#ভীন_দেশের_গল্প
#পর্ব_৪
লেখনীতে- #অলিন্দ্রিয়া_রুহি
-‘ইয়া বাবা আস্তে! কানের পোঁকা নড়িয়ে দিলে তো..’
চোখ খিঁচে এক হাতে কান ঢাকে মহুয়া। ততক্ষণে লাবণী নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়েছে। তার আঁখিদ্বয় ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে। কিছুক্ষণ আগেই সে অন্যরকম কিছু একটা দেখছিল, অথচ সেকেন্ডের ব্যবধানে মহুয়াকে দেখতে পাচ্ছে! অদ্ভুত লাগল লাবণীর নিকট। তবে নিজের বিস্ময়তা মহুয়ার কাছে প্রকাশ না করে সে নিচু কণ্ঠে বলল,
-‘দুঃখীত। আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম।’
-‘ভয় পেয়েছো? কেন, এখানে কী ভূত দাঁড়িয়ে নাকি!’ কটমট সুরে বলে মহুয়া। তখনো হাত দিয়ে কান নাড়িয়ে চলেছে। লাবণী পুনরায় নিচু গলায় বলে,
-‘না, তেলাপোকা। তেলাপোকা দেখে..’
-‘ম’রণ!’ বিড়বিড় করল মহুয়া। চোখেমুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তার যাওয়ার পানে স্পষ্ট চোখে চেয়ে রইলো লাবণী। তার পরিষ্কার মনে আছে, কিছু একটা অন্যরকম দেখেছিল সে। তারপর চোখ বন্ধ করে চিৎকার করতেই মহুয়ার কণ্ঠ কানে ভেসে আসে। এরপর চোখ খুলে মহুয়াকে ছাড়া অন্যকিছুই দেখতে পায়নি সে। তবে কী মনের ভুল ছিল? নাকি আলো আঁধারিতে মহুয়াকেই অন্যরকম লেগেছিল তার নিকট? মনের ভেতর একটা প্রশ্ন জমা রেখে রান্নাঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসে লাবণী। ওয়াশরুমেও গেল না আর। তড়িঘড়ি করে বারান্দায় চলে এলো সে। কিন্তু বিছানায় শুতে পারল না স্থির ভাবে। কেন যেন খুব ভয় ভয় লাগছে। তার উপর বারান্দা অন্ধকার। একটা বাতি আছে,সেটাতেও আলো নেই খুব একটা। রাতের অন্ধকার আকাশ এবং গা হিম করা বাতাস ভয়টাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে পারল না লাবণী। পড়িমরি করে ছুটলো রুবার ঘরে দিকে। আজকের রাতটা রুবার সঙ্গে ঘুমাতে পারলে ভালো হয়।
এত রাতে রুবার ঘর থেকে তনয়কে বেরোতে দেখে একটু না, খুব বেশি অবাক হলো লাবণী। ড্রয়িং রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ল সে স্তব্ধ নয়নে। তনয় দরজা থেকে বেরিয়ে আড়মোড়া ভাঙে। তার ঠোঁটের কোণে ক্রুদ্ধ হাসি। তারপর চোখ সামনে আনতেই লাবণীর সঙ্গে চোখাচোখি হলো। তনয়ের ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে যায় মুহূর্তেই। সেটিও নজর এড়ায় না লাবণীর। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে তনয়ের দিকে এগিয়ে গেল সে। প্রশ্ন করে,
-‘ভাবী জেগে আছে?’
তনয় খানিকটা রাগ নিয়ে মিনমিন কণ্ঠে জবাব দিলো,
-‘তুই-ই গিয়ে দেখ। আমাকে জিজ্ঞেস করিস কেন?’
-‘আপনি এত রাতে এই ঘরে তো..তাই।’
সহাস্যে বলে লাবণী। সাহস করে নিজের দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণতা নিয়ে এলো। তনয় পূর্বের চেয়েও বেশি অপ্রস্তুত হয়ে উঠে। একবার পেছন ঘুরে তাকিয়ে পুনরায় লাবণীর দিকে চাইলো। কিড়মিড় করে বলল,
-‘আমার সাথে শেয়ানাগিরি করতে আসিস না লাবণী। তুই কাজের লোক ছিলি, কাজের লোকই থাকবি। এই বাড়ির একজন নিজেকে ভাবিস না।’
-‘একটা বাসায় কুকুর থাকলে,সেও ওই বাড়ির দেখভালে নিয়োজিত থাকে। আর আমি তো মানুষ মাত্র। আপনার আম্মা আমাকে ভালোবেসে এখানে জায়গা দিয়েছেন। আপনারা সবাই আমাকে কাজের লোক ভাবলেও আপনার আম্মা আমাকে মেয়ের মতো সম্মান দিয়েছেন। ভালোবাসা দিয়েছেন। আর সেটাই আমার কাছে মূখ্য। আপনারা যে যা বলুন, আমার কিচ্ছু যায় আসে না।’
লাবণীর হঠাৎ পাল্টে যাওয়া তনয়ের চোখে পড়ল খুব। এরকম কাটকাট কথা বলার মেয়ে লাবণী নয়। লাবণী নিজেও অবাক তার ব্যবহার দেখে। যদিও তনয়ের মতো ছেলের সঙ্গে এরকম ব্যবহার করাই উচিত। একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে তনয়কে পাশ কাটানোর জন্য পা বাড়ায় লাবণী। কিন্তু যেতে পারল না। একটা হাত তার হাতকে হ্যাচকা টানে আঁকড়ে ধরেছে। সেই হাতটির মালিক তনয়। লাবণী চোখে অগ্নি এনে তাকাল। গমগমে সুরে বলল,
-‘আমার হাত ছাড়ুন।’
হাত ধরা ব্যক্তির তাতে কোনো ভাবান্তর হলো না। বরঞ্চ আরেকটু শক্ত জোর দিলো হাতের উপরে। লাবণীকে টেনে নিজের খুব কাছাকাছি এসে তনয় ফিসফিসিয়ে বলল,
-‘লাবণী, ভয় কর। আমাদের সবার কথা ছাড়। তোর নিজের কথা চিন্তা কর। তোর সামনে কতবড় বিপদ আসতে চলেছে তা তুই কল্পনাও করতে পারবি না। সো…থিংক এবাউট ইউরসেল্ফ।’
পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য হাসিটা তনয়ের ঠোঁটের উপর। লাবণীর শরীর শিউরে উঠল। হতভম্ব হয়ে পড়ল সে। তনয় হাত ছেড়ে দিয়ে চাপা স্বরে শিস দিতে দিতে চলে গেল। রেখে গেল থমথমে একখান মুখ। তনয়ের বলা কথাগুলো লাবণীর মাথার ভেতর আলোড়ন সৃষ্টি করে। কী বলে গেল এসব! কেনই বা বলে গেল? কী এমন বিপদ আসতে চলেছে লাবণীর? আর সেটা তনয়ই বা জানে কেমন করে? একঝাঁক প্রশ্ন ঝাপিয়ে পড়ে লাবণীর ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে। নিউরন ছুটে চলে এদিক থেকে ওদিক। কিন্তু হায়, উত্তর নেই একটিরও!
-‘লাবণী..তুই এখানে?’
হঠাৎ প্রশ্নে চমকে উঠে লাবণী। পেছন ঘুরে রুবাকে দেখতে পেয়ে নিজেক ধাতস্থ করে সে। রুবার কপালে ভাঁজ ভাঁজ, চোখেমুখে বিরক্তির ছটা। যেন সে এখানে লাবণীকে দেখতে পেয়ে অনেক বেশিই বিরক্ত হয়েছে! তনয়ের কথাগুলো মনের ভেতর চাপিয়ে রুবার কাছে আসার মূল বিষয়টির প্রতি জোর দেয় লাবণী। আকুতি ভরা গলায় বলল,
-‘ভাবী, আমি আজকে আপনার সাথে শুই?’
রুবা যেন আসমান থেকে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়,
-‘না… মানে, কেন? আমার সাথে থাকবি কেন?’
লাবণী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।
-‘আমার আসলে বারান্দায় একা থাকতে কেমন যেন লাগছে ভাবী। তাই..’
-‘তাহলে রান্নাঘরে গিয়ে শো। দেখ লাবণী, আমি কারো সাথে বেড শেয়ার করতে পারি না। আমার ঘুম হয় না।’
-‘আচ্ছা।’ ছোট করে জবাব দেয় লাবণী। তারপর চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। নিজের বিছানা বারান্দা থেকে নিয়ে এসে রান্নাঘরেই শুয়ে পড়ল সে। রান্নাঘরের বাতি জ্বালিয়ে রাখল। কপালের উপর হাত রেখে শূন্য সিলিংয়ে তাকিয়ে রইলো সে। মনের ভেতর আবারও ঘুরপাক খেতে লাগল তনয়ের বলা কথাগুলো। কী কারণে এমন কথা বলল সে? লাবণী কী কারো ক্ষতি করেছে? তার তো কোনো শত্রু নেই। তবে কেন তনয় বলল তার বিপদ সামনে? একসময় রাত গভীর হয়। হাবিজাবি নানান চিন্তা মাথায় নিয়ে একসময় লাবণী ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো।
★
ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই শক্ত হাতে মহুয়াকে জড়িয়ে ধরে মাজহাব। মহুয়া বিরক্ত হলো। তবে তার চোখেমুখে তার প্রকাশ পায় না। কিশোরীর ন্যায় দুষ্টু হাসিতে ভেঙে পড়ল সে। মাজহাবকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখে বলল,
-‘কী স্যার? সহ্য হয় না?’
-‘না হয় না। বিয়ে করা বউ বাসর রাতে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে জামাইকে ফেলে। এটা কোন জামাইয়ের সহ্য হবে বলো তো!’ মহুয়ার গালে নাক ঘঁষতে ঘঁষতে প্রত্যুত্তর করে মাজহাব। মহুয়া সরল গলায় বলল,
-‘কই ঘুরে বেড়ালাম? একটু পানি আনতে গেছিলাম, এই তো!’
-‘তোমার পানি আনা হলে আমি কী আমার কাজ শুরু করতে পারি?’ বলে এক চোখ টিপে দেয় মাজহাব। মহুয়া ঠোঁট কামড়ে বলে,
-‘অবশ্যই। তার আগে আমার একটা শর্ত আছে।’
মাজহাবের ভ্রু কুঞ্চিত হলো।
-‘শর্ত? কীসের শর্ত?’ সে মহুয়াকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। মহুয়া মাজহাবের হাত ধরে টেনে বিছানায় বসায়। বলল,
-‘চোখ বন্ধ করো। আমি তোমাকে প্রথম চুমুটা খাবো।’
-‘তাই নাকি? তাতে আমার চোখ বন্ধ করা লাগবে কেন? আমি একটু দেখি.. কীভাবে চুমু খাও তুমি।’
-‘একদম না..চোখ বন্ধ না করলে খাবো না। এই যে, চললাম..’
মহুয়া সত্যি সত্যি যেন চলে যাচ্ছে এমন ভঙ্গিতে পা বাড়ালে মাজহাব তাকে টেনে ধরে। নিজের চোখজোড়া দ্রুত বন্ধ করে বলল,
-‘এই যে বাবা করলাম। শান্তি? নাও, এবার করো যা করার।’
-‘হুম, শান্তি।’ বিড়বিড় করে আওড়ালো মহুয়া। তার ঠোঁটের কোণে ক্রুর হাসি। নিজেও চোখ মুদে বিড়বিড় করে কীসব উচ্চারণ করতে লাগল। একটি শব্দও হলো না। শুধু মহুয়ার ঠোঁট নাড়ানোটাই বোঝা গেল। মাজহাব বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
-‘কই? এতক্ষণ লাগে?’
মহুয়া চোখ খুলে হাসল। পুনরায় চোখ বন্ধ করে মাজহাবের কপালের উপর ফুঁ দিতেই ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে পড়ল মাজহাব। আস্তে আস্তে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। মহুয়া চোখ খুলে মাজহাবকে পরখ করে নিলো। হাত দিয়ে মাজহাবের চোখের উপর আলতো স্পর্শ করতেই মাজহাব কঠিন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। এই ঘুম মহুয়া ছাড়া অন্য কেউ ভাঙাতে পারবে না। মহুয়া শব্দ করে হেসে উঠল এইবার। উঠে দাঁড়িয়ে একটা লাথি মেরে বসল মাজহাবকে। ঘুমন্ত মাজহাব একটুখানি গড়িয়ে গেল ওপাশে। তা দেখে মহুয়ার হাসির দমক বেড়ে গেল। সে চাপা স্বরে স্বগতোক্তি করতে লাগল, ‘আমাকে আদর করতে আসছে! আমাকে! হাহ…’
দরজায় দুটো টোকা পড়তেই মহুয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। গলার স্বর হঠাৎ পরিবর্তন হয়ে আসে তার। কিছুটা ভারিক্কি চালে বলল,
-‘আসো।’
দরজা খুলে রুবার ভীত দৃষ্টি নজরে পড়ল। উঁকিঝুঁকি মেরে মাজহাবকে দেখার চেষ্টা করছে সে। মহুয়া বলল,
-‘মায়া ঘুম ঘুমিয়েছে। আমার আদেশ ছাড়া তাকে উঠানোর সাধ্যি কারো নেই।’
স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে রুবার। হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকেই মহুয়াকে জড়িয়ে ধরল। পরম আবেশে আলিঙ্গন শেষে বলল,
-‘আমি তোমার কাজে অনেক খুশি হয়েছি মহুয়া। আমি জানতাম তুমি পারবে। তাই তো নয়ছয় করে তোমাকেই এই বাড়ির বউ হিসেবে নিয়ে এসেছি।’
মহুয়া গর্বের সঙ্গে হাসে। বলল,
-‘আমি কথা দিয়ে কথা রাখতে জানি। তোমাকে ওয়াদা করেছি না, ‘ব্লাড স্টোন’ হাসিলের জন্য যা যা প্রয়োজন, তাই তাই করব। বিনিময়ে তুমিও তোমার কথা রেখো।’
-‘অবশ্যই, অবশ্যই..’
দূর আকাশে আচানক বিদ্যুৎ চমকে উঠে। মহুয়া, রুবা দু’জনেই সেদিকে চাইলো। ভাববাচ্যে মহুয়া স্বগতোক্তি করে উঠে,
-‘ম্যাক্স.. যদি তুমি জানতে তোমাকে কতটা ভালোবাসি আমি, কতটা কাছে চাই আমি, তবে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে না এভাবে। ধরা দিতে। আমার হতে। নিজের জগত ভুলে আমাকেই আপন করে নিতে। হায় আফসোস, আমার ভালোবাসাকে তুমি অস্বীকার করেছো। আমি নাকি স্বার্থান্বেষী! তোমাকে নয়, তোমাদের ওই ‘ব্লাড স্টোন’ কেই নাকি ভালোবেসেছি। আমাকে র’ক্তাক্ত অবস্থায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলে তোমরা। তুমি, তোমার বাবা-মা, তোমার একমাত্র বোন, তোমাদের গোষ্ঠী… আমি ভুলিনি। আমি ভুলিনি ম্যাক্স। তবুও দেখো, তোমাকে পাওয়ার আশায় আমি আবার এসেছি। আবার.. এবার তো স্বীকার করবে, তোমাকে আমি ঠিক কতটা ভালোবাসি। বলো, করবে না?’
মহুয়ার চোখ ভিঁজে আসে। গলার স্বর ভারী হয়। রুবা মহুয়ার কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় বলল,
-‘করবে মহুয়া। তুমি কেঁদো না। নিজেকে শান্ত করো। জানো না, ধৈর্য্য মানুষকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায়? আমি আড়াইশো বছর যাবত অপেক্ষায় আছি। আড়াইশো বছর!…. আমার পূর্ব মাতা-পিতারা সবাই-ই ‘ব্লাড স্টোন’ হাসিল করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। তাদের কথা স্মরণে রেখেই আমি এগোচ্ছি। আমি যদি ধৈর্য্য রাখতে পারি তবে তুমি কেন পারবে না মহুয়া?’
মহুয়া চোখ মুছে নিলো। রুবার কথায় আশ্বাস মিলেছে। সে ঠোঁটে হাসি ফুঁটিয়ে বলল,
-‘আসল কথা শোনো। মাজহাবের কান ভরে দিয়েছি আমি। এবার শুধু আগামীকালের অপেক্ষা। আগামীকালই লাবণীর সঙ্গে মাজহাবের তালাক হয়ে যাবে। তারপর লাবণীকে দিয়ে আমাদের প্রথম চালটা চালার সময় মাত্র! সবকিছু রেডি আছে তো?’
রুবাও ঠোঁটে হাসি এঁকে বলল,
-‘আছে, সবকিছু রেডি আছে। তুমি শুধু আগুনে ঘি ঢালতে থাকো, বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি।’
★
অন্ধকার যেন হাতঘড়ি দেখতে দেখতে অপেক্ষা করে আজানের মধুন ধ্বনি কখন নিসৃত হবে। যখনই আজান শোনা যায়, তারপর ধীরে ধীরে নিজের তল্পিতল্পা গুছিয়ে রওনা হয় সে। ফুঁটতে থাকে ভোরের আলো। নতুন দিনের সূচনা।
ঘড়ির কাটায় দশটা বেজেছে। ইতিমধ্যেই নাশতার আয়োজন টেবিলে গুছিয়ে দিয়ে দুপুরের রান্নার জোগাড় করতে লেগে পড়েছে লাবণী। মাথাটা বড্ড ভার। রাতের ঘুম ভালো হয়নি। বারবার জেগে উঠেছে। কখনো বা ভয় লেগেছে, কখনো বা মন খারাপ হয়েছে। দীর্ঘদিন পর পুনরায় একা শোয়ার অভ্যাস করতে হবে তাকে! শেষরাতে ঘুম ভাঙলে মনে পড়েছে আলেয়া খাতুনের কথা। উনি থাকতে কত যত্নেই না বড় হয়েছে লাবণী! কখনো পরের মেয়ের চোখে দেখেনি। নিজের মেয়ের মতো সোহাগ করে,ভালোবাসা দিয়ে মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ করেছে সে লাবণীকে। যা চাইলেও কোনোদিন ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।
মহুয়া একটা হালকা গোলাপী রঙের সুতির শাড়ি পরেছে। নিজের ইচ্ছায় নয়, রুবার কথামতো। মাজহাব শাড়ি পরিহিতা মেয়ে খুব পছন্দ করে। প্রথম কয়টা দিন মাজহাবের পছন্দ অনুসারেই চলতে হবে মহুয়াকে। অন্তত লাবণীকে তার জায়গা মতো রেখে আসা পর্যন্ত। তারপর আর মাজহাবের প্রয়োজন নেই কোনো। বাকি কাজটা লাবণীর মাধ্যমেই সম্পন্ন করবে তারা। এমনটিই পরিকল্পনা করে রেখেছে দু’জনে গতকাল মাঝরাত অবধি।
মাজহাব ঘুম থেকে উঠে মহুয়াকে দেখে প্রসন্ন মুখে চাইলো। সেই সঙ্গে একটু খারাপ ও লাগল। গতকাল মহুয়াকে ভালোবাসার রঙে না রাঙিয়েই কেমন ঘোড়ার মতো ঘুমিয়েছে সে! শিট!
মাজহাব বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসল। নরম গলায় ডাকে,
-‘এই মহুয়া।’
মহুয়া খোঁপা করছিল। তৎক্ষনাৎ ঘুরে তাকাল। ঠোঁট ভেঙে বলে উঠল,
-‘কী?’
-‘তুমি আমার রাগ করে আছো,না?’ মাজহাবের সরল গলা। মহুয়া বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করে রইলো।
-‘রাগ করব কেন?আজব!’
-‘না মানে…গতরাত তো সবার জন্যেই স্পেশাল হয়। অথচ আমি হুট করেই ঘুমিয়ে পড়ি। এত ঘুম চলে আসছিল, কী আর বলব! কখন যে ম’রার মতো ঘুম গেছি,নিজেও জানি না।’
মহুয়া মাজহাবের নজর বাঁচিয়ে বিদ্রুপ সমেত হেসে উঠল। গলায় তাচ্ছিল্য নিয়ে বলল,
-‘না না রাগ করিনি। আরও রাত আছে। সময় আছে। এখন উঠো। ফ্রেশ হয়ে নাশতা করবে চলো। আর আজকে তুমি কী করবে,মনে আছে তো? নাকি ভুলে গেছো?’
মাজহাব ধরতে পারে না কথার মানে। ভ্রু কুঁচকে বলল,
-‘কী করব?’
-‘সেকী! ভুলে গেছো তুমি?’ হতাশা মিশ্রিত রাগ রাগ কণ্ঠ মহুয়ার। তার চোখের ভাষা পড়তে পেরে মাজহাব চুপ হয়ে গেল। দায়সারাভাবে বলল,
-‘হুম মনে পড়েছে। আচ্ছা।’ বলে উঠে দাঁড়াল এবং ফ্রেশ হতে চলে গেল। তার যাওয়ার পানে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে রইলো মহুয়া।
টেবিলে খেতে বসেই লাবণীকে ডাকে মহুয়া। মাজহাব নিচু করে বলল,
-‘আগে খাবার টা সেড়ে নেই?’
মহুয়া বাঁধ সাধলো। সে যতদ্রুত সম্ভব এই তালাকটা কার্যকর করতে চায়। লাবণী এলে মাজহাব গম্ভীর হয়ে পড়ে। মহুয়া খেঁকিয়ে উঠে তৎক্ষনাৎ,
-‘কই? বলো না কেন?’
-‘বলছি।’
লাবণীর দিকে তাকাল মাজহাব। অনেকদিন যাবত, উঁহু, অনেক বছর যাবত এই বাড়িতে লাবণীর বসবাস। দীর্ঘদিন ধরে একটা কুকুর থাকলেও তার প্রতি মায়া জন্মে যায়৷ সেখানে লাবণী তো জলজ্যান্ত মানুষ! কেন যেন তাকে তালাক দিতে ইচ্ছে করছে না মাজহাবের। পরক্ষণেই ভাবল, এটা লাবণীর প্রতি অবিচার করা। একে তো লাবণী থাকা সত্ত্বেও আরেকটি মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে, এখন আবার তালাক না দিয়ে লাবণীকে আঁটকে রাখা হচ্ছে! আর লাবণী, সে কী সত্যি সত্যি চলে যেতে চায়? কোথায় যাবে? লাবণীর জীবনেও কী কেউ এসেছে তবে?
পেটের ভেতর কিলবিল করে উঠে শত শত প্রশ্ন মালা। নিজের কৌতূহল দমাতে না পেরে মাজহাব বলে বসল,
-‘তোকে তালাক দিয়ে দিলে তুই এই বাসা থেকে চলে যাবি?’
লাবণীর ক্ষ’ত জায়গায় নতুন আঘাত পড়ল। একটা লোক এতোটা পাষাণ কী করে হতে পারে! লাবণীর জন্য বিন্দুমাত্র দরদ নেই তার মনে? বুক ভারী করা দম গুলো নিঃশ্বাসের সঙ্গে বাইরে বের করে দিয়ে লাবণী শক্ত কণ্ঠে বলল,
-‘দরকার পড়লে যাবো। কেউ না কেউ তো আমাকে নিশ্চয়ই আশ্রয় দিবে।’
মাজহাবের মুখের উপর কালো রঙের ছায়া নেমে আসে। সে এবার পুরোপুরি নিশ্চিত, লাবণীর অন্য কোথাও কিছু একটা আছে। মাজহাবের হুট করেই রাগ রাগ লাগে। অথচ কে লাবণী? কেউ লাগে না তার। তবুও কেন রাগ হচ্ছে? নিজেকে সামলে মাজহাব দৃঢ়তার সঙ্গে বলল,
-‘তৈরি থাকিস। আজকেই তোকে মুক্ত করে দিচ্ছি।’
লাবণীও সমান তেজ নিয়ে জবাব দেয়,
-‘তৈরি আছি।’ তারপর আড়চোখে উপস্থিত তনয়ের দিকে তাকিয়ে ফের বলল, ‘সব রকম বিপদের জন্যেই তৈরি আছি।’
(চলবে)