#শাপলার_মৃত্যু (১১ শেষ পর্ব)
১৮+ থ্রিলার
নিরূপমা দেশের সনামধন্য সাইক্রিয়েটিস্ট অমিত সাহার চেম্বারে এসেছে। অমিত নিরূপমার সাথে একই স্কুলে পড়েছে। অল্প বয়সেই সাইক্রিয়েটিস্ট হিসেবে বেশ খ্যাতি কুড়িয়েছে অমিত সাহা।
নিরূপমাকে দেখেই অমিত মুচকি হেসে বলল,
কেমন আছো হে, নিরূ?
নিরূপমাও হেসে উত্তর দিল,
ভালো আছি। দিনকাল কেমন যাচ্ছে তোমার?
আর দিনকাল! পাগলের চিকিৎসা করতে করতে নিজেই এখন ভারসাম্যহীন।
এখনি একথা বললে চলবে? তোমার পথচলা তো সবে শুরু। দেশের নামকরা সাইক্রিয়েটিস্টদের মাঝে তুমি একজন। বিদেশের খ্যাতিমানদের খাতায় নাম লিখাবে না?
অমিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
খ্যাতিমানদের খাতায় নাম লিখাতে এ পেশায় আসিনি। নিজের সবটুকু উজার করে দিতে এসেছি। আশির্বাদ করো যেন নিজের সর্বস্ব উজার করে সর্বস্বান্ত হতে পারি!
নিরূপমা হাত উঁচু করে গম্ভীর স্বরে বলল,
আশির্বাদ করছি। বৎস!
দুজনেই হো হো করে হেসে উঠল।
অমিত বলল,
তা কি কাজে আমার চেম্বারে পদধূলি পড়ল?
নিরূপমা পুরো ঘটনা ব্যাখ্যা করার আগেই অমিতের পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট চেম্বারে প্রবেশ করল। বিরস গলায় বলল,
স্যার, সাব্বির সুইসাইড করেছে।
অমিতের চোখ মুখ থেকে ঝলমলে ভাব মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। সে নিচু স্বরে বলল,
আই নিউ ইট!
এরপর পিএ এর দিকে তাকিয়ে বলল,
ঠিকাছে তুমি যাও।
অমিত টেবিলের ওপর রাখা পানির গ্লাস হাতে নিল। এক নিশ্বাসে পুরো গ্লাস খালি করে ফেলল। নিরূপমা জিজ্ঞেস করল,
আর ইউ ওকে, অমিত?
অমিত একথার উত্তর দিল না। সে বলল,
শারীরিক রোগের চেয়েও বড় এবং ভয়ংকর রোগ হল মানসিক রোগ। শারীরিক রোগের লক্ষণ বাহ্যিকভাবে দেখা গেলেও মানসিক রোগের লক্ষণ বোঝা যায় না। যে ছেলেটার কথা আমার পিএ বলে গেল – সাব্বির। ছেলের বয়স ২৬ বছর। সে সিজোফ্রেনিয়াতে আক্রান্ত ছিল। এই টার্মটার সাথে তুমি কি পরিচিত?
না।
সিজোফ্রেনিয়া এক ধরনের মানসিক রোগ যার ফলাফল ভীষণ ভয়ংকর। রোগীর মনে হয়, তার আশেপাশের মানুষ তাকে মেরে ফেলবে। খাবারে বিষ মিশিয়ে দিবে বা কোনো ক্ষতি করবে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির অডিটরি হ্যালুসিনেশন হয়। গায়েবী আওয়াজ শুনতে পায়। একটা পর্যায়ে গিয়ে সে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং সুইসাইড করে বসে।
সাব্বিরের কি মনে হত?
সাব্বিরের অতিরিক্ত মাত্রায় অডিটরি হ্যালুসিনেশন হত। তার সমসময় মনে হত কেউ একজন ছাদ থেকে লাফ দিতে বলছে। যদি ছাদ থেকে লাফ না দেয় তাহলে তার পরিবারের কারো না কারো ক্ষতি হবে।
নিরূপমা চোখ বড় বড় করে বলল,
কি ভয়ংকর!
ভয়ংকর তো বটেই। একই সাথে বেদনাদায়ক।
আচ্ছা অমিত মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভোগা এসব রোগীদের ক্রাইমের সাথে জড়িত থাকাটা তো অস্বাভাবিক নয়। তাই না?
মোটেও না। সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিজেদের বাঁচাতে অনেক সময় অন্যের খুন করে বসে! তুমি অমরজিৎ এর কথা শুনেছো?
না তো! কে সে?
ক্ষুদে সিরিয়াল কিলার। বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ সিরিয়াল কিলারের ট্যাগ তার শরীরে লাগানো। সর্বপ্রথম খুন করেছে সাত বছর বয়সে। প্রথমে নিজের চাচাতো বোনকে খুন করে, এরপর আরো দুটি খুন। নিজের আট মাস বয়সী ছোট বোনকেও খুন করেছিল অমরজিৎ।
এত ছোট বয়সে এতগুলো খুন?
হ্যাঁ। কারন সে মানসিক রোগে ভুগছিল। রোগটির নাম কন্ডাক্ট ডিসওর্ডার। এ রোগে ভোগা মানসিক রোগীরা অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়।
অমিত, পূর্বে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার ফলে মানসিক রোগে ভোগার সম্ভাবনা ঠিক কতখানি?
সম্ভাবনা বিস্তৃত! ছোট বেলায় ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা অনেক সময় মানসিক রোগের বীজ হিসেবে কাজ করে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেই বীজ থেকে চারাগাছ জন্মায়। ধীরে ধীরে তা বড় হয়। একসময় ডালপালা মেলে রোগীকে কাবু করে ফেলে।
এমন সময় উচ্চ শব্দে মোবাইলের রিং বেজে উঠল। নিরূপমা মোবাইল ক্রিনে জাফরের নাম দেখে দ্রুত কল রিসিভ করল।
জাফর, কোনো খবর পেলেন?
ম্যাডাম, আপনার সন্দেহ সত্যি।
নিরূপমার চোখে মুখে বিজয়ের ছাপ স্পষ্ট। সে বলল,
ঠিকাছে। আজ রাতে আমি আমাদের পরবর্তী প্ল্যানের কথা তোমাকে জানাবো।
নিরূপমা ফোন রেখে অমিতকে বলল,
আই নিড ইওর হেল্প। আমি একটা কেস নিয়ে কাজ করছি। শাপলা নামের সাত বছরের একটি বাচ্চার খুন হয়েছে। রহস্য উন্মোচন করার আগেই দ্বিতীয় খুন হয়েছে। খুন করার পর মেয়েটিকে রেপ করা হয়েছে। খুনি অবশ্যই তৃতীয় খুন করার উদ্দ্যেশ্যে অষ্টপ্রহর ফোঁস ফোঁস করে ঘুরে বেড়াচ্ছে চারিদিকে। আমি ইনভেস্টিগেট করে যতটুকু তথ্য সংগ্রহ করেছি তা তোমার সাথে শেয়ার করতে চাই।
তুমি শুধু সম্ভাবনার হার আমাকে জানাবে।
অমিত সায় জানাল।
নিরূপমা বলতে শুরু করল।
***
রাতে কষা মুরগী দিয়ে ভাত খেতে খেতে ইন্দ্রজিৎ বলল,
নিরূ, রান্না মজা হয়েছে।
তাই নাকি?
হুঁ। মসলা, লবণ সব একদম পরিমিত পরিমাণে হয়েছে।
নিরূপমা হাসল। মুখে কিছু বলল না।
নিরূ, তোমায় বেশ প্রফুল্ল দেখাচ্ছে আজ। কি হয়েছে বল তো!
আগে আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দাও।
কি প্রশ্ন?
ক্রাইম জেনারেশন টু জেনারেশন পাস করার পসিবিলিটিস কেমন?
দেখো, এই বিষয়টা কন্ট্রোভার্শল। স্কলারদের মতে জেনারেশন টু জেনারেশন ক্রাইম পাস হয়। যেমন ইউএসএ এ তে এমন একটি পরিবার ছিল। ২০/৩০ জন করে একই ক্রাইমের সাথে যুক্ত ছিল তারা। সঠিক সংখ্যাটা মনে নেই।
ক্রাইমের করার জন্য পরিবেশও অবশ্যই দায়ী?
সেটাতো অবশ্যই। সোসাইটি, এনভেরনমেন্ট, ক্লাইমেটস, জিয়োগ্রাফিকাল লোকেশন সবই কিন্তু ক্রাইমের জন্য দায়ী। বাংলাদেশে ক্রাইমগুলোর পেছনে একটি ভাইটাল কারণ কি জানো?
দারিদ্রতা?
এটা তো আছেই! তবে আরো একটি ভাইটাল কারণ হচ্ছে ওয়েদার। কনকনে ঠান্ডায় বা তপ্ত গরমে অফেন্ডাররা খুব একটা সুবিধা করতে পারে না। বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান এসকল সাউথ এশিয়ান কান্ট্রিগুলোর ওয়েদার ক্রাইম কমিট করার অন্যতম কারণ।
ইন্টারেস্টিং!
আই নো রাইট। তবে তুমি যেটা বললে ক্রাইম জেনারেশন টু জেনারেশন বিস্তৃতি লাভ করে, এর জের ধরে ইউ এস এ’র সুপ্রিম কোর্ট কোনো এক কালে ক্রিমিনালদের বংশরোধের ব্যবস্থা করেছিল। তবে, এই সিদ্ধান্ত বেশিদিন বহাল রাখতে পারে নি। কারণ সিদ্ধান্তটি হিউম্যান রাইটস কে ভায়োলেট করে।
বুঝলাম। ইন্দ্র, শাপলা কেসের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছি আমি। খুনি শিঘ্রই ধরা পড়বে।
কি বলছ এসব?
হুম। রেপিস্ট ধরা পড়ে গেছে।
কি বলছ?
হুঁ। এখন ওই আমাদের সাহায্য করবে খুনির দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে।
ইন্দ্রজিৎ বহুদিন পর নিরূপমার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা দেখতে পেল।
***
সন্ধ্যা থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। নিরূপমার কথা মত সকল কনস্টেবলদের বিদায় দিয়ে দেওয়া হল। গ্রামে কোনো পুলিশের গাড়িও রইল না। ডা. অমিত, ইন্দ্রজিৎ, জাফর এবং নিরূপমা এই চারজন শুধু রয়ে গেল। নিরূপমা জাফরের দিকে তাঁকিয়ে বলল,
জাফর আপনি অমিতকে নিয়ে আপনাদের গন্তব্যস্থলে চলে যান। আমি আর ইন্দ্র এদিকটা লক্ষ্য রাখছি।
ঠিকাছে ম্যাডাম।
জাফর অমিতকে নিয়ে চলে গেল। নিরূপমা এবং ইন্দ্র একটি গাছের পেছনে লুকিয়ে রইল।
ঘড়িতে তখন ৯ঃ৩০ বাজে। সামাদ সাহেব তার মেয়েকে ডাক দিল।
ও পারুল! ও পারুল!
জ্বি আব্বা?
মকবুলের দোকানে যা। একটা বাদামী রঙের প্যাকেট দিবো। হেইডা লইয়া আয়।
সামাদের গলার স্বর শুকনো শোনা গেল।
আইচ্ছা আব্বা- বলে পারুল বাড়ির বাহিরে বেরিয়ে এল।
বাড়ির পাশের ঝোঁপে পারুলের জন্যই অপেক্ষা করছিল মনোয়ারা। পারুল বাড়ির থেকে একটু দূরে যেতেই সে পেছন থেকে পারুলের মুখ চেপে ধরে।
পারুল অসহায়ের মত হাত পা ছুঁড়তে থাকে। নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করে। তবে ফলাফল ব্যর্থতার দুয়ারে গিয়ে মিলিয়ে যায়।
জাফরের কল পেয়ে নিরূপমা ইন্দ্রজিৎকে বলল,
ইন্দ্র, শি ইজ কামিং!
তারা দুজনেই সেই স্থান পরিত্যাগ করল। মনোয়ারা পারুলকে নিয়ে নদীর ধারে চলে এসেছে। নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পারুল এখন ক্লান্ত। মনোয়ারা বাম হাত দিয়ে পাথর তুলে যেই পারুলের মাথায় মারতে যাবে সাথে সাথে জাফর এসে তার হাত ধরে ফেলল। ইন্দ্রজিৎ আর নিরূপমাও তার সাথে যোগ দিল।
মনোয়ারা মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করছে। পাগলের মত হাত পা ছুঁড়ছে। নিরূপমা অমিতের দিকে ইশারা করল। অমিত পকেট থেকে একটি সিরিঞ্জ বের করল। ছোট্ট কাচের শিশি ভেঙ্গে ঘুমের ওষুধ সিরিঞ্জে ভরে মনোয়ারার হাতে পুষ করল। মনোয়ারার শরীর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে গেল।
হোসেন এবং সামাদ দূর থেকে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছিল। বিপদ কেটেছে বুঝতে পেরে দুজনেই স্পটে চলে আসল।
সামাদ দৌঁড়ে এসে নিজের মেয়েকে জড়িয়ে ধরল। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।
জাফর সামাদ সাহেবের পিঠ আলগোছে চাপড়ে দিয়ে বলল,
আপনি একজন যোদ্ধা, মশাই! আপনার সাহায্য ছাড়া রহস্যের জট খোলা সম্ভব হত না।
নিরূপমার গায়ে মনোয়ারা ঢলে পরেছে। সে জাফরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
জীপের ব্যবস্থা কর। আমাদের দ্রুত হসপিটালে যেতে হবে।
****
নিরূপমা ইনভেস্টিগেটিং অফিসার রাইসুলের সামনে বসে আছে। তার হাতে এক কাপ চা।
রাইসুল বলল,
কনগ্রেচুলেশন্স নিরূপমা। তোমার প্রথম ইন্ডিপেন্ডেন্ট কেস। আর তুমি খুব সুন্দরভাবে সলভ করেছো।
নিরূপমা হেসে বলল,
ধন্যবাদ রাইসুলদা।
কিন্তু এত জটিল কেস কিভাবে সলভ করলে বলো তো?
এক রাতেই রহস্যের জট খুলে গেল রাইসুলদা। আসলে প্রতিটি ক্রাইমের ক্লু আমাদের চোখের সামনেই ঘোরাফেরা করে। আমরাই এড়িয়ে যাই।
কিভাবে?
তবে বলছি শোনো।
গ্রামের সবার সাথে কথা বলে এতটুকু বুঝতে পেরেছিলাম তারা কেউ অন্তত খুনের সাথে জড়িত না। তবে শাপলার মায়ের আচরণ আমার কাছে অদ্ভুত লেগেছে। মেয়ের মৃত্যু তাকে খুব একটা কাবু করতে পারেনি। তার ফ্যাকাশে চেহারা, উদাসীনতা, জেসচার সবকিছুই মানসিক রোগের দিকে ইঙ্গিত করছিল। এটা ছিল প্রথম ক্লু। সেসময় সন্দেহের তীর অনেকের দিকে ছিল। তাই ক্লুটা এড়িয়ে যাই।
দ্বিতীয় ক্লুটি হলো, মনোয়ারা বেগম বাঁ-হাতি। তাকে আমি সব কাজ বাঁ হাতে করতে দেখেছি। ভিক্টিম দুজনকেই পাথর দিয়ে মারা হয়েছে। এবং পাথরের অবস্থান ছিল বডির ডান দিকে। আমরা যখন বা হাত দিয়ে কোনো বস্তু ছুঁড়ি সেটি ডান দিকে গিয়ে পড়ে। আর ডান হাত দিয়ে কিছু ছুঁ্র,র,ড়ে ফেললে বা দিকে।
সন্দেহ আরো বেশি পোক্ত হল যখন জাফরকে মনোয়ারার বাড়িতে খোঁজ নিতে পাঠালাম এবং অজানা এক তথ্য জানতে পারলাম।
রাইসুল জিজ্ঞেস করল,
কি তথ্য?
মনোয়ারা ছোটবেলায় ধর্ষণের শিকার হয়েছিল।
ও মাই গুডনেস! কি বলছ?
হুঁ। এর কোনো বিচার হয়নি। কারণ ধর্ষক ছিল গ্রামের মাতাব্বরের আম বাগানের মালি। মনোয়ারার বাবার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে পুরো বিষয়টাকে মাটি চাপা দিয়ে ফেলা হয়।
মনোয়ারার অতীতের সাথে কেসের কোনো ক্লু আছে ভেবেই তার সম্পর্কে খোঁজ নিতে বলি। মনোয়ারার মানসিক সমস্যার বিষয়টা নিয়ে আমার বন্ধু ডা. অমিতের সাথে কথা বলি। ইনভেস্টিগেশনের ফলাফল যা পাই তা অনেকটা এরকম-
অতীতের ট্রমা না কাটার ফলে একটি অদ্ভুত মানসিক রোগ মনোয়ারার মাঝে জন্মায়। DID অর্থাৎ ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার। এর লক্ষণ প্রকাশ পায় তার মেয়ে শাপলা মকবুলের কাছে সেক্সুয়াল এসল্টের শিকার হওয়ার পর। মনোয়ারা বিবাহিত জীবনে সুখী ছিলনা। অতীতের সেই ভয়ংকর ঘটনাও ভুলতে পারছিল না। মেয়ে এসল্টের শিকার হওয়ার পর তার মনে হতে থাকে, শাপলাও ধর্ষণের শিকার হতে পারে। তার মেয়ের জীবনটাও তার মত কষ্টের হতে পারে। তাই তাকে মেরে ফেলা উত্তম।
শুধু তাই নয়, মনোয়ারা এভাবে চিন্তা করতে থাকে যে শাপলার বয়সী সবাইকে মেরে ফেলা উচিত যাতে তারা কেউই সেক্সুয়াল এসল্টের শিকার না হয়। যার ফলাফলস্বরূপ আমরা গ্রামে দ্বিতীয় অর্থাৎ রিনার মার্ডার হতে দেখেছি। পারুলের বয়স যেহেতু কাছাকাছি ছিল তাই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম নেক্সট টার্গেট সেই হবে। সামাদ সাহেবের সাথে এবিষয়ে কথা বলতে জাফরকে পাঠাই। তাকে আমাদের প্ল্যান সম্পর্কে বিস্তারিত বলি। পারুলকে নকল টার্গেট হিসেবে মনোয়ারার সামনে রাখতে চাই। প্রথমে রাজি না হলেও পরবর্তীতে সামাদ সাহেব রাজি হয়ে যায়।
সেদিন রাতে ইচ্ছে করেই হোসেন সাহেবের বাসায় যান সামাদ। এবং মনোয়ারাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেন, একটি গুরুত্বপূর্ণ প্যাকেট মকবুলের দোকানে ফেলে এসেছেন তিনি। বাতের ব্যাথার কারণে তিনি আর এই রাতে বাজারে যাবেন না। এটি আনতে পারুলকে পাঠাবেন। বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যে ছিল। পুলিশের গাড়ি, কনস্টেবল কিছুই ছিল না গ্রামে। ক্রাইম কমিট করার মত এরকম সুযোগ আর দ্বিতীয়টি পেতেন না মনোয়ারা। জাফর অবশ্য আমার বন্ধু অমিতকে নিয়ে প্রথম থেকেই মনোয়ারার ওপর নজর রাখছিল।
তবে সেই সাদা শাড়ি পরা অবয়বটি?
মনোয়ারা বেগমের বাড়ি সার্চ করে সেই সাদা শাড়ি পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, নিজের পরিচয় গোপন রাখতে এবং গ্রামের মানুষদের মনে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করার জন্য সাদা শাড়ি পরে ঘুরতেন তিনি। ডিফেন্স মেকানিজম হিসেবে ব্যবহার করেছে। DID এর জন্য মানুষের পার্সোনালিটি চেঞ্জ হয়। বুদ্ধি তো আর কমে যায় না!
কথাটি বলে নিরূপমা হেসে উঠল। রাইসুলও হাসল।
তবে নিরূপমা, রিনাকে তো রেপ করা হয়েছিল।
নিরূপমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
মকবুল।
ওকে কিভাবে ধরলে?
এক্ষেত্রে আমায় ভগবানই সাহায্য করেছেন। আমার একটুও খাটতে হয়নি। আমার বাসায় কদিন আগেই একটি নোংরা চিঠি এসেছিল। সেই চিঠিটা আমার এক গ্র্যাফোলজিস্ট বন্ধুর কাছে পাঠাই। সে হ্যান্ডরাইটিং এনালাইসিস এক্সপার্ট। হাতের লিখা দেখে ক্রিমিনাল টেন্ডেনসির কথা বলতে পারে। তার পরামর্শ নিয়ে একটি সার্ভে করিয়ে ফেলি গ্রামের কতজন লিখতে পড়তে পারে এর ওপর। খুব কম সংখ্যক মানুষই খুঁজে পেয়েছিলাম যারা নিজের নাম লিখতে পারে। এর মাঝে মকবুলও ছিল। তার পূর্ব কর্মকান্ডের জন্য সন্দেহ জেঁকে বসে। পুলিশের বেতের কয়েক ঘাঁ পিঠে বসাতেই চিঠির কথা উগলে দেয়। সাথে রিনার বিষয়টিও।
রাইসুল হেসে বলল,
তোমার প্রথম কেসটাই কতটা ইন্টারেস্টিং দেখেছ, নিরূ? আর কত সুন্দরভাবে পুরো কেসটা সলভ করেছ তুমি।
সবই ভগবানের আশির্বাদ!
এখন দেখা যাক মনোয়ারা আর মকবুলের কি হয়।
নিরূপমা হেসে বলল,
চা টা ঠান্ডা হয়ে গেছে রাইসুলদা। আরেক কাপ আগুন গরম চা পাওয়া যাবে কি?
********
নিরূপমা এবং ইন্দ্রজিৎ বারান্দায় পাতলা চাদর জড়িয়ে বসে আছে। নিরূপমা জিজ্ঞেস করল,
আচ্ছা ইন্দ্র, মনোয়ারা আর মকবুলের কি শাস্তি হতে পারে?
হয়তো বছর কয়েকের ইম্প্রিজনমেন্ট! মকবুল এবং মনোয়ারা দুজনেই মানসিক রোগী। তবে এই অজুহাতে ক্রিমিনালরা পানিশমেন্ট এড়িয়ে যেতে পারবে না। শাস্তি সবার প্রাপ্য।
হুম।
ইন্দ্রজিৎ বৌকে জড়িয়ে ধরে বলল,
মন খারাপ?
মনোয়ারার জন্য খারাপ লাগছে। একজন মেয়ে কতটুকু আঘাত পেয়ে এরোগে আক্রান্ত হয়েছে! তার মনে হয়েছে মরে গেলেই মেয়েগুলো বেঁচে যাবে। শাপলার গল্পে মনোয়ারা ভিলেন হলেও, তার নিজের গল্পে সে হিরো!
ইন্দ্রজিৎ আদুরে গলায় বলল,
ঠিক বলেছো। আর আমার জীবনের গল্পে তুমি হিরো।
নিরূপমা হাসল।
ইন্দ্রজিৎ বলল,
এই নিরূ! একটা গান গাও তো।
নিরূপমা গলা ছেড়ে গান ধরল,
প্রাণ ভরিয়ে, তৃষা হরিয়ে
মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।।
এখন জোনাকি পোকার দিন নয়। তবুও কোথা থেকে দুটো জোনাকি পোকা নিরূপমাদের বাড়ির বারান্দায় উড়তে লাগল। নিরূপমা ভাবল, শাপলা আর রিনাই বুঝি জোনাকি হয়ে উড়ছে!
সমাপ্ত।
লিখাঃ আতিয়া আদিবা