এবারও_তুমি_বুঝলেনা,পর্ব_৭

0
1370

এবারও_তুমি_বুঝলেনা,পর্ব_৭
#Alisha_Anjum

অধরের কথায় নিধির মুখ শুকিয়ে উঠলো। তিশুর খোঁজ মানে? অধর যদি তিশুকে খুজে পায় তাহলে তার কি হবে? নিধির উড়ে এসে জুড়ে বসা তো হবে না এসংসারে। নিধি শংকায় চোখ মেলে চাইলো অধরের দিকে। অতি উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো

— নিশান কে? সে কিভাবে তোকে তিশুর খোঁজ দেবে।

অধর শার্টের হাতা ভাজ করছিল। নিধির কথায় আপন কর্ম স্থগিত রেখে বলল

— নিশান ভাইয়া আমার বড় চাচিমার ছেলে। আম্মা তো আর নিউজ ছাপাতে দিলো না। তাই গত রাতে আমার বিশ্বাস যোগ্য মানুষ গুলোকে ফোন দিয়ে তিশুর কথাটা বলেছিলাম। যখন নিশান ভাইয়ের কাছে বললাম তখন তিনি বললেন চট্টগ্রাম যেতে। ওখানে গেলে দু ভাই মিলে কোন ব্যাবস্থা করে তিশুর খোঁজ করা যাবে।

— তার মানে তুই চট্টগ্রামে বেশ কিছু দিন থাকতেও পারিস?

অধর মাথা নাড়লো। মুখে মলিনতার ছোয়া। দুঃখ প্রকাশ কারে সে বলল

— এখানে তো কেউ আমায় সাহায্য করছে না। আম্মা তো আগে থেকেই না জানি কোন কারণে তিশুকে সহ্য করতে পারে না। আমাকে ঢাকা থেকে তিশুর খোঁজ নিতেই দেবে না।

নিধি চুপ রইল। তা বটে! অধরের মা একা নয়। তিশুও খোঁজ নিতে দেবে না।

— নিধি তাড়াতাড়ি ফোনটা দে। আমার বাসে যেতে হবে অনেক সময় লাগবে। আম্মা গাড়ি নিতে দেবে না।

নিধি মনে ভাবনা নিয়ে মৃদু স্বরে ‘হুম’ বলে উঠে পরলো। অধর নেহালকে কোলে নিয়ে খামোখা কথা বলছে নেহালের সাথে

— তোমার আন্টিকে খুজতে যাচ্ছি। দোয়া কোরো তো! তোমার বোকা আন্টিটা যেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসে আমার কাছে।

নিধি অধরের কথা শুনে মুচকি হাসলো। আর ফিরে পাওয়া! ঠোঁটে কুটিল হাসে ঝুলিয়ে কখে সে অধরের অগোচরে এক সর্বনাশা কাজ করে ফেলল। টুপ করে অধরের ফোনটা ছেলের মতো জানালা দিয়ে ছুড়ে মারলো। ফোনটা মুহুর্তেই শূণ্য থেকে পারতে পারতে একসময় ঠাস করে পরলো ময়লার স্তুপে। নোংরা ড্রেনে। এই ফোনের উছিলায় অন্তত দুদিন আটকে রাখা যাবে অদরকে। তিশুর খোঁজ নিতে পারবে না।

অধর নেহালের সাথে কথা বলে নামিয়ে দিল কোল থেকে। নিধির দিকে ক্রমশ এগিয়ে যেতেই নিধি তড়িঘড়ি করে জানালা থেকে দূরে সরে এলো। সে এমন ব্যাস্ততার মিথ্যে নাটক করতে আরম্ভ করলো যেন এক নির্মল, স্বচ্ছ অন্তরের নারী খুব মনোযোগ দিয়ে বন্ধুর ফোন খুঁজছে। অধর নিধির এদিক ওদিক ছোটাছুটি দেখে বলে উঠলো

— কি হয়েছে? কি খুঁজছিস?

অধরের প্রশ্নে নিধি স্থির হলো। মুখাবয়বে টেনে আনলো গভীর অসহায়ত্ব।

— ফোনটা তো পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে নেহাল জানালা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। ইদানীং ওর অভ্যাস কিছু হাতে দিলেই জানালা দিয়ে ফেলে দেয়।
নিধির বলা বাক্যগুলো তুমুল ঝড় আনলো অধরের বুকে। বুকটা শঙ্কায় ধুক ধুক করছে। সে ছুটে গেল জানালার কাছে। নিচের দিকে দৃষ্টি ফেলতেই স্পষ্ট দেখা গেল নোংরা ড্রেন। অধরের আফসোসে হাশফাশ লাগছে। ফোন না হলে সে যোগাযোগ করবে কিভাবে? চট্টগ্রাম নিশানের বাসায় যাবেই বা কিভাবে? কখনো নো যায়নি সেই বাড়িতে। আম্মাকে নিয়ে বাবা চলে আসার পর আর যোগাযোগ রাখা হয়নি। অনামিকা খান শশুর বাড়ি থেকে একেবারেই ছিন্ন। অধরের চিন্তায় মাথা আউলে যাচ্ছে। দিশেহারা সে। এখন কি করবে?

.
নিশান ব্যাস্ত ভঙ্গিতে হাত ঘড়িতে একবার তাকাচ্ছে। আবার তাকাচ্ছে ড্রয়িংরুমে। অধর আসবে বলে সে আজ হসপিটাল থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছে। অপেক্ষার সময় হলো তার প্রায় ১ ঘন্টা। ফর্মাল ড্রেস সে এখনো ছাড়েনি।

— ড্রেস চেঞ্জ কর বাবা। অধর হয়তো জ্যামে আটকেছে।

মায়ের কথায় নিশানের চঞ্চল চোখ জোরা ক্ষণিকের জন্য স্থির হলো। একটু হেসে বলল

— তোমার কি মনে হয় মা অধরকে চাচিআম্মা আসতে দেবে? আমার এখন মনে হচ্ছে চাচিআম্মা আটকে দিয়েছে। আমাদের সাথে তো উনি কোনো সম্পর্কই রাখতে চান না।

— তা ঠিক বলেছিস। আচ্ছা ওকে একটা ফোন করে দেখ তো।

নিশান মায়ের কথায় সম্মতি দিল। পকেট থেকে ফোন বের করে ফোন দিল অধরকে। সঙ্গে সঙ্গে এক সুশ্রাব্য কন্ঠ হতে ধ্বনিত হলো ” আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটিতে এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না”

কন্ঠ মধুর হলেও কথাটা দারুণ তিক্ত লাগলো নিশানের। সে আশ্চর্যের দৃষ্টি মেলে ধরলো মায়ের দিকে। বলে উঠলো

— এটা কি হলো মা? সকালেই তো কথা হলো। অধর আমাকে জানালো ও আসবে।

— আবার ফোন দে তো!

নিশান মায়ের কথামত আরো বেশ কয়েকবার ফোন করলো। কিন্তু প্রতিবারই ঐ একই কথা। নিশানের মা ছেলের উপর ঈষৎ রাগ দেখিয়ে বললেন

— তুই কেন ওকে বলিসনি তিশু এখানে আছে? তাহলে অধর তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করতো। আলাদাভাবে বিষয়টা গুরুত্ব দিতো।

নিশান মায়ের কথার পিঠে অবুঝ কন্ঠে বলে উঠলো

— আমি তো ভেবেছিলাম অধরকে অবাক করে দেবো। একটা সারপ্রাইজ হবে। অধর অনেক খুশি হবে।

নিশানের মা ছেলের উপর আরেকবার বিরক্ত চোখে তাকালেন। তার ছেলে বোধ হয় সবসময় বেশি না বুঝলে হয় না। আজব পোলা পেরে ধরেছে! তার উপর যুগটাও যা এসেছে। বিপদে পরলেও সারপ্রাইজ, আপদেও সারপ্রাইজ, হাসিতেও সারপ্রাইজ, খাইতে উঠতে বসতে শুতে সবসময় সারপ্রাইজ। নিশানের মা ফুস করে নিশ্বাস ছাড়লেন। তাদের সময়টাই ভালো ছিল। এতো সারপ্রাইজ ছাড়াও তাদের অন্তর অন্তর সম্পর্ক ছিল।

খিলখিল হাসিতে আকাশ বাতাস যেন মুগ্ধ। মেয়ের মতো নিলীমাকে স্নেহে ভাসিয়ে দিচ্ছে তিশু। বেশ সুন্দর মুহুর্ত কাটে তার। নিলীমা প্রথমদিকে তিশুর ধার ঘেসতে চাইতো না। কিন্তু এখন খাওয়া গোসল ঘুম সে বাবার চেয়ে তিশুর কাছেই বেশি প্রত্যাশা করে।

— আন্টি তুমি আমার কে?

নিলীমার কথায় তিশু অবাক চাহনি ফেলল তার দিকে। একটু হেসে বলল

— আমি তোমার আন্টি!

— আমার মা কে এনে দেয় না আমার বাবা।

ছোট্ট মুখের অভিমানী বাঁক। তিশর বড্ড মায়া হলো। নিলীমাকে কোলের উপর সযত্নে বসিয়ে বলল

— আমারও কোন মেয়ে নেই। তোমার মত পিচ্চি একটা সোনা নেই।

— কেন?

— আল্লাহ দেয়নি।

নিলীমা বুঝলো কিনা কে জানে? সে হঠাৎ নেমে পরলো তিশুর কোল থেকে। দৌরে প্রস্তান করলো তিশুর ঘর থেকে। তিশু পিছু ডালো। পিচ্চি পাকা মেয়ে সাড়া দিলো না। তিশুর মুচকি হাসলো। আজ যদি সে সুস্থ তাকতো। মা হওয়ার ক্সমতা সে না হারাতো তাহলে তারও এমন একটা সন্তান থাকতো। হাটি হাটি পা পা করে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াতো। অধর বাবা হতো। তিশু হতো মা। কত্ত কত্ত জায়গায় ঘুরে বেড়াতো তারা! তিশুর শাশুড়ির অভিযোগ কমতো। তিশুর উপর থেকে। সুখী একটা সংসার তিশুর ভাগ্যে জুটতো। ভাবতে ভাবতে তিশুর চোখ জল গড়িয়ে ফেলল। সবার হয়তো সব কিছু থাকে না। এই যে নিলীমা, তার মা নেই। সুন্দর বাবা আছে কিন্তু সুন্দর মা নিলীমার নেই। সে একা শুয়ে আছে স্বামী সন্তান ছেড়ে মাটির ঘরে। এটাই আসল সত্য। মৃত্যুই বড় সত্য।

তিশুকে সেদিন নিশান বলেছে নিলীমার মায়ের কথা। শুনে তিশুর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল ভয়ে। রেলস্টেশনে যে লোকটা তিশুকে তাড়া করেছিল সেই লোকটা একজন প্রফেশনালি ধর্ষক বোধ হয়। তার সাথে আরো বেশ কয়েকজনের দল ছিল একসময়। যে দলের নিকৃষ্ট মানব গুলো সর্বনাশ করেছিলো দুবছর আগে নিশানের। নিলীমাকে তারা সেদিন শিকার বানিয়েছি। নিশান আর মারিয়া সেদিন নিলীমার মামার বাড়ি থেকে ফিরছিলো। ভীষণ রাত ছিল। মারিয়ার তখন লেগেছিল পানির তেষ্টা। নিশান মারিয়াকে রেখে মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিল একটু অদূরে পানি কিনতে। এই সুযোগে মারিয়া কে অপহরণ করে কিছু লোক। নিশান ফিরে এসে মারিয়ার জায়গা শূন্য দেখে। শত খোঁজার পরেও প্রিয়তমার দেখা মেলেনি। এদিক ওদিক তৎক্ষনাৎ ছড়িয়ে পরে মারিয়ার নিখোঁজ বার্তা। নিশান পুলিশ স্টেশনে খবর দেয়। তারা আসে। খোজাখুজি করে। অবশেষে ভোরে মারিয়ার ধর্ষণকৃত মৃত দেহ পাওয়া যায়।

.
অধর আর যেতে পারলো না আজ চট্রগ্রাম। দুপুর গড়িয়ে গেছে। সে এখন এসেছে মার্কেটে। বসুন্ধরায় তার নতুন ফোন ক্রয় কারার উদ্দেশ্য। নিধিও আছে তার সাথে। অধর ভীষণ বিরক্ত হয়েছে। মরার উপর খারার ঘা হিসেবে নিধির কেন আসতে হবে? অধর যত দ্রুত পারে ফোন কিনে রওনা দিতো চট্রগ্রামে। তার মন এখানে টিকছে না। কিন্তু নিধি তাকে আটকে দিয়েছে। অধরের কোলে তুলে দিয়েছে নেহালকে। আর নিজে ঘুরে ঘুরে শপিং করছে। অধর যেন অতি কষ্টে আজ এসব সহ্য করছে। কিছু বলতেও বিবেক বাঁধা দিচ্ছে।

— অধর এদিকে আয়।

অধরের বিতৃষ্ণার মাঝেই নিধির ডাক। অদর মুখে তিক্ততা নিয়ে এগিয়ে গেল। নিধি অধরের হাত ধরলো। অধর বেজায় অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। সে বিস্ফোরিত নয়নে চাইলো নিধির দিকে। হাত মোচড়াতে লাগলো অধর। নিধি বুঝেও না বোঝার ভান করলো। অধরকে টানতে লাগলো নিজ শক্তিতে। অধর অবুঝের মতো যেতে চাইছে। হাত ছাড়িয়ে মুখ ফুটে কিছু বলার জোও নেই। কোলে নেহাল, আশপাশে মানুষের সমাগম। সিনক্রিয়েট করা কি ঠিক হবে? আর নিদিই বা তাকে কেন জোড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে? কোথায় নিয়ে যাবে?

অধর ভাবনা আর ছটফটানি নিয়ে একসময় উপস্থিত হলো নিধির সাথে একটা দরজার সামনে। ট্রায়াল রুম হবে। নিধি অধরের পানে চাইলো। মৃদু হাসির রেখা তার ঠোঁটে। অধরের কাছে এ হাসি মোটেও সুবিধার মনে হলো না। সে কিছু বলতে যাবে ঠিক সেই মুহুর্তে নিধি সুযোগ বুঝে একটা ধাক্কা দিলো অধরকে। অধর কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিধি নিজেও ট্রায়াল রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। অধরের দিকে তাকিয়ে বলল

— আমি থাকতে তোর ঐ কালো বউয়ের দরকার নেই। তুই আমার হয়ে যা। অবশ্য তুই তো ভালো মানুষ আমার হবি না। তিশুর মধ্যে যে কি পাইছিস তুই বুঝি না। তবে আমি তোকে আমার করে নেবোই

কথাগুলো একাধারে বলছে আর নিধি নিজের জামা দাঁত দিয়ে কামড়ে ছিড়ছে। অধর নিধির আচরণে ভীষণ অবাক। তার আর বুঝতে বাকি রইলো না নিধির পরিকল্পনা। অধর ধুপ করে নামিয়ে দিলো নেহালকে। তারপর সজোরে একটা থাপ্পড় মারলো নিধিকে। অত্যন্ত আক্রোশে অধরের গলা থেকে বেরিয়ে এলো

— প্রস্টিটিউটের একটা লিমিট থাকা উচিত। তুই আস্ত একটা প্রস্টিটিউট। এখন বুঝলাম আমার সংসার নিশ্চিত তুই ভেঙেছিস।

কথাগুলো বলতেই নিধি প্রচন্ড রেগে গেলো। ক্রধের বশে একটা ধাক্কা দিলো অধরকে। টাল সামলাতে না পেরে অধর পরে গেলো নিচে। এই সময়ে অসাবধানতায় তার হাতের আঘাত পরলো নেহারের উপর। সঙ্গে সঙ্গে নেহালের গলা ফাটালো চিৎকার আরম্ভ হলো। অধর বিব্রত হয়ে গেলো। এরই মধ্যে বাচ্চার কান্নার আওয়াজে ভির জমলো ট্রায়াল রুমের বাইরে। ঠক ঠক আওয়াজ করছে বাইরে থেকে। দিচ্ছে জনগণ দরজা খোলার তাড়া। নিধি যেন সুযোগ পেলো। তার জন্য অধরকে ফাঁসানোর মুখ্যম সময়।

চলবে……

( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here