ভালোবাসার প্রান্ত,৮,৯

0
1688

ভালোবাসার প্রান্ত,৮,৯
Written by- Sazia Afrin Sapna
(পর্ব-৮)

তানি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে নিলো। আমার বুকের ভেতরে হঠাৎ ধুকপুক শুরু হয়ে গিয়েছে। তানি কী এমন জানে যেটা আমি জানি না? অবশ্য বাকী সবার মতো আমিও মনে মনে খুব উৎসুক হয়ে কৌতূহলী চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছি।

সে বলতে শুরু করলো-
__সেই জনৈক ডাক্তার একদিন তার ফোনে আমাকে দেখালো এই মেয়েটা খুব ভালো লেখে। সেই লেখা সমেত লেখিকাকে তার খুব পছন্দ। তার লেখা পড়ে নাকি জনৈক ডাক্তারের মন ভালো হয়ে যায়। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম তার কথা শুনে। যে ছেলে মেয়েদের ধারে কাছেও যায় না। ছোটবেলা থেকেই বলে আসছে সে জীবনে বিয়েই করবে না। অথচ সেই ছেলে একটা মেয়েকে না দেখেই পছন্দ করে ফেললো শুধু তার লেখা পড়ে। আমি যেন বিশ্বাস করতেই পারছিলাম না। আমি তাকে বললাম, “প্রেম ভালোবাসা মানেই কষ্ট। মেয়েটা তোকে রিফিউজ করতে পারে তাই মানুষিক ভাবে তোকে শক্ত থাকতে হবে। এসব সহ্য করার মানুষিকতা থাকতে হবে। ভেঙে পড়া যাবে না।”
সে বলল, “আমি তাকে ভালোবেসে কষ্ট নিতে রাজী।”
আমি যেন অবাকের উপর অবাক হয়েই চলেছি। এ আমি কাকে দেখছি! নিজের চোখ আর কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছি না। বললাম, “সে রাজী হলেই যে কষ্ট আর জীবনে আসবে না তা কিন্তু নয়। ভালোবাসা মানেই কষ্ট। ভালোবাসায় কিন্তু কষ্ট থাকবেই।”
সে বলল, “নেবো সেই কষ্ট।”
বললাম, “তাহলে প্রোপজ করে ফেল।”
সে বলল, “আমার ভয় লাগে। মেয়েটা সাংঘাতিক রকমের, তার মুখে কিছুই আটকায় না। প্রোপজ করলে নির্ঘাত আমাকে অপমান করবে। অনেক ছেলেকেই সে অপমান করে দেখেছি। তারচেয়ে বরং আমি একাই দূর থেকে ভালোবাসে যাব। এটাই নিরাপদ।”
রাগ করে বললাম, “তোর দ্বারা আসলেই কিচ্ছু হবে না গাধা।”

এইটুকু বলেই তানি দম নিলো। আমিসহ সবাই তার দিকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছেন। আমার তো বিস্ময়ের সীমা নেই। পাগলটা এমন করে আমাকে আড়াল থেকে ভালোবেসেছে? আর আমাকে এতটা ভয়ও পেয়েছে? আর এখন উল্টা আমিই তাকে ভয় পাই। ছেলেরা আসলেই এমন, বিয়ের আগে একরূপ আর বিয়ের পরে আরেক রূপ, হুহ। একা একাই মুখ ভেংচি কাটলাম।

নানান উৎকন্ঠা নিয়ে তানিকে বললেন-
__থামলে কেন? তারপর? বলো তারপর কী হলো?

তানি কাশি দিয়ে গলা ঠিক করে নিয়ে বলল-
__তারপর বেশ কিছুদিন পরে জিজ্ঞেস করলাম, “কী রে তোর লেখিকার খবর কী?”
সে বিরস মুখে বলল, “সে লিখছে আর আমি পড়ছি।”
বললাম, “তাকে মনের কথা জানাসনি এখনও?”
সে বিবর্ণ মুখে বলল, “না।”
আমি হতাশ হলাম। এই অপদার্থকে দিয়ে আর যাই হোক প্রেম হবে না এটা আমি নিশ্চিত। তারপর কয়েক মাস এমন করেই কেটে গেল। যখনি লেখিকার কথা জিজ্ঞেস করি, তার উত্তর একই। আর আমিও একই ভাবে নিয়মিত হতাশ হই।

তানি আবার থামলো। নানান রেগে উঠে ধমক দিয়ে বললেন-
__ঘটনা বলছিস নাকি দৌড়াচ্ছিস যে একটু পর পর থেমে রেস্ট নিচ্ছিস?

তানি বলল-
__আরেহ থেমে থেমেই তো বলতে হয়। তবেই না আকর্ষণ থাকবে। একদমে সব বলে দিলে তো সব গেল।

নানান বললেন-
__এমনিতেই আমরা আকর্ষিত, তোকে আর আকর্ষণ বাড়াতে হবে না। এখন তুই বাকীটুকু বল।

তানি আবার বলা শুরু করলো-
__তারপর যেদিন মেয়েটার সাথে তার প্রথম ম্যাসেজিং এ কথা হলো সেদিন আমি তার পাশে বসে দেখছিলাম। মেয়েটা সীমান্তকে আপু ডেকে স্যরি টরি বলছিল। আমার বেজায় রাগী ভাইটা সেদিন কেমন করে যে আপু ডাকটা হজম করেছিল, তা ভেবে আমার হাসি পেলো। সীমান্ত আমাকে বলল, “দেখছিস সে কেমন? আমাকে আপু ডেকে অপমান করছে। তাকে প্রোপজ করলে আমি শিওর সে চাচী জেঠি খালা সব ডেকে ফেলবে। আমার মান সম্মান সব শেষ করে দেবে।”
আমি হাসতে হাসতে বললাম, “তাও তো তার প্রেমেই পড়ে আছিস। চাচী জেঠি খালা ডাক গুলো না হয় ভালোবেসেই হজম করে নিবি।”
সে গম্ভীর মুখে বলল, “ইম্পসিবল।”
বললাম, “তাহলে বাদ দে। ঐ ফাজিল মেয়েকে ভালোবাসতে হবে না।”
সে অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল, “সেটাও ইম্পসিবল।”
আমি আর কিছু না বলে সীমান্তর ফোনে মেয়েটার মেসেজ দেখতে শুরু করলাম। মেয়ে যা চটপটে তাতে আমার আলাভোলা ভাইটাকে পাত্তা দেবে না ভেবে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। সীমান্তর প্রতিটা প্রশ্নের সে ঝটপট উত্তর দিচ্ছে। যেন সব আগেই মুখস্ত করা ছিল। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, প্রথম দিন কথা হচ্ছে তবুও মেয়েটার ভেতরে কোনো ভয় ভীতি নেই। বলতেই হবে মেয়েটা নিঃসন্দেহে সাহসী। এদিকে আমার ভাইটা নার্ভাস হয়ে ঘেমেঘুমে অস্থির। মেয়েটা সীমান্তর আকার ইঙ্গিতের ভাষা বুঝে ফেলে বলল, “আপনি আমাকে ভালোবাসেন এটা আমি জানি।”
সীমান্ত পুরাই নার্ভাস হয়ে আমার দিকে তাকালো। তারপর লিখলো, “আমি কী আপনাকে বলেছি যে, আমি আপনাকে ভালোবাসি?”
সীমান্তর কথায় মেয়েটা তাকে কথার কৌশলে আটকে ফেলল। সে যেমন ভালোবাসা স্বীকার করলো না তেমনি মেয়েটাও বলল, বিয়ে নিয়ে তার কোনো আগ্রহ নেই। তার এই কথায় আমি হতাশ হলাম আর সীমান্ত বিবর্ণ হয়ে গেল। সীমান্তকে বললাম, কষ্ট পাবার ভয়ে তাকে এতদিন ভালোবাসার কথা বলতে সাহস পাসনি। সেই কষ্টই তো পেলিই অথচ তাকে ভালোবাসি বলার আগেই। আমার কথা শুনে সীমান্ত নির্বাক তাকিয়ে রইল। আমি কোনো সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে পেলাম না।

এইটুকু বলেই তানি থামলো। নানান এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-
__তুমি এটা কেমন করে পারলে ছোট রাণী? আমার আদরের নাতিটার মন ভাঙতে তোমার বুক কাঁপেনি? এত পাষাণ তুমি?

রুমের সবাই মন খারাপ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। যেন আমি খুন টুন করে এসে দাঁড়িয়ে আছি, আমার সারা গায়ে রক্তে মাখামাখি। আমিও আসামির মতো তাকিয়ে রইলাম। এরপর কী বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
নানান দুঃখভরা চোখে তাকিয়ে বললেন-
__না জানি কত কষ্ট পেয়েছি আমার নাতিটা! কেমন অমন করেছিলে ছোট রাণী?

আমি নিরুত্তর রইলাম। মনে মনে বললাম, প্রথম পরিচয়েই না জেনে না শুনেই বলবো যে, আমি আপনাকে ভালোবাসি? তার ভেতর ভেতর যে মন ভাঙছে তা আমি জানবো কী করে? কিন্তু এসব কিছুই বললাম না।
নানান তানির দিকে তাকিয়ে বললেন-
__রিফিউজ ফিউজ হলো কী করে?

তানি আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার কেশে নিয়ে বলল-
__সপ্তাহখানেক পরে একদিন সীমান্তকে জিজ্ঞেস করলাম, কী খবর?
সে মুচকি হেসে বলল, “কথা হচ্ছে নিয়মিত।”
অবাক হয়ে বললাম, “পটাতে পেরেছিস?”
সে বলল, “কী জনি!”
বললাম, “শোন তাকে অনেক সময় দিবি, আর জান সোনা ময়না এসব বলবি। মেয়েরা এসব ডাক খুব পছন্দ করে।”
সে অবাক হয়ে বলল, “এসব বললেই সে পটে যাবে।”
বললাম,” হ্যাঁ।”
সে অবাক হয়ে বলল, “বলিস কী?”
বললাম, “তুই যা বিজি থাকিস, তাতে সময় দিতে না পারলে কিন্তু প্রেম টিকবে না বলে দিলাম।”
তার কিছুদিন পর সে মেয়েটার ছবি দেখালো। চুলগুলো এমন এলোমেলো হয়ে সামনে ছিল যে, দেখে পাগলি পাগলি লাগছিল। মনে মনে বললাম, শেষকালে আমার ভাই একটা পাগলির প্রেমে পড়লো? তারপর একটা হলুদ রঙের শাড়ি পরা তার একটা ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বললাম, “তোর কপাল ভালো, মেয়েটা সুন্দরী।”
সীমান্ত লাজুক হাসি দিলো। এরপর আর জানি না আমি। বাকী সব ওরা দু’জন চুরি করে করেছে। আমাকে আর বলেনি। পটানোর টিপস আমিই দিলাম অথচ প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ার পরের ঘটনা সীমান্ত আমাকেই বলল না।
কথাগুলো বলে তানি মুখভার করে রইল।
নানান বললেন-
__ছোট রাণী এবার তুমি বলো কেমন করে হাবুডুবু খেলে আর সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমার বান্দর নাতি কেমন করে প্রেম করলো?

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম-
__সব ভুলে গেছি নানান। আমার কিচ্ছু মনে নেই।

নানান হতবাক চোখে তাকিয়ে বললেন-
__আমার নাতিকে তোমার পেছনে দৌড় করিয়ে এখন বলছো সব ভুলে গেছো?

আমি মাথা নিচু করে বললাম-
__হু।

মুড়ি মাখা খেয়ে হাসি ঠাট্টা গল্প আড্ডায় রাত ফুরিয়ে গেল। আমি জানি সবাই কেন আজ এই ঘরে জেগে থেকে কাটালো। কারণ সবাই জানে সীমান্তকে ছাড়া আমার রাতটা নির্ঘুম কাটবে। আমি মন খারাপ করে থাকবো এবং কাঁন্নাও করবো। তারা আমার কষ্টের ভাগ নিয়ে আমার মন ভালো রাখার জন্য এমন করে আমাকে সঙ্গ দিলেন। অথচ সকালবেলা সবাইকেই নিজেদের কাজে বের হতে হবে। নির্ঘুম শরীরটা সারাদিন খারাপ করবে তবুও তারা আমাকে ভালোবেসে সব সয়ে নেবেন। কতটা ভাগ্য নিয়ে জন্মালে একসাথে এতগুলো ভালো মানুষদের প্রিয়জন হিসেবে পাশে পাওয়া যায়!


ভেবে ছিলাম আজ লাটসাহেব ফিরে আসবে। আমাকে ছাড়া অতি কষ্টে একটা রাত পার করলেও দুইটা রাত পার করতে পারবে না। কিন্তু খবর পেলাম সে আমার কাজিন বোনদের ডেকে এনে নাটোর রাজবাড়ীতে গিয়েছে পিকনিক করতে। তার শালিরা দুলাভাইয়ের সাথে ছবি উঠিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করছে আমাকে ট্যাগ করে। আমি ওদের ট্যাগ হাইড করে রাখলাম। কমেন্ট করলাম-
“অন্যের বরের সাথে ছবি উঠা পাপ শুধু নয়, মহাপাপ। বিনা হিসাবে জাহান্নামে যাবি তোরা।
তোদের পিকনিকের সব খাবার পুড়ে কয়লা হয়ে যাবে দেখিস। তোদের ভালো হবে না।”

রাগে আমার সারা শরীর জ্বলছে। সব যে আমাকে রাগানোর জন্য করছে তা আমি জানি। তবুও আমি রাগ কন্ট্রোল করতে পারছি না। রাগে আমার কাঁন্নাও পাচ্ছে। মনে মনে বললাম, বাড়িতে আসতে হবে না। তুমি নাটোরেই থাকো। ঘরজামাই থাকো।

নানান রুমে এসে বললেন-
__ঘুরতে তো গেলে না ছোট রাণী। স্বামী শ্বশুরবাড়ি গিয়েছে সেই শোক পালন করছো। তোমার স্বামী তো দিব্যি আছে। বোকা মেয়ে তুমি।

__দেখেন আপনার নাতি কত আনন্দে আছে।

বলেই আমি কেঁদে ফেললাম। নানান বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে ফেসবুকে সীমান্তর ছবি দেখলেন। তারপর বললেন-
__কালকেই আমরা সবাই পিকনিকে যাব। এক হাজার ছবি তুলে ফেসবুক ভরে ফেলবো। ঐ শালাকে জ্বালিয়ে শেষ করবো। তুমি চোখ মুছো ছোট রাণী।

আমি যতই চোখ মুচ্ছি ততই জল গড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে কী না জানি ভয়ানক কিছু ঘটেছে। সে এমন মানুষ কেন এটাই যেন আমি কিছুতেই মানতেই পারছি না। নানান করুণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে মনে নিজেকে বললাম, না হয় শালিদের সাথে কয়টা ছবিই উঠিয়েছে, তাই বলে এমন করে কাঁদতে হবে? আমার তো নিজেকে রীতিমতো বাচ্চা মনে হচ্ছে। ধুর কাঁন্না থামাতে পারছি না কেন?

পরের পর্ব আসছে…..
Written by- Sazia Afrin Sapna

“ভালোবাসার প্রান্ত”
(পর্ব-৯)

পিকনিকে যাবার জন্য সকাল থেকেই সবাই রেডি হওয়া নিয়ে ব্যস্ত। আমারই শুধু মন টানছে না। আমি নির্লিপ্ত ভাবে বসে আছি। তাকে ছাড়া কিছুই ভালোলাগে না, কোনো কাজে একটুও মন বসে না। এ কেমন অসুখ মাবুদ! বলতেও পারছি না যে, পিকনিকে যাব না। সবাই কত আশা করে উৎসব করছে। সেই উৎসব নষ্ট করার রাইট নেই আমার। ডাকাত ছেলে আমার সব খুশি আনন্দ সাথে নিয়ে গিয়েছে। সে তো শালিকাদের সাথে ভালোই আছে, শুধু আমিই মরে যাচ্ছি।

নানান রুমে ঢুকে একটা মেরুন কালারের সিল্কের শাড়ি আমার হাতে দিয়ে বললেন-
__তোমার জন্য গিফ্ট এটা, ঐ বান্দরের দেয়া শাড়ি পরবে না। যে ছেলে বউ ফেলে শ্বশুরবাড়ি চলে যায় তার দেয়া কোনো পোষাক পরাই উচিত নয়। এই শাড়িটাতে তোমায় খুব মানাবে ছোট রাণী।

আমি ম্লান হেসে শাড়িটা নিলাম। নানান আর কিছু না বলে চলে গেলেন। শাড়িটা সত্যিই খুব সুন্দর। এত সুন্দর শাড়ি পরবো অথচ আমার স্বামীই আমাকে দেখবে না? তাহলে শাড়ি পরে কী লাভ? কিন্তু না পরলে নানান কষ্ট পাবেন। নানান মানুষটা অসাধারণ। তিনি আমাকে খুব ভালোবাসেন। শুধু তিনিই নন, এই বাড়ির প্রতিটা মানুষই আমাকে খুব ভালোবাসে। শুধু আমার স্বামীই আমাকে ভালোবাসলো না। এটা ভাবতেই আবেগে চোখে জল চলে এলো।

শাড়ি পরার সময় আমি সীমান্তকে অদ্ভুত ভাবে মিস করলাম। আমার অবিন্যস্ত শাড়ির ভাজে যেন তার অনুভূতিগুলো লুকিয়ে আছে। আমার বুক আবিষ্টিত আঁচলখানায় যেন তার প্রকাশ্য অধিকার জমাট বেঁধে আছে। শাড়ির কুচির ভেতরে লুকিয়ে আছে অবাধ্য ভালোবাসার খুনসুটি। শাড়ির পাড়ের মাঝে তার সুপ্ত প্রেমের ঘ্রাণ ছড়িয়ে আছে। শাড়ির সারা জমিন জুড়ে যেন তার অবিরত স্পর্শ। এতসব গোলমেলে অনুভূতি সমেত শাড়িটা অঙ্গে জড়িয়ে আমি যেন তলিয়ে গেলাম তার মাঝে। এ শাড়ি যে সারাটা দিন আমাকে যাতনার কাঁটা ফুটাবে তা বুঝতে আর বাকী নেই আমার।
কেন যে মেয়েদের বিয়ে হয় আর কেন যে মেয়েরা স্বামীকে ভালোবাসে! দুটো দিনে সে একটাবার কল করে আমার খবর নেয়নি। বাবা মামনি তাকে কল করেছিলেন। সে বলেছে ভালো আছে। ফিরবে আরও দু’দিন পরে। তার নাকি ফিরতেই ইচ্ছে করছে না। কেমন হৃদয়হীন হলে মানুষ বউ রেখে দূরে থাকতে পারে! নিষ্ঠুর পাষাণ একটা! একবার মনে হলো আব্বুকে কল করে বলি, ঐ ডাকাতটাকে এখনি পাঠিয়ে দাও। আবার মনে হলো থাকুক দূরে। সে থাকতে পারলে আমি কেন পারব না?
কোনোই সাজগোজ করলাম না। কার জন্য সাজবো? যার জন্য এত সাজের আয়োজন সেই মানুষটাই তো কাছে নেই। সে শালিকাদের সাজ দেখুক। অভিমান রাগে রূপান্তরিত হলো।

শাড়ি পরে রুম থেকে বের হতেই তানি সামনে এসে বলল-
__ একি! তুমি তো কোনোই সাজগোজ করোনি!
আমি কিছু বললাম না। সে মুচকি হেসে বলল-
__বরের উপর অভিমান করে যে সাজোনি তা আমি জানি।

কথাটা বলেই হুট করেই সে আমার কপালে একটা টিপ পরিয়ে দিলো। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই সে আমাকে টেনে সোফায় বসিয়ে চোখে কাজলও এঁকে দিলো। হঠাৎ নানান এসে তানির মুখের সামনে মেরুন কালারের কিছু রেশমি চুড়ি ধরে বললেন-
__শুধু টিপ পরালে আর কাজল আঁকলেই হবে? চুড়িগুলোও পরিয়ে দাও।

তানি চোখ কপালে তুলে বলল-
__শুধুই ছোট রাণীর জন্য? আমার জন্য চুড়ি কই?

__তোমার তো বর আছে।

তানি অভিমানের সুরে বলল-
__আর আপনার ছোট রাণীর বুঝি বর নেই?

নানান বললেন-
__ঐ শালার কেনা কোনো কিছুই আমার ছোট রাণীকে পরতে দেবো না। সে আমার ছোট রাণীর মন ভেঙেছে।

নানানের কথা শুনে আবেগে আমার চোখে আবার জল এলো। তানি আমার হাতে চুড়ি পরিয়ে দিলো। বলতে তো আর পারছি না যে, আমি সাজতে চাই না। চুড়ি পরানো শেষ হতেই নানান জুঁই ফুলের মালা বের করে বললেন-
__খোপায় ফুলটা আমিই পেঁচিয়ে দেবো।

আমি হা করে নানানের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তানি ভ্রু কুচকে বলল-
__উহ্! বুড়ো বয়সে শখ কত! অন্যের বউয়ের খোপায় উনি ফুল পেঁচিয়ে দেবেন! যান নিজের বউয়ের খোপায় পেঁচিয়ে দেন।

নানান ভাব দেখিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বললেন-
__পাঁকা চুলে ফুল পেঁচিয়ে দিতে আমার বয়েই গেছে!

__অন্যের বউয়ের খোপায় ফুল পেঁচানোর এত সাধ কেন? সীমান্ত এসে যদি এসব শোনে তাহলে আপনাকে গুলি করবে।

__আমি তাকে ভয় পাই নাকি?

__পান না, পাবেন।

হঠাৎ নানান চুপসে গিয়ে বললেন-
__আচ্ছা ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। তুমিই পেঁচিয়ে দাও।

তানি আমার খোপায় ফুল পেঁচিয়ে দিলো। শাড়ির দহনে আমি মরে যাচ্ছি। তার সাথে জুটলো টিপ, কাজল, চুড়ি আর ফুল। মানুষটার অনুভূতি যেন আমার পিছু ছাড়তেই চায় না। নিষ্ঠুর একটা মানুষের অনুভূতি আমাকে খুন করে দিলো।


আমরা সবাই হৈহৈ করে পিকনিকে গেলাম। বাবাও ছুটি নিয়ে আমাদের সাথে পিকনিকে যোগ হলেন। সবাই খুব উৎসব করছে। নানান আমার শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে মেরুন কালারের পাঞ্জাবি পরে বিভিন্ন পোজে আমার সাথে ছবি উঠলেন। আমি বাইরে হাসিখুশি থাকলেও পাগলটাকে মিস করে যেন শেষ হয়ে গেলাম। মন পুড়ে আমার ছাই হয়ে যাচ্ছে। মনে মনে একটা অভিমানের হিমালয় তৈরি হলো। এবার সে আসুক, একটাও কথা বলবো না তার সাথে।

বিকেল হয়ে গেল। আমি সবার থেকে একটু দূরে নির্জনে বসে আছি। এত বিশাল বড় একটা পৃথিবী। কত কী আছে পৃথিবীতে! অথচ আমি যেন খুব নিঃস্ব। একটা মানুষ আমার সব ভালোবাসা নিয়ে আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। এসব মানুষদের বিরুদ্ধে মামলা করা উচিত। মন যেন কিছুতেই বাঁধন মানছে না। তাকে আমার কাছে চাই এখন। এখন মানে এখনি। সে রাগী চোখে তাকিয়ে থাকুক আমার দিকে তবুও আমি তাকে আমার চোখের সামনে চাই এবং চাই।
হঠাৎ নানান এসে পাশে বসতেই আমি চেতনায় ফিরে তার দিকে তাকালাম। তিনি বললেন-
__খেতে হবে, চলো ছোট রাণী।

আমি নানানের দিক থেকে চোখ সরিয়ে বললাম-
__হু

আমার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন-
__স্বামীকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝিস না। এমন পাগলি কেন তুই? জানিস তোর মতো পাগলি আর দুটো দেখিনি! এখন বুঝতে পারছি যে, আমার আধা পাগল নাতি তোকে কেন ভালোবেসে বিয়ে করেছে। পাগলের বিয়ে তো পাগলির সাথেই হয়।

কথাগুলো বলেই নানান হাহা করে হাসলেন। আমার হাসি পাচ্ছে না। আমার কেন জানি পাজর ভেঙে আসছে। আমি যেন কিছুতেই স্থির থাকতে পারছি না। হুট করেই আমি পাগলের মতো বললাম-
__আমার এখনি পাগলটাকে চাই। নইলে আমি পানিও খাবো না। কীসের এত শ্বশুরবাড়িতে থাকা? তাকে এনে দিন এখনি!

নানান হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন-
__তোর মতো বউ যেন সব পুরুষের হয়। তোর এই ভালোবাসায় আমি মুগ্ধ তাই এখনি তোর পাগল বরটাকে হাজির করবো। দরকার হলে হেলিকপ্টার নিয়ে গিয়ে তাকে নাটোর থেকে তুলে নিয়ে আসবো। এবার খুশি তো? উঠ এখন, সবাই অপেক্ষা করছে।

আমার উঠতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে এই মাটিতেই নিজেকে মিশিয়ে দিই। এত কষ্ট কেন মানুষের জীবনে? তার কী একটুও আমার কথা মনে পড়ে না?
আমি উঠে ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখি সীমান্ত এদিকেই এগিয়ে আসছে। আমি হাত দিয়ে চোখ ডলে নিয়ে আবার তাকালাম। স্বপ্ন দেখছি না তো? অবেলায় আমার অভিমানের এই জমাট দেয়াল যেন আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল। আমি নিশ্চুপ পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ খুব রাগ হলো। মনে মনে বললাম, এলে কেন? ঘর জামাই থাকতে! কত শালিকা আছে তোমার, রোজ পিকনিক করতে! এখানে তোমার কে আছে? এই আমিটাই বা তোমার কে?


গাড়িতে দুজন পাশাপাশি বসে আছি। কারও মুখে কোনো কথা নেই। ঘুম নেই তো সেই কবে থেকেই। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে গেলাম। চমকে উঠে জেগে গিয়ে দেখি সে আমার শাড়ির আঁচল ঠিক করে দিচ্ছে। আমাকে চোখ মেলতে দেখে বলল-
__গাড়িতে আমি ছাড়াও ড্রাইভার আছে। শাড়িটা তো সামলাবে নাকি!

আমি রাগ করে কথা বললাম না। কথা বলবোই না। এমন হৃদয়হীন মানুষের সাথে কথা বলে কী হবে? হৃদয়হীনরা তো হৃদয়ের দাম দিতে পারে না। রাগে দুঃখে ক্ষোভে অভিমানে আমি আরেক দূরে সরে বসে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকলাম।
সে বলল-
__তোমায় আজ খুব সুন্দর লাগছে।

আমি তার দিকে ফিরে তাকালাম না আর জবাবও দিলাম না। সে বলল-
__রাগ করেছো?

মনে মনে বললাম, রাগ কেন করবো গো? আনন্দে আত্মহারা হয়ে আছি। কত আনন্দদায়ক কাজ তুমি করছো! আনন্দিত না হয়ে আমার উপায় আছে?
আমি জবাব দিলাম না। জবাব দিলেই তো সে আবার টাইগার রূপ ধারণ করবে। সে অভিমানের সুরে বলল-
__ওহ আমি পুরোনো হয়ে গেছি তাই আমার সাথে আর কথা বলতে ভালোলাগে না তাই তো?

হায় রে! আমায় রেখে দুদিন শ্বশুরবাড়িতে থেকে এসে উল্টো অভিমান করা হচ্ছে। রাগে আমার শরীর খিটখিট করছে। রাগ চেপে রেখে নম্র স্বরে বললাম-
__হ্যাঁ গো তুমি খুব পুরোনো হয়ে গেছো। এখন আমার নতুন বর চাই।

আমার কথা শুনে তার অভিমানী চোখ দুটো রাগে রূপান্তরিত হলো। কিছুক্ষণ সে আমার দিকে টাইগারের মতো তাকিয়ে থেকে তারপর ড্রাইভারকে বলল-
__গাড়ি থামাও।

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল-
__গাড়ি থেকে নামো।

আমি হতবাক হয়ে বললাম-
__মানে?

সে ঝাঁজালো স্বরে বলল-
__পুরোনো বরের গাড়িতে বসে যেতে হবে না।

__তাহলে কী আমি হেটে হেটে বাড়ি ফিরবো?

__জানি না।

আমি রাগ করে নেমে গেলাম। সীমান্তর গাড়ি আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। সন্ধ্যা গড়িয়ে আঁধার নেমে গিয়েছে। আমি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছি। আমার আকাশ পাতাল ভেঙে কাঁন্না আসছে।

পরের পর্ব আসছে…..
Written by- Sazia Afrin Sapna

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here