ভালোবাসার প্রান্ত,পর্ব-১

0
3140

“ভালোবাসার প্রান্ত”
(পর্ব-১)
Written by- Sazia Afrin Sapna

অসময়ে তার কল পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলাম। আমি তো হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি দেখছি। আমার ওটি পাগল বর ওটিতে ঢুকলে ভুলে যায় যে, সে বিয়ে করেছে আর ঘরে তার একটা বউও আছে। সেই ওটি পাগলটা ওটি ছেড়ে আমাকে কল করছে, ভাবা যায়!
কল রিসিভ করলাম, ওমা ফোন কানে ধরতেই সে ঝাঁজালো স্বরে বলল-
__তুমি এমনটা কীভাবে করতে পারলে সোনাবউ?

এমা এ তো দেখছি আমাকে রীতিমতো ধমকাচ্ছে! আমার কী এখন কাঁদা উচিত? এক ধমকেই কাঁদাটা ঠিক হবে না। বিশ্বাস করো আমি কিছুই জানি না এমন টাইপের ভাব নিয়ে আমি বললাম-
__কেমনটা করেছি আমি? আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না।

তার স্বর আরও ঝাঁজালো হয়ে গেল। যেন কন্ঠে কিছু মরিচ গুড়ো ছিটিয়ে নিয়েছে। সাথে ঝাঁজালো সরিষার গুড়ো মিক্সট। এমন স্বরে সে বলল-
__একদম না বোঝার ভান করবে না বলে দিচ্ছি পাজি মেয়ে!

আমি আমার নির্দোষ ভাবটা ঠিক রাখলাম। যদিও তার স্বরের ঝাঁঝে আমার সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে তবুও আমি অজ্ঞতার ভান করে বললাম-
__কী ভান করছি? আর ভান করতেই বা যাব কেন? আমি কী কাউকে ভয় পাই নাকি যে আমাকে ভয়ে ডরে ভান করতে হবে? সব ক্লিয়ার করে বলো।

হঠাৎ তার কন্ঠের ঝাঁঝ ধপ করে কমে গেল, সাথে একটু লজ্জা মিক্সট হলো। ঝাঁঝ আর লাজুকের যোগফলে যেমন স্বর হয় তেমন স্বরে সে বলল-
__কাল রাতে তুমি ষড়যন্ত্র করেছিলে। আমি ঘোরের মধ্যে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। এমনটা তুমি কেন করলে?

__কবে কখন কীভাবে ষড়যন্ত্র করেছি? আমার মতো একটা ইনোসেন্ট মেয়েকে এসব বলছো কী করে তুমি?

__চুপ! ইনোসেন্ট এর জাহাজ একটা! আমি কী তোমায় চিনি না? এই সব চাপা অন্যখানে মারো। তোমার অপরাধের শাস্তি তোমায় পেতেই হবে।

এ তো দেখছি আমাকে রীতিমতো বকছে। আমার কী এখন কাঁদা উচিত? কেঁদে কী বাবাকে ডাকা উচিত? নাকি মামনিকে ডাকবো? কাকে ডাকলে সে বকা বন্ধ করবে? ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না কী করবো। প্রসঙ্গ চেঞ্জ করে আত্মরক্ষা করাই যায়। বললাম-
__তুমি এই সময়টাতে ওটিতে বিজি থাকো। এসব বলার জন্য ওটি থেকে বের হয়ে এসেছো? নাকি আজ তোমার হাসপাতালে রোগী নেই? সব রোগী কোথায় গিয়েছে? এমা সব রোগী একসাথে ছুটি নিয়েছে নাকি?

সে কেমন যেন অসহায় সুরে বলল-
__ওটা মনে পড়ার পর থেকে আমি ওটিতে মন বসাতে পারছি না। আমার পাগল পাগল লাগছে তাই কল করেছি। তুমি আমাকে একদিন সত্যি সত্যিই পাগল করে ছাড়বে দেখছি।

আমি মুচকি হেসে বললাম-
__নতুন করে পাগল পাগল লাগার কী আছে সাহেব? তুমি তো আগে থেকেই পাগল। খামাখা কালরাতটাকে দোষী অপরাধী করছো কেন? আহারে বেচারা রাত!

সে এক রকম চেঁচিয়ে উঠে বলল-
__কিহ? আমি পাগল?

আমি স্বাভাবিক ভাবে নম্র স্বরে বললাম-
__এটা নিয়ে কী তোমার কোনো দ্বিধাদ্বন্দ আছে প্রিয়তম?

সে দৃঢ় কন্ঠে বলল-
__অফকোর্স আছে। একজন পাগল কখনও ডাক্তার হতে পারে না। আর রাতটা বেচারা হয়ে গেছে বখাটে মেয়ে?

__ঘটনা কাল রাতের আর এখন দশটা বাজে। এতক্ষণে তোমার মনে পড়লো? এসব তো পাগল দ্বারাই সম্ভব। আর রাতটা তো সত্যিই বেচারা।

সে কঠিন ভাবে বলল-
__বললাম তো যা ঘটেছে ঘোরের মধ্যে ছিলাম তাই মনে ছিল না। কিন্তু তুমি তো আর ঘোরের মধ্যে ছিলে না। তুমি ইচ্ছে করে ষড়যন্ত্র করে আমাকে ফাঁসিয়েছো, আমার সর্বনাশ করেছো।

তার এসব অপবাদ শুনে আমার কেমন জানি আনন্দ হতে শুরু করলো। আমি ন্যাকামির সুরে বললাম-
__এমা আমি তোমায় বখাটেদের মতো ইয়ে করেছি নাকি? আমি কিন্তু তেমন বখাটে মেয়ে নই হু।

সে ধমক দিয়ে বলল-
__চুপ একদম ফাজিল মেয়ে! তোমার মতো বখাটে মেয়ে পৃথিবীতে দুটো নেই।

__এই শোনো, একদম ধমকাবে না! তুমি আমার বিয়ে করা বর। আমি অনেকবার তোমাকে বিয়ে করেছি। প্রতি বিয়েতে তিনবার করে কবুলও বলেছি। সবগুলো বিয়েতে একটাকা দেনমোহরও দিয়েছো। সব ভুলে গেছো? আমরা চুরি করে প্রথমে বিয়ে করেছিলাম। তারপর প্রতি বিবাহ বার্ষিকীতে একবার করে বিয়ে করেছি। তারপর দুই বাড়ির সবাই মিলে আমাদের বিয়ে দিয়েছেন আবার। এই বিয়ের বয়সও এক বছর পেরিয়ে গেছে। প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে আমরা দার্জিলিং গিয়ে আবার বিয়ে করেছি। এই সব তুমি ভুলে গেলে কী করে?

__আমি এসব কিছুই ভুলিনি।

__তাহলে কাল রাতের ঘটনাকে কেন ষড়যন্ত্র বলছো? যা হয়েছে আমার বরের সাথেই হয়েছে। এমন নয় যে আমরা কালকেই প্রথম কাছাকাছি এসেছি। তাই এমন রিয়্যাক্ট কেন করছো গো?

__কালরাতে যা হয়েছে তা সম্পূর্ণ আলাদা ভাবেই হয়েছে।

__কিচ্ছু আলাদা হয়নি। সব ঠিক আছে তো।

__তুমি একদম অবলা সাজার চেষ্টা করবে না। আমি এখনি বাসায় আসছি মেডিসিন নিয়ে। তুমি যদি কন্সিভ করে থাকো তবে ৭২ঘন্টার মধ্যে মেডিসিন নিলে সব নষ্ট হয়ে যাবে।

__তোমার কী ধারণা আমি সব নষ্ট করার জন্য এই ষড়যন্ত্র করেছি?

__তাহলে স্বীকার করলে যে, তুমি ষড়যন্ত্র করেছো? আমি বাসায় আসছি।

✴️
ডাকুরাজ সাহেব বাসায় আসবে শুনেই আমি রুম থেকে বের হলাম। এখন কিচেনে ঢুকে থাকতে হবে। মামনিকে বললাম-
__মামনি আজ সব রান্না আমিই করবো। তোমার ছেলে বাড়িতে এলে তুমিই তাকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিও।

মামনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-
__সে তো বাড়ি আসবে দুইটার পরে। তুই এতক্ষণ ধরে রান্না করবি?

__দুপুরের আগেও তো আসতে পারে! তোমার যা পাগল ছেলে!

__তোর আজ কী হয়েছে সোনাই? তোকে এমন আপসেট লাগছে কেন? সকাল থেকে তো খুব আনন্দেই ছিলি। হঠাৎ কী হলো?

__কিছু হয়নি তো। আসলে আজ খুব রান্না করতে ইচ্ছে করছে।

__কিছু হয়নি তাহলে তুই ঘামছিস কেন এমন করে?

__গরম লাগছে ভীষণ। আজ বোধহয় খুব গরম পড়েছে।

মামনির সাথে কথা বলতে বলতেই গাড়ির আওয়াজ পেলাম। সে হয়তো গাড়িতে বসেই আমাকে কল করেছিল। আমি একরকম দৌড়েই কিচেনে ঢুকলাম। মামনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সাহেব বাড়ির ভেতরে ঢুকেই এদিক ওদিক তাকালো। আমি কিচেন থেকে উকি দিয়ে দেখলাম। বুঝলাম আমাকেই খুঁজছে। কাজে ব্যস্ত আছি এমন ভান করে তরকারি কাটতে বসে গেলাম। সে যে বাড়ি ফিরেছে এটা আমি জানিই না, এই টাইপের ভান করে রইলাম। সে কিচেনের দরজায় দাঁড়াতেই আমি তার দিকে তাকালাম। সে চোখের ইশারায় আমাকে রুমে ডাকলো। আমি তরকারি কাটা ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে চুলায় রান্নায় মন দিলাম। চুলায় কী রান্না চলছে সত্যিই আমি জানি না। তাকে দেখে খুনতি নাড়াচাড়া শুরু করলাম। সে কিচেনের দরজা থেকে সরে গেল। উকি দিয়ে দেখলাম সে সোফায় বসে আছে। আমি সরে আবার চুলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তাকিয়ে দেখি চুলায় ফ্রাইপ্যানে কিচ্ছু নেই আর গ্যাসও জ্বালানো নেই। তাহলে এতক্ষণ খুনতি দিয়ে আমি কী নাড়লাম?
রান্নাঘর থেকে শুনলাম মামনি তাকে বলছে-
__এখনই বাড়িতে এলি যে? শরীর খারাপ লাগছে নাকি বাবুসোনা?

__এমনিতেই ভালোলাগছিল না তাই চলে এলাম।
মনে মনে বললাম, এমনিতে তো আসো নাই, আইছো আমারে ট্যাবলেট খাওয়াইতে।
হঠাৎ টুং করে আমার ফোনে মেসেজ এলো।
“রুমে এসো খুব তাড়াতাড়ি।”
আমি রিপ্লাই করলাম না আর কিচেন থেকে বেরও হলাম না। সে আমার নম্বরে কল করলো। ততক্ষণে মামনি কিচেনে ঢুকে গিয়েছেন। ফোন কাটতেও পারছি না আবার রিসিভ করতেও ভয় লাগছে। মামনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি হাসির ভান করে ফোন রিসিভ করে কানে ধরে বললাম-
__ হ্যালো হ্যালো। ধুর কিছুই তো শোনা যায় না। কোন বোবায় কল করেছে কে জানে। এই যে বোবা ভাই, কথাই যখন বলবেন না তখন কল কেন করেছেন হুম? এটা একটা বিবাহিত মেয়ের নম্বর, ঘরে আমার সিংহ মার্কা ডাকুরাজ বর আছে। দয়াকরে আর কল করে বিরক্ত করবেন না। নইলে ইনজেকশন থেকে আপনাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না বলে দিলাম।

আমার এসব কথা শুনে মামনি হেসে উঠলেন। আমি সীমান্তকে শুনিয়ে শুনিয়ে মামনিকে বললাম-
__তুমি একটু বকে দাও তো! এমন করে গৃহবধূকে ফোন করে ইফটিজিং করছে, কত বড় সাহস!

__তুই বরং নম্বরটা তোর বাবাকে দিস তো। ইফটিজারের চৌদ্দ গুষ্ঠিকে জেলে ঢুকানো হবে।

এই রে, মামনি তো দেখছি নিজেদেরকেই জেলে ঢুকানোর কথা বলছেন। চৌদ্দ গুষ্ঠিকে জেলে ঢুকালে তো ইফটিজারের বউকেও জেলে ঢুকতে হবে। মনে মনে হাসি পেলো। বললাম-
__না না চৌদ্দ গুষ্ঠিকে নয়, শুধু ফোন ওয়ালাকে ঢুকালেই হবে। এখন তো একটু বকে দাও।

__আমার দ্বারা বকাবকি হবে না।

আমি ফোন কানে ধরেই কিচেনের দরজা দিয়ে উকি দিয়ে দেখলাম ডাকুরাজ আগুন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টি যেন বলছে, কাছে এসো তোমাকে শ্যুট করবো।
আমি ভয়ে সরে গেলাম। এবার সে ভয়ানক মেসেজ দিলো।
“আমার সাথে ফাজলামি হচ্ছে? এক মিনিটের মধ্যে যদি রুমে না যাও তাহলে জীবনেও আর আমার রুমে ঢুকবে না। মাইন্ড ইট।”

সে সোফাতেই বসে রইল আর আমি ভয়ের চোটে দৌড়ে কিচেন থেকে বের হতেই মামনি বললেন-
__কী হয়েছে দৌড়াচ্ছিস কেন?

__মামনি তুমি রান্নাটা দেখো আমি রুম থেকে আসছি।

মামনি হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি দৌড়ে রুমে গেলাম। সিঁড়িগুলো মনে হয় উড়েই পার হলাম। আমার বুকের ভেতরে ধুকপুক করছে। এমন রাগী বর আমার কপালে ছিল আল্লাহ! বান্ধবীদের বর কেমন সুন্দর আলাভোলা আর আমার বর একটা রাগের হিমালয়। রুমে ঢুকে সে নিশ্চিত জোর করে আমাকে ওষুধ খাওয়াবে। প্লিজ হেল্প মী আল্লাহ!
ডাকুরাজ রুমে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলো। আমি নার্ভাস ভাবটা কাটানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছি। এখন আমার সাহস রাখতে হবে, নইলে সব ভেস্তে যাবে কিন্তু ভেতরের ভয়টা কমছেই না কিছুতেই। সব কিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। ধুর এমন করে তাকানোর কী আছে? আমার বুঝি ভয় করে না? নিষ্ঠুর একটা! পাষাণ একটা! হৃদয়হীন একটা!

পরের পর্ব আসছে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here