#সুখের_নেশায়,০২,০৩
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___২
‘ চৈত্রিকার গালে থাপ্পড় দেওয়ার অধিকার আমি কাউকে দেই নি। তোর সাহস কি করে হলো জেরিন?এখুনি বেরিয়ে যাবি আমার বাড়ি থেকে। নয়ত আমি ভুলে যাবো সম্পর্কে কিছু হোস আমার।’
হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে আছে সাফারাত। চেষ্টা করে যাচ্ছে রাগ সংবরণের। কপালের শিরা গুলো ফুলে,ভেসে উঠেছে স্পষ্ট। চোখ দুটো যেন জলন্ত অগ্নিশিখা। সাফারাতের এহেন ক্রোধান্বিত রূপে বাড়ির সকলে ভয়ে সেঁটে আছে। জেরিন ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠল,
‘ মেয়েটা তোমাকে অনুমতি বিহীন স্পর্শ করেছে সাফারাত। আমি তো জাস্ট মেয়েটার বেয়াদবির জন্য থাপ্পড় দিয়েছি। তাছাড়া তুমি তো চিনো না মেয়েটাকে। অচেনা একটা মেয়ের এমন ব্যবহার মোটেও শোভা পায় না। ফকি,,
মুহুর্তে সাফারাত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল জেরিনের দিক,যা দেখে বেলুনের মতো চুপসে গেল জেরিন। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠল সাফারাত,
‘ অচেনা একটা মেয়েকে থাপ্পড় মারা শোভা পায় তোর?তাও যে তোর বয়সে বড়?আমার বাড়ি তে কে আসবে,কে আমায় স্পর্শ করবে সেটা আমি ভাববো। তুই কেন আঘাত করবি?তুই এ বাড়িতে সেদিনই পা রাখতে পারবি যেদিন চৈত্রিকা তোকে ক্ষমা করবে। পাক্কা দশ মিনিট পর যেন তোকে এই বাড়ির আনাচে কানাচেতে ও না দেখি আমি।’
‘ এটা আমার মামার বাড়ি। তুমি এভাবে আমাকে বের করে দিতে পারো না সাফারাত।’
‘ এটা আমার বাড়ি। আমার মায়ের বাড়ি।’
তেজী কন্ঠে চিল্লিয়ে বলে উঠল সাফারাত। জেরিন ভয়ে সরে গেল চোখের সামনে থেকে। ড্রইং রুমে উপস্থিত সাফারাতের চাচা-চাচী,চাচাতো ভাই-বোন,ছোট ফুপু কিছুই বলার সাহস পেল না।
জেরিনের মনটা উসখুশ করছে। তার মন বলছে সাফারাতের পূর্ব পরিচিত চৈত্রিকা। তবে সাফারাত কেন চৈত্রিকা কে অস্বীকার করল?ভাবনা ভুলও হতে পারে। কারণ সাফারাত নিজের বিষয়ে অন্য কারো হস্তক্ষেপ সহ্য করতে পারে না। হতে পারে তার আর চৈত্রিকার মধ্যে সে ঢুকেছে বলে সাফারাত এতো রেগে গেছে!
কিন্তু সে কখনও চৈত্রিকার মতো মেয়ের কাছে ক্ষমা চাইবে না। কখনও না।
.
.
এলোমেলো পায়ে ফুটপাত ধরে হাঁটছে চৈত্রিকা। চোখ,মুখে বিধস্ত ভাব! গায়ের শুভ্র রঙের ওড়না টা বাতাসে পাখা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে দু’দিকে। বুকের যন্ত্রণায় পা দু’টো ভারী হয়ে আসছে ক্রমশ। তবুও ভাঙ্গা মন নিয়ে এগিয়ে চলছে বাসার দিকে। যেই সুখের আশায় এতগুলো বছর অপেক্ষা করে গেল,সেই সুখ দুঃখ রূপে ফিরে এলো চৈত্রিকার জীবনে। সুখ নেই তবুও সুখের নেশা প্রকট। বেহায়ার মতো ছুটে গিয়েছিল সুখের টানে। কোনো একদিন যেই মানুষ টা নিজে বলেছিল-
“আমাকে স্পর্শ করার জন্য অনুমতির প্রয়োজন নেই তোমার। মন,দেহ দুটোই স্পর্শ করার অধিকার শুধুই চৈত্রিকার।”
অথচ একই ব্যক্তি আজ পুরোনো অভ্যাসবশত স্পর্শ করার অপরাধে অপমান করল তাকে। সময় কত কিছু বদলে দেয়। অধিকারবোধও কি ছিনিয়ে নেই?
গাল বেয়ে অঝোর ধারায় ঝরছে জল। ফর্সা চেহারা টা রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। কপোল,হাতের ব্যাথার চেয়ে অজস্র ব্যাথার বসবাস চৈত্রিকার বক্ষস্থল জুড়ে। আচ্ছা এই ফুটপাতে বসে চিৎকার করে কাঁদা যাবে?যদি যায় তবে চৈত্রিকা মুক্ত করে দিবে গলায় দলা পাকিয়ে থাকা অশ্রুদের। চৈত্রিকার মেঘে ঢাকা জীবনেও রৌদ্দুরের দেখা মিলেছে একটা সময়। এক চিলতে সুখ নিয়ে জীবনে পদার্পণ করেছিল সাফারাত নামক যুবক। আজকের সাফারাতের সাথে বহু বছর আগের সাফারাতের ভীষণ অমিল। ভীষণ!সাফারাত হয়ত ভুলে বসেছে তার চৈত্র কে কিন্তু চৈত্রিকা মন,মস্তিষ্ক, অন্তর,হৃদপিণ্ড থেকে কখনও মুছতে পারে নি সময়ের গতিতে পিছনে ফেলে আসা স্মৃতি গুলো কে এবং ভালোবাসতে। এই তো এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে কানের কাছে ফিচেল স্বরে ডাকছে সাফারাত।
‘ এই চৈত্র মাস!’
চোখের জলকণা নিজ হাতে মুছে দিয়ে পরক্ষণেই রাগান্বিত কন্ঠে বলছে,
‘ তুমি আমাকে অনুমতি দিবে তোমার বাবাকে খুন করার?আমার মনে হচ্ছে তোমার বাবা তোমাকে আঘাত করছে না বরং খুন করছে প্রতিনিয়ত আমার আত্মার।’
বুকের কোথাও ভাঙন হচ্ছে চৈত্রিকার। দরজার অভিমুখে যেই মেয়েটার সাথে কথা হয়েছিল, সেই মেয়েটা যখন সজোরে থাপ্পড় বসালো গালে,সেই সময়ে চোখের সামনে পুরো পৃথিবী অন্ধকার দেখতে পেল চৈত্রিকা। মুহুর্তেই নিজের করা কাজে ঘৃণা জন্মে নিজের প্রতি। কোনো দিকে না চেয়ে ঝাপসা দৃষ্টিতে পা ফেলে বেড়িয়ে এল ওই বাড়ি হতে।
_______
রক্তিম আভায় প্রকৃতি রক্তিম হয়ে উঠেছে। হালকা কমলা,লাল রঙে রাঙিয়ে নিয়ে মানব জাতিকে জানান দিতে মত্ত হয়ে পড়েছে ধরিত্রীর বুকে নেমে আসছে সন্ধ্যে। পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে চৈত্রিকার। সিঁড়ি ভেঙে দু’তলা পর্যন্ত উঠে দেয়ালের সাথে ঠেসে দাঁড়াল কোনো রকম। কলিং বেল চাপ দিতেই মা দরজা খুলে দিল।
চৈত্রিকার চক্ষুযুগল ফুলে আছে অতিশয়। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে তিরতির করে। অভ্যন্তরীণ পীড়া,যন্ত্রণার ছাপ ফর্সা চেহারায় স্পষ্ট, বিশদ। মেয়ের হাত টা ধরে করুন চাহনি নিক্ষেপ করলেন ফাহমিদা। চৈত্রিকা মায়ের ভয়াতুর, চিন্তিত ভঙ্গি নেত্রপাত করতেই ক্ষীণ হাসল। রিনঝিনে স্বরে বললো,
‘ মাথা ব্যাথা করছে মা। খুব বেশি ক্লান্ত আমি। রেষ্ট নেই রুমে গিয়ে?’
‘ তুই কি কিছু আড়াল করছিস চৈত্রি?’
মায়ের মলিন স্বর শুনে চৈত্রিকা প্রগাঢ় দৃষ্টিতে চাইল। ক্লান্ত নিঃশ্বাস ফেলে প্রতুত্তর করলো,
‘ যদি করি? মায়ের মন তো! ঠিক বুঝে যাবে।’
ফাহিমা বিচলিত নেত্রে চাইতেই গটগট পায়ে রুমে ঢুকে পড়ল চৈত্রিকা। রুমে ঢুকে দরজা আটকে মুখে হাত দিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। যতটা সম্ভব চেপে রাখছে কান্নার শব্দ। কান্নার শব্দ প্রাচীর ভেদ করে বাহিরে যাওয়াও নিষিদ্ধ করে দিয়েছে মেয়েটা। এতগুলো বছরে জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হয়েছে। লোহার মতো শক্ত করেছে মন। কিন্তু এক নিমিষেই তা গলতে শুরু করেছে। যেই মানুষ টা কে হন্যি হয়ে খুঁজেছে মন, তার করা আঘাত হৃদপিণ্ডের ক্ষত তাজা করতে ব্যস্ত। বছরের পর বছর প্রতি নিকষকৃষ্ণ রজনীতে চক্ষু নির্মলিত করার পূর্বে দু’টো জিনিসই মন জুড়ে বিচরণ করত। বাবার ভালোবেসে একটা বার মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া এবং জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগে হলেও যেন সাফারাতের দেখা পায়। শুধু একটাবার!
চৈত্রিকার কল্পনাতেও আসে নি সাফারাত সুখ নয় বরং এক রাশ বিষাক্ত যন্ত্রণা ঢেলে দিবে তার আঁজলা তে। মা অনেকবার খেতে ডাকল কিন্তু ক্ষিদে নেই বলে এড়িয়ে গেল চৈত্রিকা। পারতপক্ষে সে আজ বাবার মুখোমুখি হতে চাই না। অনুশোচনা, কষ্ট নাহয় তাকে ঘিরে ধরবে প্রখরভাবে। মিম অনেকবার রুমে এলেও চৈত্রিকা মৌন মুখে বসে রইল। বোনের হাবভাব চোখে বিঁধতেই আর কিছু বলতে পারল না মিম। চুপ করে রুম ছেড়ে নিজের রুমে চলে গেল। বড্ড কষ্ট হয় তার বোনের জন্য। বাবা তো চাইলেই বুকে জড়িয়ে নিতে পারে!ভালোবেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারে!কিছু কিছু ঘটনা ইচ্ছাকৃত হয় না। বাবা বুঝেও যেন রাগ চেপে দূর করে দিয়েছে চৈত্রিকা কে চিরতরে।
.
.
গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্নে চৈত্রিকা হাতে, গালে কারো স্পর্শ অনুভব করল। নিমিষেই হালকা হতে শুরু করল নিদ্রা। তবে ঘুমের দাপটে লেগে থাকা আঁখিদ্বয় চেয়েও তৎক্ষনাৎ মেলতে সক্ষম হলো না। গালে আর্দ্র ছোঁয়ায় টেনে চক্ষু মেলল। অতঃপর জ্বলনে চোখে পানি এসে জড়ো হল। চোখ মুছে ড্রিম লাইটের আধো আধো আবছা দীপ্ততায় সতর্ক দৃষ্টি নিবদ্ধ করল রুমের চার দেয়ালে। কিন্তু কোথাও কাউকে দেখতে পেল না। দরজার দিকে নজর যেতেই দেখল অর্ধেক খোলা। হাতের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি ফুটে উঠল চৈত্রিকার অধর যুগলে। হয়ত মা এসেছিল,হাতে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিয়ে গেছে। সকাল বেলা পাত্রের সামনে যাবে না বলে জেদ ধরলে বাবা রাগে থাপ্পড় মেরেছিলেন। হাতে গরম চায়ের কাপ ছিল যা থাপ্পড়ের দাপটে সম্পূর্ণ ছিটকে পড়েছিল ডান হাত ও গলার কিছু অংশে।
প্রভাতের মন মাতানো বিশুদ্ধ বায়ু দেহের সর্বাঙ্গে আলিঙ্গন করে নিতে চৈত্রিকা ছাঁদে এল। এই বাড়িটা তিনতলা। বছর খানেক ধরে এখানে ভাড়া থাকছে চৈত্রিকারা। খুব বেশি সুন্দর নয় আবার কম খারাপও নয়। তবে চৈত্রিকাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ঠিকঠাক। নিচের দিকে চাইতেই দৌড়ে এসে পাশে দাঁড়াল মিম। জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে মেয়েটা। শ্বাস ফেলার আওয়াজ কর্ণে প্রবেশ হতেই নিচ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এনে পাশে তাকাল চৈত্রিকা। বোনের হাতে নানা রঙের জারবেরা দেখে চক্ষুদ্বয় বৃহদাকার ধারণ করল নিমিষেই। ব্যগ্র কন্ঠে বলে উঠল,
‘ তোর হাতে এতগুলো ফুল কেন মিমু?কে দিয়েছে?’
‘ আমাকে দেয় নি আপু। তোকে দিয়েছে। নিচে গিয়েছিলাম দারোয়ান কাকা আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। ভাগ্যিস বাবার হাতে দেন নি।’
মিমের হাঁফানো স্বর ঝংকার তুলে কর্ণধার হলো। বোনের হাত থেকে এক প্রকার ছিনিয়ে নিল ফুলগুলো। একটা একটা করে আলগা করে ছাঁদের মেঝেতে ফুলগুলো রাখল। কিছুই পেল না একটা ছোট্ট কাগজ ব্যতীত এবং তাতে শুধুই লিখা ‘ চৈত্রিকা।’
#চলবে,,,!
#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___৩
” ভালো আছি,ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।”
দারোয়ান কাকার বেসুরেলা কন্ঠের গান শুনে মুখে হাত রেখে হাসি আটকানোর বৃথা প্রয়াস চালাচ্ছে মিম। কিন্তু হাসি!তার চেষ্টা কে হার মানিয়ে বেরিয়ে এল শব্দ করে। অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ল মেয়েটা। হাসির শব্দে লজ্জায় গান থামিয়ে মুখ কাচুমাচু করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন দারোয়ান কাকা। চৈত্রিকা চোখ পাকিয়ে তাকাল মিমের দিক। বোনের চোখ রাঙানোতে বহু কষ্টে হাসি থামাতে সক্ষম হলো মিম।
চৈত্রিকার ঘাড় ঘুরিয়ে দু’তলার দিকে চোখ বুলালো। বাবা এমন সময় জানালার ধারে বসে থাকেন। আজ দেখতে না পেয়ে চৈত্রিকা কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। দারোয়ান কাকার দিকে চেয়ে নম্রতার সহিত নিচু স্বরে প্রশ্ন করল,
‘ ফুল গুলো কে দিয়েছে কাকা?’
‘ আমি তো কইতে পারি না মা। ডিউটিতে আইবার পর দেখলাম চেয়ারের উপর থুইয়া রাখছে কেউ। একটু আকটু তো পড়ালেহা করছি ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত। তাই তোমার নাম ডা পড়তে সমস্যা হইল না।’
‘ আপনার আগে আরেকজন ছিল ডিউটিতে ভোর পর্যন্ত। উনি দেখেন নি?কেউ গেইটের ধারে এসে রেখে গেল দারোয়ানের চোখ ফাঁকি দিয়ে ব্যাপারটা অদ্ভুত।’
দারোয়ান এদিক সেদিক তাকালেন। ভয়মিশ্রিত স্বরে বলে উঠলেন,
‘ আসল কথা হইল রাতে যে ডিউটিতে আছিল হে আজ ফজরের আযানের আগেই চইল্লা গেছে। ওর মাইয়াডার শরীর ভালা না। জ্বর আইছে শেষ রাতে। আমারে ফোন দিয়া বইলা গেছিল। আমি আইতে আইতে ৬টা বাজছে। মালিকের কাছে বিচার দিও না মা। ‘
‘ দিব না কাকা। আপনার কাছে আমার ছোট্ট একটা অনুরোধ থাকবে দয়া করে বাবা কে বলবেন না আমার নামে কেউ ফুল দিয়েছে। ‘
‘ বলমু না। তুমিও কইয়ো না আমার বিষয়টা। কইলে আমার চাকরি থাকব না।’
চৈত্রিকা মাথা দু’দিকে নাড়াল। অর্থাৎ সে বলবে না। মিমের হাত টা ধরে পা বাড়িয়েও থেমে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে মৃদু হেসে বলে উঠল,
‘ গানটা সুন্দর ছিল কাকা। নিঃসন্দেহে গাইতে পারেন। মিমু তো আপনার গানের গলায় মুগ্ধ হয়েই হাসছিল। ক’জনই বা পারে মানুষের ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটাতে!’
চৈত্রিকার কথায় খুশিতে গদগদ হয়ে গেলেন দারোয়ান কাকা। চৈত্রিকাও ঠোঁটে হাসি বজায় রেখে মিম কে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল।
‘ আপু!’
‘বল।’
‘ কাকার গান চুড়েল,পেত্নীদের হি হি শব্দকেও হার মানাবে। তুমি কেন মিছে মিছে প্রশংসা করলে?’
পা দুটো সিঁড়িতে থামিয়ে দিল চৈত্রিকা। চোখে মুখে ফুটে উঠল গম্ভীর ভাব। সূক্ষ্ম একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে শান্ত গলায় উত্তর দিল,
‘ কাউকে আঘাত করা উচিত নয় আমাদের মিমু। একটা মানুষ যতই খারাপ হোক অথবা তার কাজগুলো প্রশংসার দাবিদার না হোক তবুও তাকে নিয়ে উপহাস করা অন্যায়। অন্যের মনে আঘাত দিয়ে কখনও ভালো থাকা যায় না। তোর হাসিতে কাকার মনোক্ষুণ্ণ হয়েছে। আচ্ছা তুই কি কোনো কারণ ছাড়া হাসতে পারিস?মিছে মিছে হাসি কখনও পায়?’
মাথা দুলিয়ে না বুঝালো মিম। মিমের কোমল গালে হাত ছুঁয়ে চৈত্রিকা আলতো হাসল। ক্ষীণ স্বরে বলে উঠল,
‘এই শহরে হাসির কারণ হবার মানুষের বড্ড অভাব মিমু। কাকার কারণেই তোর অধর ছড়িয়ে শব্দ করে হাসিটা এসেছে। উনাকে ধন্যবাদ জানানো প্রয়োজন তোর। একটুখানি হাসির গুরুত্ব যে কতটুকু,যার কপালে সুখের দেখা মিলে না কেবল সেই বুঝে। ‘
.
.
ওড়নার নিচে ফুলগুলো কোনো রকমে লুকিয়ে রুমে এলো চৈত্রিকা। টবে কালশিটে রূপ ধারণ করা জারবেরা গুলোর সাথে আজকের গুলো স্থান পেল। নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে চৈত্রিকা পাড়ি জমাল ভাবনায়। আজ থেকে চার দিন পূর্বে নানা রঙের জারবেরা দিয়েছিল কেউ। যার বর্তমান অবস্থা পাপড়ি গুলো শুকিয়ে যাওয়ার পথে।
সবে টিউশনি শেষ করে গলির মোড়ে হাঁটছিল চৈত্রিকা বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে। বিস্তর অম্বরে তখন মেঘেরা ছোটাছুটি খেলায় মত্ত হয়েছে। সাদা নয় বরঞ্চ কালো মেঘ। চৈত্রিকার হুট করে মনে হলো সবসময় ব্যাগে জায়গা দখল করে রাখা ছাতাটা আজ বাসায় রয়ে গেছে। কখন ধরায় নেমে আসে বৃষ্টি,ছুঁয়ে দেয় সমস্ত কায়ায় তা তো বলা মুশকিল। ফলস্বরূপ দ্রুত গতিতে পা চালাচ্ছে সে। গলি পেরিয়ে রাস্তায় আসতেই একটা বাচ্চা ছেলে দৌড়ে এসে তার সন্নিকটে হাজির হলো। বাচ্চা টার হাত ভর্তি লাল,হলুদ,গোলাপি রঙের জারবেরা। ফুলগুলো বাড়িয়ে দিয়ে মায়াময় কন্ঠে বললো,
‘ মামী মণি নাও।’
মামী মণি!ডাকটা কর্ণগোচর হতেই স্তব্ধ হয়ে পড়ল চৈত্রিকা। স্থবির দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ফুলগুলো হাতে তুলে নেওয়া মাত্র ছেলেটা চলে গেল কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা কালো গাড়িটায় উঠে। চৈত্রিকা শত প্রয়াস চালিয়েও গাড়িতে কে আছে তা দেখতে পারল না। কারণ তার দেখার আগেই গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। না পারল দেখতে,না পারল সেই ডাক,ফুল দেওয়ার মানে উদ্ধার করতে।
মায়ের ডাকে খানিকটা ভরকে গেল চৈত্রিকা। কাজে সাহায্যের জন্য ডাকছেন তিনি। চৈত্রিকা ভাবনা হতে বের হয়ে হতাশা মিশ্রিত শ্বাস ফেলল। জীবনটা কেমন গোলকধাঁধায় পরিণত হয়েছে তার, যা থেকে বের হওয়ার সঠিক পথ খুঁজতে ব্যর্থ সে। আলতো হাতে ছুঁয়ে দিল ফুলগুলোকে। আনমনে বলে উঠল,
‘ তোমার মনে আছে সাফারাত?শেষ দেখায় বলেছিলাম আমার জীবনে প্রণয়ের আরম্ভ টা হোক এক হাত ভর্তি ফুল দিয়ে। তখনও আমার অজানা ছিল সেই কথাটাই হবে আমার তোমার সাথে শেষ কথা। গতকালও কথা হয়েছে তবে সেই সাফারাত ভিন্ন, তুমি নও।’
___________
ডাইনিং টেবিলে বসে আছে সাফারাতের দাদি,চাচা-চাচি সকলে। সাফারাত চেয়ার টেনে দাদির পাশে বসল। দাদির প্লেটে রুটি দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
‘ এখন যিনি রান্না করেন তার রান্নার হাত মোটেও ভালো নয় দাদী। খেয়ে তৃপ্তি পাই না। পানসে পানসে লাগে। তোমার তো রান্নার করার বয়স নেই। আর চাচী আম্মু তেমন একটা ভালো রান্না করেন না। নতুন লোক আনা হবে রান্নার জন্য। তাছাড়া রান্নার পাশাপাশি তোমার দেখাশোনার কাজও করবে।’
‘ এমন কেউ মানে তো বউ। তুমি কি বিয়ে করে বউ আনছো ভাই?’
প্রিয়ন্তীর কথায় নত মাথা তুলে সটান হয়ে বসল সাফারাত। দুর্বোধ্য হেসে বললো,
‘ বউ না রান্নার জন্য লোক আনছি। কেউ কেউ চায় না আমার জীবনে সুখ আসুক। সবাই থেকেও একা আমি। যাকেই আঁকড়ে ধরব। দিনশেষে দেখা যাবে সেই আমাকে আঘাত করতে প্রস্তুত।’
সাফারাতের কথা শুনে চাচা-চাচিসহ সকলের মুখটা পাংশুটে হয়ে গেল মুহুর্তে। প্রিয়ন্তী সাফারাতের দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের বাবা-মা এবং সবার দিকে চাইল। পনেরো বছরের প্রিয়ন্তী খুব একটা না বুঝলেও এতটুকু ঠাওর করতে পারে তার বাবা-মার সাথে সাফারাতের সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়। বিশাল এই বাড়িতে অতি কাছাকাছি বসবাস সবার অথচ মনে মনে দূরত্ব হাজার মাইল কিংবা তারও বেশি!
সাফারাত হাত ধুয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই সাফারাতের দাদি সুফিয়া বেগম ডেকে উঠলেন। রাশভারি গলায় বললেন,
‘তোমার বাবা ফোন দিয়েছিল৷ কথা বলতে চায় তোমার সাথে।’
নিমেষে চোখ দুটো লাল রঙে ছেয়ে গেল সাফারাতের। কপালে বৃদ্ধাঙ্গুলি ঘষে বললো,
‘ আমার মনে হয় তোমার মোবাইল টা ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া উচিত। যেই জিনিস আলতু ফালতু লোকের সাথে কথা বলার জন্য ব্যবহার হচ্ছে,তা আমার বাড়িতে থাকতে পারবে না।’
সাফারাতের ক্রুদ্ধ,রোষপূর্ণ কন্ঠে দমে গেলেন সুফিয়া বেগম। করুণ চাহনি নিয়ে চাইলেন সাফারাতের দিকে।
____
‘ আপনি কি আজ ডাক্তার দেখাবেন না চৈত্রির বাবা?’
তীর্যক চাউনি নিক্ষেপ করলেন আহমেদ সাহেব। কন্ঠে একরাশ রাগ নিয়ে বলে উঠলেন,
‘ তোমাকে অনেকবার বলেছি ওই মেয়ের বাপ বলে সম্বোধন করবে না আমাকে। যে মেয়ে আমার ছেলের প্রাণ কেঁড়ে নিয়েছে সে কখনও আমার সন্তান হতে পারে না। যদি সম্ভব হতো তবে নিজ হাতে গলা টিপে মেরে ফেলতাম।’
ফাহমিদার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে গেল। প্রতিবাদ করে বললো,
‘ নিজের ভাইকে কেন মারবে ও?আপনি আজও ভুল টা আঁকড়ে মেয়েটাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছেন। শেষ করে দিচ্ছেন আমার মেয়েটাকে।’
দরজার কাছ থেকে সরে এলো চৈত্রিকা। রুমে এসে পা দুটো ভেঙে বসে পড়ল ফ্লোরে। দুই চক্ষে জল নেই। কিন্তু রক্তাক্ত হচ্ছে অভ্যন্তরে। চৈত্রিকার যেন অনুভূত হচ্ছে তার অভ্যন্তরে গড়িয়ে যাচ্ছে তরল লাল রক্ত। যে রক্ত কেউ দেখছে না,কখনও দেখবে না। বাবার ভুল কি করে ভাঙ্গাবে সে?আদৌ কি তা সম্ভব! এতো বছরে পারে নি আর হয়ত পারবে না। চৈত্রিকা নিজেই তো একটু একটু করে মরছে প্রিয়জন হারানোর বেদনায়।
চৈত্রিকা নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়াল। যতবার আত্মার মৃত্যু হয়,হোক। মেনে নিবে সে। কিন্তু কখনও ভাঙ্গবে না। অনেক দায়িত্ব আছে তার। বাবা শতবার,সহস্র বার অস্বীকার করুক তাকে সন্তান হিসেবে কিন্তু সে ঠিকি পালন করে যাবে সন্তানের দায়িত্ব। ছোট্ট একটা কাগজে লিখল- আমি বাহিরে যাচ্ছি মা,খুব শীগ্রই ফিরব।
এই কথাটি বলার জন্যই ছুটে গিয়েছিল মায়ের রুমের দিক। বুক চিরে বেরিয়ে এল এক অতি যন্ত্রণা, বেদনা মিশ্রিত শ্বাস। যাকে এক কথায় বলা যায় দীর্ঘশ্বাস। কাগজ টা রান্নাঘরে চুলোর কাছাকাছি একটা ছোট্ট পাথর দিয়ে চাপা দিয়ে রাখল। কোনো এক সময় রেললাইন থেকে পাথর টা কুড়িয়ে এনেছিল চৈত্রিকা নানার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে।
.
.
বর্ষণ হচ্ছে। মুষলধারে বর্ষণ। প্রিয় বান্ধবী মিহিতার হাত ধরে দৌড়ে বাস স্ট্যান্ডের ছাউনির নিচে ঠাঁই নিল চৈত্রিকা। আজও ভুলে গেছে ছাতা আনতে। বাসা থেকে বেরিয়ে দেখেছে রৌদ্রজ্বল দিন। তারপর মিহিতাদের বাসা হতে বেরোতেই মাঝ রাস্তায় ঝমঝম শব্দ করে নেমে পড়ল বৃষ্টি। বাস স্ট্যান্ডে তেমন কোনো লোক নেই। ওদের থেকে খানিকটা দূরে দাড়িয়ে আছে তিনটে ছেলে। হয়ত বাসের অপেক্ষায়। নিজের দিকে তাকিয়ে মুখটা লজ্জায় চুপসে গেছে চৈত্রিকার। তেমন একটা ভিজে নি কিন্তু সাদা রঙের জামা হওয়ায় অল্প ভেজাতেই দৃষ্টিকটু দেখাচ্ছে খুব। মিহিতার দিকে তাকিয়ে দেখল ওর ড্রেস ভিজলেও খারাপ দেখাচ্ছে না। কালো রঙের হওয়ার দরুন হয়ত।
পাতলা ওড়নাটা দিয়ে যতটুকু পারল নিজেকে ঢেকে নিল চৈত্রিকা। অপেক্ষা এখন বর্ষণ মুক্ত প্রকৃতির। মিহিতার সাথে টুকটাক কথায় মগ্ন অবস্থায়, আচমকা বাম হাতে কারো হিম শীতল স্পর্শে কেঁপে উঠল বক্ষস্থল। ভয়ার্ত চোখে পাশে তাকালো। কাউকে দেখতে না পেয়ে অবাক হলো প্রচন্ড। স্পর্শ টা অনুভব করেছে সে। মিছে হয় কেমন করে!পরক্ষণেই ঘাড়ে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস পড়তেই চকিতে ঘুরে তাকালো। পরিচিত মুখ আঁখি জোড়ায় ভেসে উঠতেই চৈত্রিকা হতভম্ব, হতবাক হয়ে পড়ল। কন্ঠনালি হতে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এলো,
‘ সাফারাত!’
#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)