো উচিৎ।’
জাহ্নবী বলল, ‘ তাহলে তো আমার হাতে আর মাত্র ৫ বছর আছে।’
ভায়োলেট হেসে উত্তর দিলো, ‘ তুমি সময়টাকে নষ্ট করে ফেলেছো আপু৷ সামনের সময়টাকে কাজে লাগাও। জীবনটাকে গোছাও। যেন ভবিষ্যতে এখনকার মতো আফসোস করতে না হয়।’
‘ কিন্তু আমি করবো টা কী?’
‘ সেটা নিজেকেই জিজ্ঞেস করো। তুমি কী করবে সেটা যদি আমিই বলে দেই তাহলে কীভাবে হবে?’
জাহ্নবী একটা নিশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘ আচ্ছা। ঘুমাবি না?’
‘ঘুম তো আসছে না আপু। আমি বই পড়বো। তুমি ঘুমাও।’
জাহ্নবী বিছানায় অন্যপাশে ফিরে শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করে তার প্রতিদিনকার স্বপ্নকে আওড়াতে চেষ্টা করল। প্রায়ই রাতে ঘুমানোর আগে সে চোখ বন্ধ করে দেখতে পায়, একটা চমৎকার দোতলা বাড়ি। বাড়ির দোতলায় একটা খোলা বারান্দা। সেখানে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজা যায়। বারান্দায় রাখা একটা ইজি চেয়ার, চেয়ারে বসা একটা পুরুষ মানুষ..’
কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, আজকে ওর চোখে সেই স্বপ্ন আসছে না। কিছুতেই ওই কল্পনায় ঢুকতে পারছে না জাহ্নবী। বরং চোখ বন্ধ করলেই মনে হচ্ছে, সে নতুন করে বাঁচতে শিখছে। জীবনের জন্য নতুন স্বপ্ন আসতে শুরু করেছে তার চোখে।
চলবে..
উপন্যাসঃ মেঘফুল
পরিচ্ছেদঃ ১১
লেখকঃ মিশু মনি
অর্ণব অপেক্ষা করছে জাহ্নবীর জন্য। একসঙ্গে বাসা খোঁজার উদ্দেশ্যে বের হবে তারা। জাহ্নবী অস্বস্তি বোধ করছে। কখনো কোনো পুরুষ মানুষের সঙ্গে বাইরে বের হয়নি সে!
বাসা থেকে বের হয়ে জাহ্নবী উবার থেকে গাড়ি ডেকে নিলো। অর্ণবের ধারণা ছিল দুজনকে একই রিকশাতে যেতে হবে। জাহ্নবীর এই কাজে বেশ চমকে গেছে অর্ণব।
গাড়িতে দুরত্ব বজায় রেখে বসল দুজনে। অর্ণব আড়চোখে জাহ্নবীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ আপনাকে ঝামেলায় ফেলে দিলাম তাইনা আপু?’
‘ আরে না।’
‘ আপু, আমরা কীভাবে বাসা খুঁজবো? টু লেট দেখে দেখে যাবো?’
‘ আমি আসলে বুঝতে পারছি না।’
জাহ্নবী গম্ভীর মুখে বসে রইল। এরকম পরিস্থিতিতে কী বলা উচিৎ ওর জানা নেই। তাছাড়া অর্ণবের মুখে আপু ডাকটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল।
ঢাকা শহরের অতি জনপ্রিয় শব্দ ট্রাফিক জ্যাম। এই জ্যাম শব্দের সঙ্গে ঢাকাবাসীর জীবন যেন আষ্ঠেপৃষ্ঠে লেপ্টে আছে। সেই শব্দের কবলে পড়ল ওরা। গাড়ি এমনভাবে একই জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে রইল যে, দুজনেরই ইচ্ছে করতে লাগল গাড়ি থেকে নেমে এই জ্যাম ছেড়ে পালিয়ে বাঁচি।
অর্ণব বলল, ‘আপু, আপনি কী রাগ করছেন?’
‘না তো। কেন?’
‘আপনাকে অযথা কষ্ট দিচ্ছি।’
‘এই কষ্ট আপনিও পাবেন। ঢাকায় একেবারে চলে আসুন, জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যাবে আপনার।’
‘তাহলে কী ঢাকায় না এলেই ভালো হবে?’
অর্ণব জাহ্নবীর চোখের দিকে তাকিয়ে এমনভাবে কথাটা বলল যে, জাহ্নবীর বুক ধক করে উঠল। মুহুর্তের জন্য মনে হল, অর্ণব কথাটা তাকেই উদ্দেশ্য করে বলেছে। জাহ্নবী মনেমনে নিজেকে গালি দিলো। মনটা তুলোর মত নরম হয়ে আছে তার। সামান্য ব্যাপারেই প্রেমে পড়ার জন্য মনটা অস্থির হয়ে আছে। কখন যে টুপ করে কারও প্রেমে পিছলে পড়ে যাবে, সেই দুশ্চিন্তায় মুখ ঘুরিয়ে বাইরে তাকাল জাহ্নবী।
গাড়ির পাশে একটা বাচ্চা এসে দাঁড়াল। ফুল বিক্রি করতে এসেছে। একটা বালতিতে কিছু গোলাপ ফুল আর সাদা বেলী ফুলের মালা। জাহ্নবী বেলীফুলের একটা মালা কিনে নিলো। ব্যাগ থেকে টাকা বের করে বাচ্চাটাকে দশ টাকা বেশী দিয়ে দিলো সে। একটা ফুল কিনে অর্ণবকে দেয়া যেতেই পারে। কিন্তু গোলাপ ফুল ভালবাসার প্রতীক, এটা জাহ্নবী জানে। একটা মেয়ে একটা ছেলেকে গোলাপ ফুল কিনে দিয়েছে এটা তার নিজেরই ভাবলে কেমন যেন লাগবে। আর বেলীফুল তো মেয়েদের ফুল, এটা ছেলেদেরকে দেয়া যায় না। জাহ্নবী বেলীফুলের মালাটা হাতে পেঁচিয়ে বসে রইল।
অর্ণব বলল, ‘কী ফুল এটা?’
‘বেলী।’
‘ খুব সুন্দর ঘ্রাণ।’
জাহ্নবী অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। মনে হল, একটা বেলীফুলের মালা অর্ণবকে দিয়ে সে তো বলতেই পারত, ‘ফুলটার ঘ্রাণ খুব সুন্দর। শুঁকে দেখুন।’
যদিও জাহ্নবী এতটা আত্মবিশ্বাসী নয়। কারও সাথে সহজে মিশতে পারে না সে।
জ্যাম ছেড়ে দিলে দ্রুত লালমাটিয়ায় পৌঁছে গেল ওরা। গাড়ি হতে নেমে গনগনে রোদের উত্তাপে দুজনেরই মন ভেঙে যায় যায় দশা। অর্ণব জাহ্নবীকে বলল, ‘আপু, আপনি বরং বাসায় চলে যান। আমি একাই বাসা খুঁজে নিবো।’
জাহ্নবী মনেমনে বলল, ‘আর একবার আপু ডাকলে সত্যি সত্যি বাসায় চলে যাবো।’
জাহ্নবী এভাবে কখনোই বলতে পারবে না। মুখে বলল, ‘আপনাকে একা রেখে গেলে মা আমাকে রাগারাগি করবে।’
‘ তাহলে চলুন বাসা খুঁজি।’
অর্ণবের লজ্জা করছে। একটা মেয়ের সঙ্গে বাসা খুঁজতে বেরিয়েছে সে, কথাটা শুনলে ওর বন্ধুরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়বে। সারাক্ষণ মজা করবে ওর সাথে। একটা ছেলে তো তার সঙ্গেই বাসা খুঁজতে যায়, যার সঙ্গে বাসাটাকে ঘর বানিয়ে তুলবে সে।
অর্ণবের ইচ্ছে কয়েক মাস চাকরি করার পর একটা বিয়ে করবে। ভীষণ লক্ষী আর ঘরপ্রিয় একটা মেয়ে। যেসব মেয়েদের সংসারে মন নেই, তাদের সাথে সংসার করে আনন্দ পাওয়া যায় না। বউ শাড়ি পরে এ ঘর, ও ঘর ঘুরে বেড়াবে। অর্ণবের চা খেতে ইচ্ছে হলে গলা বাড়িয়ে ডাকবে, ‘বউ, ও বউ, এক কাপ চা দিয়ে যাও তো।’
সঙ্গে সঙ্গে চা নিয়ে হাজির হবে বউ। অর্ণব তাকে বলবে, ‘এক কাপ কেন? তোমার চা কই?’
বউ বলবে, ‘তুমি তো এক কাপ ই দিতে বলেছ। এখন একা একা খাও।’
অর্ণব তখন মন খারাপ করা সুরে বলবে, ‘না না। তুমিও চা নিয়ে আসো। নয়তো এইযে চায়ের কাপ রেখে দিলাম। খাবোই না চা।’
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে শব্দ করে হেসে উঠল অর্ণব। জাহ্নবী অবাক চোখে তাকাল অর্ণবের দিকে। এই কাঠফাঁটা রোদে উত্তপ্ত ফুটপাত ধরে তারা হাঁটছে। গরমে কুলকুল করে ঘামছে জাহ্নবী। এরমধ্যে মজার কী খুঁজে পেলো অর্ণব?
জাহ্নবীর প্রশ্নবোধক চাহনি দেখে অর্ণব লজ্জা পেল। বলল, ‘সরি আপু। আমি আসলে একটা কথা ভেবে হাসছিলাম। কিছু মনে করবেন না প্লিজ।’
জাহ্নবীর রাগ হল। হাসার কারণ না জানার জন্য নয়, আবারও আপু ডাকটা শোনার জন্য। মুখ ঘুরিয়ে রাস্তার পাশে একটা লিফলেট দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল জাহ্নবী।
‘ব্যাচেলর রুমমেট চাই’
৬ষ্ঠ তলায় ব্যাচেলর ফ্ল্যাটে একজন রুমমেট আবশ্যক। আলোবাতাসপূর্ণ খোলামেলা বাসা। সম্পূর্ণ টাইলসকৃত। কল দিন – ০১৯৪..
জাহ্নবী দাঁড়িয়ে রইল লিফলেটের সামনে। অর্ণব দ্রুত নাম্বার টুকে নিয়ে কল করল। বাসা এখনো ভাড়া হয়নি। অর্ণব বলল, ‘আপনি একটু দাঁড়ান, আমি দেখে আসি বাসাটা।’
অর্ণবের বুদ্ধি দেখে রাগ হল জাহ্নবীর। এই রোদে, ফুটপাতে কোথায় দাঁড়াবে সে! নিশ্চিত মাথামোটা না হলে কেউ এভাবে বলে না। জাহ্নবী জানতে চাইলো, ‘বাসা কোনটা আপনি চিনেন?’
‘না। বলল যে, বি ব্লক। নয় বাই এগারো।’
‘ সেটা এখান থেকে অনেক দূর। আসেন আমার সঙ্গে।’
হাঁটতে হাঁটতে বাসাটা খুঁজে বের করল তারা। জাহ্নবীকে বাসার নিচে রেখে অর্ণব ওপরে গেল রুম দেখতে। মিনিট তিনেকের মাথায় হাফাতে হাফাতে নিচে এসে বলল, ‘বাসা তো পছন্দ হইছে। অনেক আলোবাতাস, অনেক সুন্দর। ভাড়া পাঁচ হাজার। এডভান্স তিন হাজার।’
‘আপনি কি এডভান্স দিয়ে এলেন?’
‘না এখনও দেইনি। ভাবলাম আগে আপনার মতামত শুনি।’
জাহ্নবী হেসে বলল, ‘আমার মতামত শুনলে এই বাসা আপনার নেয়া হবেনা।’
‘কেন?’
‘আপনি যেভাবে হাঁফাচ্ছেন। প্রতিদিন অফিস করে বাসায় ফিরে ছয় তলায় ওঠা সম্ভব না। এনার্জি থাকবে না।’
‘আরে! দারুণ কথা বলেছেন তো। আমি তো এভাবে ভেবে দেখিনি। আমার তো বাসাটা এতটাই পছন্দ হয়েছে যে, আমি এডভান্স দিয়েই ফেলতাম।’
‘হা হা। আমার মতামত শুনতে চাইলেন তাই বললাম। এখানে আরও ব্যাপার আছে, আপনার ছয় তলার ওপর আর ফ্ল্যাট নেই। গরমে থাকতে পারবেন না।’
অর্ণব অবাক হয়ে বলল, ‘কীভাবে জানলেন?’
‘গুণে দেখেছি। আর টপ ফ্লোরে অনেক গরম হয় সেটা তো আপনি জানেন।’
‘থ্যাংক ইউ আপু। আপনি না থাকলে আমি একটা ভুল করে বসতাম।’
‘যান ভুল করুন। এডভান্স দিয়ে আসুন।’
খানিকটা রাগত স্বরে কথাটা বলে হাঁটতে শুরু করল জাহ্নবী। অর্ণব কিছুতেই বুঝতে পারল না সে রাগ করার মতো কী বলেছে!
একটা দেয়ালে বেশ কয়েকটা লিফলেট দেখে জাহ্নবী বলল, ‘সব গুলো নাম্বারে কল দিন। বাসা কয় তলায়, এক রুমে কয়জন, ভাড়া কত সব শুনে তারপর সেটা দেখতে যাবেন।’
জাহ্নবীর কথামতো সব নাম্বারে বিস্তারিত শুনে একটা পছন্দসই বাসার খোঁজ পাওয়া গেল। তৃতীয় তলায়, ব্যাচেলর ফ্ল্যাট। এক রুমে দুইজন। ভাড়া তুলনামূলক বেশী। তবে অর্ণবের মনে হচ্ছে এই বাসাটাই তার জন্য সঠিক হবে।
খুশিমনে বাসা দেখতে গেল অর্ণব। বাসার নিচে একজন ছেলে এসেছে অর্ণবকে ওপরে নিয়ে যেতে। জাহ্নবীকে দেখে বলল, ‘আপু আপনিও আসুন। সমস্যা নেই।’
জাহ্নবী ইতস্তত করল। ব্যাচেলর বাসায় সে যেতে চায় না। ছেলেটা অর্ণবকে সঙ্গে নিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে বলল, ‘প্রথম দিনেই গার্লফ্রেন্ড নিয়া আসছো ব্রাদার? সমস্যা নেই। আমাদের বাসায় গার্লফ্রেন্ড এলাউ। বাড়িওয়ালা ওমানে থাকে। যে চাচা দেখাশোনা করে, আমরা ওনাকে প্রতিমাসে কিছু হাতখরচ দেই আর মাঝেমাঝে এটা ওটা খাওয়াই। মনে করো ওনার পেছনে তোমার কিছু খরচ হবে এইটা হইল এক্সট্রা খরচ। এর বাইরে এক্সট্রা কোনো খরচ নাই।’
ছেলেটার কথা মন দিয়ে শুনছিল অর্ণব। প্রথম সাক্ষাতেই এত কথা বলে ফেলল ছেলেটা। অর্ণব বাসাটা আদৌ নেবে কিনা, সেটা নিশ্চিত না হয়েই। কিন্তু জাহ্নবীকে অর্ণবের প্রেমিকা ভাবার কি কোনো যৌক্তিকতা আছে?
বাসাটা বেশ বড়। তবে নোংরা। কারও বিছানার সঙ্গে মশারি কাৎ হয়ে ঝুলে আছে, বিছানার ওপর জড়ানো চাদর ও মোচড়ানো কাপড় চোপর। যেন সদ্য বিবাহিত দম্পতিদের ভোরবেলার বিছানা।
ঘরের মাঝখানে হাড়ি পাতিল জমানো, ভাত খেয়ে প্লেট ফেলে রেখে গেছে কেউ। প্লেটে উচ্ছিষ্ট মাছের কাঁটা, তরকারির শুকিয়ে যাওয়া ঝোল। অর্ণব আসলে বুঝতে পারছে না, সে এই বাসা কী করে পছন্দ করবে!
একটা ছেলে মোবাইল টিপতে টিপতে বলল, ‘কোন ভার্সিটি? না জব?’
‘ জব।’
‘নতুন জব না অভিজ্ঞতা আছে?’
‘নতুন। আমি একচুয়েলি ঢাকাতেই নতুন।’
‘তাহলে এইসব দেখতে একটু আনইজি লাগবে। হা হা হা। কয়েকদিন থাকলে ঠিক হয়ে যাবে।’
‘কিন্তু আমি অনেক গোছানো।’
‘তাহলে আমাদের বাসাটা তুমি গোছাইয়া রাইখো। সবাই মিলে টাকা পয়সা কিছু দেবো নে।’
কথাটা বলল প্রথম সাক্ষাতের ছেলেটা। অর্ণব বুঝল সে মজা করে বলছে। অর্ণবও হেসে বলল, ‘আমি এখানে এলে বাসার চেহারাটাই বদলে যাবে।’
‘তাহলে তো বাসা ভাড়া না, তোমাকেই আমাদের ভাড়া করে আনা দরকার।’
‘হা হা। আপনাকে আমার খুব ভালো লেগেছে ভাইয়া।’
মোবাইলে ব্যস্ত থাকা ছেলেটা বলল, ‘ভাল লেগেছে কোন দিক থেকে? সৌরভ ওরে একটু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এই বাসায় উঠাইয়ো। এখানে গে এলাউ না।’
তারমানে প্রথম সাক্ষাতের ছেলেটার নাম সৌরভ। সে হাসতে হাসতে বলল, ‘ওর গার্লফ্রেন্ড আছে। গার্লফ্রেন্ড নিয়াই আসছে বাসা দেখতে। কত্ত কেয়ারিং দেখছ?’
‘তাহলে গার্লফ্রেন্ডকে নিয়া আসো। চা পানি কিছু খাওয়াইয়া দাও।’
অর্ণব বিস্ময় ভরা বড়বড় চোখে একবার সৌরভের দিকে তাকাচ্ছে, আর একবার মোবাইল টিপতে ব্যস্ত থাকা ছেলেটার দিকে।
সৌরভ বলল, ‘ ঘাবড়াই গেছো না? আরে ভয় পেও না। আমরা সবাই একটু বেশীই ফ্রি। প্রতিদিন মনে করো একসঙ্গে চা খেতে যাই। আড্ডা দেই। ঢাকা শহরে রুমমেট তো অনেক পাবা, এমন পাবা না।’
‘আপনারা আসলেই অন্যরকম।’
‘তুমি চিটাগাংয়ের?’
মোবাইল থেকে এই প্রথম চোখ তুলল ছেলেটা।
অর্ণব উত্তর দিলো, ‘জি।’
‘আমিও। আমার বাসা বহদ্দারহাট।’
‘সত্যি! তাহলে তো ভালোই হল।’
‘খুব খুশি হইছো দেখি। এত খুশি হওয়ার কিছু নাই। আমার বাসা বহদ্দারহাট না। আমার বাসা, জন্ম সব ঢাকায়।’
অর্ণব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। হো হো করে হাসতে লাগল সৌরভ। বহদ্দারহাটের ছেলেটা উঠে এসে অর্ণবের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘আমি রাতুল।’
‘আমি অর্ণব। আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। আমাকে এখন নিচে যেতে হবে। একজনকে দাঁড় করিয়ে এসেছি। আপনাদের সঙ্গে ফোনে বিস্তারিত কথা বলবো।’
‘ফোনে অত কথা বলার টাইম আছে ব্যাটা?’ সৌরভ বলল কথাটা।
রাতুল বলল, ‘এখনো তো রুমই দেখলেন না। আসুন রুম দেখাই।’
অর্ণবকে পাশের একটা রুমে নিয়ে গেল রাতুল। এই রুমটা বেশ পরিচ্ছন। দুইপাশে দুটো সিঙ্গেল বেড। একটা বিছানার তোশক নেই।
রাতুল বলল, ‘এইটা আমার রুম। রুমমেট আমারই দরকার। আপনি ফোনে আমার সঙ্গেই কথা বলেছেন। আপনাকে শুধু একটা তোশক কিনতে হবে। তাছাড়া সবকিছু আছে বাসায়। রান্নাবান্না করার জন্য খালা আছে। আপনি বাসাটা ঘুরে ঘুরে দেখুন। চার রুমের এই ফ্ল্যাটে সবাই আমরা অনেক ক্লোজ বলা যায়। এই রুমমেট চলে যাচ্ছে কারণ ওর সামনে বিয়ে। নয়তো আমার মনে হয় কেউ এই বাসা ছেড়ে কোথাও যাবে না।’
হাসল রাতুল। অর্ণব মুচকি হেসে ঘরের চারপাশটা দেখল। রাতুলের টেবিলের ওপর বইখাতা অনেক। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। গায়ে একটা টিশার্ট ও কোয়ার্টার প্যান্ট। চেহারা দেখে মনে হয় ভীষণ মেধাবী ছেলে। বাসার চেয়ে বাসার মানুষদের সঙ্গে কথা বলে অর্ণবের বেশী ভালো লেগেছে। এবার আর জাহ্নবীর মতামতের প্রয়োজন বোধ করল না অর্ণব। নিজে থেকেই অগ্রীম টাকা দিয়ে বেরিয়ে এলো।
জাহ্নবী দাঁড়িয়ে আছে গেটের বাইরে। অর্ণব হাত জোর করে বলল, ‘ক্ষমা করুন আমায়।’
অর্ণবের মুখে হাসি দেখে জাহ্নবী জানতে চাইলো, ‘এত খুশি কেন আপনি?’
‘বাসা পছন্দ হয়েছে। এটাতেই উঠবো।’
‘সবকিছু ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তো?’
‘হুম। সবদিক থেকেই এটা ভালো লেগেছে।’
‘আমার মনেহয় আরও বাসা দেখা যেতো। আরও দেখবেন?’
‘না। আপনাকে আর কষ্ট দেবো না। চলুন আমরা কোথাও বসি। অনেক কষ্ট দিয়েছি।’
‘ মাথার তালু গরম হয়ে আছে। আমি আইসক্রিম খাবো।’
‘চলুন ওই দোকানে দেখি।’
‘মহিলা কলেজের কাছে একটা আইসক্রিমের দোকান আছে। ওখানে যাবো।’
‘চলুন তাহলে।’
জাহ্নবীর হঠাৎ করেই মন ফুরফুরে হয়ে উঠল। এতটা সহজ সাবলীলভাবে কখনো কারও সঙ্গে কথা বলতে পারেনি সে। ধীরেধীরে নিজের বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে তাহলে!
জাহ্নবী হাত উঁচিয়ে বলল, ‘ওইযে ওইটা আইসক্রিমের দোকান। অনেক রকম আইসক্রিম পাওয়া যায় ওখানে।’
চলবে..