ভীন_দেশের_গল্প #পর্ব_৭,৮

0
907

#ভীন_দেশের_গল্প
#পর্ব_৭,৮
লেখনীতে- #অলিন্দ্রিয়া_রুহি

কাউচের উপর বসিয়ে দিয়ে ম্যাক্স বিরক্তি নিয়ে গমগমে সুরে বলল,
-‘Why are you crying lady? I took you in my arms with a good understanding. Stop crying, Please! I have no bad intentions.’
লাবণী প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেছে। নিজেকে পেছনে ঠেলে কাউচের সঙ্গে শক্ত গা মিশিয়ে গুটিসুটি আকারে বসল সে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে মাথাটা এদিক ওদিক নাড়তে লাগল। বলল,
-‘আমাকে বাসায় দিয়ে আসুন। আমি বাসায় যাবো। এ…এখানে থাকবো না আমি। আমাকে বাসায় দিয়ে আসুন।’
লাবণীর বলা প্রতিটা কথা ম্যাক্স বোঝার চেষ্টা করলেও ফলাফল শূন্য। অতৃপ্তি নিয়ে সে নিঃশ্বাস ছাড়ল। ঠিক তখনই আরেকটি মুখ উঁকি দিলো উৎসুক ভঙ্গিতে। সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে ম্যাক্সকে উদ্দেশ্য করে ছুঁড়ে দিলো কয়েকটি কথা,
-‘Why is she crying bro?What did you do to her?’
চোখ সরু করে তাকাল জুলিয়া। তার দৃষ্টিতে সন্দেহ। অপরদিকে জুলিয়াকে দেখতে পেয়ে সাহস পেল লাবণী। কাউচের উপর থেকে ছিটকে উঠে দাঁড়াল সে। করুণ চোখমুখ নিয়েই জুলিয়ার পেছনে গিয়ে লুকোলো। ভেজা গলায় বলল,
-‘এই লোকটা.. এই লোকটা অনেক খারাপ। আমাকে একা পেয়ে.. আপনি আমাকে বাসায় দিয়ে আসুন।’
জুলিয়া ভ্রু কুঁচকে লাবণীর দিকে এক পলক তাকাল। তারপর ভাইয়ের দিকে কঠিন দৃষ্টি তাক করে বলল,
-‘Tell me honestly, what did you do to her?’
রাগলে চোখের মণি খয়েরী থেকে লাল বর্ণ ধারণ করে। এ পর্যায়ে ম্যাক্সের চোখের মণি টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে যা থেকে বোঝা যায় সে হেব্বি ক্ষেপে গেছে। যতটা না নিজের বোনের উপর, তার চাইতেও বেশি লাবণীর উপর। এই ঝামেলাটা কেমন ঝামেলা লাগিয়ে দিলো বলো তো! তাছাড়াও ওর আচার আচরণ, ভাষা কোনোকিছুই বুঝতে পারছে না ম্যাক্স। এসব নিয়েই প্রচুর ডিস্টার্ব হয়ে আছে ওর মনটা।

সে ঝাঁঝালো কণ্ঠে পাল্টা উত্তর করল,
-‘I’ll give you a slap julia, stop talking nonsense. I didn’t do anything to her!! And most importantly, I Don’t understand her speech, her language, anything!! If you have a good solution, give it to me, otherwise get lost from here!!’

প্রতিটা শব্দ স্পষ্ট, শুদ্ধ অ্যাকসেন্ট। কান্না আর ভয় ভুলে লাবণী ড্যাবড্যাবে চোখে চেয়ে রয়। কী সুন্দর ভাবে কথা বলে ছেলেটা! লাবণী মনে মনে ভাবল, ‘আমিও যদি এভাবে কথা বলতে পারতাম!’
ততক্ষণে নিচের ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভেবে চলে জুলিয়া। পরক্ষণেই বিদ্যুৎ খেলে গেল মাথার ভেতরে। সে চেঁচিয়ে উঠল উল্লাসে। যার দরুন চমকে উঠে লাবণী। ধ্যান ভঙ্গ হতেই আবারও মনটাকে ছেয়ে ফেলে সূক্ষ্ম ভয়ের জাল। সে আঁটসাঁট ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে রয়।

জুলিয়া বলল,
-‘Bro,I have an idea! Why are we forgetting about mister Dam?’
বাকিটুকু বলতে হলো না। ম্যাক্স সবটা বুঝে নিয়ে স্বস্তি মিশ্রিত শ্বাস ছাড়লো। অবশেষে একটা দারুণ উপায় পাওয়া গেছে!

‘মিঃড্যাম’ একজন পাদ্রী। তবে তাকে সাধারণ পাদ্রী হিসেবে বিবেচনা করলে অনেকটাই ভুল ভাবনা হবে। তিনি এমন একজন যে কীনা সকলের ভূত ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে পারেন। মানুষ, জ্বিন, অথবা আকাশে বসবাসকৃত অন্যসব প্রাণী, আঁধারে লুকিয়ে থাকা র’ক্তচোষা, পানির অতলে গা ঢাকা দিয়ে থাকা মৎস কূল সহ সব বিষয়েই জ্ঞান অর্জন করেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শীতা অর্জন করেছেন দেশ বিদেশ ভ্রমণের কালে। তবে তার মূল কাজ যুগ যুগ ধরে কঠোর নিরাপত্তার সহিত ‘ভ্যাম্পায়ার’ এবং এদের জীবনের মূল বস্তু ‘ব্লাড স্টোন’ কে পাহারা দিয়ে যাওয়া। দিনের আলোয় তিনি সাধাসিধা একজন পাদ্রী হলেও রাতের আঁধারে তিনি নতুন নতুন শক্তি, এসবের উৎস খোঁজ করে চলেন। পেয়ে গেলে তা ছড়িয়ে দেন ভ্যাম্পায়ারদের মাঝে। বর্তমানে ম্যাক্স যে সমস্যায় পড়েছে, তার সমাধান যদি কেউ দিতে পারে তবে তা মিঃ ড্যামই।

লাবণী জুলিয়ার পেছনে তখনো দাঁড়িয়ে। আগামীতে কী হতে চলেছে তা ভাবতে গিয়েই বার বার চোখ ভিজিয়ে ফেলছে বোকা মেয়েটি। ম্যাক্স একবার তার দিকে হাত ইশারায় কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। তাকে মোটামুটি খারাপ মানুষ হিসেবেই ভেবে নিয়েছে লাবণী। এখন ম্যাক্স যা-ই বলবে, সব খারাপ লাগবে। তার চাইতে তাকে একা সময় পার করতে দেওয়া উচিত। এই ভেবে ম্যাক্স জুলিয়াকে বলল,
-‘Stay with her. I’m going to see Mr. Dam.’
-‘Okay bro, Tension not!’
দাঁত কেলিয়ে হাসে জুলিয়া। ম্যাক্স যাওয়ার আগে এক নজর লাবণীর দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকাল। মেয়েটার চোখের রঙ কুচকুচে কালো। আচ্ছা, এই কালো রঙের পেছনে অন্য কোনো কিছু লুকিয়ে নেই তো? ও কী সত্যি সাধারণ কেউ? নাকি ছদ্মবেশী একজন যে বিপদ নিয়ে এসেছে ম্যাক্স ও তার পরিবারের জন্য?
আনমনে চিন্তা গুলো করতে করতে ম্যাক্স পা বাড়ালো বাহিরের উদ্দেশ্যে। সে খেয়ালই করল না, তার গাঢ় চাহনির কাছে অপর চাহনি কঠিন ভাবে আঁটকে গেছে। সে চোখ ফিরিয়ে নিলেও আরেকজন ফেরাতে পারল না। তার চোখেমুখে অবাক বিষ্ময়তা। একজন মানুষের চোখের রঙ ঘন ঘন বদলায় কীভাবে? একটু আগে যেখানে টকটকে লাল বর্ণ দেখেছিল, এখন সেখানটা হালকা বাদামী-লালচে মিশেল। এরকম অদ্ভুত মানুষ আর দুটো দেখেনি লাবণী। ম্যাক্স চলে যেতেই তার নাসিকাপথ ভেদ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে।

বিরাট বড় চার্চ। চারিদিকে বড় মাঠ, মাঝখানে বিল্ডিং। মাঠের ভেতর হাজারও ফুলের সমাহার। ফাঁক রেখে বেঞ্চি পাতাও হয়েছে। আগত মানুষেরা এখানে বসে ব্যস্ত-ক্লান্ত জীবন থেকে কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে যায়। পেছনে রয়েছে লম্বা দীঘি। দীঘির জল সবুজ। সাধারণত সবুজ পানির পুকুরকে ঝিল বলা হলেও একে দীঘিই বলা হয়। যার নাম- ‘Chic lake’। হাঁটতে হাঁটতে চিক লেকের সামনে এসে মিঃ ড্যামকে পেল ম্যাক্স। হাতে তজবি জাতীয় কিছু একটা ঝুলে রয়েছে। সে এক ধ্যানে ঠোঁট নাড়িয়ে কোনো কিছু উচ্চারণ করে যাচ্ছে। ম্যাক্স নিঃশব্দে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই মিঃ ড্যাম চোখ খুলে তাকালেন। লেবু রঙের আবছা চোখ। অথচ প্রখর দৃষ্টি। ম্যাক্সের দিকে না ফিরেই বললেন,
-‘You came after a long time, Max!’
ম্যাক্স লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল,
-‘সরি ফাদার। আমি আসলেই অনেক স্বার্থপর। শুধু দরকার হলেই আসি!’
(ম্যাক্স ইংরেজিতে বলেছে,আমি বাংলা করে লিখলাম। কেননা এখানে অনেক বড় কনভার্সেশন হবে যেটা পুরোপুরি ইংরেজিতে লিখলে অনেকেই বুঝতে পারবে না। তাই ম্যাক্স এবং মিঃ ড্যামের পুরো কথাবার্তা টুকু বাংলাতেই তুলে ধরলাম।)

মিঃ ড্যাম স্মিত হাসলেন। ম্যাক্সের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। স্নেহের সহিত বললেন,
-‘আর তোমাকে সাহায্য করতে আমি অপেক্ষা করে থাকি। বলো, এবার কী জন্য এসেছো।’
-‘খুবই ছোট একটা কারণ মিঃ ড্যাম। আমাদের বাসায় যে নতুন মেয়েটি এসেছে, ওর নাম ল্যাবণী। এখন সে ইংরেজি, জার্মানি কোনোটাই বোঝে না। অপরদিকে আমিও তার ভাষা বাংলা বুঝি না। তাই..’
-‘তুমি চাচ্ছো, বাংলাটা রপ্ত করতে। রাইট?’
ম্যাক্সের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলল মিঃ ড্যাম। ম্যাক্স হেসে বলল,
-‘ইয়েস, রাইট।’
-‘ওকে।’
বলে তিনি হাঁটা লাগালেন। ম্যাক্সকেও সাথে সাথে আসতে বললেন। লম্বা মাঠ পেরিয়ে সাদা বিল্ডিং এ ঢুকে একে একে বত্রিশটি সিড়ি পার করে তিন তলায় উঠল ওরা। বড় লন পেরিয়ে একটা ঘরের সামনে এসে থামলো দু’জনে। মিঃ ড্যাম এদিকে সেদিক তাকিয়ে মানুষের উপস্থিতি বুঝার চেষ্টা করে। কেউ নেই দেখে সে দ্রুত হাতে দরজার তালা খুলে ভেতরে ঢুকল। সঙ্গে ঢুকল ম্যাক্স এবং তৎক্ষনাৎ দরজা বন্ধ করে দিলো। পুরো ঘটনাটি ঘটতে পাঁচ সেকেন্ডের অধিক সময় লাগল না। নিজেদের চতুরতার কথা ভেবে ম্যাক্স অল্প একটু হাসে। তারপর মন দিলো পাদ্রীর দিকে। তিনি একটা বাক্স খুলে ইতিমধ্যেই কিছু একটা বের করে এনেছেন। জিনিসটা দেখতে একটা লম্বা লাঠির মতো তবে কুচকুচে কালো। ম্যাক্সের হঠাৎ মাথা আসে, এই জিনিস লাবণী দেখলে নির্ঘাত ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবে। পরমুহূর্তেই নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হয় সে। হুট করে লাবণীর কথা কেন মনে এলো? কী কারণ এর?
মাথা নেড়ে লাবণীকে বিদায় করে দিলো সে। মনোযোগ দিলো মিঃ ড্যামের দিকে। তিনি চোখ ইশারায় ম্যাক্সকে কাছে ডেকে বললেন,
-‘এটা ধরো।’
ম্যাক্স বিনাবাক্য ব্যয়ে আদেশ পালন করে।
মিঃ ড্যাম চোখ মুদে কিছু একটা বিড়বিড় করে পড়তে লাগলেন। মন্ত্রের তাল শুনে ম্যাক্সও নিজের আঁখিদ্বয় বন্ধ করে নিলো। তার শরীর ভেতর ইতিমধ্যেই আলোড়ন তৈরি হয়েছে। কেমন যেন ঝিমঝিম করছে সবকিছু। ২-৩ মিনিট এভাবেই পার হলো। মিঃ ড্যাম চোখ খুলে একটা বড় ফুঁ ম্যাক্সের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে গর্বের সঙ্গে বললেন,
-‘কাজ শেষ।’
-‘শেষ?’ চোখ খুলে উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল ম্যাক্স।
-‘হ্যাঁ শেষ। আশা করি, ওই মেয়েটির সব কথা-ই আপনি বুঝতে পারবেন এখন থেকে রাজকুমার।’
বলতে বলতে হাতের লাঠিটি বাক্সে ভরে তালা মারলেন মিঃ ড্যাম। তারপর ম্যাক্সকে নিয়ে ওই রুম থেকে বেরিয়ে এসে দরজাতেও তালা ঝোলালেন।
ম্যাক্স অবিশ্বাস্য সুরে বলল,
-‘আপনার কত দক্ষতা! আসলে আমি সময় পাচ্ছি না। নইলে আপনার কাছে এসে কিছু জ্ঞানার্জন করতাম।’
মিঃ ড্যাম বললেন,
-‘এ যে আমার পরম সৌভাগ্য রাজকুমার। তবে আপনাকে আপাতত ‘ব্লাড স্টোন’ এর উপরেই নজর দেওয়া উচিত। আপনি জানেন কী, নতুন ভাবে একটি চক্র আবির্ভূত হচ্ছে। আমি আমার ধ্যানে তা উপলব্ধি করতে পেরেছি। যদিও জানি না তারা কারা।’
ম্যাক্সকে চিন্তিত দেখালো।
-‘আমি বুঝি না কেন আমাদের শান্তি নষ্ট করতে নিত্যনতুন শত্রুর আবির্ভাব হয়! ছোট থেকেই দেখে আসছি এ লড়াই। বাবা-মা, আমার দাদা-দাদী এবং তারও আগের রাজা-রাণীরা কম চেষ্টা করেনি ‘ব্লাড স্টোন’ রক্ষার জন্য। আমার দাদা-ই তো মৃ’ত্যুবরণ করেছেন এর জন্য।’
-‘ব্লাড স্টোন’ কী এবং এর মর্যাদা কতটুকু তা আমরা জানি। দুঃখের বিষয় হলো এটা আমাদের শত্রুরাও জানে। তাই তো প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রাণের আবির্ভাব হচ্ছে।’
-‘আপনি চিন্তা করবেন না মিঃ ড্যাম। যে বা যারা-ই এসেছে এতকাল যাবত, সবাইকে মৃ’ত্যু উপহার দেওয়া হয়েছে। এরপরও যারা আসবে, তাদের জন্যেও মৃ’ত্যু উপহার হিসেবে থাকবে। তবে এবারের মৃ’ত্যু টা হবে পূর্বের তুলনায় আরও কঠোর, ভয়ানক। আমি চাই, এদের জীবন নাশের ঘটনা শুনে আর কোনো প্রাণী যেন ‘ব্লাড স্টোন’ এর দিকে হাত বাড়াতে সাহস না করুক।’
দৃঢ় চিত্তে বলে উঠে ম্যাক্স। মিঃ ড্যাম ম্যাক্সের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
-‘আমাদের ভবিষ্যত রাজা হিসেবে আপনিই যোগ্য। রাজ বংশের প্রতিটি র’ক্ত তাদের রাজা হওয়ার যোগ্যতাকে প্রমাণ করেছে। আপনিও করবেন অচিরেই..’
মিঃ ড্যামের হাতের পিঠে শ্রদ্ধার চুমু খেয়ে ম্যাক্স বিদায় নিলো।

তমসাচ্ছন্ন রজনী। তাপমাত্রা কমে ষোলোতে নেমে এসেছে। জার্মানে বসবাসকৃত সবার জন্য এই ঠান্ডা কিছু না হলেও ভিম দেশ থেকে আসা লাবণীর নিকট এটা হু’হু করে কাঁপবার মতো যথেষ্ট ঠান্ডা! সে ঘুমিয়ে গেছিল। ঘুমের ভেতরই হাত-পা কুঁচকে, চোখ খিঁচে কাঁপতে লাগল।

নিজের ঘরে যাওয়ার সময় কেন যেন একবার লাবণীর ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখল ম্যাক্স। খেয়াল করল মেয়েটার গায়ে ব্ল্যাংকেট নেই। ও কাঁপছে। বিড়বিড় করে ‘রিডিকিউলাস’ বলে ভেতরে পা রাখে ম্যাক্স। অনেকটা বিরক্তির সহিত কাবার্ড থেকে মোটা কম্বল বের করে লাবণীর গায়ের উপর ছড়িয়ে দিলো। ওম পেয়ে আরামে গাঢ় ঘুম আরও গাঢ় হয়। কম্বলটা টেনে গলার তলায় কুঁচকে নিয়ে আবেশে আরেকটু তলিয়ে গেল লাবণী। এতক্ষণ কপালে যে ভাঁজ পড়ে ছিল, তা মসৃণ হয়ে এলো এইবার। নিজের অজান্তেই ম্যাক্স হেসে উঠে নিঃশব্দে। মেয়েটা একটু আধটু না, পুরোপুরি অদ্ভুত!
নিচু হয়ে কম্বলটা গলার থেকে টেনে নিয়ে মাথা এবং কানও ঢেকে দিলো ম্যাক্স। পায়ের পাতা ঢেকে দিয়ে ঘরের আগুনটা বাড়িয়ে দিলো।

নিস্তব্ধ রজনী। কোথাও কোনো শব্দ নেই। ক্ষণে ক্ষণে কানে এসে লাগে ঘড়ির টিকটিক শব্দটাই। রুম ছাড়ার আগ মুহূর্তে জানলার দিকে চোখ চলে যায় তার। জানলাটা হাট করে খোলা। ম্যাক্স আবার বিরক্ত হলো। ঘুমানোর আগে লাগিয়ে শোবে না! এইজন্যেই তো ঘরটা এতো ঠান্ডা হয়ে আছে!
বিরক্তি মনে চাপিয়ে জানালার দিকে এগোয় সে। ভারী পাল্লাটা টানতে গিয়ে একটা গন্ধ নাকে এসে লাগল তার। আগ্রহী হয়ে উঠল মন। উত্তেজিত ভঙ্গিমায় নিকষ কালো আঁধারেই চোখ বুলাতে লাগল। গন্ধটা র’ক্তের, তাজা র’ক্ত। খাওয়ার জন্য ঠোঁটে পানি চলে এসেছে। ম্যাক্স খেয়াল করল, গন্ধটা দূর থেকে আসছে। যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে। ম্যাক্স সিদ্ধান্ত নিলো, এখান থেকেই জাম্প করে বাহিরে বেরোবে। র’ক্তটা যারই হোক, এত তাজা র’ক্ত হাতছাড়া করা উচিত হবে না।

(চলবে)

[জি হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। ম্যাক্স এবং তার পরিবার ভ্যাম্পায়ার অর্থাৎ র’ক্তচোষা।]

#ভীন_দেশের_গল্প
#পর্ব_৮
লেখনীতে- #অলিন্দ্রিয়া_রুহি

-‘আপনি এখানে কী করছেন?’

তীক্ষ্ণ প্রশ্নবাণ, ম্যাক্সের মনোযোগ পুরোপুরি ভাবে ছিন্ন করে দিলো। কিছুটা চমকেই সে পেছন ঘুরে দেখল, লাবণী জেগে উঠেছে। এবং তারচেয়েও অদ্ভুত ব্যাপার, লাবণীর করা প্রশ্নটি সে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে। এমনকি এই প্রশ্নের উত্তরে কী বলা প্রয়োজন, তা-ও তার মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে মনে মিঃ ড্যামের প্রতি আরও একবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ম্যাক্স।
নিজে কী করছিল তা লুকিয়ে সে বলল,
-‘কী আর করব? জানালা খোলা ছিল। আঁটকাচ্ছিলাম।’
বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলো লাবণী। তার চোখজোড়া এতবড় হলো যেন কোটর থেকে এক্ষুনি জাম্প করে বেরিয়ে আসবে। তার হতবাক চোখমুখ ম্যাক্সের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটিয়ে তোলে। ম্যাক্স নিজে থেকেই বলল,
-‘কী আর করব বলো। তুমি জার্মানি ভাষাও জানো না,বাংলাও জানো না। তাই বাধ্য হয়ে আমাকেই বাংলা শিখতে হলো। কথাবার্তা তো বলতে হবে,নাকি?’
-‘তাই বলে এত দ্রুত? এত স্পষ্ট?’
নিজের অবাকতা মোটেও লুকোনোর চেষ্টা করল না লাবণী। ম্যাক্সের কথা শুনেও নিজেকে ধাতস্থ করতে পারল না সে। লাবণীর মনে কী চলছে তা স্পষ্ট বুঝতে পেরে কিছুটা চিন্তিত হয়ে উঠে ম্যাক্স। আসলেই তো! এভাবে ভেবে দেখা হয়নি। এত দ্রুত এত শুদ্ধ ভাবে ভাষা শেখা টা কারো কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হবে না। লাবণীর কাছেও হচ্ছে না স্বাভাবিক।
ম্যাক্স কয়েক সেকেন্ড গম্ভীর থেকে বলে উঠল,
-‘তুমি কী ভাবছো? আমি বাংলা আজকেই শিখলাম? আসলে না। আমি অনেক আগে থেকেই পারি। আমাদের এখানে আগে যে মেইড ছিল,সেও বাংলাদেশী ছিল। তার থেকেই শেখা মূলত। আমি বুঝতে পারিনি তুমি একদম ইংলিশ পারো না। বাংলা বলতে অস্বস্তি হয় আমার। আর এমনিতেও সবসময় ইংলিশ নয়তো জার্মান ভাষায় কথা বলি তাই এটাতেই অভ্যাস বেশি। বাধ্য হয়ে তোমার সাথে বাংলা ভাষায় কথা বলতে হচ্ছে।’

ম্যাক্স সরু চোখ করে তাকাল। লাবণীর বিশ্বাস হয়েছে কীনা এই কথাগুলো কে জানে। কিন্তু সে বোঝার চেষ্টা করল। লাবণীর চোখমুখ দেখে বুঝতে না পারলেও নিজের দৃষ্টি সরিয়ে সে তৎক্ষনাৎ বলল,
-‘তুমি জেগে গেলে যে? ঠান্ডা লাগছে?’
ঠোঁটের অদৃশ্য সেলোটেপ সরিয়ে মুখ খুললো লাবণী,
-‘ঘুম ভেঙে গেল।’
-‘আচ্ছা! ঘুমাও তাহলে। আমি যাই।’
ম্যাক্স জানালা আঁটকে দিলো। আঁটকানোর সময় লাবণীর চোখ এড়িয়ে বার কয়েক গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করে। কিন্তু অদ্ভুত, এখন আর কোনোপ্রকার গন্ধ পেল না। অথচ একটু আগেই বাতাসে তাজা র’ক্তের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছিল! অস্থির মন নিয়ে ম্যাক্স জানালা আঁটকে দেয়। লাবণীর দিকে চেয়ে ফের বলল,
-‘দরজা লাগানোর প্রয়োজন নেই। এই বাসায় আমি, জুলিয়া আর তুমি বাদে আর কেউ নেই। তাই কেউই আসবে না তোমার ঘরে। আর কাবার্ডে এক্সট্রা কম্বল আছে। প্রয়োজন পড়লে নিও। আগুনে হাত দিও না। আমি যেভাবে সেট করে দিছি তাতে ভোর রাত পর্যন্ত জ্বলতে থাকবে। এতে যথেষ্ট গরম হবে তোমার ঘরটা। সকাল সকাল উঠার দরকার নেই। আমরা অনেক লেট করেই উঠি সবাই। সো তুমি তোমার সময় মতো উঠে যেও। আর শোনো, আমরা কেউ ভারী খাবার খাই না। আমি যতদূর জানি, বাংলাদেশীরা সকাল-বিকাল,ভারী খাবার খেয়েই অভ্যস্ত। তোমার নিজের জন্য যেটা ভালো লাগে বানিয়ে নিও। কিন্তু আমাদের দু’ভাই-বোনের জন্য লাইট কিছু তৈরি করো। এইতো… বাকিটা আগামীকাল জুলিয়াই তোমাকে বলে দেবে। আপাতত এইটুকুই… গুড নাইট।’

লাবণীর হঠাৎ মনে হলো, অনেক বছর পর এতোটা কেয়ার নিয়ে কেউ তার কথা চিন্তা করল! সে কীভাবে ঘুমাবে, তার ঘরের জানালা খোলা, আগুন কতটা আছে, শীত করছে কীনা- কই, মাজহাব তো কখনো ফিরেও তাকায়নি! লাবণীর মন হুট করে বিষন্নতায় ছেয়ে গেল। নিশ্চুপ লাবণীকে দেখে ম্যাক্স ভ্রু কুঁচকালো। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও আবার থেমে দাঁড়াল। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে যাওয়ার ভাব করে বলল,
-‘আর হ্যাঁ, তুমি আমাকে প্রথমেই নেগেটিভ ভাবে নিয়ে নিয়েছো। বাট বিলিভ মী, আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই। আমাদের এখানে এসব একদমই নর্মাল! হয়তো তোমার কালচারটা আলাদা। তাই আমি যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখবো এরপর থেকে। ডোন্ট ওরি, আমার তরফ থেকে কোনোপ্রকার ঝামেলা পাবে না। বি ইজি। নিজের বাড়ি মনে করেই থেকো। ও, হ্যাঁ, একটা কথা লাবণী, আমাকে একটা ব্যাংক একাউন্ট দিও। তোমার ফ্যামিলিতে টাকা পাঠাবো কোন একাউন্টে, সেটা। নাকি তুমি তোমার বেতনটা নিজের কাছে রাখবে?’

লাবণী ছোট্ট করে বলল,
-‘দেশে আমার আর কেউ নেই।’
একটু থেমে পুনরায় বলল,
-‘কোনো পিছুটানও নেই।’
ম্যাক্স নিরব রইলো। একবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো, বাবা-মা, অথবা ভাই-বোন, কেউ কী নেই? কিন্তু লাবণীর চোখমুখ দেখে আর প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হলো না। সে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,
-‘দেখো, তোমার ঘুমের ভেতর ডিস্টার্ব করলাম আমি এসে! আচ্ছা তুমি ঘুমাও। আমি চললাম।’
ম্যাক্স বেরিয়ে এলো। দরজা ভিড়িয়ে দিলো লাবণী। তারপর চুপচাপ বিছানায় বসে গায়ে কম্বল টা টেনে নিলো। ঘুম এলো না তবে নানান চিন্তারা মাথায় ঘুরপাক করতে লাগল। প্রথমে এসে যতটা ভয় পেয়েছিল সে, তা অনেকাংশেই কমে গেছে এই মুহূর্তে। ম্যাক্সের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করে মনে হয়েছে, লোকটা অদ্ভুত হলেও ভালো। অত্যন্ত এখানে নিরাপদ লাবণী। শুধু একটাই আজব জিনিস, এত সুন্দর ভাবে বাংলা বলতে পারে কীভাবে সে! আর পারলেও কেন আগে বলল না?
লাবণী শত ভেবেও এর কোনো উত্তর অথবা অনুমান বের করতে পারল না।

গা হিম করা বাতাস ছেড়েছে। গায়ে ওভার কোটটা জড়িয়ে ম্যাক্স বাড়ির লনে পা রাখে। লাবণীর ঘরের জানালা বরাবর জায়গাটায় গিয়ে বারকয়েক চোখ বুলালো। আশেপাশে খোঁজার চেষ্টা করে কিছু একটা। কিছুই পেল না। র’ক্তের গন্ধ পুরোপুরি গায়েব। মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই! ম্যাক্সের কাছে অদ্ভুত লাগল ঘটনাটা। নিচ থেকে লাবণীর ঘরের জানালায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সে। পরমুহূর্তেই চোখ সরিয়ে নিলো। নিচের ঠোঁট কামড়ে আনমনে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে পুনরায় বাড়িতে ঢুকল ম্যাক্স।

-‘What are you doing here bro?’
জুলিয়া নিচে নেমে এসেছে। প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় ভাইয়ের দিকে। ম্যাক্স দরজা আঁটকে গা থেকে ওভার কোটটা খুলতে খুলতে বলল,
-‘Nothing. Anyway, you didn’t’ sleep yet?’
-‘No brother, i feel strange, don’t know why. I feel like something is wrong. something is going to happen to us!’
জুলিয়ার নিচু কণ্ঠ। পাছে লাবণী শুনে না ফেলে!
ম্যাক্স বুঝল, জুলিয়ার থেকে কোনো কিছু লুকিয়ে লাভ নেই। তারচেয়ে বরং তাকে সবকিছু খোলাসা করে বলা ভালো। এতে করে জুলিয়াও প্রস্তুত থাকবে আগাম বিপদের।

ম্যাক্স বলল,
-‘Come with me.’

জুলিয়াকে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকল ম্যাক্স। দরজাটা আঁটকে দিয়ে জুলিয়াকে বলল,
(এখানে ম্যাক্স এবং জুলিয়ার সমস্ত কথাবার্তা টুকু আমি বাংলায় রূপান্তর করছি। জুলিয়া বাংলা জানে না, ম্যাক্স জানে। তারা ইংরেজিতে কথা বলছে কিন্তু আমি সেটাকে বাংলা আকারে লিখলাম যেন সবার বুঝতে সুবিধে হয়।)

-‘জুলিয়া, আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে এবং বাবা-মাকেও খবর দিতে হবে তারা যেন এখানে আসেন।’
এতটুকু শুনেই জুলিয়ার চোখেমুখে উৎকণ্ঠা জমে উঠে। সে চিন্তিত গলায় বলল,
-‘কেন ভাইয়া? কী হইছে?’
-‘ব্লাড স্টোন’ এর পেছনে আবারও শত্রু লেগেছে। তারা কারা তা সম্পর্কে আমাকে অবগত করেননি মিঃ ড্যাম। তবে বলেছে আমরা যেন তৈরি থাকি। যেকোনো মুহূর্তে কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, এবারের শত্রুরা পূর্বের তুলনায় আরও শক্তিশালী হবে।’
জুলিয়া প্রায় কেঁদে ফেলবে যেন। তার চোখেমুখে নিদারুণ উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ।
ম্যাক্স জুলিয়ার কাঁধে হাত রেখে তাকে আশ্বস্ত করে বলল,
-‘ভয় পাইস না। আমরা সবাই মিলে একটা না একটা উপায় বের করবোই। কিন্তু সবার আগে আমাদের প্রয়োজন, বাবা-মাকে এই বিষয়ে জানানো। ‘ব্লাড স্টোন’ এর চারপাশের নিরাপত্তা বেষ্টনী আরও মজবুত করা।’

জুলিয়া নিজেকে সামলালো।
-‘হুম। তাই করো ভাইয়া। তুমি তাহলে আজকেই চলে যাও বাবা-মায়ের কাছে। আর এদিকটা আমি সামলে নিচ্ছি, তুমি চিন্তা করবে না একদম।’
-‘রাতের আঁধারেই বেরিয়ে পড়তে হবে আমাকে।’
জুলিয়া আলিঙ্গন করে ম্যাক্সকে। ম্যাক্স জুলিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-‘ভয় পাবি না। তুই রাজ বংশের একমাত্র কন্যা! তোকে ভয় পাওয়া মানায় না। সাবধানে থাকিস। অপরিচিত কাউকে ধারেকাছে ভিড়তে দিস না। আমরা জানি না, আমাদের শত্রু কারা। তাই আমাদেরকে অনেক অনেক সাবধানেই থাকতে হবে।’
হুট করে কিছু একটা মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে জুলিয়া বলে উঠল,
-‘ভাইয়া, লাবণী?’
ম্যাক্স নিশ্চুপ থাকে কয়েক সেকেন্ড।
ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভেবে বলল,
-‘মিঃ ড্যামকে বলব, ওর আসল পরিচয়টা বের করতে। ও কে, সত্যিই কী সাধারণ একজন মানুষ নাকি ও-ই আমাদের শত্রু! জানা নেই। ওর থেকেও সাবধানে থাকিস জুলিয়া। আমি দ্রুত ফিরবো। খুব দ্রুত…’

জানালার কপাট বাতাসের দাপটে দু’দিকে বারি খায়। লম্বা জানালা দিয়ে হু’হু করে শরীর-মন কাঁপানো বাতাস ঢুকছে হুড়মুড় করে। জুলিয়া দাঁতে ঠকঠক করে চেয়ে আছে দূরে… তার ভাই ছুটে যাচ্ছে আঁধারের মাঝে। আঁধারে হারাতে…
তারপর একসময় দৃষ্টি সীমানা থেকে হারিয়ে যাওয়ার পর জানালা আঁটকে বড় পর্দা ছেড়ে দিলো সে। মোমবাতির আলোয় ঝলমল করতে থাকা ঘরটাতে চোখ বুলিয়ে দেখল। বুক দুরুদুরু কাঁপছে তার। প্রচন্ড ভয় লাগছে। সে তড়িঘড়ি করে লাবণীর ঘরের উদ্দেশ্যে হাঁটা লাগালো।

লাবণী জেগেই ছিল। দরজায় শব্দ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল জুলিয়া এসেছে।
লাবণী নড়েচড়ে উঠে বসে। জুলিয়া লাবণীর দৃষ্টি উপেক্ষা করে কাবার্ড থেকে একটা পাতলা ব্ল্যাংকেট বের করে নিজের গায়ে জড়ায়। তারপর শুয়ে পড়ে বিছানার সোজাসুজি বরাবর লম্বা সোফাটায়। লাবণী কতক্ষণ বসে রইলো একই ভাবে। পরে বুঝতে পারল, জুলিয়া এই ঘরে ঘুমাবে তাই এসেছে। লাবণী একবার বলতে চাইলো, ‘আপনি খাটে ঘুমান, আমি ওখানে যাচ্ছি।’
কিন্তু পরমুহূর্তে আর বলে উঠল না। নিজেও চুপ করে শুয়ে পড়ল। দ্রুতই ঘুম চলে এলো লাবণীর চোখে। এতক্ষণ একলা অচেনা জায়গায় থাকার জন্য যে ভয় ভয় ভাবটা হচ্ছিল, তা এই মুহূর্তে কেটে গেছে জুলিয়ার আগমনে। খুব গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল লাবণী।

নতুন দেশে প্রথম ভোর হলো লাবণীর। কিন্তু ভোর সকালের চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য সে উপলব্ধি করতে পারল না। লাবণী যখন ঘুম থেকে জেগে উঠল তখন বেলা এগারোটা। বিছানার সাইডে একটা টেবিল ঘড়ি রয়েছে। লম্বা কাঠিটা ঠিক এগারোটায় আঁটকে আছে দেখে লাবণী আঁতকে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ চলে যায় সোফাটায়। জুলিয়া নেই! লাবণী বিদ্যুৎ বেগে বিছানা ছাড়ল। আলুথালু চুলগুলো পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে কোনোরকমে আঁটকে সে বেরিয়ে আসে ঘর ছেড়ে। তরতর করে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। ডায়নিং স্পেসে কেউ নেই। রান্নাঘর ঘুরে এসেও কাউকে পেল না লাবণী। তার সন্দেহ হলো, সে বাসায় একা নয়তো?
সন্দেহ থেকেই ঢোক চেপে মনে সাহস সঞ্চয় করে পুরো বাড়িটা একবার চক্কর দেয় লাবণী। কাউকে না পেয়ে তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। বুকের ছাতি পানির তৃষ্ণায় ফেটে যাবার জোগাড়। ম্যাক্স,জুলিয়া,কোথায় সবাই? কেউ কেন তাকে ডাকল না সকাল বেলা? আর যদি বাহিরে গিয়ে থাকে তবে কেন কেউ অন্তত বলে গেল না! লাবণীর হুট করেই কান্না পেয়ে বসে। অসহায় মুখ করে সে এসে বসল ডায়নিং স্পেসের সোফায়। দু’হাত দু’গালে চেপে ধরে সে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগল নিরবে। এ কোন অদ্ভুত বাড়িতে এসে পড়েছে সে কে জানে! কারো কোনো খোঁজ পাত্তা থাকে না৷ একেকজন একেক রকম। আর সবচেয়ে অদ্ভুত ওই লোকটি…কী যেন নাম? লাবণী বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে, ‘ম্যাক্স’। এর কথাবার্তা, আচার আচরণ সবকিছুতে অদ্ভুত রহস্যময়তা। বিশেষত তার চোখ, ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায় যেন!

কোথা থেকে এক দলা বাতাস আসে আচমকা। লাবণীর চুল উড়িয়ে দিয়ে যায়। সে চোখের পাতা বন্ধ করে ফেলে বাতাসের তীব্রতায়। যখন খুললো, মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের পাতা পর্যন্ত, সবকিছু চমকে উঠে। এ কে? কাকে দেখছে? এটা মানুষ… নাকি?
কিছু বুঝে উঠার আগেই লম্বা একজোড়া হাত এগিয়ে আসে। লাবণী চিল্লানোর জন্য মুখ খুলতেই একটা ফুঁ উড়ে এসে পড়ল তার গায়ের উপরে। সঙ্গে সঙ্গে অচেতন হয়ে ঘুমের ভেতর ঢলে পড়ে সে। ঢলে পড়ে আগন্তুকের গায়ের উপর। আগন্তুক হাসলো।
এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করল তবে!

ম্যাক্স যখন পৌঁছালো তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে। এক আঁধারে বেরিয়ে গেছিল, আরেক আঁধারে ফিরলো। ক্লান্ত বিধ্বস্ত ম্যাক্স ঘর্মাক্ত মুখখানা নিয়ে বার কয়েক কলিং বেল টেপার পরও কেউ কোনো সাড়াশব্দ করছে না দেখে অবাক না হয়ে পারল না। বাতাসে কিছু একটার গন্ধ। নাক কুঁচকে শোঁকার চেষ্টা করল। পেয়েও গেল। তীব্র ধাক্কায় মোটা কাঠের দরজার পাল্লা নড়বড়ে হয়ে গেল। ম্যাক্স ঘরে ঢুকেই চিৎকার করে ডাকলো,
-‘জুলিয়া…জুলিয়া!!! লাবণী?’
কেউ নেই, কেউ নেই!
পাগলের মতো হয়ে উঠল ম্যাক্স। যে চিন্তারা এতক্ষণ যাবত তার পিছু তাড়া করে বেড়াচ্ছিল, এখন সেটাই সত্যি হলো। নিয়ে গেছে। ওদের নিয়ে গেছে তারা! ওরা আবার এসেছে। আবার ফিরে এসেছে!
ম্যাক্স সোফার উপর ধপ করে বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলে। লাবণীকেও ছাড়ল না! লাবণীকে ওদেরই একজন ভেবে নিয়ে গেছে। নাহ…এবার কী করবে ম্যাক্স?
একটা পাতা ফড়ফড় করে উড়ছে। কিঞ্চিৎ শব্দ তৈরি হয় তাতে। ম্যাক্স দ্রুততার সঙ্গে কাগজের পাতাটা তুলে নিলো হাতে। তাতে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা,
‘Welcome us Max! Remember me?
—–S. Sherlock’

(চলবে)
[প্রতি পর্বে টুকরো টুকরো রহস্য থাকবে। যা জানার জন্য শেষ অবধি পাশে থাকতে হবে।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here