[১৮+ সতর্কতা]
গল্পঃ শাপলার মৃত্যু
পর্বঃ ২
জনরাঃ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার
লেখাঃ আতিয়া আদিবা
মনোয়ারা ক্ষণিককাল মকবুলের দিকে তাকিয়ে রইলো। হারিকেনের ভুতুড়ে আলোতেও তার দুচোখে খুঁজে পাওয়া গেলো একরাশ বিস্ময়। নীরবতা ভেঙ্গে সে বিড়বিড় করে আওড়াতে লাগল,
শাপলারে মাইরা ফালাইছে? কি কয় বেডায়?
শাপলারে কেরা মারবো। বেডা মজাক লয়!
আচমকা মনোয়ারা চিৎকার করে উঠলো।
ও শাপলার বাপ! বাইরে আহো। আলাই বালাই! বেডায় কি কয়? শাপলারে বলে মাইরা ফালাইছে। ও শাপলার বাপ কথা হুনো না?
হোসেন ঘুমঘুম চোখে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ঝাঁঝালো গলায় বলল,
ওই হারামজাদী। রাইত বিরাতে এমন চিল্লাইতাছস ক্যান? কি অইছে?
দেহ না মকবুল ভাই কি কইতাছে।
কি কইতাছে?
শাপলারে নাকি মাইরা ফালাইছে।
হোসেন ভ্রুঁ কুঁচকে মকবুলের দিকে তাঁকালো। তার চেহারা জুড়ে আতঙ্ক বিচরণ করছে।
হোসেন লুঙ্গি ঠিক করতে করতে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল,
কি কইতাছেন এসব মকবুল ভাই?
মকবুল বলল,
সত্যি কইতাছি। পূব দিকের নদীর পারে শাপলার লাশ পইড়া আছে। আমি শহরে গেছিলাম কাচামাল কিনতে। ফিরতে সময় দেহি নদীর পারে কেরা জানি শুইয়া আছে। মাইয়া মাইনষের ফরক পরা। কাছে গিয়া দেহি…
মকবুলের কথা শেষ হওয়ার আগেই মনোয়ারা উন্মাদের মত ছুটতে লাগল। তার গন্তব্যস্থল, গাঁয়ের পূর্বের সেই নদীর ধারে।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। হালকা কুয়াশার পর্দা ভেদ করে রোদের নরম আলো ছড়িয়ে পরছে প্রকৃতিতে। শাপলার ধবধবে ফর্সা দেহ এখন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। তার মাথার ডান দিকটা একদম থেতলে ফেলা হয়েছে। রক্ত জমাট বেধে আছে। দু একটি করে মাছি আসতে শুরু করেছে। তারা মহা আনন্দে মৃত দেহের ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনোয়ারা মেয়ের হাত ধরে বসে আছে। গায়ের মাতাব্বরকে জানানো হয়েছে। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে। গ্রামের লোকেরাও সব নদীর ধারে এসে জড়ো হয়েছে।
আধা ঘন্টার মাঝে পুলিশ চলে এলো। ক্রাইমসিন থেকে দ্রুত সবাইকে বের করে দেওয়া হল। ছবি তোলা হলো। আলামত সংগ্রহের কাজ শুরু হল। ইনভেস্টিগেটিং অফিসার রাইসুল পুরো ক্রাইম সিন পরিদর্শন করল। এরপর উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করল,
লাশের কাছে সর্বপ্রথম কে এসেছে?
মকবুল ইতস্তত করে বলল,
স্যার, আমি।
ভেরি গুড। এসে কি দেখেছেন?
স্যার, দেখলাম যে শাপলার লাশ পইরা আছে। চারিদিকে শুধু রক্ত আর রক্ত!
কখন দেখেছেন?
সময় কইতে পারিনা স্যার। কিন্তু মেলা রাইতে দেখছি।
এত রাতে আপনি এখানে কি করছিলেন?
স্যার, বাজারে আমার একটা দোকান আছে। কাচামাল বিক্রি করি। তা আনতেই শহরে গেছিলাম। যেদিন শহরে যাই হেইদিন ফিরতে একটু রাত হইয়া যায়।
অফিসার রাইসুল একটি ছোট্ট পাথরের টুকরা কুড়িয়ে ক্রাইম সিনের চারদিকে দাগ টেনে দিলো। এরপর কঠিন গলায় বলল,
আই সি! ঠিকাছে। আপনারা যে যার বাড়ি ফিরে যান। এই স্থান এখন পুলিশের হেফাজতে থাকবে।
এই দাগের ত্রিসীমানার কাছে যেনো কাউকে দেখা না যায়।
গ্রামের সবাই যে যার বাড়িতে ফিরে গেলো।
অফিসার রাইসুল তার পকেট থেকে ফোন বের করল। কন্টাক্ট লিস্টে গিয়ে একটি নাম সার্চ করল, ‘নিরূপমা চক্রবর্তী’।
*
ঠোঁটের ওপর আরো একজোড়া উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শে নিরূপমার ঘুম ভাঙ্গলো। ইন্দ্রজিৎ প্রতিদিন ঠোঁটে আদর এঁকে স্ত্রীর ঘুম ভাঙ্গায়। সদ্য বিবাহিত নিরূ-জিৎ দম্পতির কেমিস্ট্রি অন্য সকল দম্পতি থেকে বেশ আলাদা। ইন্দ্রজিৎ পেশায় একজন আইনজীবী। এদিকে নিরূপমার ইচ্ছে ডিটেকটিভ হওয়ার। এতদিন সে বেসরকারি একটি গোয়েন্দা সংস্থার সাথে যুক্ত ছিল। তবে এখন সে স্বাধীনভাবে কাজ করতে চায়।
নিরূপমা চোখ মেলে মুচকি হাসি দিলো। ইন্দ্রজিৎও হাসলো। বলল,
ঘুম ভেঙ্গেছে?
ভেঙ্গেছে।
ইন্দ্রজিৎ কফির মগটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
এই নাও তোমার বেড কফি। মানুষ বেড টি খায় আর তুমি খাবে বেড কফি।
নিরূপমা হাই তুলে বিছানায় বসতে বসতে বলল,
তুমি কি সারাজীবন আমাকে বেড কফি খাওয়াবে ইন্দ্র?
এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে তাই এমন সেবা শুশ্রূষা করছি। সত্যি বলতে তোমাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিচ্ছি। কিভাবে ভবিষ্যতে আমার সেবা করবে।
নিরূপমা চোখ পাঁকিয়ে তাকালো। বলল,
ঠিকই আছে। তুমি তো আর লাভ লোকসান ছাড়া কিছু বুঝো না।
ইন্দ্রজিৎ হেসে বলল,
লাভ লোকসান বোঝা ব্যবসায়ীদের কাজ।
তোমার কাজ কি?
কেস জেতা আর বউকে খুশি রাখা!
নিরূপমা ভেংচি কাটল।
হয়েছে। আর মাখন লাগাতে হবে না। চেম্বারে যাবে কখন?
এখুনি বেরিয়ে যাবো।
তুমি নাস্তা করেছো?
জ্বি ম্যাডাম করেছি। আপনার টাও টেবিলে রাখা আছে। খেয়ে নিয়েন।
নিরূপমা বলল,
সো সুইট অফ ইউ।
ইন্দ্রজিৎ সদর দরজা খুলতে খুলতে বলল,
নিরূ, বের হচ্ছি। সাবধানে থেকো।
নিরূপমা শুনতে পেলো ইন্দ্রর গলার স্বর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো।।সে দুহাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলল,
দুগগা, দুগগা।
নিরূপমা কফির মগে এক চুমুক দিয়ে ফোন হাতে নিলো। তিনটি মিসড কল উঠে আছে। মোবাইল স্ক্রিনে নাম দেখে তার শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো।
সে কফির মগ টি টেবিলের ওপর রেখে সাথে সাথে কল ব্যাক করল। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর অপরপ্রান্ত থেকে মোটা গলার স্বর শুনতে পাওয়া গেলো,
মিসেস নিরূপমা চক্রবর্তী। কেমন আছেন?
রাইসুল দাদা। আপনার কথার সুরে কেমন রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। আর রহস্যের গন্ধ পেলে আমার মন খারাপ থাকলেও ভালো হয়ে যায়।
হা হা হা। হাজবেন্ড কোথায়?
মাত্রই চেম্বারে গেলো।
ইন্দ্রজিৎকে আমার পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানিয়ো। ‘স্মৃতি ধর্ষণ কেস’টা জিতে তোমার স্বামী তো দেশের মানুষের সামনে হিরো বনে গেলো!
অবশ্যই জানাবো। তবে কেস জেতাটা কখনোই ইন্দ্রর কাছে মুখ্য বিষয় নয়। জনগণকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দেওয়ার তৃষ্ণায় ছেলেটা কাতর!
বেশ! বেশ। তা তুমি তোমার ফিল্ডে ফিরছো কবে?
আপনি তো জানেন দাদা, কোনো সংস্থার সাথে কাজ করতে আমি ইচ্ছুক নই। অফিস পলিটিক্স ভালো লাগে না। নিজে কিছু করার চেষ্টা করছি।
ইন দ্যাট কেস, আই ক্যান হেল্প ইউ। চারাবাড়ির এদিকে একটা মার্ডার হয়েছে। ছয় বছরের মেয়ে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে মাথায় আঘাতের ফলে মৃত্যু হয়েছে। তবে লাশ ফরেনসিকে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। রিপোর্টের অপেক্ষায় আছি।
আমি আরো বেশ কয়েকটি কেস নিয়ে একটু ছোটাছুটির মাঝে আছি। তুমি যদি চাও ইনভেস্টিগেশনের কাজটা করতে পারো।
নিরূপমার চোখ চকচক করে উঠলো। সে সাথে সাথে বলে উঠল,
দাদা, ক্রাইম সিনটা যেনো কোথায় বললেন?
(চলবে…)