ভালোবাসা ১৬তম_পর্ব

0
545

ভালোবাসা
১৬তম_পর্ব
#মৌসুমি_চৌধুরী

দাদা আমাকে দেখামাত্রই হাত নেড়ে ইশারা করলেন। হাসিমুখে এগিয়ে এসে যেভাবে বুকে টেনে নিলেন, তাতে আমি যেন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে রইলাম। দাদা একমনে কত কথা যে বলে গেলেন তার কিছুই যেন শুনতে পেলাম না। অপরাধী মনটা যেন গ্লানিবোধটুকু নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে, তাই নীরবে নিশ্চুপ থেকে কিছুটা সময় ধরে চললো।

ফের ট্যাক্সিতে বসে থাকা অবস্থাতেই দাদা ঠিক যেন অরুর মতো এদিক সেদিক দেখিয়ে কত কি যে বলতে লাগলো। বছর দেড়েক পর ফিরে এসে যা দেখছেন তার সবটাতেই যেন নতুনত্বের ছোয়া খুঁজে পাচ্ছেন। সেসবই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জানতে চাইছেন কিংবা জানার চেয়ে বেশি, দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকে দেশে ফিরে আসা মাত্র স্বদেশীদের সহজাত প্রবৃত্তির কারণেই হয়তো একটু অতি উৎসাহী ভাব লক্ষ্যনীয়।

আমি হু হ্যাঁ করেই জবাব দিচ্ছিলাম। বেশি কথা বলার মানসিক অবস্থা যেন নেই আমার। একদিকে কাল রাতের ঘটনায় অরু কি ভাবছে সে দুশ্চিন্তা আরেকদিকে বন্ধুদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কিভাবে ওদের মুখোমুখি হবো সেই ভাবনা। এতদিন ওরা সব জানলেও কেউ কিছু মুখের ওপর বলার তো কখনো সাহস করেনি। হয়তো একটা আড়াল ছিলো আমার না বলাতেই। কিন্তু এখন যখন সব কথা আমি নিজ মুখেই স্বীকার করেছি তখন আর ওদের আমায় কিছু বলতে দ্বিধা থাকবে কেন…

তার ওপর আবার বাড়িতে ফিরে গিয়ে বাজার সদাই কি আছে, কি নেই সেসব খোঁজখবর ও তো করতে হবে। দাদা এতদিন পর ফিরলেন যখন, তখন ভালো মন্দ রান্নার আয়োজন নিশ্চয়ই করতে চাইবেন মা। গতকাল বিকেল গড়িয়ে ঠিক সন্ধ্যেবেলায় খবরটা পাওয়ার পর থেকে শেষরাত অবধি তো সে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণেই রাখতে পারেনি। আর আজ ভোরে এত বেলা করে উঠেছে যে বাজারে যাওয়ার সময় ও হয়নি তার।

নাহ…এখন আর সে আবেগকে পাত্তা দেবেনা। তার আবেগই সকল অনিষ্টের মূল। আজাদের কাল রাতে বলা কথাগুলো যেন আবছা আবছা করে মনে পড়ছে তার, ঠিকই তো বলেছে সমাজের দৃষ্টিতে যা কিছু খারাপ ভাবা হয় সেরকম গর্হিত অপরাধই সে করেছে, স্বেচ্ছায়-স্বজ্ঞানে কিংবা অবচেতন মনে।

কিন্তু এখন থেকে সব ঠিক করে দেবার জন্যে যা কিছু করা প্রয়োজন তার সবটাই সে করবে। দাদার সাথেও সহজভাবে মিশবে আগের মতন। তবে আজ কিছুটা মাথা ভার ভার লাগছে, রাতে ঠিকঠাক ঘুম হয়নি তাই হয়তো…শরীরটা বেশ খারাপ লাগছে আর মনটাও ভালো নেই। কিন্তু সেসব অজুহাত দেখিয়ে ফাঁকি দেয়া তার চলবেনা। নিজেকে কড়া ভাবে শাসিয়ে যায় মনে মনে, এসব পাত্তা না দিয়ে তাকে দাদার আগমনের জন্যে করা আয়োজনের খেয়াল রাখতে হবে।

ট্যাক্সি থেকে নেমে দাঁড়াতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। কোন মতে ভাড়া চুকিয়ে ঘরের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াতেই যেন বাড়ির ভেতর থেকে সাজ সাজ রব শোনা যায়। মা বেরিয়ে আসতেই দাদা মাকে প্রণাম করে, কেমন আছো মা? বলে হাসিমাখা চেহারায় তাকিয়ে থাকেন।

মা সব অভিমান ভুলে গিয়ে যেন দাদার গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলেন কত দিন পরে এলি…এত দেরিতে দেরিতে এলে মা ভালো থাকি কি করে!!! অনেক শুকিয়ে গেছিস…বলে যেন হাহাকার করে উঠলেন মা।

দাদা মুচকি হেসে বললেন, বিলেতে কি আর মায়ের মতো যত্ন করে কেউ রেঁধে খাওয়ায়? তাই একটু আকটু অমন হয়…আর সব মায়েদের ও তাই একই অভিযোগ থাকে।

মা কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, মায়েদের দুঃখ তোরা কি বুঝবি…শুধু হাসি-তামাশার বস্তু ভেবেই উড়িয়ে দিস তাই।

দাদা মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, এবার খাইয়ে দাইয়ে এমন মোটাতাজা করে পাঠিয়ো যাতে কমপক্ষে বছর দুয়েক আর না শুকোই।

আমরা হেসে উঠতেই… মা দাদার পিঠে চাপড় মেরে বললেন, ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে আগে। বাদবাকি হাসিঠাট্টা পরে করিস।

ফের দরজা দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়লো অরু ঘরের মাঝের একটা পিলারের আড়ালে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ সে সব শুনলেও সামনে আসেনি, আমার সামনে বোধহয় দাদার সাথে কথা বলতে ইতস্তত বোধ করছে কিংবা এমনও হতে পারে যে আমি অযথাই নিজেকে গুরুত্ব দিয়ে বেশি বেশি ভাবছি। কিন্তু অরুর কাছে সেসব হয়তো গুরুত্বহীন। কাল রাতের সময়টা মনে করে আমি যতটা আবেগে ভেসে যাচ্ছি তার কাছে এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আজ দাদার আগমন। দীর্ঘ বিরহের পর স্বামী স্ত্রীর কথোপকথন কি সে আমাকে শুনিয়ে করবে!!! তুই না বিজু চিরকাল বোকাই থেকে গেলি, মিথ্যে স্বপ্নের আর জাল বুনিস না।

দাদা ঘরে ঢুকে পা টিপেটিপে গিয়ে অরুর সামনে দাঁড়িয়ে অরু কিছু বলার আগে আচমকা জড়িয়ে ধরতেই লজ্জায় অরুর যেন মুখ লাল হয়ে গেলো। ফের মাথা তুলে তাকাতেই আমার দিকে হঠাৎ চোখাচোখি হয়ে যেন চোখ আটকে গেলো। আমারো কি হলো জানিনা, নির্লজ্জের মতো দাঁড়িয়ে থেকে চেয়ে রইলাম অরুর চোখে। অস্বস্তিকর পরিস্থিতি এড়াতে অরু দাদাকে কি যেন বললো কানের কাছে মুখ নিয়ে। দাদা অট্টহাসি দিতেই আমি সরে গেলাম সেখান থেকে। গেট পেরিয়ে হনহন করে বাজারের পথে এগিয়ে গেলাম। যতটা পথ যাচ্ছিলাম মনে হচ্ছিলো যেন ওদের থেকে দূর বহুদূরে চলে যাই। ওদের পেছন ফিরে আর যেন কখনো দেখতে না পাই। আমার এই বেহায়া মনটাকে কি করে শাস্তি দেবো তা যেন আমি আর ভেবে পাচ্ছিলাম না।

দুপুরে খেতে বসেই দেখলাম এলাহি কান্ড করে ফেলেছেন মা, সব বাজার আজ একদিনেই বোধহয় দাদাকে খাইয়ে ছাড়বেন। মাছ, মাংস, ডিম, পায়েস আরো কত কি যে রেঁধেছেন… কি রাঁধেননি তিনি তা ভেবে আর কূল ধরতে পারলাম না। সবই যেন এ বেলায় খেতে হবে দাদাকে, মায়ের এই মধুর অত্যাচার দাদা যে বেশ উপভোগ করছিলেন তা তার চেহারার প্রফুল্লতা দেখেই আমি বুঝতে পারছিলাম। শত হলেও মায়ের মন, দীর্ঘদিন পুত্রকে না দেখে নরম তো হবেই।

দাদা আমাকে ক্ষেপাতে বললেন…বিজু দেখ, আমাকে পেয়ে মা’তো দেখছি তোকে ভুলেই গেছে। সব ভালো কিছু তাই আগে আমাকেই খেতে দিচ্ছেন।

আমি হেসে বললাম, তোমাকে পেয়ে তো সবাই সব ভুলেই যায়…এ আর নতুন কি!!! পরক্ষণেই কি বলছি এসব মনে করে চোখ তুলে তাকাতেই অরুর বিষন্ন চেহারায় মাথা নিচু করে থাকা দেখে শুধরে নিতে বললাম, তুমি তো সবার মন জয় করে নিতে জানো দাদা…তাই তো আমরা সবাই তোমায় এতো ভালোবাসি।

আচ্ছা, তুই এত সমঝদার হলি কবে থেকে বলতো?

বিজনেস করি আর এটা জানবো না যে লং টার্ম প্রফিট মানে আদর, স্নেহ, ভালোবাসা যার থেকে পাই তার শর্ট টার্ম খুশির খেয়াল তো রাখতে হবেই…বলে মার দিকে ইশারা করলো।

দাদা হা হা করে হেসে উঠে যেন খাবার নাকেমুখে গিয়ে একটা হেনস্তার শিকার হলেন। মা জলের গ্লাসটা দাদার মুখের কাছে ধরে আমায় বকতে শুরু করলেন। দাদা মাকে থামিয়ে হাসিমুখে বললো, ওকে আর বকোনা মা…কতদিন পর আমরা সবাই আবার একসাথে খেতে বসেছি, আমার তো ভীষণ ভালো লাগছে।

খাওয়াদাওয়া পর্বের পর আমি উঠে বেরিয়ে পড়তে চাইলাম। সকাল থেকেই আজ কাজে যাইনি, এখন একবার না গেলেই নয়। দাদা আমাকে মেইন ডোরের কাছে গিয়ে শেলফ থেকে জুতো বের করতে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে বললো, এখন বেরুচ্ছিস!!! একটু তো বোস দুটো কথা বলি…আজ নাহয় কাজে নাই গেলি।

দাদার চোখে কিছু একটা ছিলো যা আমি উপেক্ষা করতে পারলাম না। কি ছিলো সেই চোখে?…স্নেহ,
মায়া নাকি ভালোবাসা! জানিনা…শুধু এটা জানি, বিজু যে বড়ই কাঙ্গাল তাই যে যতখানি দেয় বুক পেতে নেয়।

#চলবে…

কপি করা নিষেধ, লেখা অন্যত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here