ভালোবাসা
৯ম_পর্ব
#মৌসুমি_চৌধুরী
বাড়ি ফিরে আসতেই মা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আমাদের খাওয়ার জোগাড় নিয়ে। মা’র ধারণা হোটেলে হোটেলে কি না কি খেয়েছি, ঠিকভাবে পেটপুরে খেতে পাইনি বোধহয়। আমরা তো হেসেই খুন মা’র কাজকারবার দেখে। শুধু দাদাকেই দেখলাম যেন সোনামুখ করে মা যা দিচ্ছেন তাই খেয়ে নিচ্ছে। আবার বিলেত চলে যাবে তাই হয়তো একটু বেশিই ইমোশনাল হয়ে পড়েছে। মায়ের হাতের রান্না আর কবে জোটে কে জানে…
অরুকে দেখলাম দাদার প্যাকিং নিয়ে খুব ব্যস্ত। ফিরে আসার পর থেকে যেন আর সময়ই নেই তার আমার সাথে দুটো কথা বলবার। পরশু বিকেলে দাদার ফ্লাইট, কাল থেকে ক্লাস শুরু তাই বোধহয় আজই যা যা করার সব গুছিয়ে নিচ্ছে। আমিও কিছুটা হাত লাগাতে চাইলাম যদি কোন দরকার পড়ে তাই। দাদার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটার দায়িত্বটা নিয়ে নিলাম।
ক্লাস শুরু হয়ে গেছে তাই রোজ দুজনে একসাথে যাই। শুধু যাই আর আসি এই যা…ক্লাসের সময়টায় অরু ভীষণ মনোযোগী আর বিয়ের পর থেকে যা পড়ালেখার ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে যেন এক মূহুর্ত ও দম ফেলার সময় থাকেনা তার। পাশাপাশি বসে মাঝেমাঝে তাকে দেখে ভাবতে থাকি যে আর কোনদিন বোধহয় অরু ছুটির পর আগের মতন কোথাও যাওয়ার বায়না নিয়ে হাজির হবে না। সেই খেলার মাঠ, মেলা প্রান্তর সবই আছে কিন্তু আমি থাকলেও অরু যেন আর তেমনটি নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস যেন আপনাতেই বেরিয়ে আসে।
দেখতে দেখতে দাদা চলে যাবার দিনটি চলে এলো। যাবার আগে দাদা আমার হাতে তার বেশ দামি একটি ঘড়ি পরিয়ে দিয়ে বলেন, সময়ের সৎ ব্যবহার যাতে করতে শিখিস তাই এটা দিলাম। বাবা-মা’র কথা মেনে চলিস আর অরুর খেয়াল রাখিস। আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোধক জবাব দিলাম। এয়ারপোর্টে আমি আর বাবা যাচ্ছিলাম দাদাকে সি অফ করতে কিন্তু অরু বায়না ধরলো যে, সে ও যাবে সাথে। অগত্যা বাবা তাকেও সাথে নিতে বললেন আমাদের। মা শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছতে মুছতে দাদা তাকে প্রণাম করতে নিলে ওর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন।
এয়ারপোর্টে যখন দাদা আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতে নিলো, ঠিক তখনই অরুর দু’চোখ ছাপিয়ে যেন বর্ষা নামলো। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম তার পরিবর্তন। যেটা খুব চোখে লাগছিলো আমার। দাদা দূর থেকেই হাত নেড়ে ইশারা করলো যেন ওকে সামলে রাখি আমি। ফের অরুর কাধে আমার হাতটা রেখে ধীর স্বরে বললাম, অত কাঁদিস নে…দেখবি দাদা খুব জলদি চলে আসবে।
বাড়ি ফিরে এসে অরু সেই যে নিজের ঘরের দরজায় খিল দিলো আর খুললোনা। গোটা সন্ধ্যা থেকে রাত অব্দি কি করলো কে জানে! মা আমাকে বললেন, তোর না খুব বন্ধু…যা না বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়ে আয় ভাত খেতে।
আমি একটু ইতস্তত করলেও মাকে আর না বলতে পারলাম না। কারো ব্যক্তিগত দুঃখে নাক গলানোটা ঠিক মনে হয়না আমার, তা সে যতই ভালো বন্ধু হোক। কিছু সময় মানুষকে একা ছাড়তে হয়, তার নিজের মতো করে দুঃখ ভুলবার সুযোগ করে দিতে। এতে মন শক্ত হয়। সত্যের উপলব্ধিই মানুষের জীবনের একমাত্র স্বান্তনা, যা আর কারো কথায় সে কখনো খুঁজে পায়না।
দরজায় কড়া নাড়তেই অরু এসে দোর খুললো। তার চোখ এখনো লাল তবে পড়ার টেবিলে বই, খাতা, পেন খোলা দেখে বুঝে নিলাম যে পড়তে বসেছিলো সে। রুটিন মেনে চলা অরুর জীবনে এর যেন কোন ব্যতিক্রম নেই। যত কিছু ঘটে যাক, পড়ার সময় হলে পড়তে বসতেই হবে তার।
খানিকক্ষণ ওকে নিরীক্ষণ করে ফের আমি বললাম, মা তোকে খেতে ডাকছে।
সে আনমনে কিছু ভাবছিলো তাই শুনতে পায়নি দেখেই বুঝি আচমকা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বললো, তোর দাদা কখন কল করবে জানিস?
আমি বললাম, কাল করবে হয়তো…আজতো আর সম্ভব নয়।
অরু যেন নীরবে কিছু ভাবছে…ওকে ফের তাড়া দিতেই বললো, তুই যা আমি আসছি।
চুপচাপ খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে ক্লাস করে বাড়ি ফেরা অব্দি অরুর মুখে যেন আর কথা নেই। ফের বাড়ি ফিরতেই দাদার কল পেয়ে যেন স্বস্তি ফিরে পেলো। তারপর আবার সন্ধ্যেবেলা সেই নিয়ম কার পড়াশোনা।
আমার অরুটা যেন দাদার ভালো বৌ আর ক্লাস টপার থাকার চক্করে পড়ে কোথায় হারিয়ে গেলো।
দেখতে দেখতে যখন প্রায় মাসখানেক পার হয়ে গেছে তখন দাদা ফিরে এলো স্যুটকেস ভর্তি চকলেট, কসমেটিকস আর অন্যান্য গিফট আইটেম নিয়ে। বলা বাহুল্য বেশিরভাগই অরুর জন্যে। গিফটের চেয়ে বেশি দাদার অরুর প্রতি এত প্রেম দেখে আমি ভেতরে ভেতরে যেন শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। অরুও যখন তখন আমার ঘরে এসে, বিজু দেখ তোর দাদা কি দিয়েছে আমায়…বলে হাজির হয়ে গায়ে আগুন ধরাতো আমার।
তবুও হাসিমুখে বলতাম, বেশ ভালো…বুড়ো স্বামী উপহার দিয়ে দিয়ে বৌকে বশ করছে।
অরু অমনি রেগে গিয়ে কোমরে হাত রেখে ঝগড়া শুরু করতো।
ফের আমি বলতাম, বিয়ের আগে তুইই তো বলেছিলি আমার দাদার বয়স বেশি আর এখন আমি বললেই দোষ!!!
অরু তখন রাগে কটমট করতে করতে নিজের ঘরে ফিরে যেতো। দাদার উপর আমার ভীষণ রাগ হতে লাগলো। অরুর মনে ধীরে ধীরে অনেকখানি জায়গা করে নিয়েছেন, হয়তো সে এখন আমার চেয়ে বেশি দাদাকেই ভালোবাসে।
ফের একরাতে দাদার রুম থেকে হাসির খিলখিল শব্দ শুনে আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে মোড়ের দোকান থেকে সিগারেট আর লাইটার কিনে আনলাম। অনভ্যস্ত হাতে একটা সিগারেট কোনরকমে ধরিয়ে ছাদে নিয়ে একটান দিতেই অনবরত কাশতে শুরু করলাম। মনে হচ্ছিলো নিকোটিনের ধোয়ায় যেন আমার হৃদয়টা পুড়ে ছারখার হয়ে যাক….এত কষ্ট আর সইতে পারি না।
দাদা আর অরু সিনেমায় গেছে এক ছুটির দিন, সেদিনের দুপুরের শো দেখবে বলে। তারপর সেখানে গিয়ে সন্ধ্যে পার হয়ে রাত অবধি আর ফিরলো না। ওদের এত সখ্যতা দেখে আমি যেন অস্থিরতায় ভুগে ভুগে অবর্ণনীয় কষ্ট পাচ্ছিলাম। তাই ওরা যখন বেশ রাত করে ফিরলো তখন আমি বিছানায় শুয়ে ছটফট করছিলাম। মার সাথে দাদার বলা সব কথা শুনে বুঝলাম ওরা ডিনার সেরেই ফিরেছে।
পরদিন বাবাকে রুটিন মাফিক ডক্টর দেখাতে নিয়ে গেলো দাদা। ক’দিন ধরেই যেন একটু বেশিই অসুস্থ মনে হচ্ছিলো বাবাকে। নিজে থেকে তো কখনো কিছু বলেন না বাবা, কিন্তু যখন মা নিজে থেকে দাদাকে বললেন বাবাকে নিয়ে যেতে ডক্টর কাকুর চেম্বারে, তখন আমরা বেশ বুঝলাম যে কিছু একটা সিরিয়াস প্রব্লেম হয়েছে।
দাদা একেবারে বাবার সব টেস্ট করিয়ে ফিরলেন। রিপোর্ট পেয়ে কাল আরেকবার ডক্টরকে দেখাতে নিয়ে যাবে। কি হয়েছে তখন ঠিকভাবে জানা যাবে হয়তো। সে পর্যন্ত মেডিসিন আর বেড রেস্ট চলবে।
আমি ভয় পেয়ে গিয়ে কেন জানি বাবা সামনে আসতেই তাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলাম। আমার কান্ড দেখে বাবা মৃদু হেসে বললেন…পাগল ছেলে আমার, এভাবে কেউ কাঁদে, আরে আমিতো এখনো মরে যাইনি রে, মরলে তখন কাঁদিস।
আমি কান্নারত অবস্থায় মাকে বললাম, মা বাবাকে চুপ করতে বলবে তুমি…কিছু বলছেনা দেখে ফের মার দিকে ফিরে তাকাতেই দেখলাম, মা ও যেন কাঁদছেন অঝোর ধারায় ।
দাদা একটু দূরে দাঁড়িয়ে থেকে যেন জোর করে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করলেন। অরু এসে হঠাৎ ঘরে ঢুকে কিছু না বুঝে দাদার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।
#চলবে…
কপি করা নিষেধ, লেখা অন্যত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ।