একটি_রূপকথার_গল্প,৮,৯

0
571

#একটি_রূপকথার_গল্প,৮,৯
#জেরিন_আক্তার_নিপা

আরমানের ছুটে চৌদ্দ দিন ছিল। তার থেকে চার দিন অলরেডি চলে গেছে। বাকি আছে দশ দিন। এই দশ দিনের মধ্যে কীভাবে বিয়ের সব আয়োজন শেষ হবে বুঝে আসছে না মারজিয়ার।

~ মেহেন্দি, সংগীত, হলুদ সন্ধ্যা, বিয়ে, রিসিপশন এগুলো করতেই তো পাঁচ দিন চলে যাবে। আর এসব তো মুখের কথা না যে বললাম আর হয়ে গেল। ডেকোরেশনের সময় লাগবে। ড্রেস ডিজাইনার সময় নিবে। মেয়েদের তো পার্লারেই দু’দিন লেগে যাবে। এভাবে তাড়াহুড়ো করে বিয়ে হয় নাকি? বিয়ের পরদিনই কি আরমান অথৈকে রেখে চলে যাবে!”

আশরাফ হোসেন মেহমানদের করা লিস্টে চোখ বোলাচ্ছিলেন। প্রায় সবার নামই আছে। দু-এক জন বাদ পড়েছে। তিনি ম্যানেজারকে বলে দিলেন আর কাকে কাকে কার্ড পাঠাতে হবে। হাতের কাজ সেরে বোনের দিকে ফিরলেন।

~ আমি একা গিয়ে তো বিয়ে ঠিক করিনি। ডেট ঠিক করার সময় তুমিও ছিলে।”

~ তখন তো এতসব কিছু মাথায় আসেনি। আর আরমান এবার গেলে ছ’মাস আগে আসতেও পারবে না।”

~ ছ’মাস পরেই নাহয়…

~ মাথা খারাপ হয়েছে তোর! তোর মেয়ের মন মিনিটে মিনিটে রঙ পালটায়। এখন রাজি আছে কাল শুনবি রাজি না। তখন পড়বি মহা জ্বালায়। তার থেকে ভালো লোহা গরম থাকতে থাকতে হাতুড়ি মেরে দে।”

অথৈ হাইহিলে খটখট শব্দ তুলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। মারজিয়া অথৈকে দেখল। এই মেয়ে স্বাভাবিক? কেউ বলবে! কাল রাতে বিয়ের কথা শুনে হার্টফেল করল। কাজের মেয়েটাকে কী এক অদ্ভুত শাস্তি দিল। বেচারি মেয়েটা সকাল থেকে সারাক্ষণ ফোনে কথা বলে যাচ্ছে। সকাল থেকে এখন পর্যন্ত ওর সব আত্মীয়ের সাথে কথা বলা শেষ।
অথৈকে দেখে আশরাফ হোসেন জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন কোথায় যাচ্ছে সে। তার আগেই অথৈ বাবা, ফুপির সামনে এসে দাঁড়াল।

~ আমি একটু বেরুচ্ছি। আজ সারাদিন বন্ধুদের সাথে কাটাব। বিয়ের পর তোমাদের জামাই কোথাও যেতে না দিলে তো আমার কিছু করার থাকবে না। বাধ্য বউয়ের মত তার কথা শুনে ঘরের কোণে চুপটি মেরে বসে থাকব। তাই বাকি কয়টা দিন জীবনটাকে একটু উপভোগ করে নিতে চাই। আশা করি তোমাদের এতে কোন আপত্তি নেই।”

অথৈ চলে গেলে মারজিয়া ভ্যাবাচ্যাকা গলায় বলল,

~ তোর মেয়ে পাগল হয়ে গেছে বাবু। দেখলি উল্টাপাল্টা কী সব বলে গেল!”

~ জেদ থেকে এসব কথা বলছে বুবু। আমাদের উপর রাগ জমে আছে। না পারছে ওগুলোকে ঝাড়তে না পারলে সহজ ভাবে সবটা মেনে নিতে।”

~ তুই যাই বলিস, বিয়ের পর এই মেয়ে আরমানের সব শান্তি কেড়ে নিবে। বেচারার জন্য এখন থেকেই চিন্তা হচ্ছে আমার।”

আশরাফ হোসেন হেসে ফেললেন। বুবুকে চেতিয়ে দিতে বললেন,

~ যেমন তুমি দুলাভাইয়ের সুখ শান্তি নষ্ট করে দিয়েছিলে। বেচারা বিয়ের রাতে সারারাত তোমার ঘরের দরজার সামনে বসে ছিল। আমি শত বলেও আমার ঘরে নিয়ে যেতে পারিনি। শেষে বাবাও বলেছেন, আমার ঘরে শুতে না চাইলে অন্য ঘরে শুতে। কিন্তু বেচারার এক কথা, এখানেই ঠিক আছি আমি। বিয়ের পরেও তুমি কারণে অকারণে রাগ করে এখানে চলে এসেছ। বেচারাও তোমার পেছন পেছন তোমার রাগ ভাঙিয়ে বাড়ি নিতে এসেছে। তোমার থেকে ছোট হলেও সবই মনে আছে আমার।”

~ তাহলে নিশ্চয় এটাও মনে আছে আমার হাতে কীভাবে মার খেতি তুই! চড় না খেতে চাইলে চুপ কর গাধা।”
…..
অথৈ নিজে ড্রাইভ করছে। মাঝপথে আরমানকে তুলে নিল সে। অথৈ তাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে জানে না আরমান। আজ সকালে অথৈ কল করে বলল,

“বাবার প্রিয় ছাত্র, আজকে আপনার কোন প্রোগ্রাম আছে?”

একে তো অথৈ নিজে থেকে তাকে কল করেছে। দুইয়ে অথৈ এটা জানতে চাচ্ছে সে আর ফ্রী আছে কি-না! সাথে সাথে উত্তর দিল আরমান,

“না।”

“তাহলে ফ্রী আছেন আপনি?”

“হ্যাঁ।”

“ঠিক আছে। তাহলে আপনার আজকের সারাটা দিন আমাকে দিতে পারবেন? কোন সমস্যা নেই তো।”

সমস্যা থাকলেও আরমান সব সমস্যা ছুড়ে ফেলে দিত। অথৈ তার কাছে আজকের পুরোটা দিন চাচ্ছে? সে বেচারা একটা মিনিট অথৈর সাথে কাটাতে পারলেও নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে সুখী মনে করে। আজ সে সারাটা দিন অথৈর সাথে কাটানোর সুযোগ কীভাবে হাতছাড়া করতে পারে?
গাড়িতে উঠে আরমান অথৈকে দেখল। মেয়েটা কি দিনদিন সুন্দর হচ্ছে? নাকি বিয়ের কথা উঠলেই মেয়েদের সৌন্দর্য বেড়ে যায়। গলা পরিষ্কার করে নিয়ে আরমান জানতে চাইল,

~ কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

~ বিয়ের ভাইভা দিতে।”

অথৈ কথাটা সহজ ভাবেই বলেছে। কিন্তু আরমান এই কথার অর্থ বুঝতে পারল না। আবার জিজ্ঞেস করল সে,

~ কিসের ভাইভা দিতে?”

~ বিয়ের। চাকরি যে নিয়েছেন তার ভাইভা দিতে হয়নি? ”

~ হয়েছে।”

~ একটা সামান্য চাকরি নিয়েছেন তার জন্য কত লোকের প্রশ্নের উত্তরের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তাহলে বিয়েটাকে এতটা সহজ ভাবে ধরে নিচ্ছেন কেন? বউ পেতে হলেও ছোটখাটো একটা ভাইভা দেওয়া প্রয়োজন।”

আরমান কিছুই বুঝতে পারছে না। অথৈ তাকে মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। তার সাথে কী করতে চাচ্ছে ও!

~ ভয় পাবেন না। আপনাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে কিডনি খুলে বেচে দিব না। আমার ফ্রেন্ডসরা আপনার সাথে দেখা করতে চায়৷ ওদেরই সাধারণ কৌতূহল মেটাতে হবে আপনাকে। ওদের ছেলেমানুষি কিছু প্রশ্নের উত্তর দিবেন ব্যস।”

আরমান জীবনে কোন পরীক্ষার আগের রাতেও হয়তো এতটা নার্ভাস হয়নি এখন যতটা হচ্ছে। অথৈর ফ্রেন্ডরা ওকে কী কী প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে? কে জানে। তার বন্ধুরা তো কোন ঝামেলা ছাড়াই বিয়ে করে ফেলেছে। কিন্তু তার ক্ষেত্রে বিয়েটা এত কঠিন হয়ে যাচ্ছে কেন?
……
মিনহা, প্রাপ্তি বাদেও অথৈর আরও বন্ধু আছে। আজ সবাই এসেছে। সাত আটজন মেয়ের সামনে বসে থাকতে আরমান আনইজি ফিল করছে। মেয়েগুলো তাকে কেমন করে চোখ বড় বড় করে দেখছে। যে সে ভিন্ন গ্রহের প্রাণী। অথৈ নির্বিকার মুখে বসে আছে। প্রাপ্তি আগেই আরমানের চেহারায় পটে গেছে। তাই তার কোন প্রশ্ন নেই। মিনহা চেয়ারে নড়েচড়ে বসল। সবার দিকে একবার দেখে কথা শুরু করল,

~ আমরা হলাম আপনার হবু বউয়ের বান্ধবী। আপনার হবু শালি। প্রথমে আমাদের সবার সালাম নিন।”

আরমান কী বলবে ভেবে পেল না। অথৈর মত তার বান্ধবী গুলোরও মাথার তার ছিড়া মনে হচ্ছে।

~ একটা মেয়েকে পটানো সর্বপ্রথম ও কার্যকর ধাপ হচ্ছে আগে তার বান্ধবীদের পটানো। বান্ধবী পটে গেছে মানে মেয়েটাও পটে গেছে। তাই আমাদেরকে পটানোর হান্ড্রেড পার্সেন্ট চেষ্টা করবেন।”

আরমানের কাশি উঠে যাচ্ছে। এ কী পাগলের পাল্লায় পড়ল সে!

~ আমাদের কিছু প্রশ্ন আছে। বান্ধবীর ফিউচার বলে কথা। প্রশ্ন গুলোর সঠিক সঠিক জবাব দিবেন। মিথ্যা বললে কিন্তু আমরা ধরতে পারব। এখানে একজন ফেস রিডার আছে। যে মুখ দেখে মনের কথা বলে দিতে পারে।”

মিনহার কথার মাঝে প্রাপ্তি বলে উঠল,

~ আমার কোন প্রশ্ন নেই দুলাভাই। আমি অলরেডি আপনার লুকে পটে গেছি।”

প্রাপ্তির কথা শেষ হবার সাথে সাথে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। আরমানের নিজেরও হাসি পেল।
মেয়েগুলো সব ছেলেমানুষী প্রশ্নই জিজ্ঞেস করছে। যেমন তার কয়টা গার্লফ্রেন্ড ছিল? কোন রিলেশন কত বছর ছিল? কার সাথে কতদূর এগিয়েছিল? হঠাৎ করে অথৈকে পছন্দ করলো কেন। অথৈর মাঝে কী আছে যা অন্য মেয়েদের মধ্যে নেই। এসবই। ওদের প্রশ্নের উত্তর দিতে আরমানের মজাই লাগছে।

~ গার্লফ্রেন্ডের সংখ্যা যদি জিজ্ঞেস করলো তাহলে বলতে হবে এই বিষয়ে আমার স্কোর জিরো।”

~ যা! আপনি নিশ্চয় মিথ্যা বলছেন।”

~ মিথ্যা না। সত্যিই।’

~ চেহারায় এত কিউটনেস থাকার পরেও যদি গার্লফ্রেন্ড না পান তাহলে এটা তো অন্যায়।’

~ এক দুই জন মেয়েকে যে পছন্দ হয়নি তেমন না৷ তবে সেভাবে কখনোই আমার কোন গার্লফ্রেন্ড হয়নি।”

~ আপনার সর্বপ্রথম ভালো লাগা কে ছিল।”

~ একটা মেয়ে।”

~ একটা মেয়ে, ছেলে যে না এটা তো জানিই। কিন্তু কে ছিল সে?”

~ জানি না। অত খোঁজ খবর নিইনি।”

~ আর তাকে কোন ক্লাসে থাকতে পছন্দ হয়েছিল?”

~ ক্লাস নাইন। বাচ্চা কালের প্রেম। অবশ্য প্রেমও বলা যায় না। আবেগ বলতে পারো।”

~ তাকে প্রপোজ করেছিলেন?”

~ না।”

~ কেন?”

~ তখন সাহসের বড্ড অভাব ছিল। এখন হলে চান্স নিয়ে দেখতাম।”

~ তার পরে কলেজ ভার্সিটিতে আর কাউকে মনে ধরেনি?”

~ মনে ধরার মত সুযোগটাই মন পায়নি। পড়াশোনা নিয়ে এত সিরিয়াস হয়ে পড়েছিলাম। অন্য দিকে মন দেওয়ার সময় হয়নি।”

~ আমাদের এটা বিশ্বাস করতে বলছেন এত হ্যান্ডসাম একটা ছেলে এতবছর ধরে সিঙ্গেল জীবনযাপন করছে!”

~ আফসোস। কিন্তু এটাই বাস্তব।”

~ অথৈকে আপনার কেন ভালো লাগে?”

এই প্রশ্নে আরমান একবার অথৈকে দেখল। কবি গলায় বলল,

~ ভালো লাগার কারণ নির্দিষ্ট করে কি বলা যায়? তোমাদের যখন কাউকে ভালো লাগবে তখন তার সবকিছুই ভালো লাগবে। তার খারাপ দিক গুলোও তোমার চোখে ভালো মনে হবে। আসলে ভালো লাগা পুরোটাই একটা অনুভূতি। যা অনুভব করা যায়। বিশ্লেষণ করা যায় না।’

ওদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠল,

~ দোস্ত পটে গেছি।”

আরমানের উত্তর শুনে অথৈর ঠোঁটের কোণেও সামান্য হাসির আভাস দেখা গেল। সব বান্ধবীরা আরমানের আচরণে ইমপ্রেস হয়েছে। আরমান ওদের সবাইকে ট্রিট দিল। বিয়েতে সবাইকে বরপক্ষ হয়ে যাওয়ার দাওয়াত দিল।
মিনহা অথৈর কানে ফিসফিস করে বলল,

~ এই মাল কোত্থেকে পেলি দোস্ত? আমাদের জন্যও দু’একটা আমদানি কর। এ তো সলিড মাল। কোন ভেজাল নেই। দেখলি কীভাবে আমাদের পটিয়ে নিল! মুখে মধু কথায় রস আছে। তোর বিবাহিত জীবন ঝাকানাকা।”

ফেরার পথেও অথৈই ড্রাইভ করছে। আরমান সরাসরি ওর দিকে না তাকিয়ে জানতে চাইল,

~ তাহলে বিয়ের ভাইভাতে কি আমি পাস করতে পেরেছি!’

~ সেটা তো আমার বন্ধুরা বলেই দিয়েছে।’

~ উত্তরটা আমি যাকে বিয়ে করছি তার থেকে শুনতে চাচ্ছি।’

~ ভালোই তো মিষ্টি কথায় মেয়ে ভোলাতে পারেন। কিন্তু বিয়ের পর এসব চলবে না। আমার অনেকগুলো শর্তের মাঝে এটাও একটা শর্ত, যে আমার বর হবে তার কোন মেয়ে বন্ধু থাকতে পারবে না। বন্ধুর বউদের সাথেও তার খাতির থাকতে পারবে না।’

অথৈ সামনের দিকে চোখ রেখে কথাগুলো বলেছে। আরমান ওকে দেখে হাসল৷ অথৈ এখন থেকেই তাকে নিয়ে জেলাস ফিল করছে। যাক তার ক্ষেত্রে ভালোবাসার প্রথম ধাপই অথৈর জেলাস ফিল করা।

চলবে_

#একটি_রূপকথার_গল্প’৯’
#জেরিন_আক্তার_নিপা

রাতে বাড়ি ফিরে অথৈ কাউকে জানাল না সে সারাদিন আরমানের সাথে ছিল। বাবা আরমানকে তার জন্য পছন্দ করেছে। সে তো আর করেনি। আরমান ভালো লোক সেটা অন্য ব্যাপার। যদি সে বদ লোক হতো তখন! বাবা জোর করে তার বিয়ে দিতে চাচ্ছে এজন্য বাবাকে তো একটু ভুগতেই হবে। ফুপিকেও সে এত সহজে ছেড়ে দিবে না। সবাইকে একচোট নাকানিচুবানি খাইয়ে তারপর বিয়ের পীড়িতে বসবে। ফুপি নিজের বেলায় কত কাহিনী করেছে। তার ভালো মানুষ ফুপাটাকে নাকি দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে। অথচ তার বেলা দুই ভাই বোন মিলে তাকে না জানিয়ে বিয়ে ঠিক করে এসেছে! অথৈর সিদ্ধান্তের যেন কোন মূল্য নেই। আশরাফ হোসেন না খেয়ে মেয়ের জন্য বসে ছিলেন। অথৈ ফিরলে একসাথে খাবে। কিন্তু অথৈ তো খেয়ে এসেছে। বাবাকে বসে থাকতে দেখে অথৈ বলল,

~ তুমি খেয়ে নাও বাবা। এখন থেকে আমাকে ছাড়াই খাওয়া অভ্যেস করো। মেয়েকে বিয়ে দিতে যাচ্ছ। শ্বশুরবাড়ি থেকে আমি নিশ্চয় রোজ রোজ তোমার সাথে বসে খেতে আসতে পারব না।’

মেয়ের কথায় আশরাফ হোসেন কষ্ট পেলেন। কষ্টটা এটা ভেবে হচ্ছে অথৈ এত তাড়াতাড়ি কেন বড় হয়ে গেল? কেন ওর বিয়ে দিতে হচ্ছে! মেয়েটা চলে যাবে ভাবলেই বুক পুড়ে তার। একটা মাত্রই মেয়ে তার। এই মেয়েকে কেন সারাজীবন নিজের কাছে রাখতে পারল না। অবশ্য আরমানের সাথে অথৈর বিয়ে এজন্যই দিচ্ছেন এতে মেয়েটা তার থেকে বেশি দূরে যাবে না। আরমানেরও তো বাবা মা নেই। বিয়ের পরে ছেলেটাকে বলে বুঝিয়ে এই বাড়িতে নিয়ে এলেই হবে। মেয়ে জামাই দু’জনই চোখের সামনে থাকবে। আরমান উনাকে সম্মান করে। তার এই আবদারটা অন্যায় হলেও ফেলবে না। তাছাড়া তার যা কিছু আছে সবই তো অথৈর। এই বাড়ি গাড়ি ব্যবসা সম্পত্তি অথৈর স্বামী হিসেবে সবই তো আরমানকেই দেখতে হবে। আশরাফ হোসেন একা মানুষ, মেয়ের জামাই কি তাকে ফেলে দিবে!
অথৈ বাবাকে দেখছে। বাবার ধ্যান ভাঙাতে বলল,

~ এত কী ভাবছ?’

~ কিছু না। তুমি খাবে না?”

~ না। আমার খিদে নেই। তুমি জানো না বিয়ের কথা উঠলে মেয়েদের খাওয়া ঘুমও উঠে যায়। তুমি গিয়ে খেয়ে নাও।’

আশরাফ হোসেন একবার ভাবলেন অথৈর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে এসব করা কি ঠিক হচ্ছে? মেয়েটা নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে না। কিন্তু ওর নিজেরও তো কিছু খুশি আছে।

~ অথৈ মা, বিয়েটা কি তুমি করতে চাচ্ছ না?”

~ যদি বলি না তাহলে কি তুমি বিয়ে ভেঙে দিবে?”

~ আরমান ভালো ছেলে মা। ও তোমাকে সুখে রাখবে।’

~ আমি কখন বলেছি তোমার ছাত্র খারাপ ছেলে? তোমার বিষয়সম্পত্তির লোভে যেকোনো ছেলেই আমাকে মাথায় তুলে রাখবে।’

~ আরমান তেমন না। আমার সম্পদের উপর ওর কোন লোভ নেই। ছেলেটা অল্পতেই খুশি।’

~ বুঝেছি। ছাত্রের আর এত গুণগান গাইতে হবে না। জীবনে তোমাদের একটা কথা বাদে সব কথাই আমি রেখেছি। তোমার আর ফুপির পছন্দের বাইরে গিয়ে ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়ছি। এছাড়া তোমরা আমার জন্য যা ঠিক করেছ সেটাই আমি ভালো মনে করেছি। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না।’

~ কিন্তু আমি চাই না আমাদের কথা রাখতে গিয়ে তুমি নিজের খুশি বিসর্জন দাও।’

~ তোমার আর ফুপির খুশিই আমার খুশি বাবা। তোমাদের ছাড়া আমি খুশি হতে পারব না।’

আশরাফ হোসেনের চোখ ভিজে উঠেছে। মেয়েকে লুকিয়ে চোখ মুছলেন তিনি। গলায় কান্না আটকে আছে। এখন কিছু বললে অথৈ বুঝে যাবে বাবা কাঁদছে। তাই আর কিছু বললেন না। নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। অথৈ ঘরে চলে এলো। অনেকটা সময় নিয়ে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করে বেরিয়ে এলো। ভেজা চুল মুছতে মুছতে রান্নাঘরে চলে এলো।
অথৈ বাবার ঘরে খাবার নিয়ে গিয়ে নিজের হাতে বাবাকে খাইয়ে দিয়ে এলো। খেতে খেতে আশরাফ হোসেন বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেললেন। অথৈও বাবার সাথে কাঁদল। মনে মনে ঠিক করে নিল, বিয়ের পরও এখানেই থাকবে সে৷ বাবাকে একা রেখে কোত্থাও যাবে না।
……
আরমান অথৈকে নিয়ে বিয়ের শপিং করতে এসেছে। তার মা, বোন, ভাবি এমন কেউ নেই যে অথৈর সাথে শপিংয়ে আসবে। তাই তাকে একাই আসতে হয়েছে। বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে। অথৈর মনে সে একটু একটু করে জায়গা তৈরি করে নিতে পেরেছে হয়তো। বিয়ের শাড়ি, লেহেঙ্গা, গয়নাগাটি থেকে শুরু করে সবই অথৈর পছন্দের নেওয়া হবে। কিন্তু অথৈর এসব সম্পর্কে কোন আইডিয়াই নেই। প্রায় পুরো মার্কেট দেখিয়ে ফেলার পরও অথৈর কিছু পছন্দ হচ্ছে না। সে আরমানের দিকে ফিরে হতাশ গলায় বলল,

~ আমি আগেই বলেছি। এসব বিষয়ে আমার কোন ধারণাই নেই। ছোট থেকেই আমার সব শপিং ফুপি করে। আমি নিজে কোনদিন একটা ওড়নাও কিনি নি। তাছাড়া আমার পছন্দ ভীষন বাজে। আপনি বরং এক কাজ করুন, আপনার যা যা ভালো লাগে নিয়ে নিন। আমি সব পরতে পারব। আমার নিজের কোন পছন্দ যেহেতু নেই তাই আমার কোন সমস্যা হবে না।’

আরমান অথৈর দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবল। তারপর হেসে বলল,

~ ঠিক আছে। কিন্তু আমার পছন্দের উপর আপনার ভরসা আছে তো?’

আরমান কথাটা কী ভেবে বলেছে তা অথৈর বুঝতে বাকি রইল না। অথৈ তার পছন্দ। এবং এক্ষেত্রে যে তার ভুল হয়নি এটা সে নিশ্চিত। অথৈও হেসে ওর কথায় সমর্থন করল।

~ ঠিক আছে। তবে আমার লাল রঙ একদম পছন্দ না। বউয়েরা স্বভাবতই টকটকে লাল রঙ পরে। কিন্তু লাল রঙ আমার চোখের বিষ।’

অথৈ বসে ফোন ঘাঁটছে। আরমান আবার নতুন করে শাড়ি দেখা শুরু করেছে। যেটা যেটা তার ভালো লাগছে তা অন্য পাশে সরিয়ে রাখছে। অথৈ আড়চোখে মানুষটাকে দেখল। কত খুশি মনে হচ্ছে। বউয়ের জন্য শাড়ি সিলেক্ট করছে এটা মনে হচ্ছে তার জীবনে সবচেয়ে পছন্দনীয় কাজ। মুখ থেকে হাসি সরছেই না। অথৈ একবার শুধু বলল,

~ পুরো মল বাড়ি নেওয়ার উদেশ্য আছে নাকি? এত শাড়ি কে পরবে!’

আরমান ওর দিকে না তাকিয়ে উত্তর দিয়েছে, ‘আমার বউ।’

এরপর আর অথৈ কিছু বলল না। বিয়ে করার খুশিতে লোকটার মাথা আউলিয়ে গেছে। কী করছে না করছে নিজেও বুঝতে পারছে না। কিন্তু আরমানের এসব পাগলামি দেখে দোকানের লোকটা মিটিমিটি হাসছে।
মোট ষোলটা শাড়ি আরমান অথৈর হাতে তুলে দিয়ে বলল,

~ সব কয়টা একবার করে ট্রাই করে দেখুন। ভালো না লাগলে আরও অপশন আছে।’

অথৈ চোখ কপালে তুলে বলল,

~ অসম্ভব! সবগুলো কীভাবে ট্রাই করব আমি! আমি পারব না। তাছাড়া এসব করতে করতেই রাত হয়ে যাবে।’

~ হোক। আমার কোন তাড়া নেই। রাত হয়ে গেলে আমি নিজে আপনাকে বাড়ি দিয়ে আসব।’

অথৈ বেশ বুঝতে পারছে এই লোক তার জীবন ত্যানা ত্যানা করে দিবে। বিয়ের পর এই লোক হবে ফুপার মত বউ পাগল। সে যদি বলে, এখানে সারাদিন বসে থাকুন একদম উঠবেন না। তাহলে এই লোক তা-ই করবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ট্রায়াল রুমের দিকে এগোলো অথৈ। এক এক করে তিনটা শাড়ি পরে বাইরে এসে আরমানকে দেখিয়ে গেছে। আরমান বেচারা শাড়িতে হবু বউয়ের রূপ দেখে কাবু হয়ে গেছে। অথৈর থেকে চোখ সরাতে পারছে না ও। চতুর্থ বার অথৈ ট্রায়াল রুম থেকে বের হতে অনেক সময় নিচ্ছে। আরমান বাইরে ওর অপেক্ষায় থেকে ভেবে পেল না এত সময় লাগছে কেন? অথৈর কোন সমস্যা হলো নাকি? সে আরও পাঁচ মিনিট দেখল। তারপরও অথৈ বেরুচ্ছে না দেখে আরমান দরজায় গিয়ে টোকা দিয়ে ডাকল,

~ অথৈ, কোন সমস্যা হয়েছে? ঠিক আছেন আপনি?’

ভেতর থেকে অথৈর কোন সাড়াশব্দ আসছে না। আরমান বিচলিত হলো। কী হয়েছে অথৈর!
সে এবার জোরে জোরে ডাকতে লাগল। তার ডাক শুনে অলরেডি কিছু মানুষের ভিড় তৈরি হয়েছে এখানে। শপিংমলের লোক এসে জানতে চাইল কী হয়েছে। আরমান ওদের জানাল। লোকটা দেখছি বললে আরমান রেগে গেল।

~ কখন দেখবেন আপনারা? ভেতরে আমার বউ আটকে আছে। ও ঠিক আছে কি-না সেটা জানি না আমি। দরজা খোলার ব্যবস্থা না হলে দরজা ভেঙে ফেলুন।’

~ স্যার আপনি চিন্তিত হবেন না। আমরা দেখছি।’

~ আপনাদের আর দেখতে হবে না। যা করার আমিই করছি।’ বলেই আরমান কাঁধ দিয়ে দরজায় ঠেলতে লাগল। বার কয়েক জোরে জোরে ধাক্কা দেওয়ার পর দরজা খুলে গেল। আরমান দেখল অথৈ মেঝেতে পড়ে আছে। সে এক ছুটে অথৈর পাশে গিয়ে বসল। অথৈর গা ধরে বুঝতে পারল প্রচন্ড জ্বরে অথৈ সেন্স লেস হয়ে গেছে। আরমান আন্দাজ করল, কম হলেও জ্বর ১০২/৩ তো হবেই। আরমান কিচ্ছু না ভেবে অথৈকে কোলে তুলে নিল। মেয়েটা এই প্রচণ্ড জ্বর নিয়েও তার সাথে এসেছে। তাকে বুঝতেই দেয়নি সে যে অসুস্থ। এতটা সময় এভাবেই কাটিয়েছে। শেষে ওর সহ্য ক্ষমতার সীমা পার হয়ে গেলে জ্ঞান হারিয়েছে। আরমানের নিজের উপর ভীষণ রাগ লাগছে। সে কেন বুঝেনি অথৈ অসুস্থ। ওর হয়তো খারাপ লাগছে। তার জন্যই তো অথৈকে এতটা কষ্ট সহ্য করতে হলো। স্যারকে কী জবাব দিবে তো? বিয়ের আগেই স্যারের মেয়ের খেয়াল রাখতে পারছে না। বিয়ের পর কেমন রাখতে পারবে তা নিয়ে যদি স্যারের মনে সংশয় তৈরি হয়!
আরমান অথৈকে বাড়ি নিয়ে এলো। গাড়ি থেকে কোলে করে ভেতরে নিয়ে এলে মারজিয়ার চোখ ওদের উপর পড়ে। অথৈকে এই অবস্থায় দেখে মারজিয়া আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল,

~ অথৈ! কী হয়েছে ওর! আরমান, ওর কী হয়েছে?’

~ প্রচণ্ড জ্বরে জ্ঞান হারিয়েছে মা।’

~ জ্বর! কী বলো! কখন জ্বর এলো ওর?’

আরমান অথৈকে ওর রুমে নিয়ে গেল। মারজিয়া এতক্ষণে ডাক্তার সহ আশরাফ হোসেনকেও খবর দিয়ে ফেলেছেন। অথৈ আপা জ্ঞান হারিয়েছে শুনে বাড়ির সব কাজের লোক বিয়ের আয়োজন ফেলে জড়ো হয়ে গেল। আরমান নিজেও কতটা অস্থির হয়ে পড়েছে তা ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বারবার সে অথৈর নাম ধরে ডাকছে,

~ অথৈ! অথৈ…’

চলবে_

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here