ভালোবাসার প্রান্ত,১০,১১

0
1421

ভালোবাসার প্রান্ত,১০,১১
Written by- Sazia Afrin Sapna
(পর্ব-১০)

আমি শূন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে শব্দহীন কাঁদছি। বান ডেকেছে আজ আমার চোখের কোলে। মনে হচ্ছে একজন নিষ্ঠুর মানুষ তার অভিমানের দহনে আমাকে দগ্ধে দগ্ধে ঝলসে দিয়ে চলে গিয়েছে। অচেনা এই নির্জনে কষ্টের লাভার কাছে ভয় ডর কাছে আসতে পারছে না। মানুষের জীবনে মৃত্যুর চেয়ে ভয়ানক ভয় আর নেই। সেই ভয়টাই যেন নিমেষেই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। অবলীলায় আমি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারবো এখন।
বাবা আর নানানের গাড়ি আসছিল পেছনে।সীমান্তর গাড়ি চলে যাবার দুই মিনিট হতে না হতেই বাবা আর নানানের গাড়ি এসে থামলো আমার সামনে। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তারা গাড়ি দাঁড় করালেন। নানান ছুটে এসে হতবাক হয়ে বললেন-
__একি ছোট রাণী তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কেন?

আমি কাঁন্নায় ভাঙা গলায় বললাম-
__আপনার পাগল নাতি আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে।

কথাটা বলেই আমি কাঁদতে শুরু করলাম। ততক্ষণে বাকী সবাই গাড়ি থেকে নেমে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সবাই হতবিহ্বল হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি কেঁদেই চলেছি। ইচ্ছে করছে রাস্তার পাশে বসে থাকি সারারাত। কারও মুখে যেন কোনো ভাষা নেই। নানান আমাকে তার গাড়িতে নেবার জন্য হাত ধরে টানলেন। আমি কিছুতেই গেলাম না। কাঁদতে কাঁদতে বললাম-
__সারারাত আমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো। বাড়ি ফিরবো না। দাঁড়িয়ে থাকতে না পারলে বসে থাকবো। সে তো এটাই চেয়েছিল।

নানান অসহায় চোখে তাকালেন। বাবা আমার কাছে এসে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন-
__আমি থাকতে আমার মা এখানে থাকবে কেন? আজ বাড়ি ফিরে ঐ বাদরটাকে উচিত শিক্ষা দেবো। এখন গাড়িতে উঠ মা।

আমি কিছুতেই বাবার কথা উপেক্ষা করতে পারি না। বাবার সাথে গাড়িতে উঠে বাবা আর মামনির মাঝখানে বসলাম। তখনও আমি অবিরাম কেঁদেই চলেছি। মামনি আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে চলেছেন। এমন দুজন ভালো মানুষের ছেলে অমন টাইগার মার্কা ডাকাত হলো কী করে তা আজও আমার মাথায় ঢোকেনি। নানানের মতো রোমান্টিক হলে কী ক্ষতি হতো? মানুষ কী নানা দাদার বৈশিষ্ট্য পায় না? নানান এই বয়সেও কত্তো রোমান্টিক। আর আমার তরুণ স্বামী কাঠ তক্তা আর ডাকাত। আল্লাহ এটা তোমার কেমন বিচার? এসব ভেবে কাঁন্না আরও ঠেলে আসছে। কাঁদতে কাঁদতে আমার হেচকি শুরু হয়ে গিয়েছে।
বাবা আমার মাথায় হাত রেখে অসহায় চোখে তাকিয়ে বললেন-
__বাদরটা হঠাৎ তোকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিলো কেন?

আমি হেচকি তুলতে তুলতে বললাম-
__সে বলল, সে নাকি পুরোনো হয়ে গিয়েছে। তাই আমি বললাম, হ্যাঁ তুমি পুরোনো হয়ে গেছো তাই আমার নতুন বর লাগবে। এটা শুনে সে আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছে।

কথাগুলো বলে আমি আবার কাঁদতে শুরু করলাম। আমার কথা শুনে মামনি আর বাবা দুজন দুজনার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলেন। আমি বুঝলাম না যে, এই সামান্য কথাতে তারা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন কেন!
তারপর কখন যেন ক্লান্ত হয়ে বাবার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গিয়েছি।

বাড়ি ফিরে দেখি উনি চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িংরুমে বসে কার্টুন দেখছেন। কত সুখ তার মনে! আমি তার সামনে থেকে সরে গেলাম। কেউ তাকে এব্যাপারে কিছুই বলল না। এমনকি সারা বাড়ির সবাই স্তব্ধ হয়ে রইল। তার চোখমুখ দেখে মনে হলো, সে যেন কিছুই করেনি। হৃদয়হীন ডায়নোসর একটা!


রাতে ডিনার টেবিলে নানান খুব শান্ত দৃষ্টিতে সীমান্তর দিকে তাকিয়ে খুব নম্র ভাবে বললেন-
__বউ ফেলে শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে, শালিকাদের নিয়ে পিকনিক করলে। ফিরে এসে বউকে মাঝ রাস্তায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দিলে। তা তোমার হয়েছেটা কী?

সীমান্ত কোনো জবাব দিলো না। মামনি বললেন-
__বাবুসোনা এটা তোর অন্যায় হয়েছে।

সীমান্ত কোনো জবাব দিলো না। বাবা বললেন-
__এজন্য তোমাকে শাস্তি পেতে হবে বাবুন। শাস্তি হলো কান ধরে দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকবে।

সীমান্ত নির্বাক বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। নানান বললেন-
__এত আরামদায়ক শাস্তি দিলে চলবে না। শাস্তি ভয়ানক হতে হবে যেন এমন অন্যায় আর না হয়। কাল সকালে ছোট রাণীকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব। সে এখন থেকে আমার বাড়িতেই থাকবে। ছোট রাণী তুমি আজ রাতেই তোমার শাড়ি কাপড় গুছিয়ে রাখবে। থাক গোছাতে হবে না। আমি সব নতুন কিনে দেবো। ওর কেনা কাপড় তোমায় পরতে হবে না।

কথাগুলো বলেই নানা আমার দিকে তাকালেন। আমি “হ্যাঁ” সুচক মাথা ঝাঁকিয়ে সীমান্তর দিকে তাকালাম। সে চোখ লাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টি বলছে, বাড়ির বাইরে গেলে দুটো ঠ্যাংই ভেঙে দেবো। আমি নানানকে বললাম-
__না না আমি যাব না।

নানান অবাক হয়ে বললেন-
__কেন?

বলতে তো আর পারছি না যে, আমি বাড়ির বাইরে গেলে আপনার ডাকাত নাতি আমার ঠ্যাং ভেঙে দেবে। আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম-
__বাবা মামনিকে ছেড়ে থাকতে পারবো না।

নানান দুষ্টুমির চোখে তাকিয়ে বললেন-
__আর স্বামীকে ছেড়ে?

আমি সীমান্তর দিকে তাকিয়ে বললাম-
__সে তো আমাকে ছেড়ে দিব্যি থাকতে পারে। আমি কেন পারবো না?

__তাহলে নিঃসংশয়ে আমার সাথে চলো।

__আচ্ছা যাব।

হুজুকে আচ্ছা বলেই সীমান্তর দিকে তাকালাম। তার দৃষ্টি বলছে, প্রথমে দুই পায়ে গুলি করবো তারপর লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ঠ্যাং ভাঙবো। ধমক ধামক না দিয়েও যে ভয় দেখানো যায় তা আজকেই প্রথম জানলাম তাও আমার নিজেকে দিয়ে। আল্লাহ তুমি কই আছো? এসব কী তোমার চোখে পড়ে না?
__আমার কেমন যেন লাগছে, আমি এখন যাই।
কথাটা বলেই সরে গেলাম।


রাতে রুমে ঢুকে দেখি বিছানার মাঝখানে চীনের প্রাচীরটা নেই। উনি শুয়ে থেকে ফোন টিপছেন। সেদিন রাতের ড্রিংক করার স্বপ্নের কথা মনে পড়লো। মানুষ মনের দুঃখে নাকি ড্রিংক করে। ড্রিংক করলে নাকি দুঃখ অনুভব হয় না। আমার এখন ড্রিংক করা উচিত। মাতাল হয়ে সব ভাংচুর করা উচিত তাহলে যদি এই ডাকাতটার শিক্ষা হয়। কিন্তু ওয়াইন কোথায় পাবো? ড্রিংক করতে পারছি না সেই দুঃখটাও অন্য দুঃখগুলোর সাথে যোগ হলো। মাতালের ভান করতেই পারব কিন্তু সে তো বিশ্বাস করবে না। উল্টা আমাকে শাস্তি দেবে। কি বিপদ আল্লাহ!
মনের দুঃখে আমি কিছু না বলে কাপড় গোছাতে শুরু করলাম। এমন ভাব করলাম যেন সকালেই আমি চলে যাব। সে একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার ফোনের দিকে তাকালো। বেশ স্বাভাবিক ভাবে বলল-
__কাপড় চোপড় রেখে শুয়ে পড়ো। রাত অনেক হয়েছে। সারাদিন তো পিকনিকে হৈহৈ করেছো। শরীর ক্লান্ত তাই আর জেগে থাকতে হবে না।

মনে মনে বললাম, কী দর‍দ! আমাকে কষ্ট দিয়ে কাঁদিয়ে এখন ঢং দেখানো হচ্ছে, হুহ। আমি কথা না বলে কাপড় গুছিয়ে চলেছি। সে ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল-
__কথা কী কানে যাচ্ছে না?

__সকালে সময় পাবো না গোছানোর। তাই এখন রেডি করে রাখছি।

__বাড়ির বাইরে গেলে ঠ্যাং ভেঙে দেবো।

আমি রেগে উঠে বললাম-
__কেন ভাঙবে? আর ভাঙতে পারলে ভেঙো।

__তর্ক করো না।

রাগে আমার চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু চুপচাপই থাকলাম। আমি কোলবালিশ দুটো এনে বিছানার মাঝখানে প্রাচীর দিয়ে শুতে না শুতেই সে বলল-
__বালিশ সরাও।

__কেন?

__এখন আর দরকার নেই।

__তখন তোমার দরকার ছিল আর এখন আমার দরকার আছে তাই বালিশ থাকবে।

সীমান্ত জোর করে বালিশ সরিয়ে দিতেই আমি চেঁচিয়ে উঠে বললাম-
__একদম ধরবে না আমায়।

সে হতবাক চোখে তাকিয়ে বলল-
__শুধু তো বালিশই সরিয়েছি, তোমায় ধরলাম কখন?

এই রে তাই তো! সে তো আমাকে ধরেনি। শুধু শুধু…. ধুর! আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে বললাম-
__একটু পর ধরতে তাই আগেই সাবধান করলাম।

__বয়েই গেছে আমার তোমায় ধরতে।

__তাহলে বালিশ থাকলে প্রবলেম কোথায়? থামো আরও বালিশ এনে তোমার চারপাশে প্রাচীর দিয়ে দিচ্ছি।

__লাগবে না।

__এতদিন তো লেগেছে। তা আজ হঠাৎ কী হলো?

__বেশি কথা বলো না তো।

__যে মানুষ বউকে ফেলে শ্বশুরবাড়ি চলে যায় এবং ফোন করে খবর নেয়ারও প্রয়োজন মনে করে না তার সাথে আমি আর একটাও কথা বলতে চাই না।

__ফোন তুমি করেছিলে একবারও?

__আমি কেন করবো? আমি তোমায় ফেলে চলে গেছি?

__আমি তো রাগ করে চলে গেছিলাম। আমিই রাগ করবো আবার আমিই ফোন করবো? তাহলে রাগ ভাঙাবে কে?

__আমি তো রাগ ভাঙাইনি তাহলে ভাঙলো কেন?

__জানি না।

__মাঝ রাস্তায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছো নিষ্ঠুর পাষাণ একটা!

__কেন বললে তোমার নতুন বর চাই?

__চাই-ই তো। কাল বাবাকে বলবো আমার জন্য ভালো দেখে যেন নতুন বর এনে দেয়।

__একদম খুন করে ফেলবো তোমায়।

মনে মনে বললাম, খুন তো করেই ফেলেছো। আর নতুন করে কী করবে? ডাকুরাজ কোথাকার! বললাম-
__আগে আমার নতুন বর চাই, তারপর খুন টুন যা ইচ্ছে করিও।

__তোমার ধারে কাছে যে আসবে তাকেই খুন করবে সীমান্ত।

__যত্তো সব ঢং! কোনো এক গড ফাদারকে বিয়ে করবো। যার পাশে সারাক্ষণ একগাদা গুন্ডা গার্ড থাকবে।

সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল-
__গড ফাদার তো দূরে থাকুক, তার চামচাও তোমাকে বিয়ে করবে না।

__কেন?

__তোমার মতো বকবক পাগলিকে সহ্য করার ধৈর্য্য আল্লাহ সীমান্তকে ছাড়া আর কাউকেই দেয়নি। তোমায় আধা ঘন্টা পর এসে ফেরত দিয়ে বলবে, আপনার জিনিস আপনিই রাখেন ভাই। আর আমাকে দোহাই লাগে ক্ষমা করেন।

__আমাকে ইনসাল্ট করছো? কালকেই আমি নানানের সাথে চলে যাব।

__তার আগেই ঠ্যাং ভেঙে বিছানায় শুইয়ে রাখবো। শাস্তির কিছুই দেখোনি এখনও। আমার অনিচ্ছায় তুমি যা করেছো তারপরেও আমি তোমায় কাছে টানতে চাইছি।

__কী এমন অপরাধ আমি করেছি হু? মা হতে চাওয়া দোষের কিছু তো নয়।

__তোমার জন্য দোষের। কেন আমি রাজী নই তা তো তুমি ভালো করেই জানো।

আমি প্রসঙ্গ এড়িয়ে বললাম-
__আমার ঘুম পেয়েছে। আর খবরদার বালিশ সরাবে না। তাহলে কিন্তু চেঁচিয়ে আমি বাবাকে ডাকবো।

সীমান্ত ঝাঁজালো স্বরে বলল-
__এখনি ডাকো। তিনি এসে দেখুক যাকে সারাদিন তিনি মা মা করেন সে তার ছেলেকে কতটা কষ্ট দিচ্ছে। তুমি না পারলে আমিই বাবাকে ডাকছি।

__ডাকো।

সে চুপসে গিয়ে বলল-
__ঠিক আছে বালিশ সরাবো না। ধুর।

সে আর কিছু না বলে মহা বিরক্ত হয়ে ওপাশ ফিরে চোখ বন্ধ করলো। আমিও কিছুক্ষণ পরেই ঘুমিয়ে গেলাম।

সকালে ঘুম ভেঙে আমি হাবা হয়ে গেলাম। দেখি চীনের প্রাচীর নেই। আমাকে ওর বুকে জড়িয়ে ধরে সে ঘুমিয়ে আছে। আমিও জড়িয়ে ধরে আছি। ইয়া আল্লাহ! কে নিজে থেকে কাছে গিয়েছে? সে নাকি আমি? আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না। আমি যদি নিজে থেকে তার কাছে গিয়ে থাকি তাহলে ব্যাপারটা খুব খারাপ হয়েছে। আমি তো রাগ করে আছি, আমার নিজে থেকে যাওয়া তো একদম উচিত নয়। এখনই আমার এখন থেকে পালাতে হবে। ঘুমের মধ্যের ঘটনা ঘুম ভাঙার পরে মনে রাখা ঠিক নয়। আমি চুপিচুপি তাকে সরিয়ে দিয়ে উঠতেই সে আমার হাত টেনে ধরলো। এই রে আমি শেষ! সে জেগে গিয়েছে, এখন আমার কী হবে? আমি তার দিকে তাকাতেও পারছি না। সে আমার কানের কাছে তার মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল-
__কী ভাবছো? কে কাকে টেনে নিয়েছে এটাই ভাবছো তো?

পরের পর্ব আসছে…..
Written by- Sazia Afrin Sapna

“ভালোবাসার প্রান্ত”
(পর্ব-১১)

আমি ভয়ে ভয়ে সীমান্তর দিকে তাকালাম। সে এখনো চোখ খোলেনি। আমি তার কথার কোনো জবাব দিলাম না। এখন যে ভয়ানক কিছু শুনতে হবে তা আমি নিশ্চিত। সে চোখ না খুলেই বলল-
__তুমিই চীনের প্রাচীর ভেঙে দিয়ে আমার এলাকায় চলে এসেছিলে। তারপর বলবো?

তার কথা শুনে খুব লজ্জা পেলাম কিন্তু তা বাহিরে প্রকাশ না করে স্বাভাবিক ভাবেই বললাম-
__না, বলতে হবে না। কারণ আমি সব জানি।

__কী জানো?

__চীনের প্রাচীর তুমি ভেঙে দিয়ে আমাকে টেনে তোমার এলাকায় নিয়ে গিয়েছো। আইন ভেঙেছো, ডাকাত একটা। আজ আমি অবলা বলে..

আমি এমন ভাবে কথাগুলো বললাম যেন সে প্রাচীর ভাঙার সময় আমি তা নিজের চোখে দেখেছি। অথচ সত্যিটা হলো, আমি বিভোরে ঘুমিয়ে ছিলাম, এসব কিছুই জানি না। নিজের ভাব দেখে নিজেই হতবাক হলাম। এসব কী করে যে আমি পারি তা আমি নিজেই জানি না।
এবার সে চোখ মেলে তাকালো আমার দিকে। তারপর বিস্ময়ের সুরে বলল-
__কেমন করে এত বানিয়ে বলতে পারো তুমি?

আমি থতমত খেয়ে বললাম-
__বানিয়ে কেন বলবো? যা সত্যি তাই বলছি।

__তুমি অবলা এটাও সত্যি?

__হু

সে অমার হাত ছেড়ে দিয়ে নিজের মাথায় হাত রেখে বলল-
__ওহ মোর খোদা!

আমি মুখ ভেংচি কেটে বললাম-
__ঢং বাদ দাও আমার কাজ আছে।

সে দুষ্টুমির চোখে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল-
__আমার এলাকায় এসে অবলা সুন্দরী কী কী করেছে তা শুনবে না সোনা?

এই মানুষটা সারাক্ষণ আমাকে লজ্জা দেবার ধান্দায় থাকে। হ্যাঁ আমি লাজুক লতা বা লজ্জাবতী নই, তাই বলে কী আমার একটুও লজ্জা নেই? এমন করে লজ্জা দেবার কী আছে? নিষ্ঠুর একটা! কপট রাগ দেখিয়ে বললাম-
__না, শুনবো না।

সে মুচকি হেসে বলল-
__কেন সোনা?

আমি উঠে বসে চুল ঠিক করতে করতে বললাম-
__যা গল্পে লিখতে পারব না, তা শুনতেও পারব না।

সে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলল-
__তুমি এসব গল্পে লিখবে নাকি?

__হ্যাঁ লিখবো। সবাইকে বলে দেবো তুমি কত পাষাণ হৃদয়হীন কাঠ তক্তা।

__তুমি যে প্রাচীর ভেঙে আমার এলাকায় চলে এসেছিলে সেটাও লিখবে?

__লিখবো তো। আমার ডাকাত স্বামী রাতে প্রাচীর ভেঙে আমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় তার এলাকায় তুলে নিয়ে গিয়েছিল। এসব পড়ে পাঠকরা তোমায় ছিঃ ছিঃ করবে। ছিঃ

সে যেন আমার কথায় হতভম্ব হয়ে গেল। তোতলিয়ে বলল-
__এএএসব মিইইইথ্যা কথা লিইইইখবে?

আমি নেত্রীদের মতো বিশাল ভাব নিয়ে বললাম-
__কেউ না জানলেও তুমি তো জানো যে, প্রাচীরটা তুমিই ভেঙেছো আর আমাকেও টেনে নিয়ে গিয়েছো। বিকজ ঘুমিয়ে গেলে ঝড় তুফান হলেও আমি টের পাই না। তুমি এই সুযোগটা নিছো ডাকুরাজ। এসব আমি লিখে দেশবাসীকে জানিয়ে দেবো। বিচার চাইবো।

সে মুখ কাচুমুচু করে বলল-
__কী মরতে যে লেখিকা বিয়ে করেছি আল্লাহ!

আমি ফিক করে হেসে বললাম-
__যে মরতে আমি ডাক্তার বিয়ে করেছি সেই মরতে তুমিও লেখিকা বিয়ে করেছো।

__ডাক্তার আবার কী করলো?

__ডাকাতি করলো।

__কিহ?

__খুলনার ঘোড়া ডিম পাড়ে।

কথাটা বলেই আমি মুচকি হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম।


আমি ফ্রেশ হয়ে নাস্তা রেডি করলাম। সীমান্ত নাস্তা করেই বের হবে। সে এসে ডায়নিংএ বসতেই নানান তার মুখোমুখি চেয়ারে বসে বললেন-
__বাহ্ তোমায় তো হেব্বি ফুরফুরে লাগছে হিরো! তা এই রূপের রহস্য কী?

নানানের কথায় আমার খুব হাসি পেলো। কিন্তু অস্থানে হাসলে বিপদ অনিবার্য। এবাড়িতে একজন মানুষ হুটহাট বাঘাকৃতি ধারণ করে। আর সেই বিশিষ্ট জন হলেন আমার স্বামী। তাই হাসি চেপে রাখলাম।
সীমান্ত অবাক হয়ে নানানের দিকে তাকিয়ে বলল-
__মানে?

নানান মুচকি হেসে বললেন-
__শ্বশুরবাড়ি থেকে কাল এলে ক্লান্ত হয়ে, রাত গেল এখন দেখছি তুমি ফুরফুরা হিরো হয়ে গেছো। তাই রহস্য জানতে চাইছি। কারণ আমিও এমন ফুরফুরা হতে চাই।

সীমান্ত কেশে গলা ঠিক করে নিয়ে বলল-
__কাল ক্লান্ত ছিলাম। রাতে ঘুমানোর পরে এখন ফ্রেশ লাগবে এটাই তো স্বাভাবিক।

__তা অবশ্য ঠিকই বলেছো। সুন্দরী বউ পাশে ঘুমালে ক্লান্তির চৌদ্দ গুষ্ঠি তো পালাবেই।

সীমান্ত কিছু না বলে খাওয়ায় মন দিলো। কিন্তু নানান কিছুতেই ছাড়লেন না। তিনি এক ধিয়ানে সীমান্তর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন। সীমান্ত যে ভয়ে নানানের দিকে তাকাচ্ছে না, তা আমি বুঝতেই পারছি। নানান আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-
__ছোট রাণী, নাস্তা করে রেডি হয়ে নাও।

আমি অবাক চোখে তাকালাম নানানের দিকে। আমি কিছু বলার আগেই সীমান্ত বলল-
__কেন রেডি হবে?

নানান বললেন-
__আমি তো তাকে নিতে এসেছি।

__আমার বউকে আপনি নিতে আসবেন কেন? আমি কী আপনার বউকে নিতে গেছি? আমার বউ কোথাও যাবে না।

__তুমি আমার বউকে নিতে যাবে কেন? আমার বউ তো নতুন বর চায়নি। আর আমিও তাকে মাঝ রাস্তায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দিইনি।

__তার শাস্তি প্রাপ্য ছিল তাই দিয়েছি।

__একটা নতুন বর চেয়েছে বলে তুমি তাকে শাস্তি দেবে? তুমিও তো বলতে পারতে যে, তোমারও নতুন একটা বউ চাই!

__আমার মাথা কী খারাপ হয়ে গেছে? একটা পাগলিকে বিয়ে করে আমার জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে। আবার বিয়ের কথা আমি এজীবনে মুখে আনবো না।

নানান বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে বললেন-
__তা কী করে সে তোমার জীবনটা তছনছ করলো? আহারে তোমার কত সুন্দর জীবন ছিল!

__ওসব বলা যাবে না। আর আমার বউ কোথাও যাবে না।

নানান দুষ্টুমির চোখে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন-
__তা বউয়ের মান ভাঙতে পেরেছো তো?

সীমান্ত কিছু না বলে নাস্তায় মন দিলো। নানান বললেন-
__একটু তো বলো হিরো।
তোমরা যদি না বলো হে
কেমন করে পটবে সে?
কেমন করে বউটা আমার
একটু ভালো বাসবে আমায়?
দেখেছো তোমার বউয়ের ছোঁয়াচে রোগ আমাকে ধরেছে! আমিও কবি কবি হয়ে গেছি!

কথাটা বলেই নানান হাহা করে হাসলেন। সাথে আমিও হাসলাম কিন্তু আমার গোমরামুখো সুয়ামী হাসলো না। সে যে পটানোর কথা বলা নিয়ে টেনশনে আছে তা বুঝতে পারছি। আসলে সে তো ধরা পড়ে গিয়েছে। বেশ হয়েছে! ঠিক হয়েছে! এখন ঠ্যালা সামলাও ডাক্তার সাহেব!

নানান বললেন-
__কেমন করে বউ পটাতে হয় সেই টিপসগুলো অন্তত দাও! দেখো না আজও আমি আমার বউকে পটাতে পারলাম না। কবে জানি সেও তোমার বউয়ের মতো বলে, “তুমি পুরোনো হয়ে গেছো, আমার নতুন বর চাই।” তাহলে তো সেরেছে।

কথাটা বলেই নানান হাসলেন। আমি সীমান্তকে খোঁচা মারার জন্য নানানকে বললাম-
__পুরোনোকে তো পুরোনো বলতেই হবে। নানুনেরও বলা উচিত।

নানান দুষ্টু হেসে বললেন-
__এখন আমি যদি বলি তিনিও পুরোনো হয়ে গেছেন তাহলে তো কেস উল্টো হবে। তিনি আমাকে ঘর ছাড়া করবেন। কী দুঃখ!

নানান সীমান্তর দিকে তাকিয়ে বললেন-
__হিরো তুমি তানির থেকে যে পটানোর টিপস গুলো শিখেছিলে সেগুলো অন্তত বলো!

সীমান্ত বিষম খেয়ে খকখক করে কাশতে শুরু করলো। আমি পানির গ্লাস এগিয়ে দিলাম। সে পানি খেয়ে দম নিলো কিন্তু নানানকে কিছু বলল না। নানান মুচকি হেসে বললেন-
__রাত জেগে ফিসফিস করে প্রেম করেছো, আর আমাদের বুঝিয়েছো যে, তুমি ভাজা মাছ উল্টে খাওয়া তো দূরে থাকুক, তুমি মাছই চেনো না। তোমার এই চুরি চুরি প্রেমের কাহিনী আমার এই বয়সেও মনে প্রেম জাগিয়েছে। শুধু প্রেমিকার অভাব বোধ করছি।

সীমান্ত বলল-
__প্রেমিকা চেয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন।

নানান রোমান্টিক চোখে সীমান্তর দিকে তাকিয়ে বললেন-
__ভাবছি ছোট রাণীর সাথেই প্রেম করে অভিজ্ঞতা অর্জন করবো।

সীমান্ত চোখ কপালে তুলে বলল-
__সে খুব অভিজ্ঞ নাকি?

__সে-ই তো পৃথিবীর সেরা অভিজ্ঞ।

সীমান্ত মুচকি হেসে বলল-
__হ্যাঁ তার বিশাল অভিজ্ঞতা আছে। তার কথা শুনে ছেলেরা আগে দৌড়ে পালাতো। কী দারুণ মিষ্টান্ন বাঁশ দিতো সে। এই তো তার প্রেমের অভিজ্ঞতা।

__সে তুমি বাঁশ টাস যা-ই বলো, তোমার মতো আধা পাগলের সাথে ধৈর্য্য ধরে দীর্ঘদিন প্রেম করেছে সে। এমন ধৈর্যশীলার সাথে প্রেম করেই তো অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়।

সীমান্ত চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল-
__কিহ আমি আধা পাগল?

__হ্যাঁ তখন আধা পাগলই ছিলে, এখন তুমি ফুল-পাগল।

সীমান্ত ন্যাকা রাগ দেখিয়ে বলল-
__কিহ?

__এতে কোনো সন্দেহ আছে হিরো?

__আমার তো আপনাকেই পাগল মনে হয়। আপনি আর আপনার ছোট রাণী দুজনই পাগল। জানেন সে বিয়ের আগে আমাকে কেমন করে জ্বালিয়েছে?

নানান খুব উৎসাহ নিয়ে উৎসুক চোখে তাকিয়ে বললেন-
__কেমন করে জ্বালিয়েছে? বলো বলো! তাড়াতাড়ি বলো!

সীমান্ত আমার দিকে তাকালো। এবার তার হুশও ফিরলো যে, সে ভুল বাক্য প্রয়োগ করে ফেলেছে। নিজেকে স্বাভাবিক করে সে বলল-
__থাক ওসব কথা।

নানান মুচকি হাসলেন। তার নাতিকে আমি কেমন করে জ্বালিয়েছি তা হয়তো তিনি আন্দাজ করে ফেলেছেন। বললেন-
__হু বুঝলাম। যেহেতু ছোট রাণী আর আমি দু’জনই পাগল তাই আমি ছোট রাণীর সাথেই প্রেম করবো।

সীমান্ত কপট রাগ দেখিয়ে ঝাঁজালো স্বরে বলল-
__আপনার বউ নেই? অন্যের বউয়ের সাথে প্রেম কেন করবেন?

__সেটা তোমার মতো আধা পাগল বুঝবে না।

সীমান্ত আমার দিকে তাকিয়ে বলল-
__এই যে প্রেমের রাণী, যাও তোমার রোমান্টিক লাভারের সাথে প্রেম করো। তোমার মনে তো সারাক্ষণ প্রেমের ফাল্গুন লেগেই থাকে। আমি তো কাঠ তক্তা। আমি তো ভালা না, তাই ভালা লইয়াই থাকো।

আমি নির্দোষ মুখ করে বললাম-
__আমি কখন প্রেম টেম করতে চাইলাম? এসব আমি পারি নাকি? তবে লাভারের সাথে প্রেম করাই যায়। আইসক্রীম ফুচকা খাওয়া, মুভি দেখতে যাওয়া। সাগর তীরে ঘুরে বেড়ানো। উফ্ ভাবতেই….

এইটুকু বলেই সীমান্তর চোখে আমার চোখ পড়তেই আমি থেমে গেলাম। সে বলল-
__ভাবতেই কী?

আমি ফিক করে হেসে বললাম-
__ভাবতেই নিজেকে নায়িকা মনে হচ্ছে। তবে নায়ক হলো নানান আর তুমি একটা ডাক্তারের রোলে আছো। নায়িকা অসুস্থ হয়ে পড়লে তোমাকে ডাকা হবে।

আমার কথা শুনে নানান হাহা করে হেসে উঠলেন। রাগী বাঘটাও হেসে ফেললো। আমি আর বাকী থেকে কী করবো? কাউকে হাসতে দেখলে আমি আবার না হেসে থাকতে পারি না। কী জ্বালা!

পরের পর্ব আসছে…..
Written by- Sazia Afrin Sapna

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here