উপন্যাসঃ মেঘফুল
পরিচ্ছেদঃ ১৮
লেখকঃ মিশু মনি
নাদির স্যার এত রাতে ফোন করেছেন, বিষয়টা ভাবিয়ে তুলল জাহ্নবীকে। ভয়ে ভয়ে ফোন কানে ধরল জাহ্নবী। ওপাশ থেকে নাদির সাহেবের গলা শোনা গেল, ‘মিস জাহ্নবী?’
‘জি স্যার।’
‘অনেক রাত আসলে, আমি সরি অনেক রাতে ফোন করেছি।’
‘সমস্যা নেই স্যার। বলুন?’
‘We have an emergency meeting tomorrow.আজ রাতের মধ্যেই কিছু কাগজপত্র রেডি করতে হবে। Can you do the job?’
‘জি স্যার। কী কী রেডি করতে হবে আমাকে বলুন?’
‘আমি ফাইলগুলোর ছবি আপনাকে পাঠাতে পারি। সবগুলো এলোমেলো অবস্থায় আছে। সাজিয়ে গুছিয়ে একটার পর একটা এভাবে টাইপ করে ডকুমেন্টস ফাইলে সাজাতে হবে।’
‘জি স্যার। পারবো। আপনি ছবিগুলো আমাকে পাঠিয়ে দিন।’
‘থ্যাংক ইউ মিস জাহ্নবী। আমি যাকে কাজটা দিয়েছিলাম, একচুয়েলি তিনি সবকিছু আরও গুবলেট বানিয়ে ফেলেছেন। And I think you can only do that.
‘ধন্যবাদ স্যার। আমাকে যোগ্য মনে করার জন্য।’
নাদির সাহেব কল কেটে দিলেন। জাহ্নবী মেইলে প্রবেশ করে দেখল স্যার বেশ কিছু ছবি পাঠিয়েছেন। সবগুলো ছবি ফোনের গ্যালারিতে সেভ করে ল্যাপটপে কাজ শুরু করল জাহ্নবী। কাজে মন দেয়ার পর ধীরেধীরে মাথা থেকে অর্ণবের ব্যাপারটা দূর হয়ে যেতে শুরু করেছে।
কাজের ফাঁকে জাহ্নবী এক মগ কফি বানিয়ে আনলো। কফি খেতে খেতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত দুইটা বাজে। ভীষণ অবাক হল জাহ্নবী। কাজ করতে গিয়ে কখন এত রাত হয়ে গেছে টেরই পায়নি সে! বাকি কাজটা শেষ করতে করতে সারে তিনটা বেজে গেল। ভোরবেলা ঘুমাতে গেল জাহ্নবী। এই প্রথম কোনো রাত জাগাটাকে সে আনন্দ নিয়ে উপভোগ করেছে। সবসময় রাত জেগে ভোরে ঘুমাতে যাওয়াটা হত ডিপ্রেশন। আর আজকে কাজ করতে করতে ভোর হওয়াটা যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা একটা রাত্রি।
সকাল সাতটায় ফোনের এলার্ম বাজতে শুরু করেছে। তাড়াহুড়ো করে জাহ্নবী গোসল সেরে অফিসের জন্য তৈরি হল। আজকে মা এখনো ঘুম থেকে ওঠেননি। কিংবা ঘুম থেকে উঠেছেন, ঘরের বাইরে আসেননি। এইমুহুর্তে নাস্তা বানানোর সময় নেই একদমই। জাহ্নবী এক গ্লাস পানি খেয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
অর্ণবের ব্যাপারে জাহ্নবী কিছুই ভাবতে চায় না। মোস্তফা কামালকে বিয়ে করা যেতেই পারে, কিন্তু অর্ণবকে বিয়ে করা একদমই অসম্ভব। মা’র নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়েছে। অর্ণবের কথা না ভাবতে চাইলেও মোস্তফা কামাল জাহ্নবীকে ফিরিয়ে দিয়েছে, এটা ভাবলেই রাগে ও কষ্টে জাহ্নবীর চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে।
অফিসের দরজায় এসে জাহ্নবী বলল, ‘অর্ণব টর্ণব কাউকে আমি চিনিনা। আমি কোনো মোস্তফা কামালকেও চিনিনা। আমি জাহ্নবী। আমি একটা সুখী মেয়ে।’
কথাটা বলে অফিসে প্রবেশ করল জাহ্নবী। বেশ হালকা লাগছে। তারান্নুম নামে একজন সহকর্মী জাহ্নবীকে বলল, ‘কী অবস্থা?’
‘এইতো ভাল। আপনার?’
‘ভালোই। নাদির স্যারকে দেখলাম আপনার খোঁজ করতে।’
জাহ্নবী চমকে উঠল। স্যার এত দ্রুত অফিসে চলে আসেন! সে নিজেও এর আগে কখনো অফিসে আসতে পারে না।
তারান্নুম বলল, ‘আপনার জন্য হয়তো খারাপ খবর আছে। মেন্টাল প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন।’
জাহ্নবী চিন্তায় পড়ে গেল। রাতে কাজ শেষ হওয়া মাত্রই সব ফাইল স্যারকে মেইলে পাঠিয়েছে জাহ্নবী। স্যার নিশ্চয়ই ওর কাজ পছন্দ করেননি। অনেক আশা নিয়ে স্যার ওকে কাজ করতে দিয়েছিলেন। অথচ সেটাও গুবলেট করে বসে আছে সে! জাহ্নবীর পা কাঁপতে লাগল। অস্বস্তিতে ভরে গেল মন।
এই অস্বস্তি নিয়েই দুপুর বারোটা বেজে গেল। জাহ্নবীর কষ্ট হচ্ছে। সারা রাত জেগে কাজ করেও সে ব্যর্থ। তারচেয়েও বড় কথা, স্যার জাহ্নবীর ওপর ভরসা করেছিলেন। নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না জাহ্নবী। মন খারাপ হয়ে আছে। অন্যদিকে বারবার শুধু মনে হচ্ছে, মোস্তফা কামাল আমাকে পছন্দ করেনি। অপমানিত বোধ করছে জাহ্নবী। নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগে ওর কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
হঠাৎ পিয়ন এসে জানাল, নাদির স্যার জাহ্নবীকে ডাকছেন। জাহ্নবী ভয়ে ভয়ে উঠে এলো। স্যারের রুমের কাছাকাছি এসে দেখল দূরে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। জাহ্নবীকে ইশারায় সেখানে ডাকলেন। জাহ্নবী কাছে যেতেই স্যার হাঁটতে শুরু করলেন। লিফটের ভেতরে প্রবেশ করলেন তিনি।
বুক দুরুদুরু করছে জাহ্নবীর। স্যার কী ওর কাজটা একেবারেই অপছন্দ করেছেন? এখনো কথা বলছেন না কেন!
লিফটে প্রবেশ করল জাহ্নবী। চকচকে সিলভারের দেয়াল আয়নার কাজ করছে। দুরত্ব বজায় রেখে তারা দাঁড়িয়ে রইলো।
নাদির সাহেব বললেন, ‘আপনার কাজের জন্য আজকে আমি অনেক প্রশংসিত হয়েছি। থ্যাংকস এ লট।’
জাহ্নবী চমকে উঠলো। ওর শরীরে এক ধরনের রিনঝিন বাজনা খেলা করে গেল। সে সফল হয়েছে, সে একটা কাজ ভালভাবে করতে পেরেছে! এই আনন্দের কোনো তুলনাই হয় না।
স্যার লিফট থেকে বের হতে হতে বললেন, ‘এত রাত পর্যন্ত কাজ করেছেন আপনি। নিশ্চয়ই এখন ঘুমে মাথাব্যথা করছে। আপনাকে এক কাপ কফি খাওয়ানোটা আমার কর্তব্য।’
জাহ্নবীর মন আনন্দে ভরে উঠল। নাদির স্যার স্বয়ং তাকে কফি খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছে! এ কী আনন্দ..
স্যার ক্যান্টিনের মাঝামাঝি একটা টেবিলে এসে বসলেন। জাহ্নবী বসল স্যারের মুখোমুখি। আজকে তিনি সাদা রঙের একটা শার্ট পরেছেন। শুভ্রতায় মাখামাখি হয়ে আছেন তিনি।
জাহ্নবী মাথা নিচু করে বসে রইল। নাদির সাহেব দুই কাপ কফি নিয়ে এসে বসলেন। জাহ্নবীকে বললেন, ‘অফিস ভালো লাগছে?’
‘জি স্যার।’
‘আর কফি?’
জাহ্নবী এখনো কফির কাপে চুমুক দেয় নি। লজ্জিত ভঙ্গীতে হেসে কফিতে ঠোঁট ছোঁয়ালো সে। এত গরম কফি খাওয়ার অভ্যাস নেই ওর। আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াতে গিয়েও ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল।
নাদির সাহেব হেসে বললেন, ‘আপনি সময় নিয়ে খান।’
তিন মিনিট জাহ্নবীর সামনে বসে রইলেন নাদির স্যার। এই তিন মিনিটে ওনার ফোনে পাঁচবার কল এসেছে। ভীষণ ব্যস্ত ভঙ্গীতে জাহ্নবীকে রেখে উঠে গেলেন তিনি।
জাহ্নবী কফি শেষ করে নিজের ডেস্কে ফিরে এলো। এখন বেশ ফুরফুরে লাগছে। কাজে মন দিলো সে। কিছুক্ষণ পর পিয়ন এসে জাহ্নবীকে জানালো, ‘নাদির স্যার বলেছেন আপনার ইচ্ছে হলে আজকে বাসায় চলে যেতে পারেন। আজকে আপনার ছুটি।’
জাহ্নবী বিস্মিত হল। এত ব্যস্ততার ভেতরেও স্যার সবদিকে খেয়াল রাখছেন! আজ আর বাসায় যেতে ইচ্ছে হল না। বাসায় গেলেই দম বন্ধ লাগে। তারচেয়ে ভালো লাগে এখানে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে।
বাইরের প্রকৃতি আজ ভীষণ ব্যস্ত। বড় বড় বিল্ডিংগুলো নির্দ্বিধায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। জাহ্নবীরও ইচ্ছে করে এরকম মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে।
বিকেলবেলা ভায়োলেটের নাম্বার থেকে কল এলো। সে জাহ্নবীর জন্য একটা বাসা পছন্দ করে ফেলেছে। জাহ্নবী অফিসের পর বাসাটা দেখতে যেতে পারে।
জাহ্নবী ফোনে ভায়োলেটকে বলল, ‘তোর পছন্দেই আমার পছন্দ। আমার আর দেখতে হবে না।’
আজ অফিস শেষ করেও জাহ্নবীর বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করল না। সন্ধ্যার শহরে হেঁটে বেড়াতে লাগল সে। মাঝেমাঝে গায়ে বাতাসের দোলা লাগে। রিকশার ক্রিং ক্রিং শব্দে নিজেকে অনেকটা জীবন্ত মনে হয়।
অনেক্ষণ বাইরে হেঁটে, আইসক্রিম খেয়ে জাহ্নবী বাসায় ফিরল রাত আট টায়। দরজা খুলে দিলো সামার। লিভিং রুমে অর্ণব বসে আছে। সামার ওর সঙ্গে বসে গল্প করছে। জাহ্নবীকে দেখে অর্ণব বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম আপু। ভালো আছেন?’
জাহ্নবী মৃদু স্বরে ‘হুম’ উচ্চারণ করে নিজের ঘরে চলে এলো। মা সত্যি সত্যি অর্ণবকে আসতে বলে দিয়েছেন। মা’র মাথার গণ্ডগোল কী কখনো সারবে না?
জাহ্নবী গোসল সেরে বের হয়ে দেখল অর্ণব একা বসে আছে। মায়া লাগল ওর। নিশ্চয়ই পারভীন সামারকে জোরপূর্বক ঘরে যেতে আদেশ করে দিয়েছেন। এইমুহুর্তে বাবাও বাসায় নেই। বেচারা অর্ণব!
জাহ্নবী পারভীনের ঘরের দরজায় এসে বলল, ‘মা, আসবো?’
‘আয়।’
‘মা আমি অর্ণবকে নিয়ে বাইরে যাই?’
পারভীন ভীষণ অবাক হলেন। এতটাই আশ্চর্য হলেন যে, অনেক্ষণ চোখের পলক ফেলতে পারলেন না। তিনি হাসিমুখে বললেন, ‘যা।’
‘মা, সামার ভায়োলেটকেও নিয়ে যাই?’
‘ওরা কেন আবার? একা যা।’
‘আমি একা যাবো না।’
পারভীন বিরক্ত হলেন। বিরক্তমুখে অনেক্ষণ দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললেন, ‘ঠিক আছে। ওদেরকেও নিয়ে যা।’
তিনবোন অর্ণবকে নিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল। কেউই জানেনা কোথায় যাচ্ছে তারা। দুইটা রিকশা ডাকা হলো। তিনবোন মিলে উঠতে যাচ্ছিল এক রিকশায়। অর্ণব বিব্রত হয়ে বলল, ‘একি! আপনাদের কষ্ট হবেনা যেতে?’
সামার ঝটপট উত্তর দিলো, ‘আমি আপনার রিকশায় আসি?’
‘আচ্ছা।’
ভায়োলেট ও জাহ্নবী এক রিকশায় বসল। অন্য রিকশাটিতে সামার ও অর্ণব। ক্রিংক্রিং শব্দ তুলে রিকশা এগিয়ে চলল। সামারের গা থেকে ভেসে আসা সুবাসে অর্ণব মুখরিত। ফুরফুরে লাগছে তার। জানতে চাইলো, ‘আচ্ছা, আপনি সেদিন আমাকে যে কথাটা বলতে চেয়েছিলেন, সেটা কী এখন বলবেন?’
সামার হো হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, ‘না, বলবো না। কারণ ওটার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে।’
‘মানে!’
‘মানে মেয়াদ শেষ।’
‘মেয়াদ শেষ মানে?’
‘মেয়াদন শেষ মানে মেয়াদ শেষ। ডেট এক্সপায়ার্ড।’
আবারও হো হো করে হেসে উঠল সামার। অর্ণবের ভালো লাগছে ওর হাসির শব্দ শুনতে। রিনিঝিনি রিনিঝিনি হাসি। মেয়েরা খুব সুন্দর করে হাসে। তাদের হাসির শব্দেও একটা দ্যোতনা আছে।
সামার বলল, ‘আপনি অনেক বোকা একটা লোক। আমার আম্মুর চাইতেও বোকা।’
‘আপনার আম্মু কী বোকা?’
‘ হ্যাঁ। দুনিয়ার সবচাইতে বোকা মহিলা আমার আম্মু। আর আপনি তার চাইতেও বোকা।’
অর্ণব চুপ করে রইল। রেগে গেল নাকি আনন্দ পেয়ে হাসল ঠিক বোঝা গেল না। রিকশা চলছে তো চলছেই। কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে জানেনা স্বয়ং রিকশাওয়ালাও।
ভায়োলেট পাশের রিকশা থেকে জানতে চাইল, ‘এই আপু আমরা কোথায় দাঁড়াবো?’
‘যেখানে ইচ্ছে যা। যমুনা সেতুতে চলে যা।’
জাহ্নবীদের রিকশা দ্রুত চলতে শুরু করল। যেন সত্যি সত্যি তারা যমুনা সেতুতে যাচ্ছে। সামার আবারও হো হো করে হেসে উঠল। কিছুক্ষণ বাদেই রিকশা একটা সিগন্যালে এসে দাঁড়াল। অর্ণব মনেমনে ভাবছে, আজকের রাতটা অসম্ভব সুন্দর। যদি কখনো এ রাত্রি শেষ না হতো!
সামার বলল, ‘অর্ণব ভাইয়া। আমাকে একটা ফুলের মালা কিনে দেন।’
‘ফুলের মালা কোথায়?’
‘ফুলওয়ালীর কাছে।’
‘ফুলওয়ালী কোথায়?’
‘আপনি জানেন কোথায়। আমিতো জানিনা।’
‘আমিও তো জানিনা।’
‘না জানলেও কিনে দেন।’
‘আচ্ছা ঠিকাছে।’
সামার হাসতে হাসতে বলল, ‘এজন্যই বললাম আপনি একটা বোকা। আপনাকে কে চাকরি দিলো বলুন তো? আচ্ছা, তার আগে বলুন আপনার সঙ্গে প্রেম করছে কোন মেয়ে? সেও কী আমার মায়ের মতো বোকা?’
‘আমার কোনো প্রেমিকা নেই।’
‘আহা রে। অবশ্য না থাকারই কথা। আপনার মতো বোকা লোকের সঙ্গে কার প্রেম করার সময় আছে?’
‘আপনার মায়ের মতো বোকা কোনো মেয়ের।’
‘হা হা হা। আপনি যতটা ভেবেছি ততটা বোকা নন। একটু চালাকও আছেন।’
সামারের হাসি থামলো না। রিকশা থেমে গেল। একটা রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়েছে। রিকশা থেকে নেমে জাহ্নবী ও ভায়োলেট অপেক্ষা করছে। একসঙ্গে ভেতরে এসে বসল ওরা।
রেস্টুরেন্টের টিভিতে গান চলছে। ‘তুমি আকাশের বুকে বিশালতার উপমা..’
অর্ণব চুপচাপ বসে আছে। লজ্জা পাচ্ছে সে। সবচাইতে বেশি কথা বলছে সামার। ভায়োলেট খাবারের মেন্যু থেকে কে কী খাবে সেটা ঠিক করছে।
অর্ণব বলল, ‘জাহ্নবী আপুর জব কেমন চলছে?’
‘ভাল।’
‘অফিস ভালো লাগছে?’
‘হুম। আপনার?’
অর্ণব লজ্জা পেয়ে হাসল। ঘাড় চুলকে বলল, ‘আমার ভালো লাগে না। বাসায় থাকতে ভালো লাগে।’
সামার হাসতে হাসতে বলল, ‘বাসায় কি বউ আছে নাকি?’
‘আমার রুমমেটরা অনেক ভালো। ওদের সঙ্গে এনজয় করতেই ভালো লাগে।’
জাহ্নবী’র দিকে একপলক তাকিয়ে মুচকি হাসল অর্ণব। হাসির কারণ ধরতে পারল না জাহ্নবী। সে ভায়োলেটকে বলল, ‘চল আমরা বাসাটা দেখে আসি?’
‘এই রাত্রিবেলা?’
‘তাহলে থাক।’
জাহ্নবী মাথা নিচু করে বসে রইল। খাবার অর্ডার দেয়ার পরও মেন্যুতে চোখ বুলাচ্ছে ভায়োলেট। সামার মোবাইল টিপছে। অর্ণবের চোখও মোবাইলে। জাহ্নবীর অস্বস্তি হচ্ছে। সে কিছুই পাচ্ছে না করার মতো। এ যুগের সবাই ফেসবুকে সময় কাটাতে আসক্ত। তার আসক্তির ইচ্ছে নেই, তবে ফেসবুক চালানো শুরু করবে সে। তার একটা একাউন্ট আছে ফেসবুকে। কিন্তু অযথা পড়ে আছে, খুব একটা চালানো হয় না। আজকে ফেসবুকে ঢুকে অফিসের কলিগদেরকে এড করে ফেলবে ভাবছে।
অর্ণব বলল, ‘আমার রুমমেট রাতুল ভাই খুবই ভালো একটা ছেলে।’
‘আপনি ভালো ছেলে নন?’ জিজ্ঞেস করল সামার।
অর্ণব হেসে বলল, ‘কী মনে হয় তোমার?’
‘একটা বোকার হদ্দ।’
জাহ্নবী সামারের দিকে শাসনের সুরে তাকাল, ‘কী হচ্ছে সামার?’
সামার বলল, ‘বোকার হদ্দকে চালাকের হদ্দ বলবো? এইযে চালাকের হদ্দ, আপনার ফোনটা দিন তো।’
জাহ্নবী তাকিয়ে রইল। চোখে শাসনের ইঙ্গিত। সামার অর্ণবের ফোন নিজের হাতে নিয়ে বলল, ‘আপনার ফোনের ক্যামেরা অনেক ভালো।’
অর্ণব ও সামার ফোন নিয়ে কথা চালিয়ে গেল। জাহ্নবী অস্বস্তিবোধ করছে। সে কেন আড্ডা দেয়ার মতো বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারে না? অনেক ভেবে জাহ্নবী ভায়োলেটকে বলল, ‘তুই কি খাবার অর্ডার দিয়েছিস? এখনো আসছে না।’
ভায়োলেট বলল, ‘আজকের ট্রিট তো অর্ণব ভাইয়া দিচ্ছে। এজন্য মন খুলে অর্ডার দিয়েছি।’
‘তাই নাকি? কিসের ট্রিট?’
‘চাকরি পেয়েছে তাই।’
অর্ণব বলল, ‘আপু, আপনার ট্রিটটা কিন্তু পাওনা রইলো।’
হাসল জাহ্নবী। অর্ণবের তাকানো ও কথা বলার ভঙ্গীতে মনে হচ্ছে জাহ্নবী অর্ণবের কাছের কোনো বড় বোন। জাহ্নবীর ভালো লাগছে। সে বড় বোন হওয়াতেই স্বস্তি পাবে।
জাহ্নবী জানতে চাইলো, ‘আপনার বাসার কাছেই তো লাইব্রেরি। আপনি বই পড়তে যান না?’
‘যাইনি একবারও। ভাবছি যাবো।’
ভায়োলেট জানতে চাইলো, ‘কোন লাইব্রেরি?’
‘বেঙ্গল বই।’ উত্তর দিলো জাহ্নবী।
সামার বলে উঠল, ‘আমি যাবো। আমি বহুদিন আগে একবার গিয়েছিলাম। আরেকদিন যেতে হবে। অর্ণব ভাইয়া আপনি সিঙারা খাওয়ালে যাবো। ওখানে কলিজা সিঙারা পাওয়া যায়।’
অর্ণব হেসে বলল, ‘আচ্ছা।’
‘তাহলে নেক্সট সানডে। আমাকে ফেসবুকে এড দিন তো। অফিস শেষ হয় কয়টায় আপনার?’
‘বিকেল পাঁচটায়।’
খাবার চলে এলো। সবাই মিলে আরও অনেক্ষণ আড্ডা দিলো তারা। যেন অর্ণব তাদেরই বন্ধুদলের একজন হয়ে উঠেছে। খাওয়াদাওয়া শেষে অর্ণব বিল দিতে গেলেও জাহ্নবী জোরপূর্বক বিল দিয়ে বলল, ‘আমি এখানে সবার চেয়ে সিনিয়র। কাজেই আমি বিল দিবো। অর্ণব আপনি ট্রিটের প্রস্তুতি আরেকদিন নিয়ে রাখুন। সেদিন নিজে দাওয়াত দিয়ে আমাদেরকে নিয়ে আসবেন।’
অর্ণব আর কথা বাড়াল না। হাসল সে৷ রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে জাহ্নবী রিকশা ডাকল। এবার অর্ণব নিজের বাসার দিকে রওনা দেবে৷ তাই একই রিকশাতে তিনবোন উঠতে হবে। রিকশায় ওঠার আগ মুহুর্তে অর্ণব সামারকে বলল, ‘আজকের সন্ধ্যাটা সুন্দর ছিল।’
‘আমার জন্যও।’ বলল সামার।
অর্ণবের হৃদয়ে দোলা লাগল সামারের কথা শুনে। সামার রিকশায় গিয়ে বসল। ভায়োলেট বসেছে রিকশার ওপরে, অর্থাৎ মাঝখানে। এভাবে একটা রিকশায় তিনজন ওঠা যায়।
জাহ্নবী বলল, ‘অর্ণব আমাদের ফ্যামিলির একজন হয়ে উঠছে তাইনা?’
কেউই কোনো উত্তর দিলো না। জাহ্নবী একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। দিনগুলো মন্দ কাটছে না। যদিও এইমুহুর্তে বাসায় গিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকালে ওর কষ্ট হতে শুরু করবে। তবে মনে হচ্ছে, আজকে মায়ের মুখটাও হাসিহাসি থাকবে।
চলবে..