ভালোবাসা ২১তম_পর্ব

0
570

ভালোবাসা
২১তম_পর্ব
#মৌসুমি_চৌধুরী

সকালে ঘুম থেকে উঠে রোজকার মতো কাজে যায় বিজু। তারপর সারাদিন একটানা কাজ শেষে কখনো খেয়ে আর কখনো বা না খেয়েই বাড়ি ফিরে আসে। বাড়ি বলতে তাদের মেস, যেটায় একরুমে গাদাগাদি করে চার পাঁচজন থাকে। একটা ফ্ল্যাটে বিশজন করে থাকতে হয় এমন অবস্থা। কোথাও কোথাও তো এর চেয়েও বেশি জন একসাথে থাকে।

এখানে যারা তাদের সাথে কাজ করতে এসেছে তাদের বেশিরভাগেরই পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। আর তাই দেশে অধিক টাকা পাঠাতে গিয়ে নিজের থাকা, খাওয়া-পরা কোনরকমে চালিয়ে যায়।

ছুটিছাটায় ভালো-মন্দ রান্না করে সকলে মিলে, আবার নিজেরাই আমোদফূর্তির জন্যে হয়তো একসাথে বসে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত কিন্তু ফ্লপ মুভির ডিভিডি কিনে এনে প্রায় নতুন সিনেমা দেখে। কেউ কেউ আবার ঘুরতেও বের হয়। কারো কারো বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা, ভাইবোন নাহয় বৌ-ছেলেমেয়ে রয়েছে হয়তো…আর তাই সারাদিন ভিডিও কলে কথাবলায় সময় পার করতে ভালোবাসে।

এই ঝা চকচকে শহরে সেসব দিনগুলোতে বিজুর নিজেকে বড়ই নিঃস্ব লাগে। না তার সিনেমা দেখার অত শখ আছে আর না-ই কথা বলার জন্যে বাড়িতে কেউ তার ফোনের পথচেয়ে বসে আছে…তারচেয়ে বরং ব্যস্ত দিনগুলোতে কাজের মাঝেই সময়টা তার বেশ কেটে যায়। নিজেকে ভুলে থাকার অস্ত্র হিসেবেই সে যেন পরিশ্রমকে বেছে নিয়েছে।

ওভারটাইম কাজ করতে যখন কেউ রাজি না হয় কিংবা কেউ কাজে না আসলে তাকে সেটা সামাল দিতে হয়, তখন বিজু নির্দ্বিধায় যেন কাজের ভারটা মাথা পেতে নেয়। কাজের প্রতি তার এই একনিষ্ঠতা আর পরিশ্রমী স্বভাবের জন্যে সে অল্পদিনের মধ্যেই যেন মালিকের বেশ প্রিয় হয়ে উঠেছে। আর তাই প্রথম থেকেই তাকে কিছুটা রেষারেষির শিকার হতে হয়েছে অন্য শ্রমিকদের। যদিও সেসব নিয়ে তার কোন ভাবান্তর নেই, সে শুধু কাজের মাঝে ডুবে থেকে সব ভুলে যেতে চায়।

কিন্তু ভুলতে চাইলেই কি ভোলা যায়…অরুর কথা এখনো মনে হয় কানে বাজে, তার হাসিখুশি মুখখানি ওর চোখের সামনে থাকে হরদম। কথাতো নয় যেন কোন মধুর সুরে ভেসে আসা গান আর তার চেহারার ভাবভঙ্গী যেন কোন শিল্পকর্ম। সিনেমা, নাটক, সাহিত্য সে খুব বেশি জানেনা…কিন্তু অরু যেন তার কাছে সেরকম উঁচুদরের কোন সৃষ্টিকর্ম।

কত টাকা সে কামায় এখন, অথচ খরচ করবার মতো কেউ নেই…বাবা-মা বেঁচে থাকলে তাদের জন্যে কত কি পাঠাতে পারতো। আর অরু, তার জন্যে যে কতদিন কত কিছু দেখে কিনতে মন চেয়েছে তা শুধু সে জানে আর জানে বিধাতা। বেতন ওভারটাইম সব মিলিয়ে গত দেড়বছরের কামাই মন্দ নয়, যার যৎসামান্যই খরচ হয়েছে হয়তো…

সবাই ভাবে সে বুঝি বাড়িতে বেশি টাকা পাঠানোর জন্যেই কোনদিন একবেলা খেয়ে আবার কোনদিন না খেয়ে কোনরকমে দিন কাটায়…কিন্তু কেউ কোনদিন জানবেনা যে পেট ভরে খেলেও তার মন ভরবেনা, কারণ যত্ন করে কেউ সামনে বসিয়ে খেতে দেয়ার নেই। কারো মুখে তুলে খাইয়ে দেয়া খাবারে যতখানি না পেট ভরে তারচেয়ে বেশি ভরে মন, এ কথা বিজুর চেয়ে ভালো আর কে জানে।

এখানে সবাই তাকে একটু ভিন্ন ধাচে গড়া মানুষ হিসেবে জেনে সমীহ করে ভিন্ন চোখে দেখে। জহির শুরুতে তার সাথে কাজে এলেও বছর না গড়াতেই দেশে ফিরে যায়। ফিরে যাবার আগে জহির তাকে বলেছিলো, ভাইরে এত পরিশ্রম শরীরে আমার সইবে না, কাজ করাতে করাতে তো জানে মেরে ফেলবে একদম!

সে হেসে বলেছিলো, এখানে আসার বুদ্ধিটা তো তোরই ছিলো…

দেখ ভাই, পথটা আমি বাতলে দিয়েছি এখন থাকা না থাকা সে তোর ব্যাপার।

আমি বললাম, থাকতে তো আমাকে হবেই…বাড়ি ফিরে যাবো কার আশায়।

জহির আমার কাধে হাত রেখে স্বান্তনা দিতে চাইলো।

আমি মৃদু হেসে কথা কাটাতে চাইলাম।

এখানে আসার পর থেকে প্রথম প্রথম প্রতি সপ্তাহে আজাদ আর সুজনের সাথে কথা হতো। এরপর আস্তে আস্তে সেটা কমে গিয়ে মাসে একবার আর এখন ছ’মাসে হয়তো একদিন কথা হয়। বন্ধুত্ব কিংবা অন্য সম্পর্কগুলো এমনই, চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল। আসলে সব সম্পর্ককেই বোধহয় কিছুটা সময় আর ভালোবাসা দিয়ে নিয়মিত যত্ন করে সেঁচতে হয়, নাহলে টবে থাকা ফুল গাছের মতন শুকিয়ে যেতে যেতে একসময় তার মৃত্যু ঘটে আর নাহয় শুষ্ক মৃতপ্রায় হয়ে বেঁচে থাকে।

কিংবা হয়তো তারা ভুলে যায়নি আর ভালোবেসে মনে করে ঠিকই কিন্তু দায়িত্ব আর কাজের মাঝেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে জীবনের নিয়মে। একইভাবে যেমন তার ও সময়কে দেবার মতো সময় নেই। কিন্তু অরুর ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমটা কেন ঘটে তাহলে!!! সে কি মনস্তাত্ত্বিক জটিলতায় হিসেবের বাইরে থেকে গেছে?…জানিনা। কিছু প্রশ্নের বোধহয় কোন উত্তর হয়না। যত বেশি সময় বয়ে গেছে, অরু যেন তত বেশি আমার চিন্তাভাবনায়, হৃদয় আর মস্তিষ্কে গেথে গিয়ে তার স্থায়ী নিবাস গড়ে তুলেছে। প্রবাস জীবনে যেন ভীড়ের মাঝে থেকেও সেই আমার একমাত্র সঙ্গী। আমার একাকীত্বে যেন আরো বেশি কাছে এসে আমাতেই একাকার হয়ে সে মিশে গেছে। তাকে আমার কাছ থেকে যেন আমিও আর পৃথক করতে পারবোনা। চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল এ সূত্র তার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার সাধ্য আমার নেই। বোধহয় সেটা বোঝাতেই তার প্রতি ভালোবাসা দিন দিন বেড়েই চলেছে…

এরইমাঝে একদিন রাতে হঠাৎ আজাদের ফোন এলে হ্যালো বলতেই, কি রে শালা আমি কল না দিলে তো তুই কোন খোঁজখবরই রাখিস না!!!

তোরা ব্যস্ত থাকিস তাই ডিস্টার্ব করি না।

ওরে বাপরে…কি কথা!!! ওসব ঢপ মারিস না আমায়, ঢের জানি যে তোর জানে জিগার দোস্ত সুজনের সাথে ভালোই কথা বলিস।

সেটা তোর ভুল ধারণা, তোর সাথে যেরকম সুজনের সাথেও সেরকমই যোগাযোগ আছে।

আচ্ছা,বাদ দে ওসব…দেখ যেজন্যে তোকে কল করেছি সেটা না আবার ভুলে যাই।

আমি হেসে বললাম, কারণ ছাড়া তাহলে আমায় কল দেসনি।

আজাদ আর কথা না বাড়িয়ে বললো, আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে সামনের শুক্রবার…বাদ জুম্মা আকদ সম্পন্ন হবে…তোকে কিন্তু আসতেই হবে, কোন বাহানা চলবেনা সে আমি আগেই বলে রাখলাম।

আমি একটুক্ষণ চুপ থেকে বিস্ময় কাটিয়ে উঠে বললাম, সে আমি তোকে পরে জানাবো…আগে বল তো পাত্রীটা কে?

আমাকে জানানোর তো কিছু নেই, জানাবি তোর বসকে…আর পাত্রী কে, কিরকম দেখতে সেটা বিয়েতে না এলে তোকে জানাতে পারছিনা।

এত শর্ট নোটিসে ছুটি দেবে আমায়?

আরে দেবে দেবে…জহিরের কাছে তো শুনেছি, তুই শালা ঘাঘু লোক মালিককে হাত করে নিয়েছিস।

তার কথা শুনে আমি বহুদিন পর হা হা করে হাসতেই দেখি মেসের অনেকেই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে, আজ অব্দি এমন বিস্ময়কর পরিস্থিতে আমাকে কখনোই পড়তে হয়নি…আজাদের কারণেই এমন ঘটনার অবতারণা হলো।

আজাদ বোধহয় আমার হাসির আভাস পেয়েই আরো হাস্যকৌতুক এর ভান্ডার খুলে বসে নতুন নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলো।

আমার মালিক সম্পর্কে আর কি কি জানিয়েছে তোকে জহির?

বলেছে যে, সে নাকি এখন উঠতে বসতেই ভিজে ভিজে করে আর ভিজে কে খুঁজে না পেলেই প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলে।

আমি কোনক্রমে হাসি চেপে বললাম, তবে রে…জহির আর তুই এমন প্যাদানী খাবি যে হাসিতামাশা ভুলে যাবি।

সে বেশ সিরিয়াস কন্ঠে বলে উঠে, তবুও তুই আয় রে ভাই…আর ক’বছর দূরে সরে থাকবি?

আমি বললাম, আচ্ছা মালিককে বলে দেখি।

সে বললো দেড় বছরে কোন ছুটি কাটাসনি, তোকে ছুটি না দিয়ে সে পারবেনা।

সে কি বাধ্য আমায় হুটহাট ছুটি দিতে?

তোর মতো এফিশিয়েন্ট, অনেস্ট আর হার্ড-ওয়ার্কিং মানুষকে কে ছাড়তে চাইবে বল?

সকলেই তো ছেড়ে গেছে…যেন মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো কথাটা একটা দীর্ঘশ্বাসের সাথেই।

কথা ঘুরানোর জন্য প্রসঙ্গ পাল্টে জহির বলে উঠলো, বলবি যে আমার ভাই আমার ইয়ারের বিয়ে…সে বুঝবে নিশ্চয়ই।

কাকে বিয়ে করছিস এবার তো বল?

আমার চাচাতো বোন রুখসানা কে…বলতে যেন খানিকটা লজ্জা পেলো আজাদ।

আমি বললাম, আজাদ আর লাভ ম্যারেজ!!! কিভাবে হলো?

ও শালা এবার বললো বাদবাকি কথা এলে পরে শুনবি, এখন রাখছি…রুখসানা কল দিচ্ছে আমায়।

মালিকের সাথে পরদিন কাজ শেষে কথা বলে ছুটি চাইতেই একটু অবাক হয়ে জানতে চাইলো, আচানক অ্যায়সা ক্যায়া হুয়া কি তুমহে আর্জেন্ট ছুট্টি পে জানা পাড়েগা?…ঘারপে সাব ঠিক হ্যায় না???

আমি বললাম, সাব ঠিক হ্যায় পার মেরে ইয়ারকি শাদি হ্যায়…মুঝে যা না হি পাড়েগা ভারনা বহুত বুড়া মান জায়েগা।

তিনি আর কথা না বাড়িয়ে ছুটি মঞ্জুর করলেন আমার। সেখান থেকে বেরিয়ে প্লেনের টিকিট কেটে শপিং মলে গিয়ে বেশ দামি একটা ব্র‍্যান্ডেড ঘড়ি নিলাম আজাদের জন্যে আর রুখসানার জন্যে গোল্ডের কানের দুল। গোল্ড কিনতে গিয়ে বারবার অরুর কথা মনে পড়তে লাগলো আমার।

মেসে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে ফের এয়ারপোর্ট থেকে যখন রওনা দিতে প্লেনে চড়ে বসলাম তখন নিজের কাছেই হঠাৎ মনে হলো, একা বাড়িতে গিয়ে থাকবো কি করে! আসার দিন সাথে করে দেয়া মানিব্যাগ থেকে অরুর শেষ চিহ্ন ডুপ্লিকেট চাবির গোছাটা বের করতেই চোখে জল চলে এলো। কতখানি গোছানো স্বভাবের মেয়েরে তুই অরু, শুধু আমার জীবনটাই কেন গুছিয়ে দিতে পারলিনা বলতো…

#চলবে…

কপি করা নিষেধ, লেখা অন্যত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here