এবারও_তুমি_বুঝলেনা,পর্ব_৩

0
879

#এবারও_তুমি_বুঝলেনা,পর্ব_৩
#Alisha_Anjum

তিশু ঘর থেকে প্রস্থান করতেই নিধি সন্তর্পণে একটা চিন্তামুক্ত শ্বাস নিল। গোপন দৃষ্টিতে চাইল অধরের দিকে। অধর শুকনো মুখে তাকিয়ে আছে মাটির দিকে। নিধি ওড়নার আচল হতে হাত সম্মুখে আনলো। অধরের অগোচরে হাতের মুঠো একটু খুলতেই দেখা মিলল মোমে মুখ আটকানো একটা তাবিজের। নিধি মুচকি হাসলো। কী আছে জীবনে? যদি একটু সুখই না নিতে পারে, একটু আনন্দেই দিন কাটাতে না পারে তাহলে এই এক জীবনের মূল্যটা কি? পৃথিবীতে বাঁচতে হলে সুখ কেঁড়ে ছিড়ে নিতে হয়। মুহিব ছেড়ে গেছে। তো কি হয়েছে? রূপ যৌবন তার কি কম? অধরের সংসারে আসবে সে! অধরের চেয়ে ভালো পুরুষ পাওয়া আর সম্ভব না। নির্ভেজাল একটা সংসার অধরের। নেই বাচ্চাকাচ্চা। নিধির এ সংসারে এঁটে বসতে কোনো সমস্যাই হবে না! অধর বড় ভালোবাসে ছোট বাচ্চাকাচ্চা।

— নিধি কাল মুহিবকে ফোন করে আসতে বলবি।

মুহিবের কথা কানে যেতেই নিধি ঝটপট লুকিয়ে ফেলল তাবিজ। কিন্তু মনে নতুন আরেক ভয়। মুহিব কে দিয়ে কি করবে অধর? নিধি শুকনো গলায় আগ্রহ নিয়ে বলে উঠলো

— মুহিব কেন? মুহিবকে দিয়ে কি করবি? কি… কি হবে ওকে দিয়ে?

অধর নিধির উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে কেবলই শান্ত। বিরস মুখে সে বলল

— আমি কথা বলবো ওর সাথে। আসতে বলবি ওকে।

নিধি ঢোক গিলল। ওড়নার আচলে কপালের ঘাম নির্যাস করে বলে উঠলো

— অধর আমি ওর কাছে ফিরতে চাই না। ও ওর নতুন বউ নিয়ে দিন কাটাক। আমি যেতে চাই না ঐ বেইমানের কাছে।

— তোদের কি ডিভোর্স হয়েছে? হয়নি তাই না? তুই তো পেপারে সাইন দিসনি।

অধরের প্রশ্নে নিধি চুপ। নিজের কথায় ফেসে গেছে। ইশ! কেন যে এতো সব বলতে গেছিল অধরকে। অধর নিধির দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছে। একটু পরে অধর আবার বলে উঠলো

— নিধি জীবন একটাই। তোর একটা বাচ্চা আছে। নেহালের ভবিষ্যতের কথা ভেবে অন্তত তোর মুহিবের কাছে যাওয়া উচিত। ছেলেরা একাধিক বিয়ে করতেই পারে। মুহিব হয়তো ভুলেই না হয় করে ফেলেছে। কিন্তু তোর মেনে নেওয়া উচিত।

অধরের কথাগুলো শুনে নিধি ভীষণ শঙ্কিত হলো। অধর যে তাকে পরোক্ষভাবে এ বাড়ি ছাড়তে বলছে তা তো স্পষ্ট। নিধির ভেতর বাহির যেন ঝাঁঝিয়ে উঠছে। ভয়ে হৃদপিণ্ড অস্থির। এ বাড়ি ছাড়লে সে কোথায় যাবে? মা বাবা তো একদমই মানবে না। মুহিবের কাছে তো সে যাবেই না। নিধি চোখ তুলে চাইলো অধরের দিকে। হঠাৎই সুন্দর মুখখানায় ফুটিয়ে তুলল মায়া, অসহায়ত্ব। মুখ ফুটে বলে উঠলো

— আমি খুব বোঝা হয়ে গেছি তাই না? তুই ডিরেক্টলি বলে দে তুইও আমায় সহ্য করতে পারছিস না। আজ ভাগ্য আমার খারাপ বলে সবাই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ভেবেছিলাম তুই অন্তত আমার কন্ডিশন বুঝবি। কিন্তু নাহ! তুইও বুঝলি না।

ছলছল চোখে মিথ্যা মায়া লাগিয়ে কথাগুলো ব্যাক্ত করলো নিধি। অধর যেন থতমত খেয়ে গেল। অপ্রস্তুত হয়ে পরলো সে। নিধি নেহালকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। অধরের মাথায় ঝাকে ঝকে দুশ্চিন্তা এসে ভির জমালো। সে বুঝেছে তিশুর গোমড়া মুখের কারণ, অবিশ্বাস্য কর্মকাণ্ডের হেতু। তিশু হয়তো সহ্য করতে পারছে না নিধিকে। তিশু চাইছে না নিধি এ বাড়িতে থাকুক। কিন্তু অধর কি করবে? বন্ধুত্বের খাতিরে সে নিধির বিপদের সময় তাকে ঠাই দিয়েছে। ছোট বাচ্চাটা খুব বাবা বাবা ডাকে। নেহালের মুখের যেন একটাই বাক্য, বাবা বাবা বাবা। অধরের মায়া হয়। সুন্দর ফুটফুটে একটা মায়াবী শিশু দেখলে কার না আদর করতে মন চাইবে? কিন্তু মেয়ে জাতি বড় বাঁকা রাশের। তবে তিশুর সাথে কোন প্রকার ঝামেলা অধর করতে চায় না। একদম না। তার কাছে তার প্রণয়িনী আগে। নিজের সংসারে সে ফাটল ধরাতে চায় না। কিন্তু নিধিকে কিভাবে কি বলবে অধর? অধর ভারী চিন্তায় মুষড়ে পড়লো। এই দ্বিঘাত সমীকরণ সে সমাধান করবে কি করে?

.
ব্যাস্ত শহরের ব্যাস্ততা যেন কমেই না। রাত ফুরিয়ে ভোর হয় ঘড়ির কাটা যেন ক্লান্ত হয় না। অধর প্রতিদিন মাগরিব আদায় করে মসজিদে। কিন্তু আজ ঘটা করে যাওয়া হলো হলো না। ছটফট অস্থির মন নিয়ে সে নিজের ঘরে বসে আছে। সময় চলতে চলতে তিন ঘন্টা পেরিয়েছে। এখন বাজে ঠিক পৌনে সাতটা। তিশু কোথায়? এখনও বাড়ি আসছে না কেন? চিন্তায় অধরের হাত পা যেন কাঁপছে। রাত হচ্ছে তো! তিশু কি অধরের উপর খুব রাগ করলো? অধরের বুক ক্রমাগত বিষিয়ে উঠছে। অস্থিরতায় অধর ঘরের মধ্যে পায়চারি শুরু করে দিয়েছে। করুন সূরে সে প্রার্থনা করা শুরু করে দিল মনে মনে, ” আল্লাহ আমার তিশুকে আপনি ঠিক রাইখের। ওর রাগ ভেঙে দেন আপনি। আমার তিশু ফিরে আসুক আমার কাছে। ”

অধর দু মিনিট পরপর ঘড়ি দেখছে। সেকেন্ডে সেকেন্ডে ফোন করছে। কিন্তু ফোন উঠনো হচ্ছে না। মায়ের কাছে খোঁজ নেওয়া হয়ে গেছে অধরের। কেউ বলতে পারে না তিশু কোথয়। অধর দারোয়ানের কাছে গিয়েছিল। সে বলেছে আছরের পর তিশু নাকি শুকনো মুখে বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে। তারপর আর তাকে ফিরে আসতে দেখা যায়নি। দারোয়ানের কাছ থেকে অধর নিজের ঘরে ছুটে এসেছে। সে ওয়ালেট, ফোন পকেটে পুরে প্রস্তুত। তিশুর উদ্দেশ্যে বের হবে সে।

অধর তড়িঘড়ি করে সিড়ি ভেঙে নিচে নামছে। ধড়ফড়িয়ে নামতে গিয়ে হোটচ খেল একবার। হয়তো পায়ে একটু ব্যাথা পেল। কিন্তু তোয়াক্কা নেই তার। অধরের মা ড্রইং রুমে বসে টিভি দেখছিলেন। ছেলের এমন বিক্ষিপ্ত আচরণ দেখে তড়িঘড়ি করে উঠে পরনেন। অধরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন

— আস্তে। কি হয়েছে? ব্যাথা পাবে অধর।

অধর মায়ের গলা শুনে ফিরে চাইলো মায়ের দিকে। ঝটপট এগিয়ে এসে মায়ের হাত ধরলো। সে সচরাচর এমন করে না। মা ছেলে দু’জনেই গম্ভীর স্বভাবের। কিন্তু আজ কেন যেন ভীষণ খারাপ লাগছে। বুকের ভেতর খাঁ খাঁ করছে। ক্রমেই অস্থিরতা বেড়ে উর্ধ্বে। অধর অতিশয় চিন্তিত কন্ঠে বলে উঠলো

— আম্মা তিশু এখনো কেন আসছে না। দেখেন এখন এশার আজান পরবে।

অধরের মা ছেলের মুখের দিকে দৃষ্টিতে চাইলেন। কি খুঁজলেন তিনি অধরের চোখে কে জানে! শান্ত কন্ঠে বললেন

— এতো অস্থির হওয়ার কি আছে? তিশু রাগ করে তো ওর বাবার বাড়িতেও যেতে পারে। ফোন করেছিলে তিশুর বাবার কাছে?

অধর না সূচক মাথা নাড়লো। অধরের মা অধরকে অভয়বাণী দিতে দিতে টেনে এনে সোফায় বসালেন। এক গ্লাস পানি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল

— ফোন করো তিশুর বাবার কাছে।

অধর পানিটুকু এক নিশ্বাসে শেষ করে সামনের ছোট টেবিলটার উপর রখলো। অতপর ছটফটে মন নিয়ে ফোন করলো শশুড়ের কাছে। তার মন একবারও বলছে না তিশু বাবার বাড়ি গেছে। তিশু এতো দূরের পথ পাড়ি দেবে না। হলোও তাই। অধরের ভাবনায় একটুও ভ্রান্তি নেই। ওপাশে তিশুর বাবা ফোনে বলে দিল তিশু তাদের কাছে নেই। অধর এবার ফোন কেটে মায়ের দিকে অসহায় চোখে চাইলো। বসা থেকে উঠে পরলো সে। মায়ের উদ্দেশ্যে বলল

— আম্মা আমি বের হচ্ছি। আমি জানতাম আমার তিশু ওখানে যায়নি। আমার মন বলে আমার তিশুর কিছু একটা হয়েছে। ও কখনো রাগ করে বাড়ি ছাড়ে না।

অধর যাওয়ার জন্য উদ্ধত হতেই পিছু টান দিল তার মা। বলে উঠলো

— আমি এখন তোমাকে যেতে দেবো না।

মায়ের কথায় অধর বিস্ফোরিত। পিছু ঘুরে উত্তেজিত হয়ে সে বলল

— আম্মা! কি বলছেন আপনি? তিশু বাড়ি ফিরছে না। রাত হয়ে গেছে। আমি ওকে খুজতে যাবো মা?

— না তুমি যাবে না। আমি এই রাতের বেলায় তোমাকে যেতে দেবো না। দেখনো না তুমি আকাশে মেঘ করেছে। বিজলি চমকাচ্ছে। এমন আবহাওয়া তুমি বাইরে যাবে না।

অধর দ্রুত হেটে জানালার পাশে গেল। ঘন কালো অন্ধকার হঠাৎ করে তীব্র আলোয় আলোকিত হচ্ছে। মেঘ ভীষণ দাপটের সাথে গুড়গুড় করছে। অধরের ভয় এবার একশ গুণ বেড়ে গেল। তিশু কোথায় আছে এই পরিস্থিতিতে?

— আম্মা আমার যেতে হবে। আমি আপনার কথা মানতে পারছি না। ক্ষমা করবেন।

জানালা থেকে সরে এসে মেইন ডোরের দিকে ছুটতে ছুটতে বলল অধর। ইতিমধ্যে ড্রইং রুমে নিধিসহ অধরের বাবার আগমন ঘটেছে। নিধি পেছন থেকে বলে উঠলো

— অধর যাসনে এই বৃষ্টির মধ্যে। কাল খুজতে যাস।

অধরের বাবাও ভরাট কন্ঠে বলে উঠলেন

— অধর একা যেও না। এই ঢাকা শহরে তুমি ওকে একা কোথায় খুজবে?

অধরের যেন কারো কথা কানে যাচ্ছে না। সে দরজা খুলেছে। ঠিক সেই সময় অধরের মায়ের আরো একবার নিষেধাজ্ঞা। তিনি দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন

— অধর তুমি যাবে না বলছি। আমি এই রতে খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে যেতে দেবো না। একজনের জন্য কি সবার বিপদের মধ্যে ঝাপ দিতে হবে?

মায়ের কথা অধরের মনে একটুও আঁচড় কাটতে পারলো না। বরং সে সম্মুখ পানে মুখ রেখেই বলে উঠলো

— আম্মা ঐ একজন আপনার ছেলের জীবন। আজ আপনি ছেলেকে ঝড় বৃষ্টির মধ্যে বের না হতে দিলেও কাল যদি তিশুর কিছু হয়ে যায়, তাহলে আপনার ছেলেকে আপনি ঠিকঠাক নাও দেখতে পারেন।।

কথাগুলো বলে অধর বিসমিল্লাহ বলে মাটিতে পা ফেলল। দু কদম এগুতেই ঝুপঝুপ করে নেমে পরলো বৃষ্টি। অধর হাঁটতে লাগলো বৃষ্টির মধ্যে তার প্রিয়তমার খোঁজে। রয়ে সয়ে সর্বাঙ্গে বৃষ্টির বিচরণ হচ্ছে। কিন্তু একবুক ভালোবাসা নিয়ে এক অনবদ্য, প্রেয় স্বামী হেঁটেই চলেছে।

চলবে…..

( ভেবেছিলাম ইতি টেনে দেবো। আবার হঠাৎ করেই গল্পটা টেনে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে। তিশু আর অধরের প্রতি আমার নিজেরই মায়া জন্মেছে। আপনাদের অভিমত কামনা করছি। আর আশা করি ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন ?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here