মেঘফুল
পরিচ্ছেদ: ৪৮
লেখনীতে: মিশু মনি
দমকা হাওয়া বইছে। উড়ছে ধূলো। জাহ্নবী সবেমাত্র অফিস থেকে বেরিয়েছে। রিকশায় উঠতে না উঠতেই এমন ঝড়ো হাওয়া শুরু হল যে বসে থাকা মুশকিল। রিকশার হুড উড়িয়ে নিয়ে যায় যায় অবস্থা। রিকশাওয়ালা বললো, আপামনি একদিকে সাইড করি। আপনে নাইমা যান।
বিব্রতবোধ করলেও জাহ্নবীর ‘না’ বলার সুযোগ ছিল না। রিকশাওয়ালা তাকে একটা ফার্মেসীর সামনে নামিয়ে দিয়ে সরে পড়লো। ফার্মেসীর বারান্দায় আরও জন চারেক লোক দাঁড়িয়ে। হঠাৎ আসা দমকা হাওয়ায় শহরের সবকিছুই যেন এলোমেলো হওয়ার বাহানা খুঁজছে। একটা পলিথিন ফতফত করে উড়ছে ছেড়ে দেয়া বেলুনের মতো। চোখ খোলা রাখা যাচ্ছে না। কখন যেন ধুলাবালি নিজের গন্তব্য ভেবে ঠুস করে চোখের ভেতর উড়ে এসে জুড়ে বসবে।
জাহ্নবী অপেক্ষা করতে লাগল। বাতাসের তীব্রতা কমলে শুরু হল বৃষ্টি। বাতাসের তোড়ে বৃষ্টিকে ঠেলে একদিকে নিয়ে যায়। রাস্তায় রিকশা নেই, খানিক পরপর দু একটা গাড়ি টিমটিমে আলো জ্বালিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে শা করে চলে যাচ্ছে। জাহ্নবী বেশ কয়েকটা রাইড এপসে ঢুকে গাড়ি খুঁজল, পাচ্ছে না। ঝড়ের কারণে যেন এই ভর সন্ধ্যাতেই রাত নেমে এসেছে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একটা সময় সারল্য’র কথা মনে হলো। কী এক স্পষ্ট নির্ভরতা জেগে উঠল মনে। জাহ্নবী আগামাথা কিছু না ভেবেই কল দিয়ে বসলো তাকে।
মিনিট দশেকের মধ্যেই সারল্য’র গাড়ি এসে দাঁড়াল রাস্তার পাশে। জানালার কাঁচ নামিয়ে সে জাহ্নবীকে ইশারায় ডাকলো। নির্ভরতার নিজস্ব একটা আনন্দ আছে। সেই আনন্দ খেলা করছে জাহ্নবী’র চোখেমুখে।
সে গাড়িতে উঠে বসতে বসতে বলল, ‘এই অসময়ে আপনাকে ডেকে পাঠালাম বলে বিরক্ত হোননি?’
‘না তো। আপনি কখন ডাকলেন, আমি নিজেই তো বললাম আসছি।’
‘সেই একই হলো। আমি ফোন করে এখানে বৃষ্টিতে আটকে আছি বলা মানেই আপনাকে আসার আহবান করা।’
‘আমি বিরক্ত হলে না এলেই পারতাম। এলাম কেন?’
‘তাই তো। এলেন কেন?’
সারল্য উত্তর না দিয়ে ম্লান হাসলো। গাড়ির কাঁচের ওপর ছিপছিপ করে বৃষ্টির জল পড়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। রাতের বৃষ্টিভেজা শহরে মোহময় ভালোলাগা এসে ভর করলো। জাহ্নবী বলল, ‘এত বিরক্ত লাগছিল দাঁড়িয়ে থাকতে! কখন গাড়ি পাবো তাও বুঝতে পারছিলাম না।’
‘ফোন করে ভালোই করেছেন। যদি কখনো শুনতে পেতাম এমন ঝড়ের কবলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধূলা খেয়েছেন, আমি কিন্তু খুব রাগারাগি করতাম।’
‘রাগারাগি? আপনি অন্য মানুষের সঙ্গে রাগ করতে পারেন?’
‘হ্যাঁ পারি। আপনি পারেন না?’
‘না। আমি কারও সঙ্গে রাগ করতে পারিনা। আমার সব রাগ শুধু নিজের সঙ্গে।’
কথাটা বলে জাহ্নবী জানালার বাইরে তাকায়। রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা বলেই গাড়ি দ্রুত ছুটছে। রাস্তার পাশে কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছ আর পলিথিনে মোড়ানো দোকানপাট গুলো দেখতে ভালো লাগছে তার। মনে হচ্ছে মেলা চলছিল, হুট করে ঝড় এসে সব তছনছ করে দিয়ে গেছে। তবে ঘঘন্টাখানেক পরেই আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।
সারল্য বলল, ‘বাসায় যাবেন এখন?’
‘এই সময়ে বাসা ছাড়া আর কই যাবো?’
‘রাস্তায়, রেস্তোরাঁয়, যেখানে খুশি সেখানে।’
কোনো অজানা কারণে আজ সারল্য’র মনটা ফুরফুরে। তার চমকপ্রদ বাচনভঙ্গিই স্পষ্ট বলে দিচ্ছিল তা। ঝড়ের কারণে জাহ্নবী’র মনে যে বিরক্তির উদ্রেগ হয়েছিল, তা নিমেষেই বিলীন হয়ে গেলো।
সে জানতে চাইলো, ‘যেখানে খুশি সেখানে চাইলেই যাওয়া যায়?’
‘হ্যাঁ, যাবে না কেন? এখন তাই বলে আবার স্বর্গে যেতে চাইবেন না।’
‘স্বর্গ বাদ দিয়ে যেখানে ইচ্ছে যেতে চাইলে যাওয়া যাবে? আপনার গাড়ি আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারবে?’
‘চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। গাড়িটা যদি আলাদীনের চেরাগ হয়ে থাকে আরকি।’
সারল্য মুচকি হাসলো। জাহ্নবী নিজেও হেসে ফেলল ফিক করে। রাস্তার দুপাশে ঘোলা পানির ঢল নেমেছে। ভেজা রাস্তায় পড়ে আছে ঝরাপাতা। এই শহরেও তবে গাছ আছে! ভাবে জাহ্নবী।
সারল্য জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায় যাবেন বললেন না তো?’
‘বাসায়।’
‘এই যে বললেন যেখানে খুশি যাবেন।’
‘সেটা তো আপনি বলেছেন। আমার অতশত জায়গায় যাওয়ার খুশি জাগে না। ঘুরেফিরে বাসা আর অফিসেই যাওয়ার আছে। আর একটা জায়গা আছে, আমার বাড়ি।’
‘বাড়িতে যাওয়া হয়না?’
‘প্রায়ই যাই। বাবা মা, বোনরা আছে। আমার বোনরা আবার আমার মতো নয়। ওদের যাওয়ার অনেক জায়গা। কত জায়গায় ঘুরতে যায়, কত কাজ থাকে ওদের!’
বিস্ময়ের সুরে কথাটা বলে গেল জাহ্নবী। সারল্য এক পলক তার দিকে তাকিয়েই দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। জাহ্নবী জানালার কাঁচ খানিকটা নামিয়ে দিয়ে বৃষ্টির শীতল হাওয়াকে আহবান জানায়। মন ভরে যায় মিহি বাতাসে।
সারল্য বলল, ‘আপনার কখনো কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না?’
‘আগে করতো। দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে। এখন আর করে না।’
‘এখন করেনা কেন?’
‘কী জানি! হয়তো সুখে আছি তাই।’
জাহ্নবীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে সারল্য। জাহ্নবী সুখে আছে, এটা বিশ্বাস করতেই হবে তাকে। নয়তো কেউ জানালায় হাত রেখে অন্য খেয়ালে বৃষ্টি দেখতে দেখতে প্রফুল্ল হয় না। সুখী মানুষ গুলো দেখলেই চেনা যায়। ওদের চোখমুখ কানায় কানায় পূর্ণ থাকে সুখ দিয়ে। জাহ্নবী সেই অর্থে খুব সুখী!
সারল্য বলল, ‘আমায় সুখী হওয়া শেখাবেন? আপনার মতো?’
‘আমি? নিজেই বা অত সুখী হলাম কবে? সবেমাত্র শিখছি।’
‘বেশ তো। আমিও আপনার সঙ্গে সঙ্গে শিখব।’
জাহ্নবী মুচকি হেসে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমরা তাহলে একসঙ্গে সুখী হই। আমার বাড়ির সামনে যে চায়ের দোকানটা আছে, ওখানে গিয়ে দু কাপ চা খাই চলুন।’
‘অবশেষে এটাই আপনার যেখানে খুশি সেখানে যাওয়ার গন্তব্য ঠিক হলো?’
‘না। আমার যেখানে যেতে ইচ্ছে করছে সেখানে আজকে যাবো না। যাওয়া উচিৎও হবে না।’
‘কোথায় সেটা?’
‘আপনার বাড়ির খোলা বারান্দাটা।’
সারল্য চমকে ওঠে। তার হাল আমলের নোনা ধরা বারান্দাতেও কারও যেতে ইচ্ছে করে বুঝি? ওই বারান্দাটা শুধু তার একার জোরেই টিকে আছে। নয়তো কবেই ওটা ভেঙে গুড়িয়ে নতুন ডিজাইনে রূপ দেয়া তো। আগে ওখানে প্রায়ই বসতো সারল্য। বিয়ের পর আর খুব একটা বসা হয়নি। অনেক বছর তো বন্ধই ছিল বারান্দার দরজা’টা। জাহ্নবী একরাতে ক্ষণিকেই কি এমন খুঁজে পেলো সেখানে? সারল্য উৎসুক চোখে দু একবার জাহ্নবী’র দিকে তাকায়। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে না।
জাহ্নবী চুপচাপ। গাড়ি চলছে আপন গতিতে। রাস্তা প্রায় ফাঁকাই বলা চলে। পৌঁছে যেতে খুব একটা সময় লাগলো না। চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করাতেই জাহ্নবীর খেয়াল হল। এতক্ষণ সে ডুবে ছিল কল্পনায়। তার কল্পনার বারান্দায় আরাম কেদারা ভিজছে, ভিজছে সিগারেটের অ্যাস্ট্রে।
একটা টেবিলে মুখোমুখি বসলো ওরা। গরম গরম চায়ের সুঘ্রাণে মুখরিত হয়ে আছে চারপাশ। আজ খুব একটা লোকজন আসেনি। মোটে চারজন বসে গল্পগুজব করছে। থেকে থেকে বাতাসের দমকা হাওয়ার শব্দ কানে আসছিল।
সারল্য চা খাওয়ার এক ফাঁকে বলল, ‘একটা কথা বলবো জাহ্নবী? কিছু মনে করবেন না তো?’
‘না। কিছু মনে করবো না। বলুন না?’
‘আমি তো আপনার বন্ধু তাইনা?’
‘আমিও সেটাই মনে করি।’
‘দেখুন একজন ভালো বন্ধু কিন্তু একজন ভালো বন্ধুর ব্যাপারে অনেস্টলি সবকিছু খুলে বলে। এটাই একজন বন্ধুর বৈশিষ্ট্য।’
জাহ্নবী ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো, ‘বুঝলাম না আপনার কথা।’
সারল্য ইতস্তত করে বলল, ‘থাক বাদ দিন।’
‘বাদ দিতে পারবো না। আপনি বলুন।’
সারল্য ম্লান হেসে বলল, ‘মা’র শাড়িতে আপনাকে ভীষণ অন্যরকম লাগছিল। ট্রেডিশনাল।’
জাহ্নবী মুচকি হেসে মাথা নিচু করে ফেলল। জীবনে এই প্রথম কেউ তাকে এভাবে প্রশংসাবাক্য শুনিয়েছে। মনটা খুব উৎফুল্ল হয়ে উঠল তার।
সারল্য বলল, ‘আমি বোধহয় ঠিক গুছিয়ে বলতে পারলাম না। আপনাকে শাড়িতে সবচেয়ে সুন্দর দেখায়। এটাই বলতে চেয়েছি..’
জাহ্নবী মৃদু হেসে বলল, ‘ধন্যবাদ। আমি কী তাহলে এখন থেকে সবসময় শাড়ি পরবো?’
‘পরতেই পারেন। যদি আপনার আরাম হয়।’
‘আমার আরাম হবে না। অভ্যেস নেই।’
‘তাহলে পরার দরকার নেই।’
সারল্য অন্যদিকে ফিরে চায়ে চুমুক দিলো। জাহ্নবী’র ঠোঁটে লাজুক হাসি। তার একইসাথে লজ্জাও লাগছে আবার আনন্দও হচ্ছে। কেউ একজন তাকে সুন্দর বলেছে। এতদিন ধরে সে ভেবেছিল, সে কেবলই একটা রক্তমাংসের মানুষ। যার চেহারায় নেই কোনো লাবণ্য, কোনো সৌন্দর্য। বয়সের ছাপে নুইয়ে পড়া একটা বাঙালি মেয়ে। এটাকেও যে সুন্দরের ব্যাখ্যায় বিশেষায়িত করা যায়, সেটা ধারণাই ছিল না জাহ্নবী’র।
সে আচমকা জানতে চাইলো, ‘এই বয়সেও কেউ সুন্দর থাকে?’
‘প্রত্যেকটা বয়স তার নিজের মতো সুন্দর। বয়স কখনো সৌন্দর্য কমায় না, বাড়ায়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জ্ঞান বাড়ে, অভিজ্ঞতা বাড়ে, জীবনবোধ বাড়ে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ তখন আরও সুন্দর। শুধু চামড়ায় ভাঁজ পড়লেই সৌন্দর্য হারিয়ে যায় সেটা কে বলেছে আপনাকে?’
জাহ্নবী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘এই সমাজ বলে। এত বয়সেও বিয়ে করিনি বলে সমাজ আমাকে যাচ্ছেতাই করে ফেলেছে। এজন্য বহুদিন হল কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান, আত্মীয়ের বাসা, কোথাও যাই না।’
সারল্য বলল, ‘আপনার সাহস আছে বলতে হবে। এদেশের কয়টা মেয়ের এমন সাহস হয় বিয়ে না করে কাটিয়ে দেবার?’
জাহ্নবী যেন হঠাৎ খানিকটা দমে গেল। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে উত্তর দিলো, ‘কাটিয়ে দিচ্ছি কই? আমারও তো ইচ্ছে হয় কারও সঙ্গে ঘর বাঁধতে।’
‘তাহলে বাঁধছেন না কেন?’
‘পাচ্ছি না যে। ওরকম একজন মানুষ।’
জাহ্নবী’র শীতল স্থির চোখেও কীসের যেন ছটফটানি অনুভব করে সারল্য। এ কি মনের মতো কাউকে পাবার জন্য আকুলতা? এত বছর পেরিয়েও জীবনে নিজের কাউকে না পাওয়ার হাহাকার? কে জানে, হবে হয়তো। সারল্য এসব নিয়ে ভাবতে চায় না। ভালবাসা নিয়ে ভাবলে তার রাগ হয়। কেন রাগ হয়, জানেনা সে।
এমন সময় জাহ্নবী’র ফোন বেজে ওঠে। ভায়োলেট ফোন করেছে। কথা শেষ করে জাহ্নবী বলল, ‘আমার ছোটবোন আসবে বাসায়।’
‘তাহলে এখন উঠি?’
‘ওর আসতে আরও সময় লাগবে।’
কথাটা বলার পরপরই কেমন লজ্জা লজ্জা লাগতে শুরু করল জাহ্নবী’র। সারল্যকে এখানে এভাবে ধরে রাখার মতো নির্লজ্জ কবে হল সে! লজ্জা কাটাতে আরও দুই কাপ চা দিতে বলে দেয় জাহ্নবী। চায়ের পর্ব শেষ হলে যথারীতি বিদায়ের পর্ব চলে আসে। সারল্যকে ধন্যবাদ জানিয়ে জাহ্নবী নিজের বাসায় পা বাড়ায়।
ভায়োলেট ভিজতে ভিজতে এসে হাজির। ভেজা কাপড়ের তোয়াক্কা না করে ঘরে ঢুকেই সে বলল, ‘প্লেট ধুয়ে আন, গরম গরম খিচুড়ি খাবো।’
জাহ্নবী তোয়ালে এনে ওর মাথায় রেখে বলল, ‘আগে জামা বদলে আয়। এই বৃষ্টি বাদলার দিনে তোকে কে আসতে বলেছে?’
‘বৃষ্টির দিনেই তো গল্প করে মজা আপু৷ ঢাকায় আসার পর থেকেই তোমার এখানে আসার জন্য মন উতলা হয়ে আছে।’
‘যান আগে চেঞ্জ করে আসুন।’
প্যাকেট থেকে খিচুড়ি প্লেটে ঢালতেই লোভনীয় ঘ্রাণে জিভে জল আসার উপক্রম। সঙ্গে দুই পিস লেবু আর গরুর মাংস ভুনা। জাহ্নবীর খুশি খুশি লাগছে৷ এমন দিনে এরকম মজার খিচুড়ি না হলে জমে না।
ভায়োলেট জামাকাপড় বদলে বিছানায় এসে বসলো। খিচুড়ি মুখে দিয়েই সুস্বাদু কামড়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। জাহ্নবী বলল, ‘কোথা থেকে আনলি এই অমৃত?’
‘অনেকদূর থেকে। সাধে কি এত ভিজেছি?’
‘তুই পারিসও বাবা৷ চিটাগাং গিয়ে কী কী দেখলি?’
‘ড্রামা সিরিজ। শুনবে? আগে খাওয়া শেষ করি দাঁড়াও।’
দুই বোন আয়েশ করে খিচুড়ি খেয়ে হাত ধুয়ে এসে বসল গল্প করতে। ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল ওরা৷ বাইরে থেকে ঝুম বর্ষণের মৃদু শব্দ ভেসে আসছে৷ জাহ্নবী জানালার কাঁচটা হালকা ফাঁক করে দেয়। বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে ওরা গল্প করে।
চট্টগ্রামে অর্ণবদের বাসায় ঘটে যাওয়া বৃন্তান্ত সব বড় বোনকে শোনায় ভায়োলেট। বলতে বলতে কখনো হাসে, কখনোবা সামারের চিন্তায় ব্যকুল শোনায় তার গলা। সব শুনে জাহ্নবী একটা গম্ভীর নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘ওকে নিয়ে আমার খুব চিন্তা হয় রে। সামার এত ছটফটে, কখন কী করে বসে তার ঠিক নেই।’
‘চিন্তা আমারও হয়। কোনোকিছু না ভেবেই সিদ্ধান্ত নেয় মেজোপু। আর যা মুখে আসে তাই বলে ফেলে। ভাগ্যিস ওখানে শেষ পর্যন্ত মানসম্মান রক্ষা হয়েছে।’
খানিক্ষণ পর নেমে আসে নিরবতা। দুজনেই চুপ করে বৃষ্টির শব্দ শোনে। হঠাৎ ভায়োলেট জানতে চায়, ‘তুমি কেমন আছো আপু?’
জাহ্নবী আনন্দিত গলায় বলল, ‘জীবনের সবচেয়ে সেরা সময়টা পার করছি রে৷ মনে হচ্ছে এতদিন আমি ঘুমে ছিলাম। ঘুম ভেঙে সবেমাত্র দুনিয়াটাকে দেখছি৷ কিংবা বলতে পারিস বাঁচতে শিখছি।’
ভায়োলেট জাহ্নবীকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি তো এটাই চেয়েছি৷ আমার এত ভালো বোনটা ঘরের এক কোণে অন্ধকার জীবনযাপন না করে একটু বাঁচতে শিখুক।’
‘জানিস আমি এতদিন ভেবেছি মানুষ কেন বাঁচে? আর এখন মনেহয় নিজের জন্য বাঁচাটাই সবচেয়ে দরকার৷ কেন আমার ভালো থাকার জন্য জীবনে কাউকে লাগবেই? নিজের জন্য নিযে বাঁচতে শিখি নি কেন এতদিন?’
জাহ্নবীর এই জোড়ালো সুন্দর কথাগুলো শুনতে স্বপ্নের মতো লাগছিল ভায়োলেটের। সে অভিভূত হয়ে বলল, ‘তোমার জীবন ভাবনা একেবারেই পাল্টে গেছে আপু!’
জাহ্নবী বলল, ‘হ্যাঁ রে। জীবনকে এখন আমি অন্যভাবে ভাবতে শিখেছি। আস্তে আস্তে শিখছি কীভাবে নিজের জন্যই বাঁচা যায়। আমার জীবনে কেউ নেই, কিছু নেই, এসব ভেবে এখন আর নিজেকে বোকা বানাই না। আমার জীবনে অনেক কিছুই হতে পারে। আমি যদি নিজেকে ভালো রাখতে শিখি, তাহলেই আমি ভালো থাকবো।’
খানিক্ষন চুপ থেকে জাহ্নবী বলল, ‘আমার একজন বন্ধু হয়েছে।’
উৎফুল্ল হয়ে ভায়োলেট জানতে চাইল, ‘তাই নাকি!’
জাহ্নবী মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘খুব ভালো একজন বন্ধু। যার সঙ্গে মন খারাপ, মন ভালোর গল্পগুলো খুলে বলা যায়।’
‘বাহ! যাক তুমি অবশেষে একজন বন্ধু পেলে। আমি কি তোমার বন্ধু নই আপু?’
জাহ্নবী ভায়োলেটের গাল টেনে দিয়ে বলল, ‘তুইও আমার বন্ধু। তুই আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ভায়োলেট। তোর মতো করে আমাকে আর কেউ বোঝেনা।’
‘তোমার ওই বন্ধুটাও না?’
‘ওর সঙ্গে নতুন বন্ধুত্ব হয়েছে। এখনই কী আর এত বোঝাবুঝি বোঝা যায়? তোর স্টার্টআপ নিয়ে কী ভাবলি বল তো?’
‘সেটা নিয়ে আলাপ করবো বলেই এসেছি। আজ রাতে ঘুম নেই, জরুরি মিটিং হবে। অনেক প্লান রেডি। এবার শুধু একটা একটা করে কাজ করা বাকি।’
জাহ্নবী মুগ্ধ হয়ে ভায়োলেটের কথা শোনে। অন্ধকারেও টের পায় তার চেহারার দৃঢ়তা। নতুন কিছু শুরু করতে পারার আনন্দে জাহ্নবী উত্তেজিত বোধ করে৷
চলবে..