উপন্যাসঃ মেঘফুল
পরিচ্ছেদঃ ১২,১৩
লেখকঃ মিশু মনি
১২
জাহ্নবী আইসক্রিমের দোকানে বসে লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। তাকে বসিয়ে রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে অর্ণব। তিনজন কপোত কপোতী ভীষণ রোমাঞ্চকর পরিবেশ তৈরি করেছে আইসক্রিমের দোকানে। এত রঙ্গ করেও যে আইসক্রিম খাওয়া যায়, এ ধারণা ছিল না জাহ্নবীর। দ্রুত আইসক্রিম শেষ করে পালিয়ে বাঁচল সে।
রাস্তার পাশে হাঁটতে এসে অর্ণব বলল, ‘আপনি তাহলে বাসায় চলে যান। আমিও চলে যাই।’
‘মানে!’
‘চট্টগ্রাম ব্যাক করবো।’
‘ এটা ভালো দেখায় না। আপনি চলুন আমাদের বাসায়। খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিয়ে তারপর যাবেন।’
কাঠফাটা রোদ তার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। জাহ্নবী’র এখন মনটা চাঙা। এই চাঙা মনকে সে ভাঙা করতে চায় না বলেই তার এখন বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। আবার অর্ণবের সঙ্গে থাকতেও ইচ্ছে করছে না। লজ্জায়, সংকোচে দুরত্ব বজায় রেখে হাঁটছে সে।
অর্ণবের দ্রুত বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে। একজন মেয়ে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে রোদে রোদে ঘুরতে কোনো আনন্দ নেই। জাহ্নবীকে দেখে মনে হচ্ছে সে অনেক আনন্দিত। অর্ণব কিছু বলতে যাবে এমন সময় জাহ্নবী বলল, ‘আমি..’
‘বলুন?’
‘না, আপনি বলুন।’
‘আপনি আগে শুরু করেছেন। আগে আপনি বলুন।’
‘আমি একটা বই কিনতে চাই। যদি আপনার কোনো অসুবিধা না থাকে, আমি একটা বই কিনতে যাবো।’
অর্ণব দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেল। জাহ্নবী বই কিনতে যাবে কথাটার দুটো অর্থ পারে। অর্থ এক, জাহ্নবী অর্ণবকে চলে যেতে বলছে। যেন সে একা একা নিজের কাজে যেতে পারে। অর্থ দুই, জাহ্নবী অর্ণবকেও অনুরোধ করছে তার সঙ্গে বই কিনতে যেতে। অর্ণব কী বলবে সেটা বুঝে উঠতে পারল না। প্রশ্ন করে বসল, ‘আপনি কোথায় বই কিনতে যাবেন?’
‘এখানে একটা লাইব্রেরি আছে।’
‘তাহলে চলুন।’
জাহ্নবী চমকালো। কারণ সে মনেমনে অর্থ এক টাকেই চেয়েছিল। অর্থাৎ, সে চেয়েছিল অর্ণব বাসায় চলে যাক। সে একা একা লাইব্রেরিতে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকবে। একটা বইয়ের দু চারটা পৃষ্ঠা উলটে পালটে দেখবে। তারপর পছন্দমত একটা বই কিনে ধীরেসুস্থে বাসায় ফিরবে। কিন্তু অর্ণব সঙ্গে গেলে সংকোচেই মরে যাবে সে।
তবুও অর্ণবকে সঙ্গে নিয়েই যেতে হল। লাইব্রেরির প্রবেশ দ্বারে পা রেখেই বুক ধক করে উঠল জাহ্নবীর। অর্জন নামের সেই লোকটার কথা মনে পড়ে গেছে। সে এই লাইব্রেরিতে নেই তো!
ধরফর করছিল জাহ্নবীর বুক। স্ত্রস্তপদে লাইব্রেরিতে পায়চারি করতে লাগল সে। লাইব্রেরির নাম ‘বেঙ্গল বই’। মনোরম নির্জন এক পরিবেশ। বসার মতো অসাধারণ সব জায়গায় বসে বই পড়ছে অনেকে। পরিবেশ দেখেই বই পড়ার সাধ জাগে। অর্ণব একদিকে বই খুঁজতে লাগল। জাহ্নবী চলে গেল অন্যদিকে।
হুট করে কাউকে দেখে ফেললেই সে মনেমনে ভাবে, এটাই অর্জন নয় তো? আজকে পড়ার মুডটা হারিয়ে গেছে। অযথা একটা টেবিলে বসে কয়েক পাতা বই ওল্টালো জাহ্নবী। অর্ণব নিজেও ওর মুখোমুখি বসে বইয়ে মনযোগ দিলো। এতক্ষণে ধীরেধীরে অস্বস্তিভাব কাটতে শুরু করল জাহ্নবীর।
অর্ণব অনেক্ষণ বই থেকে মাথা তুলল না। ছেলেটা অনেক ভাল। ভাল বলতে বর্তমান ছেলেদের তুলনায় বেশ ভাল। জাহ্নবী মুগ্ধ চোখে কয়েক পলক তাকিয়ে রইল অর্ণবের দিকে। হঠাৎ মুখ তুলল অর্ণব। এই চোখাচোখি সত্যিই অপ্রত্যাশিত ছিল দুজনের জন্য। কেউই বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে পারল না।
অর্ণব দুই কাপ কফির অর্ডার দিতে গেল। শান্ত ভঙ্গীতে বসে রইল জাহ্নবী। অর্ণবের হাঁটার ধরণ অনেক সাবলীল। কোনো জটিলতা নেই এতে। দুলতে দুলতে গিয়ে আবার ফিরে এলো মুহুর্তেই। জাহ্নবী মাথা নিচু করে বই পড়তে লাগল।
কফি খেতে খেতে ভার্সিটি জীবনের গল্প জুড়ে দিলো অর্ণব। গল্পে কথায় জড়তা কাটিয়ে অনেকটাই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলো ওরা। কফি শেষ করে একটা বই কিনে বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিলো। অর্ণব জোরপূর্বক একটা বই কিনে দিয়েছে জাহ্নবীকে। জাহ্নবী কিছুতেই নেবে না। অর্ণব অনুরোধের সুরে বলল, ‘প্লিজ নিন। আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। তার দুঃখপ্রকাশ হিসেবে সামান্য উপহার।’
জাহ্নবী খুশিমনে গ্রহণ করল। কারণ অর্ণব একবারও ‘আপু’ বলে ডাকে নি। আপু ডাকটা অর্ণবের মুখে শুনতে কুৎসিত লাগে ওর।
তারা বাড়ি ফিরে দেখল পারভীন খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছেন। দরজা খুলে দিলেন তিনি নিজেই। আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘বাসা পেয়েছো বাবা?’
অর্ণব বলল, ‘জি আন্টি। এগুলো রাখুন।’
তিন কেজি আম কিনে এনেছে অর্ণব। খুশি হয়ে গেলেন পারভীন। ভালো ছেলে না হলে এভাবে বাইরে থেকে কেউ আম কিনে আনে? আজকালকার ছেলেপেলেদের এসব দিকে কোনো নজর থাকে নাকি? তিনি আম নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন। অর্ণবকে জোর করতে লাগলেন দ্রুত খাবার খাওয়ার জন্য।
খাবার টেবিলে অর্ণব ও জাভেদ আলীকে মনের সমস্ত আয়েশ মিটিয়ে খাবার খাওয়ালেন পারভীন। জাহ্নবী গোসল করতে গিয়েছে। ফিরে এসে দেখল মায়ের আনন্দের সীমা নেই। খাওয়াদাওয়ার পর আম কেটে পিরিচে সাজিয়ে কাটাচামচ সহ খেতে দিয়েছেন অর্ণবকে। এমন জামাই আদর দেখে জাহ্নবীর চক্ষু চড়কগাছ!
পারভীন আদুরে গলায় জাহ্নবীকে বললেন, ‘মা, তুইও বস। আগে আম খা, তারপর ভাত খা। দ্যাখ অর্ণব কত ভালো আম কিনে এনেছে। ছেলেটাকে দেখেই মনে হয় সংসারে মনোযোগী। মায়ের কাজে সাহায্য করো তাইনা?’
অর্ণব লজ্জা পেয়ে উত্তর দিলো, ‘তা করার চেষ্টা করি আন্টি। আপনিও আম খান না।’
‘খাবো। তোমরা খেয়ে নাও। খেয়ে বিশ্রাম করো। তারপর ধীরেসুস্থে বের হইয়ো।’
আম খাওয়া শেষ করে অর্ণব চলে গেল জাহ্নবীর ঘরে। জাহ্নবী খাবার টেবিলে এলো। পারভীনের আর খোঁজ নেই। তিনি রান্নাঘরে গেছেন। অর্ণবকে খাওয়ানোর আরও কিছু বাকি আছে হয়তো।
জাভেদ আলী জাহ্নবীকে বললেন, ‘তোর মায়ের মধ্যে একটা কিশোরী মেয়েকে দেখতে পাচ্ছি। বহুদিন পর ও অনেক উচ্ছল।’
বাবার মুখে এমন কথা শুনে জাহ্নবী আর কোনো কথা বলার সাহস করল না। পারভীন পিরিচে করে দই নিয়ে অর্ণবের দরজায় কড়া নেড়ে বললেন, ‘বাবা, একটু দরজা খুলতে হয় যে..’
জাহ্নবী মুখ টিপে হাসল। তার ধারণাই সঠিক। পারভীন স্বস্তির সঙ্গে খাবার টেবিলে এসে বসলেন।
জাভেদ আলী বললেন, ‘ নিজে খাওয়ার চাইতে অন্যকে খাইয়ে বেশী সুখ পাওয়া যায়। তোর মাকে দ্যাখ।’
পারভীন বললেন, ‘আসলেই। অনেকদিন পর মন ভরে কাউকে কিছু খাইয়েছি। নিজে রান্নাবান্না করে। শান্তি শান্তি লাগতেছে।’
‘শান্তি লাগতেছে সেটা তো ভালো কথা। যাও তুমি বিশ্রাম নাও এখন।’
এমন সময় অর্ণব এসে বলল, ‘আন্টি, আংকেল। আমার একটা অনুরোধ আছে। রাখতেই হবে আপনাদের। প্লিজ?’
জাভেদ আলী ও পারভীন কৌতুহলী চোখে অর্ণবের দিকে তাকালেন। পারভীনের চোখে মুখে খুশির দীপ্তি।
অর্ণব বলল, ‘আমি এইমাত্র আমার মায়ের সঙ্গে কথা বলেছি। মা বলেছেন যেন আপনাদেরকে সঙ্গে নিয়ে যাই। ঢাকায় চলে এলে তো আগামী কয়েক মাস আমার আর বাড়ি যাওয়া হবে না। আপনারা এখন আমার সঙ্গেই চলেন। ঘুরে আসবেন। মা নিজে আপনাদের দাওয়াত দিয়েছেন।’
পারভীন ভীষণ অবাক হলেন। তিনি ভাবলেন, অর্ণবও কী মনেমনে জাহ্নবীকে পছন্দ করে বসে আছে! নয়তো তার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য এত উতলা হয়ে আছে কেন? মাকেও রাজি করিয়ে ফেলেছে। অতিরিক্ত এই ভাবনা আরও আনন্দিত করল পারভীনকে।
তিনি স্বামীকে বললেন, ‘এই, তুমি যাও। দুটো দিন থেকে আসো। ছেলেটা এত করে বলছে।’
জাভেদ আলী একবার স্ত্রী’র মুখের দিকে তাকাচ্ছেন, আর একবার অর্ণবের দিকে। অর্ণব ওনার হাত ধরে বলল, ‘প্লিজ আংকেল চলেন না। আন্টিও চলেন।’
তিনি খুশি হলেন। উত্তর দিলেন না বটে, কিন্তু মনেমনে কোথাও একটা ঘুরে আসার প্রত্যাশা তারও ছিল। অনেকদিন বাসায় থেকে থেকে নিজেকে কারাগারের বন্দি মনে হয় তার।
অর্ণব পারভীনকেও তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য জেদ করল। পারভীন রাজি হলেন না। আনন্দিত মনে শুধুমাত্র স্বামীর ব্যাগটাই গোছাতে লাগলেন তিনি।
জাহ্নবী এসে বলল, ‘মা, তুমিও যাও।’
‘ধুর কী বলিস। তোর আব্বু যাবে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। আমি ক্যামনে যাই।’
‘যাও ঘুরে আসো। তুমি ওনার ছেলেকে খাতির আপ্যায়ন করেছ, তাই ছেলের মা খুশি হয়ে তোমাকেও দাওয়াত করেছেন।’
কথাটা সুন্দর শোনালেও পারভীন খুশি হতে পারলেন না। কারণ অতিরিক্ত ভাবনায় তিনি ভেবে বসে আছেন, অর্ণব জাহ্নবীকে পছন্দ করেছে। কিন্তু জাহ্নবীর কথা শুনে ওনার অতিরিক্ত ভাবনায় ছেদ পড়ল। তাই মুখ কালো হয়ে গেল ওনার। তিনি ব্যাগ গোছানো বন্ধ করে বসে রইলেন।
জাহ্নবী বলল, ‘কি গো? কী হল তোমার? যেতে ইচ্ছে করলে যাও।’
‘নাহ। তোর বাপ যাক।’
অন্ধকার মুখ নিয়েই তিনি ব্যাগ গোছালেন। তৈরি হলেন জাভেদ আলী। জাহ্নবী পারভীনকে কখনোই বুঝতে পারে না। মুহুর্তেই মুড বদল হয় ওনার। স্বামীকে বিদায় দেয়ার আগে দরজা বন্ধ করে কী কী শিখিয়ে দিলেন, বোঝা গেল না।
বিদায়ের ক্ষণে অর্ণব আরেকবার সেই বিখ্যাত ভুল-টি করে বসল। জাহ্নবীকে বলল, ‘ভাল থাকবেন আপু। আমার জন্য দোয়া করবেন।’
কথাটা পারভীনের সামনেই উচ্চারণ করেছে সে। পারভীনের প্রচণ্ড মন খারাপ হয়ে গেল। বড়সড় ধাক্কা খেয়ে গেলেন তিনি। এত সাধ করে তিনি জাহ্নবীর সঙ্গে বিয়ে দেবেন ভেবে অর্ণবকে এত খাতির করলেন, অথচ অর্ণবের কথা শুনে মনে হল সে জাহ্নবীকে বড় বোন ব্যতীত কিছুই ভাবে নি। আপু ডাকটা নাহয় স্বাভাবিক। কিন্তু দোয়া করবেন! এই কথাটা গুরুজন ছাড়া কি কেউ কাউকে বলে? মাথা ঘুরে গেল ওনার। এদিকে জাভেদ আলীও ততক্ষণে বেরিয়ে পড়েছেন অর্ণবের সঙ্গে। তিনি দ্বিধায় পড়ে গেলেন। ঘরে পায়চারি করতে করতে নিজেকে স্বান্তনা দিলেন, ‘আজকাল বয়সে বড় মেয়ের সঙ্গে অনেক ছেলের বিয়ে হয়। জাহ্নবীর বাবা গিয়েছে যখন, নিশ্চয়ই একটা কিছু করেই আসবেন।’
স্বস্তির সঙ্গে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করলেন তিনি।
জাহ্নবী নিজের ঘরে চলে এলো। এই ঘরে এখনো অর্ণবের ঘ্রাণ রয়ে গেছে। সহ্য হচ্ছে না ওর। বিছানার চাদর ও বালিশের কভার বালতিতে ভিজিয়ে রাখল সে। অর্ণব আবারও আপু ডেকেছে! রাগে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে জাহ্নবীর। ভায়োলেট এখনো বাইরে থেকে ফিরছে না কেন? একমাত্র সে-ই জাহ্নবীর মন ভাল করে দিতে পারে।
টেবিলের ওপর অর্ণবের উপহার দেয়া বইটা দেখে ইচ্ছে করল ওটাও বালতিতে ডিটারজেন্ট পাউডারের সঙ্গে ভিজিয়ে রাখতে। ওই ছেলের কিচ্ছু দরকার নেই তার, কিচ্ছু না।
চলবে..
উপন্যাসঃ মেঘফুল
পরিচ্ছেদঃ ১৩
লেখকঃ মিশু মনি
গভীর রাত।
ভায়োলেট ঘুমানোর চেষ্টা করছে। জাহ্নবী ওকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘তোকে একটা পারসোনাল কথা বলি?’
ভায়োলেট ঘুমের ঘোরে উত্তর দিলো, ‘কাল শুনবো।’
জাহ্নবী উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। আবহাওয়া শীতল বলে আজ দ্রুতই রাত নেমেছে এই শহরে। ভায়োলেট আজ আরাম করে ঘুমোবে। কিন্তু জাহ্নবীর ঘুম আসছে না। মনের ভেতর উথাল পাথাল ঝড় বইছে তার।
ভায়োলেট পাশ ফিরে জাহ্নবীর কাছে জানতে চাইল, ‘আপু, কী বলবে বলো?’
‘তুই ঘুমাবি না?’
‘আগে তোমার কথাটা শুনবো, হজম করবো, তারপর ঘুমাবো। বলো?’
উচ্ছ্বসিত হয়ে জাহ্নবী ভায়োলেটের গায়ে হাত রাখল। মৃদু স্বরে বলতে লাগল, ‘শোন তাহলে। আমি একটা খারাপ সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। কীভাবে যে বলি! তুই আমার ছোট বোন। তোকে বলতে আমার লজ্জা করছে।’
ভায়োলেট জাহ্নবীকে ছুঁয়ে বলল, ‘মনে করো আমি তোমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। আমাকে বলো।’
‘জানিস তোর কথা শুনে আমার কান্না পাচ্ছে। আমার কোনো ভালো বন্ধু নেই। আমার তো কোনো বন্ধুই নেই।’
ভায়োলেট জাহ্নবীকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি তোমার বন্ধু। একদম কাছের বন্ধু। আমাকে বলো তোমার কী হয়েছে?’
জাহ্নবী কিছুক্ষণ সময় নিলো নিজেকে প্রস্তুত করতে। কখনো মন খুলে কাউকেই কিছু বলতে পারেনি সে। তাই হয়তো জড়তাটুকু বেশি আলিঙ্গন করছে ওকে। কথাটা বলতে গিয়ে ওর বুক ধকধক করতে লাগল।
‘জানিস ভায়োলেট, আমি প্রেমে পড়ার জন্য অস্থির হয়ে আছি।’
হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল জাহ্নবীর। কথাটা সে নিজের মুখে বলেছে এটা বিশ্বাস করতেও নিজের সময় লাগল। চোখ বন্ধ করে আছে জাহ্নবী।
ভায়োলেট জানতে চাইলো, ‘কার প্রেমে?’
জাহ্নবী বলল, ‘তা জানিনা রে। তবে আমার মনটা এত উতলা হয়ে আছে! মনে হচ্ছে যখন তখন আমি কারও প্রেমে ধপ করে পড়ে যাবো। আমার ভীষণ প্রেমের স্পর্শ পেতে ইচ্ছে করছে। কারও ভালবাসা পাবার সাধ জেগেছে অনেক। আমি যদি কাউকে ভালবাসি, আর সে যদি আমাকে ফিরিয়ে দেয়, আমার কী অনেক কষ্ট হবে ভায়োলেট?’
ভায়োলেট জাহ্নবীকে আরও শক্ত করে চেপে ধরল। যেন নিজেকে নিয়ে বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ না করে জাহ্নবীর। আজ যখন সে নিজে থেকে ভায়োলেটের কাছে মনের কথা বলতে চায়, ভায়োলেটের উচিৎ ওর প্রতি যথেষ্ট সম্মান রাখা।
ভায়োলেট বলল, ‘ আগে এমন হয়নি কখনো?’
জাহ্নবী মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘উহু কখনো না। আমি তো আজীবন ভাবতাম, বিয়েই করবো না। আমার ছেলেদের প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না। প্রেম, ভালবাসা, সংসার এসব ভালো লাগত না। এমনকি কিছুই ভালো লাগে না আমার। আমার মনেহয় আমি একজন মৃত মেয়ে। যার কোনো সাধ নেই, কোনো শখ নেই। আমি কারও সঙ্গে মিশতে পারিনা, কারও সাথে মন খুলে কথা বলতে পারি না। আমি ভাবতাম, ভালবাসা জিনিসটা আমার হয়তো কখনোই হবে না। আগে তো কত বিয়ের প্রস্তাব আসতো। আমার বিয়ে করার আগ্রহই জাগে নি কখনো। অথচ জানিনা কয়েক মাস ধরে আমার কী যেন হয়েছে, শুধু কারও প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করে। কারও সাথে ভালবাসার ঘর বাঁধতে ইচ্ছে করে। সংসার করতে ইচ্ছে করে।’
ভায়োলেট শান্ত হয়ে জাহ্নবীর বুকে লুকিয়ে রইল। আপুর শরীর থেকে মায়ের ঘ্রাণ পাচ্ছে সে। ভালো লাগছে জাহ্নবীর কথা শুনতে। চোখ বন্ধ করে তার সব কথা শুনছিল সে।
জাহ্নবী বলল, ‘আমার তো অনেক বয়স হয়ে গেছে রে। আমাকে কী কেউ এখন বিয়ে করবে? কেউ ভালবাসবে?’
‘ধুর। এসব ভেবো না তো। বয়স আবার কী হ্যাঁ? জীবন তো সবে শুরু। টেনশন কোরো না। তুমি শুধু চারপাশে মন দিয়ে খেয়াল রাখো কাকে তোমার ভালবাসতে ইচ্ছে হয়। সবার জন্য তো আর ফিলিংস হয় না।’
‘ঠিক বলেছিস। একদম ঠিক বলেছিস। আমাকে কী দেখতে বুড়ি বুড়ি লাগে ভায়োলেট?’
‘উহু একদমই না। বুড়ি লাগবে কেন? এই বয়সে কেউ বুড়ি হয়?’
‘আমার তো মনেহয় আমাকে দেখতে তিন বাচ্চার মা লাগে। আমি বিয়ে করলে এখন সত্যি সত্যি তিন বাচ্চার মা হতাম।’
‘বাংলাদেশী সোসাইটিতে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাইরের দেশগুলোর দিকে তাকাও? ওরা কিন্তু বিয়ে নিয়ে এত মাথা ঘামায় না। ওদের জীবনে প্রেম আসে বসন্ত আসার মতো। যেকোনো বয়সে, যে কারও সঙ্গে। চল্লিশ বছর বয়সেও নতুন করে জীবন শুরু করা যায় আপু।’
জাহ্নবী ভায়োলেটের গালে একটা ছোট্ট চুমু দিয়ে বলল, ‘আমার লক্ষী বোন। তুই এত ভাল কেন রে? আমার মাঝেমাঝে তুই হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। ভায়োলেট, তোর স্বপ্নটা আমাকে বলবি না?’
‘বলবো। অন্য একদিন।’
‘আজকে বলা যাবে না?’
‘না। আজকে বলতে ইচ্ছে করছে না।’
জাহ্নবী আর জোর করল না। প্রত্যেকের নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপার গুলো সিক্রেট রাখার অধিকার আছে। সময় মতোই সে তার কথা বলুক। জাহ্নবীর এখন বেশ হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে সে একটা পাখি। হাত দুটো তার পালক হয়ে গেছে। যেন হাত মেলে দিলেই উড়ে উড়ে সূদূর প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিতে পারবে সে।
জাহ্নবী সত্যি সত্যিই উড়ছে। আকাশে তুলোর মতো মেঘ ফুঁড়ে উড়ে যাচ্ছে সে। মেঘগুলো হয়ে যাচ্ছে ফুল, মেঘের ফুল। গায়ে নরম মেঘের স্পর্শ পেয়ে সে আনন্দ পাচ্ছে। মেঘের ভেতর হতে হঠাৎ উঁকি দিলো অর্ণব। জাহ্নবীর দিকে তাকিয়ে অর্ণব হাসতে লাগল। জাহ্নবী হাসতে যাবে এমন সময় হঠাৎ নিচে পড়ে গেল অর্ণব। জাহ্নবী নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল অকূল দরিয়া। সেখানে অর্ণব একটা মেয়ের সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছে। জাহ্নবী দ্রুত সেখান থেকে উড়ে অন্যদিকে চলে এলো। এই আকাশে হঠাৎ স্বাস্থ্যবান এক সুপুরুষ, পরনে সাদার মতো একটা পাঞ্জাবী। সেও মেঘের মতো উড়ছে। উড়তে উড়তে জাহ্নবীর একদম কাছে চলে এলো সে। জাহ্নবী হাসছে, অনেক শব্দ করে হাসছে। মনে হচ্ছে এই সুপুরুষ মেঘের মতোই ওর শরীর স্পর্শ করে দিয়ে চলে যাচ্ছে। এই স্পর্শ তাকে অন্যরকম এক শীতল অনুভূতি দান করল। জাহ্নবী বলতে লাগল, চলে যেও না। আরও কিছুক্ষণ থাকো। থাকো..
কলিং বেল বেজে উঠল কয়েকবার। ভায়োলেট পাশ ফিরে আবারও ঘুমিয়ে পড়ল। জাহ্নবী মেঘের ভেতর উড়তে উড়তে কলিং বেলের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। শব্দের তালে তালে হারিয়ে যেতে লাগল সেই মেঘের পুরুষ। স্বাস্থ্যবান, সাদা পাঞ্জাবীর সেই নাদুসনুদুস লোকটা। কলিং বেলের শব্দ আরও তীব্র হল। ঘুম ভেঙে গেল জাহ্নবীর।
ঘড়ির দিকে তাকাল সে। রাত তিনটা পঞ্চাশ। এত রাতে কে এলো! পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল সামারের কথা। গত রাতে তার বাসে ওঠার কথা ছিল। সে এসেছে নিশ্চয়ই। ঘুমে চোখ বুজে আসছে। জাহ্নবী চোখ ডলতে ডলতে দরজা খুলতে এলো।
সামার জাহ্নবীকে দেখেই জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আপু! ডিংকাচিকা। ওয় ইয়ে ইয়ে, হেয়ে হেয়ে।’
ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগল সামার। জাহ্নবী সশব্দে হাসতে লাগল। সামার আজ এত আনন্দিত কেন! জাহ্নবী দ্রুত দরজা আটকিয়ে সামারকে নিয়ে ঘরে চলে এলো।
দুই বোনের কোলাহলে ঘুম ভেঙে গেল ভায়োলেটের। সামার ব্যাগের চেইন খুলে জামাকাপড় গুলো মেঝের ওপর ফেলে দিচ্ছে আর বলছে, ‘ইয়াক কী বিশ্রী গন্ধ! এগুলো কাল ধুতে হবে। কিন্তু আমার যে পরিমাণ ঘুম পেয়েছে। মনে হচ্ছে আমি কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমাবো। আর ট্যুর থেকে এসে টানা বারো ঘন্টা না ঘুমালে আমার ভালো লাগে না। অনেক হেঁটেছি, খুব ক্লান্ত। গায়ে কী যে ব্যথা.. এই ভায়োলেট, ওঠ। আরে ওঠ না?’
ভায়োলেট বিছানার ওপর উঠে বসল। চোখ মুখ মুছে জানতে চাইলো, ‘এত ভোরে কীভাবে এলি আপু?’
সামার হাসতে হাসতে বললো, ‘উহহু, বলবো না। একজন বাসায় নামিয়ে দিয়ে গেছে। সামার, আমাদের তো প্রেম হয়ে গেছে। আররে প্রেম হয়ে গেছে। ওঠ, পার্টি দে।’
নিজেই দাঁড়িয়ে একটা ডান্স দিলো সামার। জাহ্নবী হাসতে হাসতে ঢলে পড়তে লাগল। সামার ব্যাগ থেকে সব জিনিসপত্র বের করে রাখল। ব্যস্ত ভঙ্গীতে কী যেন খুঁজছে সে। জাহ্নবী ভাবল, হয়তো তাদের জন্য কিছু এনেছে।
সামার গুপ্তধন পাওয়ার মতো কিছু একটা পেয়ে যাওয়ায় মহা খুশি। এরপর হাতে একটা ক্লিনজিং অয়েল নিয়ে বাথরুমে যেতে যেতে বলল, ‘আগে ফেস ক্লিন করে শাওয়ার নিয়ে ফেলি। বড় আপু, খাবার কিছু থাকলে আমাকে দাও তো।’
ভায়োলেট বলল, ‘তুই গোসল করতে করতে খাবি?’
‘খাওয়া যায়। কিন্তু খাবো না। আমি নাচতে নাচতে গোসল করবো। আমার গামছা ধুলাবালি দিয়ে শেষ। কেউ একটা পরিষ্কার গামছা ধার দাও আমাকে।’
জাহ্নবী নিজের ঘর থেকে নতুন একটা তোয়ালে এনে বাথরুমের দরজায় শব্দ করল। সামার তোয়ালে নিয়ে ধন্যবাদ জানালো জাহ্নবীকে।
ভায়োলেট অবাক হয়ে সামারের এলোমেলো কাপড়চোপড় ও ব্যাগের জিনিসপত্র গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আনন্দ হচ্ছে তার। সামারের আনন্দ দেখে মাঝেমাঝে তারও ভীষণ নাচতে ইচ্ছে করে।
জাহ্নবী ফ্রিজ থেকে মাংস ও পোলাও বের করে গরম করে রাখল। ঘরে এসে দেখল আবারও ঘুমিয়ে পড়েছে ভায়োলেট। সামার খাবার টেবিলে গিয়ে জোরে জোরে ডাকল জাহ্নবীকে। জাহ্নবী টেবিলে আসতেই সে বলল, ‘তুমিও খাও। বসো। একা একা খেতে ভালো লাগে না।’
ফজরের আযান হয়ে গেছে। নামাজের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল জাহ্নবী। সামারের সঙ্গে বসে সে-ও খাবার খেলো। খেতে খেতে সামারের ভ্রমণের গল্প শুনছিল সে। সামার খেয়ে উঠে হাত ধুয়ে চলে গেল ঘরে। জাহ্নবী একা টেবিলে বসে খাচ্ছে, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই সামারের। জাহ্নবী মুচকি হাসল। আজকের সকালটা সুন্দর।
খাবার খাওয়া শেষে নামাজ আদায় করে জানালা খুলে দিলো জাহ্নবী। বাইরে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। সে এখন কিছুক্ষণ চোখ বুজে শুয়ে থাকবে। তার মনটা অনেক ফুরফুরে। দারুণ একটা স্বপ্ন দেখেছে আজ। মেঘের ভেতর একটা নাদুসনুদুস মানুষ। একগুচ্ছ মেঘের ফুল। ওর ইচ্ছে করছে আবারও সেই স্বপ্নটা দেখতে। কিন্তু স্বপ্ন তো চাইলেই দেখা যায় না। আচ্ছা, কে সেই মেঘের মানুষ? কেনই বা সে আমার স্বপ্নে এলো? কিন্তু মানুষটার মুখচ্ছবি বা চেহারা কিছুই তো মনে নেই। শুধু মনে আছে, সে একজন সুপুরুষ, স্বাস্থ্যবান, পাঞ্জাবি পরিহিত একটা মানুষ। মাথায় কালো কুচকুচে চুল, গায়ের রং ফর্সা। মেঘের ভেতর ফুলের মতো উড়ছিল সে! জাহ্নবী’র ঘুম এলো না। সে ভোরের আলোয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সকাল হওয়া দেখল।
তার মোবাইল ফোনটা বাজছে। কল দিয়েছে জাভেদ আলী। তিনি নিরাপদে পৌঁছে গেছেন অর্ণবের বাসায়। জাহ্নবী অর্ণবের নামটা জোর করে মুছে ফেলল মাথা থেকে। সে এখন শুধুই মেঘের মানুষটাকে খুঁজবে, আর কাউকে নয়।
চলবে..