মেঘফুল পরিচ্ছেদ: ৪৯,৫০

0
451

মেঘফুল
পরিচ্ছেদ: ৪৯,৫০
লেখনীতে: মিশু মনি
৪৯

জাহ্নবী’র দিনগুলো মধুর ব্যস্ততায় কেটে যাচ্ছে। ভায়োলেটের ব্যবসার শুরুটা তার হাত ধরেই হলো। অন্যদিকে নাদিরের ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে ও তার উপস্থিতি না থাকলে চলে না। নিজের অফিস শেষ করে এই দুই কাজে সময় দেয়ার পর নিশ্বাসটুকুও ফেলার সময় হচ্ছিল না জাহ্নবী’র। এরই মাঝে একদিন সারল্য’র সঙ্গে দেখা হলে সে বলল, ‘নানুবাড়িতে যাবো। যাবেন?’

জাহ্নবী চমকে উঠলো তার কথায়, ‘নানুবাড়ি!’
‘হ্যাঁ। একদিন না বলছিলেন আপনার গ্রামে যেতে ইচ্ছে করে? গ্রাম দেখতে যাবো চলুন। নানু অনেকদিন ধরেই ডাকছে। ক’দিন ধরে আম্মুও বলছে এবার একবার নানুবাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে। অনেকদিন বাপের বাড়ি যাওয়া হয়না আম্মুর। তাই ভাবলাম আপনাকেও বলি। যাবেন?’

নিঃসন্দেহে চমৎকার দাওয়াত। কত বছর হল জাহ্নবী গ্রামে যায় না। শুধুই কি গ্রাম! তার মাথায় কোথাও বেড়াতে যাবার স্মৃতিই মনে পড়ে না। সারাক্ষণ বাড়ি, বাড়ি, বাড়ি আর৷ বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর ঘরের দমবন্ধ পরিবেশ ছেড়ে নিজের মতো বাঁচতে একলা বাসায় ওঠা। এখন তো মনপ্রাণ খুলে বাঁচতে ইচ্ছে জাগবেই।

‘অফিসের এত কাজ রেখে কীভাবে যাবো?’ জানতে চাইলো জাহ্নবী।

সারল্য’র নিষ্পাপ উত্তর, ‘অফিসে দুদিনের ছুটি নিলে খুব একটা অসুবিধা হবেনা।’
‘নাদির স্যারকে কী বলবো?’
‘জাহ্নবী, আপনি হাসালেন আমায়। আপনার কি মনে হচ্ছে নাদিরের কাজ আপনার জন্য আটকে থাকবে? ও নিজেই ওর কাজের জন্য এনাফ। তাছাড়া টিমের বাকিরা তো আছেই। আপনাকে কেউ মাথার দিব্যি দিয়ে রাখেনি।’

জাহ্নবী খানিক্ষন চুপ করে রইল। তার খুব গ্রামে বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করছে সত্যি কিন্তু নিজের স্টার্টআপের কথাটা সারল্যকে এখনো জানায়নি সে। ভায়োলেট তার ওপর পরম নির্ভরতায় ব্যবসার সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে। অফিসের ইন্টেরিয়র ডিজাইন চলছে। কাজ শেষ হলেই নিজের চাকরি ছেড়ে জাহ্নবীকে ওর অফিসে বসতে হবে। এ সময় সে কীভাবে গ্রামে বেড়াতে যাবে? এ তো অসম্ভব ব্যাপার।

জাহ্নবী ম্লান হেসে বলল, ‘আপনার নিমন্ত্রণ পেয়ে খুশি হয়েছি। কিন্তু বোধহয় যাওয়া হবে না।’
‘ভেবে দেখুন। আম্মুকে বলেছি ব্যাগ গুছিয়ে ফেলতে। দু একের মধ্যেই যাবো।’
‘যান, ঘুরে আসুন। ভালো লাগবে।’
সারল্য চোখ পাকিয়ে জাহ্নবী’র দিকে খানিক্ষন তাকিয়ে থাকতে থাকতে উত্তর দিলো, ‘আমি জানি ভালো লাগবে আপনার।’

দুই রুমের একটা ছোট্ট অফিস নিয়েছে ভায়োলেট। নিজের মনমতো সেটা সাজানোর প্রয়াস চলছে। দেয়ালে জায়গা করে নিয়েছে অভিজাত পেইন্টিং। দুই রুমের হলেও তার কাজের প্রয়োজনীয় সবকিছুই আছে এখানে। জাভেদ আলী ব্যাংক থেকে টাকা ট্রান্সফার করে দিয়েছেন ভায়োলেটের একাউন্টে। একান্তই নিজের মতো করে সে সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে নিচ্ছে।

অফিসের কাঁচের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে জাহ্নবী আনমনে কী যেন ভাবছে। ভায়োলেট তার পাশে এসে দাঁড়াল। মৃদু গলায় বলল, ‘কী দেখছো আপু?’
জাহ্নবী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘কিছু না।’
‘ভাবছো তোমার কাঁধে অনেক বড় একটা দায়িত্ব দিয়ে ফেললাম?’
‘এরকম একটা দায়িত্ব আমার খুব প্রয়োজন ছিল। নিজের মেধাকে কাজে লাগানোর কোনো সুযোগই তো পাচ্ছিলাম না।’
‘এত ভালো একটা চাকরি পেয়েছো নিজের যোগ্যতায়, তাও এই কথা?’
‘চাকরিতে তো অন্যের নির্দেশে কাজ করি ভায়োলেট। নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে কিছু একটা করার মতো কাজ দরকার ছিল। থ্যাংকস রে।’
‘আর থ্যাংকস বলো না আপু। একদিন তুমিই বিরক্ত হয়ে বলবে আমার কাঁধ থেকে দায়িত্বের বোঝা নামিয়ে দে।’
‘মাইর খাবি এবার।’

খানিক্ষন চুপ থেকে জাহ্নবী বলল, ‘অফিস রেডি হওয়ার আগে আমার কোনো কাজ আছে? মানে দুদিনের ছুটি পাওয়া যাবে?’
ভায়োলেট ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে ফিক করে হেসে ফেলল, ‘আমাকে বস ভেবো না। তুমিই এখানকার বস।’
‘সেজন্যই বলছি। বস’রা কখনো ছুটি পায় না। তাদেরকে কে ছুটি দেবে?’
‘এই কোম্পানিতে ওসব হবেনা বাবা। যখন মন চাইবে ছুটি নেবে। নিজের রিফ্রেশমেন্টের জন্য।’

জাহ্নবী ইতস্তত করতে করতে বলেই ফেলল, ‘ঢাকার বাইরে আমার একটা দাওয়াত আছে। তোকে এক বন্ধুর কথা বলেছিলাম না? ওর ফ্যামিলি যাচ্ছে। আমাকে যেতে বলেছে। কী করবো বুঝতে পারছি না।’

ভায়োলেট হেসে বলল, ‘অবশ্যই যাবে। এরপর তো কাজে মন দিতে হবে। অফিসের কাজ আমি গুছিয়ে নেবো। তোমার এখন কোনো চাপ নেই। নিশ্চিন্তে ঘুরে এসে সবকিছু বুঝিয়ে নিও। বুঝেছো?’
জাহ্নবী দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করল, ‘যাবো?’
‘যাও। মনটা ফ্রেশ হবে।’

ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা বোধ করল জাহ্নবী। সে বহু বছর পর শহরের বাইরে যাবে। এই দম বন্ধ করা শহর ছেড়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যাবে। ইশ, ভাবলেই মন ভালো হয়ে যায়।
শহরের বাতি জ্বেলে ল্যাম্পপোস্ট গুলো দাঁড়িয়ে আছে। জাহ্নবী ও ভায়োলেট একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ কারও সঙ্গে কোনো কথা বলে না। দুজনের চোখে অপরিসীম স্বপ্ন এসে নাড়া দিয়ে যায়। রঙিন, লাল, নীল স্বপ্ন। স্বপ্ন ধরার জন্য ওরা ছুটতে রাজি। এখন ছুটতে হবে, বহুদূর!

সারল্য ও তার মা রওনা দিচ্ছে গ্রামের উদ্দেশ্যে। তাদের সঙ্গে যাচ্ছে জাহ্নবী। লাগেজ গুছিয়ে সে বাসার সামনে অপেক্ষা করছে। সারল্য’র গাড়ি এসে দাঁড়াল সামনে।
জাহ্নবী ওর মাকে সালাম জানিয়ে বলল, ‘কেমন আছেন খালা?’
‘ভালো আছি মা। আসো, উঠে পড়ো।’

মহিলার পাশের সিটেই বসলো জাহ্নবী। গন্তব্যস্থল তার অজানা। সারল্য’র সঙ্গে এরপর খুব একটা কথা না হওয়ায় সে জিজ্ঞেস করার সুযোগ পায়নি ওর নানুবাড়িটা কোথায়? তবে উত্তেজনার অন্ত নেই তার। কোথায় যাচ্ছে সেটাও তার জন্য বিস্ময়কর হয়ে থাকুক।

গাড়ি চালাচ্ছে ড্রাইভার। তার পাশের সিটে বসেছে সারল্য। পরনে সাদা পাঞ্জাবি। চোখে চশমা। জাহ্নবী চমকে উঠলো ওকে দেখে। যেন রূপকথার গল্প থেকে উঠে আসা বিশুদ্ধ মানব। সারল্য পিছন ফিরে জিজ্ঞেস করল, ‘সকালে নাস্তা করেছেন?’
জাহ্নবী ইতস্ততবোধ করছে। ঘুম থেকে উঠতে তার দেরি হয়ে গেছে। তাই সকালে নাস্তা বানানো হয়নি। সারা রাত উত্তেজনায় দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি। ভোরবেলা ঘুমিয়ে সকাল নয়টায় রেডি হওয়াটা মোটামুটি কঠিন। তার ওপর সকালের নাস্তা? বায়ৃ রোজ নাস্তা বানানোর অভ্যাস থাকলেও এটা আজকে মিস হয়েছে তার। জাহ্নবী’র মুখ দেখে সারল্য কী ভেবে নিলো কে জানে। মুখ ঘুরিয়ে নিলো সে।

কিছুদূর এগোতেই গাড়িতে উঠে পড়ল সারল্য’র বোন শার্লিন ও তার মেয়ে। জাহ্নবীকে দেখে আন্তরিকভাবে হাসলো সে। এতক্ষণে জাহ্নবী’র বিব্রতভাব কাটলো। শার্লিন সঙ্গে থাকলে সারল্য’র নানুবাড়িতে বেড়াতে যেতে তার জড়তাবোধ থাকবে না। নয়তো লজ্জায় একদিকে কুঁকড়ে যাচ্ছিল সে।

শহর পেরোতেই একটা রেস্তোরাঁয় গাড়ি দাঁড় করাতে বলে দিলো সারল্য। বলল, ‘নাস্তাপানি খেয়ে নেই৷
শার্লিন মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘এখনই দাঁড়াতে হবে কেন? এখনো অনেকটা পথ বাকি।’
‘জাহ্নবী সকাল থেকে কিছু খায়নি।’
শার্লিন আর কোনো উত্তর দিলো না। বিব্রতবোধ করল জাহ্নবী। বলল, ‘আমি কিছু খাবো না।’

সারল্য জোরগলায় বলল, ‘আরে নামুন তো। মা তুমিও আসো।’
ভাগ্নীকে কোলে নিয়ে সারল্য রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করল। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল জাহ্নবী। শার্লিন ওর দিকে তাকিয়ে ভদ্রতাসূচক হেসে বলল, ‘আসুন আপু।’

নাস্তার আইটেম বলতে পরোটা, ডাল, সবজি ও ডিম ভাজি। যাত্রাপথের নাস্তা হিসেবে এই ঢের। সারল্য ওর ছোট্ট ভাগ্নীকে খাবার তুলে খাওয়াচ্ছে। জাহ্নবীর মন কেমন করে। সারল্য’র মেয়েটার কথা মনে পড়ে গেল। নিঃসন্দেহে সারল্য খুব ভালো একজন বাবা। কিন্তু বাবার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। মাঝেমাঝে ভাগ্য আমাদের সঙ্গে এমন করে কেন!

সিলেটের ছায়াঘেরা এক গ্রামে সারল্য’র নানুবাড়ি। চা বাগানের ভেতর দিয়ে পথ চলার সময় জাহ্নবী অবাক চোখে সবকিছু দেখছিল। এর আগে কখনো সে চা বাগান দেখেনি। চোখের পলকেই চা বাগান পেরিয়ে একটা অদ্ভুত সুন্দর বাড়ির সামনে এসে তাদের গাড়িটা দাঁড়াল। বেশ বড়সড় বাড়িটা। পুরনো বাড়ির কয়েকটা ঘর দক্ষিণদিকে। বাড়ির সামনের দিকে নতুন করে একটা বিল্ডিং বানানো হয়েছে, আধুনিক ডিজাইনে। পুরনো বাড়িটার দেয়ালে শ্যাওলা জমেছে, লালচে রঙের ঘরের পেছনে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় গাছ। ভেতরের মানুষ গুলো অনেক আন্তরিকতার সাথে সবাইকে গ্রহণ করলো। জাহ্নবী একটা সোফায় জড়োসড়ো হয়ে বসেছে। অস্বস্তি হচ্ছে তার। বাড়িতে ঢুকেই ছোট ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেছে সারল্য। সে একা বসে আছে এক কোণে।

এমন সময় মধ্যবয়সী এক লোক এসে জাহ্নবীকে বলল, ‘এখানে একা বসে আছেন যে? বারান্দায় আসুন।’

জাহ্নবী ভ্রু কুঁচকে ফ্যালফ্যাল করে লোকটার দিকে তাকালো। তিনি হেসে বললেন, ‘আমি ইমতিয়াজ, শার্লিনের মামা। আপনি নিশ্চয়ই ওর বন্ধু?’
জাহ্নবী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, ‘আমি সারল্য’র বন্ধু।’ কিন্তু সেটা না বলে চুপ করে রইল সে।
ইমতিয়াজ মামা বললেন, ‘বারান্দায় সবাই আছে। আসুন।’

নতুন ভবনের ভেতর দরজা দিয়ে বের হতেই পুরনো ভবনের বারান্দায় এসে পড়ল ওরা। সিমেন্টের ঢালাই দেয়া কালো রঙের শীতল মেঝের বারান্দা। একদিকে পাতা রয়েছে চৌকি, লম্বা লম্বা কয়েকটা পুরনো আমলের কাঠের চেয়ার ও একটা বেঞ্চি। সবাই সেখানে বসে গল্পগুজব করছেন। দীর্ঘদিন পর বাবার বাড়িতে এসে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছেন সারল্য’র মা।

তিনি জাহ্নবীকে আদর করে কাছে ডেকে বললেন, ‘আয় মা, এদিকে আয়। এখানে এসে বোস।’

জাহ্নবী বিমোহিত হল। মহিলা পরম যত্নে তাকে ‘তুই’ সম্বোধন করছে। এ এক অনাবিল আনন্দ! সে খুশিমনে ওনার পাশে চৌকিতে গিয়ে বসলো। চৌকিতে বসে আছেন ওনার মা অর্থাৎ সারল্য’র নানী, নানীর জা, ও তাদের পুত্রবধূরা। তিনি সবার সঙ্গে জাহ্নবী’র পরিচয় করিয়ে দিলেন। মুগ্ধতার রেশ এতটাই আচ্ছন্ন করে রাখল যে, অনেক্ষণ শুধু অবাক চোখে জাহ্নবী সবাইকে দেখে গেল। মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হচ্ছিল না তার।

এমন সময় সারল্য বাচ্চাকাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে হৈ হুল্লোড় করতে করতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল।

চলবে..

মেঘফুল
পরিচ্ছেদ: ৫০
লেখনীতে: মিশু মনি

সারল্য’র সাথে চোখাচোখি হল জাহ্নবী’র। দুজনেই মিষ্টি করে হাসলো। তখনও একটা বাচ্চা সারল্য’র ঘাড়ে। দুই হাতে বাচ্চাটা সারল্য’র চুল খামচে ধরে রেখেছে। পরম আদরের সঙ্গে ওকে ঘাড় থেকে নামিয়ে দিয়ে সারল্য ওর নানীর পাশে এসে বসলো।

নানীর মাথার সব চুল পেকে গেছে। টকটকে গায়ের রং, সাদা চুল আর ঝুলে যাওয়া চামড়ায় ওনাকে ভীষণ পবিত্র দেখাচ্ছে। বয়সটা মানিয়েছে ওনাকে। সারল্য বলল, ‘নানু, আজ রাতে কিন্তু গল্প শোনাতে হবে।’
‘এখন তো গল্প বলতে পারিনা নানুভাই। সব ভুলে যাই।’
‘ভুলভাল গল্পই শুনবো। মামী, খিদে পেয়েছে, খানাদানা দিন তারাতাড়ি।’

সারল্য’র মেজো মামী ব্যস্ততার সঙ্গে উঠে পড়লেন। লজ্জা পেয়েছেন তিনি। সারল্য বলল, ‘ঘরে খাবো না মামী, বারান্দার টেবিলে দিন।’

সারল্য’র তিন মামা। বড় মামা তার পরিবার নিয়ে দেশের বাইরে থাকেন। বাড়িতে মেজো ও ছোট মামার পরিবার। একান্নবর্তী বলা না গেলেও সবাই একই বাড়িতে থাকার দরুন বেশ যৌথ পরিবারের রেশ বিরাজ করে।
মেজো মামী টেবিলে খাবার সাজিয়ে ডাকছেন। গরম গরম খাবারে ভর্তি টেবিল দেখে সারল্য বলল, ‘মামী আমাকে একবেলা খাইয়েই বিদায় দিতে চাচ্ছেন নাকি?’
‘তা কেন হবে? তোমাকে প্রত্যেক বেলাই এমন হরেক রকম খাবার সাজিয়ে দিলেও তোমার মামীর রেসিপি শেষ হবে না।’

কথাটা বলেই মামী হাসলেন। রাঁধতে ভীষণ ভালোবাসেন তিনি। সংকোচের কারণে জাহ্নবী খেতে পারছে না। সারল্য’র সাথে তার সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠ না হলেও দুজনে সহজেই গল্প গুজব করতে পারে। কিন্তু এখানে এসে জাহ্নবী বেশ বুঝতে পারল, তার ভেতর থেকে জড়তা কাটেনি আজো। এখনও কারো সাথে স্বাভাবিক ভাবে মিশতে কষ্ট হয়। কীভাবে এই জড়তা কাটিয়ে উঠবে সে? আনমনে সে কথাই ভাবছিল জাহ্নবী।

নানু একটা বড় মাছের মাথা জাহ্নবী’র পাতে তুলে দিলেন। লজ্জায় কিছু বলতে পারল না সে। শুধু ফ্যালফ্যাল করে নানীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
নানী বললেন, ‘খাও নানুভাই।’

জাহ্নবী মাথা নিচু করে ফেলল। বাড়িভর্তি অচেনা সব লোকজনের সামনে খাবার খেতে তার বিব্রত লাগছে। সকলেই কথা বলতে ব্যস্ত। কত রকমের গল্প সবার। অথচ তার মনে হচ্ছে সবাই যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। খুব অস্বস্তি নিয়ে খাওয়া শেষ করলো জাহ্নবী। তারপর ঘরে এলো বিশ্রাম নিতে।

বিছানায় শুয়েই বিশাল জানালার ওপাশে সবুজ গাছের দোল খাওয়ার দৃশ্য দেখা যায়। বাতাসে গাছের পাতারা নাচছে। আকাশটা ভীষণ স্বচ্ছ, নীলাম্বরীর নীল শাড়ির মতো। জাহ্নবীর মনের মেঘ আস্তে আস্তে কেটে যেতে শুরু করেছে। এত সুন্দর আকাশ বহুদিন দেখেনি সে। শহরের আকাশ আর গ্রামের শান্ত শিষ্ট স্বচ্ছ আকাশের মাঝে যেন আকাশ পাতালের মতোই ব্যবধান।

সারল্য দরজায় ঠকঠক করে জানতে চাইলো, ‘বাইরে যাবেন?’

জাহ্নবী চমকে ওঠে। খোলা দরজার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সারল্য। পরনে একটা অফ হোয়াইট রঙের শার্ট। চোখে চশমা নেই। নেই কোনো ক্লান্তি। জাহ্নবীকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে আবারও জানতে চাইলো, ‘রেস্ট নেবেন? না বাইরে যাবেন?’
‘বাইরে যাবো।’

জাহ্নবী উঠে পড়ল। যদিও বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই তার ক্লান্তিতে ঘুম চলে আসছিল। তবে সারল্য’র প্রাণবন্ত আমন্ত্রণ কিছুতেই নাকচ করতে পারবে না সে। বাইরের সুনীল আকাশটা যেন হাত বাড়িয়ে ডাকছে তাকে।
এতক্ষণে স্বস্তি পেল জাহ্নবী। সারল্য’র সঙ্গে একাকী পথ চলতে তার কোনো অস্বস্তি হয় না।

বাড়ির চারপাশেই অসংখ্য বৃক্ষলতা। পেছন দিকে বিভিন্ন মৌসুমি ফলের বাগান। ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাগানের শেষ মাথায় এসে দাঁড়াল ওরা। সামনে দিগন্তবিস্তৃত ধানের ক্ষেত। সবুজ ধানের শিষে বাতাসে দোল খেয়ে ঢেউ উঠছে। শিরশির করে গায়ে লাগছে হাওয়া। জাহ্নবী’র মনে হলো, বুক ভরে শ্বাস নেয়ার জন্য গ্রামই সবচেয়ে শান্তির জায়গা। মানুষ অযথা শহরে পড়ে থাকে।
সারল্য বলল, ‘ধান কাটা দেখেছেন কখনো?’
‘না।’
‘আহা, পৃথিবীর অসংখ্য মনোরম দৃশ্যের একটা হচ্ছে ধান কাটার দৃশ্য। শুধু কাটা নয়, ধান কেটে কৃষকের বাড়ির উঠোনে জমিয়ে রাখা, মাড়াই করা, বাড়ির বউরা ঘামে ভিজে সেসব ধান সেদ্ধ করে রোদে শুকান। সবকিছুই বড় মায়ায় ভরা। কখনো সুযোগ পেলে দেখতে আসবেন।’

জাহ্নবী একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘সেই সুযোগ আমি পাবোই না। আপনি না নিয়ে এলে এইযে সবুজ ধানক্ষেত দেখছি, এটাও দেখতে পেতাম না।’
‘মাঝেমাঝে নিজেকে ছুটি দেবেন। জীবনের সব জটিলতা থেকে। তখন চলে যাবেন কোনো গ্রামে। আমি যখন জীবনের মানে খুঁজে পাইনা, তখন গ্রামে যাই। গ্রাম আমাকে নতুন করে জেগে উঠতে শেখায়।’

জাহ্নবী মুগ্ধ হয়ে পান্নাবাহারের কথা শোনে। আর মুগ্ধ চোখে দেখে সবুজ ধানের ক্ষেত, সবুজ গাছের পাতা, নীল আকাশ আর ফুরফুরে সাদা মেঘ।

সারল্য গাছ থেকে ডাব পেরে খাওয়ায় জাহ্নবীকে। আনন্দে জাহ্নবীর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে। খুশিমনে বাগানে হাঁটাহাঁটি করে সে। পুরো বাড়িটা তাকে ঘুরে দেখায় সারল্য। বহুদিন পর নিজের চেনা গণ্ডির বাইরে এসে জাহ্নবী যেন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে শুরু করেছে।
সন্ধ্যাবেলা মেজো মামার মেয়ে উনাইসা জাহ্নবীর সঙ্গে গল্প জমানোর চেষ্টা করে। উনাইসার কলেজে পড়ে। তবে ভীষণ চনমনে স্বভাবের মেয়ে। জাহ্নবী’র সঙ্গে কথায় কথায় এমন ভাব হয়ে গেল যে, নিজের সব জড়তা কখন মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে খেয়ালই করেনি সে। উনাইসার সঙ্গে রান্নাঘরে এসে মেজো মামীর পাশে দাঁড়িয়ে সে রান্না করা দেখছিল। মামী সিলেটের ঐতিহ্যবাহী সাতকড়া চিনিয়ে দিলো ওকে।
এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘জাহ্নবী তোমার বিয়ে হয়নি?’
‘বিয়ে করিনি এখনো মামী।’
মামী খানিকক্ষণ ওর দিকে চেয়ে রইলেন। কড়াইতে গরম তেলে পেয়াজ ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘মনের মানুষ চলে গেছে বলে বিয়ে করোনি নাকি?’
‘পাই ই নি।’
‘মনের মানুষ পাওনি বলে বিয়ে করোনি?’

জাহ্নবী লাজুক হেসে বলল, ‘হুম। জীবনে খুব একটা পুরুষ মানুষের সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয়ই হয়নি। খুঁজে পাবো কোথায়?’
‘তা আমার ভাগ্নের সঙ্গে পরিচয় হল কীভাবে?’
‘কাজের সূত্রে।’

কড়াইতে পেয়াজের রংটা বাদামী হয়ে এসেছে। মামী সেদিকে দৃষ্টি রেখেই কথা বলছেন জাহ্নবীর সঙ্গে। মশলা বাটা কড়াইতে ছেড়ে দিয়ে নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘ও কি তোমার বন্ধু?’
‘হ্যাঁ মামী।’
‘তোমার জন্য ছেলে দেখবো? হাতে ছেলে আছে।’

এতক্ষণে মামী জাহ্নবী’র দিকে তাকালেন। ওর অস্বস্তি হচ্ছে। লাজুক হেসে বলল, ‘এত বছর যখন পার করে এসেছি, এখন আর দেখতে হবেনা মামী। আর কিছুদিন অপেক্ষা করি।’

মামী আর কিছু বললেন না। কষানো মশলায় মাংস ছেড়ে দিলেন। মশলা ও কাঁচা মাংস কষানোর ঘ্রাণে পুরো রান্নাঘর ভরে উঠল। উনাইসা বলল, ‘আন্টি চলো বাইরে যাই।’
বাড়ির উঠোনে বাচ্চাকাচ্চারা খেলায় মেতে উঠেছে। জাহ্নবী উঠোনে এসে বসলো। শার্লিন বাটিতে খাবার নিয়ে মেয়ের পিছুপিছু ছুটছে। তার বাচ্চাটা একদমই খেতে চায় না। সব দৃশ্য দেখতে দেখতে জাহ্নবী অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। দুটো বাচ্চা এসে তার হাত ধরে বলল, ‘আন্টি চলো খেলবে।’

ইতস্তত করতে করতে উঠে এলো জাহ্নবী। ওদের সঙ্গে খেলায় যোগ দিলো। হাসি, আনন্দ আর হৈ হুল্লোড়ের মাঝখানে কখন যে নিজের চেনা সংকোচে ঘেরা চরিত্রটা থেকে বেরিয়ে এসেছে বুঝতেই পারল না। নিজেকে মনে হচ্ছে নতুন জন্ম নেয়া শিশু। উচ্ছল কিশোরীর মতো তার খলখল করে হাসতে ইচ্ছে করছে।

রাতের খাবার খেয়ে সবাই খানিকক্ষণ আড্ডা দিচ্ছিল। জাহ্নবীকে ডেকে বাইরে গিয়ে বসলো সারল্য। সেদিকে তাকিয়ে মেজো মামী সারল্য’র মাকে বললেন, ‘মেয়েটার সঙ্গে ওর কোনো সম্পর্ক নেই তো?’
‘না। সেটা মনে হয় না।’ উত্তর দিলেন সারল্য’র মা।

মেজো মামী বললেন, ‘হুম। মেয়েটা ভালোই। সাদামাটা। অনেক সহজ সরল আচরণ, কথাবার্তা। আজকালকার মেয়েদের মতো অত প্যাচঘোচ নেই।’
কথাটাতে সায় দিয়ে সারল্য’র মা বললেন, ‘হ্যাঁ। আমাকে খালা বলে ডাকে। আত্মাটা জুড়িয়ে যায়। লক্ষী একটা মেয়ে।’
‘আপা, ওর সঙ্গে আমাদের সারল্য’র বিয়ে দিয়ে দিন না। ওর মতো একটা ছেলে একা একা জীবন পার করবে কেন?’

শার্লিন উত্তর দিলো, ‘কী বলছেন মামী? ওনার সঙ্গে যায়? বা ভাইয়ার সঙ্গে ওনাকে মানায়?’
‘যার সঙ্গে মানায়, সে তো লাত্থি দিয়ে চলে গেল। অত মানামানি দিয়ে কাজ কি শার্লিন? চেহারা আর কয়দিন থাকবে? সারল্য’র বয়স হচ্ছে। এই বয়সে একা থাকা কঠিন। তার ওপর যে একবার নারীসঙ্গ পেয়েছিল, সে একা থাকতে পারে না।’

শার্লিন উত্তর দিলো, ‘ভাইয়া তার মতো আছে। থাকুক না। সে নিজে থেকে বিয়ে করতে চাইলে আলাদা কথা।’

মামী জোর দিয়ে বললেন, ‘ও নিজে থেকে চাইবে না। ওর এখন মনটা ভঙ্গুর। কাউকে ভালো লাগার বিষয় গুলো ওর মাথাতেই আসবে না। ছেলেটা আর সব ছেলের মতো না। এখন যদি আপা ওকে বিয়ের কথা বলেন, আপা বিয়ে দিলে সে বিয়ে করতেও পারে। আর বিয়ে করলে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

শার্লিন তার মায়ের মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল, ‘ভাইয়া কী ধরনের মেয়ে পছন্দ করে, মা তো সেটা জানে। মা তুমিই বলো না।’

মা খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘আমার মনে হয় মেজো ঠিকই বলেছে। একটা পরিণত বয়সে এসে ছেলেরা আর উচ্ছলতা, পাগলামি, কেয়ারনেস এসব খোঁজে না। এই সময়ে এসে ওদের দরকার হয় একজন ভালো সঙ্গী, একজন বন্ধু। যে ওকে বুঝবে। ওর কথাগুলো শুনবে। ওর একাকীত্বের সময়টাতে ওর পাশে থাকবে। একটা মেয়ের ক্ষেত্রেও তাই। মেয়েরা অল্প বয়সে জীবনে প্রেম খোঁজে, কেয়ারনেস, পাগলামি, রোমান্টিকতা, সারপ্রাইজ এসব চায়। কিন্তু একটা পরিণত বয়সে এসে ওরা চায় এমন একজন মানুষ ওর জীবনে আসুক, যে ওকে বুঝবে। যে দায়িত্বশীল, ভালো মনের মানুষ হবে। আমি এই জিনিসটা খুব ভালো বুঝি।’

শার্লিন আর উত্তর দিতে পারলো না। মায়ের কথাটা পুরোপুরি যোক্তিক সেটা সেও জানে। তার স্বামী ইতালিতে আছে, মেয়েটা ছোট বলে তাকে নিয়ে যাচ্ছে না এখনও। সবকিছু ঠিকঠাক থাকার পরও শার্লিন কোথায় একটা শূন্যতা খুঁজে পায়। সে হাতড়ে বেড়ায় সেই অমোঘ জিনিসটাকে, যার জন্য তার মন পোড়ে। এখন মায়ের কথা শুনে মনে হচ্ছে, তার একজন বন্ধুর ভীষণ অভাব। তার স্বামী মানুষ হিসেবে যথেষ্ট ভালো হলেও বন্ধু হয়ে উঠতে পারেনি তার। তাকে বুঝতে চায় না মানুষটা। মন খারাপ হলেও সে বোঝেনা, মনে অনেক আনন্দ নিয়ে তার কাছে গেলেও সে গুরুত্ব দেয় না। প্রত্যেকটা অনুভূতির যে কী মূল্য, যারা অনুভূতিপ্রবণ, কেবল তারাই জানে। শার্লিন মায়েদের আড্ডা থেকে উঠে আসে। একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ভেতরে চাপ দিচ্ছে। নিশ্বাসটাকে ঠেলে বের করে দেয়ার জন্য তার একটু জায়গা দরকার।
বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়ায় শার্লিন। ফিরে এসে মাকে বলল, ‘জাহ্নবী আপুর মনটা ভাল। তোমার ছেলেকে বুঝবে সে।’

মা হতভম্ব হয়ে শার্লিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরইমধ্যে মেয়ের মতামত বদলে গেল কী করে সেটা ভাবছেন। ওনার চোখের পলক পড়ছে না। শার্লিন সেখান থেকে চলে গেলে তিনি বললেন, ‘ ছেলেমেয়ে গুলো আজকাল খুব জটিল হয়ে গেছে। ঠিকঠাক বোঝা যায় না ওদের।’

মেজো মামী আবারও বললেন, ‘আপা, আপনি সারল্য’র সঙ্গে কথা বলেন। ওর জীবনে আর নতুন করে প্রেম ভালবাসা হবে না। আপনি ওকে বিয়ে দেন। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

মা কোনো কথা বললেন না। স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন। তার ছোট্ট ছেলে সারল্য’র সরল মুখখানা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। ছেলেটা কী মেধাবী ছিল, আর কতই না ভালো মনের। একটা মেয়েকে ভালবেসে জীবনের সবকিছু উৎসর্গ করে দিলো ছেলেটা। অথচ প্রাপ্তির খাতায় জুটল শুধুই রিক্ততা!

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here