ভীন_দেশের_গল্প #পর্ব_৫,৬

0
797

#ভীন_দেশের_গল্প
#পর্ব_৫,৬
লেখনীতে- #অলিন্দ্রিয়া_রুহি
০৫

-‘তুমি ওকে কিছু বলেছো?’
তনয়কে আড়ালে ডেকে নিয়ে অকস্মাৎ এহেন প্রশ্ন করায় হকচকিয়ে উঠল তনয়। সে রুবার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। নিরুত্তর তনয়কে দেখে রুবা দাঁত কিড়মিড় করে পুনরায় বলে উঠল,
-‘কথা বলো না কেন? কী বলছো ওকে তুমি?’
তনয়ের বাহুতে মৃদু ধাক্কা দিয়ে উঠে রুবা। তনয় থতমত খায়। তোতলানো কণ্ঠে বলে উঠে,
-‘কী শুরু করছো? কাকে কী বলছি আমি?’
-‘ওহ, না জানার নাটক করা হচ্ছে এখন? কেন, তুমি দেখোনি লাবণী তোমার দিকে চেয়ে কীভাবে বলল, ‘সব রকমের বিপদের জন্যেই তৈরি আছি’। এই কথাটা কেন বলল ও, তাও তোমার দিকেই তাকিয়ে। নিশ্চয়ই তুমি ওকে কিছু বলেছো।’
তময় আমতা-আমতা করে,
-‘দেখো রুবা, সবসময় আমার উপর প্রেশার ক্রিয়েট করতে পারো না তুমি। আমি ওকে কেন কিছু বলতে যাব? আমাকে কী পাগল কুকুরে কামড়েছে?’
তনয়ের বাহু ছেড়ে অস্থির দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকায় রুবা। সন্দিহান কণ্ঠে বলে উঠল,
-‘তাহলে এরকম কথা বলল কেন ও! কী কারণ!’
-‘সেটা আমি কী জানি? হতেও তো পারে ও মাজহাবকেই কথার জবাব দিয়েছে। তুমিই বেশি বেশি ভেবে নিয়েছো।’
চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করে নিজেকে যথাসম্ভব স্থির রাখার চেষ্টা করে তনয়।
তনয়ের কথাগুলো রুবাকে ভাবিয়ে তুললো। সে-ই কী বেশি বেশি ভাবছে তবে? হতে পারে। ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো রুবা। গলার স্বর স্বাভাবিক করে বলল,
-‘যাইহোক, ও যেন কিছু জানতে না পারে। সেদিকে খেয়াল রেখো।’
তনয় ঘাড় দুলিয়ে ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নাড়ে। তার ভেতর থেকে স্বস্তি মিশ্রিত নিঃশ্বাস ছিঁটকে বেরোলো। যাক, তার উপর থেকে হওয়া সন্দেহটা ঘুরে গেছে। একবার যদি রুবা বুঝতে পারতো, তাহলে নির্ঘাত তার ঘাড় মটকে দিতো।

দুপুরের পর পরই হঠাৎ বৃষ্টি বায়ুর তাপমাত্রা কমিয়ে দিয়েছে। এখন বিকেল। আকাশে রোদের বদলে এক ছটাক মেঘের ভেলা উড়ে বেড়াচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে আবারও বৃষ্টি নামবে বোধহয়। লাবণী ছাদে এসেছে কাপড় তুলতে। উড়ন্ত মেঘগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে সে ভাববাচ্যে বলে উঠল,
-‘তোদের কত শান্তিরে! কোনো কষ্ট নেই, ঝামেলা নেই, বাঁধা দেওয়ার কেউ নেই। নিজেদের মতো উড়ে বেড়াস শুধু। আমিও যদি তোদের মতো হতে পারতাম, কতই না ভালো হতো।’

-‘একা একা কী বকবক করিস?’
লাবণী চমকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। রুবা এসে দাঁড়িয়েছে। রুবা বলল,
-‘তোকে ডাকছে। হুজুর এসে গেছে।’
লাবণী ছোট্ট করে জবাব দিলো,
-‘আচ্ছা।’

বাকি কাপড় গুলোও দ্রুত তুলে রুবার সঙ্গে সেও নিচে চলে গেল। মাজহাব একজন হুজুর ডেকে নিয়ে এসেছেন। তার সামনেই ধর্মীয় ভাবে লাবণীর সঙ্গে নিজের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটানো হবে। লাবণী মাথায় কাপড় দিয়ে হুজুরের সামনে এলে হুজুর বললেন,
-‘আপনাকে আপনার স্বামী তালাক দিতে চায়। এতে আপনার মতামত কী? সে কী আপনার উপর অবিচার করছে? তাহলে বলতে পারেন আমাকে।’
লাবণীর ইচ্ছে হয়, চিল্লিয়ে বলার জন্য, ‘অবিচার? আমার জীবনটাই নষ্ট করে দেওয়া যদি অবিচার হয়, তবে ঘোর অবিচারই করছেন উনি।’
কিন্তু ঠোঁট ভেঙে একটি শব্দও উচ্চারণ হয় না লাবণীর। সে শুধু দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে নিচু কণ্ঠে তোতলে বলল,
-‘আ..আমি রাজী।’
এইটুকু শব্দ উচ্চারণ করতে গিয়েও তার বুকটা ভেঙে আসে। স্বামী খারাপ হোক, পাগল হোক, আর যা-ই হোক, তবুও কে চায় বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে? একটি নারী তো কখনোই চায় না। লাবণীও চায়নি। কিন্তু কতদিনই বা মাজহাবের রক্ষিতা হয়ে থাকবে সে?

হুজুর লাবণীর থেকে জবানবন্দি নিয়ে তাকে ভেতরে যেতে বললেন। পাঁচ বছর আগে ‘তিন কবুল’ এর মাধ্যমে লাবণীর জীবনের সঙ্গে মাজহাব যেভাবে যুক্ত হয়েছিল, ঠিক তেমন করেই আজ পাঁচ বছর পর, ‘তিন তালাক’ এর মাধ্যমে মধ্যকার সুতোটা ছিঁড়ে পড়ে গেল। মাজহাবের একেকবার উচ্চারিত ‘তালাক’ যেন গরম শিষার ন্যায় লাবণীর কর্ণকুহরে গিয়ে ঢোকে। দু’হাতে কান চেপে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে নিরব কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। অপরদিকে মাজহাবের ভেতর কোনো ভাবান্তর নেই। সে এক যোগে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করল। অবশেষে দু’জনের জীবন এবং জীবনের পথ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। ক্রুর হাসি ফুঁটে উঠল মহুয়ার ঠোঁটে। সেই সঙ্গে তনয় এবং রুবাও… নিজেদের ঘরে দাঁড়িয়ে উল্লাসে মেতে উঠে তিনজনে। রুবা ফিসফিস করে বলল,
-‘অভিনন্দন মহুয়া, অভিনন্দন। আমরা আমাদের কাজে সফল হয়েছি।’
মহুয়া ঠোঁট বাকায়,
-‘এতোটা খুশির কী আছে? আমাদের আসল কাজ এখনো হয়নি।’
রুবা নিজেকে সামলে নিতে নিতে বলে,
-‘হুম, জানি। তবে তুমি চিন্তা করো না। সেই কাজও দ্রুত হয়ে যাবে। মনে করো, আজই..’

হুজুরকে বিদায় দিয়ে লাবণী যে ঘরে ঢুকেছে, সে ঘরের পাল্লা সরায় মাজহাব। লাবণীকে ফ্লোরে বসে কাঁদতে দেখে মায়ার বদলে এক গুচ্ছ রাগ জেগে উঠে তার ভেতরে। দিকদিশা হারিয়ে সে ছো মেরে খামচে ধরে লাবণীর চুলের গুছি। দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
-‘নাটক! নাটক হচ্ছে এখন? যা.. এক্ষুনি এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা। কোন ভা’তার ধরছোস, তার কাছে যা। এইজন্যেই তো পাগল হয়ে ছিলি।’
অস্পষ্ট ব্যথায় গোঙানি এলেও ঠোঁট টিপে মাজহাবের কথাগুলো শুনতে লাগল লাবণী। সেই সঙ্গে এক রাশ বিস্ময়তা ঘিরে ধরে তাকে। চিড়বিড়ানি রাগটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ল। নিজে চুরি করে অপরকে চোর উপাধি দেওয়া হচ্ছে!
মাজহাবকে ধাক্কা মেরে নিজের থেকে সরিয়ে দেয় লাবণী। আচানক প্রতিবাদে তাল সামলাতে না পেরে পেছনের দরজায় মুখ থুবড়ে পড়ে মাজহাব। সেই সাথে হিংস্র হয়ে উঠল সে। লাবণীর দিকে মুখ ঘুরাতেই এক দলা থুতু তার মুখের উপর ছুঁড়ে দিলো লাবণী। আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে উঠল সে,
-‘তুই নিজে আরেকটা বিয়ে করছোস আমি থাকা সত্ত্বেও। আমি চাইলে তোকে জেলের ভাত খাওয়াতে পারতাম। তা না করে ভদ্র মানুষের মতো সব সহ্য করছি। আর এখন এসে আমাকেই কথা শোনাস! তোর মতো চরিত্রহীন আমি না। তোদের পুরুষ জাতের কপালে জুতা মারি আমি।’ বলে আরেক দলা থুতু ছিটিয়ে দেয় লাবণী।

ততক্ষণে মাজহাবের পুরোপুরি ভার উঠে গেছে। রুবা, মহুয়া, তনয় তিনজনেই চিল্লাচিল্লি শুনে ছুটে আসে। তবে কেউ কাউকে থামালো না। মাজহাব ছুটে গিয়ে ঠাস ঠাস করে বেশ কয়েকটি চ’ড় বসিয়ে দিলো লাবণীর গালে। লাবণী গুমরে উঠে। প্রতিবাদ করতে চায়। মাজহাবকে ঠেলে সরানোর চেষ্টা করতে লাগল। পাশাপাশি পা দিয়ে মাজহাবের পায়ের পাতায় একের পর এক চাপা দিতে লাগল। মাজহাব বিশ্রি ভাষায় গালাগাল করতে করতে বলল,
-‘মা** আজকে তোর রস মিটামু। সবসময় ভেজা বিলাই সাইজা থাকস। আজকে তোর আসল রূপ আমি বের করে ছাড়মু।’
-‘মা** আমি না, যেটারে নিয়ে আসছোস সেটা। এক বউ থাকতে আরেক মাইয়া আসলে সেটারে বলে রক্ষিতা। রক্ষিতা তো ভদ্র শব্দ। এটার আসল অর্থ কী জানোস? পতিতা।’

মহুয়া হুংকার করে উঠল,
-‘মাজহাব!! তুমি থাকতে ও আমাকে পতিতা বলল? তুমি ওর মুখ ভেঙে দিচ্ছো না কেন? দেখছো, এতদিন দুধ দিয়ে কোন কাল সাপ পুষছিলা?’
আগুনে ঘি পড়ল যেন। মাজহাব সত্যি সত্যি ঘুষি মেরে বসে লাবণীর মুখের উপরে। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট কেটে ছড়ে গেল। র’ক্তের ফোয়ারা নামলো। লাবণী হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলো। এর আগে এতোটা হিংস্র, বন্য পশুর ন্যায় মাজহাবকে কখনো দেখেনি সে। দু’দিনের একটা মেয়ের জন্য..! কষ্টে, দুঃখে, রাগে, ক্ষোভে- শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে মাজহাবের মাথার ভেতর বারি মেরে বসে লাবণী।বারি খেয়ে চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে শুরু করল সে। তৎক্ষনাৎ জায়গাতেই বসে পড়ল চিৎকার দিয়ে। লাবণী ঘাবড়ে যায়। মাথা ফেটে দু’ভাগ হয়ে গেল নাকি?
না,মাথা ফাটেনি। তবে তীব্র ব্যথা পেয়েছে মাজহাব। লাবণী শ্বাস নিলো। সবাইকে পাশ কাটিয়ে ঘর থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে যায়। রান্নাঘরের দরজা আঁটকে গুমরে কেঁদে উঠল। বিচ্ছেদের ইতি এত জঘন্য ভাবে না হলেও তো পারতো!

মহুয়া হৈহৈ করে উঠে। তনয়কে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘জলদি ডাক্তার ডাকো তনয়। তোমার ভাইকে ধরো।’
মাজহাব হাত ইশারায় তনয়কে দাঁড়াতে বলে মহুয়াকে বলল,
-‘আমি ঠিক আছি। চিন্তা করো না। তুমি এক্ষুনি ওই মেয়েকে ঘর থেকে বের করো মহুয়া। ও যেন আমার বাসায় আর এক মুহূর্তও না থাকে।’
মহুয়া রুবার দিকে এক পলক চেয়ে বলল,
-‘আমি দেখছি। তুমি আসো তো। রেস্ট নাও একটু। তারপর ওর ব্যবস্থা আমিই করবো। তুমি চিন্তা করো না।’
মাজহাবকে ধরে ধরে বিছানায় শুইয়ে দেয় মহুয়া। নিজে পাশে বসে মাথায় আলতো হাত বুলাতে লাগল। চোখ ইশারায় রুবাকে কিছু একটা বলতেই সে মাথা নত করে বেরিয়ে গেল।

রান্নাঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। দরজার গায়ে চাপড় দিয়ে রুবা ডাকতে লাগল লাবণীকে। কিছু সময় পর দরজা খুলে ফোলা চোখ মুখ নিয়ে লাবণী সামনে দাঁড়াল। তার ঠোঁট অনেকটা কেটে গেছে। র’ক্ত পড়া থামলেও কালশিটে পড়ে গেছে ইতিমধ্যেই। রুবা ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে লাবণীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
-‘মানুষ মানুষের প্রতিদান এত দ্রুত ভুলে যায়, তা আজ মাজহাবকে না দেখলে বুঝতাম নারে। তুই কী কম করছিস এই সংসারের জন্য? তারপরও তোর উপর এতবড় অন্যায় করল। তোকে তালাক দিলো। আবার আজকে মা’রলোও!’
লাবণী ডুকরে উঠে। রুবা লাবণীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-‘কাঁদিস না। শত হোক, একত্রে থেকেছি এতগুলো বছর আমরা। একটু হলেও তো মায়া লাগে নাকি?’
লাবণী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,
-‘আর তার সাথে এক বিছানায় থেকেছি আমি। অথচ তার বিন্দুমাত্র করুণাও হয় না আমার উপর। আমাকে চলে যেতে বলল ভাবী! কোথায় যাবো আমি? আর কে আছে?’
-‘তুই কাঁদিস না। শান্ত হ। আমি আছি তো। কিন্তু এখানে থাকলে তোরই দুঃখ বাড়বেরে। চোখের সামনে মাজহাবকে অন্য নারীর সাথে দেখবি, এটা কী ভালো লাগবে? আর মাজহাবও যে নিত্যদিন ঝামেলা করবে না তারই বা কী গ্যারান্টি। আমি বলি কী, তুই চলেই যা। এতেই তোর ভালো হবে রে লাবণী।’

লাবণী অবাক চোখ মেলে তাকায়। বলল,
-‘কোথায় যাবো আমি? আমাকে আশ্রয় দেওয়ার মতো কেউ তো নেই ভাবী।’
-‘জানি। আমি এর জন্য ব্যবস্থা করেছি। আমার এক চাচা আছেন। বিদেশে লোক পাঠান। তুই চাইলে তার সাথে কথা বলে আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারি। তবে ওখানেও তোকে যেতে হবে কাজের লোক হিসেবেই। ওখানেই থাকবি, খাবি, মাস শেষে মোটা বেতনের টাকা-ও পাবি। যাবি?’
লাবণী কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলো।
রুবা পুনরায় বলল,
-‘তুই ভাবিস না তোকে যেতে হলে টাকাপয়সা দিতে হবে। একদম ফ্রি ভিসায় যেতে পারবি। যারা নিবে তারা-ই তোর টিকিটের টাকা দিয়ে নিবে। তুই শুধু পাসপোর্ট টা বানাবি। আপাতত পাসপোর্ট বানাতে যেটুকু খরচ হবে তা না হয় আমার চাচাকেই দিতে বলব। তুই যখন কামাই করবি, তখন আবার ফিরিয়ে দিস। কী যাবি, বল? কথা বলব চাচার সাথে?’

বাহির থেকে মাজহাবের চিৎকার ভেসে আসে। সে চিল্লিয়ে বলছে, ‘খা** মা** কই? ওরে বাইর করছ আমার ঘর থেকে? ওরে যেন আর চোখের সামনে না দেখি মহুয়া। ওরে পাইলে একদম এক কো’পেই শেষ করে ফেলব।’

চোখ বন্ধ করে লাবণী। মনের ভেতর প্রশ্নের উত্তর হাতড়ে বেড়ায়। পেয়েও যায়। সে চোখ খুলে ঠান্ডা গলায় জবাব দিলো,
-‘যাবো ভাবী। তুমি সব ব্যবস্থা করে দাও।’

(চলবে)

#ভীন_দেশের_গল্প
#পর্ব_৬
লেখনীতে- #অলিন্দ্রিয়া_রুহি

শনিবারের এক সন্ধ্যা। মাঝখানে কেটে গেছে অনেক গুলো দিন। রুবার মাধ্যমে অবশেষে জার্মানি এসে পৌঁছুতে পেরেছে লাবণী। আকাশ সমান বিষন্নতা আর একটা ভাঙা মন নিয়ে লাবণীর পা পড়ল জার্মানের মাটিতে। আশেপাশে অগণিত অপরিচিত মুখ। লাবণী ভীরু চোখে চারপাশ দেখছে। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে ওয়েটিং লঞ্জের দিকে এগোয় সে। এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। অনেক মানুষের সমাগম, অথচ লাবণীর প্রচন্ড একাবোধ হচ্ছে। চোখজোড়া ধীরে ধীরে মেঘবর্ণ ধারণ করছে। যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে যেন! বুকের ভেতর থাকা যন্ত্রটা ধড়াস ধড়াস করে লাফাচ্ছে। একটা প্রশ্ন মাথায় উঁকি দিলো, ‘যদি কেউ না আসে তাকে নিতে? তবে কোথায় যাবে? এখানের ভাষাটাও তো সে জানে না!’
প্রশ্নখানা মাথার ভেতর হুটোপুটি করতে যতক্ষণ, লাবণীর চোখ ভেঙে বৃষ্টি নামতে সময় নিলো না। আশপাশ অগ্রাহ্য করে সে হু’হু করে কেঁদে উঠল।

ঠিক তখনই একটা কালো পাজেরো এসে থামলো লাবণীর সামনে। লাবণী চমকে দুই কদম পিছিয়ে যায়। গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আসে টকটকে ফর্সা বর্ণের একজন সুদর্শন পুরুষ। চোখে রোদচশমা, ওভার কোট পরনে, মাথার চুলগুলো মাঝারি, বাদামী বর্ণের। সবচেয়ে নজর কাড়া জিনিস হলো গালের ডিম্পল। না হাসলেও ভাঁজ হয়ে থাকে। লাবণী মুহূর্তেই কান্না ভুলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। তার মন বলে উঠল, ‘ইনি নিশ্চয়ই কোনো নায়ক হবেন এই দেশের।’ বস্তুত তাকে দেখে এমনটিই ধারণা জন্মাবে প্রথম দেখায়। তবে সে একজন সাধারণ মানুষ ছাড়া আর কিছুই না মূলত! যুবকটি লাবণীর দিকে দৃষ্টি তাক করতেই লাবণী গুটিয়ে গেল। নিজের দৃষ্টি সরিয়ে আঁটসাঁট ভঙ্গিমায় দাঁড়াল। যুবকটি ফোনের গ্যালারি খুঁজে একটি ছবি বের করে লাবণীর সঙ্গে মিলিয়ে শিউর হয়, ইনি-ই সে। যাকে পিক করতেই এসেছে ও।

খানিকটা অবাকও হয় সে। লাবণীর পরনের এই অদ্ভুত পোশাক সে এর আগে কখনো দেখেনি। জিনিসটা কী? কালো গাউন? একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে সে লাবণীর দিকে এগিয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে ধরে বলল,
-‘হ্যালো, ইয়া উন্ড মিস লাবণী?’
-‘জি?’
লাবণীর ঠোঁট ছিটকে বেরিয়ে আসে শব্দটি। পরমুহূর্তেই ঠোঁটে অদৃশ্য সেলোটেপ লাগিয়ে চুপ করে গেল। এই পর্যায়ে এক টানে চোখের রোদচশমা খুলে হাতে নেয় যুবকটি। পূর্বের চেয়েও অধিক বিস্ময়তা ঘিরে ধরল লাবণীকে। টকটকে গাঢ় খয়েরী বর্ণের চোখ এর আগে কখনো দেখেনি। হুট করে দেখলে যে কেউ ভয় পাবে,স্বাভাবিক। তবে লাবণী ভয় বা ঘাবড়ে গেল না। বরঞ্চ তার মনের ভেতর এক দলা কৌতূহল জমলো। অদ্ভুত এই যুবকটি কে? আর তার দিকেই কেন হাত বাড়িয়ে দিয়েছে?

লাবণী বাঙালি। সেই সঙ্গে কম শিক্ষিত একজন মানুষ। এসব তার সিভিতেই দেওয়া হয়েছিল। তার জার্মান ভাষা বোঝার কথা নয়। যুবকটি বলল,
-‘R u miss laboni? I’m max. I m here to pick u. Come inside the car laboni.’
স্পষ্ট অ্যাক্সসেন্টে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করল ম্যাক্স। নিজের পরিচয় দিয়ে লাবণীকে ইশারা করল গাড়ির দিকে। ইংরেজি কথা না বুঝতে পারলেও তাকে যে গাড়িতে বসতে বলা হয়েছে তা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারল লাবণী। আড়ষ্টতা বজায় রেখেই সে এগিয়ে চলল গাড়ির দিকে। লাবণীর থেকে কোনোপ্রকার প্রত্যুত্তর না পেয়ে ম্যাক্স অবাক হয়। অস্পষ্ট স্বরে বিড়বিড় করে বলল,
-‘Strange!’
পরক্ষণেই গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল সে।

পিচঢালা পথের দু’পাশে শারি শারি পাইন গাছ। লাবণীর নিকট অদ্ভুত ঠেকে। এর আগে এরকম গাছ সে কখনো দেখেনি। তারচেয়েও বেশি অদ্ভুত লাগে রাস্তায় কোনোপ্রকার জ্যাম নেই দেখে। আশেপাশে বারবার উশখুশ করে তাকাতে তাকাতে মনের অজান্তেই সে বলে উঠল,
-‘আরে, আপনাদের এখানে জ্যাম হয় না? মানুষ তো তাহলে সত্যি বলে দেখছি। বিদেশি জ্যামই হয় না, কত সুন্দর। আর আমাদের দেশে পাঁচ মিনিট যেতে যেতে জ্যাম লাগে। হুহ!’
প্রাণোচ্ছল কিশোরীর ন্যায় বকবক করতে লাগল লাবণী। তার একটি কথাও বুঝতে পারছে না ম্যাক্স। তবুও লাবণীকে আঁটকালো না। কথা বলতে দিলো নিজের মতো করে। কয়েক সেকেন্ড পর নিজের হুশ ফিরে এলে চুপসে গেল লাবণী। সেই সঙ্গে মেদুর রঙের লজ্জা পেয়ে বসে গাল দুটোতে। ঈষৎ রাঙা হয়ে উঠে সে। চোখ সরিয়ে নিচু কণ্ঠে বলে,
-‘আমিও না পাগল! কেমন বকবক করছি। আপনি কী রাগ করলেন?’
ম্যাক্সের প্রত্যুত্তর নেই। বেচারা তো বোঝেইনি কিছু। সে ড্রাইভ করে চলেছে নিজের মতোন করে। বোকা লাবণী নিশ্চুপ ম্যাক্সকে দেখে ভাবল, তার এই বকবকের জন্য নিশ্চয়ই রাগ করেছে সে। বিদেশের মানুষ অনেক নিয়মকানুন মেনে চলে। বেশি কথা পছন্দ করে না। আর সে প্রথমদিন এসেই বকবক করে চলেছে!
মনে মনে কষে কয়েকটা বকা দিলো নিজেই নিজেকে। আঁড়চোখে ম্যাক্সের দিকে তাকাতেই ম্যাক্স বলে উঠল স্পষ্ট ইংলিশে,
-‘What happened lady? Why you are staring at me?’
পূর্বের ন্যায় এবারও লাবণী কিছুই বুঝতে পারে না। তার ঠোঁট ছিটকে বেরিয়ে এলো,
-‘অ্যাহ!’
জবাব শুনে হাসিতে ভেঙে পড়ল ম্যাক্স। গালের ভাঁজ গভীর হলো। সুন্দর ডিম্পল পড়ে। লাবণী সরু চোখ করে তাকাল।
ম্যাক্স বলছে,
-‘you are so strange and weird, really..I never saw a girl like u laboni.’

ইংরেজিতে ‘Laboni’ উচ্চারণ করলেও বাংলায় তা শোনা গেল অনেকটা ‘ল্যাবণী’ আকারে। যা শুনে ভ্রু কুঁচকে ফেলল লাবণী। পিটপিট করে কয়েকটা পলক ফেলে সে বাচ্চাদের মতো আহত সুর নিয়ে বলে উঠে,
-‘ল্যাবণী কী? আমি লাবণী। লা-বো-ণীইই…বুঝেছেন?’
ঘাড় ঘুরিয়ে নিষ্পলক তাকায় ম্যাক্স। তার চোখের ভাষা-ই বলছে সে কিছুই বোঝেনি। লাবণী মনঃক্ষুণ্ন হলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিড়বিড় করে স্বগতোক্তি করে,
-‘লাবণীরে, তোর কপালে অনেক হ্যাপা আছে। এই ছেলে তো তোর ভাষার কিছুই বোঝে না। আর তুইও তো উনার ভাষার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝিস না। ধুরো!’

-‘are you okay?’ ম্যাক্স বলল। লাবণী বুঝল না তবুও ঘাড় নাড়ায় আনমনে। নিচের ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবতে লাগল। ভাবতে ভাবতে একটা সহজ সমাধান ও পেয়ে গেল। তার চোখজোড়া ঝলমল করে উঠে। বিদ্যুৎ বেগে ম্যাক্সের দিকে ফিরে তাকাল সে। হাত ইশারায় ম্যাক্সকে বোঝালো কিছু একটা। ম্যাক্স বুঝল না। সে কপাল কুঁচকে লাবণীর অদ্ভুত আচরণ পর্যবেক্ষণ করছে। লাবণী হাল ছাড়ল না। পুনরায় কী বলতে চাইছে তা বোঝানোর চেষ্টা চালালে ম্যাক্স বুঝল। একটা বড় ভার মাথার উপর থেকে সরে গেল। লাবণীর ইশারা অনুযায়ী গাড়ির জানালা খুলে দিলো সে। সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে দক্ষিণের আওলা বাতাস তাদেরকে দখলে নিয়ে নেয়। লাবণীর বেশ লাগে। বিশুদ্ধ বাতাস বুক ভরে টেনে নিতে গিয়ে সে উপলব্ধি করল, যে কষ্টটা এতক্ষণ বুক চেপে ছিল, সেটা আস্তে আস্তে হালকা হয়ে আসছে। মন কামড়ে রাখা জঘন্য ব্যথাটা আর নেই। তবে কী মাজহাবের দেওয়া কষ্টগুলো এতদ্রুতই ভুলে গেল লাবণী?

কক্ষনো না। মাজহাব যা করেছে তার জন্য ক্ষমা নয়, শাস্তি প্রয়োজন। সেই শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা লাবণীর না থাকলেও তাকে ক্ষমা করার মতো উদার মানসিকতাও তার নেই। বরং প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে মাজহাবের দেওয়া আঘাত গুলো তাকে শক্ত করে তুলেছে। শক্ত হতে বাধ্য করেছে। মাজহাবকে আর ভালোবাসা দিয়ে নয়, ঘৃণার সহিত মনে করবে লাবণী। মাজহাব তার জীবন থেকে পুরোপুরি ভাবে ডিলিট না হলে তার মন থেকে সম্পূর্ণ রূপে মুছে গেছে। এখন লাবণীর পথ আলাদা। সে পথের লোকগুলোও আলাদা। এদেরকে নিয়েই নতুন ভাবে জীবন সাজানোর চেষ্টা করবে লাবণী। বাকিটা বিধাতার উপর তুলে দিয়েছে সে।

-‘What do you think?’

ম্যাক্স প্রশ্ন ছোঁড়ে। লাবণী বুঝে উঠতে না পেরে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চাইলো। তার চোখের সঙ্গে নিজের চোখজোড়া মিলিয়ে নিয়ে ম্যাক্স ধীরে ধীরে বলে উঠল,
-‘Oh, you can’t speak english, don’t you?’
পুনরায় অসহায় চোখ মেলে চেয়ে রইলো লাবণী। কী বলছে ম্যাক্স? একটি ভাষাও যে বোধগম্য হচ্ছে না তার নিকট! নিজেকে ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে হয়। কেন জীবনে একদমই পড়াশোনা শিখলো না? পরক্ষণেই উত্তর আসে, তার তো পেটে দেওয়ার মতো ভাতই জোটেনি ছোটবেলায়,স্কুল জুটবে কোথা থেকে? বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস লাবণীকে ভাবুক করে তোলে। সে ঘাড় ফিরিয়ে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাল। নিষ্পলক চেয়ে রয় দূর আকাশের পানে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আকাশটা সুবিশাল। মাজহাব এবং সে- দু’জন দু’টি দেশে থাকলেও আছে কিন্তু একই আকাশের নিচে!

-‘You need to learn english as soos as possible. Otherwise it will be difficult to live here.’

আপন মনে বলে চলে ম্যাক্স। লাবণী শুনলো, বোঝার চেষ্টা করল না। দূর আকাশে তাকিয়ে জীবনের লেনাদেনা গুলো হিসেব কষতে বসল। এবং একসময় গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গেল নিজের অজান্তেই।
বাড়ির অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। আর বিশ মিনিট বড়জোর। শহর থেকে বেশ দূরেই থাকে ম্যাক্স এবং তার পরিবার। যদিও তার বাবা-মা ভিন্ন জগতেই থাকে বেশিরভাগ সময়। ম্যাক্স এবং তার জুলিয়া-ই তাদের বাংলো বাড়িতে থেকে আসছে ছোট কাল থেকে। ঘরের কাজগুলো করার জন্য আগে যাকে রাখা হয়েছিল, কিছু কারণে তাকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর থেকেই আরেকজনের খোঁজ লাগায় তারা। এই শহরের প্রায় সবারই একটা অদ্ভুত মিথস্ক্রিয়া রয়েছে তাদের প্রতি। তাদের আলাদা থাকা, একটু নিরিবিলি জায়গায় থাকা এবং অদ্ভুত আচরণ, আশেপাশের সবাইকে আগ্রহী করে তুলেছে। সেই জন্য জার্মান থেকে নয়, অন্য দেশ থেকেই কাউকে কাজের লোক হিসেবে আনার পায়তারা করে এরা। যাতে করে সে কাজের লোক হিসেবেই থাকে এবং এরচেয়ে বেশি একবিন্দু নাক না গলায় তাদের কাজ নিয়ে। তাদেরকে নিয়ে। খুঁজতে খুঁজতে গণ্ডগ্রামের যুবতী মেয়েটিকে মনে ধরে গেলে নিয়ে আসতেও দেড়ি করে না। সেই মেয়েটিই লাবণী। যাকে ওদের ভাষায় ‘ল্যাবণী’ বলে সম্বোধন করা হয়!

গাড়ি থামিয়ে লাবণীকে বার কয়েক ডাকলেও বোকা মেয়ের সাড়া নেই। গত কয়েকদিনের স্ট্রেস, রাত জাগা, অতিরিক্ত টেনশন এবং কান্নার দরুন চোখটা ভালো ভাবেই লেগে এসেছে যেন। একবার জেগে ‘হুঁ, আরেকটু ঘুমাতে দিন’ বলে পুনরায় নিদ্রায় তলিয়ে গেছে লাবণী। তার বলা কথা গুলো ম্যাক্স না বুঝলেও লাবণীর চোখের গভীর ঘুম বুঝতে অসুবিধে হলো না। অগত্যা লাবণীকে টেনে বাহিরে বের করে আনে সে। লাবণী চমকে জেগে উঠে।
-‘কী করছেন, কী করছেন আপনি!’
বলতে বলতেই নিজেকে শূন্যে আবিষ্কার করল সে। ম্যাক্স চোখের পলকে লাবণীকে পাজাকোলে তুলে নিয়েছে। লাবণীর চিৎকার এবার আর্তনাদে বদলে গেল।
-‘নামান, নামান আমাকে। আ..আমি কিন্তু চেঁচাবো। এই ছিল আপনার মনে? এই জন্যেই অন্যদেশ থেকে মেয়ে নিয়ে আসেন যাতে করে কেউ কিছু না জানতে পারে। আর যেমন খুশি তেমন আচরণ করতে পারেন, তাই না? দেখু…’
-‘Shut up lady!! Will you keep quite please?’
জোরেসোরেই ধমক মেরে উঠে ম্যাক্স। নিজের লাল চোখজোড়া আরও লাল হয়ে উঠল। সেই চোখের দৃষ্টিতে দৃষ্টি আঁটকে যায় লাবণীর। একটি শব্দও আর উচ্চারণ করতে পারল না সে। কেমন সম্মোহনের মতো লাগল। মাথার ভেতরটা ঝিমঝিম করে উঠে। নিরবে চোখের কোল ঘেঁষে কয়েকটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here