ভালোবাসা ১৯তম_পর্ব

0
536

ভালোবাসা
১৯তম_পর্ব
#মৌসুমি_চৌধুরী

বাড়িতে ঢুকেই বিজু চলে গেলো স্নান করতে। সারাদিনে এত এত বার বাস জার্নি করার পর শাওয়ার না নেয়া পর্যন্ত তার স্বস্তি ফিরে আসেনা। ফ্রেশ হয়ে পোশাক পাল্টে বের হয়ে আসতেই দেখে মা এসে বসে আছেন তার ঘরে। তাকে দেখেই বললেন, কাল রাত থেকে আজ রাত পর্যন্ত তোকে এক গ্লাস জল ও খেতে দেখলাম না…কি হয়েছে তোর বল আমায়, দাদার প্রতি কি এখনো রাগ পুষে রেখেছিস মনে?

আমি হকচকিয়ে গিয়ে খুব দ্রুত মাথা নেড়ে না বোধক ইশারা করলাম।

মা বললেন, ওদের বসিয়ে তোকে ডাকতে এলাম।তোর দাদা মুখ ভার করে বসে আছে…সে বেচারা তো মনে কষ্ট নিয়ে ভাবছে যে তুই এত বছরেও তাকে ক্ষমা করতে পারিসনি বোধহয়।

আমি আর কিছু না বলে মার সাথে খেতে চলে গেলাম।

দাদার দিকে চোখ পড়তেই মৃদু হেসে বসলাম। সবার আগে অরু আমার প্লেটেই খাবার তুলে দিচ্ছিলো। মাংসের পরিমাণ এত বেশি দিতে লাগলো যে আমি বাধ্য হয়ে বললাম, আর দিসনা…এত খেতে পারবো না আমি।

অরু আমার দিকে তাকিয়ে বললো, তিন বেলা না খেয়ে এরপর থেকে খেতে বসলে এমনই খেতে হবে।

দাদা হো হো করে হেসে উঠতেই আমিও একটু হাসলাম।

ডাইনিং রুমে খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ হলে আমি উঠে রুমের দিকে পা বাড়াতেই দাদা বলে উঠলেন, অরু কফি বানাবে…বোস না একসাথে আড্ডা দেই কিছুক্ষণ।

আমি নীরব সম্মতি দিয়ে ড্রইংরুমে বসলাম। দাদা বিলেতের গল্প করতে করতে আমার বিজনেস আর অরুর পড়ালেখার ও বেশ খোঁজখবর নিলেন। মা যে কোথাও যেতে চান না সেটা জেনে বললেন, ভালো কথা মনে করেছিস বিজু…কাল দুপুরের নেমন্তন্নে কিন্তু তোকে আর মাকে যেতেই হবে।

আমি যেন মুখ ফসকে বলেই ফেললাম, এর মধ্যে আবার আমাকে টানছো কেন দাদা?

দাদা হঠাৎ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, কেন রে…তুই আর মা না গেলে কি করে হবে বল তো…অরুর বাবা-মা কত বড় মুখ করে অত বার বলে গেলেন!

অরু যেন অভিমানে আর কিছু বলছে না। দাদা সেটা না বুঝে তাকেই বললো, তুমি বিজুকে কিছু বলো… আচ্ছা তোমাদের মধ্যে আড়িটাড়ি হয়ে থাকলে ভাব করে ফেলো কেমন।

আমি মনে মনে এটা ভেবে হাসলাম যে, ভাব করতে চাই বলেইতো আড়ি হয়ে গেছে দাদা। আর বেশি ভাব করাতে চেয়ো না, নইলে তোমাদের মাঝে যে আমি কাবাব মে হাড্ডি হয়ে যাবো।

দাদাও হেসে উঠে বললেন, তোদের ছেলেমানুষী বন্ধুত্বের কাজকারবার দেখলে আমি বেশ মজা পাই জানিস…

আমি বললাম, ছেলেমানুষী বন্ধুত্ব? তা বেশ বলেছো, কিন্তু এখন তো আমরা কেউ আর ছেলেমানুষ নই…বড় হয়ে গেছি না, তাই মান অভিমানের কারণগুলো ও ভিন্ন হতে পারে।

দাদা একটু সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন, তোদের হাবভাবে তো এখনো আমার কাছে ম্যাচিওরড বলে মনে হয়না।

আমি হেসে বললাম, ও তোমার দেখার ভুল…অরু হতাশা ভরা চোখে তাকাতেই ফের আপনা থেকেই যেন মুখ দিয়ে বেরুলো, স্নেহের চোখে দেখ তাই টিনএজ বালকবালিকা মনে হয়।

দাদা অট্টহাসি দিয়ে বললেন, ইনডিরেক্টলি তোরা যে আমার হাটুর বয়সী তাই বোঝাতে খোঁচাটা দিলি তাইতো…

আমি বলে উঠলাম, বাহ রে নিজেই বলে এখন আমাকেই মিথ্যা আরোপ চাপিয়ে দিচ্ছ।

অরুর যেন এসব আর ভালো লাগছিলো না, তাই সে বললো…কাল একটু আগে গিয়ে মাকে হেল্প করবো ভাবছিলাম, আমাদের ঘুমিয়ে যাওয়া উচিত।

আমি উঠে চলে গেলাম নিজের ঘরে। কিছুতেই যেন ঘুম আসছেনা আর…সিগারেট আর লাইটারটা সাথে নিয়ে ছাদের দিকে উঠে গিয়ে সিড়ির শেষ ধাপে পা রাখতেই কারো খালি গলায় গাওয়া পুরুষালী কন্ঠে গানের আওয়াজ শুনলাম। একটু মন দিয়ে শুনতেই বুঝলাম যে এটা দাদার কন্ঠস্বর। আড়াল থেকে সিড়ি ঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম, দাদা নিজে ছাদের কার্নিশ ওয়ালের উপর বসে অরুকে তার কোলে বসিয়ে গান শোনাচ্ছে।

ক্ষণিকের জন্যে যেন থমকে গেছে সময়…সম্বিৎ ফিরতেই আমি ধীর পায়ে নিজের ঘরে ফিরে আসলাম। ঘর থেকে ছাদের কথা ভালোভাবে শোনা যাওয়ার কোন উপায় নেই…তবুও মনে হলো ওদের কথা, হাসি আর গান সবই আমার কানে বাজছে। আমি শুয়ে পড়ে বালিশ চাপা দিয়ে কান ঢাকলাম আর জোর করে যেন চোখ বন্ধ করে রাখতে চাইলাম যাতে কিছুতেই সেসব আর দেখতে না হয়।

গোটা রাত ছটফটানির মাঝে ভাঙা ভাঙা ঘুমের মধ্যেও যেন কেঁপে কেঁপে উঠছিলাম। দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম হয়তো…

সকাল হতেই মা এসে ডেকে দিয়ে গেলো। মাকে দেখেই আমি বললাম, বাজার লাগবে? আজ ছুটির দিন তাই সকাল সকাল বাজারে না গেলে ভালো কিছু পাওয়া যাবেনা বোধহয়…

মা হাসিমুখে বললেন, তুই তো অত ভুলোমন ছেলে নস রে আমার…তবু আজ কি করে ভুলে গেলি যে অরুদের বাড়ি যেতে হবে নেমন্তন্নে!

আমি মনে মনে ভাবলাম, গোটা রাত যা কিছু বয়ে গেছে আমার ওপর দিয়ে তারপর বুঝি স্মৃতিভ্রষ্ট হলেই বাঁচি।

মাকে সেসব তো আর বলতে পারিনা, তাই বললাম…আমার যেতে ইচ্ছে করছেনা মা, তোমরা যাও না, আর তাছাড়া আমি তো কতবার এমনিতেই গেছি, অরুকে দিয়ে আসতে নিয়ে আসতে।

মা বললেন, সেসব যাওয়া আর আজ যাওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক। ওর সব দিদিরা, জামাইবাবুরা আসবেন তাদের শ্বশুরকুলের লোকেরাও হয়তো থাকবে…না গেলে লোকে মন্দ বলবে, এ কান ও কান করে পাঁচ কান হবে, অরুকে দশ কথা শুনিয়ে ছাড়বে…সেটা কি ভালো হবে বল?

আমি আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ উঠে ফ্রেশ হলাম ফের একেবারে রেডি হয়ে গিয়ে নাস্তা সারলাম। আমাকে যাবার জন্যে তৈরি দেখে অরুর মুখে যেন হাসি ফুটলো। তাকিয়ে দেখি আজ বেশ সেজেছে সে। একটু আধুনিক কিন্তু পরিপাটি সাজ। গেরুয়া রঙের চুড়িদারে যেন ভালো মানিয়েছে তাকে। বরাবরের মতনই খোলা চুল আর কানে বড় দুল। খুব সুন্দর লাগছিলো অরুকে। আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো দাদার কথায়…যাচ্ছিস তাহলে? বলে হাসলেন দাদা।

আমি মুচকি হাসি হেসে প্রত্যুত্তর দিতে গিয়ে দাদার গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবির দিকে চোখ পড়তেই যেন চুপসে গেলাম। মনে পড়ছিলো, অরুর সাথে মিল করে পোশাক পড়ার কথা। মিথ্যে সংসার যেন তাসের ঘরের মতন ভেঙে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো আর সেই ধ্বংসস্তূপটা যেন আমি আমার হৃদয়ে বহন করে চলেছি একা…

মা তাড়া দিতেই উঠে গিয়ে ট্যাক্সি ডেকে আনলাম। ফের মা, অরু আর দাদাকে ব্যাক সিটে বসিয়ে আমি সামনে ড্রাইভিং সিটের পাশেরটায় গিয়ে বসলাম। পথে গাড়ি থামিয়ে মনে করে দই-মিষ্টি নিয়ে নিলাম। মন যতো খারাপই থাক না কেন, দায়িত্বে অবহেলা বিজুর স্বভাবে নেই…সেটা যেন নিজেকে নিজেই মনে করিয়ে দিলাম আবার।

আমরা গিয়ে হাজির হতেই দেখলাম অরুদের বাড়ি ভর্তি মেহমান। ঠিক যেন বিয়েবাড়ির মতো আয়োজন। ঘরে ঢুকতেই দিদি-জামাইবাবুরা যেন দাদাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। হবে নাই বা কেন, তাদের বাড়ির সবচেয়ে দামী জামাই। অত পড়ালেখা জানা মানুষের যেন কদরই আলাদা। আজ আর আমায় কেউ খুব বেশি পাত্তা দিলো না। মিরুর পরীক্ষা তাই সে শুধু একবার সকলের সাথে দেখা করে তার ঘরে পড়তে চলে গেলো, আর তরু সর্বকনিষ্ঠ শ্যালিকা হবার সুবাদে জামাইবাবুদের পঁচানি খাচ্ছে এবং খাওয়াচ্ছে। অরুর বাবা একবার এসে কথা বলে চা-নাস্তার খোঁজ করতে সেই যে ভেতরে গেলেন আর ফিরে এলেন না। মা বোধহয় অরুর মাকে হেল্প করতে কিচেনে ঢুকে গেছেন। যেহেতু অরুর ও আর দেখা নেই, তাই বুঝলাম মা যেখানে সে ও সেখানে।

ফের একফাঁকে এসে আমার হাতে নাস্তার প্লেট ধরিয়ে আর দাঁড়ালো না। আমি সামান্য কিছু মুখে দিয়ে দাদার জামাইআদর পাওয়া দেখছিলাম। এই সমাদরের চেয়ে বরং আমার একা এসে বসার ঘরে বসে থেকে অরুর মা নিজ হাতে খাবার বেড়ে দিয়ে পাশে বসে কথা বলাটাই বেশি আপন আপন লাগতো। মেয়ে জামাইকে যদি নিজের ছেলের মতন না ভেবে পর ভাবতে হয় তবে সে আর কেমন আদর!এসব ভেবে ভেবেই যেন নিজেকে বুঝ দিয়ে দিয়ে সময় পার করছিলাম।

দুপুরে ভরপেট খাওয়াদাওয়ার পর বিকেল অব্দি জমপেশ আড্ডা দেয়ার মাধ্যমেই যেন শেষ হলো দাদার জন্য আমোদপ্রমোদ আর আমার জন্য প্রহসনের পর্ব।

যাই হোক, ভালোয় ভালোয় আমরা সবাই বাড়ি ফিরে এলাম। অরুকে দেখে মনে হলো,বেশ ফুর্তিতেই আছে…দাদা যে সবার সাথে এত তাড়াতাড়ি মিশে যেতে পারবে সেটা যেন সে ভাবতেও পারেনি।

লং জার্নির পর সবাই খুব টায়ার্ড থাকায় আজ যেন কোনমতে ড্রেস চেঞ্জ করেই সব ঘুমুতে চলে গেলো।

ভোরবেলা আমার ঘুম ভাঙলো অরুর চিৎকারে। এক দৌড়ে ডাইনিং স্পেসে গিয়ে দাঁড়িয়ে কোন দিক থেকে শব্দটা এসেছে তা ভাবতেই দেখি মার ঘরের দরজাটা হাট করে খোলা। আমি ভয়ে ভয়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখি মা মেঝেতে পড়ে আছে আর অরু মার পাশে বসে অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে ভয় পাচ্ছে। আমি গিয়ে দাঁড়াতেই আমাকে দেখে বলতে চেষ্টা করলো…বি-বিজু দেএএএখ মা জানি কেমন করছে? বিজুউউউ..বলে চেচানো শুরু করতেই আমি যেন সম্বিৎ ফিরে পেলাম। দৌড়ে মাকে কোলে নিয়ে খাটে শোয়াতেই তাকিয়ে দেখি অরু এক দৌড়ে কোথায় যেন ছুটে গেলো।

মার মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙতে শুরু করেছে। আমি কি করবো কিছুই জানিনা…দাদা কই গেছে এই সাতসকালে কে জানে। অরু একটা ট্যাক্সি ডেকে এনে যেমন ছিলো ঠিক তেমনই ঘরে তালা দিয়ে আমাকে বললো যে মাকে নিয়ে সে পেছনের সিটে যেতে পারবে। ফের তার কোলে মাথাটা রেখে মাকে শুইয়ে দিতে বললো আমায়। আমি আর দেরি না করে ঝটপট উঠে বসে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বললাম, একটু দ্রুত চালিয়ে যান।

আমাদের মা’র যেন কিছু না হয়… খানিকক্ষণ চুপ থেকে অস্ফুটে বললো অরু।

#চলবে…

কপি করা নিষেধ, লেখা অন্যত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here