#মৃগতৃষ্ণা-৪
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★প্রকৃতি গুমোট বায়ুশূন্য হয়ে আছে। গাছের পাতা যেন অনশনে বসেছে। তারা কোনক্রমেই নড়নচড়ন করবে না। ভ্যাপসা অসহনীয় গরমে অতিষ্ঠ জনমানব। মনে হচ্ছে ঝড়ের পূর্বাভাস এটা। আজ হয়তো প্রচন্ড বেগে ঝড় আসবে।আকাশ ভেঙে ভারী বর্ষনও হতে পারে।লেখিকা-মেহরুমা নূর। গ্রীষ্মের এদিনে ঝড় আসাটাই স্বাভাবিক। বিশাল উঠোন জুড়ে ধান শুকাতে দেওয়া হয়েছে। এই মৌসুমে ঘরে ঘরে ধান ওঠে। ক্ষেতে কৃষক আর বাড়িতে মেয়েরা ধানের কাজে অতি ব্যাস্ত সময় পার করে। চেয়ারম্যান বাড়িতেও এই সময় কাজের ধুম পড়ে। যদিও ধান মাড়াইয়ের বেশির ভাগ কাজ বাইরে কামলারাই করে। আর বাড়ির ভেতর কাজের লোকেরা করে। তবুও বাড়ির বউ ঝি দেরও সাহায্য করতে হয়। কাজের সময় কেউই বসে থাকতে পারে না।
ধানে পা দিয়ে এসে একটু কাঠাল গাছের ছায়ায় বসেছে পঙ্খি।ভর দুপুরের তীব্র রোদের আক্রোশে মুখাবয়ব লাল টকটকে হয়ে গেছে তার। ওড়নার কোণা দিয়ে ঘর্মাক্ত মুখ টা মুছে নিয়ে জগ থেকে পানি গ্লাসে ঢেলে নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। গরমে গলা শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। প্রকৃতির এই অবস্থা দেখে একটু চিন্তা হচ্ছে তার। সিদ্ধ ধানগুলো শুকাতে পারলে হয়। তার আগেই না আবার বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। এক ধান বারবার রোদে দেওয়া টা অনেক ঝামেলা। একবারে শুকাতে পারলে বাঁচা যায়।
পানি খেয়ে গ্লাস টা মাটিতে রাখতেই কেউ এসে ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো। আচমকা কেউ আসায় পঙ্খি হালকা হকচকিয়ে উঠে পাশে ফিরে তাকালো। ইন্ধনকে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো সে। ওড়না ভালো করে টেনে একটু সরে বসলো সে।
–একটু পানি দিবে পঙ্খি?
ইন্ধনের কথায় মাথা নেড়ে স্টিলের গ্লাসে পানি ঢেলে ইন্ধনের সামনে ধরলো। ইন্ধন পানির গ্লাস হাতে নিয়ে সাথে সাথে ফিনিস করে দিয়ে খালি গ্লাসটা আবারও পঙ্খির সামনে ধরলো। মানে সে আরও পানি চাচ্ছে। পঙ্খি জগ ধরে তার গ্লাসে আবারও পানি ঢেলে দিলো। ইন্ধন আবারও একই কাজ করলো। পুরো চার গ্লাস পানি খাওয়ার পর সে গ্লাসটা নিচে রাখলো।পা জোড়া মাটিতে টান করে ছড়িয়ে দিয়ে, দুই হাত পেছনে মাটিতে ভর দিয়ে হালকা পেছনের দিকে ঝুঁকে মাথাটা পেছন দিকে এলিয়ে দিয়ে, চোখ বুজে রইলো ইন্ধন। পঙ্খি আরচোখে একটু তাকালো ইন্ধনের দিকে। লোকটাকে এতো ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে কেন? কি এমন যুদ্ধ জয় করে আসলেন উনি? পঙ্খির ভাবনাকে অব্যাহতি দিয়ে ইন্ধন আগের ভঙ্গিতে থেকেই বলে উঠলো। –জানো পঙ্খি আজ আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করলাম আমাদের কৃষকদের চেয়ে মহান কেউই না। ওদের সামনে বড়ো বড়ো বডি বিল্ডারস রাও তুচ্ছ। এইযে দেখ আজ একটু শখ করে আমাদের কামলাদের সাথে ক্ষেতে ধান কাটতে গিয়েছিলাম। ব্যাস ত্রিশ মিনিটেই আমার কর্ম শেষ। অথচ ওরা সারাদিন এই রোদের মাঝে থাকে। ওদের এই অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণেই বাংলাদেশ শস্য শ্যামলে ভরা। ওরাই হলো রিয়েল হিরো। আমার ইচ্ছে আছে কৃষি ক্ষেত্রে আরও উন্নত করার।
ইন্ধনের মনোভাব গুলো পঙ্খির ভালো লাগলো।বিদেশে থেকেও দেশের প্রতি কতো সরল ভাবনা তার। এতো বড়ো ঘরের ছেলে হয়েও কামলাদের সাথে ক্ষেতে ধান কাটতে গিয়েছিল। পঙ্খি খেয়াল করলো ইন্ধনের কাঁধের ওপর লাল হয়ে ফুলে গেছে? পঙ্খি হঠাৎই বলে উঠলো।
–আপনি কি ধানের বান কাঁধে নিয়েছিলেন?
–হ্যাঁ ওই আরকি একটু ধান বওয়ার চেষ্টা করছিলাম। দুই বার এনেই কাঁধের এই নাজেহাল অবস্থা হয়ে গেছে। দাদা ঠিকই বলতো বিদেশে যারা থাকে তারা হলো বয়লার মুরগী।
কথাটা বলে নিজেই হেঁসে উঠলো ইন্ধন। পঙ্খি খেয়াল করলো ইন্ধন হাসলে তাঁর খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির মাঝে টোল পড়ে। আর তাকালো না পঙ্খি। চোখ সরিয়ে নিয়ে বললো।
–আপনার দাদাকে দেখেছেন আপনি?
–দেখবোনা কেন? সেইতো আমার জীবনের প্রিয় ব্যাক্তি ছিল। বিদেশে যাওয়ার তিন বছর পর তিনি মারা যান। বিদেশে থাকায় তাকেও আমি শেষ দেখা দেখতে পারিনি।
ইন্ধনের কথায় একরাশ অনুশোচনা আর অভিযোগের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। অভিযোগ টা যে তার বাবার প্রতি সেটুকু বুঝতে পারছে পঙ্খি।ওদের কথপোকথনের মাঝেই ওখানে ছায়া এসে হাজির হলো। হাতে একটা স্টিলের বোল। কাসুন্দি দিয়ে কাঁচা আম মাখিয়ে এনেছে সে। পঙ্খির পাশে বসে বোলটা এগিয়ে দিয়ে বললো।
–ভাবি কাঁচা আম মাখানো খাও। এই গরমে কাঁচা আম খাওয়ার মজাই আলাদা। আমাদের গাছের টক আম।
পঙ্খির তো জিহ্বায় পানি চলে এসেছে।লেখিকা-মেহরুমা নূর। কাঁচা আম তার দূর্বলতা। আর কাসুন্দি দিয়ে মাখালে তো কথাই নেই। ছোঁ মেরে বোলটা হাতে নিল সে। দুই আঙুলে করে মাখানো আম মুখে পুরে নিলো। স্বাদের আবেশে মুখ দিয়ে চটাস করে শব্দ করলো। ইন্ধন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো ওদের দিকে। এই কাঁচা আমের মাঝে কি এমন অমৃতর স্বাদ পাচ্ছে ওরা। ওরতো এসব টক দেখলেই গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। পঙ্খি ভদ্রতার খাতিরে বোলটা ইন্ধনের দিকে এগিয়ে দিয়ে আম মাখানো নিতে বললো। ইন্ধন মাথা নেড়ে বললো।
–আরে নানা আমি এসব খাইনা।তোমরাই খাও।
ছায়া পাশ থেকে দুষ্টুমি করে বলে উঠলো।
–আরে ভাবি কাকে কি দিচ্ছো? আমার বডি বিল্ডার ভাই টকের সামনে দূর্বল। টক দেখলেই তিনি ভয় পান।
ইন্ধন তাচ্ছিল্যের সহিত বললো।
–হোয়াট রাবিশ। ইন্ধন আর ভয়? তাও আবার সামান্য এই কাচা আমকে? হাঁহ্, দাড়া এখুনি তোদের খেয়ে দেখাচ্ছি।
ইন্ধন দুই টুকরো মাখানো কাঁচা আম মুখে নিলো। যত দম্ভোক্তির সহিত আম মুখে পুড়েছিল মুহূর্তের ব্যবধানেই তা ফুসস হয়ে গেল। চোখ মুখ কুঁচকে যেন চোখা কোন হয়ে গেল। গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেল তার। বেচারা না পারছে গিলতে না পারছে ফেলে দিতে। ইন্ধনের মুখভঙ্গি দেখে পঙ্খি আর ছায়া নিজেদের হাসির মেলট্রেন থামাতে ব্যার্থ হলো। বাঁধ ভাঙা হাসিতে ফেটে পড়লো তারা।
পঙ্খি আর ইন্ধনের একসাথে বসে হাসাহাসি করাটা কারোর চোখের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তার চোখে ভয়, ক্রোধ দুটোরই বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে। মস্তিষ্ক তাকে বারবার আজ্ঞা করে দিচ্ছে যে, এই বিষয় টাতে অতিসত্বর তাকে কিছু না কিছু করতে হবে। তানাহলে মামলা হাতছাড়া হয়ে যাবে।
কিছুক্ষণ পর ইন্ধন উঠে গিয়ে কাচারি ঘরের মাঁচালে গিয়ে সটান হয়ে শুয়ে পড়লো। ধান উল্টে দেওয়ার সময় হয়েছে। পঙ্খি আর বাকিরা কাজে লেগে পড়লো। একজন হরপাট (কাঠের তৈরি ধান টানার বস্তু) দিয়ে ধান টানছে। আর পঙ্খি সেগুলো ঝাড়ু দিয়ে দিচ্ছে। ধান উল্টানো শেষে সে একটু ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য বাড়ির ভেতর এলো।
রান্নাঘরে সেউ (চাউলের গুড়ার হাতে বানানো সেমাই) রান্না করছিল রাবেয়া। ছেলে আসার পর থেকে সে তার পছন্দের পাকোয়ান বানানের কাজেই সর্বদা জুটে থাকে। এতেই যেন তার পরম আনন্দ। জাহানারা কোন কাজে রান্না ঘরে আসলো। রাবেয়া তাকে দেখে প্রফুল্ল মুখে বললো।
–ভাবি একটু চেঁখে দেখোনা কেমন হলো? অনেক দিন পর বানালাম তো। বুঝতে পারছি না মিষ্টি পরিমাণ মতো হয়েছে কিনা।
কথাটা বলে রাবেয়া চামচে করে সামান্য সেউ জাহানারার দিকে এগিয়ে দিতে লাগলো। জাহানারা গম্ভীর কন্ঠে বললো।
–আমাকে কেন বলছো? নিজেই দেখ।
–আরে একটু দেখোই না ভাবি।
জাহানারা এবার অসন্তোষের সুরে বললো।
–এক কথা একবার কইছি না? তোমাগো হয়তো মহানন্দ বাজছে। কিন্তু আমার মনে ওতো রঙ নাই। যা ইচ্ছে করো। আমারে জ্বালাইতে আসবানা।
কথাটা বলেই জাহানারা চলে যেতে লাগলো। হঠাৎ পাপসের সাথে পা বেজে পড়ে গেল সে। পঙ্খি তখন এদিকেই আসছিলো। জাহানারা কে পড়ে যেতে দেখে সে দৌড়ে এলো তার কাছে। জাহানারার হাত ধরে তোলার চেষ্টা করলে জাহানারা পঙ্খির হাত ঝটকা মেরে সরিয়ে দিয়ে ঝাঁঝাল সুরে বললো।
–খবরদার আমার কাছে আসবানা। তোমারে না কতবার কছি আমার সাথে আদিখ্যেতা দেখাবা না। তোমার চেহারা দেখলেও আমার গা জ্বলে। চলে যাওনা ক্যা এহেন থাইকা? কিসের লাইগা পইড়া আছো?
একদফা ঝেড়ে দিয়ে জাহানারা উঠে চলে গেল। পঙ্খি মলিন মুছে দাঁড়িয়ে রইলো ওখানে। রাবেয়া পঙ্খির কাছে এসে বললো।
–মন খারাপ করেনা। আসছে ছেলের শোকে ভাবি এমন হয়ে গেছে। আমারই ভুল হয়েছে। আমার বোঝা উচিত ছিল ভাবির মনমানসিকতা এখন ঠিক নেই। আচ্ছা যাইহোক বাদ দাও ওসব। তুমি একটু চেঁখে দেখোতো সেউ টা কেমন হলো?
পঙ্খি চেখে বললো।
–অনেক ভালো হয়েছে চাচী মা। আপনি সত্যিই অনেক ভালো রান্না করেন। আমাকেও একটু আপনার মতো রান্না শেখাবেন?
–হ্যাঁ হ্যাঁ কেন নয়। তার আগে তুমি এই প্রিজের সেউটুকু খাও এখন। সেই সকাল থেকে কাজ করছো। এখন একটু শান্তি মতো বসে এটা খেয়ে নাও।
রাবেয়ার জোরাজুরিতে পঙ্খি মানা করতে পারলোনা। তার আসলেও ক্ষুধা পেয়েছিল। তাই টুলটা টান দিয়ে বসে রাবেয়ার দেওয়া সেউ খেতে লাগলো।
__
গাছের নিচে বসে ছাগল ছানা কোলে নিয়ে আদর করছিল ছায়া। এটা ওর নিজের টাকায় কেনা ছাগলের ছানা। স্কুলের উপবৃত্তির টাকা দিয়ে পাশের বাড়ির রহিমা খালার কাছ থেকে কিনেছিল ও। গত পনেরো দিন পূর্বে সেই ছাগলের দুটো ছানা হয়েছে। ছায়া প্রায় সারাদিনই এগুলোর পেছনেই লেগে থাকে। এদের খাওয়ায়, যত্নাদি করে আর আদর করে। ছায়া আর তার ছানার পেয়ার ভরা মুহূর্তে হঠাৎ পেছন থেকে পুরুষালী কন্ঠে কেউ বলে উঠলো।
–এইজন্যই তো বলি আমাদের পুরুষ সমাজ এতো অবহেলিত কেন? সিঙ্গেল পোলা দিয়ে দেশ ভরে যাচ্ছে। কোলে নিজের বাচ্চা পালার সময় মেয়েরা যখন ছাগল ছানা পালবে তখন এছাড়া আর কি হবে?
আচমকা এমন বিদ্রুপপূর্ণ কথা শুনে ছায়া ভ্রু কুঁচকে তড়িৎ গতিতে পেছনে তাকালো। দাঁত কেলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শাকিল কে দেখে পূর্বের কুঁচকে থাকা ভ্রু আরও কুঁচকে গেল। এতদিন পর আবার এই অসহ্যকর লোকটাকে সে মোটেও আশা করেনি। অতঃপর ছায়া দাঁত কিড়মিড় করে বললো।
–কি বলতে চাইছেন আপনি?
শাকিল গাছের শেকড়ের ওপর বসে বুক ফুলিয়ে একটা হতাশার নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো।
–হাঁহ্, এটাই তো জ্বালা।আমি কি বলতে চাই এই সামান্য বিষয় টাই তোর অতি সামন্য মস্তিষ্ক অনুধাবন করতে পারে না। উচ্চপর্যায়ের গর্ধব হলে যা হয় আরকি। মাথায় তো মগজের জায়গায় আছে খালি গরুর চোনা।
–এই আপনাকে না বলেছি আমাকে এসব ফালতু কথা বলবেন না? তা এতদিন পর কোন দুঃখে উদয় হলেন? কতদিন একটু শান্তিতেই ছিলাম।
–এইজন্যই তো এলাম। তুই শান্তিতে থাকবি সেটা আমি কিভাবে মেনে নিবো? আমার বদহজম হয়ে যায়। বাথরুমে প্রেসার আসে না বুঝেছিস?
–ছিহহ্ কি সব বাজে কথা বলেন। মুখটা গিয়ে পুকুরের পানিতে চুবিয়ে আসুন। ফালতু লোক একটা।
–এই ছেড়ি সাবধানে কথা বলিস। জানিস তুই কার সাথে কথা বলছিস? আমি এখন তোর গ্রামের কোন সাধারণ ছেলে না। আমি এখন একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর। ট্রেনিং শেষে আজই উল্লাপাড়া থানায় আমার পোস্টিং হয়েছে। তাই সম্মান দিয়ে কথা বলবি। নাহলে কিন্তু ধরে নিয়ে হাজতে চালান করে দিবো। এমন এমন কেস দিবো যে সারাজীবন জেলেই বুড়ী হয়ে যাবি। তারপর ওখানে বসে বসে “চাক্কী পিসিং এন্ড পিসিং”।
শাকিলের কথায় ছায়া একটু দমে গেল। ও শুনেছিল শাকিলের নাকি পুলিশের চাকুরী হয়েছে। শাকিল ওদের শরীকানা চাচাতো ভাই হয়। চাকুরি হওয়ার খুশিতে ওর মা মিষ্টি দিতে এসেছিল। সেখান থেকেই ছায়া জানতে পারে । ছায়ার দমে যাওয়া চেহারাটা দেখে শাকিল বাঁকা হেসে বললো।
–আচ্ছা যাইহোক। তোর মতো শূন্য মগজের লোকের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করার মতো ওতো সময় নেই আমার। আমার সময়ের এখন মেলা দাম আছে বুজেছিস। আমি ইন্ধনের সাথে দেখা করতে এসেছি। কোথায় ও?
ছায়া ভেংচি কেটে বললো।
–আমি যেন মরে যাচ্ছি আপনার সাথে কথা বলার জন্য। যান যান কাচারি ঘরে আছে ভাইয়া।
শাকিল ছায়ার কয়েকটা চুল ধরে টান মেরে দিয়ে চলে গেল। ছায়া পেছন থেকে বিড়বিড় করে ইচ্ছে মতো গালির ফোয়ারা ছুড়তে লাগলো।
__
কাচারি ঘরের মাঁচালে শুয়ে ছিলো ইন্ধন। শাকিল এসে হাসিমুখে বলে উঠলো।
–♬ বিদেশ গিয়া বন্ধু তুমি আমায় ভুইলো না।
♬কল কইরো, টেক্স কইরো,ভিডিও কইরো, জানাইও ঠিকানা।
বাট আপসোস। আমার হারামি ভাই কম বন্ধু সব ভুইলা গেছে। বিদেশের গোরে গোরে মুখরে পে কালা কালা চশমা দেইখা এই বন্ধুরে ভুইলা গেছে।
ইন্ধন হেঁসে উঠে বললো।
–তুই আর বদলালি না। এখনো সেই ড্রামাবাজই রয়ে গেলি। তোর তো পুলিশ বাদ দিয়ে ফিল্মে ট্রাই করা উচিত ছিল।
–সবার কপাল কি আর তোর মতো রে ভাই? বাপের উষ্টা খাইতে খাইতে শেষমেশ পুলিশে জয়েন করতেই হলো।
–তাইলে তো বোধহয় তোর টেবিলের তলের আদান-প্রদান শুরু হয়ে গেছে তাইনা?
–তওবা ওয়াস্তাকফিরুল্লা, কি কস এইগুলা। আমার মতো ইমানদার, ইজ্জতদার পুলিশের নামে এমন অপবাদ দিতে পারলি তুই? কলিজায় চোট পাইলাম।
–বাচ কর শালা। আর কতো ফুটেজ খাবি?
–উল্টো কাচিতে গোয়া কাটোস ক্যা? শালা তো আমার তোরে বানানোর পরম ইচ্ছা।
–ওই আমার বোনের দিকে নজর দিলে খবর আছে তোর।
–আরে নজর দিবো কেন? আমিতো পুরো আমওটারেই দিয়ে দিতে চাই। কিন্তু তোর গর্ধব বোন বুঝলে তো। বুদ্ধি বিতরণ করার সময় ওইডা বোধহয় বাত পইরা গেছিলো।
শাকিলের কথায় হেঁসে দিল ইন্ধন।
__
শোবার পূর্বে নিজের রুমের জন্য জগ ভরতে এসেছিল পঙ্খি। লেখিকা-মেহরুমা নূর। রান্না ঘরের দরজায় আসতেই কিছু কথপোকথন কানে আসে ওর। বাড়ির কামলা কলিম এসেছে কাজের মেয়ে চুমকির কাছে। একটা প্যাকেট চুমকির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলছে।
–এই চুমকিরাণী দেখ তোর নাইগা কি আনছি?
–কি আনছু?
–আজ বিয়ারার মেলায় গেছিলাম। হেকেন থাইকা তোর লাইগা ঠোটপালিশ আর নখপালিশ আনছি। এই দেখ।
–হত্যিই?? তোর আমার কথা মনে আছিলো?
–থাকবোনা? তুই ছাড়া আমার আর কেডো আছে? আমি তোক ফেরেম করি না?
চুমকি লাজুক হাসি দিয়ে বললো।
–যাহ্ কি কইস এইসব? আমার শরম করে।
–শরম কিসের? আমিতো তোকই বিয়া করমু। মাক কইছি। চৌয়ারি ঘরডা দিয়াই তোক ঘরে তুলমো। আইচ্ছা কালকে তুই এই ঠোটপালিশ আর নখপালিশ মাইখা এল্লা সাইজা থাকিস। তোরে বেড়াইতে নিয়া যামুনি।
–আইচ্ছা।
ওদের প্রেমালাপে আর ব্যাঘাত ঘটালো না পঙ্খি। মুচকি হেঁসে সরে এলো ওখান থেকে। মনে মনে ভাবলো, ভালোবাসা বুঝি এমন মিষ্টি হয়। জীবনে ভালোবাসা টাই মূল্যবান সম্পদ। যা সবার কপালে জোটে না। আমার জীবনে হয়তো এই সুন্দর অনূভুতির জায়গা কখনোই হবে না। এই বেরঙ জীবনে কেউ রঙ ছড়াতে আসবেনা। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের রুমের দিকে যেতে লাগলো পঙ্খি। হঠাৎ দেখলো শাশুড়ী জাহানারা আঁচলের নিচে কিছু একটা লুকিয়ে নিয়ে কোথায় যেন চুপিচুপি যাচ্ছে। ব্যাপার টায় পঙ্খির কেমন সন্দেহ হলো। পঙ্খি নিজেকে আড়াল করে লুকিয়ে তাকে অনুসরণ করতে লাগলো। জাহানারা ধীরে ধীরে উপরে তিনতলায় উঠে এলো। তারপর সেই তালাবদ্ধ রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কোমড় থেকে চাবি বের করে তালা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল সে।ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলেন। পঙ্খি বিস্মিত হয়ে গেল। ওতো জানতো এই রুমে কেউ যায় না। তাহলে উনি কেন গেলেন? নানান ভাবনার গোলকধাঁধা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ওর। পঙ্খি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। প্রায় মিনিট বিশেক পর জাহানারা বেড়িয়ে এলো। আবারও তালা আটকে দিয়ে নিজের চোখ মুছতে মুছতে ফিরে এলেন তিনি। পঙ্খি লুকিয়ে সবটাই দেখলো। একবার ভাবলো শাশুড়ীকে জিজ্ঞেস করবে। পরে ভাবলো এটা ঠিক হবে না। তিনি তো দেখতেই পারেন না। কিছু জিজ্ঞেস করলে উল্টো আরও বোকাঝকা করবেন। পঙ্খি আপাতত নিজের রুমে চলে গেল। তবে মাথায় চলতে থাকলো তার ভাবনার বেড়াজাল। মনে হচ্ছে এমন কিছু আছে যা ও জানে না।
চলবে….