প্রিয়_ডাক্তার – ১

0
2740

#প্রিয়_ডাক্তার – ১
লেখিকা – #আভা_ইসলাম_রাত্রি
জনরা- রোমান্টিক

আদর এবং মহুয়ার ভালোবাসার কাহিনীটা শুরু হয়, যখন মহুয়া মাত্র দশম শ্রেণীতে পড়ে। সদ্য বয়ঃসন্ধিকালে পা দেওয়া মহুয়া তখন চুলে বেনুনি গেঁথে মাথা নিচু করে স্কুলে যেত। ছেলেদের থেকে মহুয়া সর্বদা দূরে থাকত। বাবার কঠোর আদেশ ছিল, ছেলেদের সাথে না মেশার। মহুয়ার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, একদা এক ছেলে মহুয়াকে একটা জায়গায় ঠিকানা জিজ্ঞেস করেছিল। সরল মহুয়া ঠিকানা বলে দিয়েছে বলে, মহুয়ার বাবা মহুয়াকে কি মার’ই না মেরেছিল। মহুয়ার পিঠ এখনো বহন করছে সে মা’রের দাগ, ক্ষত! বাবা সর্বদা মহুয়াকে মা’রেন, মহুয়ার মায়ের উপরও যখন তখন হাত তুলেন। মহুয়ার মা মুখ বুজে সবটা সহ্য করেন। মহুয়াও কিছু করতে পারে না। তবে মহুয়া ভেবে রেখেছে, একদিন মহুয়া অনেক বড় হবে। নামি দামি চাকরি করবে। তারপর বাবাকে এই গ্রামে একা ছেড়ে মাকে নিয়ে পাড়ি জমাবে বহুদূরে। তারপর, মা আর মহুয়া মিলে তাদের এক সুন্দর সংসার হবে। ছোট্ট মহুয়া শুধু স্বপ্নই দেখে যায়, পূরণ করার সাধ্য যে তার নেই।
মহুয়াদের গ্রামে ছিল এক ডাক্তার বংশী। তাদের বাপ দাদা সবাই শহরের বড় বড় প্রতিষ্ঠানে ডাক্তারি করছে। আদর সেই বংশেরই ছেলে। ঢাকা মেডিকেলে অধ্যয়নরত। সে কি সুন্দর দেখতে। গ্রামে যখন আসে, মেয়েরা পাগল হয়ে চেয়ে থাকে। কল্পনা করে, হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিতে চায়। অথচ কেউ পারে না। আদরের ভীষন খারাপ মেজাজ কি না! সবাই ভয় পায়। মহুয়াও পায়। মহুয়ার বন্ধু সাথীও পায়। মহুয়া তার নাম রেখেছে, ভয়রাজ অর্থাৎ ভয়ের রাজা। এই ভয়রাজ যেখানে যায় ভয়রা যেন তাণ্ডব করে। মাথা নত করে কুর্নিশ করে তাকে। মহুয়া যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে, আদরের গ্রামে তখন বেশ দাপট। অবশ্য তাদের বংশেরই অনেক দাপট পুরো গ্রাম জুড়ে। আদর একদিন মহুয়ার পথ আটকে দাড়ায়। ধমক দিয়ে নাম ধাম জিজ্ঞেস করে। থরথর করে কেঁপে মহুয়া বলে তার বাবার দেওয়া নাম। আদর আর কিছু বলে না। চুপচাপ রোদ চশমা পড়ে বাইকে করে চলে যায়। এই ছিল আদর মহুয়ার প্রথম দেখা। প্রথম দেখাটা অবশ্যই স্মৃতিমধুর হয়। তবে মহুয়ার বেলায় হয় নি। বরং হয়েছে স্মৃতিতিক্ত। কারণ আদরের সাথে একটু কথা বলায়, মহুয়ার বাবা মদ খেয়ে সেদিন মহুয়াকে ভীষন মে’রেছিল। হাত ফুলে গিয়েছিল, শরীরের ব্যথায় তিনদিন বিছানা ছাড়তে পারেনি। তারপর ধুম করে একদিন জ্বর উঠে। মহুয়ার কি যে কষ্ট হয়েছিল তখন। কিছু খেতে পারতো না, শরীরের ব্যথায় ঘুমাতে পারত না, শুধু চোখের জল ফেলত। আদর তখন তৈরি হচ্ছে ঢাকা যাওয়ার জন্যে। অত্যন্ত মেধাবী হওয়ায় আদরের ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়ে যায়। মহুয়ার জ্বর উঠার পরদিন হঠাৎ যেন কোথা হতে ঝড়ের গতিতে আদর মহুয়ার বাড়িতে পা রাখে। এত বড় ঘরের ছেলেকে নিজেদের গরীব ঘরের দেখে মহুয়ার মা লজ্জায় মুখ তুলে চাইতে পারেন না। প্লাস্টিকের চেয়ার এগিয়ে দেন বসার জন্য। আদর বসে না। মহুয়ার মায়ের হাতে ফলের পলিথিন ধরিয়ে দিয়ে বলে,
‘ মহুয়া কোথায়? ‘
মহুয়ার মা বিস্ময়ে কথাই বলতে ভুলে যান। দু ঠোঁট সামান্য ফাঁক হয়ে ‘হ’ আকৃতি ধারণ করেছে। আদর পুনরায় প্রশ্ন করে, ‘ মহুয়া কোথায়? মা ওর জন্যে পায়েস পাঠিয়েছেন। ‘
এবার তো মহুয়ার মা আর বেশি অবাক হন। ডাক্তার বাড়ি থেকে মহুয়ার জন্যে গিন্নি পায়েস পাঠিয়েছেন? কি অবিশ্বাস্য কথা। মহুয়ার মা বলেন, ‘ মহুয়া ও ঘরে শুয়ে আছে। ‘
আদর আর কথা বাড়ায় না। হনহন পায়ে দিব্যি হেঁটে যায় মহুয়ার মায়ের দেখানো ঘরের দিকে। মহুয়ার মা পেছন পেছন আসেন। একটা যুবক ছেলে তার মেয়ের কক্ষে যাচ্ছে, ব্যাপারটা ভালো দেখায় না। গরীব হলেও, মহুয়ার মায়ের নজর এসব দিকে বেশ প্রখর। আদর মহুয়ার ঘরের দরজা খুলে। মহুয়া বিছানায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে। আদর মহুয়ার পাশে এসে দাঁড়ায়। মহুয়ার দিকে তীক্ষ্ম চোখে চেয়ে দেখে। কি নিষ্ঠুর বাবা! যেখানেই চোখ যাচ্ছে সেখানেই মা’রের দাগ। আদরের ইচ্ছে হলো মহুয়ার বাবাকে এখুনি পায়ের তলায় ফেলে পি’ষে ফেলতে। আদর মহুয়ার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। গমগম কণ্ঠে মহুয়ার মাকে জিজ্ঞেস করল,’ঔষুধ খেয়েছে? ‘
মহুয়ার মা মন খারাপ করে বললেন, ‘ হ্যাঁ! কিন্তু জ্বর নামছে না। ‘
আদর তার পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল। তিন হাজার টাকা মহুয়ার মায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ ওকে ঔষুধ খাওয়াবেন। ‘
মহুয়ার মা টাকা নেন না। বলেন, ‘ লাগবে না, বাবা। টাকা আছে আমার কাছে। ‘
আদর তর্কে জড়ায় না। চুপচাপ টাকার নোটগুলো উঠোনে থাকা খাটিয়ায় রেখে মানিব্যাগ পকেটে পুড়ে চলে যায়। মহুয়ার মা ফ্যালফ্যাল চোখে টাকার দিকে চেয়ে থাকেন। টাকাটা ব্যবহার করতে তার কষ্ট হচ্ছে। অন্যের টাকা নিয়েছেন, ভাবতে আত্মসম্মানে প্রবল আঘাত হানছে। হঠাৎ বাইরে থেকে মহুয়ার বাবার মাতাল কণ্ঠ শুনে মহুয়ার মা শশব্যস্ত হন। দ্রুত টাকার নোট নিজের আঁচলের কোণে গিঁট বেঁধে রেখে দেন। মহুয়ার বাবা একবার এই টাকার সন্ধান পেলে, টাকাগুলো কেড়ে নিয়ে যাবে। বদ লোক! মেয়ে অসুস্থ অথচ একবার এসে খোঁজও নেয় না। একবার আসেও না দেখতে। যখন আসে, হয় মহুয়ার মায়ের সাথে শারীরিক সম্পর্কের জন্যে জোরজবরদস্তি করতে নাহয় টাকা খুঁজতে। খারাপ লোক! এই সংসারে এসে তার জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেল। মহুয়ার মা নিজের ভাগ্যকে দোষারূপ করতে করতে ঘরে চলে গেলেন। মহুয়ার বাবা এসেছে। না জানি মেয়ের সাথে আবার কি করে বসে। মহুয়ার আশেপাশে থাকতে হবে এখন।

শুরুটা বেশ কষ্টের হলেও শেষটা ছিল সবুজের ন্যায় সুন্দর!
একে একে বর্ননা করলে বুঝতে সুবিধা হবে।
সেদিন ছিল শুক্রবার। গ্রামে মেলা বসেছে। মহুয়ার সাথে সকল মেয়েরা যাচ্ছে। শুধু মহুয়া যাচ্ছে না। বাবা যদি ফের মা’রে? মহুয়া মুখ গোমড়া করে উঠোনের সিড়িতে পা বটে বসে আছে। মহুয়ার মা চাল খুঁটছেন। মহুয়ার মন খারাপ দেখে তিনি বললেন, ‘ মেলায় যাবি? ‘
মহুয়া চোখ পিটপিট করে চায়। মাথা হেলিয়ে বলে, ‘ হ্যাঁ। ‘
মহুয়ার মা বলেন, ‘ তোষকের নিচে টাকা আছে। নিয়ে যা। ‘
মহুয়া ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,’ যদি বাবা মা’রে? ‘
মহুয়ার মায়ের মুখশ্রী কঠিন হয়। দাঁত কেটে বলেন, ‘ এবার গায়ে হাত তুলে দেখুক না! হাত কেটে রেখে দিব। তুই যা। মেলা দেখে আয়। ‘
মহুয়া হেসে উঠে। মন খারাপ হাওয়াই মিঠাইর ন্যায় উবে যায়। লাফিয়ে সিড়ি থেকে উঠে ঘরে যায়। টাকা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে।
মেলা হচ্ছে। ভিড় জমেছে অনেক। গ্রামের সবাই মেলা দেখে এসেছে। মহুয়া সাথীর সাথে কথা বলে মেলায় প্রবেশ করে। টাকা এনেছে। আজ সে কাঁচের লাল রঙের চুড়ি কিনবে। মহুয়া ঈদের জামার সাথে লাল চুরি পড়লে খুব সুন্দর দেখাবে।
হঠাৎ পেছন থেকে কেউ মহুয়ার চুলের লম্বা বেনুনি ধরে টানে। মহুয়া ব্যথায় আহ্ বলে আর্তনাদ করে। চুলের গোঁড়ায় সূক্ষ ব্যথা অনুভব করায় চোখে নিমিষেই জল জমে। মহুয়া পেছন ফেরে তাকায়। সেই বখাটে ছেলেটা। কামরুলকে দেখে মহুয়া রাগ দেখিয়ে বলে,
‘ আমার চুল ছাড়ো। এটা কেমন ধরনের অসভ্যতা? ‘
কামরুল বিশ্রী হেসে বলে,
‘ প্রেম করছি রে মহু, প্রেম করছি। এটুকু বুঝিস না! তুই কি বোকা রে মহু। এই মহু, রাগিস কেন? চল না, একটু চিপা থেকে ঘুরে আসি। ‘
মহুয়া অপমান বোধ করে। জোর করে চুল ছাড়ানোর চেষ্টা করে, লাভ হয়না। বরং কামরুল আরো জোড়ে চুল আঁকড়ে ধরে রাখে। সাথী ভয়ে পেয়ে মহুয়ার হাত খামচে ধরে রাখে। মহুয়া আশেপাশে তাকায়। মেলার সবাই মহুয়ার বাজে চোখে চেয়ে রয়েছে। অসম্মানে মহুয়ার হু হু করে কান্না পায়। কেঁদে ফেলে বলে, ‘ ছাড় আমার চুল। ‘
কামরুল ছাড়ে না। দূর থেকে আদরের বন্ধু শিহাব এসব হা’ঙ্গামা লক্ষ্য করতে পেরে কাউকে কল দেয়।
‘ ভাই, ভাবির সাথে ওই ব্যাটা কামরুলের বাচ্চা আবার খারাপ বিহেভ করছে। ‘
ওপাশ থেকে আদর শান্ত সুর,
‘ জাস্ট কিল হিম। ‘
শিহাব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে, ‘ একেবারে মেরে ফেলব? পুলিশ কেইস হয়ে যাবে, ভাই। ‘
‘ তাহলে মেয়েদের শাড়ি পড়ে বসে থাক, শালা। তোর কিছু করতে হবে না। আমি আসছি। ‘
আদর ফোন কেটে দেয়। শিহাব ফোন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নির্নিমেষ চেয়ে রয়। আদর রেগে গেছে, এখন কামরুলের আর নিস্তার নেই। শিহাব কামরুল, মহুয়ার দিকে এগুয়।
‘ এই কামরুল, ভাবীকে ছাড়। নাহলে আজ রাতে ভাই তোকে তারা দেখিয়ে দেবে। ‘
মহুয়া চোখ মেলে তাকায়। কেঁদে নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে। চোখ ফুলে তরমুজ। মহুয়া চোখ পিটপিট করে ভাবে, এই ভাই আবার কে? মহুয়া কি তাকে চেনে? বোধহয় না! মহুয়া ত ছেলেদের সাথে কথাই বলে না। তাহলে চিনবে কেমন করে?
শিহাবের হু’মকি-ধ’মকি কিছুই কানে তুললো না কামরুল। কামরুল খিলখিল করে হেসে বলে,
‘ কেন? ভাইও কি আমার মহুর উপর ফিদা নাকি? আচ্ছা, ঠিকাছে। আগে আমি একটু চেখে নেই। তারপর ভাইকে সুযোগ দিব। দয়ালু কিনা! হা হা হা। ‘
শিহাবের রাগে চোয়াল শক্ত হয়। সে হাত বাড়িয়ে কামরুলের থেকে মহুয়াকে ছাড়িয়ে নেয়। অতঃপর মাথা নত করে বলে,
‘ ভাবি, আপনি বাড়ি যান। কি কিনতে হবে, আমাকে লিস্ট পাঠিয়ে দেবেন। আমি কিনে দিচ্ছি। কিন্তু আপাতত আপনার বাড়ি যেতে হচ্ছে। এই মালকে আমি সামলাচ্ছি। ‘
এমনিতেও মহুয়ার চুড়ি কেনার শখ মিটে গেছে। তাই সে মাথায় হাত দিয়ে মালিশ করতে করতে কেঁদে কেঁদে বাড়ি চলে যায়। মহুয়া যেতেই শিহাব আঙ্গুল উচিয়ে কামরুলকে সতর্ক করে, ‘ ভাই তোকে ডেকেছে, আড্ডাশালায়। আজ সন্ধ্যায় সেখানে চলে আসিস, হাড্ডি গুঁ’ড়ো করতে। ‘
কামরুল এসব হু’মকি হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বলে
‘ হ হ! তোর ভাইয়ের মুরোদ আমার জানা আছে। আসছে, আমার হাড্ডি গুঁ’ড়ো করতে। শালার বাচ্চা। ‘
অথচ সেদিন কামরুলের হসপিটালে ভর্তির খবর আসে। কামরুলের মায়ের সে কি আহাজারি। মহুয়ার মায়ের কাছে এসে বিচার দিলেন, ‘ আপনার মেয়ের গ্রামে মরদ জুটেছে। সেই মরদ দিয়ে আমার সোনার টুকরা ছেলেকে পিটিয়ে ফালাফালা করে ফেলল গো! আপনার ভালো হবে না, মহুয়ার মা। মেয়েকে আটকান। নাহলে আমার অভিশাপে মরে যাবেন একদিন। এই বলে দিলাম। ‘
মহুয়ার মা মেয়ের দিকে চাইলেন। মহুয়া একপাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে বারবার ঢোক গিলছে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here