ভালোবাসা ১৫তম_পর্ব

0
571

ভালোবাসা
১৫তম_পর্ব
#মৌসুমি_চৌধুরী

বিজুকে নিয়ে আর পারা গেলো না, আরো এক বোতল যে শালা লুকিয়ে রেখেছিলো তা কে জানতো! সুজন চলে যেতেই যখন আমরা বেরিয়ে গিয়ে তার বাড়ির মাঝ রাস্তা অব্দি পৌছেছি, ঠিক তখনই শালা তার জ্যাকেটের পকেট থেকে ছোট এক বোতল ভদকা বের করে ঢকঢক করে গিলে ফেললো। চোখের পলকে যে সে এমন কান্ড করবে তা আজাদ ভাবতেও পারেনি। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকে ফের সম্বিৎ ফিরতেই সে বললো, বিজয়…এনাফ ইজ এনাফ, থামবি নাকি কষে মারবো এক চড়?

বিরবির করে কি বলছিলো ঠিক বোঝা যাচ্ছিলো না। তাই ওর মুখের কাছে কান নিয়ে শোনার চেষ্টা করতেই ভকভক করে যে মদের গন্ধ আসছিলো তা টের পেলো। অস্পষ্ট স্বরে বিজু সেই একই প্রলাপ বকছিলো, আমার যা বলার আমি বলবোই…আমি কি কারোকে ভয় পাই!!! তুই ভাবিস কি আমাকে আজাদ? এই বিজু কারো ভয়ে থাকেনা।

ফের আজাদ বললো, শালা আরেকবার উল্টোপাল্টা বকলে তোকে বেদম পিটুনি দেবো। ওর কথা শুনে বিজু হঠাৎ অকারণেই হাসতে শুরু করলো। অত রাতে ফাঁকা রাস্তায় তার অট্টহাসির আওয়াজ শুনে কেমন জানি আতঙ্কিত বোধ করছিলো আজাদ। তাই একসময় সে বিজয়কে ধাক্কা দিয়ে বললো, হয়েছেটা কি বল তো? বাড়ি ফিরে গিয়ে কোন হুজ্জত করবিনা আর…নইলে কিন্তু ভালো হবেনা বলে দিলাম।

বিজু হঠাৎ যেন ভয়ে কুচকে যাওয়ার ভান করে তার মুখে আঙ্গুল ঠেকিয়ে চুপ থাকার আশ্বাস দিলো, কিন্তু পরক্ষনেই ফের হাসতে শুরু করে বললো…এর চেয়ে ভালো আমায় মেরেই ফেল, সব ল্যাটা চুকে যাক।

আজাদ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, পরে হুশ ফিরলে আফসোস করবি রে বিজয়…মুখ থেকে কথা একবার বেরিয়ে গেলে তা আর ফিরিয়ে নেয়ার কোন উপায় থাকেনা। শেষে সব হারাবি তুই, ভাই-ভাবী দু’জনকেই। আর মা, তার কথা ভেবেছিস…উনি জানলে যে ভীষণ কষ্ট পাবে, সেটা কি তুই বুঝতে পারছিস না?

বিজু একটুক্ষণ চুপ থেকে ফের বললো, অরু মাকে কখনো কষ্ট দেবে না। মা কষ্ট পায় এমন কিছু ও করতে পারে না। সে কিছুই জানাতে যাবে না। মাকে বলার হলে বহু আগেই কিছু বলতো। তা যখন করেনি তখন বোঝাই যায় যে সে খুব সমঝদার, বলে আর কথা শেষ না করেই ভাবনায় হারিয়ে গেলো।

আজাদ বললো, তোর ভাই তোকে কত বিশ্বাস করে ভাবীর দায়িত্ব দিয়ে গেছে, আর তুই এখন এসব করলে কি তার বিশ্বাস নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হবেনা!ভাইকে মুখ দেখাবি কি করে বিজয়? তার সরল মনের বিশ্বাস আর ভালোবাসার এই প্রতিদান দিস না…নইলে আর কোন ভাই কোনদিন তার ভাইকে বিশ্বাস করার আগে শতবার ভাববে…ভাই আমার, এমন করিসনা।

বিজু চুপ করে দূরে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো। কিছু না বলেই ফের বাকিটা পথ চলতে লাগলো। বাড়ির কাছাকাছি যেতেই আজাদ বললো, ঘরে গিয়েই শুয়ে পড়বি কেমন…

সে হাত দিয়ে চোখের জল মুছে নিয়ে মৃদু হাসলো। ওদের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়তেই অরু এসে দরজা খুলে দিলো। দেখে মনে হলো, বিজু ফেরার অপেক্ষায় বোধহয় দরজার কাছেই কোথাও বসে ছিলো। আজাদকে এই অসময়ে দেখে হঠাৎ একটু যেন অবাক হলো…তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, মার ঘুমের যাতে অসুবিধে না হয় তাই এখানেই পড়ছিলাম।

আজাদ তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে নিজের আগমনের হেতু বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলো এভাবে…ভাবী আসলে হয়েছে কি, বন্ধুরা মিলে বাজি ধরে চ্যালেঞ্জ করায় বিজু একটু বেশিই ড্রিংক করে ফেলেছে। আগে কখনো ওসব খায়নি বোধহয় তাই ড্রাঙ্ক হয়ে গিয়েছে। কোনদিন আমি অন্তত দেখিনি। বলছিলাম কি ওকে বরং ওর ঘরে শুইয়ে দিয়ে যাই, সকাল নাগাদ নেশা কেটে যাবে।

ফের আর দেরি না করেই ঘরে ঢুকে অরুর দেখিয়ে দেয়া রুমটায় বিজুকে খাটে শুইয়ে দিলো। তারপর বললো, রাতে আর কিছু খাবার দরকার নেই ওর।

অরু বললো, না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়বে!!!

আজাদ বললো, ওসব খাওয়ার অভ্যেস নেই তাই এখন আর কিছু খেলে বমি করে ভাসাবে। তারচেয়ে বরং সকালে উঠে একবারে নাস্তা করুক। অনেক রাত হয়ে গেছে আমি তাহলে আসি, বলে আর দাঁড়াতে চাইলো না।

অরু ভদ্রতাসূচক একটা হাসি দিয়ে মাথা নেড়ে অনুমতি দিলো।

ফেরার সময় গোটা রাস্তায় আজাদের মনে পড়ছিলো বিজুর ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা, হতভাগাটা প্রেমে পড়ার আর মানুষ পেলো না!!!

আমি বিজু, দরজা খুলতেই অরুকে দেখে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম…খুব সুন্দর করে সেজেছে সে। কার জন্যে? আমার জন্যে তো নিশ্চয়ই না। দাদা আসবে ভোরে, তাই বুঝি রাত থেকেই তার প্রস্তুতির আয়োজন শুরু। কি তীব্র প্রতীক্ষায় সে প্রহর গুনছে কে জানে…দাদার আগমন আমার জন্যে যতটা বেদনার তার জন্যে ঠিক ততটাই আনন্দের।

আজাদ বাড়ি চলে যেতেই দরজা আটকে অরু ফের আসলো আমার কামরায়। মাথার কাছের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, তোর ঘুম আসছেনা বুঝি? পেটে খিদে থাকলে ঘুম আসবে কি করে বলতো!!! আচ্ছা। ডাইনিং রুমে গিয়ে বস তুই, আমি খাবার গরম করে দিচ্ছি…বলে চলে যেতে নিতেই আমি উঠে গিয়ে তার হাত দুটো ধরে ফের বসিয়ে দিলাম।

তারপর বললাম, কোথাও যেতে হবেনা তোর… চুপচাপ বসে থাক।

অরু বিস্ময় গোপন করতে না পেরে বললো, তুই ঠিক আছিস তো?

বিজু শুকনো হাসি হেসে বললো, একমিনিট বোস…আমি আসছি।

তারপর ফিরে এসে খাটে বসে অরুর হাত দুটো টেনে নিয়ে বালা পড়িয়ে দিতেই সে চমকে গিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে।

আমি হেসে বললাম, তোর জন্যেই কিনেছিলাম… দেবো দেবো করে আর দেয়া হয়নি।

ঘটনার আকস্মিকতায় অরু যেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেছে…সেটা মনে হলো দেখে ফের আমি বললাম, তোর ফেয়ারওয়েল গিফট।

অরু হাসিমুখে বললো, অত দামি জিনিসের কোন প্রয়োজন ছিলো না।

তুই মানুষটাই যে ভীষণ দামী…মুখ ফসকে হঠাৎ বলে ফেললাম আমি।

তারপর আবার নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, কোনদিন তো ভালো কিছু তোকে দিতে পারিনি তাই শেষ উপহারটি যেন অনেকদিন সাথে রাখতে পারিস সেজন্যে…আর তাছাড়া দেখে কিনতে ইচ্ছে করলো খুব, তোর হাতে মানিয়েছে বেশ।

অরুর চোখে যেন একবিন্দু জল দেখতে পেলাম। সে বললো, ভাত খাবি চল।

আমি বললাম, আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করছেনা… এখানেই নিয়ে আয়।

সে উঠে চলে গেলো, তারপর যখন ফিরলো তখন তার হাতে ধোয়া ওঠা এক থালা ভাত।

আমি তার দিকে একনজরে চেয়ে থেকে বললাম, অরু তোকে একটা কথা বললে রাখবি আমার?

কি কথা…বল?

আমায় খাইয়ে দিবি আজ…

অরু একটুখানি ইতস্তত করলেও ফের ভাতের থালায় হাতের আঙুল দিয়ে লোকমা তুলে আমার মুখের সামনে ধরতেই আমার চোখে জল এসে গেলো। কয়েক লোকমা গিলতেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। আমি তাড়াতাড়ি চোখ মুছে হাসি হাসি চেহারা করে বললাম, আর লাগবেনা…তুই যা, বাকিটা আমি পরে খেয়ে নিতে পারবো।

ফের অরু চলে যেতেই মনে হলো, বুকের ভেতরটা যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। শেষরাত অবধি শুয়ে থেকে চোখ লেগে আসলো। যখন ঘুম ভেঙেছে তখন বলতে গেলে বেলা বাড়ছে। আমি ছাদে গিয়ে একটা সিগারেট ধরাতেই, মাথার ওপর সূর্য তাই রোদে যেন মাথা ঘুরে উঠলো। ঘরে ফিরে দেখি, টেবিলের ওপর লেবু জল রাখা। বুঝলাম এটা অরুরই কাজ। কিন্তু সে আমার সামনে আর আসছেনা দেখে মনে হলো, কাল রাতে আমার না বলাতেও যেন অনেক বেশি কিছু বলা হয়ে গেছে আর তাই সে সামনে আসতে অস্বস্তিবোধ করছে হয়তো…

ফ্রেশ হয়ে নিয়ে, গতকালের পোশাক পাল্টে, লেবু জল খেয়ে রেডি হয়ে নিলাম। অরুর সাথে দেখা হবার আগেই বেরিয়ে পড়তে চাইছিলাম যেন…মার কাছ থেকে তাই রওনা দেবার আগে দাদার কোন কল এসেছিলো কিনা জিজ্ঞেস করে, ফ্লাইট ল্যান্ড করার টাইম জেনে নিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে ছুটলাম আমি দাদাকে রিসিভ করতে।

#চলবে…

কপি করা নিষেধ, লেখা অন্যত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here