মেঘফুল পরিচ্ছেদ: ৫৫

0
927

মেঘফুল
পরিচ্ছেদ: ৫৫

বিয়ের পরের জীবনে ভীষণ আনন্দে আছে জাহ্নবী৷ বিশাল বাড়িটাতে তার নিজস্ব সংসার। সবকিছু সাজানো গোছানো হলেও তার সংসারী মন নতুন করে সব সাজাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ঘরের সাজসজ্জা বদলেছে। বদলেছে জানালার পর্দার রং, বিছানার চাদর, দেয়ালে নতুন করে যুক্ত হয়েছে কিছু পেইন্টিং। সংসারে খুব একটা মন না থাকলেও সারল্য মুগ্ধ হয়ে জাহ্নবীর ঘর সাজানো দেখে। প্রায়ই রাস্তার পাশের দোকান থেকে একটা গাছের চারা, কিংবা সময় পেলেই মার্কেটে ছুটে গিয়ে ঘর সাজানোর একটা উপকরণ হাতে নিয়ে ফেরে। মাঝরাত্তিরে কাজ শেষ করে ঘুমাতে যাওয়ার আগে জাহ্নবী কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিন্তা করে। সারল্য যখন জিজ্ঞেস করে, এই কী করছো?
– দেখছো না চিন্তা করছি?
– কী চিন্তা করছো?
– এখানে একটা নকশীকাঁথার ফ্রেম দেবো ভাবছি। আর একটা বেতের চেয়ার।

সারল্য মুচকি হাসে। এই বয়সে এসে মেয়েটা নতুন বিয়ে করেছে। মনের মতো করে সবকিছু গুছিয়ে নেয়ার সাধ জাগতেই পারে। এতে বাধা নেই সারল্য’র। দুজনে একসাথে মন দিয়ে ব্যবসাটাকে গড়ে তুলছে। মা বাবা যেমন নবজাতক শিশুকে তিলে তিলে বড় করে তোলে, তেমনই ধীরেধীরে একটা ছোট্ট নাম’কে ব্রাণ্ড করে তুলতে দুজনেই একসঙ্গে লড়ছে।

শরতের এক উষ্ণ বিকেলে কাজের ফাঁকে জাহ্নবীকে নিয়ে কাশবনে ঘুরতে গেল সারল্য। ধূসর কাশবনের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জাহ্নবী থমকে দাঁড়ায়। মাথার ওপর স্বচ্ছ নীল আকাশে তুলোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘের দল। জাহ্নবী উদাস গলায় বলল, ‘শরতের আকাশে মেঘগুলো যেন একেকটা ফুল। মেঘের ফুল। তুমি আমার জীবনে একটা মেঘফুল হয়ে এসেছো।’

সারল্য কণ্ঠে মুগ্ধতা ছড়িয়ে জানতে চাইলো, ‘আমার জীবনে তুমি এসেছো নাকি তোমার জীবনে আমি?’
‘আমার জীবনে তুমি। আজ তোমায় একটা গোপন কথা বলবো।’
‘গোপন কথা!’
‘হুম। আমার কাছে তোমার একটা নাম আছে। যেটা তুমি জানো না। তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম সেদিনই তোমার নাম রেখেছিলাম পান্নাবাহার।’

সারল্য খানিকটা চমকায়। ভ্রু কুঁচকে সে জাহ্নবী’র দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জানতে চাইলো, ‘প্রথম কবে দেখেছো আমাকে? নাদিরের বাসায় না?’
‘উহু। সেটা সিক্রেট। কবে, কোথায়, কীভাবে দেখেছি, আর কেন তোমার নাম পান্নাবাহার এটা আমি তোমাকে কখনোই বলবো না।’

সারল্য বিস্মিত হয় জাহ্নবী’র কথায়। কৌতুহল জাগলেও সেটাকে দমন করে। থাক না কিছু বিষয় গোপনেই। সবকিছু জানা হয়ে গেলে তাতে আনন্দ থাকে না।
কাশবনে হাঁটতে হাঁটতে সারল্য জাহ্নবী’র হাতটা মুঠোয় চেপে ধরে। আজকাল আর নিজেকে একা একা লাগে না তার। অথচ সে ভেবেছিল বাকি জীবনটা বুঝি একাকীত্বকে সঙ্গী করেই কাটাতে হবে, কী অদ্ভুত!

ব্যবসাকে নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে জুড়ে ফেলায় উদাসীন ভায়োলেটের হস্তক্ষেপ আর ভালো লাগে না জাহ্নবীর। সবসময় মনে হয় ভায়োলেট এটাকে নিজের সন্তানের মতো যত্ন করতে পারছে না। সবকিছুতে একটা খাপছাড়া ভাব, উদাসীনতা। জাহ্নবী নিজের মতো এটাকে গড়ে নিয়েছে, ভায়োলেট যেন তাতে অযথাই তরকারির এলাচির মতো। ভায়োলেটকে সবকিছুর আপডেট দিতেও ওর ভালো লাগে না। কী মনে করে একদিন জাহ্নবী ডেকে নিলো ভায়োলেটকে।

দুই বোন মুখোমুখি বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিল। ভায়োলেট যথারীতি হাসিখুশি ভঙ্গীতে বসে আছে। জাহ্নবী’র চেহারায় কাঠিন্য। সে যথেষ্ট গম্ভীরতার সঙ্গে তাকাচ্ছে। ভায়োলেটের মনে হল নিশ্চয়ই একটা ঝামেলা হয়েছে। ভ্রু কুঁচকে তাকালো সে।

জাহ্নবী বলল, ‘তোকে একটা কথা বলবো বলে ডেকেছি।’
‘বলো আপু।’
‘তোর স্বপ্ন পূরণ করে ফেল।’

ভায়োলেট চমকে উঠলো। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসা থেকে নড়েচড়ে বসলো সে। জাহ্নবী বলল, ‘তুই আমাকে বলেছিলি না তোর স্বপ্নের কথা? যার জন্য স্টার্টআপটা জরুরি। এখন তো বিজনেস দাঁড় হয়ে গেছে বলা যায়। তুই স্বপ্ন পূর্ণ করতে চলে যা।’

ভায়োলেট শুকনো হাসি দিয়ে বলল, ‘এখনও সময় আসেনি আপু। এটাকে মিলিয়ন ডলার ভ্যালুয়েশন না বানিয়ে আমি কোথাও যেতে পারবো না।’
জাহ্নবী ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘মিলিয়ন না, বিলিয়ন ডলার হবে। সেটা আমি করবো। তোকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।’

ভায়োলেট খানিকটা বিব্রতবোধ করল, ‘আপু, তুমি কি আমার সঙ্গে কোনো কারণে রেগে আছো?’
‘দ্যাখ, এটা শুরুর আগে তুই যেরকম সিরিয়াস ছিলি, আমার এখন তোকে ওরকম সিরিয়াস মনে হয় না। একটা কোম্পানি যেকেউ শুরু করতে পারে কিন্তু লেগে থাকাটা এত সহজ না। এটা সবাই পারে না। এভাবে যুগে যুগে বহু কোম্পানি, নামীদামী ব্রাণ্ড গুলো দেউলিয়া হয়ে গেছে।’

ভায়োলেট চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে চাইলো, ‘তুমি কী ভাবছো আমি লেগে থাকতে পারবো না?’
‘তুই আজকাল নিজের মধ্যে নেই। তোর কী হয়েছে আমি জানিনা। তবে স্পষ্ট বুঝতে পারছি তোর ব্যবসায়ে মন নেই। নিতান্তই দায়সারা ভাবে কাজ করে যাচ্ছিস।’

ভায়োলেটের খানিকটা সময় লাগল কথাগুলো হজম করতে। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে রইল সে। চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কোনো ধোঁয়া নেই। সেও কী ঠাণ্ডা চায়ের মতো হয়ে গেছে আজকাল? আপনমনে কথাটা বলল সে। অথচ তার এখন আগের চাইতে বেশী প্রোডাক্টিভ হওয়ার কথা।

ভায়োলেট অকপটে স্বীকার করে নিলো, ‘আপু, আমার কোনো কিছু ভালো লাগছে না। সারাক্ষণ অস্থির লাগে। কী যেন আমাকে তাড়া করে বেড়ায়।’

জাহ্নবী ভায়োলেটের হাতের ওপর হাত রাখল, ‘আমি বুঝি রে। তুই ভেবেছিলি অনেক বড় হবি, অনেক টাকা হবে তারপর নিরুদ্দেশ হয়ে যাবি। তোর জীবন থেকে হয়তো সব অশান্তি দূর হয়ে যাবে। কিন্তু এত সহজ না রে। জীবন খুব অদ্ভুত। মানুষ সবকিছু ভুলতে পারলেও ভালবাসার অভাব ভুলে থাকতে পারে না। তুই যেখানেই যাস না কেন, মনে অশান্তি থাকবেই। আমি জানিনা তোকে কী বলবো। তুই এখনো ভুলতে পারিস নি ওকে।’

ভায়োলেট ম্লান হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘জীবনটা কারও জন্য থেমে থাকে না।’
‘কিন্তু মনের শান্তি?’
‘শান্তির জন্য সবসময় ভালবাসাই কেন দরকার হবে?’
‘কারণ ভালবাসা পৃথিবীর সবকিছুর চাইতে দামী। যেটা টাকা দিয়ে কেনা যায় না। তুই যতই বিলাসী জীবনযাপন কর, ভালবাসা পাবি না কিনতে। এটার জন্য কারও কাছে আসতেই হবে। ভায়োলেট, তুই নতুন করে কাউকে নিয়ে জীবন সাজিয়ে তোল। ভালো থাকবি।’

ভায়োলেট আবারও শুকনোভাবে হাসলো। তারপর নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘বাদ দাও আপু। তবে তুমি একটা বিষয় বুঝতে পেরেছো এতে আমি খুশি হয়েছি। ইদানীং কাজে মন দিতে পারছি না। আমি কিছুদিন ঘুরে আসি কোথাও।’
‘তোর ইচ্ছে। তবে আমি বলবো আমি আর সারল্য যখন এটাকে আঁকড়ে ধরেছি, তুই এখন স্বাধীন হয়ে যা। জীবনের সব পিছুটান ভুলে তুই আপন মনের ঠিকানায় হারিয়ে যা। বিজনেস নিয়ে তোর ভাবতে হবে না। তোর জন্য যখন যা প্রয়োজন, যত টাকা লাগবে আমি পাঠাবো। তুই নিশ্চিন্তে থাকবি। যেহেতু তুই এই প্রতিষ্ঠানের মালিক, গুরুত্বপূর্ণ যেকোনো কাজে অবশ্যই তোকে দরকার হবে। বাদ বাকি সব আমার ওপর ছেড়ে দে। আমি এটাকে নিজের মতো করে গড়ে তুলবো।’

ভায়োলেট অনেক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আমায় বাঁচালি আপু। নিজেকে খুব স্বাধীন মনে হচ্ছে আজ। তুই এটাকে তোর মতো করে আগলে রাখ। আমাকে ছেড়ে দে।’
‘সেটাই তো বলছি। তোর যখন যা প্রয়োজন, সময়মত পেয়ে যাবি। যা, এবার নিজের কাঙ্খিত লাইফটা এনজয় কর।’

কথাগুলো বলতে পেরে জাহ্নবী নিজেও যেন স্বস্তিবোধ করলো। সে একা এই ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। ভায়োলেটের জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত সে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানকে এতদিনে সে এতটাই ভালবেসে ফেলেছে যে, এখানে সারল্য’র মতামতও তার ভালো লাগে না। নিজের শক্তিতে এটাকে সে বড় করে তুলবে। স্বাধীনভাবে কাজ করবে সে।
ভায়োলেট জাহ্নবীকে জড়িয়ে ধরল। এমন একটা দিনের অপেক্ষাতেই যেন ছিল সে। মনে হচ্ছে বহুকাল ধরে দেখে আসা স্বপ্নটা আজ পূর্ণতা প্রাপ্তির পথে। এখন শুধুই পা ফেলা বাকি! নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে।

জাভেদ আলী ও পারভীন খুব অবাক হলেন ভায়োলেট দেশের বাইরে চলে যেতে চায় শুনে। তবে বরাবরের মতোই মেয়ের ইচ্ছায় কোনো বাঁধা দিলেন না জাভেদ আলী। তিনি ভায়োলেটের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘অবশ্যই যাবি। আমাদের ভুলে যাস না।’
‘ভুলবো না বাবা।’

বাবাকে জাপটে ধরে সে। জাভেদ আলী মেয়েদের নিয়ে গর্ববোধ করেন। তার মেয়েদের বিজনেস দ্রুত সময়ের মধ্যে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। আজকাল তিনি কথায় কথায় পারভীনকে বলতে পারেন, দেখো আমার মেয়ে কী করেছে দেখো? আমি জানতাম আমার মেয়েরা একদিন বড় হবে, অনেক বড়।

পারভীন নিজেও বেশ তৃপ্তি পান মেয়েদের কথা ভেবে। কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করেন না। জাহ্নবী শ্বশুর বাড়িতে থাকে। সামার আজকাল ঘরকুনো হয়েছে বেশ। খুব একটা কথাবার্তা হয় না ওর সঙ্গে। ভায়োলেট বিদেশে চলে যাবে শুনে মনটা যেন মুষড়ে পড়ল ওনার। বড্ড মন খারাপ লাগছে।

আজীবন মেয়েদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছেন তিনি। কখনো কাছাকাছি আসতে পারেননি তাদের। কেন যেন সবসময় নিজের চারপাশে দেয়াল তৈরি করে রেখেছেন। সন্তানের বন্ধু হতে পারেননি কখনো। আজ মনে হচ্ছে তিনি একজন ব্যর্থ মা। রাজকন্যার মতো তিনটা মেয়েকে পেয়েও যাদের আপন হতে পারেননি।

ভায়োলেট যেদিন বিদায় নিলো, সেদিনও পারভীন মুখে কাঠিন্য ধরে রাখলেন। যেন দুদিনের জন্য বেড়াতে যাচ্ছে ভায়োলেট। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করার প্রবল ইচ্ছেটাকেও দমিয়ে রাখলেন। তবে ভায়োলেট মাকে জড়িয়ে ধরল। হাউমাউ করে কাঁদলো। সেই কান্নার অশ্রুতেই বলা হয়ে গেল শত না বলা অভিমান। বুঝলেন পারভীন। কিন্তু বড্ড শেষটায় বুঝলেন!
সব পিছুটান ছেড়ে ভায়োলেট পাখির মতো উড়াল দিলো তার স্বপ্নের জীবনের উদ্দেশ্যে..

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here