#সুখের_নেশায়,৮,৯
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___৮
‘ কি করছেন আপনি সাফারাত? ছাড়ুন আমাকে। লোক দেখবে।’
সাফারাতের কপালে রুষ্ট বলিরেখার ভাঁজ ফুটে উঠল। চক্ষুদ্বয় বুলালো আশপাশ। ওই তো দেখা যাচ্ছে, একটা বয়স্ক লোক চেয়ে আছে ওদের পানে ড্যাবড্যাব নেত্রে। সাফারাত এক ভ্রুঁ উঁচিয়ে চাইতেই লোকটা থতমত খেয়ে গেল। হাঁটতে শুরু করল নিজ গন্তব্যে। কোমর আঁকড়ে ধরে রাখা হাত টা চৈত্রিকার সারা শরীরের শিহরণ ভয়ে দিচ্ছে। চৈত্রিকা অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে সাফারাতের দিকে তাকাল। তাকাতেই দেখল সাফারাত চেহারায় একরাশ গম্ভীরতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হৃদয় জুড়ে সেই কিশোরী বয়স থেকে একটু একটু করে সঞ্চরিত করা অনুভূতিরা ছোটাছুটি করছে প্রচন্ড বেগে।
সাফারাতের এক ভ্রুঁ উঁচানো দৃশ্য টা তার চোখ এড়ালো না। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে রইল চৈত্রিকা নির্নিমেষ। অন্তস্থলে তখন তুমুল বেগে বর্ষণ হচ্ছে। বর্ষণের সে-কি তীব্রতা,চৈত্রিকা চেয়েও দেখাতে অক্ষম। দৃষ্টি হলো স্থির, প্রগাঢ়। সাফারাতের কালো গেঞ্জি টা আঁকড়ে ধরে হাসফাস করতে লাগল। নিম্ন স্বরে বললো,
‘ নামিয়ে দিন না।’
চৈত্রিকার রক্তিম চেহারায় তীক্ষ্ণ চাউনি ফেলল সাফারাত। পরিহাস করে বললো,
‘ গেঞ্জি আঁকড়ে ঘনিষ্ঠ হচ্ছেন। আবার বলছেন নামিয়ে দিন না।’
মুহুর্তেই চৈত্রিকা যেন লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। অনুভব করতে পারছে তার গাল দুটো ভীষণ গরম হয়ে আসছে। হয়ত লাল টমেটোর আকারও ধারণ করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। সাফারাতের বুক থেকে হাত টা ধীরে ধীরে ছাড়িয়ে আনতে নিলে কর্ণধারে প্রবেশ করল সাফারাতের ব্যগ্র, অস্থির কন্ঠস্বর,
‘ ছাড়বেন না চৈত্র। কারণ আমি আপনাকে আমার কোল থেকে নামাচ্ছি না। আপনার পুরো শরীর জ্বরে কাঁপছিল একটু আগেই। হাঁটার মতো শক্তি আছে বলে আমার মনে হয় না। থাকলেও এই অসুস্থ শরীর নিয়ে হাঁটতে দিব না আমি।’
ভরাট কন্ঠের এলোমেলো কথার তালে যেন হারিয়ে গেল চৈত্রিকা। আহা!কি সুখ মিশে আছে প্রত্যেক টা শব্দে, বাক্যে!চৈত্রিকার মন খুব করে চাইছে সময়,মুহূর্ত থমকে যাক সব। সাফারাতের মুখ থেকে অনুভূতি জড়ানো বাক্যগুলো শুনতে আঁকড়ে ধরে রাখুক সাফারাত কে হৃদয়পটে,মনের গহীনে। কিন্তু, আদৌ কি তা সম্ভব! সাফারাত কেবল,কেবলই বন্ধুত্বের খাতিরে আগের মতো করেই তার কথা ভাবছে। এটাই চৈত্রিকার ধারণা। ভয় করে তার ভালোবাসা প্রকাশ করতে। যদি আবারও সাফারাত ক্রুদ্ধ হয়ে ফিরিয়ে নেয় মুখ? তাহলে তো একটু আকটু পাওয়া সুখগুলোও হারিয়ে বসবে সে। তাই থাকুক বন্ধুত্ব। সাফারাতের অস্ত্বিত্ব হলেই কেটে যাবে জীবন।
করিডোরে মানুষের চলাচলের আওয়াজ কাঁপিয়ে তুলল চৈত্রিকা কে। সাথে সাথে উপলব্ধি করল কোমরে বলিষ্ঠ হাতের বাঁধন গভীর হয়েছে। চৈত্রিকা হকচকালো, ভড়কাল খানিকটা। মৃদুস্বরে কিছু বলতে যাবে তার আগেই সাফারাত কপাল কুঁচকে বলে উঠল,
‘ আপনার লোক লজ্জার ভয় হলে,নিঃসংকোচে আমার বুকে মুখ লুকাতে পারেন চৈত্র। ‘
নির্লিপ্ত, নির্বিকার কথা শুনে চৈত্রিকার মাথাটা ঘুরতে শুরু করে। সাফারাতের অকপটে বলা কথাটুকু চৈত্রিকার বক্ষস্পন্দন বাড়িয়ে তুলল। মিন মিনে স্বরে বললো,
‘ ঠিক আছি আমি।’
ডাক্তারের কেবিনের সামনে এসে সাফারাতের পা দুটো থেমে গেল। একজন নার্স কে দেখে বললো,
‘ ড. সিফাত নেই?’
‘ না স্যার। উনি একটু আগেই বেরিয়ে গেছেন।’
‘ ওহ্। আপনি জ্বর মাপতে পারবেন?আর ড্রেসিংও করে দিতে হবে।’
‘ পারব স্যার।’
কেবিনে প্রবেশ করে চৈত্রিকা কে সাবধানে বেডে বসিয়ে দিল সাফারাত। নার্স কে ইশারা করল চৈত্রিকা কে দেখতে। মেয়েটার শরীর খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। বৃষ্টিতে ভিজার কারণে গাঁ কাপিয়ে জ্বর এসেছে। সাফারাত যখন একদম সন্নিকটে দাঁড়িয়ে ছিল তখন চোখে বিঁধল মেয়েটার দেহের কাঁপুনি। হুট করেই কাঁপতে শুরু করে। হাতটা আলতো করে স্পর্শ করতেই দেখে প্রচন্ড গরম দেহ। লিফট খুলতেই দেরি না করে কোলে তুলে নেয় চৈত্রিকা কে।
নার্স সাফারাতের দিকে এক পলক তাকিয়ে চৈত্রিকার মুখে থার্মোমিটার পুরে দিল। নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘ ম্যাম একটা প্রশ্ন করি?’
মাথা হেলালো চৈত্রিকা। মেয়েটা খুশিতে গদগদ হয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,
‘ ইনি কি আপনার হাসবেন্ড?’
দু’পাশে মাথা নাড়াল চৈত্রিকা। মেয়েটার মুখে চিন্তার রেখা প্রতীয়মান হলো। ফের দ্বিধান্বিত কন্ঠে বললো,
‘ বয়ফ্রেন্ড?’
পূর্বের মতোন না করল চৈত্রিকা। এক পাশে স্থির দাঁড়ানো সাফারাতের পানে দুর্বল দৃষ্টি মেলে ধরল। তার দিকেই নিষ্পলক তাকিয়ে আছে সাফারাত। চেহারায় অসীম অস্থিরতার ছাপ। চৈত্রিকা মুখ থেকে থার্মোমিটার টা বের করে নার্সের হাতে ধরিয়ে দিল। থার্মোমিটারের পারদ তরতর করে ছুটছে ঊর্ধ্বগতিতে। জ্বর ১০২°। দুর্বল কন্ঠে ও আনমনে আওড়ালো,
‘ বেস্ট ফ্রেন্ড। ‘
‘ আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড খুব হ্যান্ডসাম ম্যাম। ইনি কি সিংগেল?’
চৈত্রিকা জবাব দিতে পারল না সঙ্গে সঙ্গে। নিমগ্ন হলো চিন্তায়। সাফারাত সিংগেল নাকি কেউ আছে তার জীবনে?খুব করে জানতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু ব্যাপারটা খারাপ দেখায়,তাই দমে গেল। দমিয়ে নিল অনুভূতি,ইচ্ছে, স্পৃহা।
নার্স চৈত্রিকার কাঁধের নিচে ড্রেসিং করে দিল। সাফারাতের দিকে চেয়ে বললো,
‘ ম্যাম একটু ফ্রেশ হলে শরীর টা ভালো লাগবে স্যার। আমি নরমাল ওষুধের নাম লিখে দিচ্ছি,এতে জ্বর সেড়ে যাবে।’
‘ থ্যাংকস নার্স।’
সাফারাত চৈত্রিকার দিকে চেয়ে সাবলীলভাবে বললো,
‘ চলুন চৈত্র। ‘
চৈত্রিকা বেড ছেড়ে দাঁড়ালো নড়বড়ে পায়ে। শরীর কাঁপছে মৃদু,মৃদু। সাফারাত সূক্ষ্ম নিঃশব্দ নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে এলো কাছাকাছি। চৈত্রিকা নার্সের দিকে আঁড়চোখে তাকালো। লজ্জিত ভঙ্গিতে বললো,
‘ হাত টা ধরলেই হবে। আমি হাঁটতে পারব।’
সাফারাত হাত মুষ্টিমেয় করে নিল শক্ত করে। নিরবে হেঁটে এসে দু’জনে উপস্থিত হলো আহমেদ সাহেবের কেবিনের সামনের দিকটায়। মিম হন্তদন্ত হয়ে কাছে আসল। বোন কে ফিরে আসতে না দেখে কলিজা টা ভয়ে ছোট্ট হয়ে ছিল এতক্ষণ। তবে চৈত্রিকার গা ঘেঁষে থাকা ছেলেটা কে দেখে চোখ বড়সড় হয়ে এলো মিমের। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
কেবিনের সামনের বেঞ্চে চৈত্রিকা কে বসিয়ে দিল সাফারাত। মিম ভীত সন্ত্রস্ত পায়ে বোনের পাশে বসল। কানের কাছে মুখ নিয়ে ছোট্ট করে বললো,
‘ আপু, সাফারাত ভাই না উনি?’
সঙ্গে সঙ্গে চৈত্রিকা প্রতিউত্তর করল,
‘ হুম।’
মিমের মনে অনেক প্রশ্ন জাগলেও, এই মুহুর্তে তা করল না সে। চোরা দৃষ্টিতে কয়েক পল দেখল সাফারাত কে। একবার সাফারাত কে দেখছে তো,আরেকবার নিজের বোন কে। কেন যেন অঢেল শান্তি অনুভব করছে সে। কারণ টা অজানা। হয়ত বা বোনের সুখের কথা ভেবে।
দিহান হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে দ্রুত পদে আসল সাফারাতের সামনে। চৈত্রিকা ও মিমের দিকে এক নজর চেয়ে পরক্ষণেই সাফারাতের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। সাফারাত দাড়িয়ে আছে ওদের থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে। রাতের নিস্তব্ধতায় হসপিটাল টা ভূতের বাড়িতে পরিণত হয়েছে। কারো পায়ের শব্দও ঝংকার তুলে কর্ণকুহরে। দিহান হাসি হাসি মুখ করে বললো,
‘ ছেলেগুলো কে পেয়ে গেছি ভাই। মোট চারজনই তো ছিল।’
সাফারাত কপাল কুঁচকালো। ভরাট কন্ঠে বললো,
‘ খাতির যত্নে যেন ত্রুটি না হয় দিহান।’
‘ একদমই হবে না। খাবার কার জন্য আনতে বললি?’
‘ চৈত্রর কাছে দিয়ে আয়।’
দিহান খাবারের প্যাকেট টা এগিয়ে দিল চৈত্রিকার কাছে। চৈত্রিকা চমকে গেল। নিল না হাতে। দিহান মিমের হাতে ধরিয়ে দিতে মনে মনে ফুঁসে উঠল মিম। এই ছেলেকে একদম সহ্য করতে পারছে না সে। মুখ দেখেই বার বার বোনকে করা অপমানের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সেদিন যদি পারত তাহলে আচ্ছামতো ধুয়ে দিত সে দিহানের মা’কে। দিহান মিমের নিকষকৃষ্ণ আঁখিযুগলে রাগের
আভাস দেখতে পেয়ে বিস্মিত হলো। পিচ্চি মেয়েটা কি তাকে রাগে,ক্ষোভের অনলে পুড়িয়ে ভস্ম করতে চাচ্ছে! মনে তো হচ্ছে এমনি।
সাফারাত দূরে দাঁড়িয়ে আদেশের সুরে বললো,
‘ খেয়ে নিন চৈত্র। ওষুধ খেতে হবে আপনার। অন্যের জন্য চিন্তা করতে হলেও নিজের সুস্থ থাকা জরুরি। ‘
অনিচ্ছা সত্ত্বেও চৈত্রিকা একটু খেল। যাকে বলে নাম মাত্র খাওয়া। মুখ টা তেঁতো হয়ে আছে। বমি পাচ্ছে তার। কিন্তু সাফারাত ঠিকি বলেছে বাবার জন্য হলেও তার সুস্থ থাকা দরকার। সামনে অনেক দায়িত্ব তার। অনেক। বাবা তো কোনোদিনও নিজের পায়ে দাঁড়াবেন না আর। তাকে বাবার চিকিৎসার খরচ চালাতে হবে। মা,বোনকে আগলে রাখতে হবে। মেহুল থাকলে হয়ত তা-ই করত। মেয়ে বলে সে ঘরের এক কোণে শীর্ণ হয়ে পড়ে থেকে থেকে নিজের পরিবার কে না খেয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরে যেতে দিবে তা অসম্ভব।
দিহান সাফারাতের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
‘ আমাদের আর এখানে থাকা ঠিক হবে না। ভিতরে চৈত্রিকার মা আছেন। আমাদের হঠাৎ এখানে দেখলে খারাপ ভাবতে পারেন। চলে যাওয়ায় বেটার। ওরা এখানে সেফ। রাত একটা বাজছে। চল ফিরে যাই।’
সাফারাত তোয়াক্কা করল না দিহানের কথা এমন ভঙ্গি করল। বড় বড় পা ফেলে এসে দাঁড়াল চৈত্রিকার সামনে। পায়ের শব্দে নত মাথা উপরে তুলল চৈত্রিকা। সাফারাতের বুকটা ধুক করে উঠল যেন। বক্ষে বইতে লাগল শীতল,হিম অনিল। চৈত্রিকার পাশে বসা মিমের দিকে চোখ রাখল। মিম কি বুঝল কে জানে,নিমিষেই উঠে দাঁড়াল। মৌন হয়ে হেঁটে গিয়ে করিডোরের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। নজর রাখল বাহিরে। সাফারাত হাত বাড়িয়ে চৈত্রিকার কপালের চুল গুলো কানের পিঠে গুঁজে দিল। সাথে সাথেই চোখ বুঁজে ফেলল চৈত্রিকা। নেত্রপল্লব কাঁপছে ক্ষীণ। সেদিকে দৃষ্টি মেলে সাফারাত নিষ্প্রভ স্বরে বলে উঠল,
‘ আমি নিচে থাকব। আপনার যখনই আমার প্রয়োজন হবে করিডোরের জানালা দিয়ে শুধু একটা বার হাত বাড়িয়ে ডাকবেন চৈত্র। নিচে যাচ্ছি। খেয়াল রাখবেন নিজের। ‘
শূন্য অনুভূতিতে ছেয়ে গেছে চৈত্রিকার অভ্যন্তর। চক্ষু তৃষ্ণায় খাঁ খাঁ করছে মন। সাফারাত নেই পাশে। চলে গেছে কিছু সময় আগে। চৈত্রিকা তড়িৎ গতিতে জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নিমেষ। সাফারাত দাঁড়িয়ে আছে গাড়িতে হেলান দিয়ে। চক্ষুদ্বয়ের দৃষ্টি উপরের দিক। ঠিক চৈত্রিকার বরাবর। চৈত্রিকা প্রাণ ভরে শ্বাস টেনে নিল নিজের মাঝে। একটুখানি হাসলে কি ক্ষতি হবে?মনটা ফুড় ফুড়ে হয়ে গেছে। হাসবে না সে। আপনাআপনি হাসলে তো সাফারাত বলবে পাগল। দূর হতে দূর মানুষ দু’টো । অথচ একে অপরের দৃষ্টিতে ভাসছে দু’জন অহর্নিশ।
.
.
ধীর গতিতে চন্দ্রমার শেষ লালিমা টুকু মিশে যাচ্ছে ধরাতলে। নিকষকালো অন্ধকার উপেক্ষা করে একফালি রশ্মি ধরণীর বুকে ছুঁয়ে দিতে শুরু করে। হসপিটালে মানুষের চলাচলের পদধ্বনি প্রখর হচ্ছে। বেড়ে চলেছে আস্তে আস্তে। চৈত্রিকা নড়েচড়ে উঠল। ব্যাথায় সমস্ত দেহ বিষিয়ে আছে। পিটপিট করে চোখ মেলতেই চোখে পড়ল নার্সদের ছুটোছুটি। অকস্মাৎ কিছু একটা মস্তিষ্কে উদয় হতেই চৈত্রিকা ছুটে এলো জানালার কাছে। সাফারাত নেই। চলে গেছে বোধ হয়। সারারাত ঘুমোয় নি চৈত্রিকা। ক্ষীণ সময় পর পর শুধু সাফারাত কে অবলোকন করেছে। বন্দী করেছে অক্ষিপটে। ভোর অব্দি সাফারাত ছিল নিচে। মুখখানায় ক্লান্তি,অবসাদ ছিল। চৈত্রিকার একবার বলতে ইচ্ছে করেছিল, আপনি চলে যান সাফারাত। পরমুহূর্তে আবার সিদ্ধান্ত বদলে নেয়। থাকুক না সাফারাত। অসুস্থ শরীর নিয়ে আর জাগ্রত থাকতে পারে না সে। একটু আগে বেঞ্চে বসতেই চোখ লেগে আসে অজান্তেই।
চৈত্রিকার বুক চিরে একটা দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো। মিশে গেল প্রকৃতিতে। এই মুহুর্তে উপলব্ধি করল ভালোবাসা খুব করে পোড়াচ্ছে তার ভিতর। মনে হচ্ছে সে একটু পেয়ে আরেকটু পাওয়ার আশায় লোভী হয়ে উঠছে। ছোট বেলায় তো পড়েছে অতি লোভে তাতি নষ্ট। না সে পারবে না ভালোবাসা পাওয়ার আশায় সাফারাত কে দ্বিতীয় বার হারিয়ে ফেলতে।
___________
বাবার কেবিনে উঁকিঝুঁকি মেরে প্রবেশ করল চৈত্রিকা। ঘুমোচ্ছেন আহমেদ। ফাহমিদা ইশারা করলেন কাছে এসে বসতে। চৈত্রিকা মাথা নাড়িয়ে না করল। মন ভরে চোখের তৃষ্ণা মেটালো বাবার মুখ খানাতে চেয়ে। কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে মন চাইছে না। মনটা শক্ত করে বেরোতে যাবে তখুনি ফাহমিদা বলে উঠলেন,
‘ দাঁড়া চৈত্র,তোর বাবা ডাকছেন তোকে।’
থমকে গেল পা দু’টো। ভয়ের তাড়নায় হৃদস্পন্দন হতে লাগল অস্বাভাবিক। বাবা আবার হাইপার হয়ে যাবে না তো!কি করল সে?কেন এলো কেবিনে!দুরুদুরু বুক নিয়ে আহমেদ সাহেবের দিকে তাকাতে দেখল,তিনি হাত বাড়িয়ে ডাকছে তাকে। ইশারা করছেন কাছে যাবার। চৈত্রিকা নড়ছে না। সত্যিই কি ডাকছে তার বাবা তাকে!
#চলবে,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)
#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___৯
চৈত্রিকার কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে। গরম,তপ্ত নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসছে নাসারন্ধ্র হতে। উত্তাপে হাসফাস অবস্থা। হাঁটছে আর লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলছে। দুপুরের কড়া রোদের চেয়েও যেন তাপের প্রখর প্রদাহ অপরাহ্নে। আজকের বিকেল টা পুরোই অস্বস্তিতে ভরপুর। বাতাসের ছিটেফোঁটা নেই। পানির জন্য হাহাকার। গলা শুকিয়ে কাঠ পুরো। চৈত্রিকা আর এক পাও বাড়াতে পারছে না সামনের দিকে। পুরো দেহ জুড়ে গড়িয়ে যাচ্ছে ঘাম। শ্বাস প্রশ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। তৃষ্ণায় ব্যাথা করছে গলা৷ লাস্ট টিউশন টা করিয়ে বেরিয়ে এল সে। পুরো আধাঘন্টার রাস্তা অতিক্রম করে ভীষণ ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে দেহের প্রত্যেক টা অঙ্গ প্রতঙ্গ। না পেরে ধুলোবালিতে সজ্জিত ফুটপাতে বসে পড়ল। গরমের দাপটে মুখশ্রী অসম্ভব রকম লাল। চোখ জ্বলছে ভীষণ। চৈত্রিকা করুন দৃষ্টিতে সোজা পথের দিকে চেয়ে থাকল। তাকে আরো বিশ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু শরীর!তা যেন আর এক মিনিটের পথ অতিক্রম করতে রাজি নয়।
কথায় আছে -সুস্থ দেহ,সুস্থ মন। দেহ ও মন একই সুতোয় বাঁধা। চৈত্রিকার সাথে তা যেন মিলে গেল অক্ষরে অক্ষরে। শরীরের দুর্বলতা তার মন কে দুর্বল করে দিচ্ছে ক্রমাগত। কোনোভাবেই সামলে উঠতে পারছে না নিজেকে। মনটা কাঁদছে অতি সন্তর্পণে। কিন্তু বহিঃপ্রকাশ করতে নারাজ মেয়েটা। সে উঠে পড়ে লেগেছে এই নিষ্ঠুর ধরায় নিজেকে শক্ত, আবেগহীনা প্রমাণ করতে। জাহির করতে। তবুও হেরে যাচ্ছে। নারী যতই চেষ্টা করুক শক্ত হবার,পাথরে পরিণত হওয়ার। একটা সময় দেখা যায় শক্ত খোলসের মধ্যে নরম মন,মায়া,দরদে ভরপুর। ঠিক যেমন ঝিনুক। নিজের খোলস টা শক্ত হলেও দেহ টা তো বড্ড নরম!
পঞ্চাশ টাকা বাঁচানোর জন্য ক্লান্ত দেহে হাঁটতে রাজি চৈত্রিকা। তার উপর তিনটে মানুষের দায়িত্ব। টিউশনি করে মানুষগুলোর জন্য কিছু করা কঠিন হয়ে দাড়াচ্ছে। প্রতিদিন রিকশা দিয়ে আসা যাওয়াতে অনেক টাকা খরচ হয়। কি হয় নিজের দেহ কে একটু কষ্ট দিয়ে যদি কিছু টাকা বাঁচানো যায়!বাঁচানো যায় বাবা,বোন,মা’কে। তাই তো চৈত্রিকা হেঁটে এসে টিউশনি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজকাল রিকশাচালক রা ভাড়া অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। তারাও তো নিরুপায়। পেটে ভাত জুটাতে হলে এবং ঢাকা শহরে টিকে থাকতে হলে টাকার প্রয়োজন অত্যাধিক। চৈত্রিকার বুক চিঁড়ে দীর্ঘ একটা শ্বাস বেরিয়ে আসতে চাইল। কিন্ত এলো না বরঞ্চ তা দমিয়ে ক্ষীণ একটা শ্বাস ফেলল চৈত্রিকা। কানে এলো একটা ছোট্ট বাচ্চার অনুনয়ের স্বর। আওয়াজ লক্ষ্য করে সেদিকে চক্ষু নিবদ্ধ করে চৈত্রিকা। একটা বাচ্চা মেয়ে পেয়ারা ভর্তা বিক্রি করা লোক কে অনুরোধ করছে,
‘ কাকা একটু ভর্তা দেন। পাঁচ টেহা দিমু আমি।’
মেয়েটার আকুতি ভরা কন্ঠ লোকটার মন গলাতে পারছে না। উল্টো বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে নিচ্ছে লোকটা। ধমকেছে অনেকবার। তবুও বাচ্চা মেয়েটা যেন নাছোড়বান্দা। চৈত্রিকার লাল, রক্তিম মুখ খানায় নিমিষেই একদলা কালো মেঘ এসে জড়ো হলো। লোকটার আচরণে তার মন ক্ষুব্ধ হলো। পাঁচ কিংবা ছয় বছরের ছোট্ট একটা মেয়ে। পড়নে একটা ছেঁড়া জামা। চেহারাটা মলিন,শীর্ণ। চৈত্রিকার মনটা হু হু করে উঠে। নিজের ব্যাগ হাতড়ে পাঁচ টাকার একটা পয়সা ব্যতীত কিছুই পেল না। মাসের শেষ দিন আজ। প্রায় দুইশো টাকা ছিল ব্যাগে,যা আহমেদের একটা ওষুধ কিনতেই শেষ। হতাশ হয়ে উঠে দাঁড়াল সে। কাঁদতে ইচ্ছে করল খুব। কিন্তু একদমই শোভা পায় না ক্রন্দনরত চেহারা। এই বলে নিজেকে নিজেই শাসায় চৈত্রিকা। ঢিমে ঢিমে পায়ে হেঁটে এসে বাচ্চা মেয়েটার পাশে দাঁড়াল। মেয়েটার কপোলে গড়িয়ে যাওয়া মুক্ত দানা গুলো মুছে দেয় যত্ন করে। নিজের হাতের পাঁচ টাকা মেয়েটার হাতে গুঁজে দিয়ে ম্লান হাসল। মৃদু স্বরে বললো,
‘ এবার পেয়ারার ভর্তা দিবে তোমাকে। তোমার হাতের পাঁচ টাকা আর আমার পাঁচ টাকা মিলে দশ টাকা হয়েছে। দশ টাকার ভর্তা দেয়া হয়। এখন আর তোমার দামি দামি অশ্রু গুলো বিসর্জন দিতে হবে না।’
মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠল। ছোট মুখটায় উপচে পড়ছে আনন্দ। খুশিতে চৈত্রিকাকে জড়িয়ে ধরতে এসেও পিছিয়ে গেল এক পা। হয়ত নিজের অবস্থা বুঝে। চৈত্রিকা চিকন চিকন ঠোঁট দুটো প্রশস্ত করে,একটু ঝুঁকে কাছে টানল মেয়েটাকে। মেয়েটা আশ্বাস পেয়ে বুকে মিশে গেল তৎক্ষনাৎ। চৈত্রিকা আলতো কন্ঠে বললো,
‘ তোমার আমার জীবনে তেমন পার্থক্য নেই। দু’জনেই বোধ হয় তৃষ্ণার্ত ওই কাকের মতো,যে কিনা এক ফোঁটা পানির আশায় ছটফট করেছে। আমরাও করছি প্রতিনিয়ত সুখের নেশায়। জানি ধরা দিবে না। এই জীবনে সুখ আমাদের জন্য নয়। কিন্তু আশা রাখতে ক্ষতি কি বলো!’
মেয়েটার ছোট্ট মস্তিষ্কে চৈত্রিকার মুখে উচ্চারিত প্রত্যেক টা শব্দ তরঙ্গিত হলেও বুঝতে পারল না। ভর্তা পেয়ে খেতে শুরু করে। চৈত্রিকা সেদিকে তাকায় না আর এক পলকও। রাস্তা ধরে হাটতে শুরু করে। নিঃশব্দ,সূক্ষ্ম নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে হেঁটে আসে অনেকখানি। এদিকে থেকে দু’টো রাস্তা। বাম দিকের টায় পা রাখতেই কারো চিৎকারে কেঁপে উঠে সমস্ত দেহ। কেউ বোধহয় ডাকছে তাকে। তড়িৎ গতিতে পিছন ফিরে তাকায়। ছোট্ট সেই মেয়েটাকে দেখে প্রচন্ড অবাক এবং বিস্ময়তায় ডুবে যায় নিমেষে। আপা,আপা ডাকতে ডাকতে কাছে এসে উপস্থিত হলো মেয়েটা। হাতে পানির বোতল ও দুই প্যাকেট ভর্তা। চৈত্রিকার দিকে বাড়িয়ে হাঁপানো কন্ঠে বলে উঠল,
‘ আপা লন। আপনের লাইগ্গা এগুলো।’
চৈত্রিকা কিংকর্তব্য বিমূঢ়। হতবাক, হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালো মেয়েটার হাতের দিকে। অপ্রস্তুত হলো অনেকটা। প্রশ্নবিদ্ধ নয়ন জোড়া। মুখে বললো,
‘ আমার জন্য মানে?তুমি এগুলো আমার জন্য কেন আনলে?টাকা কোথায় পেলে?’
‘ এক ভাইয়ে কিনে দিছে আপা। উনিও আপনের মতো বহুত ভালা। আমারেও আরও কিনে দিছে। আপনি লন,আমার গুলো লইয়া আমি বাড়িত যামু। আমার আম্মা পছন্দ করে ভর্তা। ভাইয়ে কইছে আপনের কাছে দিতে এইগুলো।’
চৈত্রিকা নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল। সরব করে বললো,
‘ কে দিয়েছে আমাকে দেখাতে পারবে?’
মাথা দুলিয়ে সায় জানালো পিচ্চি মেয়েটা। তার পিছু পিছু যতখানি পথ পাড়ি দিয়ে এসেছিল ঠিক ততখানি এলো। কিন্তু পেল না মানুষটাকে। মেয়েটা মাথা চুলকে বললো,
‘ চইল্লা গেছে মনে হয় আপা। এডি নেন না। আমি বাসাত যামু।’
অস্থিরচিত্তে মেয়েটার হাত থেকে জিনিসগুলো নিয়ে নিল চৈত্রিকা। কে করছে এসব?কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। মাথা ব্যাথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। গরম হয়ে আছে অনেক। বোতলের মুখ খোলে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে নিল। পিপাসায় কাতর গলা যেন এক পশলা বৃষ্টির ছোঁয়া পেল মুহুর্তে।
.
.
বাসায় ঢুকে টেবিলের উপর প্যাকেটগুলো রেখে দিয়ে অবাক হয়ে গেল। পুরো বাসায় নিরবতার অভাব নেই। কোনো প্রকার শব্দ চৈত্রিকার কর্ণে আসছে না। বাসায় কি কেউ নেই!তাহলে দরজা হালকা করে খোলা ছিল কেন!আস্তে ডেকে যখন কাউকে পেল না তখন জোরে জোরে হাঁক ছাড়তে শুরু করে। মিম পিছন হতে উদ্বিগ্ন স্বরে বলে উঠে,
‘ কি হয়েছে আপু?’
চকিতে ঘুরল চৈত্রিকা। নজর গেল মিমের হাতের কাপড়চোপড়ের দিকে। ছাঁদ থেকে শুকানো কাপড় গুলো নিয়ে এসেছে। মিমের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে পাল্টা প্রশ্ন করে চৈত্রিকা,
‘ মা কোথায়?’
‘ উপরের বাসার ইহছান কাকাদের এখানে।’
চৈত্রিকার ভ্রুঁ কিঞ্চিৎ কুঁচকে এলো। দ্বিধান্বিত চাহনি নিক্ষেপ করল মিমের পানে।
‘ কেন?’
‘ কিছু টাকা ধার চাইতে। বাড়িওয়ালা বলেছেন আজ রাতের মধ্যে টাকা না দিলে কাল সকালে ধাক্কা মেরে বের করে দিবেন আমাদের। বাবা তো হাঁটতে পারে না। তাকে নিয়ে কোথায় যাবো আমরা আপু?কোথায় থাকব?’
মিম ডুকরে কেঁদে উঠল। মেয়েটার মনটা অনেক নরম। কোমলপ্রাণ মেয়েটা। হতে পারে বয়সের কারণে। হয়ত একটা সময় মিমও শিখে যাবে কঠোর হয়ে বাঁচতে। তার মতোই স্যাক্রিফাইস করতে। চৈত্রিকা চোখ বুঁজল।বোনকে জড়িয়ে ধরে কাদতে নিষেধ করে।ঠোঁট চেপে আটকে রাখল নিজের কান্না। চারদিকে এতো কান্নার আহাজারি কেন?কেন এতো কষ্ট পৃথিবীতে? আর সব কষ্টই বা কেন চৈত্রিকার ঘাড়ে চেপে বসল?প্রশ্ন থাকলেও, নেই উত্তর। বাবা কে হসপিটাল থেকে নিয়ে এসেছে আজ চারদিন অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পথে। সেদিন বাবার আদর পেতে গিয়েও পেল না চৈত্রিকা। কাছে গিয়ে বসতেই তার বাবা একহাত তার হাতের উপর রাখে। তৎপরে ফিরিয়ে নেয় মুখ। চৈত্রিকা বিস্তর কষ্ট পেলেও ক্ষীণ আনন্দ অনুভূত করেছিল। ডেকেছিল তো তার বাবা। তা-ই অনেক চৈত্রিকার জন্যে।
_____________
অন্ধকারাচ্ছন্ন রুম। চুপিচুপি ওষুধের পাতা টা বাবার রুমে রেখে এলো চৈত্রিকা। ফাহমিদা মিমের সাথে ঘুমিয়ে গেছেন। এই কয়েকদিনে তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। চৈত্রিকা ধীরে ধীরে নিজের রুমে এলো। সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠে ছোট্ট বাটন ফোনটা। আকস্মিকতায় হকচকিয়ে যায় চৈত্রিকা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত বারোটা বেজে দশ মিনিট। এতো রাতে কে ফোন দিল!মোবাইল হাতে নিতে চোখে ভেসে উঠে অচেনা একটা নম্বর। হয়ত কেউ ভুলবশত তার নম্বরে ডায়াল করে ফেলেছে তা ভেবে ধরল না। কেটে গেল কল একটা সময়। বেজে উঠল পুনর্বার। চৈত্রিকা রিসিভ করে কানে ধরতেই কেউ অস্থির,ব্যগ্র কন্ঠে বলে উঠল,
‘ সময় লাগালেন কেন চৈত্র?এতো অপেক্ষা করাবেন না আমায়। সাথে সাথে কল ধরবেন।’
চৈত্রিকা চমকে গেল। ধরা গলায় বললো,
‘ সাফারাত আপনি?’
‘ হুম। আমি আপনার বাসার গেইটের কাছ থেকে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে আছি চৈত্র। অপেক্ষা করছি আপনার। একটু আসুন না।’
সাফারাতের কন্ঠস্বর জড়িয়ে আসছে। মনে হচ্ছে কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তার। চৈত্রিকা থমকে গেল। হসপিটালের সেই রাতের পর আজ এক সপ্তাহ পর কোথা থেকে উদয় হলো সাফারাত!এতোদিন একটাবারও তার দেখা পায় নি চৈত্রিকা। সাফারাত নিজেকে অমাবস্যার চাঁদ বানিয়ে নিয়েছিল যেন। যার দেখা মিলে না অহরহ, অহর্নিশ।
‘ বাসায় সবাই ঘুমোয় নি চৈত্র?আপনার কি আসতে প্রবলেম হবে?’
সাফারাতের কন্ঠ শুনে চৈত্রিকা নড়েচড়ে উঠল। আবারও জাগ্রত হচ্ছে অনুভূতি। বক্ষে আছড়ে পড়ছে উত্তাল ঢেউ। অন্তস্থল কাপছে দ্রুত বেগে। সাফারাত কখনও জানবে না,সে নিজের আগমনের সাথে চৈত্রিকার বুকে ঝড়ের আগমন ঘটিয়েছে। চৈত্রিকা নরম স্বরে বললো,
‘ প্রবলেম হবে না। আসছি আমি।’
‘ শুনুন! ‘
‘ হ্যাঁ! ‘
‘ আপনার হাতের চা খাবো। বাসায় চা পাতা থাকলে তিন কাপ বানিয়ে আনবেন প্লিজ।’
চৈত্রিকার কপালে ভাঁজ পড়ল। দৈবাৎ স্বরে বললো,
‘ তিন কাপ কেন?’
‘ এলেই বুঝবেন। অপেক্ষা করছি।’
চুপিসারে বিনা শব্দে,বেশ সাবধানে চা বানালো চৈত্রিকা। ফ্লাস্কে ঢেলে নিয়ে মাথায় ওড়না চাপাল। মা আর বাবা দু’জনেই ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছে তাই চিন্তা নেই। আস্তেধীরে বেরিয়ে দরজায় তালা দিয়ে নিচে এলো সে। এখানে এসে বাঁধল আরেক বিপত্তি। চৈত্রিকা ভুলেই গেছে দারোয়ান তো তাকে এতো রাতে বেরোতে দিবে না। কিন্তু সময় আজ যেন চৈত্রিকার বন্ধু। দারোয়ান চেয়ারে মাথা হেলিয়ে গভীর ঘুমে মগ্ন। পা টিপে টিপে হাতে ফ্লাস্ক নিয়ে চৈত্রিকা বেরিয়ে এলো। খানিকটা এগিয়ে আসতেই দেখল সাফারাত দাঁড়িয়ে আছে দূরে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে চৈত্রিকা সাফারাতের উশখুশ চুল,মলিন, অনুজ্জল চেহারা। ধূসর রঙের চক্ষু জোড়া অসম্ভব লাল। ঠিক কৃষ্ণচূড়ার ন্যায়।
#চলবে,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)